Saturday, October 27, 2007

শাচৌ ও আধো ঘুম আধো জাগরণের একরাত্রি



শাহাদত চৌধুরী আর নেই। খবরের শিরোনাম দেখে চমকে উঠি। কখনো কখনো সময়মতো দেশের সব খবর পাওয়া হয়ে ওঠে না। শাচৌ-এর প্রস্থানের খবরও জানলাম কিছু বিলম্বে। পরবাস যাপনের মাশুল।

আমাদের সময়ের প্রকৃত সাহসী সম্পাদকদের একজন শাহাদত চৌধুরী। ঘনিষ্ঠদের কাছে পরিচিত ছিলেন শাচৌ নামে, জানতাম। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় কখনো ঘটেনি। বিচিত্রা অফিসে দুয়েকবার গিয়েছি, সম্পাদকের কক্ষের বাইরে থেকে খোলা দরজা দিয়ে তাঁকে দেখেছি। ওই পর্যন্তই। অথচ শাহাদত চৌধুরী নামটির সঙ্গে আমার পরিচয় ষাটের দশকের শেষভাগে ললনা পত্রিকার সুবাদে। তখন আমি স্কুলে উঁচু ক্লাসের ছাত্র।

মুক্তিযুদ্ধফেরত তিনি সাপ্তাহিক বিচিত্রা-র ভার নিয়েছিলেন। কাগজটির মূল পরিকল্পক, উদ্যোক্তা ও প্রথম সম্পাদক ছিলেন ফজল শাহাবুদ্দীন। সরকারি পত্রিকা দৈনিক বাংলা-র সহযোগী সাপ্তাহিক (শুরুতে পাক্ষিক) হিসেবে বেরোয় বিচিত্রা। শাহাদত চৌধুরী দীর্ঘকাল ভারপ্রাপ্ত ও পরে পূর্ণ সম্পাদক ছিলেন। সেই ভারপ্রাপ্ত-র যুগেও সবাই জানতো বিচিত্রা শাহাদত চৌধুরীর পত্রিকা। সত্তরের মাঝামাঝি থেকে কাগজটি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী সাপ্তাহিক। বলতে গেলে একটা সময় ছিলো যখন বিচিত্রা বাংলাদেশের সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজ-প্রেক্ষিত, তারুণ্যের প্রবণতা, এমনকি ফ্যাশন - এই সবকিছুর মানদণ্ড নির্ধারক হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। মোটকথা, বিচিত্রা-র একেকটি সংখ্যা ছিলো সমসাময়িক বাংলাদেশের ছবি।

কাগজটি সরকারি থেকে ব্যক্তি মালিকানায় যাওয়ার আগে পর্যন্ত অবস্থা এরকমই ছিলো। বাংলাদেশে এ-ও ছিলো এক ব্যতিক্রম। হয়তো ব্যতিক্রমও নয় আমাদের শাসকদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতার কথা ভাবলে - লাভজনক প্রতিষ্ঠানকে যে কোনো ছলে ব্যক্তির মালিকানায় চালান করে দেওয়ার ব্যাপারে তারা বরাবর দক্ষতার পরিচয় দিয়ে এসেছে। সরকারি থাকার কালে যে বিচিত্রা ছিলো খ্যাতির শীর্ষে, মালিকানা বদলের পর সেই গৌরবের ধারেকাছেও আর থাকতে পারেনি পত্রিকাটি। একজন যোগ্য সম্পাদক যে কাগজের জন্যে কতোটা জরুরি, এই ইতিহাস তো সেই কথাই বলে।

একটি পত্রিকা মূলত তার সম্পাদকের চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের সম্প্রসারণ। সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর সবচেয়ে বড়ো গুণ ছিলো তাঁর সাহস, ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা। সরকারি কাগজে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে, সরকারের কিছু গুণগান করতেই হয় বাধ্যতামূলকভাবে। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বিচিত্রা সরকারি নীতি ও কার্যকলাপের সমালোচনার সৎসাহস দেখিয়েছে, সরকারি নীতির সঙ্গে খুব সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন প্রতিবেদন অসংখ্য ছেপেছে। সম্পাদকের বিবেচনাপ্রসূত সাহসিকতা ব্যতিরেকে এটি কিছুতেই সম্ভব হতো না। পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে এই সাহস বাংলাদেশের খুব বেশি কাগজ তখন দেখাতে পারেনি। সময়োচিত এই সৎসাহসই বিচিত্রা-কে পাঠকদের কাছে অতোখানি গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলো। সরকারি আওতার বাইরে এসে পরবর্তীকালে সাপ্তাহিক ২০০০-এর সম্পাদক হিসেবেও শাহাদত চৌধুরী সেই সাহস ও যোগ্য সম্পাদনার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছিলেন। অথচ বরাবর ছিলেন নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ, আত্মনিমগ্ন মানুষ।

সম্পাদক হিসেবে নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি তিনি কখনোই বিস্মৃত হননি। যে কল্যাণমুখী ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র নির্মাণের জন্যে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো, তার আদর্শগুলি ধরে রেখেছিলেন তাঁর কাগজে। যাবতীয় শুভবোধের পক্ষে এবং পশ্চাৎমুখী চিন্তার বিপক্ষে ছিলেন বরাবর। বাংলাদেশে মোল্লাতন্ত্রের উত্থানের বিষয়ে প্রাথমিক সতর্কবাণীও তাঁর কাগজ থেকেই এসেছিলো।




শাচৌ-এর মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি, রাতভর আধো ঘুম আধো জাগরণের ভেতরে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেছি। নামে চেনা মানুষটির জন্যে তা ঘটেছিলো বললে বাড়াবাড়ি হবে। অন্য কোনো কারণ হয়তো ছিলো। কর্মোপলক্ষে অচেনা শহরের হোটেলকক্ষে রাত্রিযাপনও তার একটি কারণ হতে পারে। অথচ রাতভর ওই তন্দ্রাচ্ছন্নতার মধ্যে টের পাই, আমি সর্বক্ষণ শাচৌকেই ভাবছি, মাথার ভেতরে তাঁর অবিচুয়ারি লেখা হচ্ছে। দু'একবার তন্দ্রা ছুটে গেলে অন্যকিছু ভাবার চেষ্টা করি, সমর্থ হই না। শাচৌ নামের মানুষটিকে দূর থেকে চিনি, তাঁর সম্পাদিত কাগজে আমার দু'একটি রচনা ছাপা হয়েছে - এই তো। তাঁর মৃত্যু আমার মনোকষ্টের কারণ হতে পারে, নির্ঘুম রাত্রির কারণ হয়ে ওঠাটা কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিক বলেই মনে হয়। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক যে কখন কী কারণে বিচলিত হয়, তার খবর আমরা কতোটুকু জানতে পারি!

সকালে বিছানা ছাড়তে গিয়ে টের পাই, সারারাত শাচৌ-এর জন্যে মনে মনে যে শোকগাথা লিখেছি, সেখানে তাঁর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টিই সবচেয়ে বড়ো ছিলো। সম্পাদক হিসেবে শাহাদত চৌধুরী সফল ছিলেন, অনেক লেখককে লেখক হয়ে উঠতে তিনি সহায়তা দিয়েছেন, তাঁর হাত ধরে অনেক সাংবাদিকই সাংবাদিক হয়ে উঠেছেন, বাংলাদেশের প্রগতিশীল শক্তি ও মুক্তচিন্তাকে তিনি বেগবান রাখতে পেরেছেন। এসবই তাঁর কীর্তি ও সাফল্য। অথচ আমার সেই আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে তাঁর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টিই সবচেয়ে বড়ো হয়ে প্রতিভাত হয়। জানি, আমার অবচেতন ভুল কিছু করেনি। কাগজের সম্পাদক চলে গেলে আরেকজন যোগ্য সম্পাদক পাওয়া হয়তো সম্ভব। মুক্তিযোদ্ধা চলে গেলে আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যায় না - সে জায়গাটি শূন্যই পড়ে থাকে।

------------------
ডিসেম্বর ২০০৫
------------------

No comments: