Friday, August 22, 2008

দুই মাস যখন দুই দিনে নেমে আসে

কাল তিন তিনবার ভুল রাস্তায় চলে গেলাম। আক্ষরিক অর্থেই ‘এ পথে আমি যে গেছি বারবার’ বলার মতো দুশো মাইলের পথ। ইন্টারস্টেট-৩৫ ধরে সরাসরি ড্রাইভ, কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই। তবে হাইওয়ে মাঝেমধ্যে বিভক্ত হয়ে যায় অন্য নানা ঠিকানার দিকে। ভুল হলে অন্য শহরে পৌঁছে যাওয়া, নিদেনপক্ষে একটা চক্কর খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। ডালাস থেকে অস্টিন গিয়েছি, তখন সব ঠিকঠাক। ফেরার পথে ভুল রাস্তায় গিয়ে গোলমাল, চক্কর খেতে হলো।

মেয়েটা বড়ো হয়েই গেলো, চলে যাবে পড়তে অস্টিনে। জুন মাসের মাঝামাঝি খবর জানার পর মনে হলো, দুই মাস সময় এখনো আছে । অথচ কোথা দিয়ে কীভাবে সময়টা চলে গেলো! এই দুই মাসে আমরা অনেক কথা বলবো; জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ’ কনসার্টের ডিভিডি এবং হ্যারিসনের মৃত্যুর পর তাঁর বন্ধুদের আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর জর্জ’-এর ডিভিডি কিনে রাখা আছে দীর্ঘদিন, এখনো সেলোফেন-আবৃত, কথা ছিলো একসঙ্গে বসে দেখবো। সময়গুলি কোথায় গেলো?

পরশু আমাদের চারজনের পরিবার গেলাম অস্টিনে। গতকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মেয়ের পরিচয়-পর্ব (orientation) হলো। ক্লাস শুরু হতে এক সপ্তাহ দেরি, কিন্তু আবার তাকে নিয়ে অস্টিনে আসতে হবে শনিবার, তিনদিন পর। নতুন শহরে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে সে উঠবে সেদিন, গোছগাছ করে ক্লাসের জন্যে তৈরি হওয়ার সময় পাবে দিন তিনেক।

কাল দুপুরের দিকে তার অ্যাপার্টমেন্ট দেখতে যাওয়া হলো। মেয়ে রুমমেট ঠিক করেছে এক প্যালেস্টাইনি মেয়ে ফারাহকে। ফারাহ-র বাবা গতমাসে নিজে এসে ঘুরে ঘুরে সব ঠিকঠাক করে গেছেন। ভদ্রলোকের পছন্দের ওপর কোনো কথা চলে না, অ্যাপার্টমেন্ট এবং কাছাকাছি এলাকা দেখে যে কোনো বাবা-মা নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারে। বস্তুত, সকালের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের রাস্তাঘাট-বাড়িঘর দেখে আমার একটু ফাঁপড় লাগছিলো। বেশ পুরনো, ঘিঞ্জিমতো সব, ডাউনটাউন এলাকায় যেমন হয়। তখনো সঠিক ধারণা নেই, ওদের অ্যাপার্টমেন্ট ঠিক কোথায়, কেমন জায়গা।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইল কয়েকের দূরত্বে অ্যাপার্টমেন্ট দেখে মেয়ে নিজেও মহা উচ্ছ্বসিত। নিজের প্রথম ঠিকানা বলে কথা, বাবা-মায়ের ছায়ার বাইরে তার স্বাধীনতার ঠিকানা।

ফেরার পথে মেয়েকে বলি আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল-জীবনের গল্প। নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্ট দূরের কথা, নিজের বিছানার স্বপ্ন দেখাও কঠিন সূর্যসেন হলের ৪৪৮ নম্বর কক্ষের মেঝেতে শায়িত হয়ে। প্রথম বছরের প্রায় পুরোটাই সেভাবে কেটেছিলো। চোখে অবিশ্বাস নিয়ে মেয়ে তাকিয়ে থাকে, কল্পনাশক্তিও তাকে ছবিটা দেখতে সাহায্য করে বলে মনে হয় না। না হোক, কোনো ক্ষতি নেই। তার এখন সামনে তাকানোর সময়, তাকে স্বপ্ন দেখতে হবে আগামীর, পিতামাতার অতীতের জঞ্জালে তার কোনো প্রয়োজন না থাকাই উচিত।

দীর্ঘ যাত্রায় যেমন হয়, একসময় কথা থামে। ছেলেমেয়েরা এরকম যাত্রায় সচরাচর পালা করে প্যাসেঞ্জার সীটে বসে ডি জে হয়ে গান বাজায়। এখন মেয়ে সেই ভূমিকায়, তার নিজের ও ছোটো ভাইটির পছন্দের গান বাজায়। ওদের বয়সের ব্যবধান আট বছরের, একটা সময় ছিলো তাদের মধ্যে বনিবনা প্রায় ছিলোই না – তাদের দুই পৃথিবীর দূরত্ব এতোটাই বেশি তখন। বছর দুয়েক ধরে সেটা পাল্টাতে শুরু করেছে। দুইজনে মিলে কতোসব বকবক করে, একত্রে বসে গান শোনে। মেয়ে নিজের গরজে প্রতি সপ্তাহে ভাইকে নিয়ে যায় সিনেমা দেখতে। বোনের ফিরতে দেরি হলে ছেলে ‘আপু কখন আসবে? ফোন করি?’ জিজ্ঞেস করতে থাকে। ঠিক এই সময়েই তাদের বিচ্ছিন্ন হতে হবে ভাবলে কষ্ট হয়। এই সময় কি আর তাদের জীবনে ফিরে আসবে?

সেদিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপু চলে গেলে তোমার খারাপ লাগবে?’

ছেলে নিঃশব্দে কাঁধ ঝাঁকায়, সে জানে না। হয়তো সত্যিই জানে না। তার জীবন এরকম চলে যাওয়ার ঘটনা কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। অবিলম্বে জানবে, জীবন তাকে আরো অনেক অভিজ্ঞানে অভিজ্ঞ করে তুলবে ক্রমশ। এইসব ছোটোবড়ো নানা ধরনের দুঃখ-কষ্ট থেকে কে কবে রেহাই পেয়েছে?

সিডি-তে বেজে যাওয়া গান কানে আসে, মরমে পশে না। গাড়ি চালাচ্ছি, বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি। আচমকা মনে হয়, আর মোটে কয়েকদিন পরে যখন অস্টিন থেকে ফিরবো, তখন মেয়ে পাশে বসে থাকবে না। তাকে ছেড়ে আসতে হবে তার নতুন ঠিকানায়। ভেতরটা কেন কে জানে খুব শূন্য লাগতে থাকে। খুব দূরের পথ নয়, চাইলেই যাওয়া-আসা হবে। কিন্তু তবু সে তো দূরেরই একজন হয়ে উঠবে দিনদিন। এখন বলছে, প্রতি সপ্তাহে না হলেও অন্তত দুই সপ্তাহ পরপর সে আসবে। হয়তো আসবে, কিন্তু দুই ক্রমশ তিন বা চার সপ্তাহ হয়ে যাবে, একসময় আরো আরো দীর্ঘ। জীবন এরকমই, নিজেকে দিয়েই জানি, আমার পিতামাতাও আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে এই বোধ নিয়ে চোখ মুছে গৃহকর্মে মন দিয়েছিলেন। এখন আমার পালা। যা কিছু নিয়েছি তা ফিরিয়ে দিতেই হয়।

প্রথম দুইবার ভুল পথে গিয়ে আর কেউ টের পাওয়ার আগেই চুপচাপ ফিরতে সক্ষম হই। ধরা পড়লাম শেষবার ডালাস শহরে ঢোকার পর। ছেলেমেয়ের মা টের পেয়ে যায়, ‘কী হলো তোমার?’

কী করে বলি, এই বাবাটি নিজেকে অনেক শক্ত মনের মানুষ ভাবলেও হয়তো ততোটা শক্ত সে নয়। কিন্তু আর কারো তা জানার দরকার নেই। চোখের কী দোষ? Must be the clouds in my eyes!

২১ অগাস্ট ২০০৮

Tuesday, August 12, 2008

বাঙালির সময়

‘ন’টার গাড়ি ক’টায় ছাড়ে?’ এই রসিকতাটি অথবা এর কাছাকাছি কোনো কোনো শ্লেষ-মেশানো বাক্য বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে চালু আছে দীর্ঘকাল ধরে। একদিন ঠিক সময়ে ট্রেন স্টেশনে এলে যাত্রীরা বিস্মিত, কারণ এই ট্রেনটি কখনোই সময়মতো আসে না। সত্যভাষী স্টেশনমাস্টার জানালেন, এটার আসার কথা ছিলো গতকাল। এই রসিকতাও পুরনো।

কোনো কাজ – তা ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক অথবা রাষ্ট্রীয় যা-ই হোক – যথাসময়ে সম্পন্ন হবে না, এরকমই আমাদের অভিজ্ঞতা। আমরা স্টেশনে পৌঁছিবার পূর্বেই ট্রেন ছাড়িয়া যাইবে। ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা যাইবে। ট্রেন-বাস-লঞ্চ নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে যাত্রা শুরু করবে, বিদ্যুতের বিলটি আসবে পরিশোধের নির্ধারিত তারিখ অতিক্রান্ত হওয়ার পর।

সময়জ্ঞান বা সময়ানুবর্তিতা বিষয়ে বাঙালির খুব সুনাম নেই। আর এ সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত ‘আরে, বাঙালির সময়!’ কথাটি বলার একচ্ছত্র অধিকার আমরা বাঙালিরাই নিয়ে রেখেছি। এই বাক্যটি আমরা সবাই কমবেশি কখনো না কখনো বলেছি। ঠাট্টাচ্ছলে, ক্ষোভে, নিন্দাসূচকভাবে, বিরক্তি প্রকাশের জন্যে, এমনকি নিদারুণ তিক্ততায়।

বস্তুত, নিজেদের দেশ বা জাতিগত পরিচয় নিয়ে বাঙালির মতো নিন্দাসূচক উক্তি সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনো জাতি করে না। এটিকে আত্মসমালোচনা বলে চিহ্নিত করা মুশকিল। কারণ, আত্মসমালোচনা করা হয় একটি সম্ভাব্য উত্তরণ বা সমাধানের আশা ও আগ্রহ থেকে। আমাদের ক্ষেত্রে তার কোনোরকম লক্ষণ দেখা যায় না। আমরা বলার জন্যেই বলি, সংশোধিত হওয়ার আগ্রহ আমাদের কম। এই বিষয়ে প্রত্যেকেরই যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু করণীয় আছে যা আখেরে সমষ্টির অভ্যাসে পরিণত হতে পারে, সেখানে আমরা উদাসীন থাকতে সচ্ছন্দ।

০২
দেশে তো বটেই, পরবাসে বছরের পর বছর বসবাস করেও আমরা সময় নিয়ে হেলাফেলার চর্চাটি দিব্যি চালু রেখেছি। রুটিরুজির মামলা জড়িত বলে কর্মস্থলে আমরা ঠিকই পৌঁছে যাই নির্ধারিত সময়ে, সেখানে সময়জ্ঞানটি টনটনে। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে এবং সামাজিকতায় আবার নির্ভুলভাবে বাঙালি সময় উদযাপন করি। সাতটার অনুষ্ঠান ন’টার আগে শুরু হয় না। সন্ধ্যা ছ’টায় হয়তো কিছু আমন্ত্রিত মানুষজনের আসার কথা। নিমন্ত্রিত এবং নিমন্ত্রণকারী উভয়পক্ষই জানেন তা আটটার আগে ঘটা সম্ভব নয়। নিমন্ত্রিত কেউ সময়মতো এলে দেখবেন গৃহের বাসিন্দারাই তখনো প্রস্তুত নন।

আমার নিজের একটি চরম অভিজ্ঞতার কথা বলি। কয়েক বছর আগে এক তরুণ দম্পতি তাঁদের বিবাহবার্ষিকীতে জনা পঞ্চাশেক অতিথিকে আমন্ত্রণ করেছেন বাসায়। সময় দেওয়া ছিলো সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। স্বীকার করে নিই, আমরা নিজেরাও নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হইনি। বাঙালি তো! অতিথিরা সবাই এলেন ন’টার মধ্যে। গৃহকর্তা হাসিমুখে সবাইকে অভ্যর্থনা করে বসাচ্ছেন, নরম পানীয় সরবরাহ করছেন, ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে কথা বলছেন। গৃহকর্ত্রীর দেখা নেই। কৌতূহলী মহিলাদের প্রশ্নের মুখে গৃহকর্তা জানান, গৃহিনী ওপরতলায় আছেন, তৈরি হয়ে নামবেন একটু পরে। তাঁর সুসজ্জিত হয়ে অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনাটি যখন শেষমেশ ঘটলো তখন ঘড়িতে এগারোটা। আহার-পর্ব ততোক্ষণে শেষ, গৃহকর্তা রেস্টুরেন্ট থেকে কেটার করে আনা খাবার নিজেই পরিবেশন ও তদারক করেছেন। অতিথিদের কেউ কেউ বিদায়ও নিয়েছেন।

ব্যতিক্রমের কথাও বলা দরকার। একবার এক ভদ্রলোক তাঁর মেয়ের বিয়ের ছাপানো কার্ড পাঠিয়েছেন ডাকে। নির্ধারিত দিনের এক সপ্তাহ আগে ফোন করে আমন্ত্রিতদের প্রত্যেককে বিনীতভাবে জানালেন, অনুষ্ঠানটি ঘড়ি ধরে ঠিক সময়মতো অনুষ্ঠিত হবে এবং কারো পক্ষে যথাসময়ে উপস্থিত হওয়া সম্ভব না হলে না এলেও চলবে, তাঁরা কিছু মনে করবেন না। কিন্তু অধিকাংশ অতিথি অভ্যাসবশে যথারীতি বিলম্বে উপস্থিত হয়ে গৃহকর্তার অসন্তোষের কারণ ঘটিয়েছিলেন।

আরেকটি ঘটনার কথা শুনেছি। একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিতদের বারবার বলে দেওয়া হয়েছিলো নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হতে। অনেকে অনুরোধটি রক্ষা করলেও প্রায় অর্ধেক সংখ্যক অতিথি যথার্থ বাঙালি হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন নির্ধারিত সময়ের প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে। ইতোমধ্যে আহারপর্ব শেষ হয়ে গেছে এবং গৃহকর্তা অবশিষ্ট খাবার তুলে রেখে বা ফেলে দিয়ে টেবিল পরিষ্কার করে ফেলেছেন। লেট লতিফরা এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোনো আহার্যবস্তু দেখতে না পেয়ে কিছু বিস্মিত। একজন মুখ ফুটে শেষমেশ গৃহকর্তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের একটু ফেরার তাড়া আছে, খাবার কখন দেওয়া হবে? বিরক্তি ও হতাশা চেপে রেখে গৃহকর্তা নির্বিকার মুখে জানালেন, খাওয়া-দাওয়া তো হয়ে গেছে। আপনি খাননি?

০৩
সময়ের আগেই কাজ করে ফেলা কি বাঙালির চরিত্রে নেই? আছে, নিশ্চয়ই আছে। তবে এই করিৎকর্মারা একটি বিশেষ শ্রেণীর এবং আমাদের জনসংখ্যার একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ। এঁরা বণিক শ্রেণীভুক্ত, যাঁদের আমরা ব্যবসায়ী বলে জানি, আদর-সমীহ করে বিজনেসম্যান বলি। বাংলাদেশে রোজার মাস উপলক্ষে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া একটি বাৎসরিক ঘটনা, ব্যবসায়ীরা রোজার কয়েক সপ্তাহ আগেই দাম বাড়ানোর কাজটি শুরু করেন। মানুষকে অভ্যস্ত করে নেওয়া আর কি! সরকার তখন মাথা চুলকে ভাবতে থাকে, এদের কী করে সামলানো যায়। কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া যায় না, মাথা চুলকাতে চুলকাতেই মৌসুম শেষ। ভোক্তা মানুষের পকেট কাটার কাজটি ততোদিনে সম্পন্ন হয়ে গেছে। আবার হয়তো পেট্রলের দাম বাড়লো, সেই বর্ধিত দামের পেট্রল পাম্পে আসার জন্যে অপেক্ষা করে কে? তার আগেই দাম উঠে গেলো। এই ধরনের উদাহরণ অফুরন্ত। প্রতিদিনই ঘটে বাংলাদেশে। ভুক্তভোগীরা জানেন, নতুন করে বলার অনাবশ্যক।

০৪
বাঙালির সময়জ্ঞান নেই, এই প্রচলিত ধারণার বিপরীতে অনায়াসে দাঁড়ানো যায় এবং ধারণাটি ভুল প্রমাণসাপেক্ষে উল্টোটাই প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে সময় বিষয়ে আমাদের এই ঢিলেঢালা মনোভাবটি মূলত শহরকেন্দ্রিক। অর্থাৎ, বলা চলে এটি এক ধরনের নাগরিক মনোভঙ্গি ও আচরণ। আমরা নিজেরা অপেক্ষা করতে পছন্দ করি বা না করি, অন্যকে অপেক্ষা করিয়ে রাখতে আমাদের বাধে না। কর্মস্থলে নিয়ম করে অনিয়মিত থাকি, সময়ের কাজটি ফেলে রাখি ‘থাক না পরে করলে ক্ষতি কী’ ভেবে।

অথচ বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ গ্রামের বাসিন্দা এবং তাদের পেশা প্রধানত কৃষিকাজ। কৃষকরা ‘থাক, পরে করবো’ বলে যদি তাঁদের চাষবাসের কাজগুলি সময়মতো না করতেন তাহলে কী হতো? বাংলাদেশ আক্ষরিক অর্থে ভাতে মারা পড়তো। কৃষকরা সময়মতো জমিতে হালচাষ করেন, বীজ বপন করেন, শস্যের ও জমির পরিচর্যা করেন, সেচকার্য করেন, ফসল তোলেন – সবই নিয়ম করে, নির্ধারিত সময়ে। কৃষকরা সারা বাংলাদেশের মানুষের মুখে অন্নের যোগান দিয়ে আসছেন যুগ যুগ ধরে। কখনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। উপর্যুপরি প্রাকৃতিক সংকট ও দুর্যোগ তাঁদের টলাতে পারেনি, কর্তব্যকর্ম থেকে নিবৃত্ত করেনি।

অন্যদিকে ছোটোবড়ো শহরাঞ্চলেও এক শ্রেণীর মানুষ আছেন, যাঁরা সময়ের কাজটি সময়ে সম্পন্ন করে থাকেন। শিল্প-কারখানায় কাজ করা মানুষগুলিও নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে উপস্থিত হন, কলের চাকা চালু রাখেন। এর সঙ্গে রুটি-রুজির সম্পর্ক আছে নিশ্চিত, কিন্তু চেয়ার-টেবিলে বসা শহুরে কর্মজীবীদের অধিকাংশের সঙ্গে কর্তব্যকর্ম বিষয়ে এঁদের সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে।

কৃষক-শ্রমিকরা বা শ্রমজীবী মানুষরা বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু, তাঁরা তো দেখতে পাচ্ছি সময়জ্ঞানে নাগরিক বাঙালি নন কোনো অর্থেই। সুতরাং বাঙালির সময়জ্ঞান নেই, এই ধারণার সঙ্গে আমরা একমত হবো কেন?

Wednesday, July 30, 2008

আমার কম্পুকানা প্রজন্ম

ঢাকায় এক বন্ধুকে ইমেল করেছি একটা দরকারি প্রশ্ন করে। অপেক্ষায় সপ্তাহ কেটে যায়, উত্তর আসে না। অগত্যা ফোন করি। বন্ধু ঘুমচোখে হ্যালো বলেন।

দোস্ত, তোকে একটা ইমেল পাঠিয়েছি সপ্তাহখানেক আগে। পেয়েছিস?

তাই নাকি? না রে দোস্ত, খুব ব্যস্ত ছিলাম। ইমেল খোলা হয়নি।

এটাই প্রথম বা শেষ নয়, দেশে আমার অনেক বন্ধু আছেন, যাঁদের সঙ্গে এই ধরনের কথোপকথন নিয়মিতই হয়। এঁরা কমপিউটার-বিমুখ অথবা কম্পুকানা প্রজন্মের প্রতিনিধি। এঁদের প্রায় সবারই কর্মস্থলে কমপিউটার ব্যবহার অনেকটা বাধ্যতামূলক। হয়তো নেহাত ছক-বাঁধা কাজগুলি তাঁরা করেন মোটামুটি যান্ত্রিকভাবে, নাক-চোখ-মুখ বন্ধ করে, কোনোমতে শেষ হলেই বাঁচোয়া। কারো কারো বাড়িতেও আছে, তবে তা হয় ছেলেমেয়েদের প্রয়োজনে অথবা স্রেফ শোভাবর্ধনের জন্যে।

ইমেল পাঠিয়ে কয়েকদিন অপেক্ষার পর ফোন করে ইমেল খুলতে বলাটা হাস্যকর বটে। দুঃখেরও। তাহলে আর ইমেল করা কেন? সময় নষ্ট না করে ফোনটাই করা যতো দিনকয়েক আগে।

আগেভাগেই বলে রাখি, আমি নিজে কম্পুকানাদের দলে যদিও কর্মসূত্রে সর্বক্ষণ কম্পু নাড়াচাড়া করতে হয়, ঘরেও অনেকটা সময় কম্পুতেই যায়। কিন্তু সে বিষয়ে আমার বিদ্যা বা দক্ষতা নিচের দিকে। আমার জানার পরিধি ততোটুকুই, যা হলে কোনোমতে কাজ চলে যায়। এর বাইরে আরো কিছু জানা বা শেখা দরকারি মনে হলেও সেই বাসনা নিবারণের মহৌষধ, কী দরকার! এই তো বেশ চলে যাচ্ছে।

কমপিউটারে টাইপিং স্পীড দেখে আমার দশ বছর বয়সী পুত্র হাসাহাসি করে। বলে, এই স্পীড নিয়ে তুমি কাজ করো কী করে?

আমি হাসি আর মনে মনে বলি, চুপ। একদম চুপ, কেউ যেন না শোনে!

বস্তুত আমি এমন এক প্রাচীন এবং প্রযুক্তির বিচারে অক্ষম-অসহায় প্রজন্মের মানুষ যাঁদের কমপিউটার সম্পর্কে এক ধরনের জড়তা ও ভীতি আছে। জড়তার ধরণ, ‘আমি কি পারবো? না পারলে খুব লজ্জার কথা।’ ভীতিটা হলো, ‘টেপাটিপি করতে গিয়ে যদি কম্পু নষ্ট হয়!’

অতি-সতর্কতা ও অর্থহীন ভীতি আমার প্রজন্মের অধিকাংশ মানুষকে কম্পুকানা করে রেখে দিয়েছে। এঁরা একান্ত বাধ্য না হলে কমপিউটারের আশেপাশে ক্কচিৎ-কদাচিৎ ভেড়েন, অন্যথায় সম্পূর্ণ সংস্রবহীন থাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে কমপিউটার ও আনুষঙ্গিক অনেক প্রযুক্তি আজকের পৃথিবীর বাস্তবতা এবং সেসব আমাদের জীবনধারণ ও জীবনাচরণের অংশ হয়ে গেছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তা খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করে এবং তা ব্যবহার করে অনায়াস দক্ষতায়। সমস্যা শুধু অপেক্ষাকৃত বয়স্কদের নিয়ে, যাঁরা আমার প্রজন্মের মানুষ। অথচ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কমপিউটার না জানা মানুষকে অশিক্ষিত গণ্য করা হবে বলে ধারণা করি। আমার বন্ধু ও সমবয়সীরাও তা জানেন এবং স্বীকার করেন, কিন্তু বিচিত্র উপায়ে চোখ ফিরিয়ে রাখতেও তাঁরা সক্ষম।

কম্পুতে বাংলা লেখা সম্ভব জেনে এঁদের কেউ কেউ আজও বিস্মিত হন। যাঁরা অল্পবিস্তর কম্পু ব্যবহার করেন, তাঁরা শেখার আগ্রহ দেখান। সেই আগ্রহ স্থায়ী হয় না। তাঁদের কিছুতেই বোঝাতে পারি না, আমরা যারা দুরূহ বিজয় কীবোর্ড শিখেছিলাম, সে তুলনায় আজকাল কম্পুতে বাংলা কতো সহজ হয়ে গেছে, রোমান হরফ ব্যবহার করেও বাংলা লেখা যায়।

ব্যতিক্রম দেখিনি, তা নয়। আমার এক বন্ধুর অধ্যাপক পিতা আমেরিকা এলেন বেড়াতে। ঐ স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ক্লাস করে কমপিউটার শিখে ফিরে গেলেন।

কমপিউটারে আমার কিছু আগ্রহ জন্মায় আশির দশকের শেষে। হার্ডওয়্যার-সফটওয়্যার ইত্যাদি একদম প্রাথমিক বিষয়গুলি শেখার জন্যে ক্লাস করতে গেলাম, সব মাথার ওপর দিয়ে গেলো। একজন পরামর্শ দিলেন, কমপিউটার কিনে বাড়িতে নিজে হাতেকলমে শেখা সবচেয়ে ভালো। প্রথমটা কিনলাম ৯০-এর অগাস্টে, স্পষ্ট মনে আছে। যন্ত্রটি ছিলো আইবিএম পিএস-টু, সিপিইউ-মনিটর একত্রে। আর কী ওজন তার! একটা আইবিএম প্রিন্টারসহ দাম পড়লো এক হাজার ডলার, হোক না অন্যের ব্যবহার করা পুরনো জিনিস। অপারেটিং সিস্টেম ডস, যতোদূর মনে পড়ে উইন্ডোজ তখন এসে গেছে, কিন্তু এই কমপিউটারে চলবে না। সেই শুরু আমার কম্পু-কম্পু খেলা।

আমেরিকা ও কানাডায় বসবাসকারী আমার সমবয়সী কিছু বন্ধুবান্ধব ছোটোখাটো কম্পু-প্রশ্ন নিয়ে আমাকে মাঝেমধ্যে ফোন করেন। দুরূহ কিছু হলে আমি নেই, কিন্তু এইসব প্রাথমিক স্তরের জিনিসগুলি বিষয়ে সমাধান বাতলে দিতে পারলেও আমাকে তাঁরা বিশেষ প্রতিভাবান মনে করেন। বিশ্বাসই করেন না যে আমার বা তাঁদের ছেলেমেয়েরাও এই সমাধান দিতে সম্পূর্ণ সক্ষম।

একবার এক বন্ধু তাঁর কম্পুতে একটা প্রোগ্রাম ডাউনলোড করে ইনস্টল করবেন। ফোনে তাঁকে আমি কী করতে হবে ধাপে ধাপে বলে যাচ্ছি। এক পর্যায়ে তিনি আটকে গেলেন। ভীষণ গিট্ঠু। আমি যতো সহজ করে বলার চেষ্টা করি, তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। অধৈর্য তিনি প্রায় হাল ছেড়ে দিতে উদ্যত। শেষ চেষ্টা হিসেবে তাঁকে বললাম, আপনার মেয়েকে ফোনটা ধরিয়ে দিন, সে এক মিনিটে বুঝে যাবে।

খুবই অনিচ্ছায় তিনি বিশ্বিবদ্যালয়ে-পড়ুয়া মেয়েকে ডাকলেন এবং আমার অনুমান ঠিক, মেয়ে এক মিনিটে সমাধান করে ফেললো। তার কাছে এটা ডালভাত।

বন্ধুকে বললাম, বলেছিলাম না ও ঠিক পারবে?

বন্ধু গম্ভীর গলায় জবাব দিলেন, দেখতে হবে না কার মেয়ে!

Sunday, July 27, 2008

স্বপ্ন-জাগরণের মাঝখানে

পিতৃপুরুষের গ্রামের বাড়ি দোগাছি থেকে ফোন। কান্না-জড়ানো গলায় খোকা ভাই জানালেন, দাদা এইমাত্র মারা গেলেন।

কী বলবো, কী করবো বুঝতে না পেরে হতভম্বের মতো ফোন ধরে আছি। ভাবছি, সবাইকে খবরটা কীভাবে দেওয়া উচিত। ফোনে খোকা ভাই কীসব যেন বলে যাচ্ছেন, আমার মস্তিষ্কে তার কিছুই প্রবেশ করে না। না শোক, না দুঃখবোধ – কিছুই টের পাই না। শুধু মনে হয়, দাদা মারা গেলেন!

ঘুম ভেঙে যায়। ভোর হতে এখনো ঢের বাকি। বিছানায় উঠে বসি। বুঝি, স্বপ্ন দেখছিলাম। তখনো মনে মনে ভাবছি, দাদা মারা গেলেন!

বিছানা থেকে নামি। বাথরুমে যাই ঘুমচোখে। ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার আগেও ভাবছি, দাদা মারা গেছেন।

সকালে অ্যালার্মের কর্কশ শব্দে ঘুম ভাঙলে প্রথমেই মনে আসে, দাদা মারা গেছেন।

দাঁত মাজা শেষে চোখেমুখে পানি দিয়ে ঘোর কাটে। মনে পড়ে, দাদা মারা গেছেন আজ নয়, প্রায় তিরিশ বছর আগে!

অক্টোবর ১৩, ২০০৫

Monday, July 21, 2008

একে একে নিভিছে দেউটি - এবারে কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হক


এইমাত্র পাওয়া খবর, কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হক আর নেই। কয়েক ঘণ্টা আগে আকস্মিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি চলে গেলেন।

হৃদরোগের চিকিৎসাশেষে মাহমুদুল হক মাত্র তিন-চারদিন আগে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছিলেন আপাত-সুস্থ হয়ে, নিজে পায়ে হাঁটতে সক্ষম অবস্থায়। কিন্তু জীবন কী অনিত্য!

আজকের অনেক পাঠকের কাছে মাহমুদুল হক খুব পরিচিত নন। বরাবর কম লিখতেন, ইদানিং প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন লেখালেখি। ষাটের দশকের এই দিশারী লেখকের কাছে আমরা জীবন আমার বোন, নিরাপদ তন্দ্রা-র মতো অসামান্য উপন্যাস পেয়েছি।

ভালো কোনো খবর আজকাল আর পাওয়া হয় না। কীভাবে যেন যাবতীয় দুঃসংবাদ আমার কাছে দ্রুত এসে পড়ে। ব্যক্তিগত পরিচয় মাহমুদুল হকের সঙ্গে আমার ছিলো না, তবু ব্যতিক্রম হলো না।

----------------------------------
জুলাই ২০, ২০০৮। সন্ধ্যা ৭:২০
----------------------------------

Saturday, July 19, 2008

খালের এই পাড়ে খাড়াইয়া কই…

বছর চার-পাঁচেক আগে ডালাসে বাঙালিদের একটা অনুষ্ঠানে গেছি। বিরতির সময় অডিটরিয়ামের বাইরে সবাই চা-সিঙাড়া খাচ্ছে, গল্পগুজব করছে, ধূমপায়ীরা ভবনের বাইরে নির্ধারিত এলাকায়। আমি শেষের দলভুক্ত। একসময় খেয়াল করলাম, এক ভদ্রমহিলা বাংলাদেশে ছাপা একটা রসিদবই নিয়ে সবার কাছে যাচ্ছেন চাঁদা সংগ্রহ করতে। একটু কান পেতে বোঝা গেলো, চাঁদা তোলা হচ্ছে মহিলার গ্রামের বাড়িতে মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণের জন্যে। তাঁর বাড়ি কোথায় জানি না। হতে পারে বাংলাদেশের যে কোনো গ্রামে, কথা শুনে বোঝার উপায় নেই। আশ্চর্য লাগলো, বাংলাদেশের কোন প্রত্যন্ত গ্রামে মসজিদ-মাদ্রাসা হবে, তার জন্যে চাঁদা সংগ্রহ করা হচ্ছে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে।

যথাসময়ে মহিলা আমার কাছেও এলেন। তাঁকে স্পষ্ট করে জানাই, মাদ্রাসা-মসজিদের জন্যে চাঁদা আমি দিই না।

অনিচ্ছুক কারো কাছে ঠিক এই জবাব হয়তো তিনি পাননি। ফলে, তাঁর বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখ আমাকে বেশ কয়েক মুহূর্ত নিরীক্ষণ করে। অতঃপর আর কোনো কথা না বলে (মনে মনে সম্ভবত আমার দোজখবাস সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে) তিনি পরবর্তী কোনো ধর্মপ্রাণ দয়ালুর সন্ধানে যান।

কিন্তু বাংলাদেশে এই কথাগুলি ঠিক এইভাবে আমি বলতে পারতাম? নিজের ভেতর থেকে না-সূচক উত্তরই পাই। গত ২০ বছরে বাংলাদেশে মসজিদ-মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে যতো প্রকার গোঁড়ামি ও ধর্মোন্মাদনার বিস্তার ঘটেছে, তা একজন সুস্থ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্যে যথেষ্ট আতংকের। হুমায়ূন আজাদের পরিণতি আমাদের জানা আছে। তিনি নিজেও হয়তো আক্রান্ত হওয়ার আশংকা করতেন। তবু তাঁর স্পষ্টবাদিতা অক্ষুণ্ণ থেকেছে। স্বীকার করে নিই, তাঁকে নিয়ে মুগ্ধ হতে আমার কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু তাঁর অপরিমেয় সাহস ও স্পষ্টবাদিতার ছিঁটেফোঁটাও আমার মধ্যে দেখতে পাই না।

বরং যা দেখি, তা আমাকে বিচলিত করলেও অন্য কাউকে জানতে দিই না। বিপদ চোখের সামনে দেখি না, দেখতেও হয় না, বিপদের একটা সম্ভাবনা অনুমান করা গেলেই শামুকের মতো খোলসে লুকিয়ে থাকি।

তবে আমার সাহস কম, এরকম কথা মানবো কেন? আমি ধর্মীয় উন্মাদনার বিরুদ্ধে, যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে, দেশে জলপাই শাসনের বিরুদ্ধে কি কথা বলি না? নিশ্চয়ই বলি। একশোবার বলি। কীভাবে? না, ইন্টারনেটে। ব্লগ লিখে। তাতে কারো কিছু এসে-গেলো? না যাক, আমি বিপ্লব সম্পন্ন করার পরিতৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে যেতে পারি। আত্মশ্লাঘার বোধ আমাকে একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়। আমি বোধহয় একটা কিছু করেই ফেললাম। ইন্টারনেটের বিপ্লবী না আমি!

তখন আমার এই বোধ ঘুমন্ত থাকে যে, ঘোর বিপদের সম্ভাবনা মাথায নিয়ে, গর্দানহীন হওয়ার আশংকার মধ্যেও বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে অনেকে আজও কাজ করে যাচ্ছেন, ধর্মোন্মাদনা ও রাজাকারতন্ত্রের বিপক্ষে দাঁড়ানোর হিম্মত দেখাচ্ছেন। রাষ্ট্রক্ষমতার সামরিকায়নের বিপক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নিচ্ছেন। প্রকৃত সাহসী তাঁরাই, অভিবাদন তাঁদের প্রাপ্য।

কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে যোজন দূরে আয়েশী ভঙ্গিতে ল্যাপটপে আমার নেট-নির্ভর বিপ্লব সংঘটন অব্যাহত থাকে। যা খুশি বলতে পারি আমি। আমার লেখা কেউ সেন্সর করবে না। আমার কথায় ক্ষুব্ধ হলেও হাত-পায়ের রগ কাটতে কেউ আসবে না। জলপাই-রঙা ঊর্দি মাঝরাতে আমার বাড়ি ঘেরাও করবে না। আমি নির্ভয়। সুতরাং অকুতোভয়। বিপদের সব সম্ভাবনা থেকে বিস্তর দূরে।

একটা গল্প মনে পড়ছে। এক চাষীর বউ মহাদজ্জাল। তার দাপটে চাষী কোনো কথাই মুখ ফুটে বলতে সাহস পায় না। একদিন মাঠের কাজ সেরে ক্লান্ত চাষী ঘরে ফিরে খেতে বসেছে। আয়োজন সামান্য, সামান্য শাক আর ডাল। কিন্তু ডাল একেবারে বিস্বাদ, লবণ দেওয়া হয়নি। মেজাজ খারাপ হলেও বউকে কিছু বলার উপায় নেই। চুপচাপ খায় সে। রান্না কেমন হয়েছে, বউ জানতে চাইলেও সে চুপ করে থাকে। তাকে নিরুত্তর দেখে বউ যথারীতি মুখ ছোটায়, তাকে বোবা, বেআক্কেল ইত্যাদি বলতে থাকে। কোনোমতে খাওয়া শেষ করে চাষী বাড়ির পেছনের খালের ওপারে যায়। চিৎকার করে বলতে থাকে, কাউরে না ডরাইয়া কই, খালের এই পাড়ে খাড়াইয়া কই, ডাইলে তুই লবণ দ্যাস নাই, দ্যাস নাই, দ্যাস নাই…

Thursday, July 3, 2008

ওবামার ভ্রান্তি-বিভ্রান্তি


ওবামাকে এখন কি আর দেবদূতের মতো শোনাচ্ছে? গত দিন দুয়েক ধরে শুনছি, মার্কিন ধর্মীয় মোল্লাদের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করতে উঠে-পড়ে লেগেছেন তিনি। আমেরিকার আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ওবামা। রিপাবলিকানদের ধর্মভিত্তিক ভোটে ভাগ বসানোর জন্যে নাকি এটা তাঁর কৌশল। সেজন্যে এভানজেলিস্টদের সঙ্গে ওবামা সাক্ষাৎ করছেন, চার্চে চার্চে হাজিরা দিচ্ছেন। কয়্যারের সঙ্গে মাথা দোলাচ্ছেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি আট বছর আগে – জুনিয়র বুশ নির্বাচিত হওয়ার পর। বুশ দ্বিতীয় দফা নির্বাচিত হলে এই ঔদাসীন্য রীতিমতো বৈরাগ্যে পরিণত হয়। ফলে, এবারের নির্বাচন বিষয়ে বিশেষ কান পাতিনি। টুকরো-টাকরা যা ছিটকে কানে আসে, তা মরমে পশে না। তবে ডেমোক্র্যাটদের শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা দুই প্রার্থী কিছু আগ্রহ তৈরি করার কারণ ঘটিয়েছিলেন। হিলারি ক্লিনটন বা বারাক ওবামা – এই দু’জনের যে কোনো একজন প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেলেই আমেরিকায় একটা ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে যাবে। আমেরিকার ইতিহাসে এর আগে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ বা নারী কখনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মনোনয়ন পাননি, এতোটাই পুরুষশাসিত ও বর্ণবিদ্বেষী এদের ইতিহাস।

ওবামার ডেমোক্র্যাট দলের মনোনয়ন নিশ্চিত হলে সমর্থকরা উল্লসিত হয়। ওবামা সত্যি সত্যি নতুন কিছু করবেন বলে তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে। এই প্রার্থী তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতার গুণে আমেরিকাকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হন যে তিনি পরিবর্তন আনতে সক্ষম।

তাঁর সাম্প্রতিক মোল্লা-ভজানো কথাবার্তা শুনে অনেকে এখন বিস্মিত ও অপ্রস্তুত। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই হতাশ। মার্কিন দেশে মোল্লাদের ঠিকানা রিপাবলিকান শিবির, ডেমোক্র্যাটরা কখনো তাদের আস্থা পায় না, তারা নিজেরাও মোল্লাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে গা করেনি। ডেমোক্র্যাটরা তাদের উদারপন্থা নিয়ে সন্তুষ্ট ও গর্বিত ছিলো, যদিও এ দেশে লিবারেল হওয়া এক ধরনের যন্ত্রণাবিশেষ। ওবামা উদারপন্থীদের সেই অহংকারের জায়গাটুকুও বিসর্জন দিতে প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে। বারাক হুসেন ওবামা যে মুসলমান নন, বরং একজন নিবেদিত খ্রীষ্ট ধর্মানুসারী – তা প্রমাণ করার জন্যে মনে হয় রিপাবলিকানদের চেয়ে বড়ো রিপাবলিকান হতেও তিনি সম্মত।

শুধু নির্বাচনী কৌশল হলেও পরিণামে এটা উদারপন্থীদের জন্যে ক্ষতির কারণ ঘটাবে বলে অনায়াসে অনুমান করা চলে। পৃথিবী জুড়ে আর কতো মার খাবে উদারপন্থীরা? দম বন্ধ হয়ে আসছে যে!

Saturday, June 28, 2008

ঈদ সংখ্যার উপন্যাস : পাঠক-ঠকানোর বার্ষিক পার্বণ

কোনো পত্রিকা যদি পাঁচখানি ‘পূর্ণাঙ্গ’ উপন্যাস ছাপলো, প্রতিযোগী ছাপলো সাতখানি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস। তার পরে ‘পূর্ণাঙ্গ’ উপন্যাসের ঢল নামল। এখন সহজেই অনুমেয় এইসব উপন্যাসের পূর্ণাঙ্গতা নামে মাত্র, খুব বেশী হবে তো ৪/৫ ফর্মা। তার পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় আরও ২/৩ ফর্মা বাড়ানো …। ফলে দাঁড়ালো এসব না ছোটগল্প না উপন্যাস। এরা রক্তপায়ী জোঁকের মতো স্ফীতোদর একটা প্রাণী। এতে না আছে ছোটগল্পের সূক্ষ্ম কলা-কৌশল, না আছে উপন্যাসের জীবন বিস্তার, আছে স্ফীতোদর ব্যবসায়িকতা। এ শ্রেণীর দায়িত্বহীন রচনার মতো সহজ কাজ আর নেই।

মনে হতে পারে, ওপরের উদ্ধৃতিটি বাংলাদেশের পত্রিকাগুলিতে উপন্যাস প্রকাশের সাম্প্রতিক প্রবণতা সম্পর্কে লেখা । অথচ সত্য এই যে, বাক্যগুলি লেখা হয়েছিলো আজ থেকে ৭২ বছর আগে, ১৯৩৬ সালে। প্রমথনাথ বিশী লিখেছিলেন ‘ছোটগল্পের আত্মহত্যা’ প্রবন্ধে। অথচ কী আশ্চর্য, একটি অক্ষরও অদল-বদল না করে এই কথাগুলি আজও বাংলাদেশের উপন্যাসের বেলায় সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

কলকাতার শারদীয় দেশ-আনন্দবাজারের আদলে বাংলাদেশে ঈদ উপলক্ষে বার্ষিক সাহিত্য-সম্ভার নিয়ে উপস্থিত হওয়ার প্রচলন প্রথম করে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’, যতোদূর মনে পড়ে, আশির দশকের শুরুতে। এর অনেক আগে থেকেই অবশ্য ‘বেগম’-এর ঈদসংখ্যা বেরোতো, সাহিত্যমূল্যের বিচারে তার মান উল্লেখ করার মতো কিছু ছিলো না। ‘বিচিত্রা’-র পর ঈদ সংখ্যা প্রকাশ শুরু করে ‘সচিত্র সন্ধানী’ ও ‘রোববার’। শুরুর দিকে বেশ কিছু উৎকৃষ্ট উপন্যাস পাওয়া গিয়েছিলো এই ঈদ সংখ্যাগুলিতে। এরপর অন্য সাপ্তাহিকগুলি এবং কয়েকটি দৈনিকও ঈদ সংখ্যা প্রকাশ শুরু করে। এখন তো ঈদ সংখ্যা মহামারীর আকার ধারণ করেছে।

মহামারী কথাটা বলা নিতান্ত অনিচ্ছায়। ঈদ সংখ্যার নামে যা পাওয়া যাচ্ছে, পাঠককে যা ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে – তারই পরিপ্রেক্ষিতে। ছোটোখাটো পত্রিকাগুলিকে আপাতত সরিয়ে রাখি। বড়ো ও নামী সাপ্তাহিক ও দৈনিকগুলির ঈদ সংখ্যার গড় পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫০০। এই পরিসরে গড়ে ১০ থেকে ১২টি উপন্যাস থাকে। আর থাকে ১০-১২টি করে গল্প, স্মৃতিকথা/আত্মজীবনীমূলক রচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, একগুচ্ছ করে কবিতা, একটি-দুটি অনুবাদ রচনা, চলচ্চিত্র-ক্রীড়া-নাটক-টিভি-সঙ্গীত ইত্যাদি বিষয়ে রচনা, ঈদের ফ্যাশন এবং রান্নার রেসিপি ও মেয়েদের সাজসজ্জা বিষয়ে কয়েক পাতা করে বরাদ্দ।

দেশ-আনন্দবাজারে শারদীয় সংখ্যাগুলি যেখানে মূলত সাহিত্যমুখী, আমাদের ঈদ সংখ্যার চরিত্র কিন্তু পত্রিকার সাধারণ সংখ্যারই বর্ধিত রূপ। ব্যতিক্রম বলতে শুধু উপন্যাস, যা সাধারণ সংখ্যায় থাকে না। ঈদ উপলক্ষে উপন্যাস থাকে বেশুমার। সবগুলি পত্রিকা দেখিনি, তবে গত কয়েক বছরে আমার দেখা ঈদ সংখ্যাগুলির মধ্যে একটিতে উপন্যাসের সর্বোচ্চ সংখ্যা দেখেছি ১৬টি।

কিন্তু উপন্যাস নামে যা পাওয়া হয়, তা আসলে কী বস্তু? একটি ঈদ সংখ্যার মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা যদি ৫০০ ধরে নিই, সেই হিসেবে বিজ্ঞাপনসহ অন্য সবকিছু বাদ দিলেও ১৬টি উপন্যাসের একেকটির জন্যে সোয়া ৩১ পৃষ্ঠা বরাদ্দ করা সম্ভব। কিন্তু শুধু উপন্যাস দিয়ে পত্রিকার পেট ভরে না!

নাসিরউদ্দিন হোজ্জার গল্প মনে পড়ে। হোজ্জা একদিন আধাসের মাংস কিনে এনে বউকে রান্না করতে বলে বাইরে গেছে। বউ রান্না শেষ করেছে, এমন সময় তার বোন বেড়াতে এলে ওই মাংস দিয়েই সে আতিথেয়তা সারে। হোজ্জা খেতে বসে দেখে মাংস নেই। বউ কৈফিয়ত দিয়ে বললো, পাজি বেড়ালটা সব মাংস খেয়ে গেছে। হোজ্জা তৎক্ষণাৎ উঠে বেড়ালটাকে ধরে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে দেখে, ওজন ঠিক আধ সের। হোজ্জার প্রশ্ন, এই যদি বেড়াল হয় তাহলে মাংস কোথায় গেলো? আর এটা যদি মাংস হয়, বেড়ালটা কোথায়?

ঈদ সংখ্যা দেখে আমাদের তখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, এই যদি পত্রিকা হয় তাহলে উপন্যাস কোথায়? আর এগুলি যদি উপন্যাস হবে, পত্রিকা থাকলো কোথায়? এতোসব জিনিস শ’ পাঁচেক পৃষ্ঠার ভেতরে হাঁসফাঁস করতে থাকে এবং সবচেয়ে বেশি ভোগে উপন্যাস। কারণ, চরিত্রগতভাবেই এই জিনিস কিছু বেশি জায়গা দাবি করে। কাহিনীর বিন্যাস ও বিস্তার, চরিত্রসমূহের বিকাশ ইত্যাদি মিলিয়ে বাড়তি পরিসর দরকার হয়।

উপন্যাসের আকার-আকৃতি কী হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে পুরনো আলোচনায় যাওয়ার দরকার নেই। এ যুগে War and Peace আকারের উপন্যাস লিখিত হওয়ার সম্ভাবনা বলতে গেলে শূন্য। এর বিপরীতে The Old Man and the Sea-এর ক্ষুদ্রায়তনও বহুল আলোচিত। বাংলা ভাষায় রচিত ‘ঘুণপোকা’ কি পূর্ণ উপন্যাস নয়? আসলে একটি উপন্যাসের উপন্যাস হয়ে ওঠা তার আকার-আকৃতির ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে বিষয়বস্তু ও কাহিনী, লেখকের বক্তব্য ও দর্শন এবং রচনাকৌশলের ওপর। তবে এটাও মানতে হবে যে, ছোটোগল্পে ঘটনা ও চরিত্র রচনায় আঁচড় কেটে যাওয়ার সুযোগ থাকে, উপন্যাস তা অনুমোদন করে না। উপন্যাসে বিস্তারের কাজটা আবশ্যিক, পারম্পর্য রক্ষাও। যথাযথ পরিসর উপন্যাসের জন্যে প্রাথমিক শর্ত।

মুশকিল হলো, আমাদের পত্রিকাগুলি এই পরিসর অনুমোদন করতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক অথবা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ বোধহীন ও কাণ্ডজ্ঞানরহিত। তাদের লক্ষ্য ‘উপন্যাসের’ সংখ্যা বাড়ানো, উপন্যাস হলো কি না, লেখক লিখে তৃপ্ত হলেন কি না, পাঠককে উপন্যাসের নামে বড়োগল্প বা ছোটোগল্প দিয়ে প্রতারণা করা হলো কি না – এসব তাদের বিবেচ্য বলে মনে করা কঠিন। ম্যাগাজিন আকারের ঈদ সংখ্যায় একটি ‘উপন্যাস’ দেখেছি ৭ পৃষ্ঠায় শেষ! স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। অথচ একটি ছোটোগল্প লিখতেও এই পরিসর প্রয়োজন হতে পারে। রচনার গুণমানের কথা না হয় পরে, কিন্তু উপন্যাসের নামে এটাকে ইয়ার্কি ছাড়া আর কী বলা যায় আমার জানা নেই।

বাংলাদেশে হাতে গোনা যে কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা আছে, তাদের প্রভাব সামান্যই। যেহেতু প্রচার ও পাঠক সীমিত। পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিজ্ঞাপনদাতারা এসব পত্রিকার বিষয়ে উৎসাহী নয়। ফলে, বহুকাল ধরে আমাদের সাহিত্য মূলত দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য/সাময়িকী পাতাকেন্দ্রিক হয়ে আছে। দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে দৈনিক কাগজগুলি তাদের সাময়িকী পাতার বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী বলে মনে হয় না, যেনতেন প্রকারে পাতা ভরানোর দায়িত্বটাই তারা পালন করে। সাপ্তাহিক কাগজগুলির অধিকাংশই তাদের নিয়মিত সংখ্যায় সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে না। ধারাবাহিক উপন্যাস দূরের কথা, একটি-দুটি গল্প-কবিতাও তাদের পাতায় জায়গা পায় না। অথচ ঈদ মৌসুমে তাদের সাহিত্যপ্রেম উথলে ওঠে, প্রতিযোগিতা হয় কে কতোগুলি ‘উপন্যাস’ ছাপতে পারে!

এককালে যখন হিন্দুরা মুরগি খেতো না, তখন মুসলমানের মুরগিপ্রেম বলে একটা রসিকতা চালু ছিলো। বলা হতো, মুসলমানরা খুব যত্ন করে মুরগি পোষে, তবে সময় ও সুযোগ বুঝে জবাই করে খেয়েও ফেলে। আমাদের পত্রিকাওয়ালাদের ঈদকেন্দ্রিক সাহিত্যপ্রেমও যে আসলে ঐ মুসলমানের মুরগিপ্রেমের সমতুল্য, তার প্রমাণ ঈদ সংখ্যাগুলির পাতায় পাতায়। প্রয়োজনে ঐ ক্ষুদ্রাকার ‘উপন্যাসের’ হাত-পা-নাক-কান বা লেজ কেটে বরাদ্দ করা নির্দিষ্ট আকারের মধ্যে আঁটাতে হবে। যতোদূর জানি, এইসব কাটছাঁটের বেলায় লেখককে জানানোর সৌজন্যও দেখানো হয় না। ভাবটা এমন যে, লেখা ছেপে পত্রিকাগুলি লেখকদের ধন্য করে দিচ্ছে। অথচ বিষয়টা হওয়া উচিত পারস্পরিক প্রয়োজন ও সম্মানের।

এই কাটছাঁট মামলার আমি নিজে এর ভুক্তভোগী , এবং আমিই একমাত্র নই। শওকত আলী বা সৈয়দ শামসুল হকের মতো লেখকদের বেলায় এটা ঘটে না অবশ্য। তবে আমি নিশ্চিত, তাঁদেরও ‘সাইজ’ মনে রেখেই লিখতে হয়। হুমায়ূন আহমেদ বা ইমদাদুল হক মিলনরা অবশ্য এই সাইজের ‘উপন্যাসের’ মূল প্রবর্তক, সুতরাং তাঁরা নিয়ম চালু রাখেন। আনিসুল হকরাও এই প্রথার ইচ্ছুক অনুগামী। বিপদ হয় অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ও নবীন লেখকদের এবং তাঁরাই নির্বিচারে বলির শিকার হয়ে থাকেন।

সর্বগ্রাসী বাণিজ্যমুখীনতার মুখে টিকে থাকতে হলে পত্রিকাগুলিকে নিশ্চয়ই বিক্রি এবং বিজ্ঞাপন নিতে হবে, সেগুলির ওপর নির্ভর করতেও হবে। কিন্তু লাগামছাড়া মুনাফার লোভে পড়ে নামী ও প্রতিষ্ঠিত পত্রিকারাও ঈদ সংখ্যায় ১২-১৪টি করে ‘উপন্যাস’ ছাপার প্রতিযোগিতায় নামলে তা শুধু হতাশার কারণ ঘটায়। আরেকটি বিস্ময়কর ঘটনা শুনেছি। আজকাল ঈদ সংখ্যা উপন্যাসগুলির প্রতি পাতার মাঝখানে ছোটো করে বিজ্ঞাপন থাকে, অনেক পত্রিকায় সেগুলি নাকি বিজ্ঞাপনদাতারা বরাদ্দ করেন লেখকের নাম-পরিচিতি দেখে। অর্থাৎ, এই লেখাগুলিও আসলে স্পনসর করা। কিন্তু স্বল্প-পরিচিত ও নবীন লেখকদের কে স্পনসর করবে?

প্রচলিত ও প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া এই রীতির ফলে বোদ্ধা পাঠকরা মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন, ঈদ সংখ্যার ‘উপন্যাস’ পড়ার আগ্রহ তাঁদের অন্তর্হিত হয়েছে অনেক আগেই। আর ‘গল্পের বই’ পড়া আর সব গড় পাঠকদের ধারণা জন্মাচ্ছে, এই বুঝি উপন্যাস! নিশ্চয়ই কারো কারো মনে এই প্রশ্নও উঠবে, তাহলে গল্প কাকে বলে!

উপন্যাসের তাহলে কী হবে? এখন একজন লেখক যদি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লিখতে চান, লেখাটি তিনি ছাপবেন কোথায়? ঈদ সংখ্যার অবস্থা তো জানাই হলো। কোনো পত্রিকার নিয়মিত সংখ্যায় উপন্যাস লেখার সুযোগ নেই। আমার জানামতে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের দুটি মাত্র পত্রিকা ধারাবাহিক উপন্যাস ছাপছে। মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘কালি ও কলম’ একই সঙ্গে দুটি ধারাবাহিক ছাপে – কে জানে কী কারণে তার একটি আবশ্যিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের লেখকের হয়ে থাকে। আর মাসিক পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাসে কারো আগ্রহ কীভাবে টিকে থাকে আমার জানা নেই। ‘দৈনিক সংবাদ’ হলো দ্বিতীয় পত্রিকাটি যেখানে সাময়িকী পাতায় ধারাবাহিক উপন্যাস ছাপা হচ্ছে। আগেই বলেছি, সাপ্তাহিকগুলি যেখানে তাদের নিয়মিত সংখ্যায় গল্প-কবিতাও ছাপে না, ধারাবাহিক উপন্যাসের আশা তাদের কাছে না করাই যুক্তিসঙ্গত। তাহলে? লেখক যাবেন কোথায়?

লেখার উদ্দেশ্যই হলো তা উদ্দিষ্ট পাঠকের কাছে পৌঁছানো। প্রকাশিত না হলে পাঠকের কাছে তা কী উপায়ে যাবে? প্রতিষ্ঠিত লেখক হলে সরাসরি প্রকাশকের কাছে চলে যেতে পারেন গ্রন্থাকারে বের করার জন্যে, নবীন লেখকের সেই বিলাসিতা নেই। লিখবো, কিন্তু তা কোথাও ছাপার উপায় নেই – তাহলে লেখক তাঁর উপন্যাসটি (পত্রিকার শূন্যস্থান পূরণের ‘উপন্যাস’ নয়) লেখার আগ্রহ কোথা থেকে পাবেন? উত্তর নেই। পত্রিকানির্ভর উপন্যাসের জন্যে কোথাও কোনো আলোর রেখাও নেই।

Saturday, June 21, 2008

মেয়েটা চলে যাবে!

দুপুরে একটা মিটিং আছে, তার আগে লাঞ্চ সেরে নেওয়ার কথা ভাবছি। এই সময় মেয়ের ফোন। উত্তেজিত কণ্ঠ তার।

বাবা, ইউটি অস্টিন আমাকে অ্যাকসেপ্ট করেছে।

তার আবেগ-উত্তেজনার অংশীদার আমিও। বলি, তাহলে তো একটা উৎসব করে উদযাপন করতে হয়।

আবেগে মেয়ের গলা বুজে আসছে। কোনোমতে বলে, আমি এতো খুশি! আমি কাঁদছি।

কোনোকিছুতে সম্পূর্ণ একাগ্রতা অথবা যুক্তিরহিত গোঁয়ার্তুমির সফল পরিণতি ঘটলে এরকম আবেগ চলে আসার কথা। মেয়ের ইচ্ছে, সে সাংবাদিকতা পড়বে। University of Texas at Austin-এর এ বিষয়ে সুনাম আছে। সেখানে সে আবেদন করে বসে থাকলো। কোনো কারণে এখানে তার ভর্তির ব্যবস্থা না হলে একটা বিকল্প থাকা যে দরকার, তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হলো। সে কানেও তোলে না। এক কথা তার, অস্টিনেই যাবো আমি। এই বোকা মেয়েকে নিয়ে করি কী! বিকল্প কিছু সে ভাবলোই না। ইউটি অস্টিনে আবেদন করার পর সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত সারাক্ষণ সে অনলাইনে তার আবেদনের ফলাফল এলো কি না দেখে। শেষ পর্যন্ত খবর পাওয়া গেলো গতকাল, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হিসেবে সে গৃহীত হয়েছে।

মেয়ের বাবা-মা হিসেবে আমরাও যে যথেষ্ট বোকা, তা এখানকার পরিচিত বাঙালিদের অনেকেই বিশ্বাস করেন। নিজে থেকে বলার দরকার হয় না, সামাজিক সাক্ষাতে প্রশ্ন শুনতে হয়, মেয়ে কী পড়বে? সাংবাদিকতা কেন, কমপিউটার বিজ্ঞান বা ব্যবসা প্রশাসন, নিদেনপক্ষে হিসাব বিজ্ঞান কেন নয় – এরকম পরোক্ষ হতাশা প্রকাশ করেন অনেকে। কেউ কেউ এমনও ইঙ্গিত দেন, বাবা-মা হিসেবে আমাদের উচিত এ বিষয়ে তাকে নির্দেশনা দেওয়া।

ক্যালিফোর্নিয়াবাসী এক কবিবন্ধু মেয়ের সাংবাদিকতা পড়ার আগ্রহ জেনে ঠাট্টা করে বলে, নাপতালিটা তুমিই করলে? তোমার লেখালেখির আগ্রহটা ওর মধ্যে দেখতে চাও, তুমিই ওকে উৎসাহ দিয়েছো।

কী করে বোঝাবো, সে নিজে তার জীবন যাপন করবে, আমরা নই। তার প্রবণতা ও আগ্রহের অনুগামী হবে সে, যে সুযোগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের বাবা-মা আমাদের দিতে চাননি, আমরা পাইনি। এই বিজ্ঞ শুভার্থীদের জানানোর দরকার মনে করি না যে, কথা ফোটার বয়স থেকে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের মতামত সবসময় মান্য না করলেও জিজ্ঞেস করার ব্যবস্থাটা চালু রেখেছি। এমনকি প্রতি বেলার খাবার কী চায়, তা-ও তাদের মর্জি অনুযায়ী হয় সাধারণত, তাদের কখনো বলা হয়নি, টেবিলে যা আছে তাই চুপচাপ খেতে হবে। আমাদের আত্মীয়-বন্ধুসহ অনেকে এটাকে বাড়াবাড়ি রকমের আদিখ্যেতা বলে মনে করেছেন, এখনো করেন।

এর বিপরীতে আমার অভিজ্ঞতা এরকম যে, সব বিষয়ে তাদের মত জানতে চাওয়া এবং তাদের মনোভাবকে মূল্য দেওয়ার একটা অসাধারণ ও অমূল্য প্রতিক্রিয়া ঘটে। তারা আত্মবিশ্বাসী হতে শেখে এবং তার প্রতিফলন ঘটে তাদের ব্যক্তিত্বে। তারা বুঝতে শেখে, তাদের আস্থায় নেওয়া হচ্ছে এবং সেই আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতি অনুগত হওয়াটাই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। বয়স যা-ই হোক, ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি সব মানুষকেই শুদ্ধ হতে সাহায্য করে।

এ দেশে টিন-এজারদের নিয়ে সব বাবা-মাকেই কিছু সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। অনভিজ্ঞতা ও অজ্ঞানতাজনিত এবং বয়সোচিত ছোটোখাটো দুয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে এই আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত মেয়ে আমাদের কিছুমাত্র হতাশ করেনি দেখে মনে হয়, ছেলেমেয়েদের বিষয়ে বোধহয় আমরা ভুল কিছু করিনি। মেয়ে বৃহত্তর পৃথিবীর জন্যে প্রস্তুত বলে বিশ্বাস করতে ভরসা পাই।

কবিবন্ধুকে বলা হয়নি, এই মেয়ে পনেরো বছর বয়সে One Hundred Years of Solitude, Chronicle of a Death Foretold, No One Writes to the Colonel পড়ে মার্কেজকে প্রিয় লেখকের তালিকায় তুলে ফেলেছে। কাফকার লেখা ও জীবন তার কাছে বিস্ময়ের আধার। ঝুম্পার The Namesake-এ সে নিজের সংকটের সাযুজ্য পেয়ে যায়। নিজের মতো লেখালেখিও করে, যদিও কাউকে দেখাতে অনিচ্ছুক সে। তার কিছু কিছু নজরে এলে মনে মনে স্বীকার করে নিয়েছি, ঐ বয়সে ওরকম উপলব্ধির বা লেখার ক্ষমতা আমার হয়নি। গত বছর তার একটি লেখার নমুনা সচলে তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি।

আসলে সে নিজেই নিজেকে তৈরি করেছে। বাবা-মা হিসেবে আমরা সেখানে শুধু সঙ্গত করে গেছি।

মেয়ে তার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে, এই প্রাথমিক আনন্দের আতিশয্য কেটে গেলে এক ধরনের বিষাদের মেঘ মাথার ভেতরে ঘন হয়ে উঠতে থাকে। মনে হয়, মেয়েটা চলে যাবে!

বেশি দূরে সে যাচ্ছে না, মাত্র দুশো মাইলের দূরত্বে। যাওয়া-আসা নিয়মিতই হবে। তবু এ-ও তো সত্যি, এই যে তার বাইরের পৃথিবীতে যাত্রা শুরু হলো, সে আর আমাদের কাছে ফিরবে না। একদা আমরাও আমাদের বাবা-মায়ের পরিচিত ছায়া থেকে বহির্গত হয়ে গিয়েছিলাম। আর ফেরা হয়নি। হয় না। আমাদের মেয়েরও সেই যাত্রা শুরু হবে এখন থেকে ঠিক দু’মাস পর।

মনে মনে রড স্টুয়ার্টের একটি গানের দুটি পঙক্তি আওড়াই (খুব ছোটোবেলায় এই গানটি মেয়ের প্রিয় ছিলো):

When you finally fly away
I’d be hoping that I’ve served you well
For all the wisdom of a lifetime
No one can ever tell…

Tuesday, June 17, 2008

‘পৌরুষ’ : একটি উপন্যাস ও তা নিয়ে সব কেচ্ছাকাহিনী

ঢাকা থেকে এক লেখক বন্ধু ফোনে বললো, দোস্ত, এবারে ঈদ সংখ্যার জন্যে গোটাচারেক উপন্যাস লিখে পাঠা, ছাপার দায়িত্ব আমার।

আমি বলি, পাগল নাকি? বড়োজোর একটা লেখার চেষ্টা করতে পারি।

আমার এই বন্ধু লেখার জন্যে চার হাত-পায়ের সবগুলিই ব্যবহার করে, নাহলে এতো বিস্তর লেখা তার পক্ষে সম্ভব কী করে বুঝে পাই না। চাইলেই মাসখানেকেরর মধ্যে চার-পাঁচটা উপন্যাস আমার পক্ষে লেখা সম্ভব, এই আস্থার জবাবে তাকে আস্তে করে বলি, দোস্ত, আমি তো তুই না!

এই ঘটনা ২০০৪ সালের। কষ্টেশিষ্টে একটা লেখা দাঁড় করানো গেলো। প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হচ্ছিলো, লেখার আকার যেন খুব বড়ো না হয়ে যায়। জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো, বেশি বড়ো হয়ে গেলে পত্রিকাওয়ালারা ছাপতে চায় না। বিজয়ের ১৪ পয়েন্ট সুতন্বী ফন্টে লেখাটা শেষ হলো ৬৭ পাতায়। যথাসময়ে পাঠানো হলো। ছাপা হলো সাপ্তাহিক ২০০০-এ। না, যেহেতু বড়ো লেখক নই, লেখাটি মূল ঈদ সংখ্যায় জায়গা পায়নি। ঐ পত্রিকা যে বাচ্চা ঈদোত্তর সংখ্যা বের করে ‘ঈদ সংখ্যা ২’ নামে, সেখানে ছাপা হয়েছে। তবু তো হলো!

মুদ্রিত পত্রিকার কপি হাতে এলে উল্টেপাল্টে দেখলাম। ধ্রুব এষ-এর ইলাস্ট্রেশন ভালো লাগলো। নিজের লেখা ছাপা হওয়ার পর পড়ার উৎসাহ এমনিতেই হয় না, তখন অন্য ব্যস্ততাও ছিলো বলে খুব একটা মনোযোগ দেওয়া হয়নি। একদিন পত্রিকার ঐ সংখ্যাটির পাতা ওল্টাতে গিয়ে চোখ আটকে গেলো এক জায়গায় – একটি পরিচ্ছেদ দেখছি মোট আট-দশ লাইনের। এতো ছোটো কোনো পরিচ্ছেদ লিখেছি বলে মনে পড়ে না তো! এখন আর না পড়ে উপায় নেই।

সংক্ষেপে বলি সেই হতভাগ্য লেখার পরিণতি। কোনোরকম যুক্তি-টুক্তির বালাই নেই, যত্রতত্র লাইনের পর লাইন নেই হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও বাক্য বা ঘটনার পরম্পরা খোঁজার চেষ্টা বৃথা। পুরো লেখাটি মিলিয়ে দেখা গেলো, ৬৭ পাতার মধ্যে ১৮ পাতা স্রেফ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এক-চতুর্থাংশই নেই। যে উপন্যাসের নাম ‘পৌরুষ’ তার এক-চতুর্থাংশ ছেঁটে দিলে আর কী থাকে – এই ধরনের রসিকতা করে সান্ত্বনা পাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই তখন।

বন্ধু খোঁজ করে সাপ্তাহিক ২০০০-এর একটা কৈফিয়ত আদায় করে আনলো যার সারকথা হলো, প্রুফ রীডাররা নাকি এইসব কাটাকুটি করেছে।

বটে! পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব এখন তাহলে প্রুফ রীডারদের হাতে চলে গেছে! প্রুফ রীডাররা সম্পাদক হতে পারবেন না এমন কোনো কথা নেই। বাংলাদেশেই প্রুফ রীডার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক হওয়া এবং প্রেস ইনসটিটিউটের মহাপরিচালক হওয়ার দুটি ঘটনা আমাদের জানা আছে। কিন্তু সম্পাদকের বর্তমানে প্রুফ রীডাররা সম্পাদনার কাজ করছেন, ভাবা যায়!

আসলে বাজে অজুহাত, দোষ প্রুফ রীডারদের নয়। মন খারাপ করা ছাড়া আর কী করা যায়!

এই লেখাটি নিয়ে যা ঘটেছে তার সঙ্গে সম্পাদনারও কোনো সম্পর্ক নেই। আমার লেখার একটি শব্দ বা বাক্যও পরিবর্তন করা হয়নি। বিষয়টি স্থান সংকুলানের। যখন একটি ঈদ সংখ্যায় ১৫/১৬টি 'সম্পূর্ণ উপন্যাস'-এর জায়গা করতে হয়, তখন সব লেখাগুলিকে দরকারমতো 'সাইজ' না করে উপায় থাকে না। আমার লেখাটিকে 'বরাদ্দ' করা নির্দিষ্টসংখ্যক পাতায় আঁটাতে গিয়ে কেটেছেঁটে দেওয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আমিই একমাত্র নই, আরো অনেকের বেলায় একই ঘটনা ঘটেছে।

গত বছর এপ্রিলে, ব্লগিং-এ তখন আমি নতুন, সামহোয়্যারে লেখালেখি করি, হঠাৎ মনে হলো ব্লগে উপন্যাসটা ধারাবাহিক পোস্ট করলে কেমন হয়? দুয়েকজনকে দেখেছি ধারাবাহিক উপন্যাস শুরু করেছেন, দু’তিন পর্বের পর তা আর এগোয়নি। আমার সে ভয় নেই, পুরোটাই তৈরি আছে। ব্লগে বেশি বড়ো লেখা পড়ার ধৈর্য কারো নেই, সুতরাং ৮০০ থেকে ৯০০ শব্দের ছোটো ছোটো কিস্তিতে ভাগ করা গেলো। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় দুটি করে কিস্তি পোস্ট দিয়ে মোট ৩৮ কিস্তিতে শেষ হয়েছিলো। সঠিক জানা নেই, তবে পুরনো ও অভিজ্ঞ দুয়েকজন ব্লগার জানিয়েছিলেন, বাংলা ব্লগে এটাই সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ হওয়া উপন্যাস।

লেখাটিতে সম্প্রসারণের প্রয়োজন এবং জায়গা দুই-ই ছিলো, এখনো আছে। ব্লগে পোস্ট করার উদ্দেশ্য ছিলো, পাঠক-প্রতিক্রিয়া যাচাই করা। মুদ্রিত পত্রিকার লেখা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানার আশা করা মরুভূমিতে তুষারপাতের আশা করার মতোই অলীক কল্পনা। মনে হলো, পাঠক-প্রতিক্রিয়া কিছু পেলে লেখার সংশোধনের সময় কাজে লাগবে। সে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়নি। যদিও সংশোধন-পরিবর্ধনের কাজ এখনো বকেয়া।

লেখাটি সম্পর্কে একটি মন্তব্য (হয়তো অভিযোগও) এসেছে যে, উপন্যাসের নারী চরিত্রটির ওপরে খানিকটা অবিচার করা হয়েছে, তাকে সবকিছুর জন্যে দোষী করে পুরুষ চরিত্রটিকে সাধূপুরুষ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই অভিযোগ আংশিক সত্যি। তার কারণও অবশ্য লেখার নামকরণেই পাওয়া যাচ্ছে – লেখাটি পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা, যদিও পুরুষ-চরিত্রের ভালোমন্দ, যুক্তি ও যুক্তিহীনতা, পৌরুষের অহং-এর ভঙ্গুরতা – এইসবই তুলে আনার চেষ্টা করেছি। অন্তত সেটাই উদ্দেশ্য ছিলো।

Saturday, June 14, 2008

যাচ্চলে!

সকালে হঠাৎই মনে এলো, যাচ্চলে!

আজ জুনের তেরো তারিখ, ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থ। ১৩ যে অশুভ সংখ্যা বা সেই তারিখ শুক্রবারে পড়লে তা বহুগুণ বেশি অশুভ ও ভয়ংকর – এইসব বিশ্বাস আমার আদৌ নেই। বিশ্বাস থাক বা না থাক, যথাসময়ে ও কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে এই বহু-প্রচলিত ধারণা বা বিশ্বাসগুলি মনে আসবে না, এমন কোনো ব্যবস্থা নেই। অন্ধকার রাতে হঠাৎ একটি কালো বিড়াল দেখলে কেউ খুশি হয়? একা একটি শালিককে দেখলে কি কিছু একটা মনে হয় না? দুটি শালিকে আবার অন্যরকম হয়ে যায়!

আমি জানি, শিরোনামে ব্যবহার করা শব্দ বা প্রকাশভঙ্গিটি বাংলাদেশে প্রচলিত নয়। পশ্চিমবঙ্গে খুব-একটা-ক্ষতি-নেই-তবে-হলে-ভালো-হতো ধরনের মৃদু আক্ষেপ বা হতাশার অনুভূতি প্রকাশে ব্যাপক চালু।

তবু আজ সকালে আমার ‘যাচ্চলে’ বলতে ইচ্ছে করলো জুনের ১০ তারিখটা ভুলে গেলাম বলে। গত বছর ঐ তারিখে আমার সচলে আসা। তখনো সচলায়তনের আনুষ্ঠানিক উন্মোচন হয়নি, হাতে গোনা কয়েকজনকে নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। নিজেকে সেই দলে অন্তর্ভুক্ত দেখে খুশি হয়েছিলাম, সম্মানিতও বটে। সেই হিসেবে আমি প্রাচীনতম সচলদের একজন।

কয়েক সপ্তাহ আগে ঠিক করে রেখেছিলাম, গত এক বছরের সচল নিয়ে আমার কথাগুলি লিখবো। অথচ দিনটা কীভাবে কখন এলো-গেলো, টেরও পেলাম না। মনে পড়লো তিনদিন পরে, টিউবলাইট আর কাকে বলে!

একেবারে গোড়া থেকে আমি সচলে যুক্ত ছিলাম না, এর পরিকল্পনা-প্রস্তুতি সম্পর্কেও কিছু জানতাম না। জেনেছি পরে, অরূপের স্বপ্নের শুরু যেভাবে পোস্ট থেকে। ব্লগে আমার লেখালেখির শুরু ২০০৭-এর জানুয়ারিতে, যখন ব্লগ সম্পর্কে আমার ধারণা খুবই ভাসা-ভাসা (এখনো খুব বেশি জানি-বুঝি, তা বলা কঠিন)। প্ল্যাটফরম সেই সময়ের একমাত্র বাংলা ব্লগিং কমিউনিটি সামহোয়্যারইন। জুনের প্রথমদিকে একদিন সেখানে দেখি অরূপ একটা পোস্ট দিয়ে আমাকে এমএসএনে ডাকছে। মন্তব্য করে জানাতে হলো, তখন আমি কর্মক্ষেত্রে, সম্ভব নয় (সেখানে ইন্টারনেটে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু চ্যাট-ইমেল ব্লক করা)। আরিফ জেবতিকের ইমেল-আমন্ত্রণও এলো। ১০ তারিখে আমি সচলায়তনের সদস্য।

এসে দেখি, এখানকার সবাই আমার পূর্ব-পরিচিত। ভার্চুয়াল পরিচয় আর কি। কাউকে চাক্ষুষ দেখিনি, ফোনে কথা বলাও নয়। তবু অপরিচিত নন কেউ, তাঁদের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে গেছে আগের ছয় মাসে। হয়তো আমাকেও সেভাবেই কিঞ্চিৎ চিনে নিয়েছিলেন তাঁরাও।

এক বছরে সচলায়তনের পরিধি বেড়েছে অনেক, নতুন নতুন লেখক এসেছেন, আসছেন এবং আরো আসবেন। আমার অনুমান, বয়সের হিসেবে আমি বোধহয় জ্যেষ্ঠতম সদস্য এখানে। তরুণতর এবং তরুণতমদের লেখা পড়ি, তাদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচয় হয়। অনেকের লেখা পড়ে রীতিমতো মুগ্ধ ও চমৎকৃত হই। এটা আমার একটা বড়ো প্রাপ্তি।

বর্তমান সচলদের মধ্যে সর্বার্থে আমার পূর্ব-পরিচিত পরে আসা রহমান ব্রাদার্সের তিনজন – লুৎফর রহমান রিটন, মাহবুবুর রহমান জালাল ও আরশাদ রহমান (দীর্ঘদিন অনুপস্থিত সে)। গত এক বছরে মাত্র আর একজনের সঙ্গে ঘণ্টাখানেকের চাক্ষুষ দেখা হয়েছে, তার নাম সুবিনয় মুস্তফী, গত মার্চে তার ডালাস সফরের সময়। ফোন-ইমেল-চ্যাটে এবং সচলের ব্যক্তিগত মেসেজে হিমু, মাহবুব মুর্শেদ, অরূপ, ইশতিয়াক রউফ, আনোয়ার সাদাত শিমুল, কনফুসিয়াস, নজমুল আলবাব এবং এরকম আরো অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। অথচ ভার্চুয়াল সম্পর্কের বিচারে কাউকে অচেনা লাগে না। পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এই ভার্চুয়াল বন্ধুদের (কনিষ্ঠ হলেও তাদের বন্ধু ভাবি) কারণে মনে হয়, যেখানেই যাই না কেন, একজন বন্ধুকে সেখানে পাওয়া যাবেই। সবখানেই আমার ঠাঁই আছে।

Thursday, June 12, 2008

বালক ও চার সৈনিক

এখন রোহনের মনে হচ্ছে, বাসে গেলে ভালো হতো। মা টাকা দিয়েছিলো সেই হিসেবে – যাওয়ার সময় বাসে, আর ট্রেনে ফেরা। সে জানে, মা প্রতিবার একই কথা বলবে, শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। প্রথমবার একা গিয়েছিলো, তখন তার ক্লাস এইটের অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তারপর দুই বছরে আরো চার-পাঁচবার। প্রথমবারের কথা স্পষ্ট মনে আছে। বাবা বললো, তোর বুলি ফুপু আসতে চায়। একা পারবে না, আমারও সময় হচ্ছে না, তুই যেতে পারবি?

রোহন রাজি, পারবে না কেন? কেউ সঙ্গে যাবে না, সে একা বড়োদের মতো যাবে!

মা অবশ্য আপত্তি তুলেছিলো, এই ভ্যাবলা ছেলে একা কোথায় যেতে কোথায় যাবে ঠিক আছে?

খুবই অপমানের কথা। মা তাকে কী ভাবে? এখনো ছোটো আছে সে? মাত্র পাঁচটা স্টেশন দূরের শান্তাহার থেকে ফুপুকে সঙ্গে নিয়ে আসা কী এমন কঠিন কাজ? সকালে গিয়ে বিকেলের মধ্যে ফিরে আসা, এই তো। সে একা একা সাইকেল নিয়ে সারা শহর ঘুরছে না? ওদিকে দত্তবাড়ি-শিববাটী-কালিতলা, এদিকে জলেশ্বরীতলা-মালতীনগর। করতোয়ার পাড়ে শ্মশানঘাটে কেউ দিনদুপুরেও যেতে চায় না, ভয় পায়। অথচ সে কতোদিন বিকেলে একা বসে থেকেছে সেখানে। নির্জন বলে। মা জানে?

বাবার মধ্যস্থতায় সেই প্রথম একা শান্তাহার যাওয়া। বিরাট জংশন, অনেক মানুষের ভিড়, ব্যস্ততা। কিন্তু অচেনা নয় একটুও। ছোটোবেলা থেকেই বছরে কয়েকবার বাবা-মায়ের সঙ্গে এখানে যাতায়াত। দাদাবাড়ি যাও তো শান্তাহার। নানাবাড়ি যাও, তা-ও শান্তাহার হয়ে। স্টেশন থেকে কলসা পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ। বুলবুলি ফুপুর নাম কী করে যেন বুলি হয়ে গেছে। বুলবুলি নামটা কী সুন্দর! ভালো জিনিসকে কেটেছেঁটে মানুষের যে কী আনন্দ, রোহনের মাথায় আসে না। কলেজে পড়া বুলি ফুপু রোহনের চেয়ে বছর চারেকের বড়ো। ছুটিছাটায় ভাইয়ের বাড়িতে আসার জন্যে ব্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু দাদা কিছুতেই তাকে একা আসতে দেবে না, চাচারাও না। কাউকে গিয়ে আনতে হবে। অথবা ও বাড়িতে কারো সময় হলে ফুপুকে পৌঁছে দিয়ে যাবে।

আজ মায়ের হাত থেকে টাকা নিচ্ছে, মনে মনে রোহন তখনই জানে সে ট্রেনে যাবে। বাসে গাদাগাদি করে কে যায়! থামে যেখানে-সেখানে, জায়গা না থাকলেও যাত্রী তোলে। অথচ দুপুরের লোকাল ট্রেনে ভিড় বেশি থাকে না, মাঝেমধ্যে একেবারে ফাঁকা কামরা পাওয়াও অসম্ভব নয়। ফেরার পথে বরাবর ট্রেনে ফেরা হয়, বুলি ফুপু বাসে একদম উঠতে চায় না, তার বমি পায়।

বয়সে বড়ো হলেও বুলি ফুপুর সঙ্গে রোহনের জমে খুব। শ্যামলা ছোটাখাটো দেখতে বুলি ফুপু কী সুন্দর! হাসলে তার চোখ দুটোও হেসে ওঠে, গালে টোল পড়ে, আরো সুন্দর লাগে। গল্পের বইয়ে পড়া হাসিতে মুক্তা ঝরা তখন চোখের সামনে। ট্রেনে বসে অনেক গল্প করে ফুপু। কোন বান্ধবীর বিয়ে হলো, বর কেমন, কলেজে কোন স্যারের ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করে না স্যার কেমন করে তাকায় বলে – এইসব নানা কথা। রোহনও তার গল্পের ঝুলি খুলে দেয়। বড়োদের মধ্যে এক বুলি ফুপু ছাড়া এতো মনোযোগ দিয়ে তার কথা আর কেউ শোনে না।

আরেকটা খুব গোপন কথা আছে, কাউকে বলা যাবে না। সে নিজেই ঠিক বোঝে না, বলবে কী! ট্রেন থেকে নেমে বাসায় ফেরার জন্যে রিকশা নেওয়া হয়। পাশাপাশি বসে বুলি ফুপুর গায়ের স্পর্শে কীরকম যেন একটা অনুভূতি হয়, শরীরে কিছু একটা শিহরণের মতো বোধ। আড়চোখে বুলি ফুপুর মুখের দিকে তাকায় রোহন, সেখানে কোনোকিছু লেখা নেই।

আজ টিকেট কেটে স্টেশনে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। ট্রেন প্ল্যাটফরমে এসে থামলে রোহন দ্রুত পায়ে হেঁটে একবার টহল দেয়। পেছনের দিকে একেবারে ফাঁকা একটা কামরা। সে অপেক্ষা করে, অন্য কোনো যাত্রী উঠে পড়তে পারে। কেউ আসে না। গার্ডের বাঁশি বাজার পর ট্রেনটা চলন্ত হওয়ার আভাস দিলে রোহন ফাঁকা কামরার একমাত্র যাত্রী হিসেবে উঠে পড়ে। আঃ, কী আনন্দ! প্রথম দুটো স্টেশন নিজের মতো করে সে একা। পুরো রাজ্যের একচ্ছত্র দখল, ভাগ বসানোর কেউ নেই। স্টেশন ছেড়ে যেতেই একবার এই সীটে বসে, উঠে গিয়ে আবার ওই সীটে। জানালার পাশে বসে মাথা বাইরে ঠেলে দিলে হু হু বাতাসে চুল ওড়ে। উদ্দাম বাতাস পারলে চোখ বুজিয়ে দেয়। আশেপাশে কেউ না থাকলে গলা ছেড়ে গান গাইতে কোনো অসুবিধা নেই। চলন্ত ট্রেনের শব্দের তলায় নিজের গলা যে কোনো বিখ্যাত গায়কের মতো হয়ে যায় – অর্ণব বা হাবিব, অঞ্জন অথবা নচিকেতা। গানগুলো ঠিকমতো সুরে খেলে, তখন গানগুলো তার নিজের। খোলা চোখেও মনে মনে রোহন দেখে, মঞ্চে উঠে একটার পর একটা গান করছে সে, একেকটা গানের শেষে শ্রোতাদের হাততালি ও উল্লাস।

আলতাফনগরে ট্রেন থামলে চারজন লোক এই কামরার নতুন যাত্রী হয়ে উঠে এলো। তাদের পরণে ছোপ-ছোপ জলপাই সবুজ পোশাক। পোশাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিহ্ন আঁকা, বুকের বাঁ দিকে নাম লেখা ট্যাগ। পায়ে বুট, হাতে রাইফেল।

কাঁধে ঝোলানো ব্যাকপ্যাক নামিয়ে লোকগুলো রোহনকে দেখে। চার জোড়া চোখ একত্রে। রোহনের অস্বস্তি হয়, চোখ নামিয়ে ফেলে সে। মুখ ঘুরিয়ে জানালার বাইরে চোখ ফেলার আগে আড়চোখে দেখে, সৈনিকরা তখনো তাকে দেখছে। কী এমন দর্শনীয় বস্তু হয়ে গেলো সে?

এতো কাছে থেকে কোনো সৈনিককে কখনো দেখেনি রোহন। অবশ্য আলাদা করে দেখার কী আছে তা-ও বোঝে না। লোকগুলোর পোশাক-আশাক আলাদা, চুল খুব ছোটো ছোটো করে ছাঁটা – এই তো। অন্যসব মানুষের চেয়ে আর কিছুতে আলাদা লাগে না। তবু ঠিক যেন একরকমও নয়। কোথাও তারা অন্যরকম। সামনাসামনি না দেখলেও শোনা কথা কম নেই। রোহনের জন্মেরও অনেক বছর আগে এ দেশে যুদ্ধ হয়েছিলো, পাকিস্তানী সৈন্যদের নিষ্ঠুরতার গল্প সে শুনেছে বাবার কাছে। অকারণে তারা পাখি মারার মতো মানুষ মারতো, দুধের শিশুকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে বেয়োনেটের ডগায় গেঁথে ফেলার গল্প শুনে রোহনের অসহ্য লেগেছিলো। সে জানে, তারা ছিলো অন্য দেশের সৈন্য। রোহন নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে, ওদের সঙ্গে তার কখনো দেখা হয়নি। কেমন ছিলো দেখতে তারা? এই লোকগুলোর মতোই? না অন্যরকম? বাবা আজও মিলিটারি একদম সহ্য করতে পারে না।

রোহনের মনে হয়, এই চারজন আমাদের দেশের সৈনিক। তারা নিশ্চয়ই পাকিস্তানীদের থেকে আলাদা। অতো নিষ্ঠুর হওয়া এদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবু স্বস্তি পাওয়া যায় না। বাবাকে বলতে শুনেছে, বছরখানেক ধরে সৈনিকরাই আড়ালে থেকে দেশ চালাচ্ছে। সেনানায়কের চেহারা সেজন্যেই আজকাল এতো ঘন ঘন টিভিতে দেখা যায়। অন্য হোমরা-চোমরা যাদের দেখা যায়, তারা তারই হুকুমে ওঠে-বসে, যা বলে তাই শোনে। তারাও এক হিসেবে সৈনিকদের হুকুমের দাস সৈনিক হয়ে গেছে, শুধু সাজপোশাকে তারা আলাদা।

কয়েকবার এরকম নাকি হয়েছে এ দেশে, তখনো রোহনের জন্ম হয়নি। এতোকিছু তার বোঝার কথা নয, তবে বাবা ভুল কিছু বলেনি – সেনানায়ককে যে খুব আজকাল টিভিতে দেখা যায় তা সে লক্ষ্য করেছে। কিছুদিন আগেও এরকম ছিলো না, তা-ও বেশ মনে আছে। সামনে বসা লোকগুলো সেই ক্ষমতাবানের প্রতিনিধি বলেই এরকম অস্বস্তি? সে নিতান্ত এক নিরীহ স্কুলছাত্র, তাকে ভালো ছেলে বলে সবাই জানে। তার ভয় কীসে? তবু বলা যায় কিছু? তারা যা খুশি করতে পারে শোনা যায়। ঢাকায় ছাত্রদের সঙ্গে তাদের গোলমালের কথা খবরের কাগজেই পড়েছে। শিক্ষকদের ধরে জেলে আটকে রাখা হলো কতোদিন! কোনো দোষ না করেও নিজেকে খুব নিরাপদ ভাবা চলে কি না, কে জানে!

ট্রেন এখন ছুটছে শস্যভরা উন্মুক্ত মাঠের বুক চিরে। ক্ষেতে কর্মব্যস্ত কৃষক। রেললাইন বরাবর সরু অগভীর জলাশয়, টেলিগ্রাফের তারে বসা নানা জাতের পাখি। হঠাৎ রোহনের চোখে পড়ে, আকাশে ছোটো একখণ্ড কালো মেঘ মাঠের এক জায়গায় ধূসর ছায়া ফেলেছে। তার চারপাশ সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় আলোময়। ধূসর ছায়াটা স্থির হয়ে নেই, বাতাসে মেঘ সরে সরে যায়, সঙ্গে ধূসর ছায়া। ‘শরতের মিছা মেঘ’ কথাটা কোথাও লেখা দেখেছিলো, এখন মনে আসে। এই মেঘ শুধুই মেঘ, বৃষ্টি ঝরানোর ক্ষমতাও নেই।

বাইরে থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে রোহন সৈনিকদের দিকে তাকায়। চারজন পাশাপাশি বসা। এতোক্ষণ নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি করছিলো, রোহনের মুখ ফেরানো যেন সবাই একসঙ্গে টের পেয়ে এখন আবার তাকে নজর করে দেখছে। কী দেখে তারা? কেন?

ঘন গোঁফওয়ালা সৈনিক, চারজনের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে বেঁটে, হঠাৎ রোহনের দিকে তাকায়। তার ঠোঁটটা কি একটু নড়ে উঠলো? লোকটা মুচকি হাসি হাসলো? হয়তো দেখার ভুল। গোঁফওয়ালার পাশের জন রোহনের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে। লোকটার চোখগুলো কী তীব্র, যেন ভেতরটা ভেদ করে সব দেখতে পাচ্ছে। রোহনের বুকে ধুকপুক যে একটু বেশি জোরে হচ্ছে, লোকটা কি টের পেয়ে গেলো? চোখ সরিয়ে না নিয়ে তার উপায় কী! সে বুঝতে দেবে কেন? নিজেকে বোঝায়, সে একটুও ঘাবড়ায়নি। তবে কিছু একটা আছে, তাকে নিশ্চিন্ত থাকতে দিচ্ছে না। ভেতরটা আপনা থেকেই টানটান হয়ে আছে।

লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে কথায় ব্যস্ত হয়ে গেছে। সবই কানে আসছে, অথচ ভেতরের উৎকণ্ঠায় রোহন কিছুই শুনতে পায় না। তাদের সম্মিলিত উচ্চকণ্ঠ হাসি শোনা যায় এবার। রোহন ফিরে তাকায় সৈনিকদের দিকে। চার জোড়া চোখ তাকে দেখছে। মানুষের হাসির শব্দ যে এতো বিরক্তিকর ও অনাকাঙ্ক্ষার বিষয় হতে পারে, তার জানা ছিলো না। তার চেয়ে বড়ো কথা, তাদের চাউনি রোহনের ভেতরের অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিচ্ছে। পরের স্টেশনে ট্রেন থামলে নেমে যাবে স্থির করে সে, অন্য কোনো কামরায় উঠে পড়লেই হলো, তারপরে একটা তো মোটে স্টেশন। এখন তার আক্ষেপ হয়, মায়ের কথা মান্য করে বাসে গেলেই ভালো হতো।

এ্যাই ছেলে, তুমি কই যাইতেছো?

প্রশ্নটা তাকেই করা হয়েছে বুঝতে সময় লাগে রোহনের। দাড়িগোঁফে আচ্ছন্ন মুখের সৈনিক প্রশ্নকর্তা। তার ওপরে নিবদ্ধ চার জোড়া চোখকে তার হঠাৎ ক্ষুধাকাতর বাঘের চোখের মতো লাগে। খুব আড়ষ্ট বোধ করে সে। ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠে, শরৎকালের রোদ ঝলমল দিনেও তার শীত শীত করে।

তার অনিশ্চিত কণ্ঠস্বর থেকে একটিমাত্র শব্দ নিঃসৃত হয়, শান্তাহার।

একলা ক্যান? বাড়ি পলাইছো?

রোহন না-সূচকভাবে দুইদিকে মাথা নাড়ে। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, চোখগুলোকে আর তার সহ্য হচ্ছে না। এই ভয়ের অনুভূতি আর বহন করা যাচ্ছে না।

ট্রেনের গতি কমে এসেছে, আদমদীঘি স্টেশন এসে পড়লো। এবার নেমে যাওয়া দরকার। উঠে দাঁড়াবে ভাবছে, তখন তার হাত-পা স্থির হয়ে যায়। একটা কথা মনে পড়ে গেছে। একটু আগে সে শান্তাহার যাবে বলেছে, এখন আদমদীঘিতে নেমে যায় কী করে? ওদের অনুমান, সে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। এখানে নামতে চাইলে ওদের সন্দেহ আরো মজবুত হবে। নিজের ওপর মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সে, কী দরকার ছিলো শান্তাহার বলার? এই তো যাচ্ছি আর কী – এই ধরনের একটা অনির্দিষ্ট উত্তরও তো দেওয়া যেতো। এখন থাকো বসে!

প্রায়-দুপুর রোদে আদমদীঘি স্টেশনের প্ল্যাটফরমে লোকজনের ভিড় বেশি নেই। মুখ বাড়িয়ে রোহন যাত্রীদের ওঠানামা দেখে। একবার ভাবে, ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে এক দৌড়ে নেমে গেলে কেমন হয়? ওরা তখন আর তার পিছু নেবে না নিশ্চয়ই। কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে অন্য কামরায় উঠে পড়া যদি না যায়? তখন আদমদীঘিতে বসে থাকতে হবে, পরের ট্রেন যে কখন তা-ও জানা নেই। বুকভরা অস্বস্তি-উৎকণ্ঠা, ভয়-দুঃখ-ক্রোধ মিলিয়ে রোহনের এখন কাঁদতে ইচ্ছে করছে। অথচ মনে হচ্ছে, তার ভয় করবে কেন? এই ভয়ের কোনো মানে নেই।

পান-বিড়ি-সিগারেট হেঁকে যাওয়া হকারকে হাত তুলে ডাকে রোহন। এক শলা সিগারেট আর একটা দেশলাই কেনে। এখন ধরাবে। এক মুহূর্ত আগেও ভাবেনি, এখনো স্পষ্ট জানে না সে কেন কিনলো। ধরিয়ে টানা পরের কথা, সিগারেট জীবনে কখনো সে ছুঁয়েই দেখেনি। বয়স্ক কারো সামনে সিগারেট খাওয়াও চলে না। অথচ কামরার উল্টোদিকে বসা চারজনকে সে এখন সম্পূর্ণ অস্বীকার ও অবজ্ঞা করতে ইচ্ছুক। যেন তারা একেবারে নেই।

একবার মনে হয়, জীবনে কখনো সিগারেট না-ধরা হাতে দেশলাই-সিগারেট সামলাতে পারবে তো? পারবে, অন্যদের ধরাতে দেখেছে। সিগারেটটা দুই ঠোঁটের ফাঁকে রেখে দেশলাইয়ে কাঠি ঠুকে দেয় রোহন। এই তো আগুন জ্বলেছে। জ্বলন্ত দেশলাই-কাঠির দিকে চোখ স্থির করে সে।

ট্রেন চলতে শুরু করেছে। চার সৈনিকের দিকে একবারও ফিরে তাকায় না রোহন। এখন তার কোনো উৎকণ্ঠা নেই, একটুও ভয় করছে না।

Sunday, June 8, 2008

শহীদ কাদরী গুরুতর অসুস্থ

নিউ ইয়র্কে প্রবাসী কবি শহীদ কাদরী দীর্ঘকাল ধরে দুই অকেজো কিডনি নিয়ে চিকিৎসাধীন। একটি কিডনি প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় আছেন পাঁচ বছর। সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালিসিস তাঁকে সীমিতভাবে সচল রেখেছে। সপ্তাহ দেড়েক আগে পিঠে অসহ্য ব্যথা বোধ করলে তাঁকে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে নেওয়া হয়। দু’দিন আগে তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হয়েছে একাধিক গুরুতর শারীরিক জটিলতার কারণে। তখন থেকে তাঁকে সিসিইউ-তে পর্যবেক্ষেণে রাখা হয়েছে, নানাবিধ পরীক্ষা চলছে।

রক্তে সংক্রমণ ও নিচু রক্তচাপ চিকিৎসকদের সবচেয়ে বেশি চিন্তায় রেখেছে। হার্টবিট নেমেছে ৪৭-এ। অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। এপিলেপসির লক্ষণও দেখা গেছে, পরশু এবং আজ সিজার হয়েছে। নিউরোলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। তবে রক্তচাপ স্বাভাবিকের কাছাকাছি না এলে তা করা সম্ভব হবে না।

এইসব জটিলতার কারণে নিয়মিত ডায়ালিসিস করা যাচ্ছে না, করা হচ্ছে আংশিক। একটাই হয়তো ভালো খবর, তাঁর হার্টে কোনো গোলযোগ পাওয়া যায়নি। সেটা হলে দুর্যোগ আরো বড়ো ও জটিল হতে পারতো।

শারীরিক এতোসব সংকট সম্পর্কে আমার ধারণা প্রায় শূন্য, তবে কবির অসুস্থতা যে গুরুতর তা কোনো বালকও বুঝবে। নীরা ভাবী ফোনে যা জানিয়েছেন, তাই বয়ান করছি। শহীদ ভাইয়ের অনুরাগী-শুভার্থীদের খবর জানাতে অনুরোধ করে তিনি বললেন, আমি নিজেও অসুস্থ, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। সবাইকে এইসব বলতে বলতে আমি ভেঙে পড়ছি। কেউ যদি আমাকে এখন কিছু জিজ্ঞাসা না করেন, তাহলে সবচেয়ে ভালো হয়।

শহীদ কাদরী আছেন লং আইল্যান্ড জ্যুয়িশ হাসপাতালের সিসিইউ-এর ১৩ নম্বর কক্ষে। নিউ ইয়র্কবাসী কেউ ইচ্ছে করলে হাসপাতালে যেতে পারেন। হাসপাতালে ফোন (৭১৮.৪৭০.৭০০০) করলে ঠিকানা ও দিক-নির্দেশনা পাওয়া যাবে।

ডাক্তাররা বলেছেন, শহীদ ইজ আ ফাইটার।

আমরা চাই, যোদ্ধা যেন জয়ী হয়ে ফেরেন।

যাঁরা বিশ্বাসী, তাঁরা প্রার্থনা করতে পারেন কবির জন্যে। আর আমরা অবশিষ্টরা উদ্বেগ-ঊৎকণ্ঠা নিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকা ছাড়া আর কী করতে পারি?

-----------------
জুন ০৭, ২০০৮
-----------------

Tuesday, June 3, 2008

কী করতে চাই আর কী করি

কলেজে ভর্তি হওয়ার অল্পকালের মধ্যেই প্রেমে পড়ি। ঐ বয়সে সবাই যেমন পড়ে। সম্পর্কটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কিন্তু সেই সময়ের একটি অভ্যাস আমার চিরকালের সঙ্গী হয়ে গেলো। অভ্যাসটি রাত্রি জাগরণের।

প্রেমের সঙ্গে রাত্রি জাগরণের খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা আছে, ভুক্তভোগীরা এই সাক্ষ্যই দেবেন। আমার পক্ষেও ব্যতিক্রম হওয়া সম্ভব ছিলো না। অভ্যাসটি এমনই হয়ে গেছে যে কখন ঘুমাতে যাবো তা সম্পূর্ণ আমার ইচ্ছে। কিন্তু বিপদ হয় জেগে ওঠার সময়, তার নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে নেই। ভোরবেলার অ্যালার্মঘড়ি আমাকে জাগায়, যেহেতু জীবিকা নির্বাহের জন্যে একটি কর্ম আমাকে করতে হয় এবং সেখানে সকালেই হাজিরা দেওয়া বাধ্যতামূলক।

প্রাতঃকালের জাগরণটি ততোটা রূঢ় যাতে না হয়, সেজন্যে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়ে গেছে। কর্কশ ক্যাঁ ক্যাঁ আওয়াজের অ্যালার্মের বদলে রেডিওর গান ঘুম ভাঙাবে, এই আশায় রেডিওসহ অ্যালার্ম ঘড়ি এলো। কিন্তু যে গানটি তখন বাজছে তা আমার খুব অপছন্দের হলে? সাতসকালে গানের বদলে তারস্বরে বিজ্ঞাপন শুনে ঘুম ভাঙলে তা-ও খুব সুখের হয় না। এরপরে একটি অ্যালার্মঘড়ি কেনা হলো যেখানে ইচ্ছে করলে সমুদ্রের কল্লোল শোনা যাবে, অথবা পাখির ডাকে নিদ্রাভঙ্গ হবে।

কিছুই আসলে বদলায়নি। একই অনিচ্ছা ও বিরক্তি নিয়ে সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠি। বিছানায় উঠে বসে প্রতিদিন ভাবি, আজ কাজে না গেলে কী হয়? অথবা একেবারে কাজ না করতে হলে? কাজ ছেড়ে দিলে?

গ্রাসাচ্ছদনের চিন্তা আসে, পরিবারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয়। অনিচ্ছুক শরীর ও মনকে প্রস্তুত করতে হয় আরেকটি দিনের জন্যে।

জীবন নির্বাহ করার জন্যে কাজ করতে না হলে কী করতাম আমার একেকটি দিন নিয়ে? আহ, কতো দীর্ঘ সেই ইচ্ছেগুলির তালিকা!

শয্যা ত্যাগ করা যেতো অ্যালার্মের নির্দেশ ছাড়া, ঘুমের বরাদ্দ আদায় পূর্ণ হলে। জানালার পর্দা সরালে আলোয় আলোময় একটি ঝলমলে দিন বাইরে। মেঘলা হলেই কী এমন ক্ষতি? অথবা হোক না যে কোনো রকমের বৃষ্টি - ঝিরঝিরে বা ঝমঝম।

পড়বো বলে জমিয়ে রেখেছি অগণন বই, তার একটা খুলে বসা যায়। অসংখ্য সিডি কেনা আছে, অনেকগুলি বছরের পর বছর ধরে পড়ে আছে সেলোফেনের মোড়কমুক্ত হওয়ার অপেক্ষায়। আমার মেয়ে জিজ্ঞেস করে, শোনো না, তাহলে কিনেছো কেন?

আমি তাকে বলি, এগুলি আমার অবসর জীবনের সঞ্চয়। মানুষ টাকাপয়সা জমায়, আমি রাখি বই আর গানের সঞ্চয়।

বিকেলে ছেলেকে নিয়ে পার্কে যাওয়া যায়। তার খুব ইচ্ছে, একা একা বাস্কেটবল প্র্যাকটিস করার বদলে বাবাও তার সঙ্গে থাকবে। স্ত্রীর ইচ্ছে একত্রে কোনো সিনেমা দেখতে যাই, অনেক বছর হয়নি। চাইলে তাদের ইচ্ছেপূরণ ঘটানো যায়।

না-লেখা ও অসমাপ্ত গল্প-উপন্যাসগুলি লিখতে বসতে পারি। গভীর রাত পর্যন্ত একটানা লিখবো। ভালোমন্দ যা-ই হোক, একেকটি লেখা শেষ করার কী গভীর পরিতৃপ্তি! সেই স্বাদ কতোদিন পাওয়া হয়নি।

প্রকৃতপক্ষে কোনোকিছুই ঘটে না। সঞ্চয় করে রাখা বইয়ের বদলে অফিসে বসে এটা-ওটার ম্যানুয়াল পড়ি, ইমেল পড়ি। গান শোনার বাসনা ত্যাগ করে হেডফোন কানে লাগিয়ে কনফারেন্স কলের অনন্ত বকরবকর শুনি। লেখালেখিও হয় বটে। নালিশ এটুকুই, লিখতে হয় যা লিখতে চাই না।

দিনের শেষে জগতের সমস্ত অবসাদ নিয়ে ঘরে ফিরে স্ত্রী বা ছেলের বাসনা পূরণের ধারেকাছেও যাওয়া হয় না। সবশেষে একটু রাতে যখন অবসর মেলে, কমপিউটারের সামনে বসি। মনে ক্ষীণ আশা, আজ কয়েক পাতা লিখবো। হয় না, ইমেল-ইন্টারনেট সে সময়টুকু গ্রাস করে ফেলে। এইসব শেষ হলে তখন মনে হয়, আজ থাক, কাল থেকে ঠিক ঠিক হবে।

সেই আগামীকালের আশাটুকুই এখনো জাগ্রত।

Wednesday, May 28, 2008

আপনি তুমি বা তুই

অন্তত দুটি দম্পতিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি যাঁরা পরস্পরকে তুই করে বলেন। আমাদের মধ্যবিত্ত নাগরিক সংস্কৃতিতে স্বাভাবিক তো নয়ই, রীতিমতো ব্যতিক্রম ও বিপ্লবাত্মক। এর বিপরীতে এমন উদাহরণও জানি যেখানে বিবাহপূর্বকালে দু’জন দু’জনকে তুই-তোকারি করতেন, বিবাহের আনুষ্ঠানিকতার ফলে তা তুমিতে উত্তীর্ণ হয়ে প্রথাসিদ্ধ রূপ পেয়ে গেছে।

ঠিক জানা নেই, তবে পৃথিবীর খুব বেশি ভাষায় আমাদের মতো আপনি-তুমি-তুই এরকম তিন স্তরের সম্বোধন আছে বলে মনে হয় না। হিন্দি-ঊর্দূতে আছে জানি।

বাংলাদেশে যে কোনো শহরের বাইরে দুই পা গেলে অবশ্য অন্য বাস্তবতা। গ্রামবাংলায় আজও পুরুষরা সচরাচর বউদের তুই করে বলেন, যদিও মেয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বামীদের (স্বামী শব্দটি আমার ভয়ানক অপছন্দ, অথচ যুৎসই বিকল্পও নেই) তুমি, এমনকি আপনি বলে সম্বোধন করে থাকেন। কখনো কখনো আপনি-তুমির সীমানা বাঁচিয়ে ভাববাচ্যে বলা হয়। স্বামী বলে কথা, যার অর্থ প্রভু। আজকাল অবশ্য কিছু লেখাপড়া জানা মানুষও গ্রামে বসবাস করেন, তাঁরা আবার এই নিয়মের ব্যতিক্রম – বউকে তুই-তোকারি করা অরুচিকর ও অশোভন, বিবেচনা করেন। তাঁদের মনোভাব শহরের তুমি-সংস্কৃতির অনুসারী হয়ে স্বস্তি বোধ করে।

এই কিছুকাল আগেও গ্রামাঞ্চলে বাবা-মা, চাচা-চাচী, দাদা-দাদী, নানা-নানী, ভাই-ভাবী বা গ্রামের বয়স্ক মুরুব্বীদেরও তুই বলা কিছুমাত্র অস্বাভাবিক ছিলো না, অসঙ্গত বলেও গণ্য হতো না। আর ভাইয়ে-ভাইয়ে বা ভাইবোনের মধ্যে তুই ছাড়া কিছু তো হিসেবের বাইরেই ছিলো। আমাদের বাড়িতে ভাইবোনদের মধ্যে পরস্পরকে তুই/তুমি বলার চল, আব্বা-আম্মাকে আপনি। ওইরকমই আমাদের শেখানো হয়েছিলো, যেমন হয়েছিলো বাবা-মা সম্বোধনের পরিবর্তে আব্বা-আম্মা। আমাদের গ্রামের বাড়ির আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ভাইবোনকে তো বটেই, মাকে তুই বলা আজও প্রায় সর্বাংশেই চালু আছে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নিয়মিত আড্ডায় আমাদের ঘনিষ্ঠ পাঁচ বন্ধুর মধ্যে আপনি/তুমি/তুই-এর এক খিচুড়ি প্রচলিত ছিলো। আমাকে বাদ দিলে অন্য চারজন ছিলো হাবিব, সিরাজ, মিলন ও সারোয়ার। বয়সের পার্থক্য অবশ্য ছিলো, কিন্তু তারপরেও আপনি/তুমি/তুই-এর যুক্তিসঙ্গত হিসেব মেলানো কঠিন। হাবিব আর্ট কলেজের ও সিরাজ বুয়েটের পড়াশোনা শেষ করেছে আগেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া সারোয়ার ও আমি সমবয়সী। মিলন জগন্নাথ কলেজের এবং আমাদের এক বছরের ছোটো, সিরাজ তিন বছরের ও হাবিব ছয় বছরের বড়ো।

হাবিবের সঙ্গে আমাদের প্রত্যেকের আপনি চলে। বয়োজ্যষ্ঠ হিসেবে হাবিবের পক্ষে আমাদের সবাইকে তুমি, এমনকি করে বলা স্বাভাবিক ও সঙ্গত হতো। কিন্তু হয়নি। সিরাজ-মিলনের মধ্যে তুই-সম্পর্ক। সিরাজের সঙ্গে আমার ও সারোয়ারের আপনি। আমার সঙ্গে মিলনের তুই চলে, সারোয়ারের সঙ্গে আপনি। আপনি সম্বোধনের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে সিরাজ একদিন এই মর্মে এক তত্ত্ব উপস্থিত করে যে, আপনি বললে কিছু দূরত্ব বজায় রাখা যায় এবং পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ অটুট থাকে। তুই-তোকারির বন্ধুকে শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দেওয়া যায়, আপনি সম্বোধনের কাউকে শুয়োরের বাচ্চা বলা সম্ভব নয়।

সৌম্য দাশগুপ্ত কবি। বয়সে অনেক ছোটো হলেও সে আমার বন্ধুস্থানীয়। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতা শহরে। তার বাবা বরিশালের, মা চট্টগ্রামের (সেই বাবদে সে চট্টগ্রামের আহমদ ছফাকে মামা বানিয়ে ফেলেছিলো)। সৌম্য সামগ্রিকভাবে নিজেকে বাঙালি এবং আধা-বাংলাদেশী বলে পরিচয় দেয়। আংশিকভাবে তা পিতামাতার জন্মভূমির সূত্রে, বাকিটা বাংলাদেশের বিস্তর মানুষজনের সঙ্গে তার অতি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সম্পর্কের কারণে। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, বাংলাদেশে আমার চেয়ে তার চেনাজানা বেশি।

পরিচয়ের শুরুতে সৌম্যকে আপনি বলতাম। একদিন সে তুমি করে বলার অনুরোধ করলে আমি তাকে কিছুটা অবাক করে বলি, আমাকে জুবায়ের ভাই ডাকো ঠিক আছে, কিন্তু আমাকেও তুমি করে বলবে।

অবাক হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে সে বলে, বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে আপনি-আপনি বলার প্রবণতাটা খুব বেশি দেখি। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও পরস্পরকে আপনি বলেন দেখেছি। অথচ পষ্চিম বাংলায় অত্যন্ত দূরবর্তী বা শিক্ষক ও গুরুস্থানীয় কেউ না হলে আপনি বলা হয় না।

পশ্চিম বঙ্গে বাস্তবতা আসলেও তাই। বয়স্করা শিশুদের অবধারিতভাবে তুই করে বলবে। বাবা-মা ও অন্য সব বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়-পরিজনকে তুমি বলার রেওয়াজ। আপনি দিয়ে শুধু সম্পর্কের দূরত্ব বা শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশিত হবে। সেখানেও বন্ধুদের মধ্যে কোথাও কোথাও আপনি সম্বোধন বলবৎ থাকে, তবে তা ব্যতিক্রম বলেই ধরা হয়।

আমাদের দেশেও শহরাঞ্চলে কিছু বদল ঘটেছে। আজকাল শিশুরা বাবা-মাসহ বড়োদের আপনির চেয়ে তুমি বেশি বলে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তুই-তুমি প্রাধান্য পাচ্ছে। এগুলি চমৎকার ও সহজ সম্পর্কের নির্দেশক বলেই আমার বিশ্বাস।

গত কিছুদিনে সচলায়তনে কারো কারো সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। বয়সে বড়ো হওয়ার কারণে এদের অনেককেই তুমি বলার অনুমোদন পেয়ে গেছি। অথচ কাউকেই বলা হয়ে ওঠেনি যে, তারাও আমাকে জুবায়ের ভাই, তুমি বললে খুশি হই। সৌম্যকে সহজে বলতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে ওই চল এখনো গড়ে ওঠেনি বলেই হয়তো বলা যায়নি।

মানুষের জীবন যে কতো অসঙ্গতিতে ভরা তার একটি উদাহরণ আমি ঘরেই তৈরি করে রেখেছি। একদিন খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমি আমার মেয়েকে তুই বললেও ছেলেকে তুমি করে বলি। কী করে ঘটলো জানি না। কারণ খুঁজে পাওয়া গেলো না। মানুষের আচরণ আসলে খাপছাড়া হয়েই থাকে – এরকম একটা যুক্তিহীন যুক্তি দিয়েই তাকে যুক্তিসিদ্ধ করা সম্ভব। আর কোনোভাবে নয়।

Monday, May 26, 2008

বামন-গল্প : বয়স

বেশ কিছুদিন ধরে সচলায়তনে অণু-পরমাণু গল্পের ঢল নেমেছে। একটা সংকলনও হয়ে গেছে। সেই সংকলনে লেখার জন্যে আমন্ত্রিত হয়ে দুই সম্পাদককে জানিয়েছিলাম, ছোটো লেখা আমাকে দিয়ে হয় না, সুতরাং মাফ চাই।

অনেকদিন লেখালেখি কিছুই হয়ে উঠছে না। আজ ছুটির দিন বলে বসা গেলো। যা লিখতে গিয়েছিলাম তার আশেপাশেও যাওয়া হলো না, সম্পূর্ণ অন্য একটা জিনিস মাথায় এলো। তা-ও আবার ক্ষুদে গল্পের আকারে।

কিছু হলো কি?

* * * * * * * * * *

বয়স

যুদ্ধে গিয়েছিলে?
তখন বয়স হয়নি, ছোটো ছিলাম।
এখন হলে যাবে?
বয়স হয়ে গেছে।

Saturday, May 17, 2008

গোলমালচরিত

এক রাতে ঢাকা থেকে ফোন। হ্যালো বলতেই ওপাশে রীতিমতো গোলাবর্ষণ (গলাবর্ষণ আর কি!)। ফারুকের গলা। কোনোরকম সম্ভাষণ নয়, কয়েক বছর পর কথা হচ্ছে, ভালোমন্দ খোঁজখবর নেওয়ারও যেন দরকার নেই। সরাসরি প্রসঙ্গে চলে গেছে সে, কী একখান নাম দিয়া গ্যালেন মিয়া, এখনো সবাই আমারে ওই নামে ডাকে!

পুরো নাম গোলাম ফারুক। এক মুহূর্ত সুস্থির হতে জানে না – তড়বড় করে ছুটে বেড়াচ্ছে, পোশাক-আশাকে ভদ্রস্থ থাকার চেষ্টা থাকলেও বেশিরভাগ সময় প্যান্টের জিপার ওপরের দিকে খানিকটা আলগা প্রায় সারাক্ষণ, সঙ্গে আধভাঙা গলায় ক্রমাগত কথার খই ফুটছে। এতো দ্রুত কথা বলে যে অভ্যস্ত না হলে মর্মোদ্ধার করা কঠিন। এই চরিত্রের নামের প্রথমাংশের গোলামকে গোলমাল বানিয়ে ফেলা কঠিন কিছু নয়, স্বাভাবিক বলেই ধরে নেওয়া উচিত। ভুলও হয় না। অবিলম্বে নামটি আমাদের বন্ধুদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা পায়। প্রায় তিরিশ বছর ধরে চালু আছে। কোন ফারুক জিজ্ঞেস করলে এই ফারুককে চেনাতে হলে বলতে হয়, গোলমাল ফারুক।

ফোনে তখনো ফারুকের কথা শেষ হয়নি। সে বলে যায়, আমার পোলা সেদিন জিগায়, আচ্ছা বাবা সবাই তোমারে গোলমাল কয় ক্যান?

ফারুককে চিনি ১৯৭৮ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা তখনো হয়নি, বিজয়নগরে ‘নান্দনিক’ নামে একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানে কপিরাইটারের কাজ করি। সেখানেই ফারুকের সঙ্গে প্রথম দর্শন ও পরিচয়। তার সঙ্গে বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠতা হওয়ার কথা নয়, কিন্তু তার নির্ভেজাল সরলতা ও স্বভাবের কারণে তাকে উপেক্ষা করাও কঠিন। নান্দনিক যুগের পরে পুরানা পল্টনে হাউজ বিল্ডিং ভবনের পেছনে ‘অ্যাডবেস্ট’ নামের বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানেও একসঙ্গে কাজ করেছি। তারপরেও আমাদের যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব অটুট।

ফারুকের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। তার দ্রুতকথনে তা অনায়াসে হয়ে যায় ন্যাঞ্জো, তাকে দিয়ে নারায়ণগঞ্জ শব্দটা কখনো উচ্চারণ করানো যায়নি। ফারুকের শর্টহ্যান্ডসদৃশ দ্রুতকথনের আরো কিছু নমুনা দিই। মুন্নি নামে একটি মেয়ে অ্যাডবেস্টের একটি বিজ্ঞাপনে মডেলিং করেছিলো। একদিন দুপুরে প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ফারুক বলে, মুন্নি অ্যারেস্ট হইছে।

অবাক হয়ে বলি, কেন কী হয়েছে? মুন্নি অ্যারেস্ট হবে কেন?

আরে না না, মুন্নি অ্যারেস্ট হইয়া গেছে তো।

এই ধরনের কথোপকথন আরো খানিকক্ষণ চলার পরে উপস্থিত একজন কেউ ফারুকের কথার অনুবাদ করতে সক্ষম হয়। অনুবাদে যা পাওয়া গেলো তা এইরকম: মুন্নি বিমানে এয়ারহোস্টেস হয়েছে!

আমার বিয়ের কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় এসেছে সে। চা খেতে খেতে একসময় বউকে জিজ্ঞেস করে, ফ্রিজ কই?

খাবার টেবিলের পাশে ফ্রিজ দেখিয়ে বউ বলে, ওই তো!

না না, ফ্রিজ ফ্রিজ। ফ্রিজ কই?

আমি ততোক্ষণে বুঝে গেছি। আমার ছোটো ভাইয়ের নাম ফিরোজ, ফারুক তার খোঁজ করছে।

ভাতের জন্যে ফারুকের খুব দুর্বলতা। কোনোদিন হয়তো অফিসের সবাই মিলে ভরপেট চাইনিজ খেয়ে ফিরেছি। অফিসে ঢুকেই সে পিয়নকে ডেকে বলবে, জলদি ভাতমাছ লইয়া আয়।

অ্যাডবেস্ট ছিলো উৎকৃষ্ট আড্ডার জায়গা। দিনমান বিভিন্ন জাতের মানুষের আনাগোনার শেষ নেই, আড্ডার জন্যে একটি বড়ো কক্ষ আলাদা বরাদ্দ ছিলো। ক্রমাগত চা সরবরাহ চলছে। গ্রুপ থিয়েটারের দল, সাহিত্যের দল, আঁকিয়েদের দল তো ছিলোই। আরো আসতো ফুটবল-ক্রিকেট খেলোয়াড়দের দল, এমনকি বিশুদ্ধ আড্ডাবাজরা স্রেফ আড্ডার টানেই সেখানে সমবেত হতো। একসময় বলা হতো, এটা অ্যাডবেস্ট নয়, আড্ডাবেস্ট।

আমাদের গোলমাল ফারুক ফুটবলে মোহামেডানের পাঁড় সমর্থক। তার তখন স্বপ্ন ছিলো, একদিন অনেক টাকার মালিক হয়ে সে মোহামেডান ক্লাবের কর্মকর্তা হবে। সত্যি কথা বলতে কী, এমন মোহামেডান-অন্তপ্রাণ আর কাউকে আমি দেখিনি। মোহামেডানের খেলার দিন বিকেলে তাকে কিছুতেই অফিসে পাওয়া সম্ভব নয়। অফিস থেকে পায়ে হেঁটে তিন মিনিটে স্টেডিয়াম, তাকে আর পায় কে! একদিন সন্ধ্যায় খেলা দেখে থমথমে মুখ করে ফিরেছে ফারুক। জিজ্ঞেস করার দরকার নেই, তার মুখই খেলার ফলাফল বলে দিচ্ছে। জানা গেলো, খুব বাজে টীমের কাছে সেদিন হেরেছে মোহামেডান। অফিসে কয়েক মিনিট অস্থিরভাবে পায়চারি করে ফারুক, তারপর একসময় ছুটে বাইরে যায়। কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলে বলে, শালার মোহামেডান ক্লাবে ঢিল মারতে যাই!

সে সময়ের আবাহনীর তারকা ফুটবলার টুটুলও নিয়মিত আসে আড্ডা দিতে। ফারুকের সঙ্গে তার বিশেষ সখ্য যেমন ছিলো, আবাহনী-মোহামেডান নিয়ে তর্কবিতর্ক, খোঁচাখুঁচিও কম হতো না। ঠাট্টার ছলে মোহামেডানকে হেয় করা ছোটো ছোটো মন্তব্যে ফারুককে উত্যক্ত করায় টুটুল ছিলো এক প্রতিভাবিশেষ। ফারুক রেগেমেগে হৈ চৈ শুরু করে দিলে আমরা মজা দেখি। একদিন এরকম খোঁচাখুঁচি চলছে, ফারুকের গলাও চড়ছে। মিটিমিটি হাসতে হাসতে টুটুল কিছু একটা মন্তব্য করতেই ফারুকের উত্তেজনা চরমে উঠে যায়। তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে, হাত-পা নেড়ে চিৎকার করতে করতে চেয়ারে ওপর উঠে দাঁড়ায় এবং আমার জীবনে শোনা শ্রেষ্ঠতম কৌতুককর প্রশ্নটি সে করে টুটুলকে, আপনে মিয়া ফুটবলের কী বোঝেন?

Thursday, May 8, 2008

রবীন্দ্রসংগীতের শক্তি : আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটি রচনা

১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারিতে মৃত্যুর আগে এটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সর্বশেষ রচনা। প্রথমে লেখা হয় ৯৬-এর ৮ ডিসেম্বর জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ঢাকা সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের বার্ষিক সম্মেলনের জন্যে লিখিত বক্তব্য হিসেবে। অসুস্থতার জন্যে ইলিয়াস উপস্থিত হতে না পারায় লেখাটি সেখানে পাঠ করে শোনানো হয়। পরে বদরুদ্দীন উমরের ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশে লেখক সম্মতি দিয়ে জানান, তিনি আরো কিছু কথা সংযোজন করতে চান। তখন তাঁর আর নিজে লেখার অবস্থা নেই, ডান হাত ভাঙা। ডিকটেশন দেবেন, গলা ও ফুসফুসের সমস্যায় কথা বলায়ও সমস্যা। তারপরেও এই রচনায় আরো কিছু সংযোজন তিনি করতে পেরেছিলেন। ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো নিচের ভাষ্যটি।

রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁকে নিয়ে লেখা বাংলা ভাষার আরেকজন প্রধান (এবং প্রয়াত) লেখকের এই রচনাটি প্রাসঙ্গিক মনে হলো। তাই তুলে আনা।


তথাকথিত পাকিস্তানি সংস্কৃতির অজুহাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা কখনো স্তিমিত হয়নি। বরং সরকারি প্রচারমাধ্যমগুলো রাজনীতি প্রচার ও সংস্কৃতিচর্চায় কোনোরকম ভূমিকা পালন করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। নইলে ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্ভব হল কী করে? সুস্থ সংস্কৃতিচর্চায় সরকারি রক্তচক্ষু বিঘ্নের সৃষ্টি তো করতে পারেইনি বরং শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের রুখে দাঁড়াবার জন্য প্ররোচিত করেছে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে পাশ্চাত্যের ব্যান্ড মিউজিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলে বোঝা যায় রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা বেড়েছে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি। রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করা কিংবা ছোট করার অপচেষ্টা এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষিত মানুষের সমর্থন পায়নি, এখনও পায় না।

এটা রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিশেষ কোনো অনুরাগ বা ভক্তির নিদর্শন নয়। রবীন্দ্রনাথের গানের প্রধান আবেদন ব্যক্তির কাছে। এই আধুনিক ব্যক্তি যে-সমাজে গড়ে ওঠে, আমাদের দেশে সেই সমাজ এখন নির্মীয়মান। নানা কারণে এ-সমাজে ব্যক্তির বিকাশ স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক হচ্ছে না। এই সমাজগঠনের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বনির্ভর রাষ্ট্র। কিন্তু বিদেশি সাহায্য সংস্থাসমূহের রাষ্ট্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ, তাদের পরোক্ষ উস্কানিতে ধর্মান্ধ অপশক্তির উৎপাত প্রভৃতির কারণে রাষ্ট্র যেমন শক্ত হতে পারে না, ব্যক্তির স্বাভাবিক বিকাশেও তেমনি পদে পদে বিঘ্ন ঘটে।

রবীন্দ্রচর্চায় মাঝে মাঝে যে বিঘ্নের সৃষ্টি করা হয় তার কারণ কিন্তু তথাকথিত পাকিস্তানি সংস্কৃতি নয়। বরং সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট ধর্মান্ধদের উৎপাত। এই উৎপাত কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন এইসব ইতর লোকদের বিরুদ্ধে একটু সংঘবদ্ধ হলেই এরা গর্তে ঢুকে পড়ে।

সিংহভাগ শিক্ষিত মানুষের রাজনৈতিক মতামত যা-ই হোক-না কেন, একটি আধুনিক সমাজের সদস্য হওয়ার জন্য তারা উদগ্রীব। সুতরাং পঙ্গু হোক, রুগ্ণ হোক, ব্যক্তির বিকাশ এখানে কোনো-না-কোনোভাবে ঘটেই চলেছে।

এই ব্যক্তির একান্ত অনুভব সবচেয়ে বেশি সাড়া পায় রবীন্দ্রসংগীতে। তাই এই পঙ্গু বা রুগ্ণ ব্যক্তিটিকে বারবার যেতে হয় তাঁর গানের কাছেই।

রবীন্দ্রনাথ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যে-ব্যক্তিকে তিনি শক্তসমর্থ মানুষ। আমাদের পঙ্গু ব্যক্তি রবীন্দ্রসংগীতে নিজেকে শনাক্ত করতে চায় শক্ত মানুষ হিসেবে। হয়তো এই দেখাটা ভুল কিন্তু এই ভুল দেখতে দেখতেই সে একদিন শক্ত একটি ব্যক্তিতে বিকশিত হতেও তো পারে। তখনই গড়ে ওঠে ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্ববান মানুষ দায়িত্বশীল, সে কেবল নিজেকে নিয়ে মুগ্ধ থাকতে পারে না। তাই তার চারদিকের মানুষের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে ওঠে। রাশিয়ার চিঠিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আকর্ষণে কোনো ভ্রান্তি ছিল না। অসাধারণ শক্তিমান মানুষ যে-কোনো জনগোষ্ঠীর কল্যাণ ও মঙ্গল দেখে সন্তুষ্ট হতে বাধ্য।

বাংলাদেশেও ব্যক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গান যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছে। এবং শক্তসমর্থ ব্যক্তিগঠনে এই গান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। রবীন্দ্রনাথের গান মানুষকে বিপ্লবের দিকে উদ্বুদ্ধ করবে না। কিন্তু শক্তসমর্থ ব্যক্তিগঠনে রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষমতা অসাধারণ। শক্ত মানুষের সমবেত শক্তি মানববিরোধী অচলায়তন ভাঙার অন্যতম প্রেরণা তো বটেই।

* * * * * * * *

লেখাটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনাসমগ্র ৩ থেকে নেওয়া হয়েছে।

Sunday, May 4, 2008

ঠিক আত্মপক্ষ সমর্থন নয়

ঢাকায় আমার কিছু প্রতিভাবান বন্ধু আছেন। এঁরা কোনো বিখ্যাত সেলিব্রিটি নন, কিন্তু এঁদের বিস্ময়কর উদ্ভাবনী প্রতিভায় আমি বরাবর মুগ্ধ কখনো কখনো ভুক্তভোগী। ২০০৬ সালে রমজান মাস শুরু হবো-হবো, ঢাকায় পত্রিকাগুলির ঈদসংখ্যার প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে, দুয়েকটা এমনকি বাজারে এসেও গেছে। এইসময় ঢাকা থেকে এক বন্ধু (ইনি প্রতিভাবান নন) ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি নাকি অমুক পত্রিকায় উপন্যাস লিখছো?

বিস্মিত না হয়ে উপায় কী! প্রথমত, ঐ অমুক পত্রিকাটির নাম শুনেছি, চোখে দেখিনি। তবে আমাদের এক বন্ধু (যাঁর প্রতিভার আগুনে আমি দগ্ধ হবো অচিরে) সে পত্রিকায় খণ্ডকালীন কাজ করেন জানি। কিন্তু ঐ কাগজে ঈদসংখ্যা দূরে থাক, এমনিতেও লেখালেখি বিষয়ে আমার বন্ধুর সঙ্গে কখনো কথা হয়নি। সুতরাং আমি উপন্যাস লিখছি? কই, জানি না তো! ছাড়া অন্য কোনো কথা মুখে আসে না।

ফোনের অন্য প্রান্তে বন্ধুটি ধন্দে পড়ে, আমি হলেও পড়তাম। বস্তুত, ধন্দে আমি ততোক্ষণে পড়ে গেছি। কথাটা এলো কোত্থেকে? সেই অমুক কাগজের খণ্ডকালীন কর্মী আমার বন্ধুকে ফোনে ধরি অনেক কষ্টে। তিনি একটি মোবাইল ফোন বহন করেন বটে, তবে প্রায়ই তার উপস্থিতি ভুলে যান অথবা রিং এলে না-ধরলে-কী-হয় জাতীয় দার্শনিকতায় উপেক্ষা করতে পারেন। দয়াপরবশ হয়ে যখন তিনি ফোনে হ্যালো বললেন এবং ঘটনার বিবরণ দিলেন, আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হওয়ার অবস্থা। আমার সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ না করে তিনি তাঁর সম্পাদককে জানিয়ে দিয়েছেন, আমার কাছ থেকে তিনি একটি উপন্যাসের প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন এবং লেখাটি এই এলো বলে!

তার চেয়েও ভয়ংকর কথা, সম্পাদকের কাছে অলিখিত ও অকথিত উপন্যাসটি আসছে বলার পরও তিনি আমাকে বিষয়টি জানানোর দরকারই মনে করেননি। আমি কিছু উষ্মা প্রকাশ করলে তিনি নির্বিকার বললেন, আমি জানি আপনার কাছে লেখা তৈরি আছে। আর না থাকলেও এক সপ্তাহের মধ্যে একটা নামিয়ে দিতে পারবেন।

‘যদি সে ভালো না বাসে’ লিখতে হলো দুই সপ্তাহের মধ্যে। বিরক্তি, প্রস্তুতিহীনতা, সময়ের স্বল্পতা, ঈদসংখ্যায় ফরমায়েশি আকৃতির ‘উপন্যাস’ লেখার অনিচ্ছা নিয়েও। বন্ধুর প্রতিশ্রুতির (হোক তা বাগাড়ম্বর, আর কারো তা জানারও দরকার নেই) সম্মানটুকু আমাকে রাখতে হয়।

কোথা থেকে কে জানে, ডিমের ভাঙা কুসুমের মতো সূর্যের আলো কথাটা মাথায় এলো। ঠিক আছে, তাই দিয়েই শুরু হোক। দেখা যাবে কোথায় গিয়ে ঠেকে। চরিত্রগুলির মধ্যে এক জামাল খানিকটা পরিচিত। নীলা-নিশি-ইরফান বা আর কাউকে চিনি না। তাদের তৈরি করতে হলো একাধিক চেনা মানুষের এটা-ওটা মিলিয়ে। প্লুটোর গ্রহত্বমোচন নিয়ে তখন কিছু হৈ চৈ, আচ্ছা তাকেও ঢুকিয়ে ফেলো।

সময় কম তো বটেই, এদিকে আকৃতি যাতে খুব বড়ো না হয় তা-ও দেখতে হবে। শেষ না হলেও শেষ করে ফেলো। তাই হলো।

এই রচনা অসম্পূর্ণ। উপন্যাস তো নয়ই। হয়তো টেনে লম্বা করা একটি বড়োগল্প, অথবা দু’তিনটি গল্প জোড়া দিয়ে একটা পাঠক-ঠকানোর গোঁজামিল। আনোয়ার সাদাত শিমুলকে উদ্ধৃত করে বলা যায় ‘বনসাই উপন্যাস’। কী সর্বনাশ, আমার তৈরি অস্ত্রে আমি নিজে আক্রান্ত – ‘দিয়াশলাই’ সংকলনের কিছু গল্পকে আমি ‘বনসাই গল্প’ বলে চিহ্নিত করেছিলাম।

প্রশ্ন হলো, লেখাটি সচলায়তনে ধারাবাহিকভাবে কেন পোস্ট করলাম? একটিমাত্র কারণে। লেখাটির মধ্যে সম্পূর্ণ উপন্যাস হয়ে ওঠার একটা সম্ভাবনা আমি দেখতে পাই। পোস্ট করে কিছু পাঠক মতামত পেলে কাজটা সম্পূর্ণ করার বাসনা ছিলো। বিশেষ করে লেখার দুর্বলতার দিকে কেউ কেউ নির্দেশ করবেন ভাবছিলাম। সে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সফল যেমন হয়নি, একেবারে ব্যর্থ তা-ও বলা চলে না। টুকরো কিছু মন্তব্য ছাড়াও শেষ পোস্টে আনোয়ার সাদাত শিমুলের নাতিদীর্ঘ আলোচনায় অনেকগুলি জিনিসই সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তার নির্দেশ করা দুর্বলতা ও অসম্পূর্ণতাগুলি নিয়ে আমার কিছুমাত্র দ্বিমত নেই। বরং সমালোচনাটি আরো তীব্র হতে পারতো, শিমুল ভদ্রতাবশে হয়তো কিছু চেপে গেছে। বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে কিছু ছাড়ও হয়তো পেয়ে গেছি।

‘যদি সে ভালো না বাসে’ যাঁরা পড়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন, তাঁদের কাছে আমার অসীম কৃতজ্ঞতা। যাঁরা পড়েননি, তাঁরাও এক অর্থে আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন! সুতরাং ধন্যবাদ তাঁদেরও।

--------------------
২৭ এপ্রিল ২০০৮
--------------------

জাদুস্পর্শ

বাবা, কী হয়েছে তোমার বলো তো?
এই তো সামান্য অসুস্থ।
তুমি কিছু লুকাচ্ছো?
না তো, কেন?
আজ চারদিন ধরে দেখছি তুমি বেশিরভাগ সময় ঘুমাচ্ছো, না হয় চুপ করে শুয়ে আছো।
বুকে কফ জমেছে।
তা জানি, কাশি শুনতে পাই। জ্বরও আছে জানি। আর কিছু তো জানতে পারছি না।
একটু আগে ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরেছি, মেয়ে তখন ক্লাসে ছিলো। তাকে বলি না, আর দু’একদিন দেরি হলে আমার নিউমোনিয়া হয়ে যেতে পারতো। অযথা তার উদ্বেগ বাড়িয়ে কাজ কী? বলি, তেমন কিছু না।
তোমাকে এতো লম্বা সময় বিছানায় দেখি না। সত্যি বলো, তুমি কিছু লুকাচ্ছো না!
মিথ্যা করে বলি, সত্যি না। এই যে তুই ছুঁয়ে দিলি, এখন আমি সেরে উঠবো।
মেয়ে, কে জানে কেন, হঠাৎ দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠে।
বলি, এই তোর আবার কী হলো? তোকে বলা হয়নি, কাল আমি সারাদিনে সাতটা সিগারেট খেয়েছি, আজ এ পর্যন্ত দুটো।
চোখ মুছে মেয়ে বলে, তুমি সত্যি বলছো এবার ছাড়বে?
মনে মনে বলি, তোদের জন্যে আমি হয়তো মরতেও পারবো না। আমি এতো দরকারি মানুষ কবে হয়ে উঠলাম? কীভাবে?

------------------
২৬ এপ্রিল ২০০৮
------------------

‘দিয়াশলাই’-এর গল্পগুলি : এক পলকে একটু দেখা

প্রথমে বন্দনা করি….

সচলায়তনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর বর্ষপূর্তি হতে এখনো প্রায় আড়াই মাস বাকি। সে হিসেবে বয়স দশ মাসও হয়নি। এরই মধ্যে শতকরা একশোভাগ নিজস্ব মালমশলা দিয়ে তিন তিনটি প্রকাশনা রীতিমতো গর্ব করার মতো অর্জন তো বটেই। সবগুলি ই-বুক, সচলায়তন যার নাম দিয়েছে বe, হিসেবে ধরছি না, কারণ এগুলির কোনোটা আগেই মুদ্রিত গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত, কোনোটা অসম্পূর্ণ ইত্যাদি। এই তিনটি পূর্ণাঙ্গ প্রকাশনার একটি প্রথাগত মুদ্রণ মাধ্যমে, বাকি দুটি আন্তর্জালিক (নাকি অন্তর্জাল? এই সংশয় আমার আজও গেলো না। ইন্টারন্যাশনাল যদি আন্তর্জাতিক হয়, ইন্টারডিপার্টমেন্ট যদি আন্তবিভাগীয় হয়, তাহলে ইন্টারনেট আন্তর্জাল নয় কেন?)।

মুদ্রিত গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত সংকলনটি এখনো দেখা হয়নি। শুনেছি মুদ্রণঘটিত ও দূরপাল্লার সম্পাদনা সংক্রান্ত কিছু গোলমাল থেকে গেছে। প্রথম ভার্চুয়াল বই আরিফ জেবতিকের সম্পাদনায় ফেলে আসা ছেলেবেলা-ও জন্মেছিলো কিছু ত্রুটি নিয়ে। দুটি ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট কাউকে দোষারোপ করার উপায় নেই। তবে দিয়াশলাই-এর তিন তরুণ সম্পাদক আগের অসম্পূর্ণতাগুলি সম্পর্কে আগাগোড়া সজাগ ছিলেন তা স্পষ্ট বোঝা যায় এই বইয়ের পরিপাটি সাজসজ্জা দেখে।

একটা বিষয় ভেবে মজা লাগে, বিস্ময়ও কম হয় না। সম্পাদক তিনজনের বসত পৃথিবীর তিন মহাদেশে – অমিত আহমেদ উত্তর আমেরিকায়, আনোয়ার সাদাত শিমুল এশিয়ায় এবং কনফুসিয়াস ওরফে মু. নূরুল হাসান অস্ট্রেলিয়ায়। আফ্রিকায় সচল কেউ আছেন কি না আমি নিশ্চিত নই, তবে ইউরোপ থেকেও একজনকে রাখলে মন্দ হতো না। তা এই তিন ভুবনের তিন বাসিন্দা স্থানকালের বিস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও প্রযুক্তিকে সম্বল করে এক অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছেন। এখন থেকে দশ বছর আগেও হয়তো তা প্রায়-অসম্ভব ছিলো। অভিনন্দন তাঁদের প্রাপ্য।

অণুগল্প

অণুগল্প কী? তার সংজ্ঞা কীভাবে নির্ধারিত হয়? তার বৈশিষ্ট্য কী? স্পষ্ট কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ হয়তো সম্ভব নয়। তবে আমি যা বুঝি তা অনেকটা এরকম: পরিসরে অবশ্যই ছোটো, কিন্তু এতে থাকতে হবে পাঠককে সচকিত করে তোলার মতো কিছু একটা। থাকবে তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতা। তীরের মতো ঋজু ও লক্ষ্যভেদী। স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠা কোনো অনুভূতি। কোনো ধোঁয়াশাময় বর্ণনা নয়। হয়তো স্কেচ, কিন্তু স্পষ্ট দাগে আঁকা। অল্প কথায় অনেক কথা বলে যাওয়া, তবে পাঠককে যেন বোঝার আশা জলাঞ্জলি দিতে না হয়। সচলায়তনে নজমুল আলবাব ও সুমন চৌধুরী এই গোত্রের গল্পলেখক।

আবার অন্যদিকে কোনো একটা লেখা শুধু পড়ে যেতে ভালো লাগছে, মজা লাগছে, লেখক খুব আবছা কোনো বক্তব্য/ইশারা সেখানে মিশিয়ে রেখেছেন, পাঠক লক্ষ্য না করলেও ওই মজা ও পড়তে ভালো লাগার কারণেই তা সার্থক গল্প হয়ে ওঠে। সচলায়তনে এই ঘরানার একজন লেখক আছেন, তিনি সবুজ বাঘ।

অণুগল্প সংকলন ‘দিয়াশলাই’

এখন সুদৃশ্য প্রচ্ছদের ওপারে যাওয়া যাক। দিয়াশলাই সংকলনে জায়গা পেয়েছে ৩০ জন লেখকের মোট ৩৫টি গল্প। এর মধ্যে ১টি অনুবাদ।

দিয়াশলাই সংকলনের গল্পগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারি – পরমাণু, অণু, স্বয়ংসম্পূর্ণ, বনসাই এবং হলো না লো হলো না

পরমাণু

‘দিয়াশলাই’ সংকলনে বিস্ফোরক শক্তিধর মৌলিক পরমাণু গল্পগুলির লেখক সুমন চৌধুরী ও অলৌকিক হাসান। মোট ৫টি গল্প এই শ্রেণীতে। সম্পাদকরা ৫০০ শব্দে গল্প লিখতে বলেছিলেন, সুমন চৌধুরী সর্বসাকুল্যে ২০৪টি শব্দ খরচ করে (শিরোনামসহ ২০৮) ৪টি গল্প লিখে ফেলেছেন। প্রতিটি গল্পের ভাষা অতিশয় সাদামাটা, অথচ কী উজ্জ্বল, সম্পূর্ণ ও লক্ষ্যভেদী। প্রথম গল্পের নাম । স্বরবর্ণের ব্যবহার ছাড়াই ব্যঞ্জনবর্ণের একটিমাত্র অক্ষরে পরমাণু গল্পের পরমাণুসম শিরোনাম। পরমাণুর শেষতম ধাপে, আর ভাঙা যাবে না। সুমনের ৪টি গল্প ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের, তবে প্রথম () ও শেষ গল্প (বাটোয়ারা) দুটিকে অসাধারণ বললেও যথেষ্ট বলা হয় না।

৮৭টি শব্দে অলৌকিক হাসান লিখেছেন পাস ফেল। খুব নিটোল সুন্দর একটি গল্প। যথার্থ পরমাণু। একটু যত্নবান হলে শব্দসংখ্যা আরো কমানো যেতো। ছোটো একটি ঘটনা, ছোটো একটি অনুভব – এইটুকুই গল্পের সম্বল, অথচ মনোহর ও চমৎকার। একটি খচখচ করা ত্রুটি। ‘মরার মতো’ বা ‘মরার ঘুম’ ৪ প্যারার এই গল্প ৪ বার ব্যবহার করা হয়েছে ভুল বানানে। শব্দটি ‘মড়ার’।

সংকলনের একমাত্র অনুবাদ গল্পটিও (লাভ স্টোরি) পরমাণু শ্রেণীভুক্ত। শব্দসংখ্যা ৮০-র নিচে। শুরু থেকে গল্পটিকে এক যুগলের প্রেমের সংলাপ বিনিময় বলে ধারণা হয়, যদিও স্বামী ও স্ত্রী বলে দেওয়া আছে, সেভাবেই সংলাপগুলি পরপর সাজানো। পড়ার সময় কে আর অতো খেয়াল করে। মনে হতে থাকে, অনেক নিষেধ ভেঙে তাদের সম্পর্ক স্বপ্নময় একটি পরিণতির দিকে যাচ্ছে। অথচ শেষের একটিমাত্র বাক্যে জানা যায় তারা যাচ্ছে ডিভোর্সের জন্যে। গল্পের মূল লেখক ম. লিপস্কেরভ। দুর্দান্ত গল্পটির অসাধারণ অনুবাদ করেছেন সংসারে এক সন্ন্যাসী। শিরোনামটিকেও অনুবাদে প্রেমকাহিনী বলা যেতো বোধ করি।

অণু

অণুগল্প শ্রেণীতে পাচ্ছি ৫টি গল্প। হিমু ওরফে মাহবুব আজাদের ২টি এবং কনফুসিয়াস, আনোয়ার সাদাত শিমুল, নিঘাত তিথি ও মুজিব মেহদীর ১টি করে গল্প।

হিমুর গল্প দুটির নাম হাতিসোনাকপাল। হিমুর প্রায় সব রচনাতেই ব্যঙ্গ-পরিহাসের একটা ঝোঁক থাকে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হাতিসোনা অনেকটা কৌতুকের ছলে বলা হলেও চাপা-পড়া কষ্টও আগাগোড়া টের পাওয়া যায়। ‘হাতিরা ভোলে না’ – গল্পের এই অন্তিম বাক্যে ঠোঁটের কোণে অকস্মাৎ একটা স্মিতহাস্য উঠে আসার উপক্রম হতেই কোথাও একটা টান পড়ে। সে হাসি তখন আর কৌতুকের নয়, তা ফাটা-ঠোঁটে হাসতে যাওয়ার বিড়ম্বনার মতো বোধ হতে থাকে। কপাল-ও একটি নিখুঁত অণুগল্প। তবে ছোটো একটি নালিশ। মোনোপোলি খেলার সঙ্গে যাঁদের পরিচয় নেই, তাঁদের কাছে এই গল্পের কোনো আবেদন থাকবে বলে মনে হয় না।

কনফুসিয়াস অথবা মু. নূরুল হাসান গল্পসহ বিবিধ ধরনের গদ্যরচনা করে থাকেন। এই সংকলনে তাঁর বনসাই আমার প্রত্যাশা মেটায় না। গল্পটি সাদামাটা, বর্ণনা ও ভাষায়ও ধারালো লাগলো না। রচনাটি লেখকের শক্তিমত্তার পরিচায়ক নয়, এর চেয়ে অনেক উৎকৃষ্ট গল্প আমরা তাঁর কাছে পেয়েছি। সম্পাদনার ব্যস্ততায় হয়তো গল্পে মনোযোগ দিতে পারলেন না।

আনোয়ার সাদাত শিমুলের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় বছরখানেকের কিছু বেশি হবে। লেখক হিসেবে এই নবীন যুবক ক্রমশ অগ্রসরমান। দুর্বলতাগুলি কাটিয়ে উঠছেন, লেখালেখির পাঠশালায় অক্লান্ত পরিশ্রমী শিক্ষার্থীর মতো মনে হয়, নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়ার চেষ্টাও দেখা গেছে। দৈনন্দিন শিমুলের এই এগিয়ে যাওয়ার একটি স্মারক হয়ে থাকছে বলে আমার ধারণা। এই গল্পটি বোধহয় কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বাঁধা পড়ে না, এটি মানুষের নিজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার চিরকালের গল্প।

নিঘাত তিথির বন্ধু গল্পটা ভালো লাগে। সন্ধ্যার মুখে এক নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ ও বাড়ির কিশোর বয়সী কাজের ছেলেটি কোনো কথা না বলেও কথা বিনিময় করে, এইটুকুই গল্প। আদর্শ অণুগল্প। বর্ণনার অংশে নিঘাত তিথি আরেকটু সতর্ক ও যত্নবান হলে লেখাটির ধার অনেক বেড়ে যেতে পারতো। ‘এখন হাতে থাকা অফুরন্ত সময়ের অধিকাংশই কাটে অলস ভাবনা আর বিগত দিনের দেনা-পাওনার হিসেব কষে।’ – এই ধরনের বাক্য কিন্তু একটু ক্লিশে ও জীর্ণ-প্রাচীন মনে হয়।

মুজিব মেহদীর তর্কপ্রগতির জন্য প্রকল্পিত একটি অসমাপ্ত সেমিনারের প্রতিবেদন গল্পটি চমৎকার, গতানুগতিক গল্পের অনুগামী নয়। তবে অণুগল্পের নামটি মাইলখানেক দীর্ঘ কেন বোঝা গেলো না। গল্পে কমা ছাড়া অন্য কোনো যতিচিহ্নের ব্যবহার নেই। হয়তো পাঠককে চমকে দেওয়ার চেষ্টা। নাকি এসবের অন্য কোনো ব্যাখ্যা/ব্যঞ্জনা আছে যা আমি ধরতে পারিনি! ভুল বোঝাবুঝির ঝুঁকি নিয়েও বলি, সংলাপে ‘মশাই’ শব্দটি কানে লাগে, বড্ড কৃত্রিম শোনায়।

স্বয়ংসম্পূর্ণ

অণুগল্প সংকলনের বেশ কয়েকটি রচনা স্বল্প পরিসরেও সম্পূর্ণ গল্প হয়ে উঠেছে। এই গল্পগুলি প্রথাসম্মতভাবে লেখা, আকারে ছোটো বলেই সেগুলিকে অণুগল্প বলে সায় দিতে ইচ্ছে করে না।

বিবাগিনীর বাবা আর কাঠগোলাপ গাছ একটি সুন্দর মন-ভালো-করা গল্প।

অমিত ওরফে আহমেদ রাহিদ নিয়মিত লেখেন না। তাঁর এগারোটি রজনীগন্ধা পড়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, কেন লেখেন না? মনে হয় গল্পটি ঠিক অণুগল্প হিসেবে লেখার কথা ভাবাই হয়নি। গল্পের অতি দীর্ঘ প্রথম প্যারা অণুগল্পের উপযুক্ত বলে ভাবা মুশকিল। সম্ভবত লেখার চর্চা অনিয়মিত বলেই অমিতের ভাষা ও বর্ণনা কিছুটা আড়ষ্ট। কোনো মিল নেই, কিন্তু এই গল্পটা পড়তে পড়তে হঠাৎ ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখা ছবিটার কথা মনে পড়লো।

মোহাম্মদ আবদুল মুকিত, যাঁর ব্লগনাম জ্বিনের বাদশা, লিখেছেন টান নামে একটি গল্প। সহজ-সরল ভাষায় লেখা নিটোল ও সম্পূর্ণ গল্প। অণু বা পরমাণূ গল্প হিসেবে এর একটি সম্ভাবনা ছিলো। গল্পের শেষ বাক্য ‘হঠাৎ বাসার কড়াটার কথা খুব করে মনে পড়তে থাকে’ সেই ইঙ্গিতই দেয়।

মাহবুর লীলেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখার ক্ষমতা রাখেন। গল্প-কবিতা ছাড়াও লিখতে পারেন যা-খুশি ও যেমন-খুশি। তিনি ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন ছোট্টো পরিসরে লেখা তাঁর পোষায় না। কিন্তু সেখানেও যে উত্তমরূপে পারঙ্গম তিনি, চিঠির আকারে লেখা তৃষ্ণা গল্পটি সেই সাক্ষ্যই দেবে। সম্পাদকদের নির্ধারিত শব্দসংখ্যার মধ্যেই হৃদয়গ্রাহী একটি সম্পূর্ণ গল্প দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। লীলেন প্যারার শেষে কোনো যতিচিহ্ন ব্যবহার করেন না, শুধুমাত্র প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছাড়া। নিশ্চয়ই এর একটা ব্যাখ্যা আমরা কখনো পাবো। এই গল্পের একটি বাক্যে আপত্তি জানিয়ে রাখি। ‘… মরার পরেও আমাকে তুই জেলাস করিস প্লিজ’ বাক্যে ‘জেলাস’ শব্দটিতে ব্যাকরণগত ত্রুটি ঘটে। আমি জানি মুখে বলার সময় এই কথাটি খুবই চালু। কিন্তু জেলাস করা যায় না, হওয়া যায়। এখানে জেলাস-এর বদলে ইংরেজি হলে এনভি লেখা যেতো। অথবা চমৎকার বাংলা শব্দ ঈর্ষা ব্যবহারটা আরো বেশি যুক্তিযুক্ত ও প্রত্যাশিত ছিলো।

মাশীদ আহমেদ গল্পের নামই দিয়ে রেখেছেন অণু-পরমাণু এবং শুরুতেই লিখছেন, ‘ এই গল্পের কোনো শুরু নেই, শেষও নেই। আবার হতে পারে, এটা কোনো গল্পও না…’। এবং গল্প শেষ করছেন এইভাবে, ‘… ততদিন গল্পটাও চলতে থাকবে। শুধু একেক সময় গল্পটা হবে একটা ল্যাব রিপোর্ট, একটা কনসার্ট, একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়া, একটা মুভি বা বই রিভিউ, একটা বিয়ে বা একটা ঝগড়া। এরকম একেকটা অণুগল্প-পরমাণুগল্প নিয়ে চলতে থাকে গোটা জীবনের উপন্যাস।’ সুন্দর সুলিখিত গল্প আগাগোড়া। শুধু শেষ বাক্যটা গল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, একদমই প্রয়োজন ছিলো না।

নজমুল আলবাব যথারীতি একটি দুর্ধর্ষ গল্প লিখেছেন। গল্পের নাম নিশি-নেশা। নামকরণে চমৎকারিত্ব কিছু নেই, কার্যকারণও ঠিক বুঝিনি। তাতে গল্পের কোনো ক্ষতি অবশ্য হয় না, গল্পের সার্থকতা ও আবেদন অক্ষুণ্ণ থাকে। ছোটো ছোটো বাক্যের প্রায় নৈর্ব্যক্তিক বিবরণে গল্পের উন্মোচন ঘটান লেখক। গল্প শুরু হচ্ছে এইভাবে: ‘কবির তড়পাচ্ছে। কানের পাশ থেকে একটা ধারা গড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত। চিৎ হয়ে পড়ায় হাত দুটো ছড়িয়ে আছে। সিগারেটটা ছিটকে যায়নি। কানের পাশ থেকে যাওয়া রক্তের ধারা সিগারেট নিভিয়ে দিল। কবির আমার দিকে তখনও তাকিয়ে আছে। চোখে অবিশ্বাস। আসলে এভাবে কথা ছিল না। আমরা আজ অন্য প্ল্যান নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু কবির নিজেই গোলমালটা লাগিয়ে দিল। আর এখন তড়পাচ্ছে। সে না তড়পালে হয়তো আমি তড়পাতাম। কিংবা বাদল নিজের রক্তে গড়াগড়ি খেত এতক্ষণে।’ এই বিবরণ পড়ে পাঠক হিসেবে এক অনিবার্য ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়ে যাই। প্রায় দম বন্ধ করে এগিয়ে যেতে হয়। রক্তের ধারায় সিগারেট নিভে যাওয়ার ছবিটি মাথায় গেঁথে থাকে। তিন ছিনতাইকারীর একজন কবির তাদের উদ্দিষ্ট শিকারটিকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ শিকার লোকটি খুঁড়িয়ে হাঁটে, সে মুক্তিযোদ্ধা ছিলো এবং যুদ্ধে আহত। কবির নিজেও এক মুক্তিযোদ্ধার পুত্র। শিকারকে পালাতে দিয়ে সে সঙ্গী একজনের (গল্পের আমি) হাতে গুলিবিদ্ধ হয়। ‘… কবির উদ্দিনের লাশটা কানাগলির শেষপ্রান্তের মাঠে পড়ে থাকে। অন্ধকারে।’ নজমুল আলবাবের গল্পটি আক্রান্ত করে, পড়ার পর অনেকক্ষণ থম ধরে বসে থাকতে হয় আমাকে।

অমিত আহমেদের গল্পের নাম অবশেষে অরিন্দম…। অল্প পরিসরেই লেখাটি প্রথাসম্মত সম্পূর্ণ গল্প হয়ে উঠেছে। অণুগল্পের টান টান ব্যাপারটি অনুপস্থিত, যদিও সম্ভাবনা ও সুযোগ বিদ্যমান ছিলো।

মায়িশার আম্মার সাথে দায়িত্বশীল দুপুর হাসান মোরশেদের গল্প। ঘটনা বর্ণনায় ও পরিস্থিতি তৈরিতে হাসান মোরশেদ বরাবরই দক্ষ। বক্তব্যেও তীক্ষ্ণ। এই গল্পটিতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু এই গল্পে মায়িশার আম্মা ঠিক কীসের দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলছে তা অস্পষ্ট। আর ‘প্যালেস্টাইনে মরেছে আরো কয়েক ডজন, দারফুরে শিশুর চেয়ে শকুনের পুষ্টি বেশি, বাংলাদেশে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর নিরন্নের মিছিল। কোন হারামজাদা যেনো উপদেশ দিলো ভাতের বদলে বিষ খেতে।’ লাইনগুলি লেখকের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ যতোটা তুলে আনে, গল্প হিসেবে লেখাটি ঠিক ততোটুকুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অতন্দ্র প্রহরী বা শাহরিয়ার মামুনের ট্রাফিক সিগন্যালে একদিন প্রতিদিনের জীবন থেকে তুলে আনা এক টুকরো গল্প। প্রহরীকে গল্পের বর্ণনা ও ভাষা ব্যবহারে যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দেওয়া যায়।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী কোনো এক ব্লগপোস্টে নিজেই বলেছিলেন, জীবনে হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র গল্প লিখেছেন তিনি। অমিতকে যে প্রশ্নটা আগে করেছি, এখন শোমচৌকেও একই প্রশ্ন করা দরকার: কেন? কী কারণে গল্প লেখেন না আপনি? সংকলনে অস্তিত্বের অন্ধকার পড়ে ধারণা জন্মায়, এই লেখক লেখেন অতি স্বচ্ছন্দে, স্বতস্ফূর্তভাবে। এই গল্প সম্পর্কে আমার অনুভূতি ও প্রশ্নগুলি হাসান মোরশেদ আলাদা একটি পোস্টে করে ফেলেছেন। সেগুলির পুনরুক্তি আর করার দরকার নেই। তবে এতো অল্প শব্দ খরচ করে একটি সম্পূর্ণ গল্প লেখার কৌশলটা আমাকে এবার শিখতে হবে।

এই শ্রেণীভুক্ত সর্বশেষ দুটি রচনা আসলে কল্পগল্প। সবজান্তা নামের আড়ালের জ্যোতির্ময় বনিক লিখেছেন প্রাগৈতিহাসিক এবং লুৎফুল আরেফীনের গল্পের নাম আফসোস। দুঃখের সঙ্গে বলি, কল্পগল্পের ভোক্তা হওয়ার যোগ্যতা আমার অর্জন করা হয়নি বলে কোনো মন্তব্য করছি না। তবে দুটি গল্পই পড়েছি।

বনসাই

যে গল্পগুলিকে আমি এই শ্রেণীভুক্ত করেছি, আমার বিচারে সেগুলির স্বাভাবিক বিকাশ ঘটতে দেওয়া হয়নি। অণুগল্প সংকলনের ৫০০ শব্দের বাধ্যবাধকতায় এই লেখাগুলি আটকা পড়ে গেছে। ডালপালা ছেঁটে ফেলা অবস্থায় কৃত্রিম আকৃতিতে সম্পূর্ণতা খুঁজছে।

শেখ জলিলের ক্লিনিক্যাল ডেথ গল্পটি আরেকটু বিস্তার অবশ্যই দাবি করে। পড়তে পড়তে মনে হয়, লেখাটা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে সামনে-পেছনে যাওয়া-আসা করছে। শেখ জলিল মূলত কবি হলেও গদ্য লেখার সময় তিনি বিশুদ্ধ গদ্যই লেখেন, কবিতাক্রান্ত গদ্যরচনা করেন না। এখানেই গদ্যলেখক হিসেবে তাঁর শক্তির পরিচয়। তৃতীয় প্যারায় ‘ঘুমের মধ্যে মা স্ট্রোক করেছেন’ বাক্যটিতে আপত্তি জানিয়ে রাখি। রোগী স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়, রোগী স্ট্রোক করে না।

ফকির ইলিয়াসের পলাতক গদ্যগ্রহ লেখাটিতে ঘটনার পরম্পরা বুঝতে সমস্যা হয়। কারণ সম্ভবত ঐ অণুগল্পের আকৃতিগত কাঠামোর ভেতরে রাখার সচেতন চেষ্টা। হায়, সুন্দর মনোগ্রাহী একটি কাহিনী থাকা সত্ত্বেও গল্পটি অসম্পূর্ণ থেকে গেলো। ‘আরেকটি পলাতক গদ্যগ্রহ দুজনের পাশ ঘেঁষে পৃথিবীর প্রান্ত ছুঁয়ে যায়’ – গল্পের এই শেষ বাক্যটি বুঝিনি। পলাতক গদ্যগ্রহ কথাটির মানে কি?

খেকশিয়াল ওরফে কৌশিক দে লিখেছেন তেপান্তর। সম্ভাবনা ছিলো, তার পূর্ণতার জন্যে লেখায় আরো অনেক বিস্তার ঘটানো দরকার ছিলো, শৃঙ্খলাবদ্ধ বর্ণনা ও সুসংবদ্ধ ভাবনার স্ফূরণ আবশ্যক ছিলো।

মেহেদি রাঙা হাত গল্পের লেখক ধুসর গোধূলি। এই লেখা পড়ে ধারণা হয়, ব্যস্ত ব্লগার গল্প রচনায় বেশি সময় ব্যয় করতে নারাজ। তাঁর অবলোকনে অনেক খুঁটিনাটি ধরা পড়ে, এই গল্পের ছোটো পরিসরেও তার নমুনা আছে। কিন্তু গল্পটা কোনোমতে শেষ করতে পারলেই যেন বাঁচেন। এতো তাড়া কীসের? বর্ণনা ও ভাষা ব্যবহারে কিছুটা প্রাচীনতার গন্ধ। তার নমুনা শুরুর বাক্যটিতেই আছে – ‘বসন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে …’। ২০০৮ সালের একজন নবীন লেখকের কাছে আরো টাটকা ও অশ্রুতপূর্ব বর্ণনা আশা করি আমি। আর কিছু না হলেও অন্তত ক্লিশেবর্জিত হওয়া তো দরকার।

দ্বিধা গল্পে ঝরাপাতা/অভ্রপথিক সুন্দর একটা বিষয় নিয়েছেন, তবু শেষ পর্যন্তা তা বনসাই গল্প হয়েই থেকে যায়।

গল্পের নাম বাথটাবে একা। লেখকের নাম জাহিদ হোসেন। এই লেখক কিছু গল্পে ইতোমধ্যে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর শক্তিমত্তা। এই রচনায়ও তার পরিচয় আছে। কিন্তু অণুগল্পের দাবি মেটাতে গিয়ে গল্পটি ফুটে উঠতে পারলো না। ‘সেই কখন থেকে হাতের শিরা কেটে বসে আছি বাথটাবে…’ অতিনাটকীয় লাগে। যেমন লাগে মিঠুর আত্মহত্যাও। চরিত্র দুটিকে ফুটে ওঠার সময় ও জায়গা দেওয়া গেলে এরকম বোধ হতো না বলে আমার বিশ্বাস।

নিঝুমের গল্পের নাম পুনশ্চঃ। দুটি দীর্ঘ প্যারা এবং পুনশ্চ পর্ব দিয়ে গল্পটি গল্পের আকৃতি নির্মাণ হয়েছে। গুনে দেখিনি, তবে নির্ধারিত ৫০০ শব্দই খরচ হয়ে গেছে বলে ধারণা করি। প্রথম প্যারা দুটি পড়ে আমার এই বিশ্বাসই পোক্ত হয় যে প্রচুর কাটছাঁট করা হয়েছে অথবা স্থান সংকুলান করতে না পেরে লেখক কোনোমতে গল্প শেষ করেছেন। দ্বিতীয় দীর্ঘ প্যারার শেষের কয়েকটি লাইন খাপছাড়াও লাগলো। নিঝুম লেখা বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠছেন, তাঁর উত্তরণের নমুনাও সচলে দেখা গেছে, কিন্তু এই গল্পে তাঁর নবলব্ধ সচেতনতা ও ক্ষমতা অব্যবহৃত দেখলাম।

হলো না লো হলো না

আকাশ অবশ্যই সূর্যের চেয়ে বড় গৌতম রায়ের গল্প। গল্পটি ঠিক কী বিষয়ে এবং গল্পটি কেন গল্প তা বুঝতে ব্যর্থ হলাম।

ইশতিয়াক রউফের দুই পাহাড় স্বগত সংলাপ হিসেবে পড়তে ভালো লাগে। টানা গদ্যে লেখা কবিতা বললেও বলা যায়, এতোটাই সুখপাঠ্য। একটি সুন্দর ভাষাভঙ্গি তাঁর আয়ত্ত্বে। কিন্তু এই লেখাটা ঠিক গল্প হলো কি? গল্প আরো একটু স্পষ্টতা দাবি করে।

পরিবর্তনশীল অথবা মহিবুল কবির সাম্প্রতিককালে তাঁর গল্প লেখার ক্ষমতা দেখিয়েছেন সচলায়তনে। নেই-বিষয় নিয়েও তিনি গল্প লিখতে জানেন। এই সংকলনে তাঁর লাল-সবুজ মেশানো শাড়ির গল্প তাঁর সেই সক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে না। এই রচনাটি সচলে ব্লগরব্লগর হিসেবে বেশ ভালো হয়। এরকম একটি গুরুগম্ভীর বিষয় অণুগল্পের জন্যে উপযুক্ত হয় না তা বলি না, কিন্তু তাকে সফল গল্প করার জন্যে এই নবীন লেখকের আরো প্রস্তুতি দরকার বলে মনে হয়। আবেগ গল্প রচনার একটি উপাদান বটে, কিন্তু একমাত্র উপাদান নয়। এই লেখায় আবেগটি উপস্থিত, কিন্তু গল্পের আর সব উপকরণ কোথায়?

পথে শিরোনামে মুজিব মেহদীর অপর রচনাটি কবিতাক্রান্ত গদ্যরচনা। গল্প কি?

সর্বশেষ

একটি কথাই বলার। আমার অকপট বিরূপ মন্তব্য কাউকে আহত করার জন্যে নয়, বরং দুর্বলতাগুলি বিষয়ে একটু সচেতন করার চেষ্টামাত্র – এইটুকু বিশ্বাস করলে খুশি হই। মঙ্গল হোক সবার।

-------------------
২০ এপ্রিল ২০০৮
-------------------

ভাত বনাম আলু অথবা অন্যকিছু

মনে পড়ে, ১৯৭৪-এ দুর্ভিক্ষ যখন আসছে সেই সময়ও বিকল্প খাদ্যাভ্যাস হিসেবে একবেলা রুটি বা আলুর কথা বলা হয়েছিলো সরকারি তরফে। তার প্রতিক্রিয়া এখন যা হচ্ছে তার চেয়েও অনেক তীব্র হয়েছিলো তখন। কারণ ছিলো প্রধানত দুটি। এক, স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলের চেয়ে শস্তায় চাল পাওয়া যাবে – মানুষের এই প্রত্যাশা পূরণ করা যায়নি বাস্তব কারণেই এবং তা হতাশার কারণ ঘটিয়েছিলো। দুই, সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা এখনকার চেয়েও অনেক গুণে খারাপ ছিলো এবং বিকল্প উপার্জনের উপায়ও সুলভ না।

আমি ব্যক্তিগতভাবে দীর্ঘকাল ধরে ভাত-নির্ভরতা কমানোর পক্ষে। ১৯৭৭-৭৮ থেকে আমি সচরাচর দিনে একবেলার বেশি ভাত খাই না, এমনকি ভাত ছাড়াও কয়েক সপ্তাহ দিব্যি থাকতে পারি কোনোরকম শারীরিক ও মানসিক অস্বস্তি ছাড়াই। দেশে থাকাকালে আমার এই কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বন্ধুবান্ধবের অনেক ঠাট্টাও হজম করতে হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, সেই ৭৪-এ আমাদের একটা নিদারুণ অভিজ্ঞতা হলো, যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলাফল হিসেবে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনেক উত্থান-পতন ঘটলো। বন্যা ও ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলি আগের মতোই নিয়মিত বিরতিতে হতে থাকলো। অথচ আমাদের রাষ্ট্রের শাসক বা সমাজের নেতারা নির্বাক ও নিশ্চল হয়ে থাকলেন। ৭৪ এবং তৎপরবর্তীকালের ঘটনাবলি থেকে বিন্দুমাত্র শিক্ষা নিলেও বিকল্প খাদ্যাভ্যাস তৈরিতে মানুষকে উদ্দুদ্ধ ও অভ্যস্ত করে তোলা অসম্ভব ছিলো বলে আমি মনে করি না। পরিবার পরিকল্পনার মতো দুরূহ কর্মসূচিতেও প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় আমাদের সাফল্য বেশি – এটাও তো বাস্তব। সুতরাং একটা পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে ভাতের ওপর আমাদের নির্ভরতা অর্ধেক না হোক, সিকিভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। বিকল্প হিসেবে গম বা আলু বা ভুট্টা অথবা অন্যকিছু চিন্তা করা যেতো। ভাতের বদলে আলু বা রুটি খাওয়া দোষের হবে কেন? আজকের কাগজে দেখলাম, ভুট্টার রুটি খাওয়ার সংবাদ এসেছে। এটা সংবাদ হওয়ার কথা ছিলো না। ভুট্টার রুটি অনেক দেশে খাদ্য হিসেবে রীতিমতো প্রচলিত এবং পুষ্টিগুণে তা ভাতের তুলনায় কিছুমাত্র নিচে নয়। মেক্সিকো মোটেই কোনো ধনী দেশ নয়, সে দেশের মানুষ নিয়মিত ভাত খায় এবং পাশাপাশি গমের ও ভুট্টার রুটিও চলে। সে দেশের জলবায়ু আমাদের দেশের মতোই এবং মানুষজনের আকার-আকৃতি-গাত্রবর্ণ আমাদেরই মতো।

সত্য বটে, আমাদের দেশে এখন উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদনের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা আমাদের বাৎসরিক দুঃখের পার্বণের মতো আসে তা ঠেকানোর কী ব্যবস্থা আছে? সুতরাং ধানের মৌসুমে উৎপাদন ব্যাহত হলো তো সর্বনাশ। এই অবস্থা বদলানোর চেষ্টাও সত্যিকার অর্থে কিছু হয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ, আমাদের সাধারণ প্রবণতাই হলো, সমস্যা হলে কোনোমতে ধামাচাপা দাও, অথবা দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকো, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। সত্যি সত্যি গেছেও তো। নাহলে আমরা এতোকাল এভাবে টিকে আছি কীভাবে?

আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, চালের দামের ওপর সরকারের স্থায়িত্ব বা জনপ্রিয়তা ও নির্বাচনযোগ্যতা নির্ভর করে। নির্বাচিত-অনির্বাচিত অথবা জবরদখলকারী বা ছদ্মবেশী ক্ষমতাবানরা তবু এদিকে মনোযোগ দিলেন না কেন? বিকল্প খাদ্যাভ্যাসের জন্যে একটা সামাজিক আন্দোলনও হতে পারতো। হয়নি। আমরা ভাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারিনি। এর আংশিক কারণও সম্ভবত ঐ ৭৪-এই সন্ধান করতে হবে। দুইবেলা ভাতের বদলে একবেলা করে রুটি খাওয়ার বা বিকল্প হিসেবে আলুতে অভ্যস্ত হওয়ার কথা বলে সেই সময়ের আওয়ামী লীগ সরকার বিষম বেকায়দায় পড়েছিলো। সেই ঝুঁকি তাহলে নেওয়া কেন? এখনকার সেনাপ্রধান আলুর কথা বলে বেড়াতে পারছেন, কারণ তাঁর নির্বাচিত হওয়ার দায় নেই, এমনিতেই সব হাতের মুঠোয়। স্মরণ করা দরকার, খোলা বাজারে যখন চাল ৪৫ টাকা তখনো কেউ কেউ ১.২৫ দরে চাল পাবে, শেখ মুজিব এই ধরনের ব্যবস্থাকে নিরুৎসাহিত করতে চেয়েছিলেন বলে চরম মূল্যও তাঁকে দিতে হয়েছিলো।

কিন্তু বাস্তবতা মানতে হবে। প্রকৃতিকে যেহেতু আমরা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখি না, ধানের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হলে দুর্ভোগ কমানোর জন্যে খাদ্যাভ্যাস বদলের কথা আমাদের ভাবা দরকার। জন্ম-জন্মান্তরের অভ্যাস বদলানো সহজ নয়, সে কথা মনে রাখছি। তবু বলি, দুর্দিনে মানুষ শাকপাতা খেয়েও জীবনধারণ করে। ভাত না হলে বিকল্প হিসেবে আলু বা ভুট্টায় অভ্যস্ত হওয়া কী খুব দুরূহ? অন্তত অনাহারে থাকার চেয়ে তো ভালো।

------------------
১০ এপ্রিল ২০০৮
------------------

রাবাব-প্রজন্মের কাছে

বোন আমার, অকিঞ্চিৎকর মানুষ আমি, জানি না আমার প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্য কি না। কারণ, আমার প্রজন্মের প্রকৃত চেহারা-চরিত্র আসলে কীরকম? বিচিত্র মুখ ও মুখোশ আমরা বিভিন্ন সময়ে ধারণ করেছি। কখনো আমরা অকুতোভয় সংগ্রামী, সন্তের মতো সর্বস্বত্যাগী, জীবনের মায়া না করা যোদ্ধা। অথচ এই আমরাই যখন আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে কামড়াকামড়ি করতে শুরু করেছি এবং নাছোড়বান্দা কুকুরের মতো পরস্পরকে দংশেছি, তখন আমাদের আরেক চেহারা।

১৯৭১-এ পৃথিবী দেখেছ আমরা কী ক্ষমতা ধারণ করি। পরাশক্তির রক্তচক্ষু এবং বিশাল সংগঠিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হওয়ার ইতিহাস আমাদের। স্বপ্ন ছিলো একটি স্বাধীন দেশের, তা পেয়েছিলাম। আমাদের জানা ছিলো, স্বাধীনতার পরে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে থাকার, দরকার অফুরান মমতা ও ভালোবাসার। অথচ ঠিক তখনই আমরা বিচ্ছিন্ন হয়েছি পরস্পর থেকে, যুদ্ধের দুঃসময়ে যাকে ভাই বলে আপন জ্ঞান করেছিলাম, মুক্ত স্বদেশে তার বুকে বন্দুক তাক করেছি। নিজেদের মধ্যে কলহ-বিবাদ করে শক্তি ক্ষয় করে ফেলেছি।

একখণ্ড মাংস নিয়ে দুই কুকুর যখন বিবাদে লিপ্ত হয়, চতুর শেয়াল ঠিক তখনই সুযোগ বুঝে মাংসের দখল নিয়ে ফেলে। আমাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এইভাবে আমাদের স্বপ্নগুলি চুরি হয়ে গেছে।

আজ যখন তোমাকে তোমার প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে যাই, নিজেকে তুমি হতাশাবাদী বলে নিজেকে পরিচিত করো। কষ্টে আমার বুক ভেঙে যায়। আমার প্রজন্মের দিকে তোমার অভিযোগের আঙুল তোলার কথা। তোলোনি, সেটা তোমার মহানুভবতা, আমার সান্ত্বনা নয়। আমরা নিজেদের স্বপ্নগুলি খুইয়ে তোমাদের জন্যেও যে এক ভয়াবহ শূন্যতা ও হতাশার ব্যবস্থাপত্র তুলে দিচ্ছি, তা-ও আমরা বুঝতে অক্ষম ছিলাম। তোমাকে কোনো আশার কথা শোনাবো, সে মুখ আমার নেই, সাধ্যও নয়।

তুমি তোমার লেখায় হতাশার কথা বলেছো। তবু বলি, আশাবাদ না থাকলে হতাশা আসা সম্ভব নয়। সেই আশাটাকে বাঁচিয়ে রাখো। আমাদের এই দেশে এখনো সূর্য ওঠে, পূর্ণিমার রাত আসে, মা এখনো তোমার অপেক্ষায় থাকে। আমাদের দিয়ে যা হয়নি, তা তোমাদের দিয়ে হোক। নিজেদের তোমরা প্রস্তুত করে নাও। জয় হোক তোমাদের।

আর আমাদের ব্যর্থতাকে ক্ষমা করে দিও, যদি পারো।

------------------
২৭ মার্চ ২০০৮
------------------

দেশটি যে আমার!

… দেশের সংবাদের জন্যে এতো যে আগ্রহ, অধীরতা আমার, অনেকটা হয়তো নেশাগ্রস্তের মতো, কিন্তু কী দেখবো বলে আশা করি প্রতিদিন? স্পষ্ট কোনো উত্তর জানা নেই। ঘটনা-দুর্ঘটনা, হানাহানি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিপুল বিস্তার আর হতাশার খবরে ভরে থাকে কাগজ। দৈনিক দুঃসংবাদ নামে একটি কাগজ থাকলে খুব উপযুক্ত হতো বলে মনে হয়। কাগজে আর থাকে রাজনৈতিক ক্ষুদ্রতা ও অদূরদর্শিতার লজ্জাহীন বিস্তারের সংবাদ – দেশ নয়, দেশের মানুষ নয়, তাদের ভালোমন্দে কিছু এসে যায়না, আমি এবং আমার দলই একমাত্র বিবেচ্য। এইসব দেখে দেখে ভারি ক্লান্ত লাগে, বিষাদে মন ভরে যায়। কখনো এমনও মনে হয়, প্রতিদিন একই খবর পড়ছি। ভাবি, কী হবে আর দেখে, একদিনের কাগজ দেখলে সারা বছরের খবর পাওয়া হয়ে যায়। অথচ পরেরদিন নির্ধারিত সময়ে আবার ইন্টারনেটে না গিয়ে উপায় থাকে না আমার – মনে হতে থাকে আজই হয়তো অন্যরকম কোনো একটি সংবাদ দেখবো। আমার দেশে নতুন ও সুন্দর কিছু একটা ঘটে যাবে আর আমি যথাসময়ে সে সংবাদটি জানতে পারবো না, তাই হয়! বাস্তব এই যে বাস্তবে কিছুই ঘটে না, সুসংবাদের অপেক্ষায় দিনের পর দিন চলে যায়, তবু আমার আশা মরে না। অন্তিম বিচারে আশা নিয়েই হয়তো মানুষ বেঁচে থাকে।

… তোমার এবং আমার স্মৃতিমন্থন করার কারণও কিছু আছে! সেদিন আমাদের প্রাণে অর্জনের অহংকার ছিলো, দুই চোখ ভরা স্বপ্নের দ্যুতি ও বিস্তৃতি ছিলো। আকাশতুল্য অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে আমরা টগবগ তখন করছি, আমাদের সামনে কী আলোকময় অলৌকিক একটি ভবিষ্যৎ!

এই দিনে আজ সুদূর মনে হওয়া অনতিদূরের সেইসব কথা কি আমাদের স্মরণে আসবে না? মাঝখানের বছরগুলোকে ভাবলে ভুল, ব্যর্থতা ও হতাশার কথা আসবে, তা-ও নিশ্চিত। বিস্মৃত হতে আমরা প্রায়শ সচ্ছন্দ, হয়তো এই বিস্মৃতি না ঘটলে আমাদের দুঃখ-হতাশার আর শেষ থাকতো না, সর্বনাশে সম্পূর্ণ নিমজ্জন অমোচনীয়ভাবে ঘটে যেতে পারতো। তবু এই দিনটিকে স্মরণ না করে আমাদের উপায় নেই।

আজ আমাদের সেইসব স্বপ্ন ও সম্ভাবনার সবই ভুল ও ব্যর্থ হয়ে গেছে বলে মনে হয়। বস্তুত আমাদের ব্যর্থ স্বপ্নের গল্প অগণন। এতোদিন হয়ে গেলো, তবু কিছু অর্জনের গরিমা নেই আমার দেশের, অর্থ-বিত্তের অহংকার নেই। আছে যতোটুকু, নেই তার থেকে ঢের বেশি। দারিদ্র্য নামে যা আছে অপরিমেয়, তাকে লোকে ভালো চোখে দেখে না, অভাবীদের গৌরব যদি কিছু থাকেও, নিত্যদিনের ক্লিন্নতার আড়ালে তা অনায়াসে ঢাকা পড়ে যায়। তা-ও সহনীয় হতে পারতো, কিন্তু আমার দেশ জগতের সেরা হয় দৈনন্দিন অসততা ও অসদুপায়ের জন্যে। রাজনৈতিক কোলাহলে সে সারা পৃথিবীর নিন্দা কুড়ায়। রাষ্ট্রপ্রধান হত্যায় আমাদের দক্ষতা একসময় রাষ্ট্র হয়ে যায় বিশ্বময়। নিত্যদিনের খুনখারাবিতে মানুষের জীবনই সর্বাপেক্ষা শস্তা ও সুলভ পণ্য হিসেবে প্রতীয়মান হয়। ক্ষমতাধররা লোভ ও নির্লজ্জতার নতুন নতুন শীর্ষ আবিষ্কার করে এবং সেই শীর্ষে তাদের আরোহণপর্বটি ঘটে সাড়ম্বরে, অকম্পিত ও অপরিবর্তিত মুখে। মানুষের কোনো কীর্তি বা সাফল্য নয়, বন্যায়-মহামারীতে-দুর্ভিক্ষে বছর-বছর পৃথিবীর তাবৎ সংবাদপত্রের শিরোনাম হয় আমার দেশ। এতো যে নেই নেই, পর্বতপ্রমাণ আমাদের অক্ষমতা ও ব্যর্থতা, স্বপ্নভঙ্গের বিষাদ – তারপরেও মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলা কি মানায়!

তবু এই রুগ্ণ করুণ অসহায়, ক্ষুদ্র ভুখণ্ডটির জন্যে অতি উচ্চ একটি গৌরবস্তম্ভ ও শর্তহীন ভালোবাসা নিজের ভেতরে যত্নে লুকিয়ে রাখি। দেশটি যে আমার!

------------------
২৬ মার্চ ২০০৮
------------------

আমার গল্পের কিছু তাদের দিয়ে যাই

সপ্তাহের সমস্ত কাজ ও কর্তব্য সমাপন হলো। শনিবার রাতে কমপিউটারের সামনে বসেছি লেখালেখি করার বাসনায়। সচলায়তনে শুরু করা ‘আমাদের বাতিঘরগুলি ও আসন্ন দিন’ সিরিজটা এগোচ্ছে না, আরেকটা পর্ব আজ লিখতে হবে। ইমেল, ঢাকার দৈনিক দেখা শেষ, মধ্যরাতের কিছু পরে লেখা খুলে বসেছি। হঠাৎ মেয়ে আসে আমার ঘরে। সন্ধ্যায় সে গিয়েছিলো তার প্যালেস্টাইনি বান্ধবীর বাসায়। সেখানে আল জাজিরা চ্যানেলে সে দেখে এসেছে ইজরায়েলি সৈন্যরা কীভাবে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে নিরস্ত্র প্যালেস্টাইনিদের খুন করছে। ক্ষুব্ধ অসহায় গলায় আমাকে সে জিজ্ঞেস করে, এইসব আমেরিকার টিভি চ্যানেলগুলিতে দেখায় না কেন?

তার ইচ্ছে ওই ভিডিও ফুটেজগুলি একত্রিত করে সে সিএনএনসহ অন্যসব সংবাদ-চ্যানেলগুলিতে পাঠিয়ে দেবে প্রচার করার অনুরোধসহ।

হায়, আঠারো বছর বয়সে এইসব চিন্তা করা সম্ভব। পৃথিবীতে যাবতীয় শুভবোধ এখনো জাগ্রত এবং তার অনুরোধে পুঁজিস্বার্থের প্রতিভূরা যা করছে তা আর করবে না এবং শুধরে নেবে তাদের পাপগুলি!

তার সমান বয়সে আমরা অবশ্য অনেককিছু জেনে গিয়েছিলাম। ততোদিনে আমাদের প্রজন্ম প্রত্যক্ষ যুদ্ধ দেখে ফেলেছে, যুদ্ধের নখরাঘাতে মানুষের জীবন ও আশা-আকাঙ্খা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতে দেখেছে, চোখের সামনে সারি সারি নিরপরাধ মানুষের রক্তাক্ত শরীর অবলোকন করেছে, সপ্তম নৌবহর ও নিক্সন-কিসিঞ্জার জেনে ফেলেছে। মেয়েকে এখন আমি কী বলি?

বোঝার বয়স মেয়ের হয়েছে। পুঁজি ও ক্ষমতার স্বার্থের সম্পর্ক ইত্যাদি ব্যাখ্যা করে জানাই, এইসব পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা ব্যক্তিমানুষের আসলে নেই।

মেয়ে বলে, তাই বলে যা চলছে তার প্রতিবাদ হবে না? যা চলছে চলুক আমার কিছু এসে যায় না জাতীয় মানসিকতার মানুষ আমি হতে চাই না। কিছু একটা করতে চাই। টিভিতে দেখা ছবিগুলি আমার চোখে এখনো ভাসছে।

আমাদের কথা চলতে থাকে। কীভাবে কখন প্রসঙ্গ পাল্টায়, মেয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস জানতে চায়। মনে মনে ভাবি, এখন মার্চ, এখনই তো উপযুক্ত সময়। কথা বলতে বলতে সচলায়তনে উঁকি দিয়ে দেখি, শহীদ মিনারের ব্যানার পাল্টে দিয়েছে অরূপ, এখন সেখানে স্বাধীনতার মাসের ব্যানার উঠেছে – তোমাকে পাবার জন্য হে স্বাধীনতা।

মেয়েকে বলি, সে অনেক লম্বা গল্প। আজ অনেক রাত হয়ে গেছে, এখন তুই ঘুমাতে যা। পরে একসময় হবে।

সে এখনই শুনতে চায়। আমি আপত্তি করার কে! এই বিষয় নিয়ে জীবনভর বকবক করতেও ইচ্ছুক আমি। কথা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরে দেখি গুটি গুটি পায়ে দশ বছরের ছেলেটিও তার ঘর থেকে উঠে এসে বসছে। আমাদের কথায় তার ঘুম ভেঙে গেছে, এই গল্প সে-ও শুনতে চায়।

আমি বলে যাই আমাদের কালের কাহিনী। ৪৭-এর দেশভাগ, বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশের বিভক্তি, ভাষা আন্দোলন, ৬৫-র যুদ্ধ, শেখ মুজিব ও ৬ দফা, ৬৯-এর গণ-আন্দোলন, ৭০-এর নির্বাচন এবং ৭১। তারা ক্রমাগত প্রশ্ন করে, আমি সাধ্যমতো বলে যাই তাদের বোঝার সামর্থ্য অনুযায়ী।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের কথাও একসময় উঠে আসে। মেয়ে আচমকা জিজ্ঞস করে, তোমরা শেখ মুজিবকে খুন করলে কেন? কী করে পারলে?

এই প্রশ্ন অনন্তকালের। উত্তর কি আমার জানা আছে?

কথা শেষ হলে ঘড়িতে দেখি রাত সাড়ে তিনটা। ছেলেমেয়েকে বিছানায় পাঠিয়ে দিয়ে মনে হয়, লেখালেখি আজ আর হলো না। টের পাই, সে জন্যে আমার একটুও অনুশোচনা বা দুঃখবোধ হচ্ছে না। তার বদলে এক ধরনের পরিতৃপ্তি। আমার গল্পের কিছু ছেলেমেয়ের হাতে তুলে দেওয়া গেলো।

--------------------
০৩ মার্চ ২০০৮
--------------------