Monday, October 22, 2007

'তুমি পুঁতলে বিষ-বিরিক্ষ ফল খাইবে কে?'

মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যানের প্যারলে মুক্তির আবেদন আরেকবার প্রত্যাখ্যাত হলো। খুনের দায়ে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় ১৯৮১ সালে। নিয়ম অনুযায়ী ২০ বছর কারাভোগের পর ২০০১ থেকে এই নিয়ে চারবার সে প্যারলের আবেদন করেছে এবং প্রতিবারই তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আদালত জানিয়েছে, কারাগারে তার সদাচরণ আদালতের গোচরে এলেও ঠাণ্ডা মাথায় কৃত অপরাধের ভয়াবহতার কারণে আবেদন মঞ্জুর করা গেলো না। আগামী দুই বছরের মধ্যে প্যারলের আবেদন আর গৃহীত হবে না।

হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিলো ১৯৮০ সালের ৮ ডিসেম্বর। ঘটনাস্থল আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহর। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, সেন্ট্রাল পার্কের উল্টোদিকে ডাকোটা অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের প্রবেশপথে। নিহতের নাম জন লেনন, বিশ্ববিখ্যাত ব্যান্ড বীটলস-এর প্রধান পুরুষ। রক অ্যান্ড রোলের কিংবদনতী গায়ক, সঙ্গীত রচয়িতা ও শান্তি আন্দোলনের প্রবক্তা/অ্যাকটিভিস্ট। নিয়তির পরিহাস ছাড়া আর কি! না হলে অহিংসার প্রবক্তারা বারবার হিংসাত্মক ঘটনার শিকার হন কেন হন! গান্ধী ও মার্টিন লুথার কিং-কে আমাদের মনে পড়বে। অহিংসা ও শান্তির কথা বলার পুরস্কার হিসেবে তাঁরাও পেয়েছিলেন ঘাতকের সহিংস বুলেট।

মার্ক চ্যাপম্যান, তখন তার বয়স ২৫, ঘটনার দিন সকালে লেননের বাসস্থান ডাকোটা অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে আসে। ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই, সুতরাং প্রবেশপথে অপেক্ষা করতে হয়। জন লেননকে এক নজর দেখার জন্যে, অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্যে ভক্তরা ভিড় করে প্রতিদিনই, তাতে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। লেননের বাইরে যাওয়ার পথে মার্ক চ্যাপম্যান নিজেকে ভক্ত হিসেবে পরিচয় দিয়ে তাঁর অটোগ্রাফ নেয়। অতঃপর দিনমান সেখানেই সে অপেক্ষায় থাকে। স্টুডিওতে রেকর্ডিং শেষ করে লেনন রাতে ঘরে ফিরছেন, সেই সময় চ্যাপম্যান পিস্তল দিয়ে খুব কাছে থেকে তাঁকে গুলি করে।

পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি দুটি বিষয়ে - হত্যাকাণ্ডের শাসতি বিধানে তৎপরতা এবং দ্বিতীয়ত, বিচার ব্যবস্থার দৃঢ়তা ও ন্যায়বোধ। জন লেনন বিশ্ববিখ্যাত সেলিব্রিটি এবং তাঁর হত্যাকাণ্ডের বিচারে দ্রুততার তাগিদ ও চাপ হয়তো ছিলো। কিন্তু এ কথাও মনে রাখতে হবে, লেনন মার্কিন নাগরিক ছিলেন না। জন্মসূত্রে বৃটিশ, আমেরিকায় স্থিত হয়েছিলেন মৃতু্যর কয়েক বছর আগে। আমেরিকায় বসবাসের বৈধ অনুমতি আদায় করাও তাঁর জন্যে সহজ হয়নি। স্পষ্টবাদী ও প্রতিবাদী লেনন 'কমিউনিস্ট-ঘেঁষা' বলে পরিচিতি পেয়েছিলেন এবং সবাই জানেন আমেরিকায় 'কমিউনিস্ট' হওয়ার বিড়ম্বনা কি। ফলে মার্কিন প্রশাসন তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখতো এবং আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতির জন্যে তাঁকে দীর্ঘকাল আদালতে লড়তে হয়েছিলো। সরকারের অপছন্দ হলেও কিছু এসে যায় না, আদালতের স্বাধীন ও নিজস্ব শক্তি সরকারি মনোভাবের ধার ধারে না। লেননের আবেদনকে বৈধ বলে রায় দেওয়া হয়।

এর বিপরীতে আমাদের দেশে কী দেখি? প্রেক্ষিত বিবেচনায় জন লেনন আমেরিকায় যতোটা, তার তুলনায় শেখ মুজিব বা জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে আরো অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। অথচ এই দু'জনের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর যথাক্রমে ৩১ ও ২৫ বছর পার হয়ে গেলেও যথোপযুক্ত বিচার আজও সম্পন্ন হয়নি। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডে একটি মামলা দায়ের হতে লেগে যায় দুই দশকেরও বেশি। তার পেছনে ছিলো রাষ্ট্রশক্তির প্রবল অনিচ্ছা, প্রতিরোধ ও নিষেধাজ্ঞা। বরং স্বস্বীকৃত হত্যাকারীরা পুরস্কৃত হয়। ইনডেমনিটি আইনে বিচারের পথ রুদ্ধ করে ফেলা হয়েছিলো। কোনো সভ্য সমাজের জন্যে অকল্পনীয় পরিস্থিতি বটে। শেখ মুজিবকে যদি আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র নির্মাণের প্রধান কারিগর হিসেবে না-ও মানি, ভুলভ্রান্তিতে ভরা একজন শাসক অথবা শুধুই একজন নগণ্য নাগরিক হিসেবে দেখি - তারপরও মানতে হবে, কোনো হত্যাকাণ্ডই রাষ্ট্রের সমর্থন বা সায় পেতে পারে না। পেলে রাষ্ট্র দুর্বৃত্তের চরিত্র ধারণ করে। অতি সাধারণ ন্যায়বোধও এই কথা বলবে।

ন্যায়বিচার উপেক্ষা ও অগ্রাহ্য করার বিষবৃক্ষ রোপনের কাজটি শুরু হয়েছিলো মুজিব হত্যার বিচার না করার মধ্য দিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবকে খুন করে পার পাওয়া গেলে আর কিছুই অসম্ভব মনে হয় না। যে কোনো রকমের অপরাধপ্রবণতাকে উৎসাহিত করার জন্যে এই নিরাপত্তার বোধটি যথেষ্ট।

যুক্তিসঙ্গতভাবেই বিষবৃক্ষটির রূপকার হিসেবে রাষ্ট্রে তখনকার সময়ে সবচেয়ে ক্ষমতাবানদের চিহ্নিত করা চলে। অথচ এই বিষের দংশন থেকে তাঁরা নিজেরাও রেহাই পাননি। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে, অথবা তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক যে, দেশে ও সেনাবাহিনীতে একটি স্থিতাবস্থা সৃষ্টির জন্যে শাসকদের তখন ক্রমাগত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করতে হয়েছে সামরিক আদালতের বিচারে অথবা কোনো বিচার ছাড়াই। শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পরবর্তী সাত-আট বছরে ঠিক কতো হাজার সামরিক বাহিনীর সদস্য প্রাণ হারিয়েছিলেন, তার সঠিক হিসেব আজও জানা যায়নি। যে দু'চারজনের নাম আমরা জানি, সেই খালেদ মোশারফ বা হায়দার বা মনজুর হত্যাকাণ্ড বিষয়ে বিচার দূরে থাক, কোনো তদনত হয়েছে বলেও জানা যায় না। এমনকি, জেলখানার নিরাপত্তার ভেতরে তাজউদ্দিন-সৈয়দ নজরুলসহ চারজন রাজনীতিককে হত্যা করা হয়েছিলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সুবিধার সুযোগ নিয়ে। তারও বিচার হয়নি।

একই বিষ দংশন করেছিলো জিয়াউর রহমানকে। জিয়া হত্যার বিচার সামরিক ছাউনিতে হয়েছিলো বটে, কিন্তু তা ন্যায়বিচার বলে স্বীকৃত হয়নি। শুধু সামরিক পোশাকধারীদের কারণে জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছিলেন এবং বেসামরিক কারো সংশ্লিষ্টতা তাতে ছিলো না, এমন কথা সম্ভবত কোনো পাগলেও বিশ্বাস করে না। দুঃখের বিষয়, জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর তাঁর হাতে গড়া রাজনৈতিক দলটি কমপক্ষে বারো বছর ক্ষমতায় ছিলো। কিন্তু সেনা ছাউনির বাইরে জিয়া হত্যার বিচারে তাদের কিছুমাত্র উৎসাহ দেখা যায়নি। মুজিব হত্যার ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ইমডেমনিটি আইন রহিত করে সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু করেছিলো। ক্ষমতা বদলের পর আজও তা আপীল আদালতে ঝুলে আছে। বিলম্বিত বিচার যে বিচারের অধিকার রুদ্ধ করতে চাওয়া, এই আপ্তবাক্য সবারই জানা।

স্বাধীনতার পর থেকে এরশাদের সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে বিবিধ প্রকারের অস্থিরতা গেছে, প্রধানত রাজনৈতিক কারণে। এখন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো কী করেছে আইনের শাসন বিষয়ে, তা-ও একটু দেখা যেতে পারে। এরশাদ পতনের সময়ের পরিস্থিতি স্মরণ করা যাক। যে কোনো দেশে ওই পরিস্থিতিতে ক্ষমতাচ্যুত একনায়ক ও দুর্নীর্তিগ্রসত শাসককে অন্য দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হতো অথবা দেশের প্রচলিত আইনে কারাগারের বাইরের আলো দেখার কোনো সম্ভাবনা চিরতরে রহিত করা হতো। অথচ বাংলাদেশ হলে তা অন্যরকম না হয়েই যায় না। এরশাদকে সাব-জেল নামের এক প্রাসাদে সপরিবারে রাজার হালে রাখার ব্যবস্থা এ দেশেই হয়েছিলো।

সরকার পছন্দ না করলে এরশাদের কারাদণ্ড হয়, পরের সরকার একের পর এক মামলায় জামিন দেয়, পরবর্তীতে আবার প্রথমোক্ত সরকার ক্ষমতায় এলে তারা এরশাদ-প্রেমে অন্ধ ও বধির হয়ে বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখা মামলা প্রত্যাহার করতে শুরু করে। এ কথা পরিষ্কার যে এ ক্ষেত্রে বিচারালয়ের সিদ্ধান্তগুলি আইন-আশ্রয়ী নয়, রাজনীতি-প্রভাবিত। পর পর তিনটি নির্বাচিত সরকার বিচার বিভাগকে প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত করার কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি। অথচ তিনটি নির্বাচনেই নির্বাচিত-পরাজিত নির্বিশেষে সব পক্ষের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিলো বিচার ও প্রশাসন ব্যবস্থাকে আলাদা করার। হয়নি। কেন হয়নি, তা-ও সবাই জানে। ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ার ক'দিন আগে গত সরকারের আইনমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সময়ের স্বল্পতার কারণে কাজটি করা গেলো না। কী অসাধারণ যুক্তি!

বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা আমজনতাকে সম্ভবত নাবালক জ্ঞান করেন। না হলে এরকম বালখিল্য কথাবার্তা বলে পার পাওয়ার চেষ্টা কেন করা হবে? ১৯৯০-এর পরে গত সরকারের প্রধান শরিক দলটি দুই দফায় মোট দশ বছর সময় পেয়েছিলো কর্মটি সম্পাদন করার জন্যে। আন্তরিকতা ও ইচ্ছা না থাকলে দশ বছর কেন, একটি শতাব্দীও যথেষ্ট মনে হবে না তা জানা কথা। আওয়ামী লীগ পেয়েছিলো পাঁচ বছর। তারাও প্রস্তাব ও ফাইল চালাচালির অভিনয় করে গেছে, কাজের কাজটি করেনি।

রাজনৈতিক আনুগত্য নয়, প্রচলিত আইন বা সাধারণ ন্যায়নীতির বোধ, এমনকি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও হত্যাকাণ্ডের জন্যে দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি না করা ভয়াবহ অন্যায়। খারাপ দৃষ্টান্ত তো বটেই। একেকটি অন্যায়-অপরাধে কোনো শাস্তি না হওয়া আরো অপরাধের জন্ম দিয়েছে, অপরাধীদের সাহসের পরিধি বেড়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা, সমাজ-মনস্তাত্ত্বিকরা হয়তো আমাদের জানাতে পারবেন, চোখের সামনে এতোসব অন্যায় দেখে এবং সয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ঠিক কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো এবং ন্যায় ও মূল্যবোধের ক্ষতি কতোটা সাধিত হয়েছিলো। আজ বাংলাদেশে আইনকে উপেক্ষা করা বা সে বিষয়ে কিছুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ পোষণ না করার যে মনোভাব তৈরি হয়েছে সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যে, তার পেছনেও ওইসব ঘটনার প্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্রিয়াশীল বলে ধারণা করা চলে।

আমাদের দেশে বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের আচরণ দেখে আমজনতা ক্রমাগত বিব্রত ও হতাশ। সামরিক শাসনকে বৈধতা দিতে এঁদের কিছুমাত্র বাধে না, ক্ষমতাবানদের হাতের ঘুঁটি হতেও আপত্তি নেই। বিচারকের আসনে থেকেও প্রকাশ্য রাজনীতি করা বা অসত্য শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখিয়ে (সাধারণ মানুষ হলে জোচ্চুরি বলা হতো)উচ্চাসনে বসার ঘটনা আমাদের বিচারকরাই ঘটাচ্ছেন। অথচ বঞ্চিত, নিপীড়িত ও অবিচারের শিকার সাধারণ মানুষের জন্যে তাঁদেরই হওয়ার কথা শেষ ভরসা। রাষ্ট্র যখন নাগরিককে অকারণে পীড়ন করে, ক্ষমতাবানরা যখন অন্যায় করেন, বিচারকরাই তা রুখবেন। তাঁরা ন্যায়বোধকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। আমাদের ৩৫ বছরের ইতিহাসে তা খুব বেশি ঘটতে দেখা যায়নি। বরং বিচারালায়ে সুবিচার না পাওয়ার হাহাকার অগণিত।

স্বীকার করে নেওয়া দরকার, শতকরা একশো ভাগ নিশ্ছিদ্র বিচার ব্যবস্থা পৃথিবীর কোথাও নেই, সে দেশ শিক্ষা-দীক্ষা-অর্থনীতি-সংস্কৃতিতে যতো অগ্রবর্তীই হোক। কিন্তু আমাদের দেশে সর্বপ্রকারের অন্যায়-অনাচারকে প্রশ্রয় দেওয়ার যে বিষাক্ত সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছে (জনপ্রিয় ও চালু কথায়, প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে), তা থেকে উদ্ধারের পথ খুঁজতেই হবে। নাহলে বিষবৃক্ষের ফল আমরা এখন তো ভক্ষণ করছিই, অনাগতকালেও তা অব্যাহত থাকবে বলে আশংকা হয়।

----------------
নভেম্বর ২০০৬
----------------

No comments: