Saturday, October 27, 2007

আকাশকুসুম?

সত্যমিথ্যা জানা নেই, গল্পটি এক বন্ধুর মুখে শোনা। এক সংসদ নির্বাচনে বৃহত্তর ঢাকা শহরের একটি এলাকায় প্রার্থী দুই প্রতিদ্বন্দ্বী - 'ক' এবং 'খ'। 'ক' বিদ্বান মানুষ, নিপাট ভদ্রলোক, মেঠো রাজনীতির মারপ্যাঁচে দক্ষ নন বলে একাধিক নির্বাচনে পরাজিত। 'খ'-এর বিদ্যার খ্যাতি নেই, স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ও অগাধ ভালোমন্দ টাকার মালিক, বাহু ও অর্থবলে নির্বাচন জেতার কৌশল জানেন এবং এককথার মানুষ বলে বরাবর সরকারি দলে থাকেন, বারবার সরকার বদল হলে তাঁর কী করার আছে বলে একবার ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। এই দু'জন ছাড়াও আছেন অখ্যাত একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। এক প্রচার সভায় স্বতন্ত্র প্রার্থী বললেন, 'ভাইসব, আপনেরা ভালো মানুষরে ভোট দিবার চাইলে 'ক' সা'বরে দিয়েন। আর খারাপ মানুষরে চাইলে ভোট দিবেন আমারে। আমি 'খ'-এর চাইতে অনেক বেশি খারাপ লোক!'

স্বতন্ত্র প্রার্থীটি নিকৃষ্টতম ছিলেন কি না সে বিচারে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। পরদিন সকালে মারাত্মক আহত অবস্থায় তাঁকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিলো। বলা বাহুল্য, তিনি বা তাঁর বিবেচনায় ভালো মানুষটি নির্বাচিত হননি।

গল্পটি মনে পড়লো সুশীল সমাজের যোগ্য প্রার্থী আন্দোলনের প্রস্তাবে। উত্তম প্রস্তাব, অন্তত কাগজে-কলমে তো বটেই, ব্যর্থ প্রমাণিত হওয়ার আগে তাকে অশুদ্ধ বা অচল বলার সুযোগ নেই। এর পক্ষে-বিপক্ষে উৎফুল্ল ও ক্ষুব্ধ দুই রকম প্রতিক্রিয়াই পাওয়া যাচ্ছে।
উৎফুল্লরা তাঁদের ইচ্ছাপূরণের সূত্রপাত দেখছেন এই প্রস্তাবে। সত্যি বলতে কি, এর সদিচ্ছা সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করা শক্ত, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের বিপরীতে আদর্শ প্রার্থী নির্বাচনের রূপরেখা আছে এতে। মানুষকে সচেতন করে তোলা, সৎ ও যোগ্য প্রার্থী মনোনয়নের জন্যে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করা, অন্যথায় গ্রহণযোগ্য নির্দলীয় প্রার্থী দাঁড় করানো - এইসব পদ্ধতিতে একটি আন্দোলন সৃষ্টির কথা ড. ইউনুস বলেছেন সুশীল সমাজের পক্ষে।

দলগতভাবে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি এই প্রস্তাবে নীতিগত সমর্থন জানিয়েছে। না জানিয়ে উপায় কি? প্রস্তাবটি সাধারণ ভুক্তভোগী মানুষের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হবে। প্রস্তাবে এমন সব কথা বলা হয়েছে, যার প্রকাশ্য বিরোধিতার নীতিগত অবস্থান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ধার্মিক না হয়েও ধর্মাচরণের বিরোধিতা করার সাহস ক'জনের হয়?

এরপর আসতে শুরু করেছে রাজনীতিক ও তাঁদের অনুগামী-অনুসারীদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। প্রথম আপত্তি, এটি রাজনীতিকে রাজনীতিকদের হাত থেকে কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থাপত্র।

প্রশ্ন হলো, বছরের পর বছর ধরে যে রাজনীতিকরা আমাদের হতাশ করেছেন, মানুষের মঙ্গলের পরিবর্তে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন, যাঁদের হাতে পড়ে রাজনীতি শুধুমাত্র নিজেদের রাজ প্রতিষ্ঠার নীতিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভালোমন্দে যাঁদের কিছুমাত্র আগ্রহ দেখা যায়নি - তাঁদের মুখ চেয়ে মানুষ আর কতোকাল অপেক্ষা করবে? গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত তিন তিনটি সরকার দেশ শাসন করলো তবু কিছুই বদলায় না, মানুষের দুর্ভোগের শেষ হয় না।

রাজনীতিকদের পরিবর্তে সামরিক বা বেসামরিক অন্য কোনো শক্তির হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তুলে দেওয়ার বিষয়ে বেশিরভাগ মানুষেরই ঘোর আপত্তি এবং তা যথাযথ। সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতির ব্যাপারে আমাদের রাজনীতিকরা উদাসীন বলেই এসব কথা উঠতে পারছে, রাজনীতিতে ব্যাপক অরাজকতা ও নীতিহীনতা এ সুযোগটি করে দিচ্ছে। ফলে, যোগ্য প্রার্থী বিষয়ক প্রস্তাব যে অসংখ্য মানুষের অনুভূতির প্রতিনিধিত্ব করে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই অনুভূতিকে সম্মান দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি নিজস্ব নীতি ও কর্মপদ্ধতি সংশোধন করে নিতে পারে, যা ব্যাপক জনসমর্থন অর্জন করবে বলে বিশ্বাস করা যায়। বিকল্প জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের প্রস্তাব (এটি এখনো শুধুই একটি প্রস্তাব) আসতেই যে গেলো-গেলো রব উঠছে, তা কি হাস্যকর লাগে না? মনে কি হয় না, তাঁদের রাজত্বে কেউ ভাগ বসাতে আসছে শুনে তাঁরা দখল হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠছেন? কয়েক দশক ধরে রাজনীতি করেও কিছুমাত্র সাফল্য না-পাওয়া একজন রাজনীতিক ও লেখক যোগ্য প্রার্থী আন্দোলনের প্রস্তাবকারীর নামে ব্যক্তিগত কুৎসা রচনায় মন দিয়েছেন। প্রস্তাবের কার্যকারিতা বা অসারতা, বাস্তবায়নের সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে তাঁর ভিন্নমত থাকতেই পারে, কিন্তু এই ধরনের ব্যক্তি-আক্রমণ আমাদের অভব্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব বটে।

এখন বাস্তবায়নের প্রসঙ্গ। যদি প্রশ্ন করা হয়, রাজনীতি তুমি কার? বাংলাদেশে এই প্রশ্নের সরল উত্তর : যার বাহুবল ও অর্থবল আছে, তার। শুরুতে উল্লেখ করা গল্পে বর্ণিত স্বতন্ত্র প্রার্থীটির পরিণতিকে কীভাবে এড়ানো যাবে? প্রস্তাব অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলির ওপর চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব বলে মনে হয় না। সুশীল সমাজের কথামতো দলগুলি প্রার্থী দেবে, এমন দুরাশা না করাই ভালো। তারা মুখে ভালো কথা ঠিকই বলবে। কিন্তু কাজের বেলায় যা হওয়ার তাই হবে, টাকা ও বাহুবলে শক্তিমানদেরই তারা প্রার্থী করবে, এমনকি দলত্যাগী হয়ে সদ্য আসা হলেও। ক্ষমতায় অধিষ্ঠান একমাত্র লক্ষ্য বিবেচনা না করে দলগুলি যদি সাধারণ ন্যায়বোধের রাজনীতিতে ব্রতী হয় তাহলেই এই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। তাদের সে শক্তি ও সামর্থ্য নিশ্চয়ই আছে, যা নেই তা সদিচ্ছা।

ড. ইউনুসের প্রস্তাবমতো নির্দলীয়ভাবে প্রার্থী দেওয়া হলে তার না থাকবে অর্থবল, না বাহুবল। এই বাস্তবতার উপলব্ধি শেরাটনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সভায় বসে সম্ভব নয়। উদ্যোক্তারা এই প্রস্তাবটি পল্টনে দাঁড়িয়ে দিলেন না কেন? তাতে আরো বেশি মানুষের সামনে প্রস্তাবগুলিকে যাচাই করে নেওয়া যেতো। এটিকে রাজনৈতিক আন্দোলন না বলে সামাজিক আন্দোলন হিসেবেই হয়তো তাঁরা দেখতে চান। কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে এই তৎপরতার দূরত্ব কতোটুকু? কেতাবী বা তাত্ত্বিকভাবে সঠিক কোনো কর্মসূচী যে বাংলাদেশের গড়পড়তা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেই, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। যদি হতো, বাংলাদেশে বাম ধারার রাজনীতির এমন এতিম দশা হওয়ার কথা ছিলো না।

তবু বলতেই হবে এই প্রস্তাবে আর কিছু না হোক, একটা আলোচনা বা বিতর্ক তো শুরু করা গেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলি যদি কিছু সচেতন হয়, তাদের ত্রুটিগুলি শুধরে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে - তা-ও হবে আমাদের এক বড়ো প্রাপ্তি। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা আপাতত এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করছেন বলে মনেও হয় না।

----------------
মে ২০০৬
----------------

No comments: