Sunday, October 21, 2007

আরেকজন কেউ

ইতিহাস সাক্ষী, এককালে রাজা-বাদশাদের সিংহাসনে আরোহণের সময় নতুন নাম ধারণ করার রেওয়াজ ছিলো। আত্মাভিমানের আগুন উস্কে দেওয়া ছাড়া নতুন নাম আর কী কাজে লাগে! এই মার্কিন দেশে রাজা-বাদশার চল কোনোদিন ছিলো না। আমিন রাজ্যজয় করেনি, সিংহাসন থাকলে তবে আরোহণের প্রশ্ন। তবু নতুন একখানা নাম সে আজ ধারণ করেছে। ছদ্মবেশ নেওয়ার মতো।

জন্মসূত্রে পাওয়া নাম যে তার অপছন্দের ছিলো, তা নয়। আসলে নাম নিয়ে মাথা ঘামায়নি, কোনোদিন ঘামাতে হবে এমন সে ভাবেওনি। জীবনে কখন যে কী আবশ্যক হয়ে ওঠে, আগে থেকে জানার উপায় থাকে না। ফলে আমিন এখন আর আমিন নয়। পুরনো নাম বাতিল করে দিয়ে আজ থেকে নতুন নামের মানুষ সে। একেবারে কাগজে-কলমে। খোলস ছাড়লে সাপ অন্য কিছু হয়ে যায় না, সাপই থাকে। আমিনুল ইসলাম চৌধুরীর খোলস ফেলে ড্যানিয়েল রবার্টস নামধারণের কাগজপত্র নিয়ে কোর্ট বিল্ডিং-এর বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে হয়, কই, নিজেকে নতুন মানুষ বলে তো বোধ হচ্ছে না!

হওয়ার কথা যে নয়, তা-ও সে ভালোই জানে। পাড়ার দুদু ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। তখন আমিন ছোটো, ক্লাস থ্রি-ফোরে হবে। অসুখে পড়েছিলো দুদু ভাই, সুস্থ হয়ে ওঠার পর ত্বকের একটা পাতলা পরত আস্তে আস্তে উঠে যেতে শুরু করে। সাপের খোলসের মতো পুরো শরীরের আস্তরণ উঠে যাচ্ছিলো। গায়ের রং তার বেশ ফর্সাই, চামড়ার পরত উঠে গোলাপি রং দেখা দেয়। দেখলে কীরকম অস্বস্তি লাগে, গা-গোলানোর মতো হয়, বেশিক্ষণ তাকিয়ে দেখা যায় না। দুদু ভাই ক্রমে আগাগোড়া গোলাপি হয়ে গেলো। তারপরও কিন্তু দুদু ভাই অন্য কেউ হয়ে যায়নি।

স্মৃতিকাতর নয় আমিন, পুরনো কথা ভেবে উদাস হওয়ার কোনো মূল্য তার কাছে নেই। সময়ের অপচয়। ভাবালুতা। ওসব আমিনের জীবনে দরকারি উপাদান নয়, কোনো কাজে লাগে না। এখনকার এই মুহূর্তটি অনেক বেশি মূল্যবান, জরুরি। ভবিষ্যত সে অবশ্য ভাবে, নিজেকে প্রস্তুত করে। তবু কেন যে এখন হঠাৎ দুদু ভাইয়ের কথা মনে পড়লো, সে জানে না! তবে এইটুকু তার জানা আছে, মানুষের মন কখন কি ভাববে তার ওপর কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নিজের নাম বদলানোর ব্যাপারটার সঙ্গে দুদু ভাইয়ের গায়ের চামড়া উঠে যাওয়ার কোথাও একটা মিল পাওয়া যাচ্ছে বলে কি মনে পড়লো? নতুন নাম নিয়ে সে-ও অন্য কেউ হয়ে যায়নি। তবে নাম বদলের কাজটা যে দরকারি ছিলো, তা সে নিঃসংশয়ে জানে।

কোর্টে জাজ জিজ্ঞেস করেছিলো, তোমার নাম তো আমিনুল ইসলাম চাওড্রি।

হ্যাঁ।

নাম বদলাতে চাও কেন?

কাগজে-কলমে নতুন নাম ধারণ করতে কোর্টে যেতে হয় ঠিকই, তবে উকিল না নিলেও চলে। তবু আমিন একজন উকিলের পরামর্শ আগেই নিয়ে রেখেছিলো। যে কোনো কাজই যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে বুঝেশুনে সতর্কতার সঙ্গে করে সে, অপ্রত্যাশিত কোনো ঝামেলায় অপ্রস্তুত হওয়া তার পছন্দ নয়। উকিল জানিয়েছিলো, তুমি কেন নাম বদলাতে চাও এই প্রশ্নের বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যার ওপরে নির্ভর করবে বিচারকের অনুমোদন।
তৈরি ছিলো আমিন। পরীক্ষায় বসে উত্তর-জানা প্রশ্ন পেয়ে যাওয়ার মতো লাগে। ধীরেসুস্থে গুছিয়ে বলে, এই যে আমার নাম আপনি চাওড্রি উচ্চারণ করলেন, তা সঠিক নয়। শুদ্ধ উচ্চারণে হবে চৌধুরী। আমেরিকায় বাস করছি প্রায় আট বছর, আমার সিটিজেনশীপও হয়ে গেছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত এ দেশের একজন কাউকে পাইনি যে আমার নামের চৌধুরী অংশটা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারে। আপনি যে আমিনুল বললেন, সেটা অবশ্য ঠিক আছে। কিন্তু অনেকে ওখানেও হোঁচট খায়, বলে অ্যামানুল বা অ্যামিনুল, এমনকী অ্যামাইনাল শুনতেও অভ্যস্ত আমি। এ দেশে যেহেতু আমি স্থায়ীভাবে বসবাস করবো, নামটা পাল্টে ফেলাই ভালো মনে করি। এমন নাম চাই যা সবাই ঠিকমতো বলতে পারে। এ ছাড়া আর কোনো কারণ নেই।

এখনকার নামে তোমার কি কোনো ক্রিমিন্যাল রেকর্ড আছে যার জন্যে তুমি নাম পাল্টাতে চাও?

রুটিন প্রশ্ন। আমিন জানে, নাম পাল্টানোর আবেদন করে কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর মাস তিনেক ধরে পুলিশ ও এফবিআই রিপোর্ট নেওয়া হয়েছে, বিচারকের সামনে আছে সেসবের কপি। এই অনুসন্ধানের সুবাদে আমিনের যাবতীয় ইতিহাস-ভূগোল খুঁড়ে বের করা হয়ে গেছে। এ দেশে আসার পর থেকে সে কবে কোন ঠিকানায় বাস করেছে, কোথায় লেখাপড়া বা কাজ করেছে, কোনো বছরে ট্যাক্স না দেওয়ার ঘটনা আছে কি না, অপরাধমূলক কোনো তৎপরতার খবর আছে কি না, কবে বিয়ে বা বিচ্ছেদ - এইসব তথ্য দিনতারিখ ধরে ধরে নির্ভুলভাবে রিপোর্টে লেখা আছে। এখন এই প্রশ্ন করা হচ্ছে কোর্টের নথিতে তার জবাবটি নথিবদ্ধ করে রাখার জন্যে, যাতে ভবিষ্যতে কখনো তদন্তের কোনো তথ্যে ভুল পাওয়া গেলে কোর্টে শপথ করে মিথ্যা বলার দায়ে তাকে আটকে দেওয়ার সুযোগ থাকে। এসব আমিনের জানা, কাগজপত্র কোর্টে দাখিল করার আগে তার উকিল কম করেও পঞ্চাশবার প্রশ্ন করেছে, তোমার কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই তো?

সত্যি সত্যি সেরকম কোনোকিছু থাকলে নাম পাল্টানোর জন্যে কোর্টে যাওয়ার সাহস করা মুশকিল হতো। জাজের প্রশ্নের জবাবে সে ছোটো করে বলেছিলো, না নেই।

বাতানুকুল আদালত ভবনের বাইরে আসতেই আগুনের হলকার মতো উত্তাপ গায়ে লাগে। টেঙ্াসের গ্রীষ্ম এক নরক যন্ত্রণা, গায়ে ফোস্কা পড়ে যাওয়ার মতো অসহ্য গরম। ডালাস শহরে তবু কিছুটা ভালো, বাতাসে হিউমিডিটি কম। আগুন গরমের সঙ্গে হিউমিডিটি যোগ হলে কী হয়, বোঝা যায় আরো দক্ষিণে গালফ অব মেক্সিকোর কাছাকাছি হিউস্টন, কর্পাস ক্রিস্টি বা স্যান অ্যান্টোনিওতে। বাংলাদেশের গ্রীষ্মের ভ্যাপসা গরমের সঙ্গে তার অনেক মিল। শীতকালে এদিকে ঠাণ্ডা ভালোই পড়ে, বরফ-টরফ কদাচিৎ। হাড়কাঁপানো তীব্র হাওয়া না থাকলে শীত ততো অসহ্য মনে হয় না। বসন্ত আর শরৎকালের আবহাওয়া খুব চমৎকার, কিন্তু এ অঞ্চলে ওই দুই ঋতুর আয়ু বড্ড সংক্ষিপ্ত। বাল্যকালে স্কুলের বইয়ে পড়া ছয় ঋতুর বর্ষা আর হেমন্ত এ দেশে এসে নেই হয়ে গেছে। ঋতুবদল নিয়ে আমিন ওরফে ড্যানিয়েল ওরফে ড্যানির মাথাব্যথা বিশেষ নেই, যতোক্ষণ না শীত-গরমের তীব্রতা অসহনীয় হয়।

কোর্টে হাজিরা দেওয়ার জন্যে আজ স্যুট পরতে হয়েছিলো। পোশাক-আশাক বিষয়ে মনোযোগী আমিন, শৌখিনও। দামী ও নামী ব্র্যান্ডের স্যুট টাই শার্ট জুতা তার পছন্দ। কোথায় কোন পরিবেশে কি পোশাক পরতে হবে, এসব তার পরিষ্কার জানা। জি কিউ নামের ফ্যাশন ম্যাগাজিন এসব শিখিয়েছে তাকে। এই একটিমাত্র পত্রিকা সে নিয়মিত কেনে। জীবনের সর্বত্র সফলতার জন্যে পোশাকের একটি বড়ো ভূমিকা আছে, এ বিষয়ে তার কোনোরকম সংশয় নেই। আজ এই বিষ-গরমে এখন কাজ ফুরিয়ে যেতে পছন্দের স্যুটও অসহ্য বোধ হয়। একটা সিগারেট পেলে বেশ হতো। সিগারেটের নেশা নেই, মাঝেমধ্যে দু'একটা টানতে মন্দ লাগে না। এই যেমন এখন একটি কাজ সম্পন্ন করতে পারার তৃপ্তিতে খেতে ইচ্ছে করছে। কোট খুলে হাতে ঝুলিয়ে আমিন গাড়ি পার্কিং লটের দিকে হাঁটে।

গাড়ির ভেতরে ঢুকে টেক্সাসের গরমের নমুনা আরেকবার টের পাওয়া যায়। খোলা আকাশের নিচে ভরদুপুরের রোদে পার্ক করে রাখা গাড়ির ভেতরটা আগুন হয়ে আছে। এই গরমে গাড়িতে রাখা সিডি বা ক্যাসেট গলে-দুমড়ে যায়। কয়েকটি গ্রীষ্ম এখানে অতিবাহিত করতে পারলে ভালোই অভ্যাস হয়ে যাবে, পরকালে দোজখের আগুনেও বিশেষ কষ্ট হবে না। কোটটা পেছনের সীটে ছুঁড়ে দেয় আমিন। হাতের কাগজপত্রগুলো পেছনের সীটে নামিয়ে রাখে। গলার টাই আলগা করে গাড়িতে স্টার্ট দিতে গিয়ে মনে পড়ে, বেশ অপ্রাসঙ্গিকভাবে জাজ জিজ্ঞেস করেছিলো, তোমার বাপ-মায়ের দেওয়া নাম বদলে দেবে?

কোর্টে এই ধরনের প্রশ্ন করার কথা নয়। গত কয়েক বছরে আমিন দেখেছে, বাপ-মায়ের মতো সেন্টিমেন্টাল জিনিস নিয়ে এখানে কেউ তেমন মাথা ঘামায় না। ফাদারস ডে মাদারসে ডে খুব ঘটা করে পালন করা হয়, ফ্যামিলি ভ্যালু্জ-এর কথা দেশের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে সবাই বলে। অথচ আঠারোয় প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া হয়ে গেলে ছেলেমেয়েরা পৈত্রিক বাড়ি ছেড়ে উড়াল দেয়, তারপর বাপ-মায়ের খোঁজ তেমন আর নেয় কে! একেবারে অথর্ব-অসমর্থ হলে বুড়োবুড়িরা বয়স্কদের হোমে বসে পুত্রকন্যার সম্ভাব্য ভিজিটের এবং ভবনদী পার হওয়ার দিন গোনে।

প্রশ্ন শুনে আমিনের মনে হয়েছিলো প্রাচ্য দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে জাজের কিছু পরিচয় আছে। থাকতে পারে, কিন্তু জাজকে পাল্টা প্রশ্ন করার নিয়ম নেই। ঘরোয়া আলাপ হলে আমিন বলতে পারতো, বাপ আমার জীবনের কোনোকিছুতেই নেই গত বিশ বছর। মা-সহ আমাদের দুই ভাইবোনকে যে লোকটি ত্যাগ করে যেতে পেরেছে, তার দেওয়া নামের জন্যে আমার মোহ থাকবে কেন? পিতা বিহনে পৈত্রিক পদবীই বা কী কাজে লাগবে আমার? সে নাম বয়ে বেড়াতে হবে, তারও কোনো মানে নেই।

কোর্টরুমে এরকম জবাব প্রাসঙ্গিক হয় না। বিচারকের মুখের দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বলেছিলো, হ্যাঁ, নির্বিঘ্নে।

নাম বদলের আসল কারণ জাজের কাছে বলা সম্ভব ছিলো না। শুধু জাজ কেন, কেউ যে বুঝবে এমন ভরসাই তার নেই। বললে পাগল ভেবে তার দিকে হয়তো হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে বলতে গিয়ে টের পেয়েছে, তার যুক্তি কারো মাথায় ঢুকছে না। কেউ কেউ হাসিঠাট্টাও করে। নিউ ইয়র্কে মাকে ফোন করে অবশ্য জানিয়েছে সে। মা আপত্তি করবে না, আমিনের জানা ছিলো। মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক ঠিক বন্ধুর মতো নয়, তবু মায়ের কাছে সে সব কথা বলে। কোনোকিছু গোপন না করা, অযথা স্বপ্নে না ভেসে মাটিতে পা ফেলে ফেলে হাঁটার শিক্ষা মায়ের কাছেই পাওয়া। জীবনের প্রথম সাত-আট বছর ছাড়া সারজীবনই মায়ের কাছছাড়া সে। এখনো হাজার-বারোশো মাইলের ব্যবধানে দুই আলাদা শহরে বাস। বহু বছর দূরে থাকার ফলে কিছু দূরত্ব তৈরি হয়ই। মায়ের ব্যক্তিত্বও একটা বাধা বটে, খুব কাছে ঘেঁষা যায় না। লেখাপড়া খুব বেশি করেনি, তবু দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে মা একা একা লড়াইটা ভালোই করেছে এতোগুলি বছর ধরে।

মায়ের সঙ্গে বাবার বিচ্ছেদ কি কারণে হয়েছিলো, আমিন আজও জানে না। মা বলেনি, বাবার সম্পর্কে নিন্দাসূচক কোনো কথাও মায়ের মুখে কখনো শোনা যায়নি। বাবাকে তার ভালো করে মনে নেই। সংসারের সেই ভাঙচুরের সময় আমিনের বয়স পাঁচ, বোন রিয়ার আড়াই। তার বছর দুয়েকের মধ্যে রিয়াকে নিয়ে আমেরিকা পাড়ি দেয় মা। আমিন থেকে যায় মামাবাড়িতে। নিঃসন্তান মামা-মামীর কাছে আদর-যত্নের অভাব হয়নি। তবু বাবা বলে ডাকার মতো কেউ তার জীবনে ছিলো না। মা বলতে অনুপস্থিত একজন ছিলো, যে প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে চিঠি লিখতো, কালেভদ্রে ফোনে তার গলা শোনা যেতো। ফোন করে মা বলতো, আমাকে মা বলে একবার ডাক তো, বাবা। সেইসব সময়ে ফোনের ওপাশের মানুষটিকে আমিনের প্রাণভরে মা ডাকার বাসনা হতো, অথচ কিছুতেই পেরে ওঠা যেতো না। প্রতিমাসে মা টাকা পাঠাতো আমিনের খরচবাবদ। মামা-মামী দুয়েকবার আপত্তি করলে মা ঠাণ্ডা গলায় জানিয়ে দিয়েছিলো, আমার ছেলেকে তাহলে কোনো হোস্টেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হয়। এই হলো মা, ধনুকে লাগানো তীরের মতো সোজা ও একমুখী, কোনোদিন ভাঙেনি।

আচ্ছা, মা এখন তাকে ড্যানি নামে ডাকবে নাকি? কী করে সম্ভব? হাস্যকর, অবাস্তব ও উদ্ভট লাগে। মায়ের কাছে সে আমিনই থেকে যাবে চিরকাল। পুরনো বাঙালি বন্ধুদের কাছেও তাই। কেউ কেউ কখনো ঠাট্টা করে রবার্টস সাহেব বলে সম্বোধন করবে। এইসব ঠাট্টা বোঝার ও সহ্য করার মতো পরিপক্কতা তার আছে, চিন্তার কিছু নেই। নাম বদলে তাহলে হলোটা কি? এই প্রশ্নের উত্তর তার স্পষ্ট জানা আছে।

এ দেশীয় পরিচিত বা বন্ধুবান্ধব যারা আছে এবং কাজের সূত্রে যাদের সঙ্গে পরিচয় সেগুলো অস্থায়ী। লেখাপড়া শেষ হলে, কাজকর্ম বদলে ফেললে তাদের সঙ্গে এখনকার এই পরিচয়ের সব সূত্র চিরদিনের জন্যে টুটে যাবে। সেসব নিয়ে ভাবার কোনো মানে হয় না। আমিনের পড়াশোনা শেষ হতে একটা সেমেস্টার আর বাকি। তারপরে চাকরি-বাকরির খোঁজখবর শুরু করতে হবে। দেখেশুনে সে স্থির সিদ্ধান্তেএসেছে - আমিনুল আই চৌধুরী শিরোনামে রেজ্যুমে পাঠিয়ে চাকরির আশা অনেকটাই দুরাশা। নাম দেখে কেউ ইন্টারভিউয়ের জন্যেও ডাকবে না।

এ দেশে চাকরিদাতারা সবাই নিজেদের সগর্বে ইকুয়াল অপরচু্যনিটি এমপ্লয়ার, অর্থাৎ সবার জন্যে চাকরির সমান সুযোগদাতা হিসেবে ঘোষণা করে থাকে। আইন বলছে চাকরির ক্ষেত্রে গাত্রবর্ণ, ধর্ম, বয়স, লিঙ্গ বা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে কারো সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না, কাউকে বঞ্চিত করা চলবে না। আমিন জানে, আইনের বুলিটি কাজীর গরু - খাতায় ঠিক ঠিক আছে, গোয়ালে খুঁজলে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। কাউকে আমার পছন্দ না হলে চাকরি দেবো না, তার জন্যে একশো একটা কারণ তৈরি করে ফেলতেও অসুবিধা নেই, কীভাবে সেটিকে বৈষম্যমূলক বলে প্রমাণ করা যাবে? কারো বাবার সাধ্য নেই তা করে।

বাঙালি বা ভারতীয় নাম নিয়ে এ দেশে কেউ চাকরি পাচ্ছে না, তা নয়। অনেকে সুযোগ পায়, ভালো চাকরিও করে। কিন্তু সেগুলো যে ব্যতিক্রম নয়, তাই বা কে বলবে? সে এ দেশীয়দের দোষ দেয় না। ওদের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে সে দিব্যি দেখতে পায়, আমিনুল আই চৌধুরী আর ড্যানিয়েল রবার্টস-এর রেজ্যুমে হাতে পেলে ড্যানিয়েলেরটাই আগে তুলে নেবে এবং পছন্দ হয়ে গেলে আমিনুল আর কোনো মনোযোগ পাবে না, যোগ্যতা যা-ই থাক না কেন। আমিন এই বাস্তবতা জানে এবং মানে। পুতু পুতু সেন্টিমেন্টের বাঙালি সে নয়, সেসবের মূল্যও তার কাছে নেই। এ দেশে টিকতে হলে তাকে লড়াই করতে হবে এবং জেতার জন্যে উপযুক্ত রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সে নিজেকে প্রস্তুত করতে চায়।

নতুন নাম চাকরির বাজারে তাকে কিছু সুবিধা দেবে, সে জানে। ইন্টারভিউতে চাকরিদাতার মুখোমুখি একবার হতে পারলে মেরেকেটে বেরিয়ে যাওয়ার যোগ্যতা সে ধরে। লেখাপড়ায় অসাধারণ না হলেও সাধারণের কিছু ওপরে সে, নিজেকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে ও আস্থার সঙ্গে উপস্থাপন করার মতো আত্মবিশ্বাস ও চেহারা আছে, গুছিয়ে কথা বলতে জানে এবং সর্বোত্তমভাবে নিজেকে তুলে ধরার কৌশলগুলো তার আয়ত্ত্বে। শুধু শুধু নামের খিটিমিটিতে বাদ পড়ে যেতে সে রাজি নয়।

আমিন দৈর্ঘ্যে ছ'ফুট দুই, সাধারণ বাঙালি ছেলেদের তুলনায় গাত্রবর্ণে অনেক উজ্জ্বল। নিজেকে ককেশিয়ান বলে চালিয়ে দেওয়া অবশ্য সম্ভব নয়। কিন্তু সে জানে, নতুন নামের সঙ্গে চেহারা মিলিয়ে দেখে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করবে না। করলেও, কাটা কাটা ধারালো নাকমুখের চেহারায় ইটালিয় বা গ্রীক বংশোদ্ভুত হিসেবে পার পেয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। প্রয়োজনের চাতুরিকে সে অন্যায় মনে করে না, এগুলি তার যুদ্ধের কৌশল ও অস্ত্র।

পার্কিং-এর পয়সা দেওয়া ছিলো। ডাউনটাউনে পয়সা দিয়ে গাড়ি পার্ক করতে হয়। এ শহরের প্রায় সর্বত্র বিনা পয়সায় গাড়ি পার্ক করে রাখা যায়। কালেভদ্রে কোনো কাজে ডাউনটাউনে আসা হয়, তখন পার্কিং-এর পাঁচ-ছয় ডলার গায়ে লাগে। অথচ নিউ ইয়র্কে দেখেছে ঘাটে ঘাটে পার্কিং-এর পয়সা দাও, টোল দাও। এমনকি, রাতে বাড়ির সামনে গাড়ি রাখার জন্যেও মাসকাবারি দিতে হয়।

পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে রাস্তায়। গাড়ির এয়ারকন্ডিশনার এখনো গরম বাতাস উদগীরণ করছে, ঠাণ্ডা হতে আরো কিছু সময় লাগবে। দু'পাশে বিশাল বিশাল বিল্ডিং-এর মাঝখানে ডাউনটাউনের রাস্তাগুলোও ধাঁধার মতো জটিল। রাস্তা আসলে অপ্রশস্ত নয়, দু'পাশের দালানগুলোর বিশালত্বের কারণে তাদের সরু ও অকিঞ্চিৎকর দেখায়। নেহাত দরকার না পড়লে এদিকে আসা হয় না বলে রাস্তাগুলোর সঙ্গে তেমন পরিচয় নেই। সামান্য দূরত্বে একেকটা সিগন্যাল লাইট, ভালো করে খেয়াল না করলে রেডলাইট মেরে দেওয়ার এবং তার প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে পুলিশের হাতে ট্রাফিক টিকেট পাওয়ার সম্ভাবনা। বেশিরভাগ রাস্তা ওয়ান ওয়ে, সুতরাং সতর্ক থাকতে হয় যাতে ভুল টার্ন না নিয়ে ফেলে।

কেমন করে কীভাবে আমিন জানে না, কোনো ঝামেলা ছাড়াই হাইওয়ে সেভেনটি ফাইভের সাইন দেখতে পায়। এই হাইওয়ে ধরে তাকে ফিরতে হবে। এতো সহজে আগে কোনোদিন ডাউনটাউনের জটিল ধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি সে। নতুন নামের গুণ নাকি? হাইওয়ে এখন গাড়িতে গাড়িময়। ড্যাশবোর্ডে ঘড়িতে দেখে, সাড়ে বারোটা। লাঞ্চ আওয়ারের ভিড়।

নাম বদলের ফয়সালা হয়ে যাওয়ায় নতুন কিছু কাজ তৈরি হলো। ভাবতে মজা লাগে কাজগুলি আসলে ড্যানির, আমিনের নয় আর। নতুন নামে ড্রাইভারস লাইসেন্স ও সোশ্যাল সিকিউরিটি কার্ড করতে হবে। এগুলো আজই সেরে ফেলা যায়। সোশ্যাল সিকিউরিটি অফিস ফেরার রাস্তায় পড়বে, ড্রাইভারস লাইসেন্সের জন্যেও খুব দূরে যেতে হবে না। এই দুটো যতো তাড়াতাড়ি করা যায় ততো ভালো। এখানকার জীবন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা এই দুটি নম্বরে, যত্রতত্র দরকার পড়ে। এগুলি তোমার পরিচয়, যা শুধু তোমারই জন্যে বরাদ্দ, আর কাউকে এই নম্বর দুটো কখনো দেওয়া হবে না। চাকরি খুঁজতে গেলে দুটোই লাগবে, ব্যাংকে টাকা তুলতে বা কোথাও কেনাকাটার পরে চেক লিখলে পরিচয়পত্র হিসেবে ড্রাইভারস লাইসেন্স দরকার হবে। স্কুলে এবং কাজে নাম বদলের খবর জানাতে হবে অবিলম্বে। নতুন নামে পে চেক আসার আগে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ঠিক করাও জরুরি। ক্রেডিট কার্ডগুলো নতুন নামে ইসু্য করানোর জন্যে ফোন করো। অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে লীজের কাগজে নতুন নাম বসিয়ে নাও। পাসপোর্ট নতুন করে ইস্যু করাও। আরো অনেককিছু নিশ্চয় আছে, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না সব। আস্তে আস্তে পড়বে।

এই সামারে আমিন ক্লাস নেয়নি, টানা তিন সেমেস্টার ক্লাস করে হাঁপিয়ে উঠেছিলো। শুধু লেখাপড়া নয়, কাজও করতে হয় ফাঁকে ফাঁকে। পুরো গ্রীষ্মে কাজ করে টাকাপয়সার ব্যাপারটা খানিক গুছিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে। পার্টটাইম কাজ করে পড়াশোনা করতে গেলে খরচ চালানোর জন্যে ক্রেডিট কার্ডগুলোর ওপর খুব নির্ভর করতে হয়। ওগুলোতে ধারের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে, কমিয়ে আনা দরকার। লেখাপড়ার খরচের জন্যে অবশ্য তাকে অন্য অনেকের মতো নিজের রোজগারের ওপর পুরোটা নির্ভর করতে হয় না, গত বছর সিটিজেনশীপ হয়ে যাওয়ার সুবাদে সে সরকারি স্টুডেন্ট লোন নিতে পেরেছে। সরকারি টাকায় পড়াশোনা শেষ করো, তারপর চাকরি পেলে সুদসহ দীর্ঘমেয়াদী কিস্তিতে সেই ঋণ শোধ করে দিও।

শোনা কথা, একটা সময় নাকি ছিলো যখন এ টাকা ফেরত না দিলেও চলতো। ঋণগ্রহীতা সুবিধাজনকভাবে অনায়াসে ধারের ব্যাপারটা ভুলে যেতে সক্ষম হতো, সদাশয় সচ্ছল সরকারও বিশেষ গা করতো না। গত কয়েক বছরে রেগ্যান বাবা কোল্ড ওয়ার, স্টার ওয়ারে অকাতরে টাকা খরচ করেছে। ফলে এখন আমেরিকার সরকারি তহবিলে টানাটানি আর বিশাল ঘাটতির গহ্বর, গরিব ছাত্রদের টাকা ধার দিয়ে সরকার এখন আর ভুলে থাকতে পারছে না।

তা হোক, ধারের টাকা ফেরত দিতে হবে, তাতে আমিনের আপত্তি কিছু নেই। এ দেশে বসবাস করতে গেলে তিন মামুর সঙ্গে ঝামেলা এড়িয়ে থাকা ভালো, সে জানে। পুলিশ বাহিনী বাঙালির কাছে ছোটো মামু হিসেবে পরিচিত, মেজো মামু সরকারের ট্যাক্স বিভাগ আর ইমিগ্রেশন মামুটি সবার বড়ো। স্টুডেন্ট লোনের সঙ্গে জড়িত মেজো মামু। মামুরা কেউ জনপ্রিয় নয়, কিন্তু অপরিমেয় ক্ষমতার অধিকারী তারা, মুহূর্তে যে কারো জীবনকে নরকতুল্য করে তুলতে সক্ষম, সুতরাং তাদের সমীহ করা খানিকটা বাধ্যতামূলক বটে।

ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট করে আমেরিকায় এসেছিলো আমিন। ডুরান্টে সাউথইস্টার্ন ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটির আই-টুয়েন্টিতে ভিসা পেতে ঝামেলা কিছু হয়নি। টোয়েফল করা ছিলো। একা নয়, আরো জনাদশেক একঝাঁকে এসেছিলো তারা। আরো কেউ কেউ অন্যান্য ইউনিভার্সিটিতে যায়। পড়াশোনার সঙ্গে কাজ না করে উপায় নেই, ছোটো শহর ডুরান্টে কাজকর্মের সুবিধা বেশি ছিলো না। তিন বছরের মাথায় ইউনিভার্সিটি বদল করে সে ডালাসে চলে আসে। বড়ো শহর ডালাসে কাজের সুযোগ অনেক বেশি। পছন্দ না হলে সকালে কাজ ছেড়ে বিকেলের মধ্যে আরেকটা জোগাড় করে ফেলা যায়। তখন রেগ্যানের দ্বিতীয় বছর। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার দ্বিতীয় টার্মও প্রায় শেষ হয়ে এলো, আমিনের গ্র্যাজুয়েশন এখনো শেষ হলো না। এখন কাজের বাজার যথেষ্ট খারাপ, তবে একেবারে দুর্লভ নয়।

একটানা পড়াশোনা করা আসলে সম্ভব ছিলো না। হাতের পয়সাকড়ি শেষ হতে জীবনধারণের জন্যে, লেখাপড়ার টাকা সংগ্রহের জন্যে চাকরি করতে হলো, পয়সা জমিয়ে হয়তো একটা সেমেস্টার গেলো, তারপর আবার কাজ করো। আমিনের তবু সান্ত্বনা, প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তার। একসঙ্গে আসা বন্ধুদের অনেকে এখনো অনেক পিছিয়ে, কেউ কেউ পড়াশোনা থেকে একেবারে ছিটকে পড়েছে, আর ফিরতে পারবে বলে মনে হয় না।

আমিন আজ ছুটি নিয়ে রেখেছিলো কাজ থেকে, কোর্টে কতোক্ষণ লাগবে জানা ছিলো না। সোশ্যাল সিকিউরিটি আর ড্রাইভারস লাইসেন্স অফিসের কাজগুলো সারতে তেমন সময় লাগে না। নতুন নামসহ সেগুলো ডাকে এসে পড়বে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে। ড্রাইভারস লাইসেন্স-এর ছবি তোলার জন্যে দাঁড়িয়ে তার মনে হয়, আমিনুলের ছবি দিয়ে ড্যানিয়েল রবার্টসের লাইসেন্স হচ্ছে। ভালোই তো।

সারাদিন হাতে আর কোনো কাজ নেই। করতে চাইলে অবশ্য অনেকই আছে। ঘরে ময়লা কাপড় সতূপ হয়ে জমে আছে, ফিরে গিয়ে লন্ড্রি করা যায়। গাড়ির ভেতরটা রাজ্যের জঞ্জালে জঙ্গল - ফাস্ট ফুডের পরিত্যক্ত শূন্য ঠোঙা আর কোকের কাপ, ডাকবাক্স থেকে এনে রাখা দরকারি ও জাঙ্ক মেলসহ আরো বহুবিধ কাগজপত্র, গোটা দুয়েক টাই, জিমব্যাগ ও বাস্কেটবল, এমনকি হেয়ারব্রাশ ইতস্তত ছড়ানো গাড়ির সীটে এবং ফ্লোরে। পরিষ্কার করা দরকার। বাসায় অনেক কাগজপত্র ছড়িয়ে আছে, সেগুলো বাছাই করতে হবে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নির্দিষ্ট ফোল্ডারে ভরে গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করে সে - কখন কোনটা কাজে লেগে যাবে কে জানে!

হাইওয়ে থেকে বেরিয়ে গাড়ি ঘোরায় আমিন। খিদে পেয়েছে, আসাদকে তার স্টোরে পেলে একসঙ্গে লাঞ্চ করা যায়। একটা কনভেনিয়েন্স স্টোরে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আসাদ। ডুরান্টে আমিনের সঙ্গে একই সময়ে এসেছিলো। প্রথম সেমেস্টারের মাঝামাঝি পর্যন্ত পৌঁছে লেখাপড়ায় হাঁপিয়ে যায় আসাদ, আর ফিরে যায়নি। ইচ্ছেও নেই আর। এ দেশী বউ বিয়ে করেছে, কিন্তু বউই তার একমাত্র সমস্যা নয়, আরো অনেক রকম ঝামেলায় আছে সে।

আসাদকে পাওয়া যায় না, সে আজ আগেভাগে চলে গেছে কী একটা দরকারে। কমবয়সী একটি বাঙালি ছেলে কাজ করছিলো, আসাদই ঢুকিয়েছে। আমিনকে চেনে সে। জানায়, আসাদ ভাই আইজ আর আইবো না।

আমিন জিজ্ঞেস করে, কাইল অর কাম কখন, জানো?

তা কইতে পারি না। খাড়ান, স্কেজুল দেইখ্যা আসি।

দরকার নাই, অরে আমি ফোন করুম রাইতে।

আমিন বেরিয়ে আসছিলো। ছেলেটি জিজ্ঞেস করে, কোক-টোক কিছু খাইবেন না, আমিন ভাই?

এইসব দোকানে কোক-পেপসি এসবের বোতল বা ক্যানের হিসেব রাখা হয়, ফাউন্টেন মেশিনের ড্রিঙ্কের হিসেব রাখা অসম্ভব। বিনা পয়সায় এক কাপ কোক কাউকে সাধা দোষের কিছু নয়। টহল দেওয়া পুলিশদের জন্যে বিনা পয়সার ফাউন্টেন ড্রিঙ্ক বা কফি দেওয়ার রেওয়াজ আছে এইসব দোকানে। আমিন না-সূচক জবাব দিয়ে বেরিয়ে আসে। মনে মনে হাসে, তুমি তো মিয়া আমারে চিনতেই পারলা না। কারে তুমি আমিন ভাই ডাকো? আমি কিন্তু আর আমিন না, ড্যানি। বুঝছো, আমার নাম ড্যানি।

বাসায় ফিরে দ্রুত কাপড় ছেড়ে ফেলে আমিন। ঘামে ভেজা কাপড় অসহ্য লাগছিলো। শর্টস আর একটা টী-শার্টের মধ্যে ঢুকে অনেক আরাম বোধ হয়। দুপুর রোদের তীব্র উত্তাপে গাড়ির এয়ারকন্ডিশনার অপ্রতুল লাগছিলো। ঘরে এয়ারকন্ডিশনার সারাক্ষণ চালু থাকে বলে বাসার ভেতরটা অনেক ঠাণ্ডা। বেডরুমে রুমমেট শাফিন ঘুমিয়ে আছে, কাল রাতে কাজ ছিলো তার। সকালে ফিরেছে, তখন আমিন কোর্টে যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে।

শাফিন জিজ্ঞেস করেছিলো, আইজ তাইলে তোমার ড্যানিয়েল রবার্টস হওনের দিন! ভালোই হইবো, সবাইরে কইতে পারুম, জানস ব্যাডা আমেরিকান রুমমেটের লগে থাকি!

আমিন শব্দ করে হাসে। বলে, আরে মিয়া আমেরিকার ভিতরে আমেরিকান রুমমেট যে কেউ পাইতে পারে, তুমি কইবা গ্রীক।

গ্রীক কইলে মাইনষে আবার চরিত্র লইয়া, তোমার আমার সম্পর্ক লইয়া চিন্তায় পইড়া যাইবো না!

শাফিনের রসবোধ খুবই উপভোগ করে আমিন। কিন্তু মাঝেমধ্যে আবার রুমমেটটি কী কারণে যেন খুব গম্ভীর হয়ে থাকে, কথাবার্তা বিশেষ বলে না, বললে ঠিকমতো উত্তরও দেয় না। এসবকে অবশ্য আমিন বেশি গুরুত্ব দেয় না, মানুষের এরকম হতেই পারে - সবাই কি আর এক রকম হয়?

শাফিন এ দেশে এসেছে মোটে বছর দুই। ঢাকায় পরিচয় ছিলো না, তাকে কখনো দেখেনি আমিন। শাফিন আসলে আসাদের বন্ধু, এখানে এসে প্রথম উঠেছিলো ওর ওখানে। মাসখানেক পরে আমিনের রুমমেট হয়ে উঠে এসেছে। শাফিন এসেছে টু্যরিস্ট ভিসায়। এসেই ঘোষণা দিয়েছিলো, কলম্বাস আমেরিকা আইসা ফিরত গেছিলো, আমি কিন্তু যাইতেছি না!

যতোদূর শুনেছে, ঢাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যে গোড়ার দিকে সে ভালোই করছিলো। পরে বড়ো একটা ধাক্কা খেয়ে আর সামলাতে পারেনি, বিপুল ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে এবং একরকম কপর্দকশূন্য অবস্থায় দেশছাড়া হয় শাফিন। এসে অবধি সে দুটো কাজ করে দেশে টাকা পাঠায় নিয়মিত, ধার শোধ হচ্ছে। এখানে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার উপায় খুঁজছে। বন্ধুবান্ধবের পরামর্শ, কোনোভাবে স্থানীয় কোনো মেয়েকে বিয়ে করে ফেলা তার জন্যে একমাত্র উপায়।

কয়েক বছর আগে হলেও ব্যাপারটা অনেক সোজা ছিলো। তখন পয়সা দিয়ে মৌখিক চুক্তিতে কাগজের বউ পাওয়া যেতো। কাউন্টি অফিস থেকে বিয়ের লাইসেন্স নিয়ে কোর্টে বিয়ে করা কোনো ব্যাপার নয়। কাগজে কলমে নামকা ওয়াস্তে বিয়ে দেখিয়ে খুব কম সময়ে গ্রীন কার্ড পাওয়া যেতো। ঘটনা টের পেয়ে এখন ইমিগ্রেশন নিয়ম পাল্টেছে। বিয়ে করে আবেদন করলে এখন অস্থায়ী গ্রীন কার্ড দেয় বটে, দু'বছরের মাথায় আরেকবার বউসহ ইন্টারভিউ নিয়ে সন্তুষ্ট হলে তবে স্থায়ী গ্রীন কার্ডের ব্যবস্থা। এখন সমস্যা হলো, কাগজের বউদের লম্বা দু'বছর ধরে রাখা কঠিন। যদি থাকেও, দু'বছরে বউয়ের টাকার দাবি মেটাতে জান বেরিয়ে যাবে। টাকা দাও, না হলে ফাঁসিয়ে দেবো। তা ছাড়া স্থায়ী গ্রীন কার্ডের ইন্টারভিউয়ের সময় ইমিগ্রেশন অফিসাররা আলাদা ইন্টারভিউ নেয়। আলাদাভাবে দু'জনকে খুবই ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে উত্তরগুলো মিলিয়ে দেখে, বিয়েটা সত্যিকারের না শুধুই কাগুজে। বিছানার কোন পাশে কে ঘুমায়, কার টুথব্রাশের রং কি এইসব প্রশ্ন। উত্তরে সন্তুষ্ট না হলে গ্রীন কার্ড দূরে থাক, ডিপোর্ট করেও দিতে পারে।

শাফিন এমনিতে একটু লাজুক ধরনের। মেয়েঘটিত বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা খুব একটা কিছু আছে বলে আমিনের মনে হয় না। আমিন বারদুয়েক তাকে ক্লাবে-বারে নিয়ে গেছে। এসব জায়গায় কারো সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলা কোনো সমস্যা নয়। এ বিষয়ে আমিনের অভিজ্ঞতা অফুরান, দক্ষতা ঈর্ষা করার মতো। সে নিজে উদ্যোগ নিয়ে কিছু মেয়ের সঙ্গে শাফিনের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলো। বারে বসে অপরিমেয় পানীয় গলায় নামাতে শাফিনের কোনো সমস্যা নেই, সেখানে তার দক্ষতা আমিনের চেয়েও বেশি। আলাপের পরে মেয়েদের সঙ্গে অনর্গল কথা বলতেও শাফিনের অসুবিধা কিছু হয় না। কিন্তু নখদন্তহীন সেসব আলাপ কোনো ফল দেয়নি। যাকে নকআউট পাঞ্চ বলে, অথবা বাংলায় যাকে ওস্তাদের মার বলা হয় - তা শাফিনের এখনো আয়ত্ব হয়নি। নতুন কারো সঙ্গে আলাপ পরিচয় করে সম্পর্ক তৈরি করতে গেলে সময় বিনিয়োগ করা দরকার। দিনরাত কাজের পরে সম্ভাব্য বউয়ের সন্ধান সে করে কখন?

বাসায় ফেরার পথে আমিন বারগার কিং থেকে দুটো চিকেন স্যান্ডউইচ কিনে এনেছিলো। ঠোঙা থেকে একটা তুলে নেয়, ফ্রিজ খুলে কোকের ঠাণ্ডা ক্যান বের করে খাওয়ার টেবিলে বসে। শাফিনের ঘরের দরজা বন্ধ, তার মানে এখনো ঘুমিয়ে। উঠলে বাকি স্যান্ডউইচটা মাইক্রোওয়েভে গরম করে খেতে পারবে। খাবারে কামড় দিয়ে এক ঢোক ঠাণ্ডা কোক গলায় ঢেলে আমিন কিচেন কাউন্টারে, খাবার টেবিলে, টিভি স্ট্যান্ডে, মাইক্রোওয়েভের ওপরে দফায় দফায় জমিয়ে রাখা কাগজপত্রগুলো টেনে নিয়ে বাছাই করতে শুরু করে। গত কয়েকদিনের না খোলা মেলের একটার ওপর চোখ আটকে যায়। ডুরান্ট থেকে এসেছে, প্রেরকের জায়গায় এক উকিলের অফিসের ঠিকানা। উকিলের নামটা চেনা চেনা, কিন্তু ঠিক মনে করতে পারে না। ডুরান্ট ছেড়েছে সে আজ পাঁচ বছর, তারপর বলতে গেলে সেখানকার সবকিছু সে খানিকটা নিজের কাছ থেকেও আড়াল করে রেখেছিলো। ভাবেনি সেসব নিয়ে, ভাবতে চায়নি। আসলে প্রয়োজনও কিছু পড়েনি। চিঠি তুলে নিয়ে না খুলেই বোঝার চেষ্টা করে, ব্যাপারটা কী হতে পারে! আচমকা মনে পড়ে যায়, ক্রিস্টির সঙ্গে ডিভোর্সের সময় দু'জনে এই উকিলের কাছে গিয়েছিলো। সেসব চুকে গেছে কবে, এখন আবার চিঠির দরকার হলো কীসে? আমিনের এখনকার ঠিকানাও তার কাছে থাকার কথা নয়। একটু অবাক হয় সে। কৌতূহলীও।

এক ধরনের অচেনা ও বাজে উৎকণ্ঠা নিয়ে সে চিঠি খোলে। উকিল জানাচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনায় ক্রিস্টির মৃত্যু হয়েছে কয়েক মাস আগে। আমিনের বর্তমান ঠিকানা জানা না থাকায় অনুসন্ধান করে তার খোঁজ পেতে বিলম্ব হয়েছে বলে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। ক্রিস্টির এক লক্ষ ডলার অংকের জীবনবীমা করা ছিলো। সেই টাকার অর্ধেক উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত ব্যক্তি আমিন, আর বাকিটা ক্রিস্টির মেয়ের। কিন্তু যেহেতু মেয়েটি এখনো অপ্রাপ্তবয়স্ক, প্রয়াতর ইচ্ছানুযায়ী সেই টাকা একটি ট্রাস্ট ফান্ডে জমা থাকবে এবং বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ামাত্র সেই টাকার ওপরে মেয়ের দাবি প্রতিষ্ঠিত হবে। আমিনের প্রাপ্য অংশের জন্যে উকিলের সঙ্গে অবিলম্বে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হয়েছে।

ক্রিস্টি। আমেরিকায় তার প্রথম মেয়েবন্ধু। আশ্রয় দিয়েছিলো নিজেদের বাড়িতে, ভালোবেসেছিলো। সে নেই! ডিভোর্সের এতো বছর পরেও তার জীবনবীমার নমিনি হিসেবে আমিনের নাম রেখে দিয়েছিলো! কেন? আমিন দেখে, উকিলের চিঠিতে ক্রিস্টির পুরো নাম লেখা ক্রিস্টিনা চৌধুরী। বিয়ের পরে চৌধুরী পদবী নিজের নামের অংশ হিসেবে ধারণ করেছিলো সে, আর বদলায়নি! আশ্চর্য, যেদিন আমিনুল হক চৌধুরী নামটিই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, সেদিন তার হাতে এই চিঠি!

চিঠিতে উকিলের ফোন নাম্বার দেওয়া আছে। ফোন তুলে ডায়াল করে আমিন। নিজের পরিচয় দিয়ে উকিলকে জানায়, আমার অংশের টাকা আমি ক্রিস্টির মেয়েকে দিয়ে দিতে চাই। টাকাটা আসলে ওরই পাওনা। সে বিষয়ে করণীয় কি?

উকিল পেশাদার নির্লিপ্ততায় বলে, দ্যাট'স ভেরি জেনেরাস অব ইউ। তুমি কিছু কাগজপত্রে সই করে দিলে আমরা বাকিটা দেখবো।

দরকারি কাগজপত্রগুলো পাঠিয়ে দিতে বলে ফোন নামিয়ে রাখে আমিন। নাকি ড্যানিয়েল!

ক্রিস্টির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের দিনটি মনে পড়ে। তখন মাত্র এসেছে সে, এদেশ দূরের কথা, ছোট্টো ডুরান্ট শহরেরও তেমন কিছু চেনা নেই। ঢাকা থেকে সোজা এসেছিলো সে নিউ ইয়র্কে মায়ের কাছে। বলতে গেলে এক অর্থে মায়ের সঙ্গে সেই প্রথম দেখা। ছোটো বোনটির সঙ্গেও। নতুন করে পরিচিত হওয়া, তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগের কথা ভালো করে মনেও নেই। নিউ ইয়র্কে দু'দিন থেকে সে ডুরান্টে এসে উপস্থিত হয়। মাসখানেক পরে সন্ধ্যায় এক শপিং সেন্টারের পার্কিং লট থেকে গাড়ি বের করতে গিয়ে আচমকা পার্ক করে রাখা আরেকটি গাড়িতে ধাক্কা লাগিয়ে বসে। কেউ লক্ষ্য করার আগেই প্রায় নির্জন পার্কিং লট থেকে সরে যাওয়ার সুযোগ ছিলো। আমিন যায়নি, গাড়ি দাঁড় করিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির মালিকের জন্যে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয় সে। ঝামেলা হতে পারে জেনেও নিজের গাড়িতে ঠায় বসে থাকে।

ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর গাড়ির মালিকের দেখা মেলে। আধো-অন্ধকার পার্কিং লটে মেয়েটির চেহারা বা বয়স ভালো করে দেখা যায় না। মেয়েটি লক্ষ্যও করেনি তার গাড়ির ক্ষতিগ্রস্ত পেছনের বাম্পারটি। আমিন এগিয়ে গেলে মেয়েটিকে কিছু বিচলিত দেখায়। নির্জন পার্কিং লটে অচেনা যুবক এগিয়ে আসছে দেখলে তা হতেই পারে। আমিন গাড়ির ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মেয়েটি হাসতে হাসতে প্রায় গড়িয়ে পড়ে আর কি। বলে, ইস আরেকটু জোরে ধাক্কা দিয়ে গাড়িটা চুরমার করে দিতে পারলে না?
আমিন লক্ষ্য করে, মেয়েটি দেখতে ভালোই। হালকা গড়ন, কাঁধসমান সোনালি চুল, লম্বাটে মুখে হাসিটি চমৎকার। বয়স তার চেয়ে সামান্য বেশিও হতে পারে, ঠিক বোঝা যায় না। এই মেয়ের মাথায় গোলমাল আছে এরকম একটি সিদ্ধান্তে আসার আগেই আমিনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সে, হাই আমার নাম ক্রিস্টি।
আমিন নিজের নাম বলে জানায়, আমি বাংলাদেশ থেকে আসছি, পড়াশোনা করি।

ক্রিস্টি বলে, তুমি নিশ্চয়ই ভাবছো আমার মাথা খারাপ আছে, তাই না?

কী বলতে পারে আমিন? সে কিছু বলার আগেই ক্রিস্টি ব্যাখ্যা দেয় - কেন সে ঘটনার জন্যে মোটেই ক্রুদ্ধ নয় এবং কেন গাড়িটি চুরমার হয়ে গেলে সে আরো বেশি খুশি হতো। গাড়ির মালিক আসলে সে নিজে নয়, তার ভূতপূর্ব বয়ফ্রেন্ড। একসঙ্গে ছেলেটির অ্যাপার্টমেন্টে থাকতো তারা, বিয়ের পরিকল্পনাও ছিলো। গত মাসছয়েক আগে তাদের একটি মেয়ে হয়েছে। বাচ্চা পেটে আসার পর থেকেই বয়ফ্রেন্ড বাচ্চা নষ্ট করার জন্যে চাপ দেয়। ক্রিস্টি রাজি হয়নি। মনোমালিন্য, ঝগড়াঝাটি তুঙ্গে উঠলে ক্রিস্টি নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে মায়ের কাছে ফিরে যায়।

বয়ফ্রেন্ডও কয়েকদিনের মধ্যে উধাও, মেয়ের মুখও হয়তো দেখতে চায়নি। যাওয়ার আগে কী ভেবে কে জানে নিজের গাড়ি ক্রিস্টির মায়ের বাড়ির সামনে পার্ক করে একটি চিরকুটসহ চাবি মেলবাক্সে রেখে যায়। তার কোনোকিছুতে ক্রিস্টির আর কোনো আগ্রহ ছিলো না। গাড়ি সে ছুঁয়েও দেখেনি, তার নিজের গাড়ি আছে। আজ কাজে আসার সময় দেখে তার গাড়ির সামনের একটি চাকা বসে গেছে। মা তখন নাতনিকে নিয়ে বাইরে। বসে যাওয়া চাকা খুলে স্পেয়ার লাগিয়ে কাজে যেতে দেরি হয়ে যাবে। নিরুপায় হয়ে প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ডের গাড়ি নিয়ে বেরোতে বাধ্য হয়। কাজ শেষ করে বেরিয়ে কাণ্ড দেখে সে খুশিই।

ক্রিস্টি জিজ্ঞেস করে, তোমার কাছে সিগারেট আছে?

না, নেই।

খাও না?

অভ্যাস নেই, মাঝেমধ্যে শখে খাই।

তা ভালো। চলো, আমার সঙ্গে একটু হাঁটবে। সামনের দোকান থেকে সিগারেট কিনবো।

পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ক্রিস্টি বলে, ওই বেজন্মার সবকিছু আমার জীবন থেকে মুছে দিতে পারলে খুশি হই আমি। মেয়েটার শরীরে তো আমারও অংশ আছে, সে আমার। তাকে ছাড়ি কী করে? কিন্তু গাড়িটা আমি আর নিয়ে যাচ্ছি না, ওটা এখানেই থাকবে। তুমি আমাকে নামিয়ে দিয়ে যেয়ো, কেমন?

আমাকে তুমি চেনো না, জানো না। বিশ্বাস করছো কী করে?

যে ছেলে গাড়িতে ধাক্কা দিয়ে সরে পড়ার সুযোগ পেয়েও যায় না, নিজের দোষ স্বীকার করার জন্যে বসে থাকে তাকে বিশ্বাস করা চলে, কী বলো?

ক্রিস্টিকে নামিয়ে দিতে গিয়ে তার মায়ের সঙ্গে আমিনের পরিচয় হয়। মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছিলো বলে দেখা হয়নি। ড্রাইভওয়েতে রাখা ক্রিস্টির চাকা বসে যাওয়া গাড়ির চাকা বদলানোর সময় হাত লাগায় আমিন। কফি খেয়ে চলে আসার সময় ক্রিস্টি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলো, আশা করি এই আমাদের শেষ দেখা নয়।
তা হয়নি। মাস দুয়েকের মধ্যে ক্রিস্টি একরকম জোর করে আমিনকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে তুলে ফেলে। তখন আমিন নিদারুণ অর্থকষ্টে ছিলো। দেশ থেকে আনা টাকাপয়সা ফুরিয়ে গেছে, ডুরান্টে কাজকর্মও পাওয়া যায় না। ক্রিস্টিদের বাড়িতে ওঠার তিন মাসের মধ্যে বিয়ে করে ফেলে তারা। বিয়ে টিকে ছিলো বছর আড়াই।

বিচ্ছেদের জন্যে সেই সময় না করলেও পরে আমিন নিজেকেই দায়ী করেছে। দেশে থাকার সময় মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ দুর্লভ ছিলো। অপার মার্কিনী স্বাধীনতা তার মাথা খারাপ করে দেয়। শুধুমাত্র হাই দিয়ে শুরু করে যে কোনো মেয়ের সঙ্গে জমিয়ে ফেলা সম্ভব, ফাস্ট ফুডে খাইয়ে অথবা বারে দুটো বীয়ারের দামে একেকটি আস্ত নারীশরীর লভ্য - এই অভিজ্ঞতা জীবনে হয়নি। দীর্ঘ সুপুরুষ চেহারা তার সহায়ক হয়, নতুন একেকটি জয়ের আনন্দে ভেসে যাচ্ছিলো সে। বিবাহজনিত সম্পর্ক রক্ষায় দরকারি বিশ্বস্ততার বোধ তার ছিলো না। ক্ষুদ্র ডুরান্ট শহরে সবাই সবার নাড়ির খবর রাখে, ক্রিস্টির কানেও উঠেছিলো যথাসময়ে। আমিনকে জিজ্ঞেস করা হলে কোনোকিছুই অস্বীকার করে না সে। ফলাফল, উকিলের সহায়তায় পারস্পরিক বোঝাপড়ায় বিচ্ছেদ।

ডুরান্ট ছেড়ে চলে আসার পর আমিনের বোধ জন্মায় যে ক্রিস্টিকে হারিয়ে ফেলা তার খুবই ভুল হয়েছিলো। মেয়েটি তাকে কী ভালোবেসেছিলো, তা সে জানেনি। ক্রিস্টিকে ভাবলে তার এক ধরনের করুণামিশ্রিত কষ্ট হয় - ছোটো শহরের সাদাসিধে মেয়েটির জীবনে পরপর দুটি পুরুষ তার অসীম দুঃখের কারণ হয়েছে। আমিন তার নিজের জায়গায় অন্য কাউকে স্থাপিত করতে পারলে খুশি হতে পারতো, কিন্তু তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি বলে একটি অপরাধবোধ তাকে কোনোকালে নিস্তার দেয়নি।

উকিলের সঙ্গে আমিনের কথা শেষ হলে ক্রিস্টি ফিরে ফিরে আসতে থাকে। এই ক্রিস্টি বিগত জীবনের হলেও মৃত হয়নি কোনোদিন। এই পৃথিবীতে কোথাও সে ছিলো, ইচ্ছে করলে সাক্ষাতও হতে পারতো। আজ সে মৃত, কোথাও আর নেই। হয়তো আছে, তার মেয়েটির জীবন ও অস্তিত্বের ভেতরে। আমিন টের পায়, সে এখনো আমিন, ড্যানিয়েল নাম ধারণ করেও অন্য কেউ সে হয়নি। হয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। আসলে এক শরীরে সে এখন দুটি পরিচয় নিয়ে অতিবাহিত করবে অবশিষ্ট জীবন।

কোকে চুমুক দিয়ে বিস্বাদ লাগে। খাওয়ার ইচ্ছে চলে গেছে আমিনের, পেটের ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠে। গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকে উৎকণ্ঠার মতো কিছু। ছোটোবেলায় পরীক্ষার দিন সকালে ভাত খেতে বসলে ঠিক এরকম হতো, মনে পড়ে।

অর্ধেক খাওয়া স্যান্ডউইচ সে ফেলে দেয় গারবেজ ক্যানে।

No comments: