দেশান্তরী হওয়ার আগে পর্যন্ত ঢাকা স্টেডিয়ামে দল বেঁধে ফুটবল দেখতে যাওয়া প্রায় নিয়মিত ছিলো। তখন আবাহনী-মোহামেডানের দাপটের যুগ। ব্রাদার্স ইউনিয়নও ভালো খেলছে, কিন্তু শেষমেশ তিন নম্বর হয়ে থাকে তারা। আমি নিজে আবাহনীর সমর্থক, কিন্তু আসাদ-ফরিদী-ফারুক-দিশুর মতো মোহামেডান সমর্থকদের সঙ্গে মোহামেডান গ্যালারিতেও বসেছি প্রায়ই। সমর্থক হিসেবে অতি-উৎসাহী নই, ভালো খেলা দেখতেই যাওয়া। ফলে বৈরি সমর্থকদের সঙ্গে এক সারিতে বসেও কোনো বিপত্তি ঘটেনি।
তখন একেক সময় অদ্ভুত একটা ভাবনা মাথায় আসতো। মনে হতো, গোলমুখে কোনো স্টপারের হঠাৎ যদি বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে যায় এবং তীব্র শটে সে নিজের গোলেই বলটি পাঠিয়ে দেয়? তেমন কখনো ঘটতে দেখিনি, কিন্তু মানুষের মনোবিকলন যে কোনো মুহূর্তেই ঘটতে পারে জানি বলে ভাবনাটি মাথা থেকে তাড়ানো যায়নি। ইংরেজিতে এইরকম পরিস্থিতির বর্ণনা দেওয়া হয় 'মোমেন্টারি ল্যাপস্ অব রিজন' বলে। বাংলায় কী বলা যায়? মুহূর্তের বিভ্রান্তি বা হতবিহ্বলতা? চকিত মনোবিকলন?
এইসব মনে এলো টিভিতে এবারের বিশ্বকাপ ফাইনালে জিদান-কাণ্ড দেখে। সব দেশে এবং কালে কিছু খেলোয়াড় থাকেন যাঁরা মাঠে চট করে মেজাজ হারিয়ে ফেলেন। সত্তর-আশির দশকে ঢাকার ফুটবলে মঞ্জু, টুটুল, কালা-র পরিচিতি ছিলো মাথা-গরম খেলোয়াড় হিসেবে। এমনও বলা হতো, ভাত রান্না করার জন্যে আগুনের দরকার নেই, চাল ধুয়ে হাঁড়িটি ওদের কারো মাথায় বসিয়ে দিলে ভাত হয়ে যাবে। কেউ অবশ্য তা পরীক্ষা করে দেখেছে বলে জানা নেই। ১৯৮২ সালে এরশাদের শাসনের কালে আবাহনী-মোহামেডানের খেলায় গোলযোগের সূত্র ধরে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে, যা আগে বা পরে আর কোনোদিন ঘটেনি। আবাহনীর চার খেলোয়াড় সালাউদ্দিন, চুন্নু, আনোয়ার ও হেলালকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিলো, যেন তাঁরা কোনো দাগী অপরাধী। টুটুল তখন ব্রাদার্সের খেলোয়াড়, আবাহনীতে থাকলে গ্রেফতারের তালিকায় পঞ্চম নামটি যে টুটুলের হতো, সে বিষয়ে আমাদের কারো কোনো সংশয় ছিলো না। কিন্তু বয়সে আমার চেয়ে কিছু ছোটো হলেও টুটুলের সঙ্গে ব্যক্তিগত কিছু ঘনিষ্ঠতার সুবাদে জানি, মাঠে মাথা-গরম হিসেবে যতোই খ্যাতি-অখ্যাতি থাক, মাঠের বাইরে কথাবার্তা ও আচরণে তার মতো বিনয়ী ও নম্র ব্যবহারের মানুষ খুব বেশি হয় না। মঞ্জু সম্পর্কেও একই কথা শুনেছি।
অথচ ঢাকার মাঠে এই পরিচিত মাথা-গরমরা কিন্তু বড়ো কোনো অঘটন ঘটাননি। ঘটিয়েছিলেন এমন একজন যিনি অতি ভদ্র-সজ্জন খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ঘটনাটি অনেকেরই মনে থাকার কথা, ঢাকা স্টেডিয়ামে ৭৯-৮০ সালের দিকে সেইসময় দেশের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় মোহামেডানের এনায়েত চড়াও হয়েছিলেন রেফারি দলিল খানের ওপর। এই নিয়ে এনায়েতের শাস্তি এবং তা বাতিলের জন্যে ভক্ত-সমর্থকদের ক্ষুব্ধ মিছিলসহ প্রচুর হৈ চৈ হয়েছিলো।
জিদান ও এনায়েতের ঘটনা দুটির সাদৃশ্য এখানেই যে, এনায়েত এবং জিদান দু'জনেই এক ধরনের অন্যায় ও অনুচিত উস্কানির ফাঁদে পড়েছেন। ঢাকা স্টেডিয়ামের ঘটনার দিন মোহামেডানের প্রতিপক্ষ কোন দল ছিলো স্পষ্ট মনে নেই, খুব সম্ভব ওয়ান্ডারার্স। সেদিন গ্যালারিতে উপস্থিত থাকার সুবাদে জানি, খেলার শুরু থেকেই এনায়েতকে একাধিকবার ফাউল করা হলেও রেফারি উপেক্ষা করেছেন। এমনকি দুয়েকটি ফাউলের কারণে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের হলুদ কার্ড পাওয়ার কথা। কিন্তু ফাউলগুলি রেফারির বাঁশির স্বীকৃতি পায়নি। মৌখিক প্রতিবাদও এনায়েত করেছিলেন বলে মনে পড়ে। কিন্তু অন্যায়-অবিচার মানুষ কতোদূর সহ্য করতে পারে? খেলার মাঠে ঘর্মাক্ত শরীরে ও স্নায়ুচাপের তীব্রতায় ধৈর্যের স্থায়িত্ব আরো কম হওয়ার কথা। ফলে, যা হওয়ার তাই হলো। এনায়েতের সবল পায়ের লাথিতে ধরাশায়ী রেফারি দলিল খান। ঘটনাটি যে প্রশংসনীয় বা সমর্থনযোগ্য ছিলো না তা যে কেউ, এমনকি এনায়েত নিজেও, স্বীকার করবেন।
জিদানের ঘটনা আরো অনেক বড়ো মাপের। প্রথমত, তা ঘটলো ২০০৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে। মাঠে উপস্থিত দর্শকরা তো বটেই, সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ টিভির সামনে বসে এই কাণ্ড প্রত্যক্ষ করলেন। দ্বিতীয়ত, এটি ছিলো ফ্রান্সের মহাতারকা, এমনকি ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় জিদানের জীবনের শেষ খেলা। বিশ্বকাপের শেষে তিনি অবসর নেবেন বলে আগাম ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে হিসেবে বলতে গেলে বিশ্বকাপের নক আউট পর্যায়ে ফ্রান্সের যে কোনো খেলাই তাঁর শেষ খেলা হয়ে যেতে পারতো।
৩৪ বছর বয়স্ক জিদান আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছিলেন। কোয়লিফায়িং রাউন্ডে ফ্রান্সের অবস্থা সুবিধার যাচ্ছিলো না, বিশ্বকাপে জায়গা হয়-কি-হয় না দশা। অবসর বাতিল করে দলে ফিরলেন মহানায়ক, ফ্রান্সও বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলো। সে কৃতিত্বও জিদানকেই দিতে হবে।
এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হওয়ার আগে বা প্রাথমিক পর্যায়ে ফ্রান্স কারো গণনার মধ্যে আসেনি। ১৯৯৮-এর বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স ২০০২-এ মোটেই ভালো খেলেনি, এমনকি পুরো টুর্নামেন্টে একটি গোল পর্যন্ত করতে পারেনি। এবারের শুরুর দিকে খেলায় কোনোমতে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে যাচ্ছিলো, তখনো কেউ ভাবেনি ফ্রান্স ফাইনাল পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতা ধরে। এই অসম্ভবকে ঘটিয়ে তোলার নায়ক ছিলেন জিনেদিন জিদান। অধিনায়ক হিসেবে খেললেন অধিনায়কোচিত খেলা। খেললেন বীরের মতো, জাদু ও স্বপ্নে মেশানো ফুটবল। পেলে ও ম্যারাডোনার মতো সর্বকালের সেরাদের পাশে তাঁকে জায়গা দিতেও কারো আপত্তি হওয়ার কথা ছিলো না।
এখন প্রশ্ন উঠছে। ফাইনালে ইতালির খেলোয়াড় মাতারাৎজিকে যেভাবে আঘাত করলেন, তা জিদানের মাপের ও মর্যাদার খেলোয়াড়ের কাছে কেউ আশা করেনি। এমনকি, আমাদের প্রাক্তন 'মাথা-গরম' টুটুলের কলামেও প্রশ্ন দেখলাম, এ কি করলেন জিদান? ঘটনার সামান্য আগে মাতারাৎজি জিদানের জার্সি ধরে টানাটানি করলে জিদান প্রশ্ন করেছিলেন, 'তুমি কি আমার জার্সি নিতে চাও? তাহলে খেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।' এই পর্যন্ত জিদান ঠিক জিদানই ছিলেন। পরের সেই মহাকাণ্ডে ঈশ্বর জিদান নেহায়েত এক রক্তমাংসের মানুষ, যিনি ক্রুদ্ধ হয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য পর্যন্ত হতে পারেন। হয়তো তা মুহূর্তের ভুল, তবু তা ভুলই এবং বিশাল (ইংরেজিতে যাকে কলোসাল বলা হয়) ভুল। মাতারাৎজি নিজে স্বীকার করেছেন, জিদানকে তিনি উত্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু ঠিক কী বলেছিলেন যা জিদানকে এই পরিমাণে ক্রুদ্ধ করতে পারে, তা হয়তো কোনোদিনই জানা যাবে না। জিদান যা বলছেন তার সঙ্গে মাতারাৎজির ভাষ্য মিলছে না। ফিফার তদন্তেও এর বেশি আর কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
আমার ধারণায় মাতারাৎজি ছাড়াও আরেকজন ইতালিয় খেলোয়াড় এই ঘটনায় কিছু অপ্রত্যক্ষ ইন্ধন দিয়েছিলেন। তিনি ইতালির গোলরক্ষক বুফোঁ। ঘটনার কিছু আগে জিদানের হেড করা বলটি নিশ্চিত গোল হওয়ার কথা। অথচ বুফোঁ প্রায় অলৌকিকভাবে ফিস্ট করে বল বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এই মাপের একটি বড়ো খেলায় যখন ১-১ গোলে আটকে আছে ফলাফল এবং সময় ফুরিয়ে আসছে, তখন নিশ্চিত পাওয়া গোল না পেলে হতাশা আসা বিচিত্র কিছু নয়। মাতারাৎজি সেই কাটা ঘায়ে কিছু নুন ছিটিয়েছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই।
ইতালির শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়েও বলা যায়, জিদানের হেডে গোল হয়ে গেলে খেলার ফলাফল অন্যরকম হওয়া, এমনকি তা ফ্রান্সের পক্ষে যাওয়াও অসম্ভব ছিলো না। এরকম অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলে খেলায় ফ্রান্স পরাজিত হলেও তাদের স্বপ্নের ফাইনাল-যাত্রার গৌরব কিছুমাত্র কম হতো না। আর জিদানের জীবনের সর্বশেষ খেলায় জয় বা পরাজয়ে কিছু এসে যেতো না। তিনি বীর হিসেবেই বিবেচিত হতেন (মাতারাৎজি নিজেই বলেছেন, সোনার বলটি জিদানেরই প্রাপ্য ছিলো, কেননা তিনিই সেরা খেলোয়াড় এই বিশ্বকাপে)।
নিশ্চিত হয়ে বলা চলে, এই ধরনের বিদায় জিদানের কল্পনায় ছিলো না। জীবনের শেষ খেলায়, তা-ও বিশ্বকাপের ফাইনালে, মাঠ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার কথা কেউ ভাবে না। আরেকবার সুযোগ পেলে হয়তো চিত্রনাট্যটি নিজেই পাল্টে নিতেন জিদান। তা তো আর হওয়ার নয়। কিন্তু এই মুহূর্তের ভ্রান্তি কি সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে জিদানের অর্জন ও অবদানকে মিথ্যে করে দেবে? তাঁর মহত্ব নিমেষে নেই হয়ে যাবে? হয়তো হবে না, তাঁর সোনার বলটি ফিফা ফিরিয়ে নিলেও না। চূড়ান্ত বিচারে এক মুহূর্তের ভ্রান্তি বা বিভ্রান্তিতে সারা জীবনের শ্রেষ্ঠ ও উৎকৃষ্ট অর্জনগুলো ভুল হয়ে যায় না।
-------------------
জুলাই ২০০৬
-------------------
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment