অন্তত দুটি দম্পতিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি যাঁরা পরস্পরকে তুই করে বলেন। আমাদের মধ্যবিত্ত নাগরিক সংস্কৃতিতে স্বাভাবিক তো নয়ই, রীতিমতো ব্যতিক্রম ও বিপ্লবাত্মক। এর বিপরীতে এমন উদাহরণও জানি যেখানে বিবাহপূর্বকালে দু’জন দু’জনকে তুই-তোকারি করতেন, বিবাহের আনুষ্ঠানিকতার ফলে তা তুমিতে উত্তীর্ণ হয়ে প্রথাসিদ্ধ রূপ পেয়ে গেছে।
ঠিক জানা নেই, তবে পৃথিবীর খুব বেশি ভাষায় আমাদের মতো আপনি-তুমি-তুই এরকম তিন স্তরের সম্বোধন আছে বলে মনে হয় না। হিন্দি-ঊর্দূতে আছে জানি।
বাংলাদেশে যে কোনো শহরের বাইরে দুই পা গেলে অবশ্য অন্য বাস্তবতা। গ্রামবাংলায় আজও পুরুষরা সচরাচর বউদের তুই করে বলেন, যদিও মেয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বামীদের (স্বামী শব্দটি আমার ভয়ানক অপছন্দ, অথচ যুৎসই বিকল্পও নেই) তুমি, এমনকি আপনি বলে সম্বোধন করে থাকেন। কখনো কখনো আপনি-তুমির সীমানা বাঁচিয়ে ভাববাচ্যে বলা হয়। স্বামী বলে কথা, যার অর্থ প্রভু। আজকাল অবশ্য কিছু লেখাপড়া জানা মানুষও গ্রামে বসবাস করেন, তাঁরা আবার এই নিয়মের ব্যতিক্রম – বউকে তুই-তোকারি করা অরুচিকর ও অশোভন, বিবেচনা করেন। তাঁদের মনোভাব শহরের তুমি-সংস্কৃতির অনুসারী হয়ে স্বস্তি বোধ করে।
এই কিছুকাল আগেও গ্রামাঞ্চলে বাবা-মা, চাচা-চাচী, দাদা-দাদী, নানা-নানী, ভাই-ভাবী বা গ্রামের বয়স্ক মুরুব্বীদেরও তুই বলা কিছুমাত্র অস্বাভাবিক ছিলো না, অসঙ্গত বলেও গণ্য হতো না। আর ভাইয়ে-ভাইয়ে বা ভাইবোনের মধ্যে তুই ছাড়া কিছু তো হিসেবের বাইরেই ছিলো। আমাদের বাড়িতে ভাইবোনদের মধ্যে পরস্পরকে তুই/তুমি বলার চল, আব্বা-আম্মাকে আপনি। ওইরকমই আমাদের শেখানো হয়েছিলো, যেমন হয়েছিলো বাবা-মা সম্বোধনের পরিবর্তে আব্বা-আম্মা। আমাদের গ্রামের বাড়ির আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ভাইবোনকে তো বটেই, মাকে তুই বলা আজও প্রায় সর্বাংশেই চালু আছে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নিয়মিত আড্ডায় আমাদের ঘনিষ্ঠ পাঁচ বন্ধুর মধ্যে আপনি/তুমি/তুই-এর এক খিচুড়ি প্রচলিত ছিলো। আমাকে বাদ দিলে অন্য চারজন ছিলো হাবিব, সিরাজ, মিলন ও সারোয়ার। বয়সের পার্থক্য অবশ্য ছিলো, কিন্তু তারপরেও আপনি/তুমি/তুই-এর যুক্তিসঙ্গত হিসেব মেলানো কঠিন। হাবিব আর্ট কলেজের ও সিরাজ বুয়েটের পড়াশোনা শেষ করেছে আগেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া সারোয়ার ও আমি সমবয়সী। মিলন জগন্নাথ কলেজের এবং আমাদের এক বছরের ছোটো, সিরাজ তিন বছরের ও হাবিব ছয় বছরের বড়ো।
হাবিবের সঙ্গে আমাদের প্রত্যেকের আপনি চলে। বয়োজ্যষ্ঠ হিসেবে হাবিবের পক্ষে আমাদের সবাইকে তুমি, এমনকি করে বলা স্বাভাবিক ও সঙ্গত হতো। কিন্তু হয়নি। সিরাজ-মিলনের মধ্যে তুই-সম্পর্ক। সিরাজের সঙ্গে আমার ও সারোয়ারের আপনি। আমার সঙ্গে মিলনের তুই চলে, সারোয়ারের সঙ্গে আপনি। আপনি সম্বোধনের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে সিরাজ একদিন এই মর্মে এক তত্ত্ব উপস্থিত করে যে, আপনি বললে কিছু দূরত্ব বজায় রাখা যায় এবং পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ অটুট থাকে। তুই-তোকারির বন্ধুকে শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দেওয়া যায়, আপনি সম্বোধনের কাউকে শুয়োরের বাচ্চা বলা সম্ভব নয়।
সৌম্য দাশগুপ্ত কবি। বয়সে অনেক ছোটো হলেও সে আমার বন্ধুস্থানীয়। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতা শহরে। তার বাবা বরিশালের, মা চট্টগ্রামের (সেই বাবদে সে চট্টগ্রামের আহমদ ছফাকে মামা বানিয়ে ফেলেছিলো)। সৌম্য সামগ্রিকভাবে নিজেকে বাঙালি এবং আধা-বাংলাদেশী বলে পরিচয় দেয়। আংশিকভাবে তা পিতামাতার জন্মভূমির সূত্রে, বাকিটা বাংলাদেশের বিস্তর মানুষজনের সঙ্গে তার অতি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সম্পর্কের কারণে। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, বাংলাদেশে আমার চেয়ে তার চেনাজানা বেশি।
পরিচয়ের শুরুতে সৌম্যকে আপনি বলতাম। একদিন সে তুমি করে বলার অনুরোধ করলে আমি তাকে কিছুটা অবাক করে বলি, আমাকে জুবায়ের ভাই ডাকো ঠিক আছে, কিন্তু আমাকেও তুমি করে বলবে।
অবাক হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে সে বলে, বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে আপনি-আপনি বলার প্রবণতাটা খুব বেশি দেখি। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও পরস্পরকে আপনি বলেন দেখেছি। অথচ পষ্চিম বাংলায় অত্যন্ত দূরবর্তী বা শিক্ষক ও গুরুস্থানীয় কেউ না হলে আপনি বলা হয় না।
পশ্চিম বঙ্গে বাস্তবতা আসলেও তাই। বয়স্করা শিশুদের অবধারিতভাবে তুই করে বলবে। বাবা-মা ও অন্য সব বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়-পরিজনকে তুমি বলার রেওয়াজ। আপনি দিয়ে শুধু সম্পর্কের দূরত্ব বা শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশিত হবে। সেখানেও বন্ধুদের মধ্যে কোথাও কোথাও আপনি সম্বোধন বলবৎ থাকে, তবে তা ব্যতিক্রম বলেই ধরা হয়।
আমাদের দেশেও শহরাঞ্চলে কিছু বদল ঘটেছে। আজকাল শিশুরা বাবা-মাসহ বড়োদের আপনির চেয়ে তুমি বেশি বলে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তুই-তুমি প্রাধান্য পাচ্ছে। এগুলি চমৎকার ও সহজ সম্পর্কের নির্দেশক বলেই আমার বিশ্বাস।
গত কিছুদিনে সচলায়তনে কারো কারো সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। বয়সে বড়ো হওয়ার কারণে এদের অনেককেই তুমি বলার অনুমোদন পেয়ে গেছি। অথচ কাউকেই বলা হয়ে ওঠেনি যে, তারাও আমাকে জুবায়ের ভাই, তুমি বললে খুশি হই। সৌম্যকে সহজে বলতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে ওই চল এখনো গড়ে ওঠেনি বলেই হয়তো বলা যায়নি।
মানুষের জীবন যে কতো অসঙ্গতিতে ভরা তার একটি উদাহরণ আমি ঘরেই তৈরি করে রেখেছি। একদিন খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমি আমার মেয়েকে তুই বললেও ছেলেকে তুমি করে বলি। কী করে ঘটলো জানি না। কারণ খুঁজে পাওয়া গেলো না। মানুষের আচরণ আসলে খাপছাড়া হয়েই থাকে – এরকম একটা যুক্তিহীন যুক্তি দিয়েই তাকে যুক্তিসিদ্ধ করা সম্ভব। আর কোনোভাবে নয়।
Wednesday, May 28, 2008
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment