Saturday, October 27, 2007

প্রথম ও তৃতীয় বিশ্ব একাকার

২০০৪ সালে আমেরিকায় জর্জ বুশ দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। সেই সময়ের একটি কৌতুক এরকম :

২০০৫-এর এক সকালে প্রৌঢ় একজন ভদ্রলোক হোয়াইট হাউসের সদর দরজায় উপস্থিত। সিকিউরিটির একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, আপনার জন্যে আমি কী করতে পারি, মহাশয়?

প্রৌঢ় বললেন, আমি প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।

প্রহরী সবিনয়ে বললো, আমি দুঃখিত, কিন্তু বুশ সাহেব তো এখন আর হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা নন। আপনি কি বর্তমান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাত করতে ইচ্ছুক?

প্রৌঢ় কোনো উত্তর না দিয়ে চলে গেলেন।

পরদিন প্রৌঢ় আবার এসেছেন একই অনুরোধ নিয়ে, প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

প্রহরীও একই উত্তর দেয়, বুশ সাহেব এখন আর হোয়াইট হাউসে বাস করেন না।

প্রৌঢ় চলে গেলেন। আবার এলেন পরদিন, আমি প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

প্রহরী বিনীতভাবে বললো, কৌতূহল প্রকাশের জন্যে ক্ষমা করবেন মহাশয়, কিন্তু আপনি গত দু'দিনও এসেছিলেন একই আর্জি নিয়ে। আমি তো আপনাকে বলেছি, বুশ সাহেব আর হোয়াইট হাউসে বাস করেন না, তিনি এখন আর আমাদের প্রেসিডেন্ট নন।

প্রৌঢ় মুচকি হেসে বললেন, আঃ, তোমার এই কথাটিই আমি বারবার শুনতে আসি। শুনতে কী যে ভালো লাগে!

আমরা জানি, গল্পে বর্ণিত বাসনা পূর্ণ হয়নি। অনেক উত্তর-না-পাওয়া প্রশ্নের জন্ম দিয়ে এবং আমেরিকান জনগণের বুদ্ধি-বিবেচনার নমুনা দেখাতেই বুশ দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়েছিলেন।

সেই সময়ে আমার এক সহকর্মী ছিলো ভারতের বিহার রাজ্যের জৈনেন্দ্র কুমার শর্মা, আমেরিকায় জে. কে. নামে সে পরিচিত। বুশের প্রবল সমালোচক জে. কে.। নির্বাচনের ফলাফলে সে খুবই মুষড়ে পড়েছিলো। কাজকর্ম ফেলে সারাক্ষণ তার হতাশার কথা বলে।

একদিন তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে বললাম, বুশের জয়ে কিন্তু তোমার খুশি হওয়ারও কারণ আছে।

উত্তেজিত হয় জে. কে.। হয়তো ভাবে তাকে নিয়ে ঠাট্টা করছি। বিরক্ত হয়ে বলে, তোমার মাথা খারাপ? এর মধ্যে তুমি খুশি দেখছো কোথায়?

বললাম, দেখো, বুশ জিতে যাওয়ার ফলে আরো চারৰছর ধরে বুশ-সংক্রান্ত অসংখ্য কৌতুক শোনার সুযোগ তৈরি হলো। হেরে গেলে তো আর তা হতো না!

বুঝতে জে. কে. একটু সময় নেয়। আস্তে আস্তে তার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠতে দেখি। মাথা ঝাঁকায় সে। বলে, ঠিক ঠিক, এটা তো ভাবিনি!

ঘটনাটি মনে পড়লো ইরাক নিয়ে জর্জ বুশের দুরবস্থা দেখে ('চরমপত্রে' এম. আর. আখতার মুকুল বর্ণিত 'প্যাঁকে পড়া' অবস্থা, 'এক্কেরে ছ্যারাব্যারা')। একের পর এক মিথ্যাচার করে সারা পৃথিবীর মানুষকে বোকা বানিয়ে ইরাক আক্রমণের সিদ্ধান্ত ছিলো বুশের একতরফা। হয়তো ধারণা ছিলো, কী আর এমন, এ তো ডালভাত (অনুবাদে 'পিস অব কেক')। সাদ্দামকে নামিয়ে ফেলতে পারলেই হয়ে গেলো! আমাদের অনেকের মনে পড়তে পারে, ৬৫-র যুদ্ধে পাকিস্তানের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা দিয়েছিলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভারতের পরাজয় ঘটবে এবং তিনি দিল্লীতে বসে চা খাবেন!

দিল্লীতে চা খাওয়া ভুট্টোর হয়নি। আর সাম্প্রতিক ইতিহাসে ব্যাপকতম বোমবর্ষণ করে ইরাককে ছিন্নভিন্ন করে, অকাতরে নিরীহ মানুষকে হত্যা করে দুই মাসের মধ্যে 'মিশন অ্যাকমপ্লিশড' বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন বুশ। এই তো সেদিন ইরাক আগ্রাসনের তিন বছরপূর্তি হয়ে গেলো, কর্ম সম্পাদন হওয়া দূরের কথা, আড়াই হাজারের কাছাকাছি মার্কিন সৈন্য নিহত হওয়ার পর এখন আমেরিকার মানুষের উপলব্ধি পাল্টে গেছে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, বুশের নেতৃত্ব অনুমোদন করে মাত্র ৩৭ শতাংশ মানুষ, অথচ ইরাক যুদ্ধের সূচনায় তা ছিলো ৮০-র কাছাকাছি। মুখে স্বীকার করা সম্ভব নয়, কিন্তু এখন বুশ নিজেও জানেন, ইরাক আসলে হয়ে গেছে 'মিশন ইমপসিবল'। চিনি-মোড়া কথাবার্তা দিয়ে যা-ই বোঝানো হোক, ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে যে আমেরিকা আসলে ইরাক থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ বা অজুহাত সন্ধান করছে। ইরানকে হুমকি-ধামকিও তারই অংশ বলে মনে করা চলে। ইরাক বুশের একমাত্র সমস্যা নয়, অভ্যন্তরীণ অনেক বিষয় নিয়েও অনেক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে বুশ প্রশাসন। ল্যাজে-গোবরে হয়ে এখন বুশ এবং সাঙ্গপাঙ্গরা মিডিয়াকে দুষতে শুরু করেছেন। বলা হচ্ছে, মিডিয়া ইরাক যুদ্ধ নিয়ে ভুল প্রচার করে সর্বনাশ করে দিচ্ছে।

কী আশ্চর্য, এই ধরনের কথা আমরা তৃতীয় বিশ্বের কোথায় যেন খুব সম্প্রতিই শুনেছি বলে মনে পড়ছে। শুনেছি বিদ্যুৎ সংকট, সার বা জ্বালানি তেলের ঘাটতি, এমনকি জঙ্গিদের উত্থানের জন্যেও মিডিয়া দায়ী!

বাক, ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দেশ আমেরিকায় কিছুকাল আগে জুডিথ মিলার নামে এক সাংবাদিককে কয়েকমাস কারাবাস করতে হলো। কারণ? জুডিথ তাঁর একটি রিপোর্টের সূত্র আদালতে প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছিলেন। তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্গত আমাদের চেনা একটি দেশের কথা আবার মনে পড়ে যাচ্ছে কি?

সম্প্রতি প্রকাশ পেয়ে গেছে, বুশ প্রশাসন সিনেট-কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে সবার অগোচরে ফোনে আড়ি পাতার কর্মসূচী নেয়। অজুহাত? সন্ত্রাস-বিরোধী তৎপরতার একটি অংশ হিসেবে এটি করা হয় এবং বুশ সাহেব জোর গলায় এর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। এই নিয়ে হৈ চৈ এখনো চালু আছে।

আমাদের পরিচিত তৃতীয় বিশ্বের দেশটিতেও সম্প্রতি আড়িপাতা চালু হয়েছে। বলা হয়েছে, রাষ্ট্র ও সমাজবিরোধী (পড়তে হবে সরকারবিরোধী) তৎপরতা রোধের জন্যে এই নিয়মটি জরুরি।

হায়, প্রথম বিশ্বের এতো যে অহংকার, তার কী হবে? প্রথম ও তৃতীয় বিশ্বের (দ্বিতীয়টি কোথায়?) মধ্যে পার্থক্য কতোই সামান্য!

-----------------
মার্চ ২০০৬
-----------------

No comments: