১
ফ্লাইট পৌঁছেছিলো সময়মতোই, প্লেনের দরজায় প্লাস্টিক-হাসি নিয়ে দাঁড়ানো বিমান-সুন্দরী বলে, হ্যাভ আ নাইস ডে। জবাবে পরিষ্কার বাংলায় তুমিও বলে বেরিয়ে আসে বিজু। জানে প্লাস্টিকবালা তার জবাব শোনার জন্যে অপেক্ষা করে নেই, বিজু কিছু বললো কি বললো না তা নিয়ে মাথাও ঘামাবে না সে। শুধু বিজু কেন, কারো জবাবই সে শুনবে না, তার মুখস্থ হ্যাভ আ নাইস ডে-র জবাব সে চায়ই না। প্লেন ল্যান্ড করার পর যাত্রীরা বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজায় দাঁড়িয়ে হাস্যমুখে তাকে ওই এক বাক্যের সম্ভাষণ আউড়ে যেতে হবে এক নাগাড়ে। মাথাপিছু একবার। চাকরি।
ব্যাগেজের জন্যে অপেক্ষা করতে হয় অনেকক্ষণ। সত্যি হয়তো অনেকক্ষণ নয়, কিন্তু ভ্রমণের ক্লান্তি আর অবসাদ অনেক সময় সেরকম ধারণা দিয়ে থাকে বটে। যেমন এখন। হাতের কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখে বিজু, সাড়ে সাতটা। এখনো ঈস্ট কোস্টের সময় দেখাচ্ছে। কাঁটা ঘুরিয়ে সাড়ে ছ'টা করে দেয়। স্থানীয় সময়। বাংলাদেশে এখন সকাল সাড়ে ছ'টা, ঠিক বারো ঘণ্টার পার্থক্য।
মনে মনে ঢাকার সঙ্গে এই সময় অনুবাদের অভ্যাস তার আজও যায়নি। বারো বছর পরেও। সময় অনুবাদ করেও মন থেমে থাকে না। দেখে মা সকালের চা নিয়ে বারান্দায় বসেছে, কাজের লোকজনের তদারকি করছে। মগবাজারের মোড়ে ক্যাফে তাজ-এর সামনের চুলায় আগুন দেওয়া হয়েছে, বিশাল তাওয়ার ওপরে পরোটা। দূরপাল্লার বাসগুলো রওনা হচ্ছে। রমনায় বয়স্ক মানুষদের হাঁটাহাঁটি। শহর জেগে উঠেছে আরেকটি দিনের জন্যে। মনে মনে এইসব দেখা বিজুর নিজস্ব বিনোদন।
আজকের বিমানযাত্রায় অবশ্য ক্লান্ত-অবসন্ন হওয়ার কথা নয়। ফ্লাইটের সময় খুব দীর্ঘ ছিলো না, ঘণ্টাতিনেক। বিমানভ্রমণের জন্যে দু'তিন ঘণ্টার ফ্লাইটই আদর্শ। ঢাকা-কক্সজার বা ঢাকা-কলকাতার বিমানযাত্রা অসহনীয় রকমের বিরক্তিকর লাগে বিজুর, প্লেনে উঠে জুতমতো বসতে না বসতেই ল্যান্ডিং-এর ঘোষণা।
এখান থেকে ঢাকায় যাতায়াত আরেক মেরুর অভিজ্ঞতা, সে অনন্তযাত্রা আর শেষ হয় না, শেষ হবে এমন ভরসাও একসময় ক্ষীয়মাণ হয়ে আসতে থাকে। প্লেনের ভেতরে একঘেয়ে গোঁ গোঁ শব্দ। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে মেঘদলের ভেতর দিয়ে উড়ে যাওয়ার খেলা, সেই অপরূপ সুন্দর দৃশ্যও অপরিবর্তনীয় হয়ে থাকে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লান্তিকর ঠেকে। স্থবির-অনড় সৌন্দর্যও একসময় একঘেয়ে মনে হয়, চোখ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মুখের ভেতরে এক ধরনের তেতো স্বাদ স্থায়ীভাবে জায়গা করে নেয়, কোনো খাবারই মুখে রোচে না - সব খাবারের স্বাদ-গন্ধ একই রকমের লাগে। বসে থাকতে থাকতে হাত-পা অবশ হয়। শরীরের বাঁধনগুলো আলগা হয়ে যায় বলে মনে হয়। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে। বিজু প্লেনে একদম ঘুমাতে পারে না। একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হতেই চমকে জেগে ওঠে, ঘুমাতে না পারার কষ্টে শরীর নির্যাতিত হতে থাকে।
ব্যাগেজ সংগ্রহের নির্দিষ্ট জায়গায় ক্যারুসেল এখনো নড়াচড়া শুরু করেনি, সুতরাং এখন দাঁড়িয়ে থাকো। বিরক্তিকর। গন্তব্যে পৌঁছে ব্যাগেজের জন্যে অপেক্ষা এক যন্ত্রণা। ফ্লাইটের জন্যে বসে থাকা যায় - ওয়েটিং এরিয়ায় খবরের কাগজের পাতায় সময় কাটে, এক কাপ কফি কিনে নিয়ে ওভারহেড টিভিতে সিএনএন দেখা যায়।
তিন বছর আগের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকাকে বদলে দিয়েছে, পরিণত করেছে সিজোফ্রেনিক এক জনগোষ্ঠীতে। সবকিছুতে এখন সন্ত্রাসের আতংক। পুকুরের পানিতে নিরীহ সাদা রঙের কিছু দেখলেই সন্দেহ সেটা অ্যানথ্রাক্স। সারা পৃথিবীকে তারা এই অজুহাতে বদলে দিতে চায়। একে ধরো, ওকে মারো, তাকে হটাও - এইসব চলছে সেই থেকে।
এই আতংকের চেহারা সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান এয়ারপোর্টে। সিকিউরিটি চেকিং-এর সময় শুধু পরনের প্যান্ট আর জামাটা খুলতে হয় না। পায়ের জুতা, কোমরের বেল্ট খোলো, সেলফোন, সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার, খুচরো পয়সা, চাবির গোছা বের করে সিকিউরিটির বাস্কেটে দাও। তারপর মেটাল ডিটেক্টর লাগানো দরজার ভেতর দিয়ে হাঁটো। পিক আওয়াজ হলো তো ফিরে গিয়ে ভালো করে দেখো শরীরের কোথাও ধাতব আর কিছু আছে কি না। ব্যাগের মধ্যে ছুরি-কাঁচি জাতীয় কিছু নেওয়া যাবে না, যতো ছোটোই হোক। ওগুলোই নাকি সন্ত্রাসীদের অস্ত্র। কী আশ্চর্য! 'হৃদয়ের মতো মারাত্মক একটি আগ্নেয়াস্ত্র, আমি জমা দিইনি'! কে লিখেছিলো? নির্মলেন্দু গুণই তো।
নতুন নিয়মকানুন জারি হওয়ার কালে বিজুর মনে হয়েছিলো, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ভল্যুমগুলো নিষিদ্ধ করার কথা কারো মনে পড়েনি কেন? ছোটোখাটো ছুরি-টুরির চেয়ে ওগুলোর ক্ষতি করার ক্ষমতা বেশি ছাড়া কম নয়।
কাচের দেয়ালের বাইরে তাকিয়ে দেখা যায়, শরতের রোদ মরে এসেছে। প্লেন নামার সময় ঘোষণা শুনেছিলো, স্থানীয় তাপমাত্রা পঁয়ষট্টি ডিগ্রী ফারেনহাইট। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও আজকাল মেট্রিক পদ্ধতি চালু হয়ে গেছে, অথচ এদেশে যে কেন পুরোপুরি চালু হলো না, কে জানে! অদ্ভুত এক জবরজং হয়ে আছে - টাকাপয়সার হিসেবে দশমিক, পাশাপাশি চালু আছে দূরত্বসূচক ফুট-গজ-মাইল, ওজনের বেলায় আউন্স-পাউন্ড। ওষুধপত্রে মিলিগ্রাম। গ্যাস স্টেশনে যাও, সেখানে আবার গ্যালনের হিসেব। দোকানে কোকাকোলার বিশ আউন্সের বোতলের পাশে দু'লিটারের বোতলের নির্বিরোধ সহাবস্থান। আমেরিকার সাধারণ মানুষদের, যাদের সবার নামই নাকি জো ব্লো, আইকিউ-এর দৌড় নিয়ে অনেক মজার গল্প চালু আছে, সেটাই হয়তো এই জগাখিচুড়ি অবস্থাটা স্থায়ী করে রেখেছে। সেলসিয়াস বা মিটার শুনলে তারা হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে - এগুলো খায়, না মাথায় মাখে? আরো একটা কারণ আছে বলে বিজুর মনে হয় - বিখ্যাত মার্কিন কবির আই হ্যাভ মাইলস টু গো-র শুদ্ধতা রক্ষাও তো দরকার। কিলোমিটারস টু গো বলা যাবে? হাস্যকর শোনাবে না!
ব্যাগেজ এলাকায় অদৃশ্য সুড়ঙ্গ থেকে এখন কনভেয়র বেল্টে চড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে বিভিন্ন আকার ও চেহারার স্যুটকেস, নানা চেহারা ও স্বাস্থ্যের ব্যাগ, স্লিপিং ব্যাগ, কার্ডবোর্ডের বাক্স। গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে ঘুরন্ত ক্যারুসেলে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছো, থাকো - ক্যারুসেল তোমার ব্যাগেজটি সামনে এনে হাজির করলে টুপ করে তুলে নাও। কনভেয়র বেল্টে একটা চ্যাপ্টামতো লম্বা বাক্সও দেখা যায়, আকার দেখে ভেতরে কী আছে বোঝার উপায় নেই। সবই আসছে, শুধু বিজুর কালো রঙের ব্যাগটারই দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।
ভেবে দেখলে ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য। জীবনে অন্তত একবারও কি ওর ব্যাগেজ প্রথমদিকে আসতে পারে না? কনভেয়র বেল্টে কারো না কারো ব্যাগ বা স্যুটকেস তো প্রথমে আসবেই। সেই প্রথমটা কখনোই বিজুর নয়, এমনকি প্রথম দশ-পনেরোটার মধ্যেও তার ব্যাগেজের দেখা সে পায়নি এ জন্মে। এয়ারপোর্টে কাউকে হয়তো রিসিভ করতে এসেছে বিজু। তার যাত্রীটি অবধারিতভাবে একেবারে শেষের দিকে হেলেদুলে বেরিয়ে আসে - প্লেনের ভেতরে বসে এতোক্ষণ কী যে করে কে জানে!
কাঁধে ঝোলানো হাতব্যাগটা অসহ্য লাগছিলো। ভারী তেমন নয়, তবু অযথা ঘাড়ে তুলে রাখারও কোনো মানে হয় না। ব্যাগটা বিজু পায়ের কাছে নামিয়ে রাখে। হাত দুটো বুকের ওপর আড়াআড়ি রেখে দাঁড়ায়। কনভেয়র বেল্টের ওপরে রাখা চোখে শিকারী মাছরাঙার একাগ্রতা। নৌকায় নানাবাড়ি যাওয়ার সময় দেখেছে, শূন্যে একই জায়গায় স্থির থেকে মাছরাঙা ক্রমাগত ডানা ঝাপটায়, তার অচঞ্চল চোখ নিচে পানির ভেতরে ভাসতে থাকা মাছের ওপর। অস্ত্র তার ঠোঁট, তাক করে আছে শিকারের দিকে।
কালো ব্যাগ শেষ পর্যন্ত দেখা দেয়। ব্যাগটা বিজু কনভেয়র বেল্ট থেকে তুলে নিতেই পাশে দাঁড়ানো আরেকজন যাত্রী হাসিমুখে বলে, সম্ভবত তোমার ভুল হয়েছে। এ ব্যাগটা আমার।
বটেই তো - এ রকমই হওয়ার কথা! হুবহু এক রকম দেখতে, তবু ব্যাগ ওর নয়! বিব্রত মুখে দুঃখিত বলে ব্যাগের দখল ছেড়ে দেয় বিজু। দুঃখিত সে হয়নি, বলার জন্যে বলা। দুঃখিত তার নিজের জন্যে হওয়া উচিত। যে কোনোকিছু ঠিক যেরকম ঘটা উচিত বলে মনে হয়, তার বেলায় কীভাবে যেন সব নিয়ম-কানুন পাল্টে যায়!
ব্যাগেজ এলাকার ভিড় অনেকটা পাতলা হয়ে যাওয়ার পর নিজের ব্যাগের দখল পেয়ে বিজু এসকেলেটরে নিচে নেমে আসে। নিচের এ জায়গাটা সুড়ঙ্গের মতো - আধো অন্ধকার। দিনদুপুরেও বাতি জ্বলে। যে রাস্তাটা ঘুরে ঘুরে এয়ারপোর্টের সবগুলো টার্মিনাল ছুঁয়ে চলে গেছে, তার সমান্তরাল মাটির নিচে বানানো হ্রস্ব এই সুড়ঙ্গ-রাস্তাগুলো। সুড়ঙ্গগুলো খুব দীর্ঘ নয় বলে দু'দিক থেকে দিনের আলো খানিকটা আসে, নিউ ইয়র্কের আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন স্টেশনের মতো পুরো রাতের চেহারা পায় না। ওপরের মূল রাস্তা থেকে আলাদা হয়ে সুড়ঙ্গে ঢুকে আরেকদিক দিয়ে বেরিয়ে আবার সদর রাস্তায় উঠে পড়ো।
নিচের সুড়ঙ্গ-রাস্তার পাশে বহির্গামী যাত্রীদের জন্যে চেক-ইন করার ব্যবস্থা, বিশেষ করে খুব ভারী লাগেজ থাকলে এখানে চেক-ইন করতে সুবিধা, টানাটানি করে ওপরে না গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে কয়েক পা এগোলেই কাউন্টার। কাছে কাচে ঘেরা যাত্রীদের প্রবেশপথ, এসকেলেটরে ওপরে ডিপারচার লাউঞ্জে উঠে যাওয়ার ব্যবস্থা। এলিভেটরও আছে। রাস্তার ওপারে আন্ডারগ্রাউন্ড গাড়ি পার্কিং-এর জায়গা।
ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে বিভিন্ন জাতের সাইন দেখে বিজু বুঝে উঠতে পারে না, ঠিক কোথায় দাঁড়াতে হবে বাসের জন্যে। দুটো বাস দাঁড়িয়ে আছে সামান্য দূরত্বে, এগুলোর একটাও ওর নয়। এয়ারপোর্টের পশ্চিমে গাড়ি পার্কিং এলাকায় যাবে একটা, অন্যটা শাট্ল্ বাস - যাত্রীদের নিয়ে যাবে শহরের ভেতরে যাত্রীদের যার যার হোটেল বা বাড়ির ঠিকানায়। ওর বাসও ওখানেই আসবে ভেবে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। ব্যাগ দুটো নামিয়ে রেখে ভাবে, সিগারেট ধরানো দরকার। সেই বস্টন এয়ারপোর্টে ঢোকার আগে শেষ সিগারেট খেয়েছে - পাঁচ ঘণ্টারও বেশি।
আজকাল কোনো ফ্লাইটেই সিগারেট খাওয়া যায় না। এমনকি কোথাও কোথাও এয়ারপোর্টের ভেতরেও নয়। কোনো কোনো এয়ারপোর্টের ভেতরে অবশ্য ধূমপানের জন্যে নির্দিষ্ট জায়গা করে দেওয়া আছে। আটলান্টায় দেখেছে পাশাপাশি দুটো খাঁচার মতো ঘর, সেখানে বসে ধূমপান করা যায়। কোরিয়ার সিউল এয়ারপোর্টে দেখেছিলো আরো ভয়াবহ অবস্থা। কাচঘেরা দরজাবন্ধ ঘরে সিগারেট খেতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। ঢোকার আগে বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছিলো, ঘরটি ধোঁয়ায় ধূসর। বেরিয়ে আসার পর মনে হয়েছিলো, ওই ঘরে ঘণ্টা দুয়েক কাউকে আটকে রেখে দিলে সারাজীবনের মতো সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে উড়ে যাবে। বিজু নিজে অবশ্য ওই ঘরে দু'ঘণ্টা থাকবে না, সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছে কখনো হলে দেখা যাবে।
এখন প্রায় সারা পৃথিবীতে সিগারেটখোরদের বড়ো দুর্দিন, প্রায় জাতগোত্রহীন প্রাণী হিসেবে গণ্য করা হয় তাদের। এ দেশে পুলিশে ধরে পেটালে পুলিশের নামে মামলা ঠুকে দেওয়ার অধিকার আছে, অথচ সিগারেটের মতো জরুরি বিষয় নিয়ে যে এতো খবরদারি চলছে সেখানে অধিকারবোধের কথা কেউ যে মনেও রাখছে না! বিজু মাঝে মাঝে ভাবে, বাঙালির সংগ্রামী ঐতিহ্যের ধারায় একটা জঙ্গী আন্দোলন করে ফেলা যায় না? নিদেনপক্ষে একখানা হরতালের ডাকও তো দেওয়া যায়!
সিগারেট ধরাবে কি না এই দ্বিধায় পড়ে যায় বিজু। সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে একজোড়া বুড়োবুড়ি। ধূমপায়ীদের কপালে কোনো ছাপ মারা থাকে না, ওদেরও নেই। তবু তার ধারণা হয়, ওরা না-খাওয়া গোত্রের। ওদের সামনে সিগারেট ধরিয়ে ফেললে হয়তো মুখে কিছু বলবে না, কিন্তু কপাল কুঁচকে এমনভাবে তাকাবে যেন বিশাল কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। এরকম অভিজ্ঞতা দু'একবার হয়েছে। গায়ের রং তামাটে দেখলে আগেও কেউ কেউ ভুরু কুঁচকে তাকাতো, আজকাল তা সারাক্ষণ মনে রাখতে হচ্ছে - তাদেরই এখন সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে মনে করা হয়। একসময় হয়তো পৃথিবী গায়ের চামড়ার রং দিয়েই বিভক্ত হয়ে যাবে। সুতরাং আলাদা করে নজরে না পড়ে ভিড়ে মিশে থাকাই ভালো।
দ্বিধায় পড়ার পরের কারণ কিছু জটিল। তার অভিজ্ঞতা বলছে, সিগারেট না ধরালে আরো মিনিট পনেরো অপেক্ষা করতে হবে বাসের জন্যে। কিন্তু সে ঠিক জানে, যদি ধরিয়ে ফেলে, গোটা দুয়েক টান দেওয়ার পরেই বাসের দেখা পাওয়া যাবে। প্রায় আস্ত সিগারেট তখন ফেলে দিয়ে বাসে উঠে পড়তে হবে। মৌজ টুটে গেলে কারো ভালো লাগে! হাজার হোক, নেশার জিনিস তো বটে!
একবার নয়, দু'বার নয় - অজস্রবার এরকম ঘটেছে। একবার অফিসের কাজে বিজুকে সিঙ্গাপুর যেতে হয়েছিলো মাসখানেকের জন্যে। পৃথিবীর অন্য অনেক শহরের মতো নয় সিঙ্গাপুর, সেখানে যখন-তখন ট্যাক্সি পাওয়া কোনো শক্ত ব্যাপার নয়। অথচ তাড়ার সময় অনেকবার দেখেছে, সব খালি ট্যাক্সিগুলো যাচ্ছে উল্টোদিকে। বিরক্ত হয়ে রাস্তার ওপারে গিয়ে দেখেছে কিছুই বদলায়নি ট্যাক্সিগুলো তখনো যাচ্ছে উল্টোদিকে, সে নিজে দাঁড়িয়ে আছে ভুল জায়গায়!
এবারের এই বস্টন ট্রিপটাও ব্যতিক্রম কীসে! ডালাস ছাড়ার দিনে ফ্লাইট ছিলো দুপুর আড়াইটায়। দুপুরের খাওয়ার জন্যে সেটা বড্ড দেরি। সকালে জরুরি কয়েকটা কাজ সেরে নেওয়ার জন্যে অফিসে যেতে হয়েছিলো, তার ওপরে একটা অনির্ধারিত মিটিং-এও বসতে হয়। দেরি হয়ে যাচ্ছিলো বলে তাড়াহুড়ো করে এয়ারপোর্টে পৌঁছে একটা স্যান্ডউইচ আর বরফ-চা খেয়ে প্লেনে উঠেছিলো বিজু। অহো, বিমান আকাশে ওড়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ট্রে-ভর্তি খাবার এসে হাজির। স্যান্ডউইচ, চিপস, ব্রাউনি আর একখানা আস্ত আপেল। অতোসব খাওয়ার অবস্থা ছিলো না বিজুর, আকাশযাত্রার একঘেয়েমি কাটাতে শুধু চিপস খানিকটা চিবিয়েছিলো। কিছু পরে এককাপ কফিও পাওয়া যায়।
আজ ফেরার ফ্লাইটও প্রায় একই সময়ে - বস্টনের সময় দুপুর পৌনে তিনটা। হাতের কাজকর্ম সারতে সারতে সাড়ে বারোটা। দুপুরের ট্র্যাফিক ঠেলে এয়ারপোর্টে পৌঁছতেও ঘণ্টাখানেক লেগে যাবে। বস্টনে বিজুর এই প্রথম। অচেনা শহরে একা ড্রাইভ করার সময় এক ধরনের উৎকণ্ঠা থাকে, সময়মতো পৌঁছতে পারবো তো! একবার পথ ভুল করে ফেললে ঠিক রাস্তায় ফিরতে অনেকখানি সময় খরচ হয়ে যেতে পারে। ভাড়া করা গাড়ি আবার জায়গামতো ছাড়তে হবে। সাত রকমের ব্যস্ততা আর উদ্বেগে দুপুরে খাওয়ার কথা বিজুর মনেও পড়েনি। সব সেরে কোনোমতে প্লেনে উঠে নিজের সীটে বসতেই খিদে টের পায়। তিনদিন আগের অভিজ্ঞতা মনে করে নিশ্চিন্তও বোধ করে - খাবার প্রচুর দিয়েছিলো সেদিন। কিন্তু আশ্চর্য, কী করে যে ওরা বিজুকে চিনে ফেলে বার বার কে জানে! আজকের ফ্লাইটে খাবার বলতে সাকুল্যে পাওয়া গেলো লিলিপুটদের দেশ থেকে আমদানি করা অতিশয় ছোটো এক প্যাকেট প্রেটজেল আর বাচ্চাদের খেলনা সাইজের প্লাস্টিকের গ্লাসে দু'চুমুক-সমান কোক।
খিদেয় এখন পেট জ্বলছে, ক্লান্তি আর অবসাদের কারণও সেখানেই। বাড়ি ফেরার তাড়া আছে, তবু এয়ারপোর্টে কিছু একটা খেয়ে নিলে হতো। ইচ্ছে করেনি। পেটে এখন কিছু পড়া দরকার মনে হলেও বাড়ি ফিরে খাবে ঠিক করেছিলো। রানু অফিস থেকে এতোক্ষণে ফিরেছে নিশ্চয়ই। কাজের চাপ পড়লে মাঝেমধ্যে অবশ্য দেরিও হয়। বিজুর আজ ফেরার কথা, রানুর মনে আছে কি না কে জানে!
হাতের কাছে খাবার নেই, সিগারেট আছে। বিজুকে অবাক করে দিয়ে বুড়োবুড়ি দু'জনেই সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে। জয় বাংলা! এবার আর আটকায় কে! দু'টান দেওয়ার পরে বাস আসে তো আসুক। ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট ঝুলিয়ে পকেট হাতড়ে মেজাজ খারাপ। লাইটার কোথায় গেলো? কোথায় পড়েছে কে জানে! কলম, লাইটার এসব যারা সবসময় হারায়, বিজু সে দলের মানুষ নয়। ভ্রমণের সময় হাতব্যাগের ভেতর একটা-দুটো অতিরিক্ত লাইটার রাখে সে, খুঁজলে ঠিকই পাওয়া যাবে। কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে ব্যাগের ভেতর এখন হাতড়াতে যাবে কে? বুড়োবুড়ির কাছে চাইতে হবে।
এখানে সিগারেটের আগুনও ধার করতে হয়। বলতে হবে, ক্যান আই বরো আ লাইট? যেন বাড়ি বয়ে গিয়ে কালই বিজু ধার করা আগুন ফেরত দিয়ে আসবে। এ দেশে আসার আগে শুনেছিলো, আমেরিকায় ভিখারি বলে কিছু নেই। কিন্তু সিগারেটের ভিখারি তো যত্রতত্র। জীর্ণ কাপড় পরা বয়স্ক সাদা চামড়ার মানুষ, কখনো তরতাজা কৃষ্ণকায় যুবক নির্দ্বিধায় এগিয়ে এসে বলে, ক্যান আই বরো আ স্মোক?
এক হিসেবে এরা আবার ভিক্ষুকও নয়, ভিখারিরা ধার চায় না, দান চায়। বিজুর তখন বলতে ইচ্ছে করে, বাবা, ধার তো নিচ্ছো, ফেরত দেবে কীভাবে? তোমার সঙ্গে এ জীবনে কখনো আর দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখি না যে!
বুড়োর লাইটারে সিগারেট ধরিয়ে বিজু বলে, জানো একবার এক বন্ধুর কাছে দেশলাই চাইলাম। বন্ধু গম্ভীর মুখে বললো, সিগারেট নেই, ম্যাচও নেই, শুধু অভ্যাসটা আছে!
দু'জনেই খুব মজা পেয়ে গলা খুলে হাসে। বুড়ির প্রশ্ন, কোথা থেকে আসছো তুমি?
আমি এ শহরেই থাকি, বস্টনে গিয়েছিলাম একটা কাজে।
মুচকি হেসে বুড়ো জিজ্ঞেস করে, কতোদিন ছিলে?
তিনদিন।
তিনদিনেই তুমি বস্টনের লোকদের কায়দায় বস্টন বলতে শিখে ফেলেছো দেখছি। টেক্সাসে আমরা বস্টনকে তো বস্টন বলি।
থতমত খেয়ে বিজু বুঝতে পারে, ওর অবস্থা এখন সেইসব মানুষের মতো যারা চোরকে চুর বলে, কিন্তু চোর আর চুর উচ্চারণের পার্থক্য কিছুতেই ধরতে পারে না। বুড়ো বস্টন শব্দটা নিশ্চয়ই দু'রকম করে বলেছে পার্থক্য বোঝানোর জন্যে, কিন্তু তার কানে ধরা পড়েনি। বোকার মতো হাসতে হয়।
বুড়ো আবার জিজ্ঞেস করে, তোমার দেশ কোথায়? ইন্ডিয়া?
না, বাংলাদেশ।
ওঃ ব্যাংলাডেশ, সেই জর্জ হ্যারিসনের কনসার্ট।
বিজু দেখেছে, এ দেশী অপেক্ষাকৃত কম বয়স্করা বাংলাদেশ নামের দেশটি এই পৃথিবীতে নাকি অন্য কোনো গ্রহে - জানেই না। কেউ কেউ নামও শোনেনি। একটু বয়স্করা চেনে জর্জ হ্যারিসনের কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর সুবাদে। মনে থাকারই কথা, তাদের যৌবনের উদ্দাম সময়ের ঘটনা! আজকাল যে কোনো অজুহাতেই বেনিফিট কনসার্ট করে তহবিল সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশের নামে সেই ধারণার শুরু হয়েছিলো, সে কথা ক'জন মনে রেখেছে?
বিজু বলে, হ্যাঁ। সেই বাংলাদেশ।
রাভি শ্যাঙ্কারের জ্যায় বাংলাও শুনেছি আমি।
জয় বাংলা নামে রবি শঙ্করের কোনো রেকর্ড আছে, বিজু জানতো না। জয় বাংলা শুনলে তার এক ধরনের অহংকার হয়। এ শুধু আমাদের নিজস্ব, আর কোনো দেশের মানুষের কোনো ভাগ নেই সেখানে। কী ধ্বনিময়, কাব্যিক এবং উদ্দীপক! বিজুর যখন বোঝার বয়স হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে জয় বাংলা উধাও হয়ে গেছে ততোদিনে, কেউ আর বলে না। যারা এর উদগাতা, তারাও যে কী করে ভুলে গেলো! জয় বাংলা বলে বাঙালি যুদ্ধ করেছিলো, বীরের মতো জয় করেছিলো। তারপর সব ভুলেও গেলো। এগুলো তার শোনা কথা, গল্পের মতো। তবু জয় বাংলা তার ভেতরে গাঁথা হয়ে আছে, প্রকাশ্যে বলতে গেলে কেউ কেউ খুব অদ্ভুত চোখে তাকায়। কোনো অশ্লীল কথা শুনলেও অনেকেই ওভাবে তাকাবে না। জয় বাংলা কি এতোটাই অশ্লীল, অস্পৃশ্য, অনুচ্চারণীয়?
এবার বুড়ো অজান্তে তার হাতে একটা লোপ্পা ক্যাচ তুলে দিয়েছে। সুযোগটা ছাড়ে না বিজু। বলে, আমরা কিন্তু রাভি শ্যাঙ্কারকে চিনি না, ওঁর নাম রবিশঙ্কর।
বুড়োর মুখ লাল হয়ে উঠতে দেখে বিজু, একটুও খারাপ লাগে না। এ দেশে এসে প্রথম প্রথম এসব নিয়ে কিছু না বলে চুপ করে থাকতো। এখন সুযোগ পাওয়ামাত্র অপমানটা ফিরিয়ে দেয়। অপমান না তো কী? ওরা আশা করবে ওদের নামধামসহ ইংরেজি সবকিছু ওদের মতো আমরা উচ্চারণ করবো, আর আমাদের নামগুলি যেমন খুশি বলার সব অধিকার ওদের!
বাংলাদেশকে বলবে ব্যাংলাডেশ। আবদুলকে অ্যাবডুল। এমন নয় যে ওদের ভাষায় দ-এর উচ্চারণ নেই - ফাদার, মাদার বলতেও দ লাগে। বাংলাদেশ বলার সময় দ আর মুখে আসে না। যতোসব!
বরাবর যা হয়, বিজু তাই হতে দেখে আবার। বুড়োবুড়ির বাস চলে এসেছে। বিজুরটা তো সবার শেষে আসার কথা - ওর জন্মের আগেই এসব ঠিক হয়ে আছে। জানতে এবং হজম করতে তার একটু সময় লাগছে, এই যা।
আরো খানিক পরে বাসের দেখা মেলে। নীল রঙের বাসের গায়ে সাদা অক্ষরে লেখা - পার্ক অ্যান্ড ফ্লাই। বিজুর সিগারেট প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো, সুতরাং ফেলে দিতে কষ্ট হয় না। খুবই ধীরে এগিয়ে আসছে বাসটা, থামবে কি না বোঝা যাচ্ছে না। অগত্যা হাত তুললে বাস থামে। তাড়াতাড়ি উঠে এলে ড্রাইভার জানায়, বিজু ভুল জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলো, ওখানে এই বাসের থামার কথা নয়। ক'দিন আগে ওখানে বাস থামানোর কারণে এক ড্রাইভারকে জরিমানা দিতে হয়েছে।
কী আশ্চর্য! অন্যসব বাস থামার জায়গাতেই বিজু দাঁড়িয়ে ছিলো। তার বাসের জন্যে ওটা ভুল জায়গা!
বাসে আরো চার-পাঁচজন যাত্রী। খালি একটা সীটে বসতে বসতে বিজু ড্রাইভারকে জানায়, আমার জন্যে থেমেছো বলে ধন্যবাদ। ভয় পেয়ো না, কাউকে আমি বলতে যাচ্ছি না। শুধু তোমার বসকে একটু না জানালে ব্যাপারটা কিন্তু খুবই খারাপ দেখাবে!
জোরে হেসে ওঠে কৃষ্ণকায় ড্রাইভারটি, ভালো বলেছো কিন্তু!
মিনিট কয়েকের মধ্যে বাস ঢুকে পড়ে পার্ক অ্যান্ড ফ্লাই-এর পার্কিং লট-এ। সারি সারি গাড়ি পার্ক করা। '...চোখে পড়বে মানুষের সাধ্যমতো ঘরবাড়ি...' আল মাহমুদের কবিতার লাইন না? নাকি অন্য কারো? এ দেশে অবশ্য ব্যাপারটা সাধ্যমতো গাড়ি। গাড়ি দেখে মানুষের বিত্তের আন্দাজ মেলে, চালককেও খানিকটা চেনা যায়। বিশ-বাইশ বছরের উদ্দাম যুবক কখনো মার্সিডিস চালাবে না, চালাবে যারা সমাজে স্থিত, আর্থিকভাবে নিশ্চিত। করভেট-এর চালক সশব্দ গতির প্রেমিক। টয়োটা করোলা নিতান্ত মধ্যবিত্তের। মার্সিডিসের গরিবি সংস্করণ লেক্সাস আরেকটু উঁচু জাতের মধ্যবিত্তের বাহন, বিএমডবি্লউ বা জাগুয়ার-এর মালিকরা আভিজাত্যের প্রতিনিধি।
দেশে ফেরিঘাটে যেমন হরেক রকমের দোকানপাট গড়ে ওঠে মানুষের দরকারের কথা মনে রেখে, এখানে এয়ারপোর্টের আশেপাশে পার্ক অ্যান্ড ফ্লাই-এর মতো ব্যবসা ফেঁদে বসে গেছে এরা। মানুষের প্রয়োজনেই উদ্ভাবিত হয় নতুন ব্যবসা। দু'চারদিনের জন্যে বা দিনে-দিনে ফেরার মতো সময়ের জন্যে বিমানযাত্রার কালে এদের জিম্মায় গাড়ি রেখে যাওয়া যায়। পয়সার হেরফেরে খোলা জায়গায় অথবা ছাদঢাকা জায়গায় গাড়ি রেখে যেতে পারো। ওরা নিজেদের বাসে নির্দিষ্ট এয়ারলাইনের টার্মিনালে পৌঁছে দেবে। বাসগুলো এয়ারপোর্টের বিভিন্ন টার্মিনালে সারাদিন টহল দিতে থাকে। ফেরার সময় বাস চিনে উঠে পড়লেই হলো, ফিরিয়ে নিয়ে আসবে নিজেদের পার্কিং লটে।
নিউ ইয়র্কের মতো ট্যাক্সিবহুল শহর নয় ডালাস, তবু ফোন করে দিলে সময়মতো পাওয়াও কঠিন নয়। কিন্তু এখানে গাড়ি রেখে গেলে খরচ পড়ে ট্যাক্সিভাড়ার তুলনায় অনেক কম। তিনদিনের জন্যে বিজুর খরচ হবে গোটা পঁচিশেক ডলার। ট্যাক্সিতে বাসা থেকে এয়ারপোর্টে যাতায়াতে পঞ্চাশ-ষাটের ওপর অনায়াসে লেগে যেতো। পঁচিশ-পঞ্চাশে বিজুর নিজের কিছু আসে-যায় না, পয়সা দেবে অফিস।
বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত কাউকে বলা যেতো। সময়মতো এয়ারপোর্টে নামিয়ে দেবে, তুলেও নেবে ঠিক। অনেকে বউ বা বন্ধু-বান্ধবের গাড়িতে এয়ারপোর্টে যাতায়াত করলেও অফিসের কাছে ট্যাক্সিভাড়ার টাকা ঠিক ঠিক বিল করে আদায় করে নেয়। যেসব খরচের জন্যে রসিদ না থাকলেও চলে, ট্যাক্সিভাড়া বা পোর্টারের টিপস সেগুলোর মধ্যে পড়ে। এই কারণে বন্ধুদের অনুরোধ করতে ইচ্ছে করে না বিজুর। তারা ভেবে বসতে পারে, বিজু অফিসের পয়সা পকেটে ঢোকাবে। দরিদ্র দেশের মানুষ হলেও বিজুর কাছে খুব অরুচিকর লাগে এই ক্ষুদ্র অসততা। বিজু খুব সাধুপুরুষ, এমন নয়। হাতের কাছে মিলিয়ন ডলারের দাঁও পেয়ে গেলে কী হবে বলা শক্ত, কিন্তু এরকম ছিঁচকেমিতে তার রুচি নেই। অফিসের কাজে না হয়ে ব্যক্তিগত কারণে এয়ারপোর্টে যাতায়াতের দরকার হলে অবশ্য আলাদা কথা। তবু কাউকে বলতে ভালো লাগে না বিজুর। নিজেকে দিয়েই জানে, সবারই ব্যস্ততা আছে, কাজকর্ম আছে। রানুকে বলা যেতো। যেতো কি? নাঃ, হয়তো যেতো না।
ড্রাইভারের হাতে নিজের গাড়ির হদিস লেখা কাগজখানা ধরিয়ে দিয়েছিলো বিজু। কাগজ দেখে পার্কিং লটে ওর গাড়ির সামনে বাস থামিয়ে দেয় ড্রাইভার। ব্যাগ দুটো তুলে নিয়ে দরজার কাছে আসতে ড্রাইভার বলে, হ্যাভ আ নাইস ডে।
আবার সেই নাইস ডে! দিন যেমনই যাক, ধন্যবাদ দেওয়া রেওয়াজ। বিজুও দিলো।
পার্কিং লট থেকে বেরোনোর পথে একটা খুপরিমতো ঘরে জানালা খুলে বসা এক মহিলা। গাড়ি থেকে নামার দরকার নেই। গাড়ি রেখে যাওয়ার সময় পাওয়া দিন-সময়ের ছাপ মারা কার্ডটা এগিয়ে দেয় বিজু। মহিলা কমপিউটার টিপে বলে দেয়, কতো দিতে হবে। পয়সা মিটিয়ে দিলে সামনে যাওয়ার রাস্তা উন্মুক্ত হয়ে যায়।
রাস্তায় নেমে এক মিনিটের মধ্যে হাইওয়ে। 'মানুষের সাধ্যমতো ঘরবাড়ি...'। কোন কবিতার লাইন এটা? আগে-পরের লাইনগুলো মনে পড়ে না, শুধু এইটুকু মাথার ভেতরে আটকে আছে! আহ্, কতোদিন কবিতা পড়া হয় না, বিজুর মনেও নেই। মাঝে মাঝে এমন আচমকা একেকটা লাইন কোথা থেকে মাথার ভেতরে ফিরে ফিরে আসে। ক'দিন আগে মনে পড়েছিলো এরকম একটি পংক্তি, '... প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে, মনেও রাখবে না...'। মনে পড়ে না - কোথায় পড়েছিলো, কোন কবিতা, কার লেখা।
এবার দেশ থেকে কিছু কবিতার বই আনিয়ে নিতে হবে। ভাবতেই তার মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে ওঠে। ওই ভাবা পর্যন্তই। এই তো গত বছর নিজে দেশে গিয়েছিলো, ইচ্ছেটা তেমন হলে তখন নিয়ে আসতে পারতো। করবো করবো করেও কতো কিছু করা হয় না, দিনযাপনের বায়না নিয়ে কেটে যায় একটিমাত্র জীবন।
গাড়ির ভেতরে সিগারেট খাওয়া একেবারে বারণ। রানু আজকাল পৃথিবীর ধূমপান নিষিদ্ধকরণ অভিযানের অগ্রসেনানীদের একজন। সুতরাং ওই বিষয়ে বিজুর ওপর যাবতীয় খবরদারির একচ্ছত্র অধিকার তার। অথচ এই রানু বুয়েটে পড়ার দিনগুলোতে বিজুর জন্যে বেনসন অ্যান্ড হেজেস-এর আস্ত প্যাকেট কিনে আনতো। সিগারেট হাতে না থাকলে নাকি ছেলেদের ঠিক পুরুষালি ভাবটা আসে না। বিয়ের পরেও কিছুদিন নিজের হাতে সিগারেট ধরিয়ে দেওয়া কী সাংঘাতিক রোম্যান্টিক ব্যাপার ছিলো রানুর কাছে!
হায়, কোথা দিয়ে যে কী হয়ে গেলো, কোথায় কোন কলকব্জা কখন বিকল হয়ে গেলো - জানাও হলো না। এখন নাকি সিগারেটের গন্ধে রানুর বমি আসে। ভাবা যায়!
২
আমাকে তুমি বিয়ে করলে কেন?
এই অদ্ভুত ও আচমকা প্রশ্নটি রানু করেছিলো বিয়ের রাতে। পরিচয়ের সময় থেকেই এইসব চমকের সঙ্গে বিজুর পরিচয় হয়েছিলো। এই হাসিখুশি, আবার পরের মুহূর্তে তুচ্ছ কিছু নিয়ে রেগে ওঠা - রানু এরকমই বরাবর। তবু টানা চার বছর প্রেম করার পর বিয়ের রাতে একা হলে বিজুকে বলা রানুর প্রথম বাক্য ওই অদ্ভুত প্রশ্নটি। শুনে মনে হবে যেন ওর অমতে জোর করে বিয়েটা ঘটিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিয়ের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন বা সংশয় দু'জনের কারোই ছিলো না। ঝোঁকের মাথায় নয়, ভেবেচিন্তে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে। তাহলে? তবু তখন এটাকে ছেলেমানুষি বা পাগলামি বলে বিশ্বাস করে নিতে সক্ষম হয়েছিলো বিজু। সময় যেতে মনে হতে শুরু করেছিলো, কী যেন একটা ইঙ্গিত ছিলো সেখানে। আজও সে ভেবে পায় না, কথাটা রানু কেন বলেছিলো। রানু নিজেও কি জানে, নাকি বলার ঝোঁকেই বলা? অনেকবার জিজ্ঞেস করবে ভেবেছে, কথাটা মুখে আনতে পারেনি বিজু। নাটকে-সিনেমায় দেখে বিয়ের রাতে দু'জনের কথাবার্তা কীরকম হতে পারে তার একটা ধারণা তৈরি হয়েছিলো, তার ধার দিয়েও যায় না এই প্রশ্ন।
নাটক-সিনেমা বাস্তব নয়, তাহলে বাস্তব কীরকম? নিজেও তো আগে কোনোদিন বিয়ে করেনি, করলে আগেরটার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যেতো। বন্ধুদের কেউ তখনো বিয়ে করেনি, করলেও তাদের কাছে কি সে জিজ্ঞেস করতে পারতো? সম্ভবত না, সংকোচ হতো। রানুর সেই প্রশ্ন আজও বিজুর কাছে অদ্ভুত ও বিস্ময়কর, অস্বস্তিকরভাবে অমিমাংসিত।
রানু আজকাল আর বিজুকে বিস্মিত করে না। যে কোনো অপ্রত্যাশিতকে অতি স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে শিখে গেছে সে। অনেক বছরের অভ্যাস! তবু পুরোপুরি অভ্যস্ত হওয়া কি যায়? এখনো রানুর আচমকা আক্রমণ বিজুকে আহত করে, বিষণ্ণ করে।
বুয়েটে একই বছরে ভর্তি হওয়া - রানুর আর্কিটেকচার, বিজু ইলেকট্রিক্যালে। তবু রানুকে চোখে না পড়ার কোনো কারণ ছিলো না। সুন্দরী বলে ততোদিনে তার নাম রাষ্ট্র হয়ে গেছে। অনেকের নজরে পড়েছিলো সে।
সুন্দরী মেয়েরা লেখাপড়ায় ভালো হয় না বলে একটা তত্ত্ব বাজারে চালু আছে। সেই হিসেব মনে হয় খুব বেঠিক ছিলো না, বুয়েটে সুন্দরী চোখে পড়তো ক্কচিৎ-কদাচিৎ। রানু ব্যতিক্রম ছিলো, বলতেই হবে।
লাইব্রেরির সামনে একদিন বিজু একা পেয়ে যায় রানুকে। শরৎকালের সকালে রোদের তেমন তেজ নেই। পরিষ্কার নীল আকাশে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি। রানুর পরনের শাড়ির রঙও আকাশী নীল। আকাশ দেখেই পরেছে নাকি? বিজু লাইব্রেরিতে ঢুকতে যাওয়ার আগে বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলো, শেষ করে ভেতরে ঢুকবে। রানুকে দেখে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়, অনেকটা পথ আগলে ধরার মতো। রানু থমকে দাঁড়িয়েছে।
বিজু বলে, তোমার সঙ্গে খুব জরুরি দরকার আমার।
রানুর চোখে জিজ্ঞাসা। কিছু কৌতূহল। আর অবাক হওয়া। একে কি সে আগে কোথাও দেখেছে? কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকাও যায় না। চোখের জিজ্ঞাসা মুখে তুলে আনে সে, কথা! আমার সঙ্গে!
হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে।
ছেলেটি কি ওদের সিনিয়র নাকি? না হলে সরাসরি তুমি করে বলার কথা নয়। রানু নিশ্চিত হতে পারে না। বলে, কী কথা?
সরাসরি রানুর চোখে চোখ ফেলে বিজু বলে, তোমাকে আমার চাই।
অপ্রস্তুত রানুর মুখে এসে যায়, মানে?
বিজু ব্যাখ্যা করার ভঙ্গিতে দু'হাত নেড়ে বলে, মানে হলো তোমার সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। তোমার হয়তো জানা নেই, তাতে তোমার কোনো দোষ না-ও থাকতে পারে, সব খবর সবাই সময়মেতো পায় না। কিন্তু তোমাকে আমার যেমন চাই, আমাকেও তোমার চাই।
রানু সামলে নিয়েছে। এর নাম কি প্রেম নিবেদন? এখানে নিবেদন কোথায়? প্রেমই বা কোথায়? এ তো উদ্ভট দাবি। কোনো বইয়ের পাতায়, সিনেমায় এরকম দেখেনি সে। কারো কাছে শোনেওনি। হাসিই পেয়ে যাচ্ছিলো, কোনোমতে সামলে গম্ভীর মুখে বলে, আমার কাছে তেমন কোনো খবর আসেনি।
বলেইছি তো, সবাই সবকিছু সময়মতো জানতে পারে না। পরে জানবে।
না জেনে আমার কোনো ক্ষতিও হয়নি।
কিন্তু তোমাকে না হলে যে আমার চলবে না!
স্পষ্ট করে রানু বলে, আমার চলবে।
তুমি ঠিক জানো না।
এবার স্পষ্টতই বিরক্ত রানু, চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে। বলে, আশ্চর্য, আপনাকে আমি তো চিনিও না!
বিজু সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো করে বলে, আপনি নয়, তুমি।
আপনার মতো অচেনা কাউকে তুমি করে বলতে শিখিনি আমি।
কঠিন কিছু নয়, শিখে নিলেই হয়।
না শিখেও আমি বেশ আছি।
থাক, ওসব ফয়সালা না হয় পরে হবে। আমরা এখন ক্যান্টিনে যাচ্ছি চা খেতে। এসো।
রানু অনায়াসে না বলতে পারতো। সেটাই স্বাভাবিক ছিলো। বলে না, কৌতুক বোধ করছিলো সে। ছেলেটিকে দু'একবার দেখেছে বলে মনে করতে পারে, কিন্তু আলাদা করে মনে রাখার কোনো দরকার হয়নি। উপলক্ষও নয়। এখন হলো।
চা নিয়ে একটা খালি টেবিলে সামনাসামনি বসে বিজু বলে, তোমার কথা শোনার আগে নিজের পরিচয়টা দিয়ে নিই, কী বলো?
জবাব দেওয়ার কিছু নেই, চায়ের কাপ তুলে নিয়ে বিজুর মুখের দিকে তাকায় রানু। তার কৌতূহল হচ্ছে খুব। কৌতূহলে নাকি বিড়াল মারা পড়ে। নাঃ, নিজের ওপর বিশ্বাস আছে তার, সে মারা পড়বে না।
আমার নাম বিজু। পুরো নাম জানাতে পারি, আপাতত তার দরকার দেখছি না। পড়ি ইলেকট্রিক্যালে, তুমি আর্কিটেকচারে আমি জানি। একই ব্যাচে। ইস্কাটনে পৈত্রিক বাড়িতে থাকি, দুই ভাইয়ের মধ্যে আমি ছোটো। বড়ো ভাই আমার পাঁচ বছরের বড়ো, বুয়েট থেকেই পাশ করেছে, এখন বউ আর এক ছেলে নিয়ে থাকে সুইডেনে। বাবা সরকারি চাকরিতে, মা সংসারে। আর আমার নিজস্ব কথা, কবিতা পড়তে আর সব ধরনের গান শুনতে ভালোবাসি। ক্লাস করার চেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বেশি ভালো লাগে। কলেজে পড়ার সময় একটা মেয়ের সঙ্গে কিছুটা বন্ধুত্বমতো হয়েছিলো, প্রেমট্রেম পর্যন্ত যাওয়া যায়নি। এ ছাড়া আর কোনো অনাত্মীয় মেয়ের সঙ্গে মেলমেশা করিনি। এই তো আমি, এবার তোমার কথা বলো।
রানু কী বলবে, তার অবাক হওয়া যে ফুরায় না! কেউ এভাবে আলাপ-পরিচয় করতে পারে! এইমাত্র যার নাম জানা হলো, সেই বিজু নামের ছেলেটিকে তার ভালো বা মন্দ কিছুই লাগছে না। তার নিজের প্রতিক্রিয়া কী হওয়া উচিত বা যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তা সঙ্গত কিনা - বোঝা যাচ্ছে না। বলে, আমার কোনো কথা নেই।
তার মানে তোমার নামধামও কিছু নেই!
তা নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সেগুলো আপনাকে জানানোর দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না।
কেন দরকার নেই?
দরকার নেই, ব্যস।
তার মানে এই যে আমরা এক টেবিলে চা নিয়ে বসেছি, এরও কোনো মানে নেই?
রানু বলে, নেই মনে করলেই নেই। আপনি চা খেতে বললেন, এসেছি। এই তো।
বিজু হাসে, যে কেউ ডাকলেই বুঝি তুমি চা খেতে যাও?
এবার রানুর রেগে যাওয়া উচিত। রীতিমতো অপমানজনক! সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের সঙ্গে চায়ের টেবিলে বসা রানুর জন্যেও একেবারেই নতুন। কেন যে এলো তা সে নিজেও জানে না, যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে এসেছে।
রানু কোলের ওপর রাখা ব্যাগটা তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। বলে, স্যরি। ভুল করে ফেলেছি।
বিজু কিছু বলার আগেই রানু টেবিল ছেড়ে চলে গেছে।
সেই প্রথমদিনের ঘটনার পরে সম্পর্কটা যে বিয়ে পর্যন্ত যেতে পেরেছিলো, তা-ও বিজুর পাগলপারা একগুঁয়েমির কারণে।
রানু টেবিল ছেড়ে উঠে যাওয়ার পর নিজেকে তার নিতানত ক্যাবলাকান্ত মনে হচ্ছিলো প্রথমে। জানে, আশেপাশের টেবিল থেকে কেউ কেউ ওকে লক্ষ্য করছে। সামলে নেয় কয়েক মুহূর্তে। চায়ের কাপে দু'চুমুক দিয়ে একটা মেয়ের এভাবে টেবিল ছেড়ে উঠে যাওয়াটা যেন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার - এরকম মুখ করে ধীরেসুস্থে চায়ে চুমুক দিতে থাকে।
চা শেষ করে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায়। '...ইউ গট লাকি বেব, হোয়েন আই ফাউন্ড ইউ...'।
মনে পড়ে, মেয়েটা তার নাম বলেনি। না বলুক, ওর নাম সে জানে।
পরদিন, তার পরদিন এবং তার পরদিন ক্রমাগত রানুর ডিপার্টমেন্টে ক্রমাগত হানা দিতে থাকে বিজু।
রানু চোখমুখ কুঁচকে বলে, নির্লজ্জের মতো আসেন কেন?
বিজুর জবাব, বলেছি তো, তোমাকে আমার চাই। কতো কোটিবার আমাকে ফেরাবে তুমি? একসময় তোমাকে হ্যাঁ বলতেই হবে।
এরকম বিশ্বাস থাকা ভালো। রানু গলায় ঠাট্টা স্পষ্ট।
রানু, পুরুষমানুষের কাজ হলো লক্ষ্যস্থির করে তাকে জিতে নেওয়া। তার জন্যে বিশ্বাস তো কিছু লাগেই।
৩
সিগারেট নিয়ে মেয়ের আপত্তি মায়ের থেকে আরেক কাঠি ওপরে। ফুলটুস জন্মানোর কয়েক মাস আগে থেকে ঘরে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো বিজু। বাইরে গিয়ে খায়। শীতের সময় যখন বরফে চারদিক সাদা হয়ে আছে, তীব্র ঠাণ্ডা হাওয়ায় হাড় পর্যন্ত জমে যাওয়ার অবস্থা, তখনো বাইরে বারান্দায় যেতে হয়। তবু রেহাই নেই, টের পেলেই ফুলটুস তেড়ে আসবে। ছুঁড়ে না ফেলা পর্যন্ত একটানা বলতে থাকবে, বাবা, তোমাকে না বলেছি আর সিগারেট খাবে না। ফেলে দাও। কী হলো, শুনছো না! বলেছি না, সিগারেট খেলে তোমার অসুখ হবে, অসুখ হলে তুমি মরে যাবে। এক্ষুণি ফেলে দাও বলছি...
স্কুলে শেখা। গতবছর স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে সে, তখন থেকে শুরু। হাট্টিমা টিম টিম শেখার বয়সেই আজকাল বাচ্চাদের ধূমপানের, ড্রাগের জ্ঞানে জ্ঞানী করে তোলা হয়। কী হতো আরো দু'চার বছর পরে এসব তাদের মাথায় ঢোকালে? শিশুদেরও আর এজ অব ইনোসেন্স বলে কিছু থাকবে না!
সিগারেট নিয়ে, ড্রাগস নিয়ে কতো কথা, অথচ প্রসেস করা গোমাংসের নামে যে বিষ দিয়ে বারগার তৈরি হয়, তা-ও আবার স্কুলে লাঞ্চের সময় দুধের বাচ্চাদের জন্যে অনায়াসে হালাল। এই নিয়ে কেউ কথাটিও বলে না। টিভিতে সিগারেটের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ, কমবয়সী ছেলেমেয়েরা নাকি তাতে সিগারেটে আসক্ত হতে উৎসাহী হয়। বীয়ার-হুইস্কির বিজ্ঞাপন অবশ্য অনায়াসে অবাধে চলতে পারে, ওগুলো টিভিতে দেখানোর সময় সম্ভবত ছেলেমেয়েরা চোখ বন্ধ রাখে অথবা ওসবে বোধহয় আসক্ত হওয়ারই কিছু নেই!
হাইওয়েতে এখন তেমন ভিড় নেই। সূর্যের শেষ আলোও নিভে আসছে। হেডলাইট জ্বালিয়ে নব টিপে রেডিও চালু করে বিজু। ট্রাফিক রিপোর্ট হচ্ছে একটা স্টেশনে, শহরের কোন রাস্তায় ট্রাফিক কেমন, কোথাও অ্যাক্সিডেন্ট বা রাস্তা মেরামতের কারণে ট্রাফিক জ্যাম আছে কিনা সেসবের বিবরণ। দু'একটা রেডিও স্টেশনের নিজস্ব হেলিকপ্টার আছে, সেগুলো সকাল-বিকেল রাশ আওয়ারে সারা শহরের ওপর চক্কর দিয়ে রিপোর্ট করে, সেগুলো খানিকটা বিশ্বাসযোগ্য। বাদবাকি স্টেশনগুলোগুলোর ট্রাফিক রিপোর্ট শোনার দরকার নেই, বেশিরভাগ সময়ই পুরনো খবর। অনেক সময় এমনও হয়েছে, যে রাস্তায় বা ইন্টারসেকশন বন্ধ বলা হচ্ছে, বিজু হয়তো ঠিক সেখানেই তখন। কোথায় রাস্তা বন্ধ, কোথায় কী! গাড়িগুলো দিব্যি চলছে যেমন চলার কথা। বিজু অন্য স্টেশন ধরে, সেখানে গাড়ির বিজ্ঞাপনের নামে তারস্বরে চিৎকার। পরেরটাতেও বিজ্ঞাপন, ভায়াগ্রার বিকল্প ওষুধের খবর। চার নম্বরে এসে পছন্দমতো একটা গান পেয়ে যায়, 'ইউ ডোন্ট নো হাউ ইট ফীলস্ টু বি মি...'।
হাইওয়ে থেকে বেরিয়ে একটা দোকানে থামতে হয়, ফুলটুসের জন্যে বড়ো বারবি পুতুল কেনে বিজু। কে জানতো বাবা হলে মেয়ের পুতুলের হিসেবও রাখতে হবে! এমন একটা পুতুল চাই যেটা ওর সংগ্রহে নেই। কতো রকমের যে বারবি তার কোনো হিসেব করা সম্ভব নয় - জিপসি বারবি, সাঁতারু বারবি, প্রিন্সেস বারবি আর ফ্যাশন বারবির পাশাপাশি তাদের ব্যবহার্য খেলনা গাড়ি, ফোন, রেডিও। একই বারবিকে অনেক সাজে সাজানোর জন্যে হরেক রকমের পোশাক, নেইল পলিশ, কানের দুল সব প্যাকেট করে ঝুলিয়ে রাখা।
ফুলটুসের এখন সেই বয়স যে বয়সে এ দেশে বড়ো হওয়া মেয়েরা বারবি-জ্বরে পড়বেই, তৈরি হবে তার হরেক রকমের বারবির সংগ্রহ। কার সংগ্রহে কতোগুলো বারবি, এই নিয়ে তাদের প্রতিযোগিতা। এখনকার দাদী-নানীরা যে বয়সে বারবি খেলেছে, এখন নাতনিরাও সেই বয়সে বারবির জন্যে একই রকম পাগল হয়।
ফুলটুসের বায়না ছিলো, বস্টন থেকে বড়ো একটা বারবি আনতে হবে। ফরমায়েশটা শাস্তিমূলক। বস্টন যাওয়ার দিন সকালে যথারীতি ওকে স্কুলে নামাতে গিয়েছিলো বিজু। স্কুলে যাওয়ার পথে মেয়ে আর সব দিনের মতো একটানা বকবক করে যাচ্ছিলো - সূয্যিমামার আলোটা কেন চোখে ঝাল দিয়ে দিচ্ছে, দুষ্টু সূয্যিমামাকে খুব করে বকে দিও তো, বাবা!
স্কুলে যাওয়ার পথের পাশে একটা ঝাঁকড়ামতো গাছকে সে নিজস্ব গাছ বলে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, সেই গাছের পাতাগুলো এই সময়ে কেন ঝরে যাচ্ছে জাতীয় প্রশ্নও চলছিলো। এইসব নিয়মিত বকবকের এক ফাঁকে বিজু বলেছিলো, মামণি, আজ দুপুরে বাবা বস্টনে যাচ্ছে। তুই স্কুল থেকে ফেরার আগেই চলে যাবো, ফিরবো তিনদিন পরে। তোর জন্যে কী আনতে হবে?
মেয়ে খুব উদারভাবে তখন বলেছিলো, কিচ্ছু আনতে হবে না।
বস্টনে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে পৌঁছে বাসায় ফোন করে জানা গেলো কাহিনী ভিন্ন মোড় নিয়েছে। কেঁদেকেটে মেয়ে বাড়ি মাথায় তুলেছে - বাবা কেন তাকে বলে যায়নি! ফোনে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শেষমেশ আসামী বাবার শাস্তি ধার্য হয়েছিলো, অনেক বড়ো একটা বারবি কিনে নিয়ে যেতে হবে। ফিরে এসে কিনে দিলে চলবে না, বস্টন থেকেই আনা চাই।
কাল সন্ধ্যায় হাতে কিছু সময় ছিলো। একটা খেলনার দোকানে ঢুকেওছিলো বিজু, না কিনে বেরিয়ে এসেছিলো। অতো বড়ো পুতুল ব্যাগে ঢুকবে না। হাতে করে বয়ে আনারও কোনো মানে হয় না। ঠিক করে রেখেছিলো, বাসায় ফেরার পথে কিনে নেবে। মেয়ে না জানলেই হলো।
দোকান থেকে বেরিয়ে আচমকা মনে পড়ে, সেলফোনটা এখনো অন করা হয়নি। প্লেনে উঠে সুইচ অফ করে রেখেছিলো। অন করে দেখে, মেসেজ আছে।
একটা মেসেজ, ফুলটুসের - বাবা, তুমি এখনো আসছো না!
বাসায় পৌঁছতে সন্ধ্যে পেরিয়ে যায়। রানু রান্নাঘরে ছিলো। দরজা খোলার শব্দে উঁকি দিতে বিজুর সঙ্গে চোখাচোখি। মুখের কোনো রেখা একটুও বদলায় না। চোখ নামিয়ে সিঙ্কে রাখা কাপ-গ্লাসগুলো ধোয়ায় ব্যস্ত হয়ে যায় রানু। বিজু বস্টন যাওয়ার দিন দুয়েক আগে থেকে রানুর সঙ্গে হিসেব করা কথা চলছে। যতোটুকু না হলে নয়, তাই আর কি। বস্টন থেকে প্রতিদিন একবার করে ফোন করেছে বিজু। ঠিক রানুর সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ থেকে নয়, ফুলটুসের জন্যে।
খানিকটা দায়িত্ব পালনও বটে। না করলে এই নিয়েও কথা শুনতে হবে, আমাদের খবরে তোমার কোনো দরকার আছে নাকি!
একটা বয়সে ফুলটুসের ফোনে কথা বলার নেশা হয়েছিলো খুব, ফোন বাজলে ওকেই ধরতে হবে। কোত্থেকে ছুটে এসে সবার আগে ফোন তুলে ফেলতো। আজকাল আর ফোনের দিকে তাকিয়েও দেখে না। সুতরাং বিজু ফোন করলে রানু ধরেছে। বিজুর তোমরা কেমন আছো-র উত্তরে রানু সংক্ষেপে বলেছে, ভালোই তো।
সব ঠিকঠাক?
হ্যাঁ।
ফুলটুসের কথা বলো, শুনি।
এই যে ধরো, দিচ্ছি। বলে রানু ফোন তুলে দিয়েছে ফুলটুসের হাতে।
বিজু আড়চোখে দেখে, খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আজ রানুকে। এমনিতে ঘরে সাজগোজ দূরে থাক, মাঝেমধ্যে এমন একেকটা কাপড় পরে থাকে যে, দেশে হলে যে কেউ তাকে কাজের বুয়া ভেবে বসবে। অফিসে যাওয়ার সময় সে সামান্য সাজগোজ করে, কোনো বিয়েবাড়ি-জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও যত্ন করেই সাজে। কিন্তু বাসায় সে যে কেন এমন জবরজং হয়ে থাকে, কে জানে! অনুযোগ করলে দু'চারদিনের জন্যে ব্যাপারটা একটু পাল্টায়। তারপর আবার যে কে সেই। মনে হতে পারে, বিজুর কাছে নিজেকে অনাকর্ষণীয় করে তোলাই তার জীবনের সাধনা! অথচ সামান্য একটু যত্নে রানু যে কী সুন্দর হয়ে উঠতে পারে, ও জানেই না।
বিজু কিছুটা অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, আজ একটুখানি সেজেছে রানু। ঘরে সাধারণত সে শাড়ি পরে না, খুবই নাকি ঝামেলা। বিজু তাকে শাড়িপরা দেখতে পছন্দ করে বলেই হয়তো। আজ কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি পরা, শাড়িটা আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারে না। নতুন কিনেছে নাকি? লম্বা চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। ঠোঁটে কি একটু লিপস্টিক দিয়েছে? ঠিক বোঝা যায় না এতোদূর থেকে। কী মনে করে? বিজু ফিরবে তাই?
রানুকে কিছু বলার উৎসাহ হয় না বিজুর। তিনদিন পরে ঘরে ফিরে ছোট্টো একটা কোনো সম্ভাষণ কিংবা সামান্য এক টুকরো হাসিও কি সে পেতে পারে না? একটা জলজ্যান্ত মানুষ ঘরে ঢুকলো, রানুর চাউনিতে, মুখের রেখায় তার স্বীকৃতিটুকুও নেই। সেই মানুষটি যদি তার মেয়ের বাবা হয়, তার জীবনের সঙ্গে পরতে পরতে জড়িত হয়ে থাকে - সে তো সামান্য মনোযোগ দাবি করতেই পারে। পারে না কি? বাতিল করা না হোক, অন্তত পুরনো প্রেমিক হিসেবেও? সেই ভালোবাসা নিষ্পত্র বৃক্ষের মতো শূন্য হয়েও যায়নি। হলে এক ছাদের নিচে বাস করা সম্ভব হতো না।
বিজু টের পায়, ভালোবাসা আজও আছে, বোতলবন্দী দৈত্যের মতো। জাদুর প্রদীপে হাত বোলানোর কায়দাটাই শুধু ভুল হয়ে যাচ্ছে।
শুধু রানুর দোষ হবে কেন? বিজু নিজেও কিছু বলেনি, একটা শব্দও নয়। বিজু জানে, ভব্যতার খাতিরেও কিছু একটা বলা উচিত। রাগ-অভিমান করে কথা বন্ধ করে রাখা শিশুদের মানায়, সে বয়স কবে গত হয়েছে! কয়েক ফুট দূরত্বে দু'জন কেউ কাউকে যেন চেনে না। আগন্তুকের মতো। ঠিক তাও বোধহয় নয়। সম্পূর্ণ অপরিচিতরাও পরস্পরকে হাই বলে সম্ভাষণ জানায় এ দেশে। কেমন আছো বলাও সাধারণ রেওয়াজ। দিনের শেষে ঘরে ফেরার পর স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে নিয়ম করে জিজ্ঞেস করে, দিনটা কেমন গেলো তোমার?
হয়তো শুধুই কথার কথা, তবু সেটুকুও দরকারি বলে বিজুর মনে হয়। কথাবার্তা শুরু করার একটা ভূমিকা তো বটে। কিন্তু প্রাচ্যদেশীয় বংশোদ্ভূত পুরুষরা সংস্কার বা অভ্যাসবশে হয়তো সেটাকে বাহুল্য জ্ঞান করে। বিজু জানে, এই অহমের কোনো মানে নেই। তবু জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার, অভ্যাস যায় কী করে? সেটা ত্যাগ করা খুব সহজ নয়।
এ দেশীয় সহকর্মীদের দেখেছে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই তার প্রিয়জনের সঙ্গে ফোনে কথা শেষ করে আই লাভ ইউ বলে। ভারি লোকদেখানো আর ফাঁপা লাগে বিজুর। দিনে পঞ্চাশবার ভালোবাসি বললেই ভালোবাসার বৃক্ষ মহীরূহ হয়ে ওঠে না। হলে এদের সমাজে বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা ডালভাতের মতো সহজ ও অনায়াস হতো না।
এ দেশে লেখাপড়া করতে আসা বিজুর চেনা বাঙালি ছেলে এক শ্বেতাঙ্গিনীকে বিয়ে করেছে। ভালোবাসাবাসির কোনো ব্যাপার ছিলো না। ছেলেটি স্পষ্ট বলেছিলো একদিন, বোঝলেন বিজু ভাই, বিয়াখান করছিই পাত্তির লাইগা। খালি গ্রীনকার্ড হইয়া লউক, লাত্থি মাইরা ওই সাদা চামড়ারে খেদাইয়া দিমু। তারপর দ্যাশে গিয়া রিয়াল বিয়া কইরা লইয়া আসুম, দেইখেন। অহন তো কিছু করার নাই, খালি উঠতে-বইতে আই লাভ ইউ মুখস্থ কইয়া যাই।
বসার ঘরে টিভিতে কার্টুন নেটওয়ার্কে ফ্লিন্টস্টোনস। কার্টুন দেখতে বসলে মেয়ের আর কিছু খেয়াল থাকে না। তখন তার চোখের পলক পড়ে না, ছবিগুলো সব গিলে খেতে থাকে। ঠিক পাশেই বোমা ফাটলেও বুঝি চোখ ফেরাবে না। আজ অবশ্য অন্যরকম। দরজা খোলার শব্দে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছে। বাবা আসবে বলে বোধহয় কান খাড়া করে রেখেছিলো। ছুটে এসে কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে, তুমি আমাকে বলে যাওনি কেন, বাবা? ভুলে গিয়েছিলে?
ব্যাগ দুটো কোনোমতে নামিয়ে রেখে বিজু সোফায় বসতে বসতে বলে, হ্যাঁ রে, ভুল হয়ে গেছে। আর হবে না।
ঠিক তো?
ঠিক।
আমার বারবি কোথায়? এনেছো?
বিজু মাথা চুলকে বলে, এই যাঃ, এক্কেবারে ভুলে গেছি যে!
প্রায় চিৎকার করে ওঠে ফুলটুস। কেঁদেই ফেলবে নাকি!
তুমি একটা পচা বাবা। খুব পচা বাবা।
বিজু হাসতে হাসতে বলে, চল, গাড়িতে বারবিটা এসে বসে আছে কি না দেখি।
মেয়েকে কোলে করে গাড়িতে ফিরে যায় বিজু। সামনের প্যাসেঞ্জার সীটে বসিয়ে রাখা বারবির গোলাপি রঙের বাক্সটা দেখতে পেয়েছে ফুলটুস। কোল থেকে সড়াৎ করে নেমে গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে সে। বারবি কোলে করে ফিরে আসে, বাবা, তুমি ভুল কথা বলেছো কেন?
বিজুর ধারণা শিশুদের মুখে মিথ্যে শব্দটা ভারি বেমানান আর রূঢ়। প্রথম থেকেই ফুলটুসকে শেখানো হয়নি সেটা। তার বদলে ফুলটুস শিখেছে ভুল কথা।
কী ভুল কথা বলেছি রে বুড়ি?
এমনিতে বুড়ি বললে ফুলটুস খুব রেগে যায়। বলে, আমি বুড়ি না, আমার সাদা চুল নেই।
আজ বারবির ঘোরে আছে সে এখন, হয়তো খেয়ালও করেনি। বলে, বারবিকে গাড়িতে রেখে এসে আমাকে বলেছো, তুমি ভুলে গিয়েছো! একা একা বারবি ভয় পাবে না!
মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে ফিরে আসে বিজু। বাক্সবন্দী বারবিকে উদ্ধার করে মেয়ের হাতে দিতে হয়। সোফায় বসে বলে, বারবি তোর পছন্দ হয়েছে রে?
ঘাড় নেড়ে ফুলটুস জানায়, হ্যাঁ, হয়েছে।
এই ক'দিন বাবাকে মিস করেছিলি?
হ্যাঁ।
কতোটা?
হাত দুটো দু'দিকে ছড়িয়ে দিতে গিয়ে ফুলটুস টের পায়, বগলের তলা থেকে বারবি পড়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে পুতুলটাকে আবার জড়িয়ে ধরে বলে, অনেক।
বারবিকে কোলে ফেলে ফুলটুস বাবার সঙ্গে বকবক করে যায়। জানো, স্কুলে টিচার আমাকে স্মার্ট গার্ল বলেছে। মা কাল গোসল করাতে গিয়ে আমাকে ব্যথা দিয়েছে, আমি অনেক কান্না করেছি। মাথায় শ্যাম্পু করার সময় চোখে ঝাল দিয়ে দিয়েছে।
বিজু বলে, জানিস আমি যখন তোর মতো ছোটো ছিলাম, মা-র সঙ্গে গোসল করতে গেলেই আমি কাঁদতাম।
ফুলটুস দুলে দুলে হি হি করে এক চোট হেসে নিয়ে বলে, ও মা, তুমি কান্না করতে, বাবা?
কেন রে, বাবা বুঝি কাঁদতে পারে না!
বড়োরা আবার কাঁদে নাকি!
হ্যাঁ, বড়োরাও কাঁদে। খুব কাঁদে। না কাঁদলে বড়োদের চোখের পানিগুলো কোথায় যাবে বল তো? আর আমি তো তখন তোর মতো ছোট্টো। আমার মা সাবান ঘষে দেওয়ার সময় এতো জোরে জোরে ডলে দিতো, মনে হতো গায়ের চামড়াই বুঝি তুলে ফেলবে। সে যে কী দুঃখের, তুই বুঝবি না।
এতোক্ষণে রানুর গলা শোনা যায়। রান্নাঘর থেকেই মেয়েকে বলে, ফুলটুস বাবাকে জামাকাপড় বদলাতে দাও। আর তোমাকে এখন বিছানায় যেতে হবে, কাল স্কুল আছে না!
বাবার সঙ্গে আর একটুখানি কথা আছে, মা!
তোমার বকবক কী আর থামবে?
ফুলটুস ঘাড় ঘুরিয়ে মা-কে পাঁচ আঙুল তুলে দেখায়, আর ঠিক পাঁচ মিনিট।
বিজু যেখানে বসেছে, সেখান থেকে রানুর মুখের আধখানা দেখা যায়। বাকি অর্ধেক আড়াল হয়ে আছে রান্নাঘর আর বসার ঘরের মাঝখানের আধখানা দেয়ালের আড়ালে। ফুলটুসের কথার জবাব না দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে সে।
রানু ফুলটুসকে তুমি করে বলে। বিজু কিছুতেই পারে না, তুই করে না বললে মনে হয় নিজের মেয়ে নয়, আর কারো সঙ্গে কথা বলছে সে। রানু আগে ভুরু কুঁচকে বলতো, মেয়ের সঙ্গে ওরকম অশিক্ষিতদের মতো তুই-তোকারি করে কথা বলো কেন?
বিজু অবাক হয়ে গিয়েছিলো, তুই-তোকারি শুধু অশিক্ষিত চাষাভূষারা করে! আশ্চর্য তো! কথাটা তার কাছে এমনই নতুন, অবান্তর ও আচমকা যে পাল্টা কোনোকিছু চট করে মুখে আসে না। আশ্চর্য, খু্বই আশ্চর্য হয়েছিলো সে।
বুয়েটে দু'জনের ডিপার্টমেন্ট আলাদা ছিলো, তখনও কোনো বিষয়ে অমিলের খবর পাওয়া যায়নি! পছন্দ-অপছন্দের মিল হলেই সম্পর্কটা প্রেম-ভালোবাসার দিকে গড়ায়। এখন পেছন ফিরে কি একটু কাটাছেঁড়া করে দেখা যায়? সত্যি সত্যি মিল ছিলো, নাকি মিল আছে বলে বিশ্বাস করতে তখন ইচ্ছে করতো? ঘোর লাগার ব্যাপার? নাকি বয়সে দু'জনেই বদলে গেছে, আগের মতো আর নেই! এমনও তো হতে পারে, প্রেম করার দিনগুলোতে যা কিছু জরুরি আর পছন্দের মনে হয়, সংসারে ঢুকলে সেসব ফালতু, অপ্রয়োজনীয়। অন্যভাবে দেখলে, প্রেম করার দিনগুলোতে ফুল-পাখি-চাঁদ খুব জরুরি, বিয়ের পরে যেমন বাজারের ফর্দ। এটাও ঠিক, দু'চার ঘণ্টা একসঙ্গে থাকার সময় খুব সতর্কভাবে নিজেদের দুর্বলতা, খারাপ অভ্যাসগুলো আড়াল করে রাখা খুবই সম্ভব। এমনকী প্রেমিকা সঙ্গে থাকলে প্রেমিকপুরুষ হিসি পেলেও চেপে রাখে। দাম্পত্য সেই আড়ালগুলোকে ছিঁড়ে প্রকাশ্য করে দেয়।
পরে আরেকদিন কথা উঠতে বিজু বলেছিলো, দেখো রানু, আমার মেয়েকে তুই করে না বললে আমার তৃপ্তি হবে না। তোমার পছন্দ না হলেও কিছু করার নেই, আমি ওটা পাল্টাতে পারবো না।
রানু ফোঁস করে উঠেছিলো, আমি বললে পারবে কেন?
বিজুর বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো, কেউ বললেই পারবো না।
বিজু দেখেছে, কথা কাটাকাটির সময় রানু খুবই প্রতিভাময়ী হয়ে উঠতে পারে। সেই সময়ে তার স্মরণশক্তি তাকে চমৎকার সাহায্য করে থাকে। বাসার ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় চার-পাঁচটা বাজারের ফর্দ তৈরি করে সে, অথচ বাজারে গিয়ে দেখা যায় একটাও সঙ্গে আসেনি। গাড়ির চাবি কোথায় রেখেছে মনে করতে পারে না কখনোই। কিন্তু এইসব কথা কাটাকাটির সময় পাঁচ-সাত বছর আগের কোনো একটা তুচ্ছ কথা ঠিক সময়মতো তুলে এনে তাকে বিষাক্ত ছোবলের মতো ব্যবহার করতে পারে। তার প্রতিভার সবচেয়ে বড়ো নিদর্শন দেখায় সে যখন সম্পূর্ণ মনগড়া একটা কথাকে সত্যিকারের ঘটনা বলে সাজিয়ে বিবৃত করে।
বিজু কথা কাটাকাটির সময় উপযুক্ত পাল্টা কথাটা প্রায়ই মনে আনতে পারে না, কথা খুঁজে না পেয়ে তোতলাতে থাকে। শেষ হলেও তার রেশ থাকে অনেকক্ষণ, বিজু সেই কথাগুলো মনে মনে রিপ্লে-র মতো করে বাজায়। ঠিক সেই সময় রানুর কোনো কথার উপযুক্ত জবাব মনে এসে যায় - কোনো ঘটনা। মনে পড়ে অনেক আগে বলা রানুর কোনো একটা কথা যা এই তর্কের সময় কাজে লাগানো যেতো। ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আবার হয়তো নতুন করে শুরু করা যায়। বিজুর ইচ্ছে হয় না। সে বুঝে গেছে, দাম্পত্য বিতর্কযুদ্ধে ক্রমাগত পরাজয় তার একমাত্র ও অনিবার্য নিয়তি।
বিজু জানে বলেই সে ফাঁদ এড়িয়ে খুব ঠাণ্ডা গলায় বলেছিলো, একটা কথা কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছো। তোমার বাবাও মাঝে মাঝে তোমাকে তুই করে বলেন, আমি নিজে শুনেছি।
এর জবাব যা আসে, তা-ও বিজুর কাছে অভিনব। রানু বলে, এখানে আমার বাবার কথা আসছে কেন?
কী আর করা যাবে, সাদা চোখে স্পষ্ট জিনিসটাও যে দেখতে অস্বীকার করে, তার সঙ্গে কথা বাড়ানোর মানে হয় না। তার মনে হয়েছিলো, তুলনাটা খুবই সমান্তরাল এবং প্রাসঙ্গিক।
এরপরে অবশ্য রানু এই প্রসঙ্গ আর কোনোদিন তোলেনি। তবে সময় বয়ে যায়নি, দু'বছর পরে আবার হয়তো এটাকেই ঠিক ঘাড়ে ধরে ফিরিয়ে আনবে রানু। লড়াইয়ে কোন অস্ত্র কখন কাজে লেগে যায়, কে বলবে! বিজু কোথাও একবার পড়েছিলো, পুরুষমানুষের একজন বউ থাকে কটু কথা বলার জন্যে, যাতে জীবনটা একেবারে পানসে আর একঘেয়ে না হয়ে যায়!
বিজু মেয়ের লম্বা ঘন চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে বলে, তুই খেয়েছিস রে, ফুলটুস? নাকি আমার সঙ্গে খাবি?
বলে বুঝতে পারে, খুব বাজে শট খেলে একখানা মোক্ষম ক্যাচ সে তুলে দিয়েছে। হয়তো এক্ষুণি শুনবে, হ্যাঁ, তুমি না থাকলে তোমার মেয়েকে আর কে খাওয়াবে!
সেরকম কোনোকিছু অবশ্য শোনা যায় না, একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বিজু। ফিল্ডারের অমনোযোগের সুযোগে লাইফ পাওয়া আর কি!
ফুলটুস বলে, হ্যাঁ, খেয়েছি।
কি খেলি আজ রাতে?
ভুলে গেছি।
বিজু বুঝলো, খাওয়ার সময় ও একমনে কার্টুন দেখছিলো। রানু খাইয়ে দিয়েছে। কার্টুন দেখার সময় কী মুখে যাচ্ছে, কে খেয়াল করে! চোখ ফেরালেই কিছু একটা মিস হয়ে যেতে পারে।
তুই যে বললি বাবার সঙ্গে কী কথা আছে!
আমার ছোটোবেলার কথা বলো বাবা।
তোর আবার ছোটোবেলা বড়োবেলা কীসের! তুই তো এখনো ছোটোই।
না এখনকার কথা নয়, যখন আরো ছোটো ছিলাম।
বিজু হাসতে হাসতে বলে, শুধু অ্যাঁ অ্যাঁ করে কান্না করতি, কথা তো আর বলতে শিখিসনি তখন।
না, তখনকার কথা নয়। ওই যে হামটি-ডামটির গল্পটা বলো।
ফুলটুসের তখন ভালো করে কথাও ফোটেনি, ক্যাসেটে শুনে শুনে হামটি-ডামটি শিখেছিলো। হামটি-ডামটি বলতে পারতো না, বলতো ঠামটি-ঠামটি। আর পুট টুগেদার এগেন লাইনটা বুঝতে না পেরে তার কানে যেরকম পৌঁছতো সেভাবেই বলতো, পুটুরেগেন। বিজু জিজ্ঞেস করতো, পুটুরেগেন মানে কি রে? বললেই রেগে যেতো ফুলটুস। সেই কাহিনী তার বারবার শোনা চাই, আর শুনে প্রতিবার হাসিতে গড়াগড়ি।
হামটি-ডামটি পর্ব শেষ হলে ফুলটুসের নতুন বায়না, এবার স্নো হোয়াইটের কথা বলো বাবা।
ফুলটুসকে ডিজনির স্নো হোয়াইট ভিডিও কিনে দিয়েছিলো বিজু, ওর তখন তিনও হয়নি। সেই ভিডিও সে সারাদিনমান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতো। আসলে গিলতো। রানীর প্ররোচনায় স্নো হোয়াইটকে বনের ভেতরে নিয়ে গিয়ে জল্লাদের ছুরি উঁচিয়ে ধরার দৃশ্য এলেই ফুলটুস চোখ বুঁজে চিৎকার করে উঠতো, মারবে না, মারবে না। ডাইনিরূপী রানীর হাত থেকে স্নো হোয়াইট বিষাক্ত আপেল নিয়ে মুখে তুলছে দেখলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠবে ফুলটুস, না খাবে না, খাবে না।
বিজু জানে, গল্পের রশি এখুনি না গোটালে ফুলটুস টেনে টেনে সেটাকে লম্বা করতে থাকবে। রানুর তাগাদা আবার জারি হওয়ার আগেই উঠে পড়া দরকার। সে বলে, এখন যে ঘুমাতে হবে তোকে।
আমার একটুও ঘুম পাচ্ছে না।
না পেলেও ঘুমাতে হবে। কাল স্কুল আছে না!
ফুলটুস বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, আজ আমি তোমার সঙ্গে ঘুমাতে যাবো।
এই বায়নাটা মাঝে মাঝে করে সে। নিজের ঘরেই ঘুমায় ফুলটুস, কোনো কোনো রাতে ঘুমিয়ে পড়া পর্যন্ত মাকে অথবা বাবাকে তার সঙ্গে গিয়ে শুয়ে থাকতে হয়।
বিজু কিছু বলার আগেই রানু সামনে এসে দাঁড়ায়। বিজু লক্ষ্য করে তার অনুমান ঠিক, রানু হালকা করে লিপস্টিক মেখেছে। কী একটা সুগন্ধিরও সুবাস পাওয়া যায়। নিজের বউ বলে নয়, সত্যিই খুব সুন্দর লাগছে ওকে।
বছরখানেক হলো রানু চশমা নিয়েছে, চশমায় ওকে খুব মানায়। আলাদা এক ধরনের ব্যক্তিত্ব ফোটে। হয়তো আরেকখানা মুখোশ।
রানুকে হাত ধরে টেনে পাশে বসিয়ে চুমু খাওয়ার একটা তীব্র ইচ্ছেকে শাসন করে সে। ফুলটুস উপস্থিত আছে বলে নয়, বাসার আবহাওয়া ফুরফুরে থাকলে চুমুটুমু পর্যন্ত ওর সামনেই চলতে পারে। রানু দু'চারবার আপত্তি তুলেছে, মেয়ে বড়ো হচ্ছে না! বিজু তখন বলেছে, টিভিতে ও সারাক্ষণই তো দেখছে, এমনকি কার্টুনেও। আমার মনে হয়, বাবা-মা ওর সামনে চুমু খেলে মোটেই অস্বাভাবিক লাগবে না।
রানু ফুলটুসকে বলে, বাবা এখন কাপড় বদলে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসবে। তুমি তোমার ঘরে লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়ো, যাও।
ফুলটুস বিজুর গলা আরো শক্ত করে ধরে বলে, না আমি বাবাকে চাই।
বিজু বলে, বেশ তো, চল। কিন্তু তার আগে আমাকে একটুখানি সময় দিতে হবে। তুই দাঁত ব্রাশ করে নে, আমি জামাকাপড়টা বদলে আসছি।
ফুলটুসকে কোল থেকে নামিয়ে উঠে দাঁড়ায় বিজু। শোয়ার ঘরের দিকে যেতে যেতে রানুকে বলতে শুনলো, এইসব আহ্লাদ পেয়ে পেয়ে তো মেয়ে মাথায় উঠছে!
একটা কানেই দিব্যি শোনা যায়, তবু মানুষের দুটো কান থাকে কেন? উত্তর হলো, ভালো ভালো কথাগুলো যাতে এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে!
বিজু শিখে গেছে, সব কথা শুনতে নেই, জবাবও দিতে নেই। রানুর এই কথাটাও শুনতে পায়নি ধরে নেয় সে। দুটো কানই মাঝে মাঝে ব্যবহার করতে হয় যে!
৪
বিজু নিজে জানে, বাচ্চা ছেলেরা কোনো খেলনা চাই বলে যেরকম জেদ করে, সে নিজেও ঠিক তাই করছে। রানুর প্রেমে সে আকণ্ঠ ডুবে ছিলো, তা নয়। তবু মুখ ফুটে তোমাকে চাই বলে ফেলে সেটা গিলে ফেলতেও পারছিলো না। পিছিয়ে আসতে মনের জোর লাগে। তবু প্রত্যাখ্যানের এক ধরনের শক্তি আছে জেদ বাড়িয়ে তোলার। সময়ে তা-ও ভোঁতা হয়ে আসে।
শুধু শুধু জেদ করে, কান্নাকাটি দিয়ে খেলনা পাওয়া যাবে না বুঝে বাচ্চারাও একসময় চুপ করে যায়, মেনে নিতে শেখে। মুখে যতো বড়াই করুক, বিজুর জেদও থিতিয়ে আসছিলো। রানুর ক্রমাগত প্রত্যাখ্যানকে আর অবজ্ঞা করা সম্ভব হয় না। সহ্য করার বদলে এক ধরনের আত্মসম্মানবোধ জেগে উঠছিলো। কী এমন রানু, আমি কেন তাকে উপেক্ষা করতে পারবো না? রানুর খোঁজে তার ডিপার্টমেন্টে যাওয়া বন্ধ করে দিলে কেমন হয়? রানুর চোখ কি তখন তাকে খুঁজবে? না-থাকাই হবে আমার সবচেয়ে বড়ো থাকা!
ডিসেম্বরের শেষে এক শীতসকালে বিজু ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে দেখে, ক্লাস হবে না, অঘোষিত ধর্মঘট। কী নিয়ে ধর্মঘট ঠিকমতো জানা যায় না। সবগুলো বিল্ডিং-এর সদর দরজায় তালা, ভেতরে যাওয়া যাবে না। সবাই ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ কেউ খোলা মাঠে গোল হয়ে বসে গল্প করছে। বিজুর মনে হলো, ক্লাস না হলে ভালোই তো। আগে থেকে জানা থাকলে এই সাতসকালে উঠতে হতো না, লেপমুড়ি দিয়ে আরো খানিকটা বেলা পর্যন্ত ঘুমানো যেতো।
আশেপাশে তাকিয়ে বন্ধুবান্ধবদের কাউকে চোখে পড়ে না। অনির্দিষ্টভাবে হাঁটতে শুরু করেছিলো সে। উত্তরে পলাশীর দিকের গেটে পৌঁছে মনে হয়, ইউনিভার্সিটির আর্টস বিল্ডিং-এর দিকে যাওয়া যায়। লাইব্রেরির আশেপাশে কাউকে না কাউকে পাওয়া যাবেই। রিকশা নেওয়ার দরকার নেই, হেঁটে যাওয়া যায়। রাস্তা পেরোতে যাবে, এই সময় পেছন থেকে কেউ বলে, একটু শুনবেন?
মেয়েলি গলার স্বর, নাম ধরে ডাক নয়, যে কেউ যে কোনো কাউকে ডাকতেই পারে। ঘুরে না তাকিয়েও বিজু জানে, তাকেই ডাকা হচ্ছে। চিনতে ভুল হয়নি। রানু।
রাস্তা না পেরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে, ফিরেও তাকায় না। অপেক্ষা করে। রানু পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলে, আপনাকে ডাকছি অনেকক্ষণ, শুনতে পাচ্ছেন?
রাস্তায় এতো মানুষের কে কোথায় কাকে ডাকছে, কী করে বুঝবো! আমার নাম ধরে তো ডাকতে শুনিনি। সে যাকগে, কেন ডাকছিলে তাই শুনি।
শুনেছেন তো, আজ ক্লাস হবে না।
হ্যাঁ। সেজন্যেই ভাবছিলাম আড্ডা দিতে যাই। আড্ডাখানায় কখনো ধর্মঘট হয় না।
রানু বলে, তাহলে আর আপনাকে আটকাবো না।
কী আশ্চর্য, আমার তো কারো সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমন্টে করা নেই, আড্ডায় সেটা লাগেও না। যখন খুশি যাবো, নাহলে যাবো না। তোমার কথা শুনি।
আপনার সঙ্গে কথা ছিলো।
বিজু গলায় কিছু শ্লেষ মেশায়, তাই তো বলি, দরকার না থাকলে আমাকে খুঁজে বের করবে কেন!
রানু খোঁচা হজম করে বলে, এখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলবো?
বিজু মনে মনে ভাবে, ও ব্বাবা, বেশ তো কথা ফুটেছে। কিন্তু হচ্ছেটা কী, তাই তো বোঝা যাচ্ছে না। মুখে বলে, কোথায় যেতে চাও?
তা জানি না।
তার মানে আমি যেখানে নিয়ে যাবো সেখানেই যাবে?
রানু হাসে, হ্যাঁ।
রাস্তা পেরিয়ে সলিমুল্লাহ হলের সামনের ফুটপাথে উঠে এসে বিজু বলে, জাহান্নামে?
ওই জায়গাটায় যাওয়ার ইচ্ছে নেই।
বিজু এবার হাসে, আমারও না। শুনেছি জাহান্নামের রাস্তায় এখন নাকি অনেক খোঁড়াখুঁড়ি করছে ওয়াসা আর মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন। রাস্তা বন্ধ।
রানু হাসতে হাসতে বলে, এসব কথা পান কোথায় আপনি?
স্বরচিত।
হাঁটতে হাঁটতে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরির পেছনের লনে। বিজু দেখেছে, জায়গাটা এমনিতে খালি থাকে না, জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়েরা বসে থাকে। আজ এরকম জনশূন্য পাবে ভাবেনি। প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্যে কি সময়টা বেশি সকাল?
সঠিক জানে না, তবে বিজু অনুমান করতে পারছে রানু কী বলতে চায়। আজই হয়তো সমর্পণের সময়। নিঃশর্ত? বিজুর নিজেরও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। এতোদিন একটা জেদের কারণে বারংবার প্রত্যাখ্যানের অপমান উপেক্ষা করতে পেরেছিলো। জিতে নেওয়ার নেশায় স্থির ছিলো বলে আর কিছুকে জরুরি মনে হয়নি। আবার গত কিছুদিনের হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো আলগা অবস্থায়ও সে পৌঁছে গিয়েছিলো, জয়ী হওয়াটা তখন আর ততো দরকারি ছিলো না।
এখন কী করবে সে? প্রত্যাখ্যানের অপমান ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগ তার আছে। নেবে কি? রানুকে সে অনায়াসে বলতে পারে, যে তোমাকে চেয়েছিলো, সে আর এখানে বাস করে না।
অথবা পারে সে ক্ষমা করে দিতে। নিঃশর্তে।
সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ টানছিলো বিজু। রানু বলে, কী ভাবছেন?
আজ কার মুখ দেখে সকাল হয়েছিলো তাই মনে করার চেষ্টা করছি।
কেন?
আমার সঙ্গে হঠাৎ তোমার কথা বলার দরকার পড়লো বলে। ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক না? এতোদিন তো উল্টোটাই হয়ে এসেছে।
সবদিন একরকম না-ও হতে পারে। সময়ে কতোকিছু পাল্টে যায়!
কিন্তু সবকিছুর আগে একটা জিনিস পাল্টানো দরকার।
কী?
বাংলা গল্প-উপন্যাসে আপনি থেকে তুমিতে নামতেই বিশ-পঁচিশ পাতা খরচ হয়ে যায়। কী অপচয়, কোনো মানে হয়!
ইঙ্গিত না বোঝার কোনো কারণ ছিলো না। রানু বলে, অচেনা কাউকে চট করে তুমি করে বলা যায়?
অচেনা মানুষের সঙ্গে কেউ ব্রিটিশ কাউন্সিলের নির্জন লনে বসে না।
তোমার সঙ্গে তর্কে পারবো না।
এই সহজ জিনিসটাতেই এতো সময় লেগে গেলো!
বিজুর অনুমান মিলে যাচ্ছে। শর্তহীন সমর্পণ। রানুর কথা বলার ধরণই বলে দিচ্ছিলো, অনুমানের জন্যে আর অবশিষ্ট ছিলো না কিছু। কথা বলতে বলতে বিজু ভেতরে ভেতরে নিজের সঙ্গে লড়াই করে যায় - অপমানের প্রতিশোধ, না ক্ষমা? কী হয়, যদি সে এখন রানুকে ফিরিয়ে দেয়? বলে, রানু, তোমাকে আর চাই না আমার। একসময় ভেবেছিলাম, তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না। এখন দেখছি, সেটা ভুল ধারণা। কী হয় তাহলে, রানুর প্রতিক্রিয়া কী হবে? খুব আহত হবে সে? দুঃখিত হবে? বিজুও হয়েছিলো একসময়, তখন কার কী এসে গেছে? কিন্তু এই নারীকে সে জয় করতে চেয়েছিলো, সে এখন নিজে থেকে এসেছে তার কাছে। ইচ্ছে করলেই এখন স্পর্শ করা যায় তাকে। জিতে যাওয়ার লোভ কার না হয়? প্রতিশোধ? কীসের প্রতিশোধ?
সারাটা দিন একসঙ্গে কাটে। যাই যাই করেও রানুর বাসায় ফেরা হচ্ছিলো না, কথা যে শেষ হতে চায় না। শেষ বিকেলের দিকে একরকম জোর করে রিকশা ডেকে উঠে পড়ে রানু, আর দেরি হলে বাসায় অনেক কৈফিয়ত দিতে হবে।
রিকশা চলতে শুরু করার আগেই বিজুও উঠে বসেছে রানুর পাশে। রানু বলে, আরে এটা কী হচ্ছে?
একটু এগিয়ে দিই তোমাকে।
আমি একাই বেশ যেতে পারবো, রোজই যাচ্ছি। তোমাকে এগিয়ে দিতে হবে না।
বিজু রিকশাওয়ালাকে বলে, তুমি চলো তো।
রিকশা চলতে শুরু করলে রানু বলে, কেউ দেখে ফেললে?
দেখলে দেখবে, পাবলিক ন্যুইস্যান্স কিছু করছি না!
চেনা কেউ দেখে বাসায় বলে দিলে আমাকেই ঘরবন্দী হয়ে থাকতে হবে।
এতো ভাবলে চলে নাকি! সবার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, সারাক্ষণ চোখ রাখছে রানুর সঙ্গে কে যাচ্ছে তাই দেখতে!
একটু চুপ করে থেকে রানু বলে, আচ্ছা তুমি এরকম ছেলেমানুষি করো কেন?
ছেলেরা ছেলেমানুষি করবে না তো কে করবে?
একটুও কি সিরিয়াস হতে জানো না তুমি?
না। বড়ো হলে হবো।
তার মানে এখনো বড়ো হওনি?
এখনো না। জানো, একটা গানে আছে - 'উওম্যান, আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড / দ্য লিটল চাইল্ড ইনসাইড অব আ ম্যান'। পুরুষমানুষের ভেতরে বাস করা ছোট্টো শিশুটিকে বোঝার চেষ্টা করো হে নারী।
রানু যাবে টিকাটুলি, স্টেডিয়ামের কাছে এসে কোনোমতে ঠেলেঠুলে বিজুকে নামিয়ে দেয় সে। অনিচ্ছায় নেমে দাঁড়ায় বিজু। রানু মিষ্টি করে হেসে বলে, কাল দেখা হবে।
হতেই হবে।
বিজু এই সময়ে এখন কোথায় যায়, কী করে? বাসায় ফিরতে একদম ইচ্ছে করছে না। আজকের দিনটা অন্যরকম, উদযাপন করা দরকার একা একা।
স্টেডিয়ামের গেটের সামনে ঝালনুন দেওয়া কাটা আমড়া কেনে। অনির্দিষ্টভাবে রাস্তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমড়া খায় সে, টকঝাল মিলিয়ে অদ্ভুত মজাদার জিনিস।
হঠাৎ মনে পড়ে, ক্লাসে যাওয়ার জন্যে যে নোটবই হাতে ছিলো, সেটা এখন নেই। রানুর ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছিলো, ওর সঙ্গেই চলে গেছে। আপনমনে হাসে বিজু।
বিকেলের রোদ মরে গেছে, সন্ধ্যা নামছে। সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে লাগলো সে। 'আর কি কখনো কবে, এমন সন্ধ্যা হবে...'
৫
রানুর সঙ্গে তার সম্পর্ক কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, কোথায় যাচ্ছে - এসব আর আজকাল তেমন ভাবতে ইচ্ছে করে না বিজুর। কী হবে? কোনোকিছু পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। যা হবে তার সঙ্গে নিজেকে মেলাতে হবে। শুরুতে এই যুদ্ধ-সন্ধি খেলাটা দুরূহ ও দুঃসহ মনে হতো, কিন্তু কালক্রমে সব সয়ে যায়।
বারো বছরের অনবরত লড়াইয়ের অভিজ্ঞতায় অতি নিপুণ ও অনিচ্ছুক এক সমরবিদ সে। এই যুদ্ধ, তো এই সহাবস্থানের সন্ধি। সহাবস্থান মানে কি? পরস্পরকে সহ্য করে অবস্থান করা? যতোক্ষণ না আবার টানাপোড়েন শুরু হয়ে যায়, টেনশন বাড়ে, যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে? প্রথম গোলাটি নিক্ষিপ্ত হয়? তাই হবে। তবে তাই হোক।
একটা প্রজেক্টের কিছু খুচরো কাজ নিয়ে বস্টনে যেতে হবে, খবরটা রানুকে জানিয়েছিলো অফিস থেকে ফিরে। শুনে রানু প্রস্তাব দেয়, আমি আর ফুলটুসও তোমার সঙ্গে গিয়ে ঘুরে আসতে পারি।
খুব ভালো কথা। কিন্তু আমি সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকবো, সন্ধ্যার আগে একটুও সময় হবে না। অচেনা জায়গায় তোমরা একা একা কোথায় ঘুরে বেড়াবে? সারাদিন হোটেলে বসে থাকারও কোনো মানে হয় না।
মিষ্টির বাসায় যেতে পারি আমরা। ওর সঙ্গে বেড়ানো যাবে। আর কিছু না হলে সারাদিন আড্ডা দেওয়া হবে। ওর ছেলে ফুলটুসের বয়সী, ওদেরও ভালো সময় কাটবে।
বিজুর মনে পড়ে, রানুর এই বান্ধবীটি বস্টনেই থাকে। মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হয়। ওদের বিয়ের পর বার দুয়েক ইস্কাটনের বাসায়ও এসেছে মিষ্টি। বিজু একদিন ঠাট্টা করে বলেছিলো, আমার কোনোদিন ডায়াবেটিস হলে তুমি কিন্তু ভুলেও আমার কাছাকাছি আসবে না।
মিষ্টি প্রথমে ধরতে পারেনি, বিজু ব্যাখ্যা দিয়েছিলো, তখন ডাক্তারের কড়া নিষেধ থাকবে, তবু মিষ্টি দেখলে খেতে ইচ্ছে করবেই! নিষিদ্ধ হলেই লোভ বেশি হয় না!
রানুর আইডিয়াটা পছন্দ হয় বিজুর। সায় দিয়ে বলে, বেশ তো, তোমার অফিসে কাল কথা বলো, ছুটি পাবে কি না আমাকে জানাও। ট্রাভেল এজেন্টকে বলে একই ফ্লাইটে টিকেটের ব্যবস্থা করতে হবে।
রানুর ছুটির সমস্যা ছিলো না, কিন্তু গোলমাল হলো মিষ্টিকে নিয়ে। ননদের বিয়েতে সে ঢাকায় যাচ্ছে পরের সপ্তাহে। ব্যস, রানু দপ করে নিভে গেলো। এই ব্যাপারটাও বিজুর কাছে এক ধাঁধা, যে কোনো কিছু নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে রানু খলবলিয়ে উঠতে পারে, আবার কয়েক মিনিটের মধ্যে তেমন কোনো কারণ ছাড়া শোকসভায় যাওয়ার চেহারা বানিয়ে ফেলতেও দক্ষ সে।
বস্টন যাওয়ার উপলক্ষ আর মিষ্টির দেশে যাওয়ার সময় কাছাকাছি পড়ে গেছে, সেখানে কারো কিছু করার নেই! তাহলে?
তবু বিজু বলে, ছুটি যখন নিয়েই ফেলেছো, টিকেটটা করে ফেলি। আর এর মধ্যে খোঁজখবর করে দেখা যাক, বস্টনে চেনা কাউকে না কাউকে হয়তো পেয়ে যাবো। আমার কাজ শেষ হলে না হয় আরো দু'দিন থেকে তারপর ফিরবো।
রানুর তাতে সায় নেই, সে যাবে না ঠিক করে ফেলেছে। তার মন খারাপ থাকলো প্রায় সারাদিন। রাতে বিজু প্রস্তাব দেয়, যদি বস্টনে যাবে না ঠিক করে থাকো, তাহলে একটা কাজ করো। ফুলটুসকে নিয়ে হিউস্টন ঘুরে আসতে পারো।
হিউস্টনে রানুর বড়ো বোন থাকে, গাড়ি নিয়ে চার-পাঁচ ঘণ্টায় দিব্যি চলে যাওয়া যায়। বিজু ভাবছিলো, ঘরে বসে ছুটি নষ্ট না করে এটা একটা বিকল্প হতে পারে। ওদেরও ভালো লাগবে, ফুলটুস বড়ো খালামনির খুব ভক্ত।
রানু হঠাৎ ঝামটা দিয়ে বলে ওঠে, ফুলটুসের স্কুল আছে না?
হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে খানিকটা সময় লেগে যায় বিজুর। আশ্চর্য, বস্টনে যাওয়ার কথা হচ্ছিলো, তখন ফুলটুসের স্কুলের কথা ওঠেনি! এখন হঠাৎ! 'দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভন্ অ্যান্ড আর্থ, হোরেশিও...।'
বস্টন যাওয়ার দু'দিন আগে সন্ধ্যায় অফিসে আটকে যায় বিজু। কয়েকদিন আগে একটা প্রজেক্ট প্ল্যান তৈরি করেছিলো। একটু আগে বস্ এসে জানিয়ে গেলো, বেশ কিছু অদলবদল করতে হবে এবং শেষ করে দিতে হবে আজই। তখন বিকেল চারটা।
বিজুর খুশি হওয়ার কারণ নেই, বস্ যেভাবে বলে দিয়েছিলো, সেভাবেই সে করেছিলো। এখন শেষ মুহূর্তে এসে বলছে, বদলে দাও। অন্তত ঘণ্টা চারেক লেগে যাবে শেষ করতে। কিছু করার নেই, এর নাম চাকরি। বাসায় ফোন করে রানুকে বলেছিলো, আমার আজ ফিরতে দেরি হবে। কতো দেরি তাও বলতে পারছি না।
রানুর ঠাণ্ডা গলার জবাব, এ আর নতুন কী!
রানু, প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো। ক'দিন আগের করা একটা প্রজেক্ট প্ল্যান বদলাতে হবে আজকের মধ্যে। আমাকে ধরিয়ে দিয়ে গেলো এই একটু আগে।
বেশ তো, কাজই করো। তোমাকে বাসায় আসতে হবে না।
মানে?
মানে আবার কী? তোমাকে দিয়ে তো ঘরের কোনো কাজই হবে না। সারাদিন অফিস করে ডে-কেয়ার থেকে ফুলটুসকে তুলে নিয়ে এসেছি। এখন রান্না করতে হবে, মেয়েকে গোসল করাতে হবে, খাওয়াতে হবে। এদিকে মেয়ে বাবার সঙ্গে গোসল করবে বলে জেদ ধরে বসে আছে।
বিজু আস্তে আস্তে বলে, আমি এখন তাহলে কী করতে পারি?
কিছু করতে তোমাকে, কেউ বলেনি। যেখানে আছো থাকো, যা করছো তাই করে যাও।
বিজুকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না রানু, ফোন রেখে দিয়েছে সে। বিজু থম ধরে বেকুবের মতো বসে থাকে খানিকক্ষণ, তারপর উঠে বাইরে যায়। এইসব সময়ে সিগারেটের চেয়ে ভালো আর কী আছে!
সেই রাতে বিজুর ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় একটা বেজে গিয়েছিলো। রানু-ফুলটুস নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে গেছে, প্রায় নিঃশব্দে দরজা খুলে নিজের বাসায় চোরের মতো ঢুকে দেখে, বসার ঘর অন্ধকার। ঠিক অন্ধকার নয়, ঘরের আলো নেভানো, টিভি চলছে, সেই আলোতে ঘর আলো। রানু ঘুমিয়ে গেছে সোফার ওপরে। খিদে নিয়ে ফিরেছিলো বিজু, কিন্তু এখন খাবার টেবিলে বসলে সাড়া পেয়ে রানু উঠে পড়তে পারে। দু'গ্লাস পানি খেয়ে শুতে চলে গিয়েছিলো সে।
পরদিন সকালে ফুলটুসকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে এসে দেখে, রানু এক বাটি সিরিয়াল নিয়ে বসেছে খাবার টেবিলে। অন্যান্য দিনে বিজু একবারে তৈরি হয়ে মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অফিসে চলে যায়। গতকাল অনেকরাত পর্যন্ত কাজ করেছে, আজ দেরি করে যাবে। রানুর অফিস খুব দূরে নয় বলে সে আটটার মিনিট দশেক আগে বেরিয়েও ঠিক সময়মতো অফিসে পৌঁছতে পারে।
বিজু কফি মেকার চালু করে দিয়ে বাটিতে দুধ-সিরিয়াল ঢালে। টেবিলে এসে বসে। দু'জনে মুখ নিচু করে খুব মনোযোগের সঙ্গে খায়, যেন সিরিয়ালের বাটি ছাড়া দর্শনীয় আর কিছু নেই।
'নো স্মাইলস, নট আ সিঙ্গল ওয়ার্ড অ্যাট দ্য ব্রেকফাস্ট টেবল্ / ...সো মাচ দ্যাট আই ওয়ানা সে, বাট আই ফীল আনএবল্ / ...ওয়ান ম্যান ওয়ান উয়োম্যান, ওয়ান লাইফ টু লিভ টুগেদার..'
৬
ফাইনাল পরীক্ষার শেষ হলে বিজু সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলে, এবার বিয়েটা সেরে ফেলা দরকার।
রানু হেসে ফেলে, তোমার যে বিয়ের এতো শখ!
আরে কী আশ্চর্য, শখ হবে কেন? এটা হলো দরকারের কথা। শখ সেটাই যা মানুষ মাঝেমধ্যে করে থাকে। আমার এখনো একবারও বিয়ে করা হলো না।
সবাই যে বলে বিয়ে দিল্লিকা লাড্ডু। খেলে মানুষ পস্তায়, না খেলেও নাকি পস্তায়।
তাহলে খাওয়াটাই লাভ, কী বলো? চলো খেয়ে দেখা যাক।
দু'বাড়িতেই কমবেশি জানাজানি হয়ে গেছে ততোদিনে। রানুকে একদিন বাসায় নিয়ে গিয়ে মা-র সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলো বিজু। পরে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, কেমন দেখলে মা? তোমার ছেলের বউ হলে কেমন হয়?
মা-র সঙ্গে বিজুর হাসি-ঠাট্টাও চলে। মা বলেছিলো, বাঁদরের গলায় মুক্তার মালা হয়ে যাবে না তো?
আজকালকার বাঁদররা মুক্তার কদর জানে মা।
বিয়ের আনুষ্ঠানিক কথা পাড়ার একটা ব্যাপার থাকে, সেটা সামলাবে কে? বিজুকে নিয়ে রানু যায় ধানমণ্ডিতে বোনের বাসায়। দুপুরে খাবার টেবিলে বসে বোন-দুলাভাইকে সব বৃত্তান্ত খুলে বলা হলো। দুলাভাই খুব গম্ভীর মুখে জানায়, আমার কিন্তু একদম মত নেই।
থতমত খেয়ে যায় রানু। দুলাভাইয়ের ওপর অনেক ভরসা তার, সেই কারণেই আসা। রানু বলে, মানে?
একটিমাত্র শ্যালিকার দখল কোন দুলাভাই ছাড়তে চায়? যে চায় সে মহা আহাম্মক। এতোদিন ধরে আশা করে আছি, শ্যালিকাসুন্দরীর মন একদিন না একদিন গলবে। এখন সে আশাও গেলো বলে।
একচোট হাসাহাসির পর রানু বলে, তোমার সঙ্গে আমার প্রেম তো জন্ম-জন্মান্তরের। তাই বলে বোনের অফিসিয়াল সতীন তো আর হতে পারি না।
সেখানেই তো কথা। আমার যদি সত্যি সত্যি আরেকটা বিয়ে করতে ইচ্ছে করে তাহলে কী হবে, বল তো? কোথাকার কে এসে তোর বোনের সতীন হয়ে বসবে। তার চেয়ে তুই রাজি হয়ে গেলে সবদিক থেকে ভালো হতো। দুই বোনে মিলেমিশে থাকতিস। ঝগড়াঝাটি চুলোচুলি হলেও ঘরের কথা ঘরেই থাকতো। কতো সুবিধা বল তো!
আপা বলে উঠেছিলো, আহা শখ কতো!
রানু বলে, তোমার সঙ্গে প্রেম বিয়ের পরেও চলতে পারে, দুলাভাই।
তখন কি আর তুই আমকে পাত্তা দিবি?
তুমি এমন আনাড়ি, তা জানতাম না। তখন হবে পরকীয়া প্রেম। জানো না, পরকীয়া প্রেম সবচেয়ে মিষ্টি!
রানুর দুলাভাই উদ্যোগী মানুষ বোঝা গেলো। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে দেখাদেখি, কথাবার্তা সব শেষ। কোনো পক্ষ থেকে আপত্তি ওঠেনি, কারণও কিছু ছিলো না।
বিয়ের রাতে রানুর প্রথম কথা, আমাকে তুমি বিয়ে করলে কেন?
আমাকে কতোবার ফিরিয়ে দিয়েছিলে মনে আছে, এখন যাবে কোথায় জাতীয় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো বিজু, তার আগেই বোমা ফাটিয়েছে রানু। ওই একবারই অবশ্য, কিন্তু তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি কোনোভাবে।
বিয়েতে ছেলেকে নিয়ে ভাই-ভাবী এসেছিলো। বউভাতের পরদিন বড়ো ভাই বিজুর হাতে দু'খানা প্লেনের টিকেট ধরিয়ে দিয়ে বলে, যা, দু'জনে মিলে ঘুরে আয়। সিঙ্গাপুরের টিকেট। ভাইয়ের পরামর্শমতো সিঙ্গাপুরে দু'দিন থেকে মালয়েশিয়ার দেসারু বলে একটা সমুদ্রসৈকতে চলে গিয়েছিলো। সিঙ্গাপুর থেকে গাড়িতে ঘণ্টা দেড়েক।
কী যে সুন্দর জায়গা দেসারু। বিজু-রানুর মুগ্ধতার শেষ ছিলো না। জায়গাটা এখনো ট্যুরিস্ট স্পটের মতো করে তৈরি হয়ে ওঠেনি। ভ্রমণকারীদের জন্যে থাকা-টাকার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু বড়ো হোটেল-শপিং সেন্টার এসব নিয়ে হৈ হৈ করা বাণিজ্যিক রিসর্ট হয়ে ওঠেনি। অনেকখানি প্রাকৃতিক, যেন ইচ্ছে করেই এভাবে ফেলে রাখা হয়েছে। সমুদ্রের পানি এতো স্বচ্ছ যে, কোমরসমান পানিতে দাঁড়িয়েও পায়ের পাতা স্পষ্ট দেখা যায়।
বিজু মনে মনে বলে, এই জায়গাটা যেন চিরদিন এরকম থাকে। দেসারুর কথা বেশি লোকের জানার দরকার নেই। জানলে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়বে, সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। এটা তার নিজস্ব ভ্রমণবিলাস হয়ে থাক, এখানে বারবার ফিরে আসবে সে।
খুব নামকরা নয়, এরকম অপ্রচলিত জায়গাই বেড়ানোর জন্যে বিজুর বরাবর পছন্দ। দেসারুতে দুই কামরার একটা কটেজে উঠেছিলো। বাসনকোসনসহ কিচেন আছে, রান্নাবান্না ইচ্ছে করলে করা যায়। মধুচন্দ্রিমায় কেউ রান্না করে সময় নষ্ট করে?
খাওয়ার জন্যে আধমাইল হেঁটে যেতে হয় রেস্টুরেন্টে। সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে ঘন গাছগাছালির ছায়াঢাকা রাস্তায় হাঁটতেও ভালো লাগে। বিকেলে সমুদ্রস্নান, সন্ধ্যায় সমুদ্রের পাড়ে খালিপায়ে হাঁটাহাঁটি। এখানে নিজেদের নাম-পরিচয় মনে না রাখলেও চলে।
ইস্কাটনের বাড়িতে নতুন সংসার শুরু হয়েছিলো। বিয়ের পরপরই বাবা-মাকে একদম একা ফেলে আলাদা বাসায় যেতে চায়নি বিজু, বড়ো ভাই আগেই দেশান্তরী। ধীরেসুস্থে একটু গুছিয়ে নিজেদের আস্তানায় যাওয়ার ইচ্ছে। রানুর আপত্তি ছিলো না।
কর্মজীবন শুরু না করলে নাকি পুরুষমানুষ হয়ে ওঠা সম্পূর্ণ হয় না। চাকরিটা বিজু বেশ উপভোগ করতে শুরু করেছিলো। অফিসে এক ধরনের পরিবেশ, যার সঙ্গে কখনো পরিচয় ছিলো না। আগে কখনো কখনো কোনো অফিসে গেছে কোনো কাজে, কিন্তু নিজে সে অফিসের কেউ ছিলো না, ছিলো শুধু অতিথি বা কারো সাক্ষাতপ্রার্থী। এখন তার নিজের অফিস, নিজস্ব বসার জায়গা, নিজের চেয়ার-টেবিল। নির্দিষ্ট কাজের দায়িত্ব, সে কাজ সময়মতো সম্পন্ন করার শর্ত। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার পরিতৃপ্তি একটি সফল যৌনসঙ্গমের চেয়ে কম নয়।
দিনের শেষে নির্ভার হয়ে ঘরে ফেরা, অপেক্ষমান একটি সুন্দর মুখের মুখোমুখি হওয়া। শুধু সাতসকালে উঠে তৈরি হওয়াটাই যা কষ্টের। মনে হতো, সদ্যবিবাহিতদের দেরি করে অফিসে যাওয়ার অধিকার থাকা উচিত। তার হাতে কোনোদিন ক্ষমতা এলে এই নিয়ম সে চালু করে দেবে। যারা অফিসের সময় ঠিক করে, তারা সবাই নিশ্চয়ই চিরকুমার নয়, তারা নিজেরাও সদ্যবিবাহিত ছিলো কোনোদিন। তবু বোঝে না কেন? ভুলে গেছে? নাকি খুবই অসুখী দাম্পত্য ছিলো তাদের? বউয়ের কাছ থেকে দূরে থাকাতেই আনন্দ?
বিজুর অবশ্য বউয়ের কাছাকাছি থাকতেই ভালো লাগছিলো। আমাকে তুমি বিয়ে করলে কেন প্রশ্নটা কাঁটার মতো তবু ফুটছিলো থেকে থেকে। জিজ্ঞেস করবে করবে ভেবেও করা হয়নি। মুখে আটকায়। ওই প্রশ্নের সঙ্গে মেলানো যায়, এমন কোনোকিছুর কোনো লক্ষণ পাওয়া যায়নি। একসময় বিজুর নিজের সন্দেহ হতে থাকে, রানু কি সত্যি সত্যি বলেছিলো? যদি না-ই বলে থাকে, কথাটা সে পেলো কোথায়? কোনো একটা ঘটনা আদৌ কখনো ঘটেনি, তবু তাকে সত্যি বলে ভ্রম হতে পারে। এটা সেরকম কিছু?
৭
শোয়ার ঘরে আলো জ্বেলে বিজু দেখে, পরিপাটি বিছানা। বেডকভার আর কম্ফর্টার আজই পাল্টানো হয়েছে বলে মনে হয়। নাকি এটাই সে দেখে গিয়েছিলো বস্টনে যাওয়ার আগে? মনে করতে পারে না। নিজের বেলায় যতো অমনোযোগী হোক, বাড়িঘর ছিমছাম পরিপাটি রাখতে ক্লান্তি নেই রানুর।
বিশেষ করে বাসায় কারো আসার কথা থাকলে সে বুলডোজারের নির্দয়তায় বিজুর কাগজপত্র, ফুলটুসের খেলনা-বই-ক্রেয়ন সব সরিয়ে ফেলতে থাকে। বাসায় একটা বাচ্চা আছে, এখানে-ওখানে তার দু'একটা খেলনা পড়ে থাকতেই পারে, অতিথিরাও নিশ্চয়ই বুঝবে - এই যুক্তি রানুর কাছে একেবারে অচল। অতিথি এসে যেন সবকিছু ছবির মতো সাজানো দেখে।
কোথায় একটা গবেষণায় দেখা গেছে, এক নজরে মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় অনেক বেশি খুঁটিনাটি দেখে ফেলতে পারে। ফলে, যে ঘরটি একজন পুরুষের কাছে দিব্যি পরিপাটি সাজানো মনে হচ্ছে, একজন মেয়ে তার মধ্যে থেকেই দশটা খুঁত খুঁজে পাবে অনায়াসে। আর কোনো গবেষণা বিজুর এমন সর্বাত্মক সমর্থন পায়নি। তবু আজ একটু অতিরিক্ত যত্ন আছে বলে তার ধারণা হয়। এমনও হতে পারে, বিজুর সেরকম ভাবতে ইচ্ছে করছে। রানুর শাড়ি পরা, সামান্য সাজও হয়তো কোনো ধারণা দিয়ে থাকবে।
ঘরের পোশাক পরে গোসল করার কথা ভাবে। কিন্ত তার আগে ফুলটুসকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে। দেরিতে ঘুমালে মেয়ে সকালে উঠতে বড্ড ঝামেলা করে। হাতমুখটা অবশ্য এখনই না ধুয়ে নিলেই নয়। শরীরে ধুলোময়লা নিয়ে মেয়ের ঘরে যেতে ইচ্ছে করে না। মনে আছে, ফুলটুস হওয়ার পর প্রথম প্রথম সিগারেট খেয়ে ওর কাছাকাছি যেতে বিজুর অস্বস্তি হতো খুব। নিজেকে ভারি অপরিচ্ছন্ন লাগতো, মনে হতো সিগারেটের গন্ধে ফুলটুসের তুলতুলে কচি শরীরের টাটকা গন্ধটা ঢাকা পড়ে যাবে। দাঁত মেজে মুখহাত ভালো করে ধুয়ে নিতো আগে।
নতুন বারবিকে নিয়ে বিছানায় যায় ফুলটুস। ঘুমিয়েও পড়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে। ঘরে নাইট লাইট জ্বালিয়ে ক্যাসেট প্লেয়ারে গান চালু করে দিলে এক্কেবারে কথা বন্ধ। অভ্যাসটা করাতে অনেক সময় লেগেছে। আগে বিছানায় শুলে মেয়ের রাজ্যের কথা মনে পড়ে যেতো, এক প্রশ্নের লেজ ধরে আরেকটা, তারপর আরেকটা, আরো একটা - চলতেই থাকতো।
ফুলটুসের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বিজু। রানু সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে টিভি দেখছে। পায়ের শব্দে ফিরে তাকায়। বলে, খাবার কি এখন দিয়ে দেবো?
নিজে থেকে খাবার দেবে কিনা জিজ্ঞেস করছে! হলো কী রানুর? বিজু বললো, নাঃ, আগে গোসল করতে হবে। তুমি খেয়ে নিয়েছো?
এতো দেরি করে আমি কবে খাই?
তা-ও ঠিক। ফুলটুস হওয়ার পর সামান্য ওজন বেড়ে গিয়েছিলো রানুর, বহু কষ্টে হেলথ ক্লাবে মাস তিনেক নিয়মিত হাজিরা দিয়ে বাড়তি পাউন্ডগুলো ঝরাতে পেরেছে। এখনো মাঝেমধ্যে যায়, সপ্তাহে দু'তিনবার। এখন অফিস থেকে ফিরে সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে নেয় সে, সন্ধ্যার পর আর কিছু খায় না।
বিজু ভেবে প্রশ্ন করেনি। কথার কথাও মানুষ বলে, নাকি বলে না! সে কি আশা করেছিলো, রানু তার জন্যে না খেয়ে বসে থাকবে? অন্তত আজকের জন্যে? উচিত হয়নি। কী এমন রাজ্যজয় করে এলো সে যে আজ নিয়ম-টিয়ম সব উল্টে যাবে?
তবু কেন যেন মনে হচ্ছিলো। 'তার পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর...'। মাতাল হাওয়ার ঝলকের মতো সুগন্ধি-সুবাস!
সোফার পাশে রাখা হাতব্যাগ খুলে কাগজে মোড়া জিনিসটা বের করে বিজু। রানুর পাশে বসতে বসতে হাত বাড়িয়ে তুলে দেয়। রানু উঠে বসে। বলে, কী এটা?
শহরের বাইরে কোথাও গেলে বিজু খালি হাতে ফেরে না, রানুর জন্যে কিছু না কিছু একটা আনে। স্যুভেনির জাতীয় কিছু। বিজু বলে, খুলে দেখো।
রানু কাগজের মোড়ক খুলতে বেরিয়ে আসে একটা কফি কাপ আকৃতির পেন হোল্ডার। সামনের দিকটা বড়োসড়ো কাপের মতো দেখতে, কিন্তু পেছনে একেবারে চ্যাপ্টা। মনে হবে ভার্টিক্যাল একটা কোপ মেরে কাপটাকে আধখানা করে ফেলা হয়েছে। ওপর থেকে দেখলে কাপের মুখটা ইংরেজি ডি অক্ষরের মতো দেখায়। তার গায়ে লেখা: বস্টন ওয়াজ সো এক্সপেনসিভ দ্যাট আই ক্যুড অ্যাফোর্ড অনলি হাফ আ কাপ।
খুবই অপ্রত্যাশিতভাবে একটা স্নিগ্ধ হাসি ফোটায় রানু। বলে, খুব মজার তো!
এক মুহূর্তের জন্যে বুয়েটের সময়টা ফিরে এলো বলে মনে হয় বিজুর। বলে, আমার মনে হলো তোমার পছন্দ হবে।
খুব সুন্দর কিন্তু। মেয়ের জন্যে বারবি পুতুল, আমার জন্যে আধখানা কাপ, তোমার জন্যে কী?
বিজু কবিতা পড়তে ভালোবাসে, বলা উচিত একসময় ভালোবাসতো, ছন্দটন্দ তেমন বোঝে না। তবু রানুর শেষের কথাটা কবিতার লাইনের মতো শোনায় - মেয়ের জন্যে বারবি পুতুল, আমার জন্যে আধখানা কাপ, তোমার জন্যে কী? বাঃ, বেশ তো!
আমার জন্যে আবার কী?
রানু উঠে গিয়ে পেন হোল্ডারটা রাখে কিচেন কাউন্টারের ওপরে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কয়েকটা কলম তুলে নিয়ে রাখে তার ভেতরে। ফিরে এসে বিজুর পাশে বসে। ইচ্ছে করলে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায়। ইচ্ছেটাকে আবার শাসন করে বিজু, সতর্ক হওয়া উচিত।
টিভিতে কী একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিলো, বিজু লক্ষ্য করেনি। রানু রিমোট টিপে চ্যানেল বদলে দেয়। সিএনএন। রানু খবর-টবর বিশেষ দেখে না, টিভিতে তার পছন্দের জিনিস হলো মুভি। খুঁজে খুঁজে সে নতুন-পুরনো, রঙিন-সাদাকালো সব ছবিই দেখে। এখন চ্যানেল পাল্টায় সম্ভবত বিজুর জন্যে।
বিজু টিভির সামনে বিশেষ বসে না, সকালের কফি খেতে খেতে খবরের শিরোনামগুলো দেখে নেয়। এখন তর্ক চলছে ইরাকে সাদ্দামের ছেলেদের খুন করার পর তাদের ছবি টিভিতে দেখানো উচিত হয়েছে কি না তাই নিয়ে। খুন করাটা জায়েজ ছিলো কিনা তা নিয়ে কেউ কিছু বলছে না। পৃথিবীতে কতো যে উচিত-অনুচিতের প্রশ্ন আছে! কেউ কেয়ার করে?
রানু টিভির পর্দায় চোখ রেখে বলে, তোমার জন্যে নয় কেন?
নিজের জন্যে কেনা যায়? বিজুর চোখও টিভিতে।
কিনলেই কেনা যায়।
বিজু বলে, তুমি জানো নিজের জন্যে কী কেনা যায় তাই খুঁজে পাই না।
কথাটা ঠিক। টুকটাকি জিনিস ছাড়া নিজের জন্যে কিছু সে কিনতে পারে না, জানেও না। কোনো একটা শার্ট কাউকে পরতে দেখে হয়তো খুব পছন্দ হয়ে গেলো, নিজে দোকানে গিয়ে ওই ধরনের কিছু খুঁজেও পায় না। যা সামনে দেখে, কোনোটাই পছন্দের মনে হয় না। জামাকাপড় থেকে শুরু করে বিজুর প্রায় সব কেনাকাটা রানুর।
রানু আচমকা জানায়, সিগারেট তো নিজেই কেনো!
এবার রানু তার দিকে মুখ ফিরিয়েছে টের পায় বিজু।
প্যালেস্টাইনিদের সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তি আলোচনার সময়ও দুই পক্ষের মধ্যে খুনোখুনির খবর এখন টিভিতে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত লোকরা কীসব বলছে, বিজুর মাথায় ঢোকে না। শুনলে না ঢুকবে! তার এখন উপস্থিত সংকট, সে বুঝতে পারছে না রানু ঠিক কোনদিকে যাচ্ছে। শান্তির পায়রার দিকে তাক করা বন্দুক।
বিপদের গন্ধ পাচ্ছে বিজু, পিঁপড়েরা যেমন বৃষ্টির গন্ধ পায়। উঠে দাঁড়ায় বিজু। তাড়াতাড়ি বলে, বরং খেয়েই নিই এখন।
এই না বললে গোসল করে খাবে।
তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে, আগে খেয়ে নিই। গোসল পরে।
খিদে পাওয়ার কথাটা মিথ্যা নয়, অজুহাতও নয়। বস্টন থেকেই খিদে বয়ে নিয়ে এসেছে সে। তবু এখন এই সময়ে সেটাকে কাজে লাগাতে পেরে নিজের ওপরে খুশি হয়ে ওঠে বিজু।
রানু বলে, পাঁচটা মিনিট সময় দাও, খাবারগুলো গরম করে দিই।
তোমাকে কিছু করতে হবে না, আমি করে নিতে পারবো।
কেন আমি করলে খাওয়া যাবে না?
আমি কিন্তু তা বলিনি, শুধু বলেছি নিজেই করে নিতে পারতাম।
মাছ তখনই বড়শিতে ধরা পড়ে যখন সে মুখ খোলে। মহাজনদের বাক্যি। চুপ করে থাকার অভ্যাস করা দরকার, বিশেষ করে যখন কথা না বললেও চলে। বিজু কিছু ভেবে বলেনি, খাবার গরম না করলেও ক্ষতি কিছু নেই। একেবারে সদ্য ফ্রিজ থেকে বের করা না হলে ঠাণ্ডা খাবার সে দিব্যি খেয়ে ফেলতে পারে। গরম করার দরকার হলে নিজে করে নেওয়া যায়, মাইক্রোওয়েভে ঢুকিয়ে দিলেই হলো। সেটা যে তাকে আদৌ কখনো করতে হয় না, তা-ও নয়। রানু কথাটা একটু সুন্দর করে বলতে পারতো। চাই কি একটা কপট ধমক দেওয়ারও সুযোগ ছিলো। সেটাই কি উপযুক্ত হতো না!
রানু খাবার গরম করে টেবিলে সাজিয়ে দেয়। ভাজা ইলিশ আর কষানো গরুর মাংসের সঙ্গে খিচুড়ি। খেতে ভালোবাসে বিজু, খিচুড়ি-গোমাংস তার সবচেয়ে প্রিয় খাবার। এই দুই পদ না থাকলে বেহেশত-দোজখ কোনোখানেই তার আগ্রহ নেই। আলুভর্তা, ছোটো মাছের চচ্চড়ি নিয়ে বাঙালি বড়ো বেশি আদিখ্যেতা করে, সেসবে খুব আসক্তি নেই তার। ভাজাভুজি হলে সবজিও চলে, কিন্তু সালাদকে সে গরু-ছাগলের খাদ্য মনে করে। নিজেকে সে মাংসাশী প্রাণী বলে পরিচয় দেয়।
শরীর ঠিক রাখার অজুহাতে খাবার নিয়ে কতো রকমের এক্সপেরিমেন্ট আজকাল, রানু নিজেও সে আন্দোলনের নির্ভীক সৈনিক। মেদহীন ছিপছিপে শরীরের মালিক বিজুর এসব না ভাবলেও চলে। কখনো যদি সেরকম সময় আসে, তখন দেখা যাবে।
আজ হঠাৎ হলো কী রানুর? না বলতেই বাসায় শাড়ি পরার মতো একটা দুর্লভ ঘটনা ঘটিয়েছে। যত্ন করে একটু সাজগোজও করেছে। টেবিলে বিজুর পছন্দের খিচুড়ি-গোমাংস। এমন নয় যে এসব তার ভালো লাগছে না। খুবই ভালো লাগছে। কিন্তু নিজে থেকে সে আর এসব আশা করে না আজকাল। আশা না করাটা অভ্যাস হয়ে গেছে। আরো বড়ো সমস্যা, এই যে ভালো লাগছে, বলা যাবে কেমন করে? সে কি বলবে, রানু, তোমাকে সুন্দর লাগছে! বড্ড ফাঁপা। আর কীভাবে বলা যায়? ভয়ও আছে, বললে আবার যদি উল্টো মানে হয়ে যায়? রানুর আগের কথাগুলো খাঁজকাটা ছুরির খোঁচার মতো বিঁধছে এখনো!
খাওয়ার টেবিলে উল্টোদিকের চেয়ারে রানু বসা, কিছু বলছে না। মুখ নিচু করে খেয়ে যাচ্ছে বিজু। চোখ তুলে তাকাতে বার দুয়েক চোখাচোখি হয়ে যায়, রানু ওর খাওয়া দেখছে। সে খেতে বসেছে, রানু কাছে বসে আছে, এই ঘটনা শেষ কবে ঘটেছিলো?
একসঙ্গে খেতে বসা আজকাল হয় না। দু'জনে সারাদিন অফিসে, দুপুরে একসঙ্গে খাওয়ার প্রশ্ন নেই। বিজু ফিরতে ফিরতে রানুর রাতের খাওয়া হয়ে যায়।
ফুলটুসের খাওয়া টিভির সামনে বসে, কার্টুনের চাটনি না হলে খাবার মুখে রোচে না তার। বিজুর জন্যে টেবিলে খাবার দেওয়া থাকে। ইচ্ছে হলে গরম করে নেয়, নাহলে ওভাবেই খেয়ে নেয়। অবশিষ্ট খাবারগুলো ফ্রিজে তুলে রাখার দায়িত্ব তার।
এক রাতে মাংসের বাটিটা তুলে রাখতে ভুলে গিয়েছিলো। পরদিন শনিবার, ছুটির দিন। ঘুম থেকে উঠে দেখে রানু কী যেন স্প্রে দিয়ে ঘষে ঘষে কার্পেটের একটা দাগ তোলার চেষ্টা করছে। ফুলটুস কিছু একটা ফেলেছে কার্পেটে। বিজুকে দেখতে পেয়ে রানু গলায় কিছু বাড়তি ঝাঁঝ মিশিয়ে বলে, কাল রাতে মাংসের তরকারিটা তুলে রাখতে কী হয়েছিলো? গন্ধ হয়ে গেছে। ওই মাংসই খেয়ো, আমি আর রান্না করতে পারবো না। ঘরের একটা কিছু তোমাকে দিয়ে হয় না। সব কাজ আমাকে একা হাতে করতে হবে? বাঁদী পেয়েছো?
অভিযোগ। অভিযোগের বিবরণ। সিদ্ধান্ত। আনুষঙ্গিক আরো অভিযোগ। প্রশ্ন। এবং আরো প্রশ্ন। পর পর কি এগুলো সব সাজানো ছিলো?
হাঃ, গুড মর্নিং অ্যান্ড ওয়েলকাম টু আ নিউ ডে।
সবদিন এরকম ভুল হয় না, কাল ভুলে গেলো কী করে? মনে পড়েছিলো, আগের রাতে সে বাসায় খায়ইনি, বাইরে খেয়ে এসেছিলো। অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছিলো বলে বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে খেয়ে নিয়েছিলো। ফিরতে ফিরতে সাড়ে দশটা, রানু-ফুলটুস তখন ঘুমিয়ে গেছে। টেবিলের খাবার তোলা আর হয়নি।
ব্যাখ্যা দেওয়া যেতো, কিন্তু চেঁচামেচি দিয়ে দিন শুরু করা তার পছন্দ নয়। পরে দেখেছে, কোথায় কী? তরকারিটা মোটেই নষ্ট হয়নি। নাকের কাছে নিয়ে শুঁকে দেখলো, গরম করে খেয়ে খারাপ কিছু বুঝলো না। খেয়ে পেটের গণ্ডগোল হয়নি। রানুকেও খেতে দেখেছিলো। তাহলে? বিজুর কাছে উত্তর নেই।
কোনো কোনোদিন ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে নিজেই গরম করে টেবিলে বসে যায় সে একা একা। 'আই অ্যাম অলরেডি গন... সাম ডে ইউ আর গনা ইট ইয়োর লাঞ্চ বাই ইয়োরসেলফ্...।'
একা বসে খাওয়ার মধ্যে এক ধরনের ভিখিরি-ভিখিরি ব্যাপার আছে। ছোটোবেলায় তাদের বাড়িতে দেখেছে, দুপুরে কোনো ভিখারি খাবার চাইলে মা কাঁসার থালায় করে ভাত-তরকারি সাজিয়ে দিতো, সঙ্গে কাঁসার গ্লাসে পানি। ওই কাঁসার বাসনগুলো ভিখারিদের জন্যেই নির্দিষ্ট করা ছিলো। বিজু কতোদিন দেখেছে, দরজার সামনে বসা ভিখারি একা একা খেয়ে যাচ্ছে। খেতে খেতে বাঁ হাতে গ্লাস ধরে এঁটো ডান হাতের কব্জি গ্লাসের তলায় ঠেকিয়ে ঢক ঢক করে অনেকটা পানি খাচ্ছে। গ্লাস নামিয়ে রেখে ভিখারি আবার ভাত খেতে শুরু করতো, তার উদাস চোখ তাকিয়ে থাকতো কোন অনির্দিষ্টের দিকে।
রানু জিজ্ঞেস করে, রান্না ভালো হয়েছে?
হ্যাঁ।
জিজ্ঞেস না করলে তো বলতে না। খুশি করার জন্যে বলছো?
অনেকে আগ বাড়িয়ে রান্না ভালো হয়েছে বলতে পারে। বিজু কেন যে পারে না! তার ধারণা, খাওয়ার ধরণ দেখেই বোঝার কথা রান্নাটা সে পছন্দ করে খাচ্ছে, নাকি শুধু গিলে যাচ্ছে! মুখ ফুটে বলতে হবে? নিজের বউকেও? অন্য মানুষের বাড়িতে হলে আলাদা কথা।
রানুর কথায় বলে, খুশি করার জন্যে বলবো কেন? সত্যি, তাই বলছি।
আরেকটু মাংস নাও। মাছভাজা দিই একটা?
বিজু চোখ তুলে রানুকে দেখে। আস্তে আস্তে বলে, একটা কথা বলবো রানু?
জিজ্ঞাসা চোখে নিয়ে তাকায় রানু, কী কথা?
ম্লান হেসে বিজু বলে, জানো এই যে তুমি এখন সামনে বসে আছো, আমার খেতে খুব অস্বস্তি হচ্ছে।
নার্ভাস একটা হাসি ফোটে রানুর মুখে। বলে, আমি থাকলে অস্বস্তি হবে কেন?
না, অনেকদিন অভ্যাস নেই তো! একা একা খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
একটু চুপ করে থাকে রানু। চোখ নামিয়ে ডান হাতের একটা আঙুল দিয়ে টেবিলে কিছু একটা খুঁটছিলো। শ্বাস ফেলে অস্পষ্ট করে বলে, আমাদের সম্পর্কটা কোথায় এসে দাঁড়ালো বলো তো!
আমিও তাই ভাবি রানু। মনে হয়, এরকম হওয়ার কথা ছিলো না। খুব ভেবে দেখলে কিন্তু সত্যিকারের বড়ো কারণও কিছু পাওয়া যাবে না। তবু এটাই সত্যি এখন।
আমি তাহলে উঠে যাই?
তোমাকে উঠে যেতে কিন্তু বলিনি রানু। ভুল বুঝো না, কথাটা বলা দরকার মনে হলো, তাই বলা।
রানু চেয়ারে গা এলিয়ে ডাইনিং টেবিলের ওপরে সিলিং-এ ঝোলানো আলোর ডুমটার দিকে তাকিয়ে থাকে। চশমার আড়ালে রানুর চোখ কি ভিজে ওঠে? নাকি দেখার ভুল!
‘ইফ ইউ ডোন্ট নো মি বাই নাউ, ইউ উইল নেভার নেভার নেভার নো মি... নো, ইউ ওন’ট।’
টেবিলের ওপর পড়ে থাকা রানুর হাতে চোখ পড়ে। শুধু হাত ধরাধরি করে পাশাপশি বসে থাকা - কতোদিন হয় না! ভালো করে তো দেখাও হয়নি অনেকদিন, আরো দশটা হাত পাশাপাশি রাখলে এখন হয়তো রানুর হাতটা আলাদা করে চিনতেও পারবে না বিজু।
কবে সে এক আশ্চর্য সময় ছিলো, এই হাতের একটুখানি স্পর্শের জন্যে আড়াল খোঁজা, নিঃশব্দে হাত ধরে কথা বলার চেয়েও বেশি কথা বলা - এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়ার ছিলো না। সময়ে চাওয়াগুলো পাল্টে যায়, ভালো লাগা, ভালোবাসাও নতুন মাত্রার সন্ধান করে।
সম্পর্ক কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে বললো রানু, বিজুও ভেবেছে কতোবার! তবু মনে হয়, এই অবস্থার ভেতরেও কি ভালোবাসা নেই? ভালোবাসা কোনো বদ্ধ জলাশয় নয়, সময়ে সেও পাল্টায়। নতুন পলি পড়ে, চর জেগে ওঠে কোথাও। উদ্দাম স্রোতে পাড় ভাঙে কোথাও, চোরাস্রোতের গভীরতার থৈ পাওয়া যায় না। হয়তো পুরনো ভালোবাসাও আগের খোলস ছেড়ে নতুন চেহারা নিয়েছে এখন। তাই যদি হবে, পুরনো দিন ভেবে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলা কেন! এই বদলটা মানতে মন চায় না, তা-ই বা কেন!
বিজুর খাওয়ার ইচ্ছে চলে গেছে। গ্লাস তুলে অনেকটা পানি খায়, প্লেটে পড়ে থাকা অবশিষ্ট ভাতগুলোর ভেতরে আঙুল দিয়ে এলোমেলো নকশা কাটতে থাকে। কয়েক বছর আগে হলেও হয়তো সে রানুর নাম লিখতো।
বুয়েটে যখন রানু আস্তে আস্তে তার জীবনের ভেতরে ঢুকে পড়ছিলো, সেই সময় বিজু হাতের কাছে কাগজ-কলম পেলেই রানুর নাম লিখতো - একবার, দু’বার, শত শতবার। কোনো কারণ নেই, ভেবেচিন্তেও নয়। কী অদ্ভুত ঘোরলাগা এক সময় ছিলো! সেই অর্থহীন বোকামির মধ্যেও কতো রোমাঞ্চ!
মনে আছে, একবার রানুর জন্মদিনে বিজু নিজের হাতে একটা কার্ড বানিয়েছিলো। কার্ডের ব্যাকগ্রাউন্ড হলুদ রঙে আগাগোড়া ছোপানো, ঠিক মাঝখানে লাল মার্কার দিয়ে বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখেছিলো, আজ তোমার দিন, শুভ হোক, মঙ্গল হোক। আর পুরো কার্ড জুড়ে বিভিন্ন রঙের কালিতে ছোটো ছোটো করে লিখলো, রানু রানু রানু রানু...। সেই কার্ড রানুকে কী মুগ্ধ, উচ্ছ্বসিত করেছিলো!
খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে পড়ে বিজু। অভ্যাসমতো প্লেট হাতে তুলে নিয়ে ময়লা ফেলার পাত্রে এঁটো ভাতগুলো ঢেলে দেয়। অন্নকষ্টের দেশের মানুষ, প্রথম প্রথম খাবার ফেলতে গেলে বাধো বাধো ঠেকতো। এখানে ঘরে ঘরে, হোটেল-রেস্টুরেন্টে আর ফাস্ট ফুডের দোকানে যে কী পরিমাণ খাবার ফেলে দেওয়া হয়, না দেখলে বিজুর বিশ্বাসই হতো না। এখন আর কিছু মনে হয় না, সয়ে গেছে। প্রাচুর্যের হাত ধরে অপচয় আসে।
সিঙ্কে পানি ছেড়ে সাবান দিয়ে প্লেটটা ধুয়ে ফেলে বিজু। ফুলটুসের জন্মের বছরখানেক পরে বিজুর মা এসেছিলো নাতনিকে দেখতে। বিজুকে নিজের হাতে বাসনকোসন ধুতে দেখে মা খুব আশ্চর্য হয়ে বলেছিলো, পুরুষমানুষ এসব কাজ করে নাকি!
বিজু হাসতে হাসতে বলেছিলো, এখানে আর নূরুর মা বুয়াকে কোথায় পাবো, মা?
তাই বলে তোকে করতে হবে?
আমি একা না মা, এ দেশে সবাই করে। আর একটা-দুটো প্লেটের জন্যে ডিশওয়াশার চালানোর কোনো মানে হয় না। রানুর জন্যে রেখে দেবো, সেটা কি ঠিক? ও-ও তো আমার মতো বাইরে কাজ করে সারাদিন। ঘরে এসে বাচ্চা সামলায়, রান্নাটাও তো আমি করি না। এইটুকু না পারলে চলবে কী করে?
তুই আবার রান্না করবি কি?
বিজু বলে, একেবারে যে পারি না, তা নয়। শিখে নিয়েছি। এ এমন এক দেশ মা, এখানে ঘরের কাজ বাইরের কাজ সব ভাগাভাগি করে করতে হয়। আমি পুরুষমানুষ বলে যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকি, রানুর অবস্থা কী হবে ভেবে দেখো তো!
মা তবু ঠিক মানতে পারেনি। পারার কথা নয়, সারাজীবনের অভিজ্ঞতা তাকে অন্যরকম শিখিয়েছে। বলেছিলো, এতো কষ্ট করে এখানে থাকার তাহলে দরকার কী তোদের? দেশে চলে এলেই পারিস।
বিজু এক পায়ে খাড়া। এ দেশে তার মন বসেনি কোনোদিন, আসতেও সে চায়নি। তাকে আসতে হয়েছিলো, মা জানে। এখন ফিরে যাওয়ার কথা বললেও সিদ্ধান্ত তার একার হবে না, ফুলটুসের জন্মের পর তার জীবনের অংশীদার আরো একজন বেড়ে গেছে। এসব মাকে বলার মানে হয় না।
বলে, তার চেয়ে তুমি চলে এসে আমাদের সঙ্গে থাকো। বাবা তো আর নেই, বড়ো ভাইও বাইরে।
তোর বাবা নেই, তার কবরটা তো আছে!
এই কথার জবাব হয় না। বাবার কবর এখানে তুলে আনা যাবে না। বিজু জানে, মায়ের এখন শুধু অপেক্ষা, বাবার কাছে কবে যেতে পারবে। মৃত্যু বাবাকে আলাদা করে সরিয়ে নিয়ে গেছে, কিন্তু মা খুব বেশিকাল আর আলাদা থাকতে চায় না।
মা কী বুঝেছিলো কে জানে। মানতে পারছিলো না, বেশ বোঝা যাচ্ছিলো। শেষমেষ বলেছিলো, আমি যে ক’দিন আছি, তোকে বাসন ধুতে হবে না। আমি করে নেবো।
তা মা করেছিলো। মাস দেড়েক ছিলো, তার বেশি তাকে রাখা যায়নি। যতোদিন ছিলো, বিজুকে রান্নাঘরে বা ধোয়াধুয়ির মধ্যে যেতে দেয়নি একেবারে।
প্লেট ধুয়ে পানি খেতে খেতে বিজু দেখে, রানু উঠে দাঁড়িয়েছে। মুখে বিষণ্ণতার মেঘ। ধীর পায়ে সোফায় গিয়ে বসে রানু।
টেবিলে খাবার দেওয়ার সময় টিভি বন্ধ করে উঠে এসেছিলো, রিমোট চেপে আবার অন করে দেয়।
‘দ্য কোল্ড রিমেইনস অব হোয়াট বিগ্যান উইথ আ প্যাশনেট স্টার্ট...।’
৮
আমার ভালো কিছু একটা হোক, তুমি চাও না। তাই না?
ইউনিভার্সিটির শেষ পরীক্ষায় খুবই ভালো রেজাল্ট করেছিলো রানু। পড়াশোনায় সে বিজুর চেয়েও ভালো ছিলো, কিন্তু শেষ পরীক্ষার ফল সম্ভবত রানুর প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে যায়। পরীক্ষার বেশ আগে থেকেই সে আমেরিকার ইউনিভার্সিটিগুলোতে লেখালেখি শুরু করেছিলো, বিজু জানতো। বিশেষ পাত্তা দেয়নি।
দিতে হলো রেজাল্টের মাস তিনেক পরে টেক্সাসের একটা ইউনিভার্সিটি থেকে রানুর মাস্টার্স করার জন্যে স্কলারশীপের ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়ে গেলে। বিজু চাকরিতে ঢুকেছিলো বিয়ের পরপরই। রানু স্কলারশীপের জন্যে লেখালেখির পাশাপাশি নিজেও চাকরির চেষ্টা করছিলো। কাগজপত্র আসতেই তা বন্ধ হয়ে যায়।
বিজু যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করে, ওভাবে না দেখে ভালো করে ভাবো। তুমি আরো পড়াশোনা করতে বাইরেই যদি যাবে, আমরা বিয়ে পরেও করতে পারতাম। তুমি আমেরিকায় যাবে, আমি এখানে - কেমন হচ্ছে ব্যাপারটা?
কথা হচ্ছিলো রাতে বিছানায় শুয়ে। বিজু দু'হাত ভাঁজ করে মাথার নিচে দিয়ে চিৎ হয়ে শোয়া। রানু ডান কাত হয়ে, বিজুর দিকে মুখ।
আমি তো তোমাকেও সঙ্গে যেতে বলছি।
ওরা স্কলারশীপ তোমাকে দিয়েছে, আমাকে নয়।
রানু বলে, গিয়ে চেষ্টা করলে তোমার পড়াশোনারও একটা ব্যবস্থা করা যাবে, আমি ঠিক জানি।
তোমার জানাটা ভুলও হতে পারে, রানু।
যদি লেখাপড়ার ব্যবস্থা না হয়, তোমার নিজের লাইনে কাজকর্ম খুঁজে নিতে পারবে।
বিজু মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলে, আমার জন্যে কি ওরা চাকরি নিয়ে বসে আছে?
রানু হাসে না, তুমি আগে থেকেই এরকম কথা বললে কী করে হবে? গিয়ে চেষ্টা তো করা যায়।
রানু, তুমি কি বুঝতে পারছো, এটা ঠিক ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ যাতায়াতের মতো ব্যাপার নয়? আমাকে যেতে হলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখানকার পাট গুটিয়ে যেতে হবে। আমি বলছি না যে, এই চাকরি আমার জীবনের মোক্ষ। কিন্তু এটা আমার ক্যারিয়ারের সঙ্গে জড়িত। তোমার লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর ফিরে এসে আবার নতুন করে আমাকে শুরু করতে হবে, তা ভেবে দেখেছো?
না-ও ফিরতে পারি। একেবারে চলে গেলে ক্ষতি কী?
এই ভাবনার সঙ্গে বিজুর পরিচয় ছিলো না। বন্ধুরা অনেকে বিদেশে চলে গেছে, কেউ কেউ চেষ্টায় আছে। কিন্তু নিজে দেশের বাইরে কোথাও স্থায়ীভাবে চলে যাবে এমন কোনোদিন সে ভাবেইনি।
বলে, লাভ-ক্ষতির কথা জানি না, তবে এতে আমার সায় নেই।
ছেলেভোলানোর কায়দায় রানু হঠাৎ বিজুর গলা জড়িয়ে ধরে খুব মিষ্টি গলায় বলে, আমি বললেও না?
রানু, তুমি বোঝার চেষ্টা করো। ঝোঁকের মাথায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না।
ঝোঁকের মাথায় বলছি না। চিঠি লেখালেখির শুরু থেকেই জানি, আমি এ দেশে থাকবো না।
কিন্তু এর মধ্যে এখন আর শুধু আমি বলে কিছু নেই, আমরা বা আমাদের।
রানু হাল ছাড়ে না। গাঢ় গলায় বলে, আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে?
নিজেকে আস্তে আস্তে ছাড়িয়ে নেয় বিজু। বলে, তার মানে আমি না গেলেও তুমি যাচ্ছো, এই তো?
হ্যাঁ। তুমি যেতে চাও কিনা, সেটা তোমার ওপর ছেড়ে দিচ্ছি।
আমি যদি যেতে না চাই তাহলে আমাদের সম্পর্কটা কোথায় যাচ্ছে ভেবে দেখেছো?
রানু স্পষ্ট গলায় জানায়, তোমাকে ছেড়ে একা যাওয়ার কথা কিন্তু আমি একবারও ভাবিনি, বলিওনি। যা কিছু ভেবেছি, দু'জনকে নিয়ে। এখন তুমি যদি আমাকে একা ছেড়ে দাও, তার জন্যে আমি দায়ী হতে যাবো কেন?
ছোটোবেলায় একবার নানাবাড়ির ঘাটে বাঁধা নৌকায় বসে একা একা বৈঠা নিয়ে খেলা করছিলো বিজু। ঘাটে আর কেউ ছিলো না। হঠাৎ হাত ফসকে বৈঠা পানিতে পড়ে যায়। তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে তুলতে গিয়ে নিজে পানিতে পড়ে গিয়েছিলো সে। সাঁতার তখনো জানে না বিজু। কেউ একজন ঘাটে আসছিলো তখন, দেখতে পেয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকটা তাকে তুলে এনেছিলো। কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার, কিন্তু নদীর পানিতে তলিয়ে যেতে যেতে সে টের পেয়েছিলো, দম বন্ধ হয়ে আসা জিনিসটা কী। এখন রানুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে সেই অনুভূতিটা স্পষ্ট মনে আসে বিজুর।
বিজু শ্বাস ফেলে বলে, কিন্তু যাওয়ার সিদ্ধান্তের দায়িত্বটা তোমার। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছো তুমি একাই। কথা বলে দু'জনে ভালোমন্দ যাচাই করে ঠিক করা যেতো।
আমার পড়াশোনার ব্যাপারে একটা সুযোগ এসেছে, আমাদের ভবিষ্যৎ ভেবেই সেটা আমি হাতছাড়া করতে চাইনি। তোমাকে নিয়েই যেতে চেয়েছি। তুমি না কোরো না, প্লিজ। সময় আছে হাতে, ভেবে দেখো।
রানু এগিয়ে এসে বিজুর বুকে মাথা রাখে। বিজু টের পায়, একটা চোরা স্রোত তাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম করেছে। অসহায় একটা বোধ তাকে অবশ করে দিচ্ছে।
মুরুব্বিরা সবাই এক গলায় বলে, সুযোগটা ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। এরকম সুযোগ প্রতিদিন আসে না, আর পায়ই বা ক'জন? একবার গেলে বিজু নিজেও লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে পারবে।
বিজুর আর পড়াশোনা করার ইচ্ছে ছিলো না, কিন্তু রানু একা চলে যাবে তা-ও ঠিক মনে হয় না। দাম্পত্য বিচ্ছিন্ন থাকার জন্যে নয়, একত্রে বসবাসের বাসনা থেকে মানুষ বিয়ে করে। বিয়ের আগে এই স্কলারশীপের ব্যাপারটা ঘটলে কী হতো? বিয়ে স্থগিত হয়ে যেতো? অপেক্ষার সময়টা দীর্ঘ হতো শুধু?
বিজু জানে, কোনোকিছুই পাল্টাতো না, বিয়েটা অনিবার্য ছিলো। তখন রানু যাওয়ার আগে বিয়ে সেরে ফেলতে চাইতো তারা দু'জনেই এবং ফলাফল এখন যা হতে যাচ্ছে তাই হতো। আমেরিকা যাত্রায় রানুর সঙ্গী না হয়ে বিজুর উপায় কী?
৯
ধূমপায়ীরা সাধারণত আহারের পরের সিগারেটটি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে। ব্যতিক্রম দেখেছে বিজু বাবাকে। খাওয়ার পরে বাবা সিগারেট ধরানোর জন্যে অপেক্ষা করতো প্রায় আধঘণ্টা। তার আগে চাই মিষ্টান্ন। ঘরে তৈরি পায়েস হোক বা দই, কিংবা দোকানের রসগোল্লা-সন্দেশ। একেবারে শেষ দিন পর্যন্ত এই নিয়ম ছিলো। বিজু মিষ্টি খেতে একেবারেই পছন্দ করে না, তার পছন্দ খুব ঝাল।
বিজু প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে লাইটার হাতে নেয়। বসার ঘরের টিভির পাশে কাচের স্লাইডিং ডোর, দরজায় লম্বালম্বি ব্লাইন্ড। ঝোলানো সরু রশি টেনে পর্দা সরিয়ে দেওয়ার মতো ব্লাইন্ড খানিকটা সরিয়ে ভারী স্লাইডিং দরজা ঠেলে বাইরের বারান্দায় এসে দরজাটা বন্ধ করে দেয়।
এ দেশে এই বারান্দার নাম প্যাটিও। বুকসমান উঁচু করে কাঠ দিয়ে ঘেরা, ওপরে ছাদ। বারান্দায় আলো জ্বালানো হয়নি, দরকার হয় না। কাচের দরজা দিয়ে বসার ঘরের আলো খানিকটা আসে। বাইরে একটু দূরে রাস্তার আলো। প্যাটিওর একপাশে গোটাকতক চেয়ার আর একটা গোলাকার টেবিল। প্লাস্টিকের, রোদবৃষ্টিতে এগুলোর কিছু হয় না। অন্য পাশে বারবিকিউ গ্রিল, ফুলটুসের ট্রাইসাইকেল, রাজ্যের বাতিল হয়ে যাওয়া খেলনা।
আর আছে রানুর শখের ছোটোবড়ো নানা আকারের টবে লাগানো প্ল্যান্ট। কোনো কোনোটা আবার শীত সহ্য করতে পারে না, তখন টেনে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখতে হয়। এই প্ল্যান্টগুলো নিয়ে রানু একটু মনে হয় বাড়াবাড়িই করে। একসময় এমন হলো, প্যাটিও আর বসার ঘর প্রায় পুরোটা প্ল্যান্টে আর টবে সয়লাব। পা ফেলারও জায়গা হয় না। বসার ঘরে টিভির ওপরে, সোফার ফাঁকে-ফোকরে, দেয়ালের ধার ঘেঁষে, এমনকী স্টিরিও সিস্টেমের দুই স্পীকারের ওপরেও দুটো টব বসে গেলো।
এক ছুটির দিনে দুপুরে রানু লিভিং রুমে বসে টিভি দেখছিলো। বিজুকে ঘুরঘুর করতে দেখে আদুরে গলায় বলে, আমার পাশে এসে একটু বসো না!
দাঁড়াও, আমার একটা ইমেল পাঠাতে হবে এক্ষুণি।
একটু পরেই না হয় করলে।
বিজু গম্ভীর মুখ করে রানুকে বলে, আমি লিভিং রুমে আজকাল কেন বেশিক্ষণ বসি না জানো?
রানু মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকায়। বিজু ঠাট্টা করছে কি না বোঝার চেষ্টা করে বোধহয়। বলে, না তো। কেন?
বিজু বলে, কিছুক্ষণ এ জায়গায় বসে থাকলে তুমি একটা টব এনে আমার মাথার ওপরে বসিয়ে দেবে, এই ভয়ে!
খুবই নির্দোষ, নিষ্কণ্টক হাসাহাসি হয়েছিলো খানিকক্ষণ। ইঙ্গিতটা রানু বুঝেছিলো। পরের উইকএন্ডে কিছু টব বসার ঘর থেকে বিদায় হলো। তবু এখনো নেহাত কম নেই। সকালে উঠেই রানু প্রথম প্ল্যান্টগুলোকে পানি খাওয়ায়।
বিজুর হঠাৎ মনে হয়, আচ্ছা প্ল্যান্ট শব্দটার বাংলা কী? গাছ বললে খুবই অবিচার করা হয়। গাছ বললে একটা শক্তপোক্ত ব্যাপার মনে আসে। লতা? লতা নিজে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, কোনোকিছুকে আশ্রয় করে লতিয়ে ওঠে। সব মিলিয়ে লতা জিনিসটার ভেতরে বেশ একটা কোমল নরম-সরম মেয়েলি ব্যাপার আছে। কিন্তু এগুলো টবে দিব্যি নিজের শক্তিতে দাঁড়িয়ে আছে। এগুলো মেয়েলি নয়? মানিপ্ল্যান্ট আবার লতাই। প্ল্যান্ট তাহলে দু’রকমেরই হতে পারে, লতা আবার শুধুই মেয়েলি।
বারান্দার পাশে তরুণ বয়সী একটা গাছ বেড়ে উঠছে। কী গাছ কে জানে! বিজু গাছপালা তেমন চেনে না। আম-কাঁঠালের গাছ চেনে। পাইন-ইউক্যালিপটাস না চেনার কোনো কারণ নেই। আর চেনে বটগাছ। ‘বটবৃক্ষের ছায়া যেমন রে...।’ বটবৃক্ষ না বললে ঠিক মানায় না, বটগাছ বললে তার বিশাল বিস্তৃতি বোঝা যায় না।
কোনো কোনো জিনিসকে অনেক সময় চলতি নামে বললে বেড় পাওয়া কঠিন হয়। একবার নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে যাওয়া হয়েছিলো। ফুলটুস তখনো পানিকে মাম বলে। যে কোনো বিখ্যাত ও দর্শনীয় জায়গায় যাওয়ার ব্যাপারে বিজুর এক ধরনের বিরাগ আছে, পরে মনে হবে কী হতো না দেখলে? জলপ্রপাত কখনো দেখা ছিলো না। আগ্রহও খুব একটা ছিলো না - অনেক উঁচু একটা জায়গা থেকে নিচে সশব্দে পানি পড়ছে, এই তো, এর মধ্যে আর দেখার কী হলো!
কিন্তু নায়াগ্রার প্রপাতের সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধতা গোপন রাখা অসম্ভব। কী অবিশ্বাস্য, বিশাল ও আশ্চর্য সেই সুন্দর! এ জিনিসকে তো মাম বা পানি বা জল বললে যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। জলরাশি বললেও হালকা লাগে। জলধি বরং খানিকটা মানায়, কিন্তু অভিধানে তার অন্য অর্থ লেখা আছে।
সিগারেট ধরিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে বিজু। রানু আসবে নাকি? একসময় রাতের খাওয়ার পরে দু’কাপ চা নিয়ে দু’জনে এসে বসা হতো আধো অন্ধকার প্যাটিওতে। শীতের সময় অবশ্য বাইরে বসা যায় না, তখন বসার ঘরে। খুব শীতে চায়ের বদলে কফি, ঠাণ্ডায় কফিটা জমে ভালো।
বিজু আজকাল চা-কফিতে দুধ-চিনি কোনোটাই নেয় না। প্রথমে দুধ ছেড়েছে, তারপরে চিনি। প্রথম প্রথম বিস্বাদ লাগতো, এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। রানুর সঙ্গে সম্পর্কের মতোই? একটা-দুটো করে মধুর-সুন্দর ব্যাপারগুলো ঝরে যেতে শুরু করেছে। যতো অনিচ্ছায় হোক, হয়েছে তো। চূড়ান্ত সিনিকের মতো কখনো কখনো বিজু ভাবে, এই ভালোবাসাবাসি আসলে চুইংগামের মতো - প্রথম প্রথম ভারি মিষ্টি, তারপর একসময় স্বাদ চলে যেতে থাকে, চলে যায়ও, যেহেতু নিয়তিই চলে যাওয়া, তখন শুধু অভ্যাসবশে চিবিয়ে যাও যতোক্ষণ না ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার সুযোগ ঘটছে!
ঘাড় ঘুরিয়ে বসার ঘরে তাকায় বিজু, রানুকে দেখা যায় না। হয়তো রান্নাঘরে কিছু একটা করছে। চা বানাতে গেছে? বিজু সিগারেটে মন দেয়। শেষ হওয়ার পরও খানিকক্ষণ বসে থাকে। তখনো আশা থাকে, যদি রানু আসে চা নিয়ে। আসে না, আসবে তার কোনো লক্ষণও নেই। উঠে পড়ে বিজু।
শরৎকালের শুরু থেকে সন্ধ্যার পরে একটু শীত শীত করে, শেষরাতে ঘুমের মধ্যে কম্বল খুঁজতে হয়। বাংলাদেশের মতো এদের শরৎ-হেমন্ত ঋতু আলাদা করা নেই, একত্রিত হয়ে গেছে ফল নামে। স্কুলে পড়ার সময় শরৎকালের ইংরেজি অটাম শিখেছিলো। এ দেশে এসে শিখলো, ফল। ফল-এর একটা অর্থ তো হয় পতন। প্রেমে নিপতিত হলে ফলিং ইন লাভ। প্রেমের অন্তর্ধানও তো এক রকমের পতন, তখন কী বলা হবে? ফল ফ্রম গ্রেস? স্বর্গ হইতে বিদায়?
দ্বিতীয় কিস্তিতে সমাপ্য
Tuesday, October 23, 2007
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment