একটি ভিডিও দেখার সুযোগ হয়েছিলো। যাকে হোম ভিডিও বলা হয়, সেই গোত্রের। কোনো চলচ্চিত্র নয়, নয় কোনো নাটক বা বিনোদনের ছবি। এটি একজন মানুষের অত্যন্ত ব্যক্তিগত আত্ম-অনুসন্ধানের সফল ও আনন্দদায়ক পরিণতির ছোট্টো দলিল। কিন্তু তারপরেও সব মিলিয়ে ভয়াবহ এক করুণ গল্পের আভাস দেয় এই ভিডিও। ঘণ্টাখানেক দৈর্ঘ্যের ভিডিওটি অবশ্য শুধু ওই পরিণতির ছবিটি দেখায়, সম্পূর্ণ গল্প বলে না। সেই অর্থে ভিডিওটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। হওয়ার কথা নয়, কেননা গল্প বলা এর উদ্দেশ্য ছিলো না। এটি একান্তই ব্যক্তিগত দলিল। পরে প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য, পেছনের গল্প এবং পরবর্তী ঘটনাবলির ভাসা ভাসা বিবরণে যা জেনেছি, তারই একটি ছবি তুলে আনার চেষ্টা করা যায়।
ভিডিওর শুরুতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্ত বাড়ির একটি টেবিলে, ডাইনিং টেবিল বলে ধারণা হয়, দুটি চেয়ারে বসে আছে দু'জন নারী। একজন বয়স্ক, চেহারায়, পোশাকে গ্রামীণ মানুষের ছাপ। কথা বলে বগুড়া শহর বা তৎসংলগ্ন অঞ্চলের ভাষায়। এই মুহূর্তে তার বয়স অনুমান করা যায় না, ধারণা করা যাবে ভিডিও দেখার পরে আনুষঙ্গিক কাহিনীটি জানা হলে। অন্যজন বয়সে তরুণী, মাথাভর্তি কোঁকড়া চুলগুলিই প্রথমে চোখে পড়ে। রং-চেহারায় পুরোপুরি বাঙালি ছাপ থাকলেও কথা বলে মার্কিনি ধাঁচের ইংরেজিতে। তার পরণের পোশাকটি অবশ্য কোনো তথ্য জানায় না, সূত্রও পাওয়া যায় না। আজকাল বাংলাদেশে শহরের অনেক মেয়েও এ ধরনের পোশাক পরে।
দুই নারী পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে। একজন মহিলা দোভাষী, যাঁকে ক্যামেরায় দেখানো হচ্ছে না, একজনের কথা সাবলীলভাবে অনুবাদ করে জানাচ্ছেন অন্যজনকে। এই কথোপকথন থেকে অবিলম্বে জানা যায়, ইংরেজি-বলা তরুণীটি ওই বয়স্কার কন্যা।
বিবরণের সুবিধার জন্যে এদের একটি করে কাল্পনিক নাম দেওয়া যাক। আমরা বয়স্কাকে আমিনা এবং তরুণীকে সামিনা নামে চিনবো। তিরিশ বছর পরে, সামিনার জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার পর, এই তাদের প্রথম সাক্ষাত। ভিডিওতে ধরা ছবিতে দেখা যায়, একজন আরেকজনকে ক্রমাগত স্পর্শ করে, অনুভব করার চেষ্টা করে। পরস্পরের অজানা অসম ভাষায় হৃদয়ের যে আর্দ্রতা-ভালোবাসার পূর্ণ প্রকাশ ঘটতে পারে না, স্পর্শে তা সঞ্চারিত হতে থাকে। বস্তুত, প্রথমবারের সাক্ষাতে আজীবনের বিচ্ছেদ ও অদেখার তৃষ্ণা আর কিছুতেই মেটে না বলে বোধ হয়।
একসময় সামিনা ক্রমাগত চোখের পানি মুছতে থাকলে তার মা বলে ওঠে, 'ওঙ্কা কর্যা চোখ মুছপার থাকলে চোখ বিষ করবি রে মা...'। অনূদিত হয়ে কথাটি মেয়ের কাছে পৌঁছুলে কান্নাচোখেই হেসে ফেলে সে, 'আমার চোখ সত্যিই ব্যথা করছে, মা'। মায়ের মাথায়, কপালে, চুলে, গালে হাত বুলিয়ে মেয়ে একবার হাসে, একবার কেঁদে ওঠে, 'এতোদিন পর সত্যি তোমার দেখা পেলাম, মা গো! এই দিনের জন্যে আমি অপেক্ষা করেছি আমার সারাটা জীবন ধরে!' মেয়ের তুলনায় মায়ের আবেগ খানিকটা নিয়ন্ত্রিত মনে হলেও তার চোখও ভিজে ওঠে।
আরো খানিকক্ষণ এই ধরনের কথোপকথন চলে। পরস্পরকে জানা হয়, স্পর্শে আনন্দ-বেদনার বিনিময় ঘটে। তারপর দেখা যায়, মা-মেয়েতে মিলে বগুড়ায় গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে। কোনোদিন-না-দেখা আমেরিকানিবাসী এই গ্রামের মেয়েটিকে প্রথমবারের মতো দেখতে মানুষ ভেঙে পড়ে। মায়ের বাড়িঘরের হতদরিদ্র (হয়তো বাংলাদেশের বিচারে অতোটা খারাপ নয়, কিন্তু মেয়েটির অনভ্যস্ত চোখে তো তাই মনে হবে!) চেহারা দেখে মেয়ে। দেখে তার গ্রামের মানুষদের। কোনোদিন না-দেখা এক ভাইকে জড়িয়ে ধরে সে কাঁদে।
ভিডিওটি মোটামুটি এইভাবে শেষ হয়। অনিবার্যভাবে প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠে আসে। এই দু'জন নারী, যারা পরস্পরের সঙ্গে রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত, একের থেকে অন্যজন আলাদা হয়ে গিয়েছিলো কীভাবে? কেন তাদের পরস্পরের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের জন্যে তিরিশ বছর অপেক্ষা করতে হলো? ভিডিওতে দু'জনের সাক্ষাতের আবেগার্দ্র মুহূর্তগুলো দেখে কৌতূহল বেড়ে উঠতে থাকে। বন্ধু দম্পতির বয়ানে কাহিনীটি জানা হয়। সেই গল্প যেমন করুণ ও হৃদয়বিদারক, তেমনি নিবিড় অনুসন্ধানী এক নারীর জয়ী হওয়ার ইতিবৃত্ত।
ভিডিও ধারণের তিরিশ বছর আগে আমিনা ছিলো গ্রামে বেড়ে ওঠা সাধারণ পরিবারের একজন সদ্য-তরুণী। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশে পনেরো-ষোলো বছর বয়সী তরুণীদের জন্যে নিরাপদ কোনো জায়গা ছিলো না। পাকিস্তানী উর্দিধারীদের হাতে পড়েছিলো আমিনা। তার সদ্য-তারুণ্যের স্বপ্ন হয়ে উঠেছিলো দুঃস্বপ্ন। যে বয়সে চারদিকের পৃথিবী রঙিন হয়ে ওঠার কথা, আমিনার জগৎ সেই সময়ে ঘিরে ফেলেছিলো এক নিকষ অন্ধকার। পরবর্তী কয়েক মাস তার বদ্ধ পৃথিবীতে কালো ছাড়া আর কোনো রং ছিলো না, যন্ত্রণা ও গ্লানি ছাড়া কোনো অনুভূতি ছিলো না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর উদ্ধার পেয়ে নিজেকে সে আবিষ্কার করে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক জায়গায়, তার নাম-ধামও সে জানে না। শুধু বুঝেছিলো, জায়গাটা নিজের গ্রাম থেকে অনেক দূরে।
একদিক থেকে হয়তো ভালোই হয়েছিলো, তখন তার ঘরে ফেরা সম্ভব ছিলো না। শরীরের ভেতরে আরেকজন মানুষের উপস্থিতির সমস্ত লক্ষণ তখন প্রকাশ্য। অচেনা জায়গাই তার জন্যে স্বস্তিকর তখন। অল্পদিন পরে একটি মেয়ে ভূমিষ্ঠ হলে শিশুটিকে রেডক্রসের লোকদের হাতে তুলে দিয়ে আমিনা ফিরে গিয়েছিলো নিজের গ্রামে। মেয়েটির জন্যে তার কোনো অনুভূতি বা ভালোবাসা তৈরি হয়নি, তাকে তো আমিনা ভালোবেসে জন্ম দেয়নি। এক পাশবিকতার ফসল হয়ে সে এসেছিলো পেটে, তার জন্যে সুন্দর অনুভূতি তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগই ছিলো না! দুঃস্বপ্ন কোনো ভালো অনুভূতি দেয় না।
এতোকিছুর পরেও মানুষের বেঁচে থাকার সহজ প্রবণতাই হয়তো আমিনাকে স্বাভাবিক মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিলো। কালক্রমে তার বিয়ে হয়, স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসারও হয়। তবু কখনো কোনো উদাস মুহূর্তে পরিত্যক্ত মেয়েটির কথা কি কখনো তার মনে হয়নি? নিশ্চয়ই হয়েছে। কিন্তু কোনোদিন কাউকে বলা যায়নি সে কথা। ভয়াবহ ও গোপন এই কাহিনী কারো সঙ্গে ভাগ করা যায় না, নিজের মনের গহীনে লুকিয়ে রাখতে হয়।
এদিকে সামিনাকে সেই শিশুকালেই রেডক্রসের লোকেরা যুদ্ধশিশু হিসেবে আমেরিকায় নিয়ে যায়। পরে একটি পরিবার তাকে দত্তক নেয়। বোধ-বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দত্তক নেওয়া পরিবারেরই একজন হিসেবে নিজেকে জেনে এসেছে সে। পরে বড়ো হয়ে একসময় জেনেছে, সে আসলে যুদ্ধশিশু। তখন থেকে তার অনুসন্ধানের শুরু। সে বুঝে যায়, পৈত্রিক পরিচয় কোনোদিনই আর উদ্ধার করা যাবে না, কিন্তু মায়ের সন্ধানে সে অক্লান্ত, একাগ্র হয়ে থাকে।
অনেক বছরের সন্ধানের পরে আমিনার নাম-ঠিকানা উদ্ধার করতে সক্ষম হয় নিজের মা হিসেবে। রেডক্রসের কাগজপত্র ঘেঁটে নিশ্চিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রনিবাসী বাংলাদেশের এক বন্ধুর মাধ্যমে সে আমিনার কাছে এই মর্মে খবর পাঠায় যে, হারিয়ে যাওয়া মেয়েটি তার সাক্ষাৎপ্রার্থী। যোগাযোগ করা হলে আমিনা এ বিষয়ে কোনো উৎসাহ দেখায় না, কোনো কথা বলতে আগ্রহী নয় সে, ব্যাপারটাকে সত্যি বলেও স্বীকার করে না।
আমিনার মৌখিক অস্বীকারের যুক্তি বোঝা দুরূহ নয়। যে সত্য এতো বছর ধরে সে আড়াল করে এসেছে, স্বামী-সন্তান-সংসারের বাস্তব পৃথিবীতে যে সত্যের কোনো অস্তিত্ব এতোদিন ছিলো না, সেই সত্য তার যাবতীয় অন্ধকার ও দুঃখস্মৃতিসহ সামনে এসে উপস্থিত হলে তাকে মেনে নেওয়া সহজ নয়। আমিনার সমস্ত পৃথিবী যে ওলটপালট হয়ে যাবে! জানাজানি হলে মানুষের কাছে মুখ দেখাবে সে কী করে? আরো কঠিন কথা, যে মেয়েকে জন্মের পরেই সে পরিত্যাগ করেছে, নিজের সন্তান বলে স্বীকৃতি দেয়নি মনে মনেও, মা হয়ে তার সামনে দাঁড়াবে কোন দাবিতে?
এই দোটানারও শেষ হয় একদিন। সামিনা আরো কয়েকবার চেষ্টা করেও আমিনার মন গলাতে পারে না। শেষমেশ সামিনা খবর পাঠায়, সে বাংলাদেশে আসছে এবং নিজে মায়ের সামনে দাঁড়াবে। তখন দেখবে, কেমন করে মা তাকে অস্বীকার করে, ফিরিয়ে দেয়!
আমিনার তখন সত্যের মুখোমুখি না হয়ে উপায় থাকে না। বুকভরা আকুতি আর চোখভরা জল নিয়ে সে ঢাকায় আসে মেয়ের সঙ্গে মিলিত হতে। তিরিশ বছর পর।
তার আগে এই সত্য স্বয়ং আমিনাকেই উন্মোচন করতে হয় স্বামীর কাছে, পুত্রের কাছে। গ্রামের প্রতিবেশীদের কাছে। আত্মীয়-পরিজনের কাছে। সে বিস্মিত হয়ে দেখে, তার আশঙ্কা সত্যি হয়নি। তার নিজের চেনা পৃথিবী উল্টে যায়নি। কেউ তাকে কোনো প্রশ্ন করেনি, অভিযোগের আঙুল তার দিকে তোলেনি, কলঙ্কের ছবিও কেউ আঁকতে বসেনি। বরং ভালোবাসা, সহানুভূতি দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। আমিনা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে, মানুষ আজও মানুষ আছে। বয়স্কদের মনে সেই সময়ের স্মৃতি এখনো খুবই জাগ্রত। সেইসব মানুষেরা জানে, মানুষের মতো দেখতে একদল অমানুষ আমিনাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলো, কিন্তু তাতে সে অপবিত্র হয়নি।
তারা আরো জানে, সামিনার জন্মের ইতিহাস তার নিজের রচিত নয়, সেই ইতিবৃত্ত রচনায় তার কোনো ভূমিকাও ছিলো না। যে লোকটি এখন আমিনার স্বামী, সামিনাকে সে কন্যার স্নেহ দিতে কার্পণ্য করে না, তার পুত্র - সমপর্কে সামিনার সৎভাই - সামিনাকে বোন বলে জড়িয়ে ধরে। দুই ভাইবোনে গলা জড়িয়ে কাঁদে।
সামিনার সঙ্গে আমিনার প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্তটিতে ভিডিওর শুরু। বেদনাময় মধুর তার পরিসমাপ্তি।
যুদ্ধ, বিপ্লব বদলে দেয় রাষ্ট্র ও সমাজ, তা নিয়ে রচিত হয় ইতিহাস। তার প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্তিমানুষের জীবন যে কীভাবে পাল্টে যায়, যুদ্ধের হিংস্র ও দয়াহীন নখর যে কী গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি করে রেখে যায় কারো কারো জীবনে, তারই এক আশ্চর্য ও অসামান্য দলিল এই ভিডিও। এই দলিল ইতিহাস বটে, তবে তা ব্যক্তিগত। কেতাবী ইতিহাস ব্যক্তিমানুষের জীবন বা তার অনুভবের কারবারী তো নয়!
Tuesday, October 23, 2007
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment