Sunday, May 4, 2008

‘দিয়াশলাই’-এর গল্পগুলি : এক পলকে একটু দেখা

প্রথমে বন্দনা করি….

সচলায়তনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর বর্ষপূর্তি হতে এখনো প্রায় আড়াই মাস বাকি। সে হিসেবে বয়স দশ মাসও হয়নি। এরই মধ্যে শতকরা একশোভাগ নিজস্ব মালমশলা দিয়ে তিন তিনটি প্রকাশনা রীতিমতো গর্ব করার মতো অর্জন তো বটেই। সবগুলি ই-বুক, সচলায়তন যার নাম দিয়েছে বe, হিসেবে ধরছি না, কারণ এগুলির কোনোটা আগেই মুদ্রিত গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত, কোনোটা অসম্পূর্ণ ইত্যাদি। এই তিনটি পূর্ণাঙ্গ প্রকাশনার একটি প্রথাগত মুদ্রণ মাধ্যমে, বাকি দুটি আন্তর্জালিক (নাকি অন্তর্জাল? এই সংশয় আমার আজও গেলো না। ইন্টারন্যাশনাল যদি আন্তর্জাতিক হয়, ইন্টারডিপার্টমেন্ট যদি আন্তবিভাগীয় হয়, তাহলে ইন্টারনেট আন্তর্জাল নয় কেন?)।

মুদ্রিত গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত সংকলনটি এখনো দেখা হয়নি। শুনেছি মুদ্রণঘটিত ও দূরপাল্লার সম্পাদনা সংক্রান্ত কিছু গোলমাল থেকে গেছে। প্রথম ভার্চুয়াল বই আরিফ জেবতিকের সম্পাদনায় ফেলে আসা ছেলেবেলা-ও জন্মেছিলো কিছু ত্রুটি নিয়ে। দুটি ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট কাউকে দোষারোপ করার উপায় নেই। তবে দিয়াশলাই-এর তিন তরুণ সম্পাদক আগের অসম্পূর্ণতাগুলি সম্পর্কে আগাগোড়া সজাগ ছিলেন তা স্পষ্ট বোঝা যায় এই বইয়ের পরিপাটি সাজসজ্জা দেখে।

একটা বিষয় ভেবে মজা লাগে, বিস্ময়ও কম হয় না। সম্পাদক তিনজনের বসত পৃথিবীর তিন মহাদেশে – অমিত আহমেদ উত্তর আমেরিকায়, আনোয়ার সাদাত শিমুল এশিয়ায় এবং কনফুসিয়াস ওরফে মু. নূরুল হাসান অস্ট্রেলিয়ায়। আফ্রিকায় সচল কেউ আছেন কি না আমি নিশ্চিত নই, তবে ইউরোপ থেকেও একজনকে রাখলে মন্দ হতো না। তা এই তিন ভুবনের তিন বাসিন্দা স্থানকালের বিস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও প্রযুক্তিকে সম্বল করে এক অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছেন। এখন থেকে দশ বছর আগেও হয়তো তা প্রায়-অসম্ভব ছিলো। অভিনন্দন তাঁদের প্রাপ্য।

অণুগল্প

অণুগল্প কী? তার সংজ্ঞা কীভাবে নির্ধারিত হয়? তার বৈশিষ্ট্য কী? স্পষ্ট কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ হয়তো সম্ভব নয়। তবে আমি যা বুঝি তা অনেকটা এরকম: পরিসরে অবশ্যই ছোটো, কিন্তু এতে থাকতে হবে পাঠককে সচকিত করে তোলার মতো কিছু একটা। থাকবে তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতা। তীরের মতো ঋজু ও লক্ষ্যভেদী। স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠা কোনো অনুভূতি। কোনো ধোঁয়াশাময় বর্ণনা নয়। হয়তো স্কেচ, কিন্তু স্পষ্ট দাগে আঁকা। অল্প কথায় অনেক কথা বলে যাওয়া, তবে পাঠককে যেন বোঝার আশা জলাঞ্জলি দিতে না হয়। সচলায়তনে নজমুল আলবাব ও সুমন চৌধুরী এই গোত্রের গল্পলেখক।

আবার অন্যদিকে কোনো একটা লেখা শুধু পড়ে যেতে ভালো লাগছে, মজা লাগছে, লেখক খুব আবছা কোনো বক্তব্য/ইশারা সেখানে মিশিয়ে রেখেছেন, পাঠক লক্ষ্য না করলেও ওই মজা ও পড়তে ভালো লাগার কারণেই তা সার্থক গল্প হয়ে ওঠে। সচলায়তনে এই ঘরানার একজন লেখক আছেন, তিনি সবুজ বাঘ।

অণুগল্প সংকলন ‘দিয়াশলাই’

এখন সুদৃশ্য প্রচ্ছদের ওপারে যাওয়া যাক। দিয়াশলাই সংকলনে জায়গা পেয়েছে ৩০ জন লেখকের মোট ৩৫টি গল্প। এর মধ্যে ১টি অনুবাদ।

দিয়াশলাই সংকলনের গল্পগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারি – পরমাণু, অণু, স্বয়ংসম্পূর্ণ, বনসাই এবং হলো না লো হলো না

পরমাণু

‘দিয়াশলাই’ সংকলনে বিস্ফোরক শক্তিধর মৌলিক পরমাণু গল্পগুলির লেখক সুমন চৌধুরী ও অলৌকিক হাসান। মোট ৫টি গল্প এই শ্রেণীতে। সম্পাদকরা ৫০০ শব্দে গল্প লিখতে বলেছিলেন, সুমন চৌধুরী সর্বসাকুল্যে ২০৪টি শব্দ খরচ করে (শিরোনামসহ ২০৮) ৪টি গল্প লিখে ফেলেছেন। প্রতিটি গল্পের ভাষা অতিশয় সাদামাটা, অথচ কী উজ্জ্বল, সম্পূর্ণ ও লক্ষ্যভেদী। প্রথম গল্পের নাম । স্বরবর্ণের ব্যবহার ছাড়াই ব্যঞ্জনবর্ণের একটিমাত্র অক্ষরে পরমাণু গল্পের পরমাণুসম শিরোনাম। পরমাণুর শেষতম ধাপে, আর ভাঙা যাবে না। সুমনের ৪টি গল্প ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের, তবে প্রথম () ও শেষ গল্প (বাটোয়ারা) দুটিকে অসাধারণ বললেও যথেষ্ট বলা হয় না।

৮৭টি শব্দে অলৌকিক হাসান লিখেছেন পাস ফেল। খুব নিটোল সুন্দর একটি গল্প। যথার্থ পরমাণু। একটু যত্নবান হলে শব্দসংখ্যা আরো কমানো যেতো। ছোটো একটি ঘটনা, ছোটো একটি অনুভব – এইটুকুই গল্পের সম্বল, অথচ মনোহর ও চমৎকার। একটি খচখচ করা ত্রুটি। ‘মরার মতো’ বা ‘মরার ঘুম’ ৪ প্যারার এই গল্প ৪ বার ব্যবহার করা হয়েছে ভুল বানানে। শব্দটি ‘মড়ার’।

সংকলনের একমাত্র অনুবাদ গল্পটিও (লাভ স্টোরি) পরমাণু শ্রেণীভুক্ত। শব্দসংখ্যা ৮০-র নিচে। শুরু থেকে গল্পটিকে এক যুগলের প্রেমের সংলাপ বিনিময় বলে ধারণা হয়, যদিও স্বামী ও স্ত্রী বলে দেওয়া আছে, সেভাবেই সংলাপগুলি পরপর সাজানো। পড়ার সময় কে আর অতো খেয়াল করে। মনে হতে থাকে, অনেক নিষেধ ভেঙে তাদের সম্পর্ক স্বপ্নময় একটি পরিণতির দিকে যাচ্ছে। অথচ শেষের একটিমাত্র বাক্যে জানা যায় তারা যাচ্ছে ডিভোর্সের জন্যে। গল্পের মূল লেখক ম. লিপস্কেরভ। দুর্দান্ত গল্পটির অসাধারণ অনুবাদ করেছেন সংসারে এক সন্ন্যাসী। শিরোনামটিকেও অনুবাদে প্রেমকাহিনী বলা যেতো বোধ করি।

অণু

অণুগল্প শ্রেণীতে পাচ্ছি ৫টি গল্প। হিমু ওরফে মাহবুব আজাদের ২টি এবং কনফুসিয়াস, আনোয়ার সাদাত শিমুল, নিঘাত তিথি ও মুজিব মেহদীর ১টি করে গল্প।

হিমুর গল্প দুটির নাম হাতিসোনাকপাল। হিমুর প্রায় সব রচনাতেই ব্যঙ্গ-পরিহাসের একটা ঝোঁক থাকে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হাতিসোনা অনেকটা কৌতুকের ছলে বলা হলেও চাপা-পড়া কষ্টও আগাগোড়া টের পাওয়া যায়। ‘হাতিরা ভোলে না’ – গল্পের এই অন্তিম বাক্যে ঠোঁটের কোণে অকস্মাৎ একটা স্মিতহাস্য উঠে আসার উপক্রম হতেই কোথাও একটা টান পড়ে। সে হাসি তখন আর কৌতুকের নয়, তা ফাটা-ঠোঁটে হাসতে যাওয়ার বিড়ম্বনার মতো বোধ হতে থাকে। কপাল-ও একটি নিখুঁত অণুগল্প। তবে ছোটো একটি নালিশ। মোনোপোলি খেলার সঙ্গে যাঁদের পরিচয় নেই, তাঁদের কাছে এই গল্পের কোনো আবেদন থাকবে বলে মনে হয় না।

কনফুসিয়াস অথবা মু. নূরুল হাসান গল্পসহ বিবিধ ধরনের গদ্যরচনা করে থাকেন। এই সংকলনে তাঁর বনসাই আমার প্রত্যাশা মেটায় না। গল্পটি সাদামাটা, বর্ণনা ও ভাষায়ও ধারালো লাগলো না। রচনাটি লেখকের শক্তিমত্তার পরিচায়ক নয়, এর চেয়ে অনেক উৎকৃষ্ট গল্প আমরা তাঁর কাছে পেয়েছি। সম্পাদনার ব্যস্ততায় হয়তো গল্পে মনোযোগ দিতে পারলেন না।

আনোয়ার সাদাত শিমুলের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় বছরখানেকের কিছু বেশি হবে। লেখক হিসেবে এই নবীন যুবক ক্রমশ অগ্রসরমান। দুর্বলতাগুলি কাটিয়ে উঠছেন, লেখালেখির পাঠশালায় অক্লান্ত পরিশ্রমী শিক্ষার্থীর মতো মনে হয়, নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়ার চেষ্টাও দেখা গেছে। দৈনন্দিন শিমুলের এই এগিয়ে যাওয়ার একটি স্মারক হয়ে থাকছে বলে আমার ধারণা। এই গল্পটি বোধহয় কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বাঁধা পড়ে না, এটি মানুষের নিজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার চিরকালের গল্প।

নিঘাত তিথির বন্ধু গল্পটা ভালো লাগে। সন্ধ্যার মুখে এক নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ ও বাড়ির কিশোর বয়সী কাজের ছেলেটি কোনো কথা না বলেও কথা বিনিময় করে, এইটুকুই গল্প। আদর্শ অণুগল্প। বর্ণনার অংশে নিঘাত তিথি আরেকটু সতর্ক ও যত্নবান হলে লেখাটির ধার অনেক বেড়ে যেতে পারতো। ‘এখন হাতে থাকা অফুরন্ত সময়ের অধিকাংশই কাটে অলস ভাবনা আর বিগত দিনের দেনা-পাওনার হিসেব কষে।’ – এই ধরনের বাক্য কিন্তু একটু ক্লিশে ও জীর্ণ-প্রাচীন মনে হয়।

মুজিব মেহদীর তর্কপ্রগতির জন্য প্রকল্পিত একটি অসমাপ্ত সেমিনারের প্রতিবেদন গল্পটি চমৎকার, গতানুগতিক গল্পের অনুগামী নয়। তবে অণুগল্পের নামটি মাইলখানেক দীর্ঘ কেন বোঝা গেলো না। গল্পে কমা ছাড়া অন্য কোনো যতিচিহ্নের ব্যবহার নেই। হয়তো পাঠককে চমকে দেওয়ার চেষ্টা। নাকি এসবের অন্য কোনো ব্যাখ্যা/ব্যঞ্জনা আছে যা আমি ধরতে পারিনি! ভুল বোঝাবুঝির ঝুঁকি নিয়েও বলি, সংলাপে ‘মশাই’ শব্দটি কানে লাগে, বড্ড কৃত্রিম শোনায়।

স্বয়ংসম্পূর্ণ

অণুগল্প সংকলনের বেশ কয়েকটি রচনা স্বল্প পরিসরেও সম্পূর্ণ গল্প হয়ে উঠেছে। এই গল্পগুলি প্রথাসম্মতভাবে লেখা, আকারে ছোটো বলেই সেগুলিকে অণুগল্প বলে সায় দিতে ইচ্ছে করে না।

বিবাগিনীর বাবা আর কাঠগোলাপ গাছ একটি সুন্দর মন-ভালো-করা গল্প।

অমিত ওরফে আহমেদ রাহিদ নিয়মিত লেখেন না। তাঁর এগারোটি রজনীগন্ধা পড়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, কেন লেখেন না? মনে হয় গল্পটি ঠিক অণুগল্প হিসেবে লেখার কথা ভাবাই হয়নি। গল্পের অতি দীর্ঘ প্রথম প্যারা অণুগল্পের উপযুক্ত বলে ভাবা মুশকিল। সম্ভবত লেখার চর্চা অনিয়মিত বলেই অমিতের ভাষা ও বর্ণনা কিছুটা আড়ষ্ট। কোনো মিল নেই, কিন্তু এই গল্পটা পড়তে পড়তে হঠাৎ ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখা ছবিটার কথা মনে পড়লো।

মোহাম্মদ আবদুল মুকিত, যাঁর ব্লগনাম জ্বিনের বাদশা, লিখেছেন টান নামে একটি গল্প। সহজ-সরল ভাষায় লেখা নিটোল ও সম্পূর্ণ গল্প। অণু বা পরমাণূ গল্প হিসেবে এর একটি সম্ভাবনা ছিলো। গল্পের শেষ বাক্য ‘হঠাৎ বাসার কড়াটার কথা খুব করে মনে পড়তে থাকে’ সেই ইঙ্গিতই দেয়।

মাহবুর লীলেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখার ক্ষমতা রাখেন। গল্প-কবিতা ছাড়াও লিখতে পারেন যা-খুশি ও যেমন-খুশি। তিনি ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন ছোট্টো পরিসরে লেখা তাঁর পোষায় না। কিন্তু সেখানেও যে উত্তমরূপে পারঙ্গম তিনি, চিঠির আকারে লেখা তৃষ্ণা গল্পটি সেই সাক্ষ্যই দেবে। সম্পাদকদের নির্ধারিত শব্দসংখ্যার মধ্যেই হৃদয়গ্রাহী একটি সম্পূর্ণ গল্প দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। লীলেন প্যারার শেষে কোনো যতিচিহ্ন ব্যবহার করেন না, শুধুমাত্র প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছাড়া। নিশ্চয়ই এর একটা ব্যাখ্যা আমরা কখনো পাবো। এই গল্পের একটি বাক্যে আপত্তি জানিয়ে রাখি। ‘… মরার পরেও আমাকে তুই জেলাস করিস প্লিজ’ বাক্যে ‘জেলাস’ শব্দটিতে ব্যাকরণগত ত্রুটি ঘটে। আমি জানি মুখে বলার সময় এই কথাটি খুবই চালু। কিন্তু জেলাস করা যায় না, হওয়া যায়। এখানে জেলাস-এর বদলে ইংরেজি হলে এনভি লেখা যেতো। অথবা চমৎকার বাংলা শব্দ ঈর্ষা ব্যবহারটা আরো বেশি যুক্তিযুক্ত ও প্রত্যাশিত ছিলো।

মাশীদ আহমেদ গল্পের নামই দিয়ে রেখেছেন অণু-পরমাণু এবং শুরুতেই লিখছেন, ‘ এই গল্পের কোনো শুরু নেই, শেষও নেই। আবার হতে পারে, এটা কোনো গল্পও না…’। এবং গল্প শেষ করছেন এইভাবে, ‘… ততদিন গল্পটাও চলতে থাকবে। শুধু একেক সময় গল্পটা হবে একটা ল্যাব রিপোর্ট, একটা কনসার্ট, একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়া, একটা মুভি বা বই রিভিউ, একটা বিয়ে বা একটা ঝগড়া। এরকম একেকটা অণুগল্প-পরমাণুগল্প নিয়ে চলতে থাকে গোটা জীবনের উপন্যাস।’ সুন্দর সুলিখিত গল্প আগাগোড়া। শুধু শেষ বাক্যটা গল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, একদমই প্রয়োজন ছিলো না।

নজমুল আলবাব যথারীতি একটি দুর্ধর্ষ গল্প লিখেছেন। গল্পের নাম নিশি-নেশা। নামকরণে চমৎকারিত্ব কিছু নেই, কার্যকারণও ঠিক বুঝিনি। তাতে গল্পের কোনো ক্ষতি অবশ্য হয় না, গল্পের সার্থকতা ও আবেদন অক্ষুণ্ণ থাকে। ছোটো ছোটো বাক্যের প্রায় নৈর্ব্যক্তিক বিবরণে গল্পের উন্মোচন ঘটান লেখক। গল্প শুরু হচ্ছে এইভাবে: ‘কবির তড়পাচ্ছে। কানের পাশ থেকে একটা ধারা গড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত। চিৎ হয়ে পড়ায় হাত দুটো ছড়িয়ে আছে। সিগারেটটা ছিটকে যায়নি। কানের পাশ থেকে যাওয়া রক্তের ধারা সিগারেট নিভিয়ে দিল। কবির আমার দিকে তখনও তাকিয়ে আছে। চোখে অবিশ্বাস। আসলে এভাবে কথা ছিল না। আমরা আজ অন্য প্ল্যান নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু কবির নিজেই গোলমালটা লাগিয়ে দিল। আর এখন তড়পাচ্ছে। সে না তড়পালে হয়তো আমি তড়পাতাম। কিংবা বাদল নিজের রক্তে গড়াগড়ি খেত এতক্ষণে।’ এই বিবরণ পড়ে পাঠক হিসেবে এক অনিবার্য ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়ে যাই। প্রায় দম বন্ধ করে এগিয়ে যেতে হয়। রক্তের ধারায় সিগারেট নিভে যাওয়ার ছবিটি মাথায় গেঁথে থাকে। তিন ছিনতাইকারীর একজন কবির তাদের উদ্দিষ্ট শিকারটিকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ শিকার লোকটি খুঁড়িয়ে হাঁটে, সে মুক্তিযোদ্ধা ছিলো এবং যুদ্ধে আহত। কবির নিজেও এক মুক্তিযোদ্ধার পুত্র। শিকারকে পালাতে দিয়ে সে সঙ্গী একজনের (গল্পের আমি) হাতে গুলিবিদ্ধ হয়। ‘… কবির উদ্দিনের লাশটা কানাগলির শেষপ্রান্তের মাঠে পড়ে থাকে। অন্ধকারে।’ নজমুল আলবাবের গল্পটি আক্রান্ত করে, পড়ার পর অনেকক্ষণ থম ধরে বসে থাকতে হয় আমাকে।

অমিত আহমেদের গল্পের নাম অবশেষে অরিন্দম…। অল্প পরিসরেই লেখাটি প্রথাসম্মত সম্পূর্ণ গল্প হয়ে উঠেছে। অণুগল্পের টান টান ব্যাপারটি অনুপস্থিত, যদিও সম্ভাবনা ও সুযোগ বিদ্যমান ছিলো।

মায়িশার আম্মার সাথে দায়িত্বশীল দুপুর হাসান মোরশেদের গল্প। ঘটনা বর্ণনায় ও পরিস্থিতি তৈরিতে হাসান মোরশেদ বরাবরই দক্ষ। বক্তব্যেও তীক্ষ্ণ। এই গল্পটিতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু এই গল্পে মায়িশার আম্মা ঠিক কীসের দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলছে তা অস্পষ্ট। আর ‘প্যালেস্টাইনে মরেছে আরো কয়েক ডজন, দারফুরে শিশুর চেয়ে শকুনের পুষ্টি বেশি, বাংলাদেশে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর নিরন্নের মিছিল। কোন হারামজাদা যেনো উপদেশ দিলো ভাতের বদলে বিষ খেতে।’ লাইনগুলি লেখকের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ যতোটা তুলে আনে, গল্প হিসেবে লেখাটি ঠিক ততোটুকুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অতন্দ্র প্রহরী বা শাহরিয়ার মামুনের ট্রাফিক সিগন্যালে একদিন প্রতিদিনের জীবন থেকে তুলে আনা এক টুকরো গল্প। প্রহরীকে গল্পের বর্ণনা ও ভাষা ব্যবহারে যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দেওয়া যায়।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী কোনো এক ব্লগপোস্টে নিজেই বলেছিলেন, জীবনে হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র গল্প লিখেছেন তিনি। অমিতকে যে প্রশ্নটা আগে করেছি, এখন শোমচৌকেও একই প্রশ্ন করা দরকার: কেন? কী কারণে গল্প লেখেন না আপনি? সংকলনে অস্তিত্বের অন্ধকার পড়ে ধারণা জন্মায়, এই লেখক লেখেন অতি স্বচ্ছন্দে, স্বতস্ফূর্তভাবে। এই গল্প সম্পর্কে আমার অনুভূতি ও প্রশ্নগুলি হাসান মোরশেদ আলাদা একটি পোস্টে করে ফেলেছেন। সেগুলির পুনরুক্তি আর করার দরকার নেই। তবে এতো অল্প শব্দ খরচ করে একটি সম্পূর্ণ গল্প লেখার কৌশলটা আমাকে এবার শিখতে হবে।

এই শ্রেণীভুক্ত সর্বশেষ দুটি রচনা আসলে কল্পগল্প। সবজান্তা নামের আড়ালের জ্যোতির্ময় বনিক লিখেছেন প্রাগৈতিহাসিক এবং লুৎফুল আরেফীনের গল্পের নাম আফসোস। দুঃখের সঙ্গে বলি, কল্পগল্পের ভোক্তা হওয়ার যোগ্যতা আমার অর্জন করা হয়নি বলে কোনো মন্তব্য করছি না। তবে দুটি গল্পই পড়েছি।

বনসাই

যে গল্পগুলিকে আমি এই শ্রেণীভুক্ত করেছি, আমার বিচারে সেগুলির স্বাভাবিক বিকাশ ঘটতে দেওয়া হয়নি। অণুগল্প সংকলনের ৫০০ শব্দের বাধ্যবাধকতায় এই লেখাগুলি আটকা পড়ে গেছে। ডালপালা ছেঁটে ফেলা অবস্থায় কৃত্রিম আকৃতিতে সম্পূর্ণতা খুঁজছে।

শেখ জলিলের ক্লিনিক্যাল ডেথ গল্পটি আরেকটু বিস্তার অবশ্যই দাবি করে। পড়তে পড়তে মনে হয়, লেখাটা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে সামনে-পেছনে যাওয়া-আসা করছে। শেখ জলিল মূলত কবি হলেও গদ্য লেখার সময় তিনি বিশুদ্ধ গদ্যই লেখেন, কবিতাক্রান্ত গদ্যরচনা করেন না। এখানেই গদ্যলেখক হিসেবে তাঁর শক্তির পরিচয়। তৃতীয় প্যারায় ‘ঘুমের মধ্যে মা স্ট্রোক করেছেন’ বাক্যটিতে আপত্তি জানিয়ে রাখি। রোগী স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়, রোগী স্ট্রোক করে না।

ফকির ইলিয়াসের পলাতক গদ্যগ্রহ লেখাটিতে ঘটনার পরম্পরা বুঝতে সমস্যা হয়। কারণ সম্ভবত ঐ অণুগল্পের আকৃতিগত কাঠামোর ভেতরে রাখার সচেতন চেষ্টা। হায়, সুন্দর মনোগ্রাহী একটি কাহিনী থাকা সত্ত্বেও গল্পটি অসম্পূর্ণ থেকে গেলো। ‘আরেকটি পলাতক গদ্যগ্রহ দুজনের পাশ ঘেঁষে পৃথিবীর প্রান্ত ছুঁয়ে যায়’ – গল্পের এই শেষ বাক্যটি বুঝিনি। পলাতক গদ্যগ্রহ কথাটির মানে কি?

খেকশিয়াল ওরফে কৌশিক দে লিখেছেন তেপান্তর। সম্ভাবনা ছিলো, তার পূর্ণতার জন্যে লেখায় আরো অনেক বিস্তার ঘটানো দরকার ছিলো, শৃঙ্খলাবদ্ধ বর্ণনা ও সুসংবদ্ধ ভাবনার স্ফূরণ আবশ্যক ছিলো।

মেহেদি রাঙা হাত গল্পের লেখক ধুসর গোধূলি। এই লেখা পড়ে ধারণা হয়, ব্যস্ত ব্লগার গল্প রচনায় বেশি সময় ব্যয় করতে নারাজ। তাঁর অবলোকনে অনেক খুঁটিনাটি ধরা পড়ে, এই গল্পের ছোটো পরিসরেও তার নমুনা আছে। কিন্তু গল্পটা কোনোমতে শেষ করতে পারলেই যেন বাঁচেন। এতো তাড়া কীসের? বর্ণনা ও ভাষা ব্যবহারে কিছুটা প্রাচীনতার গন্ধ। তার নমুনা শুরুর বাক্যটিতেই আছে – ‘বসন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে …’। ২০০৮ সালের একজন নবীন লেখকের কাছে আরো টাটকা ও অশ্রুতপূর্ব বর্ণনা আশা করি আমি। আর কিছু না হলেও অন্তত ক্লিশেবর্জিত হওয়া তো দরকার।

দ্বিধা গল্পে ঝরাপাতা/অভ্রপথিক সুন্দর একটা বিষয় নিয়েছেন, তবু শেষ পর্যন্তা তা বনসাই গল্প হয়েই থেকে যায়।

গল্পের নাম বাথটাবে একা। লেখকের নাম জাহিদ হোসেন। এই লেখক কিছু গল্পে ইতোমধ্যে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর শক্তিমত্তা। এই রচনায়ও তার পরিচয় আছে। কিন্তু অণুগল্পের দাবি মেটাতে গিয়ে গল্পটি ফুটে উঠতে পারলো না। ‘সেই কখন থেকে হাতের শিরা কেটে বসে আছি বাথটাবে…’ অতিনাটকীয় লাগে। যেমন লাগে মিঠুর আত্মহত্যাও। চরিত্র দুটিকে ফুটে ওঠার সময় ও জায়গা দেওয়া গেলে এরকম বোধ হতো না বলে আমার বিশ্বাস।

নিঝুমের গল্পের নাম পুনশ্চঃ। দুটি দীর্ঘ প্যারা এবং পুনশ্চ পর্ব দিয়ে গল্পটি গল্পের আকৃতি নির্মাণ হয়েছে। গুনে দেখিনি, তবে নির্ধারিত ৫০০ শব্দই খরচ হয়ে গেছে বলে ধারণা করি। প্রথম প্যারা দুটি পড়ে আমার এই বিশ্বাসই পোক্ত হয় যে প্রচুর কাটছাঁট করা হয়েছে অথবা স্থান সংকুলান করতে না পেরে লেখক কোনোমতে গল্প শেষ করেছেন। দ্বিতীয় দীর্ঘ প্যারার শেষের কয়েকটি লাইন খাপছাড়াও লাগলো। নিঝুম লেখা বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠছেন, তাঁর উত্তরণের নমুনাও সচলে দেখা গেছে, কিন্তু এই গল্পে তাঁর নবলব্ধ সচেতনতা ও ক্ষমতা অব্যবহৃত দেখলাম।

হলো না লো হলো না

আকাশ অবশ্যই সূর্যের চেয়ে বড় গৌতম রায়ের গল্প। গল্পটি ঠিক কী বিষয়ে এবং গল্পটি কেন গল্প তা বুঝতে ব্যর্থ হলাম।

ইশতিয়াক রউফের দুই পাহাড় স্বগত সংলাপ হিসেবে পড়তে ভালো লাগে। টানা গদ্যে লেখা কবিতা বললেও বলা যায়, এতোটাই সুখপাঠ্য। একটি সুন্দর ভাষাভঙ্গি তাঁর আয়ত্ত্বে। কিন্তু এই লেখাটা ঠিক গল্প হলো কি? গল্প আরো একটু স্পষ্টতা দাবি করে।

পরিবর্তনশীল অথবা মহিবুল কবির সাম্প্রতিককালে তাঁর গল্প লেখার ক্ষমতা দেখিয়েছেন সচলায়তনে। নেই-বিষয় নিয়েও তিনি গল্প লিখতে জানেন। এই সংকলনে তাঁর লাল-সবুজ মেশানো শাড়ির গল্প তাঁর সেই সক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে না। এই রচনাটি সচলে ব্লগরব্লগর হিসেবে বেশ ভালো হয়। এরকম একটি গুরুগম্ভীর বিষয় অণুগল্পের জন্যে উপযুক্ত হয় না তা বলি না, কিন্তু তাকে সফল গল্প করার জন্যে এই নবীন লেখকের আরো প্রস্তুতি দরকার বলে মনে হয়। আবেগ গল্প রচনার একটি উপাদান বটে, কিন্তু একমাত্র উপাদান নয়। এই লেখায় আবেগটি উপস্থিত, কিন্তু গল্পের আর সব উপকরণ কোথায়?

পথে শিরোনামে মুজিব মেহদীর অপর রচনাটি কবিতাক্রান্ত গদ্যরচনা। গল্প কি?

সর্বশেষ

একটি কথাই বলার। আমার অকপট বিরূপ মন্তব্য কাউকে আহত করার জন্যে নয়, বরং দুর্বলতাগুলি বিষয়ে একটু সচেতন করার চেষ্টামাত্র – এইটুকু বিশ্বাস করলে খুশি হই। মঙ্গল হোক সবার।

-------------------
২০ এপ্রিল ২০০৮
-------------------

No comments: