Tuesday, October 23, 2007

একটি ব্লগবিতর্ক : আশরাফ রহমানের সংবিধানপ্রেম ও ভারতীয় জুজু

আশরাফ রহমানের ব্লগপাতায় কোরানের একটি উদ্ধৃতি বাংলায় (শিরোনামের বাইতুল হিকমার বাংলা করা যেতো না?) দেওয়া আছে: 'যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে?' মানছি, পারে না। এবং আমার প্রশ্নও সেখানেই। যারা জানে এবং যারা জানে না। এই দুইয়ের বাইরেও আরেকটি শ্রেণী আছে। আমি ধর্মকর্ম তেমন জানি না, তবে আমার ধারণা ধর্মগ্রন্থে এই শ্রেণীর কথাও কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই আছে। এই তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত মানুষেরা জানে না, কিন্তু জানার ভাণ করে থাকে। আশরাফ রহমানের লেখাপত্র থেকে তাঁকে এই তিন নম্বর শ্রেণীভুক্ত বলে প্রবল সন্দেহ হয়।

কয়েকদিন আগে এই জ্ঞানী ব্যক্তি 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আওয়ামী লীগ' শিরোনামে পোস্ট লিখেছেন। জানিয়ে রাখা দরকার আওয়ামী লীগের পক্ষ হয়ে কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ন্যাপ বা কমিউনিস্ট পার্টি (এমনকি দুর্ঘটনাক্রমে জামাত) হলেও আমার কথাগুলি অন্যরকম হতো না। পরিপ্রেক্ষিত না জেনে অথবা বিবেচনা না করে ঐতিহাসিক দলিলপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করা কিছু বিপজ্জনক বটে। আশরাফ রহমান আমার চেয়ে ভালো জানবেন যে কোরান শরীফের অনেক সুরার পেছনে কোনো বিশেষ ঘটনা বা পরিস্থিতি আছে, যাকে 'শানে নযুল' বলে আমরা জানি। আশরাফ রহমানের উল্লিখিত পোস্টটির নাজেল হওয়ার শানে নযুল আমার জানা নেই, কিন্তু তা হয় অজ্ঞতাপ্রসূত অথবা উদ্দেশ্যমূলক (সদুদ্দেশ্য মনে করার কোনো কারণ নেই)। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ঘটনার প্রেক্ষাপট আড়ালে রেখে (এ ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত বলে সন্দেহ করি) একটি ঐতিহাসিক দলিলের উদ্ধৃতি কোনো উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার কাজে লাগানো চলে। বারংবার বলা হলে বিশ্বাসীর মনেও সংশয় জাগতে পারে।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের এক আম্রকাননে (আশরাফ রহমান বলেছেন 'কুষ্টিয়ার আম্রকানন', এই নামে কোনো জায়গা আছে বলে জানা নেই) নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও নীতি সম্পর্কে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তাতে 'সাম্য', 'মানবিক মর্যাদা' ও 'সামাজিক ন্যায়বিচার' প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিলো। আশরাফ রহমানের আপত্তি, এগুলি ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানে স্থান পায়নি কেন। তার বদলে সংবিধানে 'ভারতের স্বার্থ রক্ষার জন্যে' রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় 'সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ইত্যাদি' (হায় আশরাফ রহমান, চতুর্থটি ছিলো জাতীয়তাবাদ তা-ও আপনার জানা নেই, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে চেপে গেলেন আপনার উদ্দেশ্যের সঙ্গে খাপ খায় না বলে?)।

প্রথমেই জিজ্ঞাসা করা দরকার, 'সাংবাদিক' (কিসের কে জানে, এখনো খোলাসা হয়নি, কেউ জানালে খুশি হবো) হিসেবে আশরাফ রহমানের নিশ্চয়ই জানা আছে, যুদ্ধকালীন সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের একটি ঘোষণা ও সংবিধানের ঘোষণার মধ্যে পার্থক্য কি। পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করা অবশ্যই দরকারি। ২৫ মার্চে পাকিস্তানী সেনাদের অতর্কিত আক্রমণের মুখে বাঙালি নেতৃত্ব তখন ছত্রখান (এই পরিস্থিতির জন্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কতোটা প্রস্তুতি নিয়েছিলেন বা নেননি তা আলাদা বিতর্কের বিষয়, এখানে প্রাসঙ্গিক মনে করি না), এই বাস্তব অবস্থাটি বিবেচনায় আনতে হবে। ২৫ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল, ব্যবধান মাত্র ১৫ দিনের। এই স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতে দেওয়া ঘোষণাটি অন্তর্বর্তীকালীন, তা মনে রাখতে হবে। তখন সারা পৃথিবীর কাছে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্তিত্বের প্রমাণ দেওয়াটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। এই ঘোষণায় ঠিক তাই করা হয়েছিলো বলে মনে করার কারণ আছে।

১০ এপ্রিল দেওয়া ঘোষণার সঙ্গে ১৯৭২-এর সংবিধানে ঘোষিত রাষ্ট্রনীতির খুব বিশাল বিরোধ আছে বলেও তো মনে হয় না। 'সাম্য', 'মানবিক মর্যাদা' ও 'সামাজিক ন্যায়বিচার'-এর পরিবর্তে 'গণতন্ত্র', 'সমাজতন্ত্র', 'ধর্মনিরপেক্ষতা ও 'জাতীয়তাবাদ'। তাহলে আশরাফ রহমানের হা-হুতাশ কেন? কারণ তা নাকি ভারতের রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে মিলে যায়। তা এই নীতিগুলি কি ভারতের এজমালি সম্পত্তি যা অন্য কোনো রাষ্ট্রের আদর্শ হতে পারবে না? অথবা হলে তা ভারতপন্থী বলে ধরে নিতে হবে? যুক্তি বটে! সন্দেহ করি, ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়েই তাঁর আসল মাথ্যব্যথা।

আওয়ামী লীগ যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে (সে আদর্শে এখন তারা কতোটা বিশ্বস্ত তা নিশ্চয়ই প্রশ্নসাপেক্ষ), সেই অধিকারটি তারা ঐতিহাসিকভাবে অর্জন করে বসে আছে। ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব তাদের হাতে ছিলো, তারা যুদ্ধ সংগঠিত ও পরিচালনা করেছে (অবশ্যই এককভাবে নয়) এবং তাকে একটি সফল পরিণতি দিতে সক্ষম হয়েছে এইসব অস্বীকার করতে পারলে অনেকে খুশি হবেন। কিন্তু ইতিহাসের বাস্তবতা খণ্ডানো যাবে কীভাবে? কোন যুক্তিতে?

এখন বৃহত্তর বা বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতের কথা বলা যাক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এইচ. জি. ওয়েলস 'দ্য আউটলাইন অব হিস্ট্রি' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ওয়েলস-এর উদ্দেশ্য ছিলো ইউরোপীয় ইতিহাসের একটি দলিল প্রস্তুত করা। লিখতে গিয়ে দেখলেন, পৃথিবীর অবশিষ্ট অংশকে বাদ দিয়ে ইউরোপের ইতিহাস লেখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তাঁকে পৃথিবীর ইতিহাসই লিখতে হলো। এই উদাহরণটি মনে রাখলে বোঝা যাবে, পৃথিবীর কোনো দেশ বা সমাজ এবং তার কোনো বিপ্লব-আন্দোলন-উত্থান-পতনের ঘটনা স্বয়ম্ভু নয়। শীর্ষেন্দুর একটি লেখায় এরকম একটি লাইন ছিলো বলে মনে পড়ছে: 'দূরে কোথাও যুদ্ধ হলে আমাদের চায়ে চিনি কম পড়ে।' এই বোধ সবার থাকে না।

১৯৭১-এ বিশ্ব পরিস্থিতি এখনকার মতো আমেরিকা-নির্ভর একমুখী ছিলো না। সমান্তরালে দাঁড়িয়ে ছিলো সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব। এই দুই পরাশক্তির ইচ্ছা বা সমর্থন ছাড়া একটি নতুন জাতিরাষ্ট্রের উত্থান তখন কল্পনার অতীত। ইতিহাস এই সাক্ষ্য অবশ্যই দেয় যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিণতি অত্যন্ত দুরূহ, এমনকি অসম্ভব ছিলো। ভারত সমাজতান্ত্রিক দেশ না হলেও তাদের ঝোঁকটা ছিলো সেদিকেই, যা ৮৪ সালে ইনদিরা গান্ধীর মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। সুতরাং যে ভারত বা সামাজতান্ত্রিক শক্তি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তা দিয়েছিলো, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে তারা তাদের ইচ্ছা ও আদর্শের প্রতিফলন আমাদের মধ্যে দেখতে চাইবে তা খুব অপ্রত্যাশিত নয়।

সেই সময়ের বাংলাদেশের মানুষেরা এ-ও সাক্ষ্য দেবেন যে মুক্তিযুদ্ধপরবর্তীকালে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের (যাঁরা সাধারণভাবে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনের দিকনির্দেশকের ভূমিকায় থাকেন) প্রবণতা প্রবলভাবে সমাজতন্ত্রমুখী ছিলো। এঁদের সবাই ভারতপন্থী ছিলেন, এ কথা কোনো পাগলেও বলবে না। এমনকি অনেকে মানতে না চাইলেও বলা দরকার, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ ভারতঘেঁষা, এ-ও এক ধরনের কল্পিত ও প্রচারিত কেচ্ছা।

১৯৭২ সালের বাস্তবতায় এই সমাজতান্ত্রিক বলয়ের বাইরে যাওয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র, যুদ্ধপীড়িত ও দরিদ্র দেশের থাকার কথা নয়। আজ এই ২০০৭ সালেও নেই। এখন সমাজতন্ত্র নেই, আছে একক শক্তি আমেরিকা ও তার ইচ্ছাধীন বিশ্বব্যাংক-এনজিওনির্ভর বিশ্বায়নের দামামা। এদের ইচ্ছার বাইরে আমাদের একটি পা-ও ফেলার উপায় নেই।

আশরাফ রহমান ৭২-এর সংবিধানে ভারতের স্বার্থরক্ষার কথা বলেছেন, তার দায় আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। যদি তা মেনে নেই, তারপরেও কথা থাকে। সেই আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পরে ৩৬ বছরে দেশের শাসনক্ষমতায় ছিলো দুই দফায় সাকুল্যে সাড়ে আট বছর। বাকি সাড়ে সাতাশ বছর দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা যাঁরা ছিলেন, তাঁরা ঘোষিতভাবে ভারতবিরোধী। তারপরেও আজ বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্য ও সংস্কৃতির অবাধ বিচরণক্ষেত্র হয়ে উঠলো কী প্রকারে? তাঁরা তাহলে কার স্বার্থ রক্ষা করছিলেন বা করছেন?

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে দেওয়া একটি ঘোষণার সঙ্গে সংবিধানের রাষ্ট্রনীতি (সেই সময়ে অধিকাংশ মানুষ যা মেনে নিয়েছিলেন) বিষয়ে আশরাফ রহমান খুব বিচলিত। অথচ পরবর্তীকালে সংবিধানটিকে ইচ্ছামতো জবাই করে যে ভোজ-উৎসব হলো, তা কার স্বার্থ রক্ষা করেছে? উত্তরটি আমরা জানি। আশরাফ রহমান এ বিষয়ে তাঁর বিজ্ঞ মতামত অচিরেই দেবেন আশা করছি।

----------------------------------------------

আশরাফ রহমানের প্রতিক্রিয়া


মুহাম্মদ জুবায়েরঃ

১. আপনি আমার ব্লগের টাইটেল (বায়তুল হিকমাহ) নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। শব্দটি আরবী হওয়ায় আপনার যে খুব কষ্ট লেগেছে তা বেশ অনুভব করলাম। আপনি যদি বায়তুল হিকমাহ শব্দটির অর্থ ও ইতিহাস জানতেন তাহলে কোন আপত্তি হয়ত করতেন না। এই মানসিকতা নিয়ে আপনি মুহাম্মদ জুবায়ের নাম নিয়ে ব্লগে এসেছেন কেন? আপনি বললেন, কুরআনের উল্লিখিত আয়াতের বাইরেও একটি শ্রেণী আছে এবং ধর্মগ্রন্থের কোথাও না কোথাও অবশ্যই আছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন 'অবশ্যই' শব্দটি তখনই ব্যবহার করা উচিত যখন বিষয়টি সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত। এখন আপনিই বলুন,কেবলমাত্র সন্দেহ করে ধর্মগ্রন্থের দোহাই দিয়ে আমাকে আপনার কথিত তৃতীয় শ্রেণীতে ফেলা কি ঠিক হলো?

২. আপনি আমার পোস্টটিকে অজ্ঞতাসূলভ নাকি উদ্দেশ্যমূলক তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আপনি সংশ্লিষ্ট পোষ্টেই এ প্রশ্নটি করতে পারতেন। কিন্তু তা যেহেতু করেন নি তাই বলছি, পোস্টটি ছিল উদ্দেশ্যমূলক। আমার উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনাকে পাঠকদের কাছে তুলে ধরা এবং প্রকৃত ইতিহাস থেকে যারা মানুষদের দুরে রেখেছে তাদের পরিচয় তুলে ধরা। পোস্টে আমার জিজ্ঞাসা ছিল-কেন প্রবাসী সরকারের প্রস্তাবনাগুলোকে সংবিধানে উল্লেখ করা হয় নি? এক্ষেত্রে আমি ফ্রান্সের উদাহরণ তুলে ধরেছিলাম। (ফরাসী বিপ্লবের প্রস্তাবনাগুলো সেদেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। )

৩. বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মুলনীতি চারটি জায়গায় তিনটি উল্লেখ করার পর ইত্যাদি লেখাতে- আপনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে আমি চতুর্থটি জানি কিনা? আপনার মতো একজন সচেতন নাগরিক নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, আমাদের দেশের কাস সিক্সের একজন ছাত্রও এ বিষয়টি জানে। তবে আমি বিস্মিত হলাম আপনার জ্ঞানের বহর দেখে । আপনি বললেন, চতুর্থ মুলনীতিটি ছিল 'জাতীয়তাবাদ'! আপনার সহযোদ্ধাদের কাছে জিজ্ঞেস করুন তো সেটি কি 'জাতীয়তাবাদ' না 'বাঙালী জাতীয়তাবাদ'?

৪. আপনি স্বল্প সময়ের মধ্যে তৈরী প্রবাসী সরকারের প্রস্তাবনাগুলো যৌক্তিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন। ? আপনি কি মনে করেন ,মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে নেয়া প্রস্তাবনাটি সঠিক ছিল না?

৫. ৭২ এর সংবিধানে অন্তভর্ূক্ত রাষ্ট্রীয় মুলনীতিগুলো যে ভারতের পরামর্শে করা হয়েছিল এব্যাপারে আমি ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য পোস্টে উল্লেখ করেছিলাম। কিন্তু আপনি সে ব্যাপারে কোন আপত্তি তুলেন নি। কিন্তু আমার পোস্টটির লিংক দিয়ে সৎ সাহস দেখাননি। এব্যাপারে আপনার আরো জানা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এজন্য আপনি মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের 'অরতি স্বাধীনতাই পরাধীনতা' বইটি পড়তে পারেন।

৬ . রাজনৈতিক সচেতন একজন মানুষ হিসেবে আপনি নিশ্চয়ই মানেন যে, ধর্মনিরপেবাদ, সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্র পরস্পরের বিপরীতধমর্মী মতবাদ। একটি দেশের জন্য একটি মতবাদই যথেষ্ট । কিন্তু তা না করে কেন ভারতের গৃহীত মতবাদগুলো গ্রহণ করা হলো? ভারতে বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষার লোকজন বাস করে। কিন্তু আমাদের দেশে এ সমস্যা নেই বললেই চলে। সুতরাং এ মতবাদগুলো আমাদের দেশের জন্য কতটুকু যৌক্তিক হয়েছে তা নিয়ে চিন্তা করা উচিত ছিল।

৭. বাংলাদেশের সংবিধানকে যারা হত্যা করেছে তা এ জাতি ভাল করেই জানে। গণতন্ত্রকে কবর দিয়েছিল কারা, কারা বাক স্বাধীনতাকে হরণ করেছিল, কারা আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধ করে বাকশাল কায়েম করেছিল তাও জাতি জানে। সুতরাং গণতন্ত্রের কথা অন্তত আওয়ামীলীগারদের মুখে মানায় না।

৮. জুবায়ের সাহেব, বলুন তো যে চেতনার মাধ্যমে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি সে চেতনাকে সংবিধানে অন্তর্ভক্ত না করায় আওয়ামীলীগের সমালোচনা করা কি অন্যায় হয়েছে? যদি তাই হয় তাহলে তো আমাদের সবকিছু ৭২ থেকে শুরু করতে হবে। ( আসলেই তাই কারণ স্বাধীনতার যুদ্ধে সময় তো শেখ মুজিব ও তার পরিবার পরিজন ময়দানে ছিলেন না। তাই ২৬ শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বরের আগে মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে দেশ স্বাধীন করলো সে ইতিহাস তাদের না জানাই ভাল)


-------------------------------------------

আশরাফ রহমানের প্রতিক্রিয়ার জবাব


আশরাফ রহমান,

শুরুতেই বলে নেওয়া দরকার, আপনার মতামত আমার পছন্দ না হতে পারে, আপনার নামটি কিন্তু আমি সঠিকভাবে লিখেছি। আপনি আমার নাম লিখেছেন অশুদ্ধভাবে, মুহম্মদ অংশে একটি অনাবশ্যক আ-কার জুড়ে দিয়েছেন। যা নেই তা আপনারা দেখতে পাবেন এবং যা আছে তাকে নির্বিচারে অস্বীকার করবেন অথবা নিজের পছন্দমতো দেখবেন, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

আপনার মন্তব্যের ক্রম ঠিক রেখে আমার প্রতিক্রিয়াগুলি এরকম:

১. আপনার ব্লগ শিরোনাম 'বায়তুল হিকমাহ' নিয়ে আমি আপত্তি করিনি, শুধু বলেছি এটিও বাংলায় হতে পারতো কিনা। আরবি ভাষার জন্যে আলাদাভাবে কোনো অনুরাগ-বিরাগ আমার নেই। আপনার থাকতেই পারে। আমি শুধু বলেছিলাম শিরোনামটি বাংলায় হলে আমি বুঝতে পারতাম। বায়তুল হিকমাহ শব্দের অর্থ ও ইতিহাসে আমার মত পরিবর্তিত হতো না। তবে আমার এই মানসিকতার সঙ্গে আমার নামটি কীভাবে যেন আপনি গুলিয়ে ফেললেন কে জানে। নামটি আমার রাখা নয়, নিয়ম অনুযায়ী আমার বাবা-মা তা রেখেছিলেন। আমি তার ইচ্ছুক বা অনিচ্ছুক বাহক মাত্র। আমার নাম মুহম্মদ জুবায়ের বলে আমি আরবি ভাষার অনুরক্ত হবো, তা আশা করা খুব যুক্তিযুক্ত বলে মনে করি না। এই অযাচিত মন্তব্যে আপনার মানসিকতার পরিচয় অবশ্য পাওয়া গেলো। আমার কথিত তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত হওয়ার উপযুক্ত মানুষ আপনি, তা-ও তো প্রমাণিত।

২. আপনার পোস্টের উত্তর সংশ্লিষ্ট পোস্টে না দিয়ে আলাদা লেখার কারণগুলো এরকম: প্রথমত, বিষয়টি নিয়ে যা বলতে চেয়েছি তা দীর্ঘ হতো এবং পোস্টের উত্তর হিসেবে যা বেমানান বলে বিবেচনা করেছি। দ্বিতীয়ত, আমার কমপিউটারের সমস্যার কারণে ওই সময়ে লেখা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

আপনার পোস্টটি যে উদ্দেশ্যমূলক ছিলো তা স্বীকার করার জন্যে ধন্যবাদ জানিয়েও বলতে হচ্ছে উদ্দেশ্য যা বলেছেন তা সত্য ঢাকার মুখোশ হিসেবে চলতে পারে, মুখ নয়। আমি কোনো মুখোশকে বিশ্বাস করতে প্রস্তুত বা সম্মত নই। আপনি স্বীকার করবেন না জানি, তবু বলি আপনার উদ্দেশ্য আর যাই হোক মুক্তিযুদ্ধের ধারণা বা চেতনা তুলে ধরা নয়।

আমার পোস্টে আমি বলেছিলাম, '১০ এপ্রিল দেওয়া ঘোষণার সঙ্গে ৭২-এর সংবিধানে ঘোষিত রাষ্ট্রনীতির খুব বিশাল বিরোধ আছে বলেও তো মনে হয় না। 'সাম্য', 'মানবিক মর্যাদা' ও 'সামাজিক ন্যায়বিচার'-এর পরিবর্তে 'গণতন্ত্র', 'সমাজতন্ত্র', 'ধর্মনিরপেক্ষতা ও 'জাতীয়তাবাদ'।' এই বিষয়ে আপনার বিজ্ঞ মন্তব্য কিন্তু পাওয়া গেলো না। যুদ্ধকালীন প্রস্তাবনা ও উত্তরকালে রচিত সংবিধান আলাদা হলে কী দোষ ঘটে তা আপনি পরিষ্কার করেননি। আপনি ঘুরেফিরে ফ্রান্সের উদাহরণ টেনেছেন। কিন্তু ভারত বা ফ্রান্স দুটোই আমার কাছে পরদেশ। ভারত আমার আদর্শস্থানীয় না হলে ফ্রান্স হবে, তারও তো কোনো যুক্তি দেখছি না। আর ফ্রান্স যা করেছিলো সারা পৃথিবী কি তা অনুসরণ করেছে?

আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে যে কথাগুলি বলেছি তা-ও আপনি বেশ সুবিধাজনকভাবে পাশ কাটিয়ে গেলেন।

৩. যতোদূর জানি, ৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতির একটি ছিলো জাতীয়তাবাদ। আপনার কথিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ হলেও তো দোষের কিছু দেখছি না। বাংলাদেশীতে রূপান্তরিত হওয়ার আগে আমাদের পরিচয় বাঙালিই ছিলো। তা অবশ্য আপনার জন্মের আগের কথা, জানা না থাকলে তার জন্যে নিশ্চয়ই আপনি দায়ী নন। কী বলেন?

৪. ১০ এপ্রিলের প্রস্তাবনাটি সঠিক না বেঠিক ছিলো, সে বিষয়ে মন্তব্য আমার পোস্টে আছে। ওপরেও বলেছি, আবারও বলছি, সেই ঘোষণার সঙ্গে ৭২-এর সংবিধানের কোনো ব্যাপক বিরোধ আমি দেখি না। আপনি কী কী বিরোধ দেখছেন তার ব্যাখ্যা কোথাও পাওয়া গেলো না।

৫. ভারতের সংসদে ইন্দিরা গান্ধী যা বলেছিলেন তা নিয়ে কী বলার থাকতে পারে? ৭২-এর সংবিধানে ভারতীয় পরামর্শের কথা যা বলেছেন, সে বিষয়েও আমার পোস্টে বলা আছে। আপনার দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আপনাকে শুধু পড়েই জানতে হবে। আমি বা আমার বয়সীরা তার প্রত্যক্ষদর্শীও বটে। এ বিষয়ে আমার পড়াশোনা কতোটা করা দরকার তা নিয়ে আপনার পরামর্শের প্রেক্ষিতে বলি, আমি আপনার উল্লিখিত বইটি (নামটি ভুল লিখেছেন) পড়িনি এই ধারণা আপনার কোথা থেকে হলো? বরং আপনি মেজর জলিলের লেখার বাইরে কিছু পড়েছেন কিনা জানতে আমি খুবই আগ্রহী। মেজর জলিল হয়তো আপনার আদর্শস্থানীয় এ কারণেই যে পরবর্তীকালে এই ব্যক্তি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিপ্লব করতে গিয়েছিলেন এবং লক্ষ লক্ষ যুবকের জীবন নষ্ট করে শেষমেশ টুপি-রাজনীতিতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।

৬. সমাজতন্ত্রের সঙ্গে গণতন্ত্রের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বিরোধ আছে তা মানি, তবে ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে নেই। আর এই শেষেরটি নিয়েই যে আপনার আসল উদ্বেগ আমার পোস্টে তা আমি বলেছি। আর একাধিক রাষ্ট্রীয় আদর্শ থাকতে পারবে না, এই ধারণা কোথায় পেলেন? আপনার ভারতীয় জুজুর কথা আমার পোস্টের শিরোনামেই ছিলো, আপনি তা-ই প্রমাণ করলেন।

৭. বাংলাদেশের সংবিধান কাটাছেঁড়ার প্রসঙ্গে আমি কিন্তু কোনো দল বা ব্যক্তির কথা বলিনি। অথচ আপনি পূর্বধারণাপ্রসূত হয়ে ধরে নিয়েছেন আমি আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বলেছি। আমার পোস্টটি আবার ভালো করে পড়ে দেখবেন।

৮. আপনার কথিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জিনিসটি কী একটু ব্যাখ্যা করবেন? সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের কোন আকাঙ্ক্ষাটি উপেক্ষিত হয়েছে, সে বিষয়ে আপনি বললে বুঝতে সুবিধা হয়। আর শেখ মুজিব যুদ্ধের ময়দানে কেন ছিলেন না, তা আমরা সবাই জানি। আপনি এ নিয়ে কুতর্কে যেতে চাইলেও আমার তাতে রুচি নেই। শেখ মুজিবের পরিবারের কেউ যুদ্ধে ছিলেন না, তা-ও সত্য নয়। আপনি যথারীতি সত্য গোপন করছেন। জেনেশুনে।

No comments: