Monday, October 22, 2007

জর্জ হ্যারিসনকে বিলম্বিত অভিবাদন

২৫ ফেব্রুয়ারি জর্জ হ্যারিসনের জন্মদিন। জীবিত থাকলে এই দিনে তাঁর বয়স হতো ৬৪। বীটলস-এর একটি গানের শিরোনাম ছিলো 'হোয়েন আই অ্যাম সিক্সটি ফোর'। চার বীটলস-এর দু'জন পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন 'সিক্সটি ফোর' হওয়ার আগেই। জন লেনন ৪০-এ, জর্জ হ্যারিসন ৫৮ বছর বয়সে। পল ম্যাকার্টনি ও রিংগো স্টার অবশ্য কিছুকাল আগে 'সিক্সটি ফোর' হয়েছেন।





নভেম্বর ৩০, ২০০১। প্রতিদিনের অভ্যাসমতো সকালে কর্মক্ষেত্রে রওনা হওয়ার আগে এক কাপ কফি নিয়ে টিভির সামনে বসেছি। সংবাদ শিরোনামের সুন্দরী সংবাদ পাঠিকাকে গম্ভীর মুখ করে বলতে শুনলাম, ৫৮ বছর বয়সী জর্জ হ্যারিসন লোকান্তরিত হয়েছেন আগের দিন দুপুর দেড়টায়।

শুনে স্তব্ধ হয়ে খানিকক্ষণ বসে থাকি। অফিসে যাওয়ার ইচ্ছে মুহূর্তে অন্তর্হিত - খুব নিকটজনের মৃত্যুতে যেরকম হয়। পরিচয় দূরের কথা, জর্জ হ্যারিসনকে স্বচক্ষে দেখার কোনো সম্ভাবনাও তৈরি হয়নি কখনো। কিন্তু আত্মার পরম আত্মীয়ই ছিলেন তিনি, অনেক বছর ধরে। আমার মতো আরো লক্ষ লক্ষ মানুষ বীটলস-এর জন লেনন, পল ম্যাকার্টনি, জর্জ হ্যারিসন ও রিংগো স্টারকে সহযাত্রী ও একান্ত আপন মানুষ ভাবতে আজও পছন্দ করেন।

ষাটের দশকের মাঝামাঝি বীটলস গ্রুপটি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যায়। ইংল্যান্ডের লিভারপুলের এই চার যুবকের সম্মিলন পাশ্চাত্যের রক ও পপ সঙ্গীতের ইতিহাস-ভূগোল সব পাল্টে দিয়েছিলো। সঙ্গীত যে মানুষের চিন্তা-চেতনা ও জীবনযাত্রাকে, সমাজ ও রাজনীতিকে নতুন ধারায় প্রবাহিত করে দিতে পারে, তা দেখা গিয়েছিলো এই সময় থেকে। প্রথা ও প্রতিষ্ঠান বিরোধী সঙ্গীত রক অ্যান্ড রোল, বীটলস তাতে যোগ করে এক নতুন মাত্রা। পাশের বাড়ির ছেলেটির মতো প্রিয়দর্শন এই চার যুবক মনোহর ও বিচিত্র সঙ্গীত সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের দুর্দান্ত রসবোধ এবং বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা সহজ ব্যক্তিত্ব দিয়ে সারা পৃথিবীর হৃদয় হরণ করতে সক্ষম হন।

বীটলস নামের গ্রুপটির যাত্রা শুরু ১৯৬০-এ, মারমার-কাটকাট জনপ্রিয়তা ১৯৬২ থেকে। শুরুতে তা ছিলো ইংল্যান্ডকেন্দ্রিক। ৬৪-তে প্রথমবারের মতো আমেরিকা যাত্রা ও বিজয়, ক্রমে সারা পৃথিবী। ১৯৭০-এ গ্রুপ ভেঙে যায় লক্ষ লক্ষ ভক্ত-শ্রোতা ও সঙ্গীতপিয়াসীদের হৃদয় ভেঙে দিয়ে। দলনেতা লেনন ১৯৮০-এর 8ই ডিসেম্বরে নিউ ইয়র্কে এক উন্মাদ যুবকের গুলিতে নিহত হওয়ার পরও বহু বছর বীটলস-এর আবার একত্রিত হওয়ার আশা ভক্তদের মধ্যে জাগরূক ছিলো। বীটলস-এর তিন জীবিত সদস্য বরাবর সে সম্ভাবনা অস্বীকার করেছেন। ১৯৮৮-তে জর্জ হ্যারিসন স্পষ্ট করে বলেছিলেন, "জন লেনন যতোদিন পর্যন্ত মৃত থেকে যাবেন, ততোদিন বীটলস-এর পুনর্জন্মের কোনো সম্ভাবনা নেই।" তবুও ভক্তদের আশা মরে না, জল্পনা চলতে থাকে। জর্জের তিরোধানের পরে সে অবকাশও আর থাকে না।




নিভৃতচারী জর্জ প্রথম থেকেই 'কোয়ায়েট বীটল' নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালে রক অ্যান্ড রোল হল অব ফেম-এ বীটলস-এর অন্তর্ভুক্তির অনুষ্ঠানে রসিকতা করে বলেছিলেন, "আমি আর কী বলবো, আমি তো কোয়ায়েট বীটল!"

১৯৯৮-এ জানানো হলো, এককালের প্রচণ্ড ধূমপায়ী জর্জ হ্যারিসন গলায় ক্যানসারের চিকিৎসা নিচ্ছেন। ৯৭-এ অস্ত্রোপচার করে ফুসফুসের খানিকটা কেটে বাদ দিতে হয়েছিলো। গলার ক্যানসার সেরে গেলেও ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে নিজের বাড়িতে মানসিক রোগী এক উদভ্রান্ত মানুষের ছুরিতে আহত হলেন, স্ত্রী অলিভিয়া দ্রুত তৎপরতায় আক্রমণকারীকে আঘাত করলে জর্জের প্রাণ রক্ষা পায়। ছুরির আঘাত তাঁর ফুসফুসে পৌঁছে গিয়েছিলো। সুস্থ হয়ে উঠলেও ২০০১-এ গোড়ার দিকে ক্যানসারের প্রত্যাবর্তন - এবার ফুসফুসে, সঙ্গে ব্রেন টিউমার। জর্জ এবার পরাজিত হলেন। মৃত্যুই শেষ সত্য, রক অ্যান্ড রোল সঙ্গীতের বিশ্বজয়ী তারকাকেও সে রেহাই দেয় না।

বীটলস-এর কনিষ্ঠতম সদস্য জর্জ হ্যারিসনের জন্ম ১৯৪৩-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি। বাবা ছিলেন বাস ড্রাইভার। লিভারপুলের ডাভডেল প্রাইমারি স্কুলে ছিলেন জন লেননের দুই ক্লাস নিচে এবং পরে লিভারপুল ইনসটিটিউটে পল ম্যাকার্টনির এক ক্লাস নিচে। জর্জের সাত বছর বয়সে মা কিনে দিয়েছিলেন একটি গীটার। পল ম্যাকার্টনির সঙ্গে একই বাসের যাত্রী হিসেবে পরিচয়, তখন জর্জের বয়স তেরো। বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনি, দু'জনেই যে একটি করে গীটারের মালিক। পল ইতোমধ্যেই জন লেননের সঙ্গে কোয়্যারিম্যান নামে একটি গানের গ্রুপের সদস্য, জর্জকে নিয়ে গেলেন তিনি জনের কাছে। গীটারে দক্ষতার সুবাদে অবিলম্বে জর্জও গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত হলেন। এই গ্রুপটিই ১৯৬০ সালে বীটলস নাম ধারণ করে। তার পরের কয়েক বছরের ইতিহাস সঙ্গীতে ক্রমাগত সাফল্য ও জনপ্রিয়তার নতুন নতুন শীর্ষে আরোহন।

শেষ পর্যন্ত কাল হলো অভূতপূর্ব এই জনপ্রিয়তাই - ব্যক্তিগত জীবন বলতে আর কিছু থাকলো না, ভক্তরা পারলে তাঁদের টুকরো টুকরো করে ভাগাভাগি করে নেয়। এঁদের জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাও সংবাদপত্রের শিরোনাম হয় এবং ভক্তরা তা গোগ্রাসে খায়। দূর থেকে এক নজর দেখতে পেলেই কারো জন্ম সার্থক হয়ে যায়, উন্মত্ত আবেগে কেউ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এই অভাবিত জনপ্রিয়তা এর আগে কেউ কখনো দেখেনি। একসময় এমন হয় যে, উন্মুক্ত কনসার্টে ভক্তদের সোল্লাস চিৎকারে গান চাপা পড়ে যেতে থাকে - কি গাইছেন, তা-ও নিজের কানে তাঁরা শুনতে পান না। এভাবে আর যা-ই হোক, গান গাওয়া চলে না।

১৯৬৬-তে তাঁরা প্রকাশ্য কনসার্ট বন্ধ করতে বাধ্য হলেন, এরপর তাঁদের যাবতীয় গান অ্যালবাম আকারে বাজারে আসতে থাকে। একত্রে এই চারজনকে আর কোনোদিন মঞ্চে দেখা যায়নি। দিনরাত্রি এই নিরাপত্তার ঘেরাটোপের মধ্যে হাঁপিয়ে ওঠেন চার যুবক, নিজেদেরই অজান্তে তৈরি করা গণ-উন্মাদনার শিকার তাঁরা। বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের নিয়ে থাকতে থাকতে তাঁরা ক্লান্ত হয়ে উঠলেন একসময় - ব্যক্তিত্বের সংঘাত, রেষারেষির শুরু হয়। ১৯৭০-এ বীটলস ভেঙে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় ভক্তদের হৃদয় বিদীর্ণ হয়। পরবর্তীকালে চারজনই একক সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে বিপুল সাফল্য পেয়েছিলেন।

বীটলস ভেঙে যাওয়ার পর পুরো সত্তর দশকটি একক সঙ্গীতকার হিসেবে জর্জ হ্যারিসনের সাফল্যের কাল। একের পর এক সফল অ্যালবাম করেছেন - তিনটি প্ল্যাটিনাম (দশ লক্ষাধিক বিক্রিত কপি) এবং আটটি গোল্ড (পাঁচ লক্ষাধিক বিক্রিত কপি)। প্রথমটি ছিলো বীটলস যুগে রচিত ও অব্যবহৃত গানগুলি নিয়ে তিনটি ডিস্ক-সম্বলিত 'অল থিংস মাস্ট পাস' যা জর্জকে একক শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। জন লেননের মৃত্যুর পর তাঁকে নিবেদন করলেন একটি অ্যালবাম 'অল দোজ ইয়ারস এগো'। তারপর কিছুটা নিষ্ক্রিয়, ৮৭-তে আবার একটি সফল অ্যালবাম - 'ক্লাউড নাইন'। ৮৯-তে বব ডিলান, টম পেটি, রয় অরবিসন, জেফ লিন ও জর্জ হ্যারিসন একত্রিত হয়ে 'ট্র্যাভেলিং উইলবেরি' নামে এক গ্রুপ তৈরি করেন। এই গ্রুপের অ্যালবাম বিপুল সাফল্য পায়। অতঃপর আবার আড়ালে চলে যান জর্জ। মৃত্যুর আগে একটি অ্যালবাম তৈরি করছিলেন, অসমাপ্ত রেখেই চলে যেতে হলো তাঁকে।




জর্জ হ্যারিসনকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিলো, "আপনি বীটলস-এর একজন না হলে জীবনে কি হতেন?" জর্জের জবাব, "আমার বোধ-বুদ্ধি হওয়ার বয়স থেকেই তো আমি বীটল। সুতরাং আমার পক্ষে অনুমান করাই সম্ভব নয়, বীটল না হয়ে আমি আর কী হতে পারতাম!"

আরেকবার বলেছিলেন, "আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ঘটনা ছিলো বীটলস-এ অন্তর্ভুক্ত হওয়া। আর দ্বিতীয়টি হলো, বীটলস থেকে বেরিয়ে আসা।"

প্রকাশ্য কনসার্ট বন্ধ করে দেওয়ার পর জর্জ হ্যারিসন ভারতীয় সংস্কৃতি ও দর্শনে আকৃষ্ট হন, এই অনুরাগ আমৃত্যু অটুট ছিলো। এই সময় তিনি সেতারে রবি শংকরের কাছে দীক্ষা নেন। জর্জের আগ্রহ ও প্ররোচনায় বীটলস-এর অবশিষ্ট সদস্যরা এবং আরো অনেক রকশিল্পী ও সেলিব্রিটি ভারতে যান প্রাচ্য মিস্টিসিজম-এর টানে। এর প্রত্যক্ষ ফল ছিলো, বীটলস-এর 'নরওয়েজিয়ান উড', 'উইদিন ইউ, উইদাউট ইউ'-সহ বেশ কয়েকটি গানে সেতার ও অন্যান্য ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মিশ্রণের সফল নিরীক্ষা। বীটলস-এর গানের শব্দচয়নে 'জয় গুরুদেব' এবং পরবর্তীতে একক শিল্পী হিসেবে হ্যারিসনের গানে 'হরে রাম হরে কৃষ্ণ' এইসব অনায়াসে ঢুকে পড়েছে। আরো পরে লেননের একটি গানের শিরোনাম হয় 'ইনস্ট্যান্ট কর্ম'।

জর্জ হ্যারিসনের চরিত্র ছিলো অন্তর্মুখী, কিছুটা রহস্যাবৃত থাকতেই ভালোবাসতেন। জন লেনন একবার বলেছিলেন, "জর্জ নিজে কোনো রহস্য নয়, কিন্তু ওর ভেতরে তো অনন্ত রহস্য।"

১৯৭৪-এ নিজস্ব রেকর্ড কোম্পানির নাম দিলেন 'ডার্ক হর্স'। বলতেন, "যে ঘোড়াটি পেছনে থেকে অকস্মাৎ তীব্র গতিতে আর সবাইকে পেছনে ফেলে রেস জিতে যায়। আমার মনে হয়, সেটাই আমি।"

বীটলস-এর তুমুল জনপ্রিয়তার সময়ে জর্জ বিয়ে করেছিলেন, স্ত্রীর নাম প্যাটি। কিছুকাল পরে হ্যারিসনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন _ এরিক ক্ল্যাপটন - প্যাটির প্রেমে পড়েন, তাঁকে উদ্দেশ করে রচিত হয় ক্ল্যাপটনের বিখ্যাত গান 'লায়লা'। জর্জের সঙ্গে প্যাটির বিচ্ছেদ হলে এরিক ক্ল্যাপটন তাকে বিয়ে করেন, জর্জ নিজে সেই বিয়েতে উপস্থিত থাকেন। ক্ল্যাপটনের সঙ্গে মৃত্যুর সময় পর্যন্ত হ্যারিসনের বন্ধুত্ব অটুট ছিলো। হ্যারিসন ১৯৭৭-এ বিয়ে করেন অলিভিয়াকে, তাঁদের একমাত্র পুত্রের নামেও ভারতীয় ছাপ - ধ্বনি হ্যারিসন।

জর্জ হ্যারিসনের চরিত্রে বৈপরীত্যও ছিলো। শান্তশিষ্ট স্বল্পভাষী বলে পরিচিতি পেলেও ঘনিষ্ঠদের সান্নিধ্যে প্রচুর কথা বলতেন। একজন তো বলেছিলেন, "ওকে থামাবে কে!" আপাত-বিষণ্ণ মানুষটি আচমকা চমকপ্রদ রসিকতায়ও পটু ছিলেন। দার্শনিকতায় আগ্রহী হয়েও গাড়ির রেসিং পছন্দ করতেন। তিনি এমন একজন রক-তারকা যিনি বাগানে সার ছড়িয়ে বেশি আনন্দ পেতেন। তাঁর আত্মজীবনী 'আই, মি, মাইন'-এর উৎসর্গে লিখলেন : "যেখানে যতো বাগানবিলাসী আছে, তাদের সবার উদ্দেশে।"

নিজের জীবনদর্শনটির সারাংশ তিনি এইভাবে বিবৃত করেছিলেন, "আমার মনে হয় প্রকৃত সঙ্গীত যাদের জীবনের সর্বস্ব তারা পৃথিবীকে উদ্দেশ করে বলতে পারে, 'আমার ভালোবাসা তুমি গ্রহণ করো, আমার হাসি ও আনন্দটুকু নাও। যা কিছু অসুন্দর সেগুলোকে সরিয়ে রাখো একপাশে, ওসবে তোমার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু আমার সঙ্গীতের শুদ্ধতা ও সুন্দরটি তুমি নাও, কারণ সেটিই খাঁটি ও সর্বোৎকৃষ্ট, এবং এটুকু্ই আমি স্বেচ্ছায় ও সানন্দে বিলিয়ে দিতে পারি'।"




বীটলস একত্রিত থাকার কালে জন লেনন ও পল ম্যাকার্টনির মতো অতিকায় প্রতিভার আড়ালে পড়ে ছিলেন জর্জ হ্যারিসন। নিয়ম অনুযায়ী একেকটি গানের রচয়িতা মূলত গানটি গাইবেন, বাকিরা তাতে সহায়তা ও সঙ্গত দেবেন। লেনন-ম্যাকার্টনির বিপুল সৃষ্টি-উৎকর্ষতার কারণে জর্জের রচনা প্রায়শই বাদ পড়ে যেতো। এ নিয়ে তাঁর খেদ ও দুঃখ ছিলো, তা গোপনও করেননি। বীটলসের একটি অ্যালবামে অন্তর্ভুক্ত তাঁর 'হোয়াইল মাই গীটার জেন্টলি উইপস'-এ তা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছিলো। সেই উৎকর্ষতা জর্জ ক্রমাগত চর্চা ও চেষ্টায় অর্জন করেছিলেন। বীটলস যুগের তাঁর আরো স্মরণীয় গানগুলির মধ্যে আছে মিষ্টি ও মন-ভালো-করা 'হিয়ার কামস দ্য সান',
'সামথিং' (এই গানটিকে ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমের গান বলে বহুবার উল্লেখ করেছেন)। গীটারবাদনের দক্ষতায় হ্যারিসনের চেয়ে উৎকৃষ্ট তাঁর সমসাময়িক অনেকেই ছিলেন, কিন্তু তাতে তিনি এমন সুন্দর মিষ্টি ও হৃদয় মন্থন করা একটি আবেশ রচনা করতেন যা তুলনারহিত। ওপরে উল্লিখিত দুটি গান ছাড়াও এর উদাহরণ আছে 'লেট ইট বি', 'অল ইউ নীড ইজ লাভ' এবং আরো অসংখ্য গানে।

মাত্র কয়েক বছরে বিপুল ও বৈচিত্র্যময় সৃজনশীলতায় বীটলস একটি প্রজন্মকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ষাটের দশকে সারা পৃথিবীতে যে অস্থিরতা ও বিদ্রোহ এবং একই সঙ্গে হিপি আন্দোলনের মতো চরম বৈরাগ্যের সংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে, বীটলস তারই এক প্রতীক ও প্রতিভূ, অনুঘটক ও অংশীদার। সেই আচ্ছন্নতার রেশ আজও রয়ে গেছে ওই প্রজন্মের জীবিতদের মধ্যে। বীটলস-এর নামে তাঁরা আজও উদাস হয়ে যান, স্মৃতিতাড়িত হন। এমনকি এখনকার নবীন বয়সী যাদের স্মৃতিতাড়িত হওয়ার সুযোগ নেই, তারাও বিস্ময়-বিহ্বলতা নিয়ে বীটলস শোনে। ফলে, জর্জের মৃত্যুতে সব ধরনের মানুষের যে স্বজন বিয়োগের প্রতিক্রিয়া হয় তা অপ্রত্যাশিত লাগে না।

প্রতিক্রিয়া জানিয়ে পল ম্যাকার্টনি বললেন, "জর্জ ছিলো আমার ছোটো ভাইয়ের মতো। ... মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম, অসুখ-বিসুখ সব ভুলে সে যথারীতি হাসিঠাট্টা করে গেলো, কোথাও বিষাদের চিহ্নমাত্র নেই। খুব সাহসী ও বড়ো হৃদয়ের মানুষ না হলে এটা পারা যায় না।"

বিখ্যাত আইরিশ ব্যান্ড ইউটু সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা পোষণ করতেন না জর্জ, তা গোপনও করেননি। ইউটু-র প্রধান পুরুষ বনো-র তা অজানা ছিলো না। ৯৯-এ জর্জ আততায়ীর হাতে ছুরিকাহত হলে বনো বলেন, "মানুষটি আশ্চর্য গীটারবাদক ও সঙ্গীতরচয়িতা। মিলেনিয়াম উৎসবে লিংকন মেমোরিয়ালে আমাদের নিজস্ব একটি গান গাইতে গাইতে একসময় অবলীলায় জর্জের 'মাই সুইট লর্ড' গাইতে শুরু করি। এই মানুষটিকে আমি ভীষণ ভালোবাসি, যদিও আমি নিশ্চিত নই অনুভূতিটি পারস্পরিক কি না।"

বব ডিলান বললেন, "জর্জ ভালোবাসা উস্কে দিতে জানতো, তার ছিলো একশো মানুষের সমান মানসিক শক্তি। সে ছিলো সূর্য, ফুল ও চাঁদের মতো, তার অভাব আমরা অনুভব করতে থাকবো দীর্ঘদিন ধরে। তার অনুপস্থিতিতে পৃথিবী নিদারুণভাবে শূন্যতর হয়ে গেলো।"

বব গেলডফ বলছেন, "জর্জ নিজেই বলতো, জন ও পলের বিশাল প্রতিভার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কীভাবে সম্ভব? কিন্তু আমার তো মন হয়, সে তা দিয়েছে এবং ভালোভাবেই।"

জন লেননের বিধবা স্ত্রী ইয়োকো ওনো বলেন, "তার জীবন ছিলো ম্যাজিকাল এবং আমার মনে হয় তার সান্নিধ্যে আসার ফলে আমাদের জীবনেও তার কিছু ছায়া পড়েছিলো।"

জন লেনন নিহত হওয়ার পর নিউ ইয়র্কে সেন্ট্রাল পার্কের একটি অংশের নামকরণ করা হয় স্ট্রবেরি ফিল্ড, লেননের একটি গান থেকে নেওয়া হয় নামটি। জর্জের মৃত্যুর খবরে পিট ডেগ্যান নামের এক ভক্ত ভোরের আলো ফোটার আগেই স্ট্রবেরি ফিল্ডে চলে এসেছেন। তাঁর মতে "আজকের দিনটি রক অ্যান্ড রোলের ভক্তদের জন্যে খুব দুঃখের দিন।"

স্ট্রবেরি ফিল্ড-এ আরো অনেক ভক্ত সমবেত হয়েছিলেন। এঁদের একজন, স্টিভ ইয়ালপ, পার্কে জগিং করতে এসে থমকে দাঁড়ালেন। জর্জের 'হোয়াইল মাই গীটার জেন্টলি উইপস' গানটির প্রসঙ্গ টেনে বললেন, "আজ আমি কাঁদছি, আর কাঁদছে আমার গীটার।"

৪২ বছর বয়স্ক জো ক্যানিন তিন দশক ধরে বীটলস-এর অনুরাগী, বলতে গেলে বীটলসকে সঙ্গী করেই বড়ো হয়েছেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া: "আমাদের সবারই বয়স বাড়ছিলো। জর্জের প্রস্থানের সময়টি হঠাৎই এলো আর আমাদের মনে পড়ে গেলো, সব সুন্দরই বিলীন হয় মৃত্যুতে।"

হুয়ান মাহদালানি নামের এক আর্জেন্টিনীয় ভক্ত লিখছেন, "বীটলসদের আমি কখনো চাক্ষুষ দেখিনি, অথচ তাদের কাছে কী অপরিমেয় আমার ঋণ! তাদের সঙ্গীত আমার প্রতিটি নিশ্বাসে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমি নিজের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি করে নিয়েছি, তাদের সুরকে আমার নিজেরই সুর বলে জেনেছি। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, তারা যে কোনো ধর্মগুরুর চেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিলো আমার প্রজন্মকে। বিদায় জর্জ, আমি জানি এখন তুমি সূর্যের অনেক কাছাকাছি।"

আরেকজন লিখেছেন, "জর্জ, যে গীটারে আমি তোমার গান তুলেছি, সেই গীটার কেঁদে যাবে বাকি জীবন। তোমার মৃত্যুতে আমি আজ এক আত্মার সঙ্গীকে হারালাম, যদিও তুমি তা কখনো জানোনি।"

জর্জ হ্যারিসনের অনুরাগীদের এই ধরনের আরো কিছু মন্তব্য :

: "তুমি নেই, কিন্তু তোমার গান বেঁচে থাকবে। কী আশ্চর্য সুন্দর একজন মানুষ ছিলে তুমি, আশ্চর্য একজন গায়ক, সঙ্গীতরচয়িতা ও গীটারবাদক। তোমার অভাব আমাকে পীড়িত করবে। এই মুহূর্তে আমি চুপ করে বসে প্রাণভরে কাঁদতে চাই।"

: "একমাত্র ভালো যা হলো তা ওই যন্ত্রণা ও কষ্টের অসুখটি তোমাকে আর স্পর্শ করতে পারবে না। স্বর্গে অপেক্ষমাণ জন লেনন এতোদিনে একজন বন্ধুকে ফিরে পাবে, হয়তো দু'জনে মিলে কিছু সঙ্গীত রচনাও সম্ভব হয়ে উঠবে। আমাদের কাছে তা কখনো পৌঁছবে না, এই যা দুঃখ।"

: "আজ ভোরে আমার অ্যালার্ম রেডিওতে 'হিয়ার কামস দ্য সান' শুনে ঘুম ভাঙলো। রেডিও স্টেশনটি অলটারনেটিভ গানের, জর্জ হ্যারিসনের গান সেখানে বাজার কথা নয়। তক্ষুণি বুঝে ফেলি, জর্জ চলে গেলো। তার গান শুনতে শুনতে আমি বড়ো হয়ে উঠেছি, কতো স্মৃতি জড়ানো আছে সেইসব গানের সঙ্গে। তার গান আমার জীবন পাল্টে দিয়েছে এবং তার বিদায়ে, সীমাহীন আশাবাদী ও অসাধারণ মুক্তচেতনার মানুষটির অভাবে পৃথিবী আমার কাছে এখন বিষণ্ণতর বলে প্রতিভাত হচ্ছে। আমি তোমাকে মিস করছি, জর্জ।"

: "আজ ভোর ছ'টায় মা ঘুম ভাঙিয়ে যখন জানালো আমার আইডল আর নেই, আমার মন-খারাপের আর অবধি রইলো না। ক্লাসে গিয়ে আমি বন্ধুদের সামনেই কেঁদে ফেললাম। এই লেখার সময়ও আমি শোকগ্রস্ত। জর্জ ঠিকই বলেছিলো, সবকিছুকেই চলে যেতে হবে। হয়তো আমাদের শোকও একসময় প্রশমিত হবে। কিন্তু আমার এবং আমার মতো অনেকের জীবনে যে প্রভাব সে বিস্তার করেছিলো তা কখনো বিলীন হবে না।"

: "আমেরিকায় বীটলম্যানিয়ার যখন শুরু, আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। বলাই বাহুল্য বীটলস-এর গানের সঙ্গে সঙ্গে শুধু নয়, তাদের কালচারের সঙ্গে বড়ো হয়ে উঠেছি আমি। এইসব আমাদের নবীন জীবনকে কী ভীষণভাবে আচ্ছন্ন করেছিলো। জর্জের মৃত্যুর খবর শুনে আমি এবং আমার স্ত্রী পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম। যেন আত্মীয়বিয়োগ ঘটেছে আমাদের। জর্জ ছিলো আমার প্রিয়। আমি শখের বশে গীটার বাজিয়ে এখানে-ওখানে গান করি। আমি জানি, আমার পরবর্তী অনুষ্ঠানে অবশ্যই 'নরওয়েজিয়ান উড', 'সামথিং' এবং 'হোয়াইল মাই গীটার জেন্টলি উইপস' (যা এখন আমার প্রকৃত অনুভূতি) গাইবো।"

: "জন লেনন নিহত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরে আমার জন্ম। আমার বয়স একুশ হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে আমি আরেকজন বন্ধু জর্জকে হারালাম। জর্জ আমার সবচেয়ে প্রিয় বীটল। আমার মনে আছে, ছোটোবেলায় বিছানা গোছানোর সময় আমি আমার মা-র সঙ্গে সঙ্গে জর্জের 'সিক্রেট' গানটি গাইতাম। পরে বড়ো হতে হতে বীটলস-এর অসাধারণ গানগুলি আমার প্রিয় হয়ে ওঠে। জর্জের গীটারের ধ্বনির মতো মিষ্টি আর কিছু হয় না। ভালো থেকো, প্রিয় বন্ধু আমার।"

: "বীটলস-এর সঙ্গে যারা বড়ো হয়ে ওঠেনি তাদের পক্ষে অনুমান করা অসম্ভব যে ওই চারজন আমাদের প্রজন্মের কাছে কতোখানি ছিলো, কী ছিলো। আরেকজন বীটল-এর মৃত্যু আমাদের যৌবনকালটিকে ক্ষণিকের জন্যে ফিরিয়ে আনে এবং এই অনুভবের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় - জীবন কতো ছোটো। আজ বড়ো বিষাদগ্রস্ত আমি। জীবন তবু থেমে থাকে না। বীটলস-এর গান আমাদের সারাজীবনের অংশ হয়ে থাকবে।"

: "প্রিয় জর্জ, কী বলবো আমি? আমার বাবা তোমার অসুস্থতার খবর জানিয়েছিলেন, যেমন তিনি বরাবর তোমাদের কথা বলতেন এবং যা শুনতে শুনতে আমি বীটলস ভালোবেসে বড়ো হয়ে উঠেছি। আমি তো জানতামই, একদিন এরকম একটি খবর আমাকে শুনতে হবে। তবু আজ সকালে বাবা যখন ফোন করে জানালেন তুমি নেই, আমার কান্না আর থামে না। জানো, তুমি সম্ভবত আমার জীবন বাঁচিয়েছিলে? একসময় আমি ভীষণ মৃত্যুচিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। সেই সময় আমি তোমার অসুস্থতার খবর পাই। পত্রিকায়, ইন্টারনেটে তোমার খবর পড়ি আর মনে হয়, তুমি মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছো, আর আমি তাকেই আলিঙ্গন করার চিন্তা করছি। তোমার কাছে প্রতিজ্ঞা করছি জর্জ, আমি আমার এই মৃত্যুচিন্তাকে দূর করে দেবো। এই মুহূর্তে আমি তোমার গান শুনতে শুনতে লিখছি আর কাঁদছি। জানি, পৃথিবীজুড়ে আরো অনেক মানুষই তা করছে। মনে পড়ে, ১৯৮০ সালে জনের মৃত্যুর সময় আমরি বয়স ছিলো দশ। তার জন্যেও আমি কেঁদেছিলাম। অনেকে বুঝতেই পারছিলো না, যে মানুষটিকে আমি কোনোদিন দেখিনি, চিনিনি তার জন্যে আমি কেন কাঁদছি। কিন্তু জানো, তুমি, জন, পল আর রিংগো আমার জীবনের অংশ হয়ে আছো! আরো জানতে চাও? তোমাদের চারজনের কারণেই আমি ইংরেজি শিখেছিলাম, এখন ইংরেজি পড়াই আর ক্লাসে তোমাদের গানের কথা ছেলেমেয়েদের বলি অনবরত। আমি ইংল্যান্ডে গিয়ে বেশ কিছু সময় কাটিয়েছিলাম তোমাদের লিভারপুল শহরে। তোমরা যেখানে ছিলে এবং আরো সব জায়গা যা তোমাদের স্মৃতি ধরে রেখেছে - সেইসব ঘুরে ঘুরে দেখেছি। তোমাদের অনুভব করতে চেয়েছি। তোমাদের একটি অ্যালবামের নাম ধার করে বলতে পারি, আমার জন্যে সেটি ছিলো এক 'ম্যাজিকাল মিস্টেরি ট্যুর', সে এক আশ্চর্য স্বপ্নসম্ভব। প্রিয় জর্জ, প্রিয় বন্ধু আমার, তোমাকে বোঝাতে পারবো না, কী বেদনা আমি অনুভব করছি আজ। আমার হৃদয়ে তোমার জন্যে একটি বিশেষ জায়গা সারাজীবন থাকবে, জনের জন্যে যেমন আছে। আজ আমাকে ঘরে থাকতে হবে, আজ আমি কাজে যাবো না। কিচ্ছু করবো না। বিদায়, প্রিয় বন্ধু।"




কারিন নামের জর্জ হ্যারিসনের এক ভক্ত জানাচ্ছেন, "আমার তখন আট বছর বয়স, আমার বড়ো বোনের বারো। সে যা যা করতো আমাকেও তা-ই করতে হবে। এইভাবেই আমার বীটলস-এর গানের সঙ্গে পরিচয়, আমি লুকিয়ে আমার বোনের বীটলস অ্যালবামগুলি শুনতাম। গানগুলো আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো। বীটলস-এর ভাঙন আমাকে যেন একেবারে বিধ্বস্ত করে দিয়ে গেলো। কিন্তু আমি জর্জের প্রেমে পড়ে গেলাম ১৯৭১-এ 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'-এর সময়। তখন আমি পনেরো বছরের।"

জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক দেশটির জন্মের সময় থেকে। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে অগাস্ট মাসে রবি শংকরের আগ্রহে জর্জ হ্যারিসন একটি কনসার্টের মাধ্যমে যুদ্ধকালে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরনার্থীদের জন্যে তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। আজকাল মানবিক ইস্যুতে বেনিফিট কনসার্টের আয়োজন হরহামেশা হয়ে থাকে। কিন্তু ১৯৭১-এর অগাস্টে নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়্যার গার্ডেনে এই ধরনের কনসার্ট সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিলো 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' নামে। বাংলাদেশ সেই ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে গেলো। এই কনসার্টের ফলেই পৃথিবীর মানুষ বাংলাদেশকে জানলো। সন্দেহ নেই, জর্জ হ্যারিসনের বিশ্বব্যাপী তারকা-খ্যাতি এই আয়োজনে ও তার সাফল্যে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা রেখেছিলো।

২০০৫-এ 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' প্রথমবারের মতো ডিভিডি-তে প্রকাশ করা হয়েছে। সঙ্গে নতুন করে প্রকাশিত হয়েছে অ্যালবামটিও। মৃত্যুর আগে হ্যারিসন এটি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সমাপ্ত দেখে যেতে পারলেন না। কাজটি সম্পন্ন হলো স্ত্রী অলিভিয়া ও পুত্র ধ্বনির উদ্যোগে। রবি শংকর এ উপলক্ষে লিখেছেন :

"আমি আনন্দিত যে 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' নতুন করে মুক্তি পাচ্ছে। বাংলা অঞ্চলের মানুষ হিসেবে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্যে আমার টান তো ছিলোই। তার ওপরে সেই সময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহারা শরণার্থী ও শিশুদের সাহায্যের জন্যে কিছু একটা করার তাগিদ আমার স্বাভাবিকভাবেই ছিলো।

"জর্জ হ্যারিসনকে বিষয়টি জানালাম। সে আমার অন্তরের আকুতি ও উদ্বেগটি সে বুঝলো এবং একটি কনসার্টের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ শুরু হলো। বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছিলো তাতে। আমার প্রিয় জর্জের সহায়তা ছাড়া তা কিছুতেই সম্ভব হতো না। যা ঘটেছিলো, তা এখন ইতিহাস। এটি গত শতাব্দীর সবচেয়ে তীব্র ভাবাবেগপূর্ণ সঙ্গীত-অভিজ্ঞতাগুলোর অন্যতম।

"অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেন কোনটি আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় কনসার্ট। উত্তরটি আমার জন্যে কঠিন, কারণ পঁচাত্তর বছরের বেশি সময় ধরে সঙ্গীত পরিবেশন করে আসছি আমি। কিন্তু 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' খুবই উল্লেখযোগ্য আমার জন্যে। এর ধারণাটি আমার উদ্ভাবন এবং কনসার্টটি করা হয় আমার আত্মার কাছাকাছি সব মানুষদের সাহায্যের জন্যে, এর মধ্যে আমার অনেক দূর সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনও নিশ্চয়ই ছিলেন। কনসার্টের প্রথম অংশে আলী আকবর খান ও আল্লারাখা খান মঞ্চে উঠেছিলেন আমার সঙ্গে। দ্বিতীয় অর্ধে জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে ছিলেন বব ডিলান ও এরিক ক্ল্যাপটন। সবশেষে জর্জ এই উপলক্ষে তার লেখা 'বাংলাদেশ' গানটি পরিবেশন করে।

"এর ফলে রাতারাতি সারা পৃথিবী বাংলাদেশ নামের দেশটির কথা জানলো। লক্ষ লক্ষ ডলার ইউনিসেফের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হলো। এই ঘটনা যে বিস্মৃত হওয়ার নয়, এ আমার পরম পরিতৃপ্তি। এটি জেনেও ভালো লাগছে যে এই ছবি এবং অ্যালবামটি নতুন করে প্রচারিত হচ্ছে। আমি নিশ্চিত ১৯৭১-এর এই সাড়া-জাগানো কনসার্টটি আজকের শ্রোতাদেরও মুগ্ধ করবে।"




আমেরিকায় বাংলাদেশের পরিচিতি খুব বেশি নেই। অধিকাংশ মানুষ নামও শোনেনি দেশটির, কেউ কেউ আজও জিজ্ঞাসা করে বাংলাদেশ জায়গাটা ঠিক কোথায়? অপেক্ষাকৃত বয়স্করা বাংলাদেশকে জানে 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'-এর কারণেই। তাদের কাছে বাংলাদেশ এবং জর্জ হ্যারিসন এক স্মৃতিময় ব্যঞ্জনার সমার্থক। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জন্যে হ্যারিসন যে কতোটা করেছিলেন, তার বিচার আমরা কোনোদিন করিনি। শত বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যা করা সম্ভব হতো না, দুটি মাত্র কনসার্ট করে সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন তিনি।

সেই প্রথম পৃথিবীর মানুষ জানলো, বাংলাদেশ নামে একটি দেশের অভু্যদয় ঘটছে, তারা স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করছে, সে দেশটিতে নির্বিচার গণহত্যা ও নারীলাঞ্ছনার ঘটনা ঘটছে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশছাড়া হয়েছে। জর্জের উদ্যোগ ও অংশগ্রহণ ছাড়া এটি এতো দ্রুত ঘটানো কিছুতেই সম্ভব হতো না। যতোদূর জানি, ওই একবারই জর্জ হ্যারিসন তাঁর তারকাখ্যাতি ও জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করেছিলেন এবং তা করেছিলেন বাংলাদেশের জন্যেই।

অথচ বাংলাদেশ তাঁকে মনে রাখেনি, ধন্যবাদ জ্ঞাপনটিও করেনি। তাঁকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এমনকি, তাঁকে বাংলাদেশে আসার জন্যে কখনো আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, এমন কথাও কখনো শুনিনি। আমাদের কৃতজ্ঞতাবোধের যথার্থ নমুনা বটে। রাষ্ট্রীয়ভাবে না পারি, আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে স্মরণ করবো। মনে মনে আমাদের অক্ষমতা ও অকৃতজ্ঞতার জন্যে মার্জনা চাইবো।

এই সেদিন ট্র্যাভেলিং উইলবেরি-র অ্যালবামে 'হ্যান্ডল মি উইথ কেয়ার' গানে জর্জের গীটারবাদন শুনতে শুনতে আচমকা মনে হলো, শুধু বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে এমন হৃদয় নিংড়ে নেওয়া আবেদন যিনি সৃষ্টি করতে জানেন, তাঁকে মরে যেতে হয় কেন? আমাদের মতো অকিঞ্চিৎকরদের আয়ু সঞ্চারিত করেও যদি এই ধরনের সৃষ্টিশীল মানুষদের অমর করে দেওয়া যেতো!

-------------------
২০০৭-০২-২৩
-------------------

No comments: