ফোন এসেছে। কেউ একজন সাঈদকে চায়। আসাদ মোটামুটি অনুমান করেছে, তবু জিজ্ঞেস করে, কোন সাঈদ? এ বাসায় দু’জন সাঈদ আছে।
সৈয়দ আসাদুল আলমের খোঁজে ফোন করা হয়েছে জেনে অকম্পিত গলায় বলে দেয়, এই মুহূর্তে সে এখানে নেই। কোনো মেসেজ থাকলে বলো, ফিরলে জানিয়ে দেবো।
ওপাশ থেকে মহিলা নিজের নাম-পরিচয় ঘোষণা করে, কোন প্রতিষ্ঠানের হয়ে ফোন করা হচ্ছে তা-ও জানায়। তারপর সামান্য বিরক্তি-মেশানো গলায় বলে, আগেও অনেকবার মেসেজ রেখেছি। জানি না সে মেসেজগুলো পাচ্ছে কি না, কিন্তু তার কোনো সাড়াশব্দ আমরা এখনো পাইনি। তুমি কি দয়া করে তাকে জানাবে, বিষয়টা খুবই জরুরি এবং অবিলম্বে তার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হওয়া দরকার?
নিশ্চয়ই তাকে বলবো ফোন করতে। নম্বরটা বলো, আমি লিখে নিচিছ।
নম্বর আসাদের জানা আছে, লেখার দরকার নেই। কাগজ-কলমও হাতে নেয়নি সে। ফোনের ওপাশ থেকে কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। কেন ফোন আসছে, তা জানা আছে। নম্বর লেখার অভিনয় সেরে মহিলাকে প্রথামতো ধন্যবাদ দেয়। ফোন রেখে চুপ করে বসে থাকে।
এ বাসায় দু’জন সাঈদ, তা অবশ্য ভুল নয়। আলমও দু’জন। আসাদের পুরো নাম সৈয়দ আসাদুল আলম, অন্যজন চার বছরের বড়ো চাচাতো ভাই সৈয়দ রশিদুল আলম। কেউ মিস্টার আলমের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও কোন আলমকে চাই, এরকম ব্যাখ্যা চাওয়ার সুযোগ আছে। আমেরিকায় প্রথম নামে পরিচিত হওয়াই প্রথা এবং এ দেশীয়রা সৈয়দ উচ্চারণ করতে জানে না, ফলে এ বাসায় একজোড়া সাঈদ। পারিবারিক পদবী যে নামের শুরুতে থাকতে পারে, তা এদের অভিধানে নেই। বুঝিয়ে বললেও বুঝতে পারবে না।
সুতরাং চুপচাপ মেনে নিয়ে দু’জন সাঈদ অথবা মিস্টার আলম হয়ে থাকতে অসুবিধা নেই। বরং সুবিধা কিছু পায় আসাদ। এই যেমন এখন। ফোনে সাঈদ নামের একজনকে চাইলে কোন সাঈদকে চাই জিজ্ঞেস করে খানিকটা প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পাওয়া যায়।
নিজের মুখে বলতে হলো সে বাসায় নেই। নতুন কিছু নয়। অনেকদিন ধরে এসব সামলাচ্ছে। প্রথম প্রথম এরকম সময়ে রীতিমতো তোতলা হয়ে যেতো, উল্টোপাল্টা সব কথা মুখে চলে আসতো। ক্রমে সে পেশাদারী দক্ষতা অর্জন করেছে। এইসব ক্ষেত্রে যতোক্ষণ সে নিজের পরিচয় স্বীকার না করছে, ফোন করার কারণ জানানো হবে না। আইনের নিষেধ। ব্যক্তিগত বা আর্থিক লেনদেন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে আলোচনা করা যায় না, এমনকি তার বউয়ের সঙ্গেও নয়।
সে আসাদ নয় বলে নিজের পরিচয় অস্বীকার করলে সুবিধা এই যে, অপ্রিয় কথাগুলো বার বার শুনতে হয় না। না শুনে যে ভালো বোধ করে, এমন নয়। ভাবতে না চাইলেও ব্যাপারটা নেই হয়ে যাচ্ছে না, মিটেও যাবে না।
গতমাসে ক্যারলের জন্মদিন গেছে। একটা ডায়মন্ড বসানো ঘড়ি কিনে দিতে হয়েছে। ক্যারল নিজে পছন্দ করেছিলো। সাড়ে তিনশো ডলারের ঘড়ি কেনার সামর্থ্য থাক আর না-ই থাক, জন্মদিনে তোমার সাদা চামড়ার বউ মুখ ফুটে একটা উপহার চাইবে আর তুমি দেবে না, তাই কি হয়? না দিলে আসাদের পৌরুষ আহত হয়, সামর্থ্যে কুলিয়ে উঠতে না পারলেও বায়নাটি পূরণ করা কর্তব্য।
ওয়ালেটে ক্রেডিট কার্ড আছে কয়েকটা। সবগুলোই এখন শুধু পকেটশোভা, কাজে লাগানোর উপায় নেই। আমেরিকান এক্সপ্রেসের বিল দেওয়া হয়নি দুই মাস, ফোনে এবং চিঠিতে নিয়মিত তাগাদা আসছে। বকেয়া শোধ না করা পর্যন্ত তা ব্যবহার করা যাবে না। ভিসা-মাস্টার কার্ডগুলোতেও চার্জ করার অবস্থা নেই, ব্যাংকে মোটে শ’খানেক ডলার। চেক লিখে দিলে সেটি তার ব্যাংকে ক্যাশ হওয়ার জন্যে যেতে দু’তিনদিন সময় লাগবে, সেই ভরসায় ঘড়ি কিনে ফেলেছিলো চেক লিখে। কীভাবে জানা নেই, তবু এই দু’তিনদিনের মধ্যে ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার একটা ব্যবস্থা করা যাবে বলে তার বিশ্বাস হয়।
টাকার জোগাড় হয়নি। দু’বার চেক বাউন্স করার পর ব্যাংকের চিঠি, অবিলম্বে টাকা জমা দাও। দেবে কোথা থেকে, টাকা থাকলে তো! দিনকয়েক পর ঘড়ির দোকানের কালেকশন ডিপার্টমেন্ট থেকে ফোন আসতে শুরু করে। খুব শিগগির মিটিয়ে না ফেললে তারা স্থানীয় কাউন্টি অফিসে রিপোর্ট করে দেবে জানিয়েছে। তখন হট চেক লেখার দায়ে ওয়ারেন্ট ইস্যু হবে।
এই ধরনের ওয়ারেন্টে তাকে ধরার জন্যে পুলিশ বাসায় আসবে না ঠিকই, কিন্তু রাস্তায় কোনো কারণে থামালে তুলে নিয়ে হাজতে ভরে দেবে। হাজতবাস কখনো করতে হয়নি, তবে আগেও বার দুয়েক ওয়ারেন্ট ইস্যু পর্যন্ত যাওয়ার অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। সেইসব সময়ে আতঙ্ক ও উদ্বেগ নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। রাস্তায় পুলিশের গাড়ি দেখলে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, এই বুঝি থামতে বললো।
এখন উপায় কি, ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? কী করা যায়, আসাদের মাথায় আসে না।
রশিদ কাজে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে নিচে নেমে আসছিলো। সিঁড়ি থেকেই জিজ্ঞেস করে, কে ফোন করছিলো রে, আসাদ?
চোখে একটাও বাড়তি পলক না ফেলে এবং এক মুহূর্ত না ভেবে আসাদ গল্প বানিয়ে ফেলতে পারে। এই দক্ষতাও তাকে অর্জন করতে হয়েছে। নিজের দরকারে। রশিদকে জানায়, আমার ম্যানেজারে কল করছিলো, আজ কাজে যাইতেছি কি না জানতে।
রশিদ কিচেনে চায়ের কেতলিতে পানি চাপিয়ে সোফায় এসে বসে। ক্লজেট থেকে জুতা বের করে এনেছে। মোজা পরতে পরতে বলে, তর পায়ের কী অবস্থা? সারছে না?
ইচ্ছা করলে কাজে যাইতে পারি, কিন্তু আরো দুই একটা দিন পরে যাইতে চাই।
পারলে যা গিয়া। খামাখা ছুটিগুলি নষ্ট করবি ক্যান? পরে দরকারের সময় পাবি না। তখন আবার আনপেইড ছুটি নিতে হইবো।
আসাদ তা জানে। তবু সুযোগ পেলে আজকাল সবাই তাকে কিছু জ্ঞান দিয়ে দেয়। চুপ করে শুনতে হয়। কী বলবে সে? সময় এলে কোনোদিন এগুলো ফিরিয়ে দেওয়া যাবে। এখন তার শুধু মুখ বুজে শুনে যাওয়ার কথা। রশিদের মতো অতোদূর ভাবতে পারলে, সতর্ক হতে জানলে এই অবস্থা হয় না।
দেশে আসাদের বাবা-মা দু’জনেই ডাক্তার, ভালো পসার ও নামডাক আছে ঢাকা শহরে। মায়ের কাছে চাইলে যখন-তখন টাকা পাওয়া যায়। পকেটে পয়সা না-থাকা জিনিসটা কেমন তার জানা ছিলো না। জানলো এই প্রাচুর্যের দেশ আমেরিকায় এসে। এখানে আসার পরপরই কাজে ঢুকে পড়েছিলো। এইচএসসি শেষ করে পড়তে আসা এ দেশে। কিন্তু পড়াশোনা তাকে দিয়ে হবে না, সে জানে। লেখাপড়ায় তার মন ছিলো না কোনোকালে, মাথাও না। আসার আগে টোয়েফ্লের পুলসেরাত কী করে পার হওয়া সম্ভব হয়েছিলো, নিজেও জানে না।
রশিদের কথার জবাবে অস্পষ্টভাবে বলে, আজকার দিনটা যাক, কাল থিকা যাইতে পারি। আপনে আজ এতো সকাল সকাল যাইতেছেন যে?
না, কাম তিনটার সময়ই। এখন একটু ব্যাংকে যামু। তিনটা পে চেক পকেটে নিয়া ঘুরতেছি, জমা দিই দিই কইরা যাওয়াই হয় না।
আসাদের একবার মনে হয়, এখনই সুযোগ। কিছু টাকা ধার চাইলে হয়। চাইলে কৈফিয়ত দিতে হবে। কেন কী বৃত্তান্ত, এইসব। তা না হয় সামলে দেওয়া যাবে, কিন্তু সমস্যা হলো রশিদ ভাইয়ের কাছে মাস দুয়েক আগে নেওয়া তিনশো ডলার এখনো ফেরত দেওয়া হয়নি। দেওয়ার কথা ছিলো অনেক আগেই। এখন আবার নতুন করে ধার চাওয়া যায় কোন মুখে? সাহস হয়না।
টাকার চিন্তা মাথায় রেখে একেবারে অন্য কথা বলে সে, ব্যাংক থিকা কি বাসায় আইবেন খাইতে? কিছু রান্দা-বাড়া নাই মনে হয়, চিকেন আর ডাইল রাইন্দা ফালাইতে পারি। বেশিক্ষণ লাগবো না।
না, দরকার নাই। বাইরে কিছু একটা খাইয়া নিমু নে।
আপনে তো বাইরের খাওয়া খাইতে পারেন না।
একদিন খাইলে কিছু হইবো না।
জুতার ফিতা বাঁধা শেষ করে রশিদ উঠে যায় কিচেনে। চায়ের পানি ফুটেছে, কেতলি শিস দিচ্ছে। আসাদ চা খায় না, জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। এক চামচ চিনি ও টীব্যাগ দিয়ে কাপে পানি ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করে, ক্যারল কই?
কাজে গেলো।
তুই একলা সারাদিন বইসা কী করবি?
আসাদ আরেকবার টাকা চাওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে চায়। বললে এখনই বলতে হবে। পারা যায় না। বলে, দেখি এখনো কিছু ঠিক করি নাই।
চায়ের কাপ নিয়ে সোফায় ফিরে আসে রশিদ। বলে, আমার লগে ব্যাংকে যাবি? তারপর বাইরে কিছু একটা খাইয়া তরে বাসায় নামাইয়া দিয়া যামুনে।
তার টাকার এতো দরকার আর আরেকজন ব্যাংকে যাচ্ছে টাকা জমা দিতে, ভাবতে ভালো লাগে না। সঙ্গে গিয়ে দেখতেও ভালো লাগবে না, মন খারাপ হবে। তার নিজের একটা পে চেক সময়মতো ব্যাংকে জমা না পড়লে চেক বাউন্স করবে অবধারিতভাবে। অথচ রশিদ ভাই কী করে পয়সা ধরে রাখে, কে জানে! তিনটা চেক পকেটে, জমা দেওয়ার তাড়া নেই। কেউ কেউ পারে, আসাদ সে দলে নয়।
নিজেকে সে বলতে শোনে, চলেন যাই।
সঙ্গে থাকলে মুখ ফুটে টাকা চাওয়ার জন্যে কিছু সময় পাওয়া যাচ্ছে, সেটাই বড়ো কথা। রশিদ ভাই বেরিয়ে গেলে সম্ভাবনা আর থাকে না। গাড়িতে উঠে কোনোমতে কথাটা একবার উগরে দিতে পারলেই হয়। তারপর কৈফিয়ত, সামান্য তিরস্কার এবং আরো কিছু অভিজ্ঞান সঞ্চয় - এইসব নিয়ে ভাবতে হবে না, মুখ বুজে গিলে ফেলা যাবে। তার অভ্যাস আছে। যতোই বকাবকি করুক, রশিদ ভাই শেষ পর্যন্ত না করবে না, আসাদ জানে। সাহস করে বলে ফেলাটাই এখন বড়ো কাজ।
চায়ে চুমুক দিয়ে রশিদ রিমোট টিপে টিভি অন করে। কাপ নামিয়ে রেখে সিগারেট ধরিয়ে বলে, তাইলে যা, রেডি হইয়া আয়।
আসাদ উঠে দাঁড়ায়, হ যাই।
এখনো সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে আসাদকে। সিঁড়িতে ওঠানামা করতে একটু বেশি কষ্ট হয়। পায়ের পাতায় ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দুই রকম গল্প বানিয়ে বলতে হয়েছে। কাজের সবাই জানে, রিক্রিয়েশন সেন্টারে বাস্কেটবল খেলতে গিয়ে পা মচকে গেছে। কাজের বাইরে সবাইকে বলতে হয়েছে, কাজে একটা ভারী বাক্স পায়ের ওপর পড়েছে। এ বাসার বাইরে কেউ আসল ঘটনা জানে না। বলার মতো কথা নয়।
দিনকয়েক আগে সন্ধ্যায় ক্যারলের সঙ্গে কথা কাটাকাটি। খাবার টেবিলের তর্ক ঝগড়ায় গড়াতে সময় লাগেনি। ঝগড়াঝাটির সময় ক্যারল খুবই আক্রমণাত্মক ও হিংস্র হয়ে ওঠে, আসাদ জানে। বেশ আগে একবার কিচেনের বড়ো ছুরি নিয়ে আসাদের দিকে তেড়ে গিয়েছিলো। রশিদ ভাই ওপরে নিজের ঘরে ছিলো, চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে নেমে আসে। ক্যারলের কব্জি চেপে ধরে রশিদ ভাই ছুরিটা কেড়ে না নিলে সেদিন কী হতো, কে জানে। তবু ঝগড়ার সময় সেসব আর কে মনে রাখে! আসাদও রাখেনি। এক সময় ক্যারল খাবার টেবিলের কাচের টপটা ঠেলে উল্টে দিলে তা পড়ে আসাদের ডান পায়ের পাতায়।
অসহ্য ব্যথায় মনে হয়েছিলো, তার পায়ের পাতা দু’ফাঁক হয়ে গেছে। চিৎকার দিয়ে সে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে। ক্যারলের হুঁশ হয় তখন। আসাদকে জড়িয়ে ধরে মিনিটের মধ্যে এক কোটিবার দুঃখিত হয় সে। সম্ভবত অপরাধবোধের তাড়নায় শুশ্রুষার কথাও মনে আসে না। সেই সময়ে রশিদ কাজ থেকে ফিরে কাণ্ড দেখে হতভম্ব। তারপর দৌড়াও হাসপাতালে।
কাপড় পাল্টে সাবধানে ডান পায়ের ভর বাঁচিয়ে নিচে নামে আসাদ। এই টাউনহাউসে ওপরতলায় দুই বেডরুমের মাঝখানে কমন বাথরুম। মাস্টার বেডরুম আসাদ আর ক্যারলের, অন্যটাতে রশিদ থাকে। নিচে আরেকটা বাথরুম, কিচেন, ডাইনিং স্পেস আর লিভিং রুম। রশিদের চা-সিগারেট তখনো শেষ হয়নি। আসাদ ফ্রিজ থেকে অরেঞ্জ জুস বের করে ঢালে কাচের গ্লাসে, তার পছন্দের পানীয়।
কিচেন কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বড়ো চুমুক দেয় আসাদ। রশিদ ভাইয়ের কাছেই টাকা চাইতে হবে। আর কোনো উপায় চোখে পড়ছে না। বন্ধুবান্ধব কারো কাছে বাড়তি টাকা থাকার কথা নয়, সবারই কায়ক্লেশে দিন চলে। অল্পবিস্তর ধার বন্ধুদের কাছেও আছে, চাওয়া যায় না।
এক হিসেবে টাকা-পয়সায় তারই সবচেয়ে ভালো থাকার কথা। আর সবাইকে লেখাপড়া সামলে পার্ট টাইম কাজ করতে হয়। পড়ার খরচ আছে, তার ওপর আহার-বাসস্থান ও গাড়ির খরচ।তার স্কুলে হাজিরা দেওয়া নেই, পয়সাও দিতে হয় না। ফুলটাইম কাজ সে করতে পারে। স্টপ অ্যান্ড গো চেন কনভেনিয়েন্স স্টোরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে তার রোজগারও সবার চেয়ে বেশি।
ক্যারল এক ডাক্তারের মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট, ঘরে আনা তার টাকার পরিমাণও খারাপ নয়। ক্যারলের অবশ্য হুটহাট চাকরি ছেড়ে দেওয়ার বাতিক আছে, কোনো কাজ তার একটানা বেশিদিন ভালো লাগে না। লম্বা সময় বসেও থাকে না, কীভাবে কেমন করে আরেকটা কাজ খুব তাড়াতাড়ি জুটিয়েও ফেলে।
রশিদ সেভেন ইলেভেনে ক্যাশিয়ার। বাসাভাড়াসহ অন্যসব সাংসারিক খরচ সে আধাআধি দেয়। অথচ দু’জনের রোজগারেও আসাদ তার অর্ধেক সময়মতো গুছিয়ে আনতে হিমশিম খায়। পকেটে থাকা টাকার হিসেবে আসাদই বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে দুঃস্থ। কোনো মানে হয় না।
খেলাধুলায় আসাদ বরাবর ভালো ছিলো - স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় ঢাকা হকি লীগে খেলেছে। টেবিল টেনিসে জুনিয়র ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে একবার সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিলো। ফুটবল-ক্রিকেটেও অনায়াস দক্ষতা, লীগে খেলার সুযোগও এসে যেতো সময়ে। তার আগেই দেশ ছেড়ে সেসব বিসর্জন দিতে হয়েছে - এখন সুযোগ নেই, চর্চাও না।
এ দেশে এক টেবিল টেনিসই কিছু খেলা হয়, এরা বলে পিং পং, তা-ও কদর কম। ফিল্ড হকি খেলার চল নেই, এরা খেলে আইস হকি। ক্রিকেটের নামও শোনেনি কেউ। ফুটবলে আগ্রহ মোটে তৈরি হচ্ছে, স্কুলের বাচ্চারা খেলে, নাম সকার। এ দেশে যার নাম ফুটবল, তা একেবারে অন্য জাতের খেলা, উন্মুক্ত ময়দানে দলবদ্ধ কুস্তি।
বিষণœ ও মন খারাপ লাগলে আসাদ মাঝে মাঝে ভাবে, এ দেশে না এলেই হয়তো ভালো হতো। যেসবে তার দক্ষতা, দেশে সেগুলো সম্বল করেই জ্বলে উঠতে পারতো। কেউ একজন হয়ে উঠে অনেক মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকা সম্ভব হতো।
জৌলুসের জীবনযাপন, স্পোর্টস কার, এন্তার ফুর্তি এইসব সম্ভাবনা তাকে টেনে এনেছিলো আমেরিকায়। লেখাপড়া তাকে দিয়ে হবে না, সে জানতো। অথচ গ্লানিময় এই অনুল্লেখ্য অকিঞ্চিৎকর জীবনের ভেতরে সে কী করে যে জড়িয়ে পড়লো!
তার সমস্যা কী একটা!
গাড়িতে বসে সীট বেল্ট লাগাতে লাগাতে আসাদ সোজাসুজি বলে ফেলে, আমার শ’পাঁচেক টাকার দরকার, রশিদ ভাই।
শেষ পর্যন্ত বলতে পেরেছে, আসাদের নিজেরই বিশ্বাস হয় না। এরকম হুট করে না বললে কিছুতেই বলা যেতো না। ইনিয়ে বিনিয়ে ভূমিকা করে বলতে গেলে এ-কথা ও-কথার পর টাকার কথাটাই হয়তো মুখে আসতো না। চোখ-নাক-মুখের সমস্ত ক্রিয়া বন্ধ করে বলা তো হয়ে গেছে, এখন যা হয় হোক। একটু বেশি করেই চেয়েছে। পুরো পাঁচশো পেলে খারাপ হয় না। টাকা কখনো বাড়তি হয় না, কোনো না কোনো কাজে লেগেই যায়। চাই কি, ক্যারলকে নিয়ে আজ রাতে রেস্টুরেন্টে খেয়ে আসা যায়। এ দেশী বউ পুষতে গেলে সপ্তাহে অন্তত একদিন বাইরে খেতে হয়, শুক্র-শনিবার রাতে ক্লাবে বা বারে যাওয়াও নিয়মের মধ্যে পড়ে।
রশিদের মুখ দেখে তার রাগ, বিরক্তি, কৌতুক কিছুই বোঝার উপায় নেই। জিজ্ঞেস করে, ক্যান, কী হইলো আবার?
আসাদের হঠাৎ মনে হয়, আচ্ছা, এই নিয়ে রশিদ ভাইয়ের এই প্রশ্ন ঠিক কতোবার শুনেছে সে? টাকা ধার চাইলে হুবহু এই জিজ্ঞাসাটাই প্রথম শুনতে হয়। খুবই বিরক্ত লাগে। সবাই শুধু তার কাছে কৈফিয়ত চায়। কর্মস্থলে প্রতিমাসের ইনভেন্টরির পর জিনিসপত্র বা টাকাপয়সার ঘাটতি হলে ম্যানেজারকে বাদ দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, কেন হলো। ঘরের বউ ক্যারল জিজ্ঞেস করবে, গত সপ্তাহের পে চেক পুরোটা তোমাকে দিয়েছি, সে টাকা গেলো কোথায়?
ঠিক কথা, কিন্তু টাকা জমা হওয়ার পরপরই বার্থ ডে পার্টিতে যাওয়ার জন্যে ক্যারলের জন্যে নতুন এক প্রস্থ পোশাক কেনা হলো, তা কারো মনে থাকবে না। পাওনা টাকার তাগাদা দিয়ে সরোজ মুখ কালো করে বলবে, সময়মতো টাকা ফেরত দিস না কেন, টাকা কী করিস তুই? আসাদকে চুপ করে থাকতে হবে, মুখ ফুটে সে বলতে পারবে না, আমিনকে দেড়শো ডলার ধার দিতে হয়েছে, তার জরুরি দরকার। পকেটে টাকা রেখে বন্ধুর প্রয়োজনে দেবে না, তা তো হয় না। বাসা ভাড়া দিতে দেরি হয়ে যাচ্ছে? সে দেখা যাবে, ব্যবস্থা একটা হবেই। এসব কেউ বোঝে না।
রশিদের প্রথামাফিক জেরায় বিরক্ত হলেও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে আসাদ। লম্বা শ্বাস টেনে সামনের দিকে চোখ রেখে বলে, দরকার আছে। পারলে দিবেন, না পারলে আর কী করা!
পারা না পারার কথা না। লাগলে ধার নিবি, তাতে তো মানা করি নাই।
আসাদের আশংকা হতে থাকে, হয়তো পুরনো ধারের কথা তুলে ফেলবে রশিদ ভাই। তাহলেই সব গেলো। রশিদ আরো কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে যায়।
ব্যাংক দশ মিনিটের পথ, আর কোনো কথা ছাড়াই যাওয়া হয়। আসাদকে গাড়িতে বসিয়ে রশিদ ভেতরে যায়। ফিরে এসে ব্যাংকের ছাপ মারা একটা খাম তুলে দেয় আসাদের হাতে। বলে, ফিরত দিতে পারবি কবে?
চেষ্টা করুম এই মাসেই এইটা আর আগেরটা মিলাইয়া দিয়া দিতে।
রশিদ মৃদু হেসে বলে, এই মাসে পারবি না, মাসের আর বাকি আছে পাঁচদিন।
আসাদ খেয়াল করেনি। ভেবে উত্তর দেওয়াও নয়। বলতে হবে তাই বলা। প্রতিশ্রুতি রাখা যাবে কি না, সময় হলে দেখা যাবে। সামলে নিয়ে বলে, আমি এখন থিকা এক মাস মীন করছিলাম।
তা-ও পারবি না, খামাখা কইয়া লাভ কি? তার থিকা মাসে মাসে দুইশো কইরা দিস। তাইলে গায়ে লাগবো না, আমারও অসুবিধা কিছু নাই।
আসাদের জন্যে অতি উত্তম ও সুবিধাজনক প্রস্তাব, কৃতজ্ঞতায় প্রায় গলে পড়ে সে। ভাই না হলে আর কে করবে এরকম! বলে, তাইলে খুবই ভালো হয়।
আরেকখান কথা। এইটা শোধ না হইলে আর টাকা চাইস না।
আসাদ এক কথায় রাজি। না হওয়ার সুযোগ কি আছে!
ভাইটির জন্যে রশিদের দুর্বলতা অনেক। ঢাকায় ওদের বাসায় থেকে সে ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করেছে। চাচা-চাচী তাকে নিজেদের ছেলেমেয়েদের থেকে আলাদা করে দেখেনি। পাশ-টাশ করে ওই বাড়ি থেকেই সে উড়াল দিয়েছিলো ক্যালিফোর্নিয়ায়। আসাদ এসেছিলো তারও আগে। এমবিএ শেষ করে ক্যালিফোর্নিয়ায় রশিদের চাকরি-বাকরির সুবিধা হয় না। আসাদ ফোন করে বলে, ডালাসে আইসা পড়েন, একটা ব্যবস্থা হইবোই। আমি তো আছি, দুই ভাইয়ে এক লগে থাকতে পারুম।
আসাদ তখনো বিয়ে করেনি। ছোটোবেলা থেকে কিঞ্চিৎ দুরন্ত ও খেলাধুলা নিয়ে মেতে থাকা আসাদ খুবই প্রিয় রশিদের। আসাদের মুখে আমি তো আছি শুনে ভালো লাগে, ভরসা হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার পাট তুলে দিয়ে রশিদ চলে আসে দু’মাস পরে। আসাদ যে এতো রকমের ঝামেলার মধ্যে ডুবে আছে, প্রথম প্রথম বোঝা যায়নি। যখন টের পেলো, তখন আর বিশেষ কিছু করার নেই। যতোদূর পারে সাহায্য করার চেষ্টা করেছে, পরামর্শ দিয়েছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি।
একবার বাসাভাড়া বাকি পড়লে অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের লোকজন এসে টিভি-ভিসিআর আটকে রেখেছিলো, রশিদ টাকা দিয়ে উদ্ধার করে আনে। আসাদের টাকাপয়সার টানাটানি, এতোসব ঝামেলা দেখে রশিদের কষ্ট হয়, আহা, কোন বাড়ির ছেলে বিদেশে কীভাবে আছে। দেশে তার এই অবস্থা কল্পনা করা যেতো?
আগে কোনোদিন বোঝা যায়নি, এখন রশিদ টের পায়, আসাদ আসলে কারো পরামর্শ কানে তোলার ছেলে নয়। সে যা করবে ঠিক করে রেখেছে, তা-ই করবে।
তবু আসাদকে সে আজীবন স্নেহ করে এসেছে, তাকে দেখে এখন তার বুক শুধু মায়ায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। ক্ষমতা থাকলে সে তাকে এই চক্করের ভেতর থেকে টেনে বের করে আনতো। কিন্তু তার আর সাধ্য কতোটুকু? এই দুর্বলতাটুকুও সে যথাসম্ভব আড়াল করে রাখে, টের পেলে আসাদ তার ওপর আরো বেশি নির্ভর করতে শিখবে। সেটা ভালো নয়। নিজের ভবিষ্যতও রশিদকে ভাবতে হয়।
কেনটাকি ফ্রায়েড চিকেনে বসে খেতে খেতে রশিদ জিজ্ঞেস করে, ক্যারলের সাথে আলাপ করছিলি?
আসাদ জানে, কী জানতে চায় রশিদ। তবু না বোঝার মতো মুখ করে বলে, কীসের আলাপ?
তর গ্রীন কার্ডের।
না, করা হয় নাই।
আর কবে করবি? এই কইরা দুই বছর কাটাইয়া দিলি। আইজ পর্যন্ত তর অ্যাপ্লাই করাই হইলো না। এতোদিনে তর পার্মানেন্ট কার্ড হইয়া যাওয়ার সময় হইয়া যাইতো।
আসাদ চুপ করে থাকে। ভাজা মুরগির টুকরো মুখে দিয়ে চিবায়। প্যাকেটের মধু বিস্কিটে মাখায় ধীরেসুস্থে। ঠাণ্ডা পেপসির গ্লাসে চুমুক দেয়। কী বলবে সে?
বিয়েটা তার সত্যিকারের, কাগজ-কলমের বউ নয় ক্যারল। চেইন রেস্টুরেন্ট অ্যাপলবী’জ-এর ম্যানেজার তখন আসাদ, ক্যারল সেখানে ওয়েট্রেস হিসেবে ঢুকেছিলো। ইলিনয়ের ছোটো এক শহর থেকে সদ্য বড়ো শহরে আসা ক্যারল তখন পায়ের নিচে মাটি খুঁজছে। সুন্দরী ছিপছিপে নীলনয়না আসাদের নজরে পড়ে যায়। গায়ের রংটাই শুধু শ্যামলা, পোশাক ও ফ্যাশন সচেতন আসাদ দেখতে অত্যন্ত সুপুরুষ। ছয় ফুট উচ্চতার সঙ্গে মানানসই স্বাস্থ্যের দ্যুতি। প্রেম জমে উঠতে সময় লাগেনি।
ওকলাহোমা রাজ্যের ডুরান্টে লেখাপড়া করার নিমিত্ত আসাদকে এ দেশের ভিসা দেওয়া হয়েছিলো। সেই শর্ত ভঙ্গ করে পড়াশোনা ছেড়ে দিলে ইমিগ্রেশন থেকে ডিপোর্টেশনের চিঠি আসে। তাকে চলে যেতে বলা হয়। এসব নিয়মরক্ষার চিঠি, সত্যি সত্যি কেউ এসে ঘাড় ধরে বহিষ্কার করবে না।
তবু এক ধরনের মানসিক চাপ তো বটে। কাঁটা হয়ে থাকতে হয় সারাক্ষণ, কোনো কারণে ইমিগ্রেশন মামুর হাতে পড়ে গেলে তারা সরাসরি প্লেনে তুলে দেবে। তখনই ডুরান্ট ছেড়ে ডালাসে আসা, অন্তত ঠিকানা বদল করে লুকিয়ে থাকা হলো। ক্যারলকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত আসাদ দ্রুতই নিয়েছিলো। বউ হিসেবে ক্যারল তার গ্রীন কার্ডের আবেদন করতে পারবে, ডিপোর্টেশনের চিঠি নিয়ে তখন আর মাথা ঘামাতে হবে না।
বিয়ের পরে নতুন ঝামেলা। ক্যারলের সঙ্গে কথা বলবে ভাবলেই আসাদের মনে হতে থাকে, ক্যারল তাকে হয়তো চালবাজ, ঠক ভেবে বসবে। যদি ভাবে, ভালোবাসা নয়, গ্রীন কার্ডের মতলবেই তাকে বিয়ে করেছে আসাদ! তা যে সত্যি নয়, কী দিয়ে প্রমাণ করা যাবে?
একসময় ভেবেছে, কিছু সময় গেলে ক্যারল বুঝবে আসাদের মধ্যে চালাকি কিছু ছিলো না এবং নিজে উদ্যোগী হয়ে গ্রীন কার্ডের জন্যে চাপ দেবে আসাদকে।
মুশকিল হলো, গ্রীন কার্ড জিনিসটা কী এবং একজন বিদেশীর যে তা দরকার, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা ক্যারলের নেই। এই সরলতাও আসাদকে বিপদে ফেলে রেখেছে, ফলে দুই বছর কেটে গেছে, আলোচনার সূত্রপাত করা সম্ভব হয়নি।
আসাদকে চুপচাপ দেখে রশিদ বলে, নিজে না পারলে আর কাউরে দিয়া আলাপ করান যায় না?
সেইটা ভালো দেখায় না।
তর নিজে কওনের অসুবিধা আমি বুঝি। তুই চাইলে আমিও অর সাথে কথা কইতে পারি, আমি তো আর বাইরের মানুষ না।
দেখি, কি করা যায়।
দেখতে দেখতে তো অনেক সময় গেলো। রশিদ চিকেনে কামড় বসায়।
এই প্রসঙ্গ চাপা দেওয়ার উপায় আসাদের জানা আছে। অব্যর্থ সেই ওষুধ সে এখন ব্যবহার করে। জিজ্ঞেস করে, আপনের কেসের কদ্দূর কী হইলো?
গত বছর রশিদ টাকাপয়সার শর্তে চুক্তির বিয়ে করে। নিজেরই ব্যবস্থা, আগে থেকে আসাদ বা আর কাউকে জানায়নি। কৃষ্ণকায়া দরিদ্র মেয়ে ভ্যানেসা দেড় হাজার ডলারের শর্তে রাজি - বিয়ের সময় নগদ পাঁচশো, গ্রীন কার্ডের আবেদনের সময় আরো পাঁচশো, বাকিটা দু’বছর পর ইমিগ্রেশনে দ্বিতীয় দফা ইন্টারভিউয়ের পরে।
বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের দিনে ভ্যানেসা এক হাজার দাবি করে বসে। শর্ত স্মরণ করিয়ে দিলে মুখ বাঁকা করে জানায়, এই মুহূর্তে হাজার ডলার না দিলে সে ইমিগ্রেশনে যাওয়া দূরে থাক, ভুয়া বিয়ের কথা ফাঁস করে দেবে।
ফাঁস করে নিজেও ফেঁসে যাবে, তাতে ভ্যানেসার হয়তো হারানোর কিছু ছিলো না, কিন্তু রশিদের ইচ্ছে নয় ঝামেলায় জড়ানোর। দাবি পূরণ না করে তার উপায় থাকে না। কথা হয়েছিলো, ঠিক এক মাস পরে দু’জনে যাবে ইমিগ্রেশন অফিসে গ্রীন কার্ডের আবেদন করতে। বিয়ের পর দিনকয়েক অপেক্ষা না করলে ব্যাপারটা খুবই ন্যাংটো দেখায়।
নির্দিষ্ট দিনে ভ্যানেসাকে তুলে নিতে তার বাসায় যায় রশিদ। রুমমেটের কাছে জানা যায়, ভ্যানেসা সেখানে আর থাকে না, কোথায় চলে গেছে, জানিয়ে যায়নি। রুমমেট আরো বলে, ওর সঙ্গে তোমার দেখা হলে বোলো, গতমাসের ভাড়ার টাকাটা সে দেয়নি, দিয়ে যায় যেন।
প্রমাণ করার উপায় নেই, তবু রশিদের ধারণা, ভ্যানেসা তখন নিজের ঘরে বসে সব শুনছিলো আর হেসে গড়িয়ে পড়ছিলো। ওই পর্যন্তই, ভ্যানেসার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। পাওয়া যাবে, এমন আশাও নেই।
রশিদ ভুরু কুঁচকে বলে, ওইটা আর কিছু হইবো না, বাদ দে।
আসাদ বলে, ক্যান যে নিজে নিজে মাতবরি করতে গেছিলেন! আমারে আগে একবার কইলে সবাই মিল্যা ভালো একটা ব্যবস্থা করা যাইতো। টিংকু এক মাইয়ার লগে শওকতের কন্ট্রাক্ট বিয়া দিছে না? দুইজনে এক জাগায় কাম করে, সবসময় দেখা হয়, ছুইটা যাইবো কই? টিংকু নিজেও তো করছিলো, অরও গ্রীন কার্ড হইছে।
রশিদ একটু চুপ করে থেকে বলে, আসলে ভুল হইছে। মনে করছিলাম, চুপেচাপে সাইরা ফালাইতে পারুম। তখন তো কইতামই। আসলে কইতে শরম করতেছিলো, তরা কি না কি মনে করবি।
এতোদিনে আমারে এই চিনা চিনছেন?
তা না, তরে আর নতুন কইরা কি চিনুম। দুই নম্বরী বিয়ার কথা কাউরে কই ক্যামনে, তুই ক?
সাহস ও সুযোগ পেয়ে আসাদ বলে, ধরা খাইয়া ছাগল না হইলে তো মনে হয় কইতেনই না।
আসাদকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে রশিদ কাজে চলে যায়। বাসায় ঢুকে পকেট থেকে ব্যাংকের খাম বের করে দ্রুত টাকা গোনে আসাদ। পাঁচশোই দিয়েছে, রশিদ ভাইকে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানায় সে। এই উপকার সে কোনোদিন ভুলবে না এবং ভবিষ্যতে নতুন করে এ ধরনের ঝামেলায় আর জড়াবে না বলেও নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।
তার মনে পড়তে পারতো, এই ধরনের প্রতিজ্ঞা সে আগে অনেকবার করেছে, যথাসময়ে ভুলে যেতেও সক্ষম হয়েছে। মনে না পড়ুক বা না পড়ুক, তার এই মুহূর্তের সদিচ্ছাটি একশো ভাগ খাঁটি, একটুও খাদ নেই।
আসাদ ফোন তুলে ঘড়ির দোকানের নম্বর ডায়াল করে নিজের নাম-পরিচয় দিয়ে বলে, আমি এইমাত্র মেসেজ পেলাম, তোমরা আমার খোঁজ করছিলে। কী ব্যাপার, বলো তো?
একটা সমস্যা হয়েছে। তুমি আমাদের এখানে একটা চেক লিখেছিলে, তোমার ব্যাংক সেটা দু’বার ফেরত পাঠিয়েছে। আমরা তোমাকে চিঠি লিখেছিলাম, ফোনও করেছি। কিন্তু তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
ওঃ, আমি খুবই দুঃখিত। আমি আসলে শহরের বাইরে ছিলাম গত সপ্তাহ দুয়েক। ফিরেছি এই একটু আগে। ফলে, এসবের কিছুই আমি জানতাম না। খুবই দুঃখিত।
ফোনের ওপাশ থেকে পেশাদারী সৌজন্য প্রকাশ করে বলা হয়, তা ঠিক আছে, কিন্তু এখন তুমি এই লেনদেনটা কীভাবে মেটাতে চাও? আশা করি, আমরা এ বিষয়ে অন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই তুমি ব্যাপারটা চুকিয়ে ফেলবে।
ওঃ, নিশ্চয়ই। আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তোমাদের দোকানে আসছি।
তুমি মোট চারশো বারো ডলার সাতচল্লিশ সেন্টের একটা মানি অর্ডার নিয়ে নিজে আসতে পারো, অথবা মেল করেও দিতে পারো। চেক নয় কিন্তু। তবে মনে রেখো, আগামী তিনদিনের মধ্যে ফয়সালা না হলে আমরা ব্যাপারটা আমাদের লীগ্যাল ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দেবো।
না না, তার দরকার হবে না। আমি আসছি।
ফোন নামিয়ে রেখে কপালের ঘাম মোছে আসাদ। ঘরে এয়ারকন্ডিশনার চলছে, তবু ঘামছে সে। এই লুকোচুরি খেলার অভিনয়ের পরিশ্রম ও অবসাদ বড়ো কম নয়। সাড়ে তিনশো টাকার দেনা এখন মেটাতে হবে আরো ষাট-বাষট্টি ডলার দণ্ড দিয়ে। এক সপ্তাহের বাজার হয়ে যায় এই টাকায়। আরো আছে, এই চারশো বারোর সঙ্গে আরো পঞ্চাশ, ব্যাংকের চার্জ - একেকবার চেক বাউন্স করার জন্যে পঁচিশ ডলার করে।
ফোন রাখার সময় মেসেজ ইন্ডিকেটরের লাল বাতিটি জ্বলে থাকতে দেখে। না-শোনা দুটি নতুন বার্তা অপেক্ষা করে আছে। বাইরে ছিলো, তখন এসেছে। এই সময় ক্যারল করেনি, তা একরকম নিশ্চিত। বন্ধুবান্ধবদের কেউ নয়, তা-ও অনুমান করা যায়। এখন আর কে তাকে ফোন করবে? হবে আমেরিকান এক্সপ্রেস বা মাস্টার কার্ড। পাওনা টাকার তাগাদা। নাকি নতুন কোনো পাওনাদার?
সহ্য হয় না। খুব অবসন্ন লাগে। এই দমবন্ধ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় আসাদের জানা নেই। সারা দিনমানের এই চোর-পুলিশ খেলা কবে যে শেষ হবে, একটু ভালো করে শ্বাস নেওয়া যাবে! এখন শুধু রং বদলানো, নিজেকে আড়াল করার খেলা।
Thursday, October 18, 2007
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment