Wednesday, July 30, 2008

আমার কম্পুকানা প্রজন্ম

ঢাকায় এক বন্ধুকে ইমেল করেছি একটা দরকারি প্রশ্ন করে। অপেক্ষায় সপ্তাহ কেটে যায়, উত্তর আসে না। অগত্যা ফোন করি। বন্ধু ঘুমচোখে হ্যালো বলেন।

দোস্ত, তোকে একটা ইমেল পাঠিয়েছি সপ্তাহখানেক আগে। পেয়েছিস?

তাই নাকি? না রে দোস্ত, খুব ব্যস্ত ছিলাম। ইমেল খোলা হয়নি।

এটাই প্রথম বা শেষ নয়, দেশে আমার অনেক বন্ধু আছেন, যাঁদের সঙ্গে এই ধরনের কথোপকথন নিয়মিতই হয়। এঁরা কমপিউটার-বিমুখ অথবা কম্পুকানা প্রজন্মের প্রতিনিধি। এঁদের প্রায় সবারই কর্মস্থলে কমপিউটার ব্যবহার অনেকটা বাধ্যতামূলক। হয়তো নেহাত ছক-বাঁধা কাজগুলি তাঁরা করেন মোটামুটি যান্ত্রিকভাবে, নাক-চোখ-মুখ বন্ধ করে, কোনোমতে শেষ হলেই বাঁচোয়া। কারো কারো বাড়িতেও আছে, তবে তা হয় ছেলেমেয়েদের প্রয়োজনে অথবা স্রেফ শোভাবর্ধনের জন্যে।

ইমেল পাঠিয়ে কয়েকদিন অপেক্ষার পর ফোন করে ইমেল খুলতে বলাটা হাস্যকর বটে। দুঃখেরও। তাহলে আর ইমেল করা কেন? সময় নষ্ট না করে ফোনটাই করা যতো দিনকয়েক আগে।

আগেভাগেই বলে রাখি, আমি নিজে কম্পুকানাদের দলে যদিও কর্মসূত্রে সর্বক্ষণ কম্পু নাড়াচাড়া করতে হয়, ঘরেও অনেকটা সময় কম্পুতেই যায়। কিন্তু সে বিষয়ে আমার বিদ্যা বা দক্ষতা নিচের দিকে। আমার জানার পরিধি ততোটুকুই, যা হলে কোনোমতে কাজ চলে যায়। এর বাইরে আরো কিছু জানা বা শেখা দরকারি মনে হলেও সেই বাসনা নিবারণের মহৌষধ, কী দরকার! এই তো বেশ চলে যাচ্ছে।

কমপিউটারে টাইপিং স্পীড দেখে আমার দশ বছর বয়সী পুত্র হাসাহাসি করে। বলে, এই স্পীড নিয়ে তুমি কাজ করো কী করে?

আমি হাসি আর মনে মনে বলি, চুপ। একদম চুপ, কেউ যেন না শোনে!

বস্তুত আমি এমন এক প্রাচীন এবং প্রযুক্তির বিচারে অক্ষম-অসহায় প্রজন্মের মানুষ যাঁদের কমপিউটার সম্পর্কে এক ধরনের জড়তা ও ভীতি আছে। জড়তার ধরণ, ‘আমি কি পারবো? না পারলে খুব লজ্জার কথা।’ ভীতিটা হলো, ‘টেপাটিপি করতে গিয়ে যদি কম্পু নষ্ট হয়!’

অতি-সতর্কতা ও অর্থহীন ভীতি আমার প্রজন্মের অধিকাংশ মানুষকে কম্পুকানা করে রেখে দিয়েছে। এঁরা একান্ত বাধ্য না হলে কমপিউটারের আশেপাশে ক্কচিৎ-কদাচিৎ ভেড়েন, অন্যথায় সম্পূর্ণ সংস্রবহীন থাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে কমপিউটার ও আনুষঙ্গিক অনেক প্রযুক্তি আজকের পৃথিবীর বাস্তবতা এবং সেসব আমাদের জীবনধারণ ও জীবনাচরণের অংশ হয়ে গেছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তা খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করে এবং তা ব্যবহার করে অনায়াস দক্ষতায়। সমস্যা শুধু অপেক্ষাকৃত বয়স্কদের নিয়ে, যাঁরা আমার প্রজন্মের মানুষ। অথচ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কমপিউটার না জানা মানুষকে অশিক্ষিত গণ্য করা হবে বলে ধারণা করি। আমার বন্ধু ও সমবয়সীরাও তা জানেন এবং স্বীকার করেন, কিন্তু বিচিত্র উপায়ে চোখ ফিরিয়ে রাখতেও তাঁরা সক্ষম।

কম্পুতে বাংলা লেখা সম্ভব জেনে এঁদের কেউ কেউ আজও বিস্মিত হন। যাঁরা অল্পবিস্তর কম্পু ব্যবহার করেন, তাঁরা শেখার আগ্রহ দেখান। সেই আগ্রহ স্থায়ী হয় না। তাঁদের কিছুতেই বোঝাতে পারি না, আমরা যারা দুরূহ বিজয় কীবোর্ড শিখেছিলাম, সে তুলনায় আজকাল কম্পুতে বাংলা কতো সহজ হয়ে গেছে, রোমান হরফ ব্যবহার করেও বাংলা লেখা যায়।

ব্যতিক্রম দেখিনি, তা নয়। আমার এক বন্ধুর অধ্যাপক পিতা আমেরিকা এলেন বেড়াতে। ঐ স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ক্লাস করে কমপিউটার শিখে ফিরে গেলেন।

কমপিউটারে আমার কিছু আগ্রহ জন্মায় আশির দশকের শেষে। হার্ডওয়্যার-সফটওয়্যার ইত্যাদি একদম প্রাথমিক বিষয়গুলি শেখার জন্যে ক্লাস করতে গেলাম, সব মাথার ওপর দিয়ে গেলো। একজন পরামর্শ দিলেন, কমপিউটার কিনে বাড়িতে নিজে হাতেকলমে শেখা সবচেয়ে ভালো। প্রথমটা কিনলাম ৯০-এর অগাস্টে, স্পষ্ট মনে আছে। যন্ত্রটি ছিলো আইবিএম পিএস-টু, সিপিইউ-মনিটর একত্রে। আর কী ওজন তার! একটা আইবিএম প্রিন্টারসহ দাম পড়লো এক হাজার ডলার, হোক না অন্যের ব্যবহার করা পুরনো জিনিস। অপারেটিং সিস্টেম ডস, যতোদূর মনে পড়ে উইন্ডোজ তখন এসে গেছে, কিন্তু এই কমপিউটারে চলবে না। সেই শুরু আমার কম্পু-কম্পু খেলা।

আমেরিকা ও কানাডায় বসবাসকারী আমার সমবয়সী কিছু বন্ধুবান্ধব ছোটোখাটো কম্পু-প্রশ্ন নিয়ে আমাকে মাঝেমধ্যে ফোন করেন। দুরূহ কিছু হলে আমি নেই, কিন্তু এইসব প্রাথমিক স্তরের জিনিসগুলি বিষয়ে সমাধান বাতলে দিতে পারলেও আমাকে তাঁরা বিশেষ প্রতিভাবান মনে করেন। বিশ্বাসই করেন না যে আমার বা তাঁদের ছেলেমেয়েরাও এই সমাধান দিতে সম্পূর্ণ সক্ষম।

একবার এক বন্ধু তাঁর কম্পুতে একটা প্রোগ্রাম ডাউনলোড করে ইনস্টল করবেন। ফোনে তাঁকে আমি কী করতে হবে ধাপে ধাপে বলে যাচ্ছি। এক পর্যায়ে তিনি আটকে গেলেন। ভীষণ গিট্ঠু। আমি যতো সহজ করে বলার চেষ্টা করি, তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। অধৈর্য তিনি প্রায় হাল ছেড়ে দিতে উদ্যত। শেষ চেষ্টা হিসেবে তাঁকে বললাম, আপনার মেয়েকে ফোনটা ধরিয়ে দিন, সে এক মিনিটে বুঝে যাবে।

খুবই অনিচ্ছায় তিনি বিশ্বিবদ্যালয়ে-পড়ুয়া মেয়েকে ডাকলেন এবং আমার অনুমান ঠিক, মেয়ে এক মিনিটে সমাধান করে ফেললো। তার কাছে এটা ডালভাত।

বন্ধুকে বললাম, বলেছিলাম না ও ঠিক পারবে?

বন্ধু গম্ভীর গলায় জবাব দিলেন, দেখতে হবে না কার মেয়ে!

No comments: