বাংলা ভাষায় স্বতঃসিদ্ধ বলে একটি শব্দ আছে, যার সঙ্গে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। অভিধানে শব্দটির অর্থ দেওয়া আছে এইভাবে : যাহার সত্যতা বিনা প্রমাণে উপলব্ধ হয়। বাল্যকালে স্কুলে এই ধরনের কিছু উদাহরণ শেখানো হয়েছিলো মনে আছে। যেমন, সূর্য পূর্বদিকে উদিত হয়। প্রতি বছর এই সময়টিতে - আশ্বিন-কার্তিক মাসে উত্তরবঙ্গের কিছু অঞ্চল মঙ্গায় আক্রান্ত হবে, লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন থাকবে, অনাহারে দিনাতিপাত করবে এবং একসময় কিছু মানুষ ধরাধাম থেকে বিলীন হয়ে যাবে আমাদের চোখের সামনে। এই বাৎসরিক মঙ্গাও সেই অর্থে পুবগগনে সূর্যোদয়ের মতো স্বতঃসিদ্ধ হয়ে গেছে। সকালের সূর্যোদয়কে কেউ যেমন আলাদা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করে না, আমাদের দেশের সদাশয় সরকারও মঙ্গা বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার দরকার মনে করে না - জানা কথা, এ তো হবেই। মানুষ কষ্ট পাচ্ছে? তা পাক। মারা যাচ্ছে? যাক, কতো আর মরবে, আমরা আছি চোদ্দো কোটি। কাগজে এ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে? তা হোক, এ-ও একরকম স্বতঃসিদ্ধ যে, সাংবাদিকরা এসব লিখেই যাবে। আর কিছু করার ক্ষমতা তাদের নেই। তারা বানিয়ে বানিয়ে কতো কথা লেখে! কিছু মনে না করলেই হয়। মাঝে মাঝে ছেলেভোলানোর মতো বলে দিলেই হবে, খবরের কাগজওয়ালারা দিবাস্বপ্ন দেখে - নেই-জিনিসকেও দেখতে পায়। বাংলা ভাই নেই, দেশে জঙ্গী নেই, বোমা নেই - দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্যে সাংবাদিকদের এসব অমূলক প্রচার! সরকারি এই ভাষ্যও স্বতঃসিদ্ধ।
আমাদের দেশে প্রচুর স্বতঃসিদ্ধ বিষয় আছে, আমরা বছর বছর সময় হলেই সেগুলি দেখি। জুন মাসের শেষে সংসদে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা শেষ না হতেই বিরোধীদলের প্রতিক্রিয়া সংবাদপত্রে পৌঁছে যায় - এই বাজেট গণবিরোধী। যাচাই-বিশ্লেষণ? তার দরকার কী? আমরা তো জানিই, এ বাজেট গরিব মারার বাজেট। অন্যদিকে সরকার দলীয়রা এবং তাদের সমর্থকরা নামতা পড়বেন, এটি সর্বকালের সর্বসেরা জনকল্যাণমুখী বাজেট। আর আমরা জনগণ জানি, প্রতি বছর একই বিবৃতি শুধু সনতারিখ বদলে সংবাদপত্র অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
আরো আছে। বিরোধী দল সংসদে নির্বাচিত হবে সংসদ অধিবেশনে না যাওয়ার জন্যে, অথচ মাস গেলে বেতনভাতা ইত্যাদি নিতে বিবেকের কামড় তাঁরা টের পাবেন না। ক্ষমতাসীনরা ছাড়া আর কেউ দেশপ্রেমিক নয় এবং বিরোধীদল সর্বদাই ষড়যন্ত্রকারী ও গণতন্ত্রের দুশমন হিসেবে চিহ্নিত হবেই হবে। বিরোধী দলে থাকলে হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার, ক্ষমতায় গেলে সেই হরতালই নৈরাজ্যের লাইসেন্স। যতো জবরদস্তি হোক, জনতা যতোই বিরক্ত ও রুষ্ট হোক _ হরতাল সফল করার জন্যে দিনশেষে জনগণ ধন্যবাদ পাবে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পরদিন থেকে নির্বাচিত সরকার তাদের পতনের হুমকি পেতে থাকবে এবং হুমকিদাতারা সরকারি নিপীড়নের শিকার হতে থাকবে। যে যখন ক্ষমতায় যাবে, নিজেদের পছন্দের মানুষদের জামিন দিয়ে জেলমুক্ত করবে, ফাঁসির আসামী হলেও। রোজার মাস এলেই আহার্য ও ব্যবহার্য যাবতীয় জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে ক্রমাগত ব্যঙ্গ করবে। বৃহত্তম দুই দলের নেত্রীরা সাধারণ সৌজন্য বিনিময় দূরে থাক, মুখ দেখাদেখিও করবেন না। কল্পনা করা যাক, শেখ হাসিনা ফোন করে তারেক রহমানকে বলছেন, বাবা তারেক, বউ নিয়ে তো একদিনও খালার সঙ্গে দেখা করতে এলি না! অথবা খালেদা জিয়া যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসে ফ্লোরিডায় পুতুলকে ফোন করে বলছেন, এই মেয়ে, কবে তোর বাসায় যাবো? তোর মা তো বছর বছর তোর কাছে বেড়াতে যায়। আমি কি এতোই পর? জানিস, তোর আর আমার ডাকনাম এক?
রাজনৈতিক মতান্তর বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা যতোই থাক না কেন, এরকম মানবিক বাৎসল্য দেখানো কি খুবই অসম্ভব শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার পক্ষে? কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এঁরা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার অর্থ বোঝেন না, জানেন না রাজনীতির মত ও পথের পার্থক্য সামাজিকতার প্রতিবন্ধক হতে পারে না। তাঁরা বোঝেন পরস্পরকে সরাসরি শত্রুজ্ঞান করা। সুতরাং আমাদের কল্পনার দৃশ্যগুলি কখনোই অভিনীত হবে না, এ-ও আমরা স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নিতে পারি।
উত্তরবঙ্গে বাৎসরিক মঙ্গার কথা হচ্ছিলো। বাংলাদেশ ঝড়-বন্যার দেশ, সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ কখন কোথায় ছোবল দেবে তা আগে থেকে জানা যায় না। আবহাওয়া দপ্তরের সতর্কবাণী যখন আসে, তখন খুব বেশি সময় হাতে থাকে না। ফলে, তার জন্যে আগেভাগে প্রস্তুতি নেওয়া খানিকটা দুরূহ বটে। তবু যথাযথ প্রস্তুতি থাকলে এবং ত্রাণকর্ম ঠিকভাবে সমন্বয় করতে পারলে এসব দুর্যোগ সামাল দেওয়া যে খৃবই সম্ভব, তার নিকট ইতিহাস কিন্তু আমাদের আছে। কিন্তু মঙ্গা নামের এই উপদ্রবটি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে একটি নির্ধারিত সময়েই আসে। প্রতি বছরই আসে। ক্যালেন্ডারে যেমন জাতীয় ছুটির দিন চিহ্নিত থাকে, একইভাবে মঙ্গার দিনতারিখও চিহ্নিত করা সম্ভব। অথচ সরকারের বিভাগ ও মন্ত্রণালয়গুলো যথারীতি ঘুমন্ত থাকে। কাগজে মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশা ও মৃত্যুর কথা লেখালেখি করা হয়, কেউ কানেও তোলে না। এই উপলক্ষে স্থায়ী সমাধান ভাবার কথা বলা হয়, পরবর্তী বছরে আগাম প্রস্তুতির আশ্বাসও শোনা যায়। আগডুম-বাগডুম করে, সাহায্য আসছে এই আশ্বাসে কিছু সময়ক্ষেপণ করতে পারলে অগ্রহায়ণ-পৌষ এসে পড়ে, মঙ্গার কথা ভুলে যাওয়া তখন দুরূহ হয় না। দুঃখের কথা, আপাত-সংক্ষিপ্তকালের এই দুর্ভোগের যাঁরা ভুক্তভোগী, এই সময়টি তাঁদের জন্যে মোটেই সংক্ষিপ্ত নয়। অপুষ্ট শরীরে অনাহারে-অর্ধাহারে বা অখাদ্য খেয়ে কাটানোর পক্ষে দুই-তিন মাস বড়ো দীর্ঘ, দীর্ঘ সময়। ক'দিন আগে একটি কাগজে শিরোনাম দেখলাম, রমজান মাসে মঙ্গাপীড়িত মানুষগুলোর অনাহার ও রোজা একাকার হয়ে গেছে। ঠিক তার নিচেই ঢাকায় ঈদের বাজারে ফ্যাশনদুরস্ত দামি পোশাকের দোকানে ক্রেতাদের ভিড়ের খবর। সংবাদপত্রের দোষ নেই - পছন্দ হোক বা না হোক, সংবাদ পরিবেশন করাই তার কাজ। তবু মনে হয়, ঠিক যেন দুই ভিন্ন গ্রহের দুটি সংবাদ। হৃদয়বিদারক।
এই যে বছর বছর একই অঞ্চলে প্রায় দুর্ভিক্ষের অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে, তাকে অবহেলা বা উপেক্ষা করার এই রাজনীতি বা শাসননীতিটি কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? মানুষের অপরিসীম দুর্ভোগ, অনাহার, মৃত্যু - এর প্রতিকার ভাবা হয় না। পরিকল্পনা নেই, উদ্যোগ নেই। শাসকদের উদ্বেগ নেই। সহানুভূতি, তা-ও কি আছে? শুধু শাসকদের কথা কেন, বিরোধীদলগুলি ও তার নেতারা এই অভুক্ত মানুষগুলির জন্যে কী করলেন? খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন এইসব দুর্যোগে সরকারের অপেক্ষায় না থেকে রাজনৈতিক দলগুলি ত্রাণে নেমে পড়তো। এখন যা করা হয়, তা কাগজের বিবৃতি দিয়ে 'গভীর উদ্বেগ প্রকাশ'। নির্বাচনের সময় ভোটের জন্যে তাঁরা মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ধর্না দিতে পারেন, কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ ও ব্যয় করতে পারেন অনায়াসে, অথচ মানুষের দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারেন না - এটিই এখন বাস্তব সত্য। একটি সফল ত্রাণ অভিযান সংগঠিত করতে তাঁরা অক্ষম, এমন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। এবং তা সত্যি হলে আর আমাদের কী অবশিষ্ট থাকে?
অক্টোবর ২০০৫
Saturday, October 27, 2007
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment