Sunday, May 4, 2008

আমার গল্পের কিছু তাদের দিয়ে যাই

সপ্তাহের সমস্ত কাজ ও কর্তব্য সমাপন হলো। শনিবার রাতে কমপিউটারের সামনে বসেছি লেখালেখি করার বাসনায়। সচলায়তনে শুরু করা ‘আমাদের বাতিঘরগুলি ও আসন্ন দিন’ সিরিজটা এগোচ্ছে না, আরেকটা পর্ব আজ লিখতে হবে। ইমেল, ঢাকার দৈনিক দেখা শেষ, মধ্যরাতের কিছু পরে লেখা খুলে বসেছি। হঠাৎ মেয়ে আসে আমার ঘরে। সন্ধ্যায় সে গিয়েছিলো তার প্যালেস্টাইনি বান্ধবীর বাসায়। সেখানে আল জাজিরা চ্যানেলে সে দেখে এসেছে ইজরায়েলি সৈন্যরা কীভাবে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে নিরস্ত্র প্যালেস্টাইনিদের খুন করছে। ক্ষুব্ধ অসহায় গলায় আমাকে সে জিজ্ঞেস করে, এইসব আমেরিকার টিভি চ্যানেলগুলিতে দেখায় না কেন?

তার ইচ্ছে ওই ভিডিও ফুটেজগুলি একত্রিত করে সে সিএনএনসহ অন্যসব সংবাদ-চ্যানেলগুলিতে পাঠিয়ে দেবে প্রচার করার অনুরোধসহ।

হায়, আঠারো বছর বয়সে এইসব চিন্তা করা সম্ভব। পৃথিবীতে যাবতীয় শুভবোধ এখনো জাগ্রত এবং তার অনুরোধে পুঁজিস্বার্থের প্রতিভূরা যা করছে তা আর করবে না এবং শুধরে নেবে তাদের পাপগুলি!

তার সমান বয়সে আমরা অবশ্য অনেককিছু জেনে গিয়েছিলাম। ততোদিনে আমাদের প্রজন্ম প্রত্যক্ষ যুদ্ধ দেখে ফেলেছে, যুদ্ধের নখরাঘাতে মানুষের জীবন ও আশা-আকাঙ্খা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতে দেখেছে, চোখের সামনে সারি সারি নিরপরাধ মানুষের রক্তাক্ত শরীর অবলোকন করেছে, সপ্তম নৌবহর ও নিক্সন-কিসিঞ্জার জেনে ফেলেছে। মেয়েকে এখন আমি কী বলি?

বোঝার বয়স মেয়ের হয়েছে। পুঁজি ও ক্ষমতার স্বার্থের সম্পর্ক ইত্যাদি ব্যাখ্যা করে জানাই, এইসব পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা ব্যক্তিমানুষের আসলে নেই।

মেয়ে বলে, তাই বলে যা চলছে তার প্রতিবাদ হবে না? যা চলছে চলুক আমার কিছু এসে যায় না জাতীয় মানসিকতার মানুষ আমি হতে চাই না। কিছু একটা করতে চাই। টিভিতে দেখা ছবিগুলি আমার চোখে এখনো ভাসছে।

আমাদের কথা চলতে থাকে। কীভাবে কখন প্রসঙ্গ পাল্টায়, মেয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস জানতে চায়। মনে মনে ভাবি, এখন মার্চ, এখনই তো উপযুক্ত সময়। কথা বলতে বলতে সচলায়তনে উঁকি দিয়ে দেখি, শহীদ মিনারের ব্যানার পাল্টে দিয়েছে অরূপ, এখন সেখানে স্বাধীনতার মাসের ব্যানার উঠেছে – তোমাকে পাবার জন্য হে স্বাধীনতা।

মেয়েকে বলি, সে অনেক লম্বা গল্প। আজ অনেক রাত হয়ে গেছে, এখন তুই ঘুমাতে যা। পরে একসময় হবে।

সে এখনই শুনতে চায়। আমি আপত্তি করার কে! এই বিষয় নিয়ে জীবনভর বকবক করতেও ইচ্ছুক আমি। কথা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরে দেখি গুটি গুটি পায়ে দশ বছরের ছেলেটিও তার ঘর থেকে উঠে এসে বসছে। আমাদের কথায় তার ঘুম ভেঙে গেছে, এই গল্প সে-ও শুনতে চায়।

আমি বলে যাই আমাদের কালের কাহিনী। ৪৭-এর দেশভাগ, বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশের বিভক্তি, ভাষা আন্দোলন, ৬৫-র যুদ্ধ, শেখ মুজিব ও ৬ দফা, ৬৯-এর গণ-আন্দোলন, ৭০-এর নির্বাচন এবং ৭১। তারা ক্রমাগত প্রশ্ন করে, আমি সাধ্যমতো বলে যাই তাদের বোঝার সামর্থ্য অনুযায়ী।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের কথাও একসময় উঠে আসে। মেয়ে আচমকা জিজ্ঞস করে, তোমরা শেখ মুজিবকে খুন করলে কেন? কী করে পারলে?

এই প্রশ্ন অনন্তকালের। উত্তর কি আমার জানা আছে?

কথা শেষ হলে ঘড়িতে দেখি রাত সাড়ে তিনটা। ছেলেমেয়েকে বিছানায় পাঠিয়ে দিয়ে মনে হয়, লেখালেখি আজ আর হলো না। টের পাই, সে জন্যে আমার একটুও অনুশোচনা বা দুঃখবোধ হচ্ছে না। তার বদলে এক ধরনের পরিতৃপ্তি। আমার গল্পের কিছু ছেলেমেয়ের হাতে তুলে দেওয়া গেলো।

--------------------
০৩ মার্চ ২০০৮
--------------------

No comments: