কোনো পত্রিকা যদি পাঁচখানি ‘পূর্ণাঙ্গ’ উপন্যাস ছাপলো, প্রতিযোগী ছাপলো সাতখানি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস। তার পরে ‘পূর্ণাঙ্গ’ উপন্যাসের ঢল নামল। এখন সহজেই অনুমেয় এইসব উপন্যাসের পূর্ণাঙ্গতা নামে মাত্র, খুব বেশী হবে তো ৪/৫ ফর্মা। তার পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় আরও ২/৩ ফর্মা বাড়ানো …। ফলে দাঁড়ালো এসব না ছোটগল্প না উপন্যাস। এরা রক্তপায়ী জোঁকের মতো স্ফীতোদর একটা প্রাণী। এতে না আছে ছোটগল্পের সূক্ষ্ম কলা-কৌশল, না আছে উপন্যাসের জীবন বিস্তার, আছে স্ফীতোদর ব্যবসায়িকতা। এ শ্রেণীর দায়িত্বহীন রচনার মতো সহজ কাজ আর নেই।
মনে হতে পারে, ওপরের উদ্ধৃতিটি বাংলাদেশের পত্রিকাগুলিতে উপন্যাস প্রকাশের সাম্প্রতিক প্রবণতা সম্পর্কে লেখা । অথচ সত্য এই যে, বাক্যগুলি লেখা হয়েছিলো আজ থেকে ৭২ বছর আগে, ১৯৩৬ সালে। প্রমথনাথ বিশী লিখেছিলেন ‘ছোটগল্পের আত্মহত্যা’ প্রবন্ধে। অথচ কী আশ্চর্য, একটি অক্ষরও অদল-বদল না করে এই কথাগুলি আজও বাংলাদেশের উপন্যাসের বেলায় সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
কলকাতার শারদীয় দেশ-আনন্দবাজারের আদলে বাংলাদেশে ঈদ উপলক্ষে বার্ষিক সাহিত্য-সম্ভার নিয়ে উপস্থিত হওয়ার প্রচলন প্রথম করে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’, যতোদূর মনে পড়ে, আশির দশকের শুরুতে। এর অনেক আগে থেকেই অবশ্য ‘বেগম’-এর ঈদসংখ্যা বেরোতো, সাহিত্যমূল্যের বিচারে তার মান উল্লেখ করার মতো কিছু ছিলো না। ‘বিচিত্রা’-র পর ঈদ সংখ্যা প্রকাশ শুরু করে ‘সচিত্র সন্ধানী’ ও ‘রোববার’। শুরুর দিকে বেশ কিছু উৎকৃষ্ট উপন্যাস পাওয়া গিয়েছিলো এই ঈদ সংখ্যাগুলিতে। এরপর অন্য সাপ্তাহিকগুলি এবং কয়েকটি দৈনিকও ঈদ সংখ্যা প্রকাশ শুরু করে। এখন তো ঈদ সংখ্যা মহামারীর আকার ধারণ করেছে।
মহামারী কথাটা বলা নিতান্ত অনিচ্ছায়। ঈদ সংখ্যার নামে যা পাওয়া যাচ্ছে, পাঠককে যা ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে – তারই পরিপ্রেক্ষিতে। ছোটোখাটো পত্রিকাগুলিকে আপাতত সরিয়ে রাখি। বড়ো ও নামী সাপ্তাহিক ও দৈনিকগুলির ঈদ সংখ্যার গড় পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫০০। এই পরিসরে গড়ে ১০ থেকে ১২টি উপন্যাস থাকে। আর থাকে ১০-১২টি করে গল্প, স্মৃতিকথা/আত্মজীবনীমূলক রচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, একগুচ্ছ করে কবিতা, একটি-দুটি অনুবাদ রচনা, চলচ্চিত্র-ক্রীড়া-নাটক-টিভি-সঙ্গীত ইত্যাদি বিষয়ে রচনা, ঈদের ফ্যাশন এবং রান্নার রেসিপি ও মেয়েদের সাজসজ্জা বিষয়ে কয়েক পাতা করে বরাদ্দ।
দেশ-আনন্দবাজারে শারদীয় সংখ্যাগুলি যেখানে মূলত সাহিত্যমুখী, আমাদের ঈদ সংখ্যার চরিত্র কিন্তু পত্রিকার সাধারণ সংখ্যারই বর্ধিত রূপ। ব্যতিক্রম বলতে শুধু উপন্যাস, যা সাধারণ সংখ্যায় থাকে না। ঈদ উপলক্ষে উপন্যাস থাকে বেশুমার। সবগুলি পত্রিকা দেখিনি, তবে গত কয়েক বছরে আমার দেখা ঈদ সংখ্যাগুলির মধ্যে একটিতে উপন্যাসের সর্বোচ্চ সংখ্যা দেখেছি ১৬টি।
কিন্তু উপন্যাস নামে যা পাওয়া হয়, তা আসলে কী বস্তু? একটি ঈদ সংখ্যার মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা যদি ৫০০ ধরে নিই, সেই হিসেবে বিজ্ঞাপনসহ অন্য সবকিছু বাদ দিলেও ১৬টি উপন্যাসের একেকটির জন্যে সোয়া ৩১ পৃষ্ঠা বরাদ্দ করা সম্ভব। কিন্তু শুধু উপন্যাস দিয়ে পত্রিকার পেট ভরে না!
নাসিরউদ্দিন হোজ্জার গল্প মনে পড়ে। হোজ্জা একদিন আধাসের মাংস কিনে এনে বউকে রান্না করতে বলে বাইরে গেছে। বউ রান্না শেষ করেছে, এমন সময় তার বোন বেড়াতে এলে ওই মাংস দিয়েই সে আতিথেয়তা সারে। হোজ্জা খেতে বসে দেখে মাংস নেই। বউ কৈফিয়ত দিয়ে বললো, পাজি বেড়ালটা সব মাংস খেয়ে গেছে। হোজ্জা তৎক্ষণাৎ উঠে বেড়ালটাকে ধরে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে দেখে, ওজন ঠিক আধ সের। হোজ্জার প্রশ্ন, এই যদি বেড়াল হয় তাহলে মাংস কোথায় গেলো? আর এটা যদি মাংস হয়, বেড়ালটা কোথায়?
ঈদ সংখ্যা দেখে আমাদের তখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, এই যদি পত্রিকা হয় তাহলে উপন্যাস কোথায়? আর এগুলি যদি উপন্যাস হবে, পত্রিকা থাকলো কোথায়? এতোসব জিনিস শ’ পাঁচেক পৃষ্ঠার ভেতরে হাঁসফাঁস করতে থাকে এবং সবচেয়ে বেশি ভোগে উপন্যাস। কারণ, চরিত্রগতভাবেই এই জিনিস কিছু বেশি জায়গা দাবি করে। কাহিনীর বিন্যাস ও বিস্তার, চরিত্রসমূহের বিকাশ ইত্যাদি মিলিয়ে বাড়তি পরিসর দরকার হয়।
উপন্যাসের আকার-আকৃতি কী হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে পুরনো আলোচনায় যাওয়ার দরকার নেই। এ যুগে War and Peace আকারের উপন্যাস লিখিত হওয়ার সম্ভাবনা বলতে গেলে শূন্য। এর বিপরীতে The Old Man and the Sea-এর ক্ষুদ্রায়তনও বহুল আলোচিত। বাংলা ভাষায় রচিত ‘ঘুণপোকা’ কি পূর্ণ উপন্যাস নয়? আসলে একটি উপন্যাসের উপন্যাস হয়ে ওঠা তার আকার-আকৃতির ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে বিষয়বস্তু ও কাহিনী, লেখকের বক্তব্য ও দর্শন এবং রচনাকৌশলের ওপর। তবে এটাও মানতে হবে যে, ছোটোগল্পে ঘটনা ও চরিত্র রচনায় আঁচড় কেটে যাওয়ার সুযোগ থাকে, উপন্যাস তা অনুমোদন করে না। উপন্যাসে বিস্তারের কাজটা আবশ্যিক, পারম্পর্য রক্ষাও। যথাযথ পরিসর উপন্যাসের জন্যে প্রাথমিক শর্ত।
মুশকিল হলো, আমাদের পত্রিকাগুলি এই পরিসর অনুমোদন করতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক অথবা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ বোধহীন ও কাণ্ডজ্ঞানরহিত। তাদের লক্ষ্য ‘উপন্যাসের’ সংখ্যা বাড়ানো, উপন্যাস হলো কি না, লেখক লিখে তৃপ্ত হলেন কি না, পাঠককে উপন্যাসের নামে বড়োগল্প বা ছোটোগল্প দিয়ে প্রতারণা করা হলো কি না – এসব তাদের বিবেচ্য বলে মনে করা কঠিন। ম্যাগাজিন আকারের ঈদ সংখ্যায় একটি ‘উপন্যাস’ দেখেছি ৭ পৃষ্ঠায় শেষ! স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। অথচ একটি ছোটোগল্প লিখতেও এই পরিসর প্রয়োজন হতে পারে। রচনার গুণমানের কথা না হয় পরে, কিন্তু উপন্যাসের নামে এটাকে ইয়ার্কি ছাড়া আর কী বলা যায় আমার জানা নেই।
বাংলাদেশে হাতে গোনা যে কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা আছে, তাদের প্রভাব সামান্যই। যেহেতু প্রচার ও পাঠক সীমিত। পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিজ্ঞাপনদাতারা এসব পত্রিকার বিষয়ে উৎসাহী নয়। ফলে, বহুকাল ধরে আমাদের সাহিত্য মূলত দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য/সাময়িকী পাতাকেন্দ্রিক হয়ে আছে। দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে দৈনিক কাগজগুলি তাদের সাময়িকী পাতার বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী বলে মনে হয় না, যেনতেন প্রকারে পাতা ভরানোর দায়িত্বটাই তারা পালন করে। সাপ্তাহিক কাগজগুলির অধিকাংশই তাদের নিয়মিত সংখ্যায় সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে না। ধারাবাহিক উপন্যাস দূরের কথা, একটি-দুটি গল্প-কবিতাও তাদের পাতায় জায়গা পায় না। অথচ ঈদ মৌসুমে তাদের সাহিত্যপ্রেম উথলে ওঠে, প্রতিযোগিতা হয় কে কতোগুলি ‘উপন্যাস’ ছাপতে পারে!
এককালে যখন হিন্দুরা মুরগি খেতো না, তখন মুসলমানের মুরগিপ্রেম বলে একটা রসিকতা চালু ছিলো। বলা হতো, মুসলমানরা খুব যত্ন করে মুরগি পোষে, তবে সময় ও সুযোগ বুঝে জবাই করে খেয়েও ফেলে। আমাদের পত্রিকাওয়ালাদের ঈদকেন্দ্রিক সাহিত্যপ্রেমও যে আসলে ঐ মুসলমানের মুরগিপ্রেমের সমতুল্য, তার প্রমাণ ঈদ সংখ্যাগুলির পাতায় পাতায়। প্রয়োজনে ঐ ক্ষুদ্রাকার ‘উপন্যাসের’ হাত-পা-নাক-কান বা লেজ কেটে বরাদ্দ করা নির্দিষ্ট আকারের মধ্যে আঁটাতে হবে। যতোদূর জানি, এইসব কাটছাঁটের বেলায় লেখককে জানানোর সৌজন্যও দেখানো হয় না। ভাবটা এমন যে, লেখা ছেপে পত্রিকাগুলি লেখকদের ধন্য করে দিচ্ছে। অথচ বিষয়টা হওয়া উচিত পারস্পরিক প্রয়োজন ও সম্মানের।
এই কাটছাঁট মামলার আমি নিজে এর ভুক্তভোগী , এবং আমিই একমাত্র নই। শওকত আলী বা সৈয়দ শামসুল হকের মতো লেখকদের বেলায় এটা ঘটে না অবশ্য। তবে আমি নিশ্চিত, তাঁদেরও ‘সাইজ’ মনে রেখেই লিখতে হয়। হুমায়ূন আহমেদ বা ইমদাদুল হক মিলনরা অবশ্য এই সাইজের ‘উপন্যাসের’ মূল প্রবর্তক, সুতরাং তাঁরা নিয়ম চালু রাখেন। আনিসুল হকরাও এই প্রথার ইচ্ছুক অনুগামী। বিপদ হয় অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ও নবীন লেখকদের এবং তাঁরাই নির্বিচারে বলির শিকার হয়ে থাকেন।
সর্বগ্রাসী বাণিজ্যমুখীনতার মুখে টিকে থাকতে হলে পত্রিকাগুলিকে নিশ্চয়ই বিক্রি এবং বিজ্ঞাপন নিতে হবে, সেগুলির ওপর নির্ভর করতেও হবে। কিন্তু লাগামছাড়া মুনাফার লোভে পড়ে নামী ও প্রতিষ্ঠিত পত্রিকারাও ঈদ সংখ্যায় ১২-১৪টি করে ‘উপন্যাস’ ছাপার প্রতিযোগিতায় নামলে তা শুধু হতাশার কারণ ঘটায়। আরেকটি বিস্ময়কর ঘটনা শুনেছি। আজকাল ঈদ সংখ্যা উপন্যাসগুলির প্রতি পাতার মাঝখানে ছোটো করে বিজ্ঞাপন থাকে, অনেক পত্রিকায় সেগুলি নাকি বিজ্ঞাপনদাতারা বরাদ্দ করেন লেখকের নাম-পরিচিতি দেখে। অর্থাৎ, এই লেখাগুলিও আসলে স্পনসর করা। কিন্তু স্বল্প-পরিচিত ও নবীন লেখকদের কে স্পনসর করবে?
প্রচলিত ও প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া এই রীতির ফলে বোদ্ধা পাঠকরা মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন, ঈদ সংখ্যার ‘উপন্যাস’ পড়ার আগ্রহ তাঁদের অন্তর্হিত হয়েছে অনেক আগেই। আর ‘গল্পের বই’ পড়া আর সব গড় পাঠকদের ধারণা জন্মাচ্ছে, এই বুঝি উপন্যাস! নিশ্চয়ই কারো কারো মনে এই প্রশ্নও উঠবে, তাহলে গল্প কাকে বলে!
উপন্যাসের তাহলে কী হবে? এখন একজন লেখক যদি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লিখতে চান, লেখাটি তিনি ছাপবেন কোথায়? ঈদ সংখ্যার অবস্থা তো জানাই হলো। কোনো পত্রিকার নিয়মিত সংখ্যায় উপন্যাস লেখার সুযোগ নেই। আমার জানামতে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের দুটি মাত্র পত্রিকা ধারাবাহিক উপন্যাস ছাপছে। মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘কালি ও কলম’ একই সঙ্গে দুটি ধারাবাহিক ছাপে – কে জানে কী কারণে তার একটি আবশ্যিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের লেখকের হয়ে থাকে। আর মাসিক পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাসে কারো আগ্রহ কীভাবে টিকে থাকে আমার জানা নেই। ‘দৈনিক সংবাদ’ হলো দ্বিতীয় পত্রিকাটি যেখানে সাময়িকী পাতায় ধারাবাহিক উপন্যাস ছাপা হচ্ছে। আগেই বলেছি, সাপ্তাহিকগুলি যেখানে তাদের নিয়মিত সংখ্যায় গল্প-কবিতাও ছাপে না, ধারাবাহিক উপন্যাসের আশা তাদের কাছে না করাই যুক্তিসঙ্গত। তাহলে? লেখক যাবেন কোথায়?
লেখার উদ্দেশ্যই হলো তা উদ্দিষ্ট পাঠকের কাছে পৌঁছানো। প্রকাশিত না হলে পাঠকের কাছে তা কী উপায়ে যাবে? প্রতিষ্ঠিত লেখক হলে সরাসরি প্রকাশকের কাছে চলে যেতে পারেন গ্রন্থাকারে বের করার জন্যে, নবীন লেখকের সেই বিলাসিতা নেই। লিখবো, কিন্তু তা কোথাও ছাপার উপায় নেই – তাহলে লেখক তাঁর উপন্যাসটি (পত্রিকার শূন্যস্থান পূরণের ‘উপন্যাস’ নয়) লেখার আগ্রহ কোথা থেকে পাবেন? উত্তর নেই। পত্রিকানির্ভর উপন্যাসের জন্যে কোথাও কোনো আলোর রেখাও নেই।
Saturday, June 28, 2008
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment