বিদেশে বাঙালি চেনা যায় কী কী প্রকারে?
আমেরিকা বোধ হয় একমাত্র দেশ যেখানে পৃথিবীর সব দেশের মানুষের কমবেশি প্রতিনিধিত্ব আছে। কোনো একটিমাত্র শহরে যদি সব দেশের, ভাষার ও সংস্কৃতির মানুষের নমুনা খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়, সেই শহরটি অবশ্যই নিউ ইয়র্ক। বড়ো অন্য শহরগুলিতেও এই মিশ্রণ আছে, যদিও তা নিউ ইয়র্কের মতো ব্যাপক নয়। অনেক সময় রং-চেহারায় একরকম হলেও তারা আলাদা সংস্কৃতির মানুষ।
আমার বাস ডালাস শহরে, এখানে নিকট প্রতিবেশী দেশ মেক্সিকো থেকে আসা অভিবাসী মানুষের সংখ্যা প্রচুর। প্রায়ই এদের কেউ এসে আপন মানুষের মতো স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলতে শুরু করবে, এই অভিজ্ঞতা কমবেশি সব বাঙালিরই আছে। আমাদের দেখে দেশী মানুষ মনে হওয়া বিচিত্র নয় তাদের পক্ষে। আমাদের গায়ের রং ওদেরই মতো রোদ-পোড়া ধরনের, চোখ-নাক-মুখের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোও প্রায় এক। শরীরের গঠন, উচ্চতা ও চুলের রঙে বিশেষ হেরফের নেই। খাদ্যাভ্যাসেও বাঙালির সঙ্গে ওদের কিছু মিল আছে, ঝাল-মশলাদার খাদ্য তাদের পছন্দ। ভাত তাদের প্রতিদিনের খাবারের অংশ হলেও আমাদের তুলনায় তা পরিমাণ ও গুরুত্বে গৌণ। ভাষা অবশ্যই আলাদা।
স্প্যানিশ ভাষাভাষী সহকর্মীদের কল্যাণে আমার বিদ্যার দৌড় 'আমিগো' (বন্ধু, মেয়েদের বেলায় 'আমিগা'), 'হোলা' (হ্যালো), 'কোমোস্তা' (কেমন আছো?), ফ্রিয়োঁ (ঠাণ্ডা), কালিয়েন্তে (গরম), বুয়েনো (ভালো), গ্রান্দে (বড়ো/বিশাল), আদিয়োস (বিদায়), দিনেরো (টাকা), ত্রাবাহো (কাজ) - এই রকমের অল্প কয়েকটি শব্দের মধ্যে সীমিত। এই স্প্যানিশ ভাষাভাষী ভাইয়েরা কথা বলতে এলে বিপদে পড়ে যাই। ওরা যেমন ইংরেজি না জানলে 'মি নো ইংলিশ' জাতীয় বাক্য গঠন করে, বাধ্য হয়ে তখন তাদের কায়দা ধরে জানাতে হয়, 'মি নো এস্পানিয়ল, আমিগো'।
শুধু মেক্সিকো নয়, দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশের মানুষের সঙ্গে আমাদের আকৃতি ও প্রকৃতিগত অনেক মিল। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের মানুষের সঙ্গেও তাই। আমাদের উপমহাদেশের ভারতীয় বা পাকিস্তানীদের কথা অবশ্য আলাদা করে বলার দরকার নেই।
এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে এখানে বাঙালি/বাংলাদেশীদের আলাদা করে চেনা যাবে কী প্রকারে? শ্বাসকষ্টে পতিত না হলে মানুষ কখনো অনুভবই করে না যে, বাইরের সঙ্গে তার শরীর ক্রমাগত বাতাস আদান-প্রদান করছে। মাছেরা বুঝতে পারে না তারা পানিতে আছে, যতোক্ষণ না তাদের ডাঙায় নিয়ে আসা হয়। ফলে, বাঙালি/বাংলাদেশী হিসেবে এমনিতে আমরা নিজেদের আলাদা কোনো বিশেষত্ব দেখতে পাই না। অর্থাৎ, ঠিক কোন কোন বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমরা অন্য দেশের বা সংস্কৃতির মানুষদের থেকে আলাদা? আমরা হাতে মেখে ভাত মুখে তুলি দেখলে অন্যদের চোখ কপালে উঠে যায়। কোনো বাঙালিকে কাঁটা-চামচে ভাত খেতে দেখলে যেমন আমাদের কাছে অতি বিচিত্র ও বিসদৃশ্য ঠেকে।
বাঙালি/বাংলাদেশীদের আচার-আচরণের বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে আমার হাই স্কুলে পড়ুয়া মেয়ে ও তার কয়েক বান্ধবীর পর্যবেক্ষণ থেকে একটি তালিকা করা গেছে। এদের প্রায় সবাই আমেরিকায় জন্মেছে অথবা অতি শিশুকাল থেকে এ দেশে বড়ো হয়ে উঠেছে এবং নিজেদের পছন্দে নয়, তাদের পিতামাতার কর্মফলে এক অদ্ভুত মিশ্র সংস্কৃতির প্রতিনিধি। আমাদের দেশীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনাচরণের সঙ্গে এদের আত্মীয়তা প্রায় দূর-সম্পর্কের, কিন্তু এরা নিজেদের একশোভাগ আমেরিকানও হয়তো কখনো বলতে পারবে না।
আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলে কিছু মানুষ তাদের জীবনাচরণ বিষয়ে হাস্যকরভাবে গোঁড়া ও সংস্কারাচ্ছন্ন এবং পৃথিবীর কোনো পরিবর্তনই তাদের কিছু-গোঁয়ার বা একরোখা এবং কিছু-অর্বাচীনসুলভ মনোভাব বদলাতে সক্ষম হবে না বলে মনে করা হয়। এ দেশে এরা 'রেডনেক' নামে পরিচিত। রেডনেক আসলে একটি বিশেষ মনোভঙ্গির পরিচয় (বহুকাল আগে স্কটল্যান্ডে শব্দটি প্রথম চালু হয়েছিলো, সে প্রসঙ্গ আলাদা)। আমেরিকার একটি টিভি চ্যানেলে জেফ ফক্সওয়র্দি নামের একজন কমেডিয়ানের জনপ্রিয় নিয়মিত শো-তে 'ইউ আর আ রেডনেক, ইফ ইউ...' বলে রেডনেকদের বৈশিষ্ট্যগুলো হাস্যকৌতুকের ঢঙে পরিবেশন করা হয়। আমেরিকায় বড়ো হওয়া এই প্রজন্মের বাঙালি (?) প্রতিনিধিদের পর্যবেক্ষণ-প্রসূত নিচের তালিকা তারই অনুকরণে তৈরি। তালিকাটি হালকা মেজাজের, তাতে কিছু সাধারণীকরণ ও অতিরঞ্জন থাকাও অসম্ভব নয়। তবু তাদের চোখ দিয়ে আমাদের চেহারাগুলি একটু দেখে নেওয়া যায়।
তুমি বাঙালি বা বাংলাদেশী, ...
১. ঘরের ভেতরে গন্ধ হবে বলে যদি তুমি বাড়ির বাইরে শুটকি রান্না করে পাড়া-প্রতিবেশীদের ঘ্রাণে (সুঘ্রাণ অবশ্য নয়) অর্ধ-ভোজনের (আসলে নাড়ি-ভুঁড়ি উল্টে যাওয়ার) ব্যবস্থা করো।
২. যদি একটি বাড়ির মালিক হওয়ামাত্র বাগানে গোলাপ-চারার আগেই কাঁচা মরিচের চারা রোপন করো (অ্যাপার্টমেন্ট হলে টবেও হতে পারে) এবং আহারের সময় গোটাকয়েক মরিচ তুলে এনে গৌরবদীপ্তভাবে বলতে পারো, 'আঃ, গাছের মরিচের স্বাদই আলাদা' (যেন দোকানে কেনা মরিচ গাছে জন্মায় না এবং তার স্বাদ মরিচের মতো মোটেই নয়)।
৩. যদি পঞ্চাশ ডলার খরচ করে (পরিচর্যার সময় ও পরিশ্রম বাদ দিয়ে) বাগানে গোটা চারেক টমেটো ফলাতে সমর্থ হও এবং সেই উপলক্ষে কিছু মানুষকে দাওয়াত করে পোলাও-কোর্মা খাওয়াও। তা টমেটো কোথায়? না, সালাদে!
৪. যখন ছেলেমেয়েদের জন্মদিনে তাদের সমবয়সী বন্ধুবান্ধবের তুলনায় কমপক্ষে তিনগুণ আমন্ত্রিত হয় তোমার নিজের বন্ধুবান্ধব।
৫. যখন তোমার বিনোদন বলতে দিনে সামপ্রতিক দুই-তিনটি হিন্দি ছবি এবং বাংলাদেশের টিভি সিরিয়াল/নাটক।
৬. যদি সামাজিকতা বলতে তুমি বোঝো শুধুমাত্র দাওয়াত করা এবং দাওয়াতে যাওয়া।
৭. বাঙালি/বাংলাদেশী হিসেবে তুমি খুবই গর্বিত হলেও পাশের বাড়ির আমেরিকানের সঙ্গে কথা বলার সময় তুমি কতোটা আমেরিকান হয়েছো, তার প্রমাণ দিতে যখন ব্যস্ত হয়ে ওঠো।
৮. যদি তোমার ছেলেমেয়েরা বাংলা শিখছে না বলে হা-হুতাশ করো, অথচ শেখানোর চেষ্টা নিজেরা কখনোই তেমনভাবে না করো, এমনকী তাদের সঙ্গে বাংলার বদলে ইংরেজিতে কথা বলো ('কাম অন সামি, ইউ ক্যান ডু ইট!')।
৯. যখন লুঙ্গি নামের মেয়েদের স্কার্ট-সদৃশ বস্ত্রটি নিয়ে পুরুষরা গর্ব করবে, কিন্তু তা পরে কখনো বাইরে যাবে না। আর মহিলারা শাড়ি যত্ন করে রেখে দেবে পার্টিতে পরবে বলে।
১০. যদি ভাতকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও একমাত্র আহার্য বলে মনে হয় এবং ছেলেমেয়েরা ভাত না খেলে তাদের আহার সম্পূর্ণ হলো না বলে তুমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করো।
১১. যদি বাড়িতে কোনো অতিথি আসার কথা থাকলে ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে প্রাণপাত করো।
১২. যদি আগত অতিথিকে বিদায় দেওয়ার সময় খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে আধ ঘণ্টা কথা বলতে হয় এবং দুই পক্ষ মিলিয়ে কমপক্ষে দশবার 'খোদা হাফেজ' না বলা পর্যন্ত বিদায়-পর্ব শেষ না হয়।
১৩. যখন তোমার ছেলেমেয়েকে সদ্যপরিচিত কারো সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও, 'এই তোমার অমুক আঙ্কল বা অমুক আন্টি' এবং ছেলেমেয়েরা বিস্মিত হয়ে ভাবতে থাকে, 'কী আশ্চর্য, আমাদের এতোগুলো আঙ্কল-আন্টি? এরা এতোদিন কোথায় ছিলো? আগে দেখিনি তো!'।
১৪. যদি তুমি কথা বলার সময় কোনো কোনো শব্দের সঙ্গে আপাত-অর্থহীন সমিল শব্দ ব্যবহার করো। যেমন : 'খাবার-টাবারগুলো তুলে রাখতে হবে। খেলা-টেলা শেষ হলে গোসল-টোসল করে নাও।' 'তোমার এতো অসুখ-বিসুখ হয় কেন?' 'ভাত-টাত যা আছে খেয়ে নাও, মাংস-টাংস আজ নেই, রান্না-বান্না করার সময় পাইনি।' 'বই-টই পড়ো, সময় কেটে যাবে।' 'তোমরা যে কেন বাংলা নাটক-টাটক দেখতে চাও না বুঝি না, হিন্দি সিনেমা-টিনেমা তো বেশ দেখো।' 'ফোন-টোন দেখি আজকাল করোই না।'
১৫. যদি তুমি ইংরেজি বলার সময় আস্তে আস্তে বোঝাতে গিয়ে বলো 'স্লোলি স্লোলি', অল্প অল্প বলতে 'লিটল লিটল'।
১৬. রিসাইকলিং বলতে যখন তুমি বোঝো তোমার পাঁচ বছর বয়সী ছেলের জন্মদিনে পাওয়া তার অপছন্দের উপহারগুলি (বেশিরভাগ সময়ই তা জামা-কাপড় বা বয়সোপযোগী খেলনা) এক কোণে জমিয়ে রাখা এবং সময়মতো আট বছরের কোনো বাচ্চার জন্মদিনে উপহার হিসেবে (জামা গায়ে না লাগুক বা খেলনা বয়সোপযোগী না হোক, কী এসে যায়?) গছিয়ে দেওয়া।
১৭. কোনো অতিথি আসার সম্ভাবনা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত যদি তোমার শৌখিন সোফাগুলো চাদর বা প্লাস্টিকের কভার দিয়ে ঢাকা থাকে।
১৮. বারবিকিউ-এর জন্যে আমন্ত্রিত হলেও যখন তুমি ভাতের খোঁজ করবে, গৃহকর্ত্রীকে ভাত রান্না করার জন্যে প্ররোচিত করবে এবং শেষমেশ বারবিকিউ ও ভাত দুটোই খাবে।
১৯. যখন তুমি ঘরোয়া কোনো সমাবেশে আমেরিকা বা বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতি নিয়ে তর্ক করবে, যদিও দুই দেশের কোথাও তোমার ভোট দেওয়ার সুযোগই হয়তো নেই (একটিতে অনুপস্থিত বলে আর অন্যটিতে হয়তো ভোটাধিকার এখনো হয়নি)।
২০. যদি উপার্জনের একটি অংশ তোমার খরচ হয় ফোন কার্ড কিনতে, যেহেতু তুমিই একতরফা ফোন করে যাবে তোমার আত্মীয়-বন্ধুদের এবং তারা তোমাকে ফোন করবে ক্কচিৎ-কদাচিৎ।
আর এর বাইরে একই শহরে দুই-তিনটি বাঙালি/বাংলাদেশী অ্যাসোসিয়েশন গঠনের কথা না হয় না-বলাই থাক!
Thursday, October 18, 2007
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment