Thursday, October 18, 2007

যাই

১.

আমার অনেক ঋণ রয়ে গেলো তোমার কাছে!

ভেজানো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অস্পষ্ট স্বরে প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলেন এবারক হোসেন। তাঁর গলা ধরে আসে। জোহরা বেগম এমনিতে সহজে ভেঙে পড়ার মানুষ নন, কিন্তু কথাগুলো তো শুধু কথা নয়, তার পেছনে কিছু একটা যেন লুকানো। ভাবতে চান না এমন কথা মনে আসে, তাহলে এই সেই সময়! এসে গেলো!

চোখ ভিজে উঠতে মুখ নিচু করেন জোহরা বেগম। এবারক হোসেনের দুই হাতের মুঠোয় ধরা তাঁর ডান হাত। হাতগুলো কি একটু কেঁপে ওঠে? ঠিক বোঝা যায় না। বুকের ভেতরে শেকড় উপড়ে ফেলার মতো তোলপাড়, মাথা পাগল-পাগল। এই সময়ে হাতের সামান্য কেঁপে যাওয়া কি আর টের পাওয়া যায় তেমন করে! টের পেলেও মানতে ইচ্ছে করে না। এ সত্যি নয়, সত্যি নয়!

দরজার বাইরে বারান্দায় রবি অপেক্ষা করছে। গেটের সামনে রিকশা দাঁড়িয়ে, ওই রিকশাতেই রবি এসেছে। আর দেরি করিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না ভেবে জোহরা বেগম বললেন, তোমরা যাও। আমি আরেকটা রিকশা পেলেই চলে আসছি।

এবারক হোসেন শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ওঠেন। ঘরের ম্লান আলোয় দেখা যায়, তাঁর ফর্সা মুখ লালচে হয়ে উঠেছে। গায়ে জড়ানো চাদরে চোখ মুছে এবারক হোসেন ডান হাত রাখেন জোহরা বেগমের মাথায়। সে মাথায় এখন কালোর চেয়ে সাদা চুল অনেক বেশি, পাতলাও হয়ে এসেছে। পঞ্চাশ বছর আগের একটি ছবি এক ঝলক দেখতে পেলেন এবারক হোসেন। মাথাভরা কোঁকড়া কালো চুলের মেয়েটি। টলটলে একখানা মুখের ওপরে বসানো উজ্জ্বল একজোড়া চোখ।

বিয়ের পরে এবারক হোসেন কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছেন, জোহরা বেগম কিছুদিন নিজের বাবা-মা’র কাছেই থাকবেন। বিদায় দেওয়া-নেওয়ার ছোট্টো এক টুকরো ছবি। সেই ছবিটিই এখন এবারক হোসেন স্পষ্ট দেখলেন। কী মায়া মাখানো সেই মুখ, সেই দেখা! ‘চেয়ে দেখি আর মনে হয় / এ যেন আর-কোনো একটা দিনের আবছায়া, ... দূরকালের কার একটি ছবি নিয়ে এল মনে। / স্পর্শ তার করুণ, স্নিগ্ধ তার কণ্ঠ, / মুগ্ধ সরল তার কালো চোখের দৃষ্টি।’

মুখ বাড়িয়ে জোহরা বেগমের কপালে ছোটো করে ঠোঁট ছুঁইয়েই পেছন ফিরেছেন এবারক হোসেন। টের পেলেন, তাঁর একটা হাত শক্ত করে ধরে আছেন জোহরা বেগম। ‘লতায়ে থাকুক বুকে চির-আলিঙ্গন, / ছিঁড়ো না, ছিঁড়ো না দুটি বাহুর বন্ধন।’

কী হলো, এবার যাই!

জোহরা বেগম জানেন না কখন তাঁর দুই হাত এবারক হোসেনের হাত আঁকড়ে ধরেছে। কী একটা মনে পড়ি-পড়ি করে। মনের ভেতরটা কী-যেন-কী কয়ে ওঠে। উপায় নেই, হাতটা আলগা করে দিতে হয়।

দরজা খুলে বাইরে আসতে এক ঝলক ঠাণ্ডা এসে মুখে লাগে। পৌষ শেষ হয়ে মাঘের শুরু। এবারে শীতও যেন একটু বেশিই পড়েছে। জোহরা বেগম জানেন, তবু জানেন না, বুকের ভেতর এমন খালি লাগে কেন!
ধীর পায়ে দুটো সিঁড়ি ভেঙে নামেন এবারক হোসেন। গেটের কাছে এসে এক মুহূর্ত থামেন। রাস্তায় আলো বেশি নেই। বাইরের বারান্দায় আলো জ্বালানোর কথা মনেও পড়েনি। বসার ঘরের জানালা ঘেঁষে দাঁড়ানো পুরনো শিউলি গাছে সাদা ফুলগুলো দেখা যায় আধো অন্ধকারে। ভোরের আলো ফোটার আগে পাড়ার কয়েকটা ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে শিউলি কুড়িয়ে নিয়ে যায় রোজ। মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে মাঝে মাঝে ওদের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। প্রথম প্রথম সকালে দরজা খুলে বেরোলে ফুলচোররা দৌড়ে পালিয়ে যেতো, প্রশ্রয় পেয়ে আজকাল আর পালায় না। অনেক বছর ধরে ওই ভোরের ফুলচোরদের মুখ বদলে গেছে কিছুদিন পর পর, ফুল কুড়ানোর বয়স ছাড়িয়ে গেলে নতুন মুখ এসে তাদের জায়গা নিয়েছে। কাল ভোরে কি ওদের দেখা পাওয়া আর হবে?

রবি এবারক হোসেনের হাত ধরে রিকশায় তুলে বসিয়ে দেয়। নিজে উঠে বসার আগে বলে, আমি রিকশা পেলে পাঠিয়ে দিচ্ছি, দিদা। না হলে এই রিকশাই আপনাকে নিতে আসবে।

এবারক হোসেনের মুখটা ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলেন না বলে নেমে রাস্তার কাছে চলে এলেন জোহরা বেগম। এবারক হোসেন শক্ত মুখে সোজা সামনে তাকিয়ে আছেন। ব্যথাটা কি আছে এখনো? বাড়লো কি আবার? এমন মানুষ, মুখে ফুটে বলবেন না, বুঝতেও দেবেন না! চোখের কোলে কি পানি দেখা যায়! কিছু একটা বলতে গিয়েও পারলেন না জোহরা বেগম, রিকশা চলতে শুরু করেছে। এবারক হোসেন মুখ তুলে দোতলা বাড়িটা একবার দেখলেন - ‘ভাঙল দুয়ার, কাটলো দড়াদড়ি...’

এমনিতে শীতবোধ খুব বেশি তাঁর, অথচ আজ এই মাঘের প্রবল শীতের রাতে রিকশায় বসে কিছুই টের পাচ্ছিলেন না। ফুলহাতা ফ্লানেলের শার্টের ওপর সোয়েটার, তার ওপরে উলের চাদর জড়ানো। একটু মনে হয় গরমই লাগছে। লাগুক, কিছু এসে যায় না। রবি পাশে বসে এক হাতে তাঁর কোমর জড়িয়ে ধরে আছে। মনে মনে হাসলেন, ধরে কি আর রাখতে পারবি রে রবি? চলেই তো যাবো।

পেছনে তাকিয়ে নিজের বসত বাড়িটিকে আরেকবার দেখলেন। দেখতে পেলেন না, জোহরা বেগম তখনো দাঁড়িয়ে আছেন গেটের কাছে, ঝাপসা দুই চোখ তাঁরই দিকে।

বাড়ির দিকে চোখ ফিরিয়ে এবারক হোসেনের মনে হলো, এই বাড়িটিকে কি তাঁর জাগতিক অর্জনের প্রতীক মনে করা যেতে পারে? হয়তো পারে। ছেলেমেয়েদের মানুষ করার সঙ্গে সঙ্গে একই রকম যত্নে-ভালোবাসায় অনেক বছর ধরে বানানো। দেড় হাজার টাকায় সাড়ে চার শতক জায়গা যখন কিনেছিলেন বাড়ি করার জন্যে, এদিকে বসতি তেমন ছিলো না। শহরের শেষ মাথায় বাঁশঝাড় ঘেরা জায়গাটিতে বাড়ি তুলে শখ করে নাম দিয়েছিলেন - বনান্ত। হিসেব করে দেখলে পঁয়ত্রিশ বছরের বাস এই বাড়িতে। এতোটা সময় চলে গেছে, বোঝা তো যায়নি!

শীতের রাতের জনহীন অন্ধকার রাস্তায় রিকশা এগিয়ে যায়। সরু পীচঢালা রাস্তা, দুটো রিকশা কোনোমতে মুখোমুখি পাশ কাটাতে পারে। এবারক হোসেন যখন এখানে বাড়ি তুলতে শুরু করেন, সেই সময় ছিলো কাঁচা মাটির রাস্তা। একদিন ইট বসলো, পীচ ঢালা হলো তারও অনেক পরে। দু’পাশে খানিক দূরে দূরে ল্যাম্পপোস্ট। নামেই ল্যাম্পপোস্ট, আলো জ্বলে না বেশিরভাগ সময়। সেই বাঁশঝাড়ের অনেকটাই এখন নেই। মানুষের নতুন নতুন বসতির বিস্তার ঠেকায়, এমন সাধ্য কার!

বাড়ি তৈরি শুরু হওয়ার সময় কাছের প্রতিবেশী বলতে ছিলো রাস্তার উল্টোদিকে আলতাফ কন্ট্রাকটর আর তার পরের বাড়ির তোতারা। তোতার ছোটো বোন আঙুরকে বিয়ে করেছে এক পুরনো ছাত্র, মোহাম্মদ আলী। পরে ওদেরও বাড়ি উঠেছে তাঁর বাড়ির ঠিক পুবদিকের সীমানা ঘেঁষে।

রাস্তায় মানুষজন একেবারে নেই, দু’পাশের বাড়িগুলোও ঘোর অন্ধকারে ডুবে আছে এখন। এতোদিনের প্রতিবেশীরা কেউ জানে না, মনে মনে এবারক হোসেন বিদায় নিতে নিতে একেকটা বাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছেন।
মোহাম্মদ আলী ছেলেটা বেশ খোঁজখবর করে, বাজারে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করে যায়, কিছু আনতে হবে কি না। আর আছে তাঁদের দু’ঘর ভাড়াটে। ওপরতলায় অসীমকুমার কুণ্ডু। বউ রীতা আর ছোটো তিনটি মেয়ে নিয়ে সংসার সরকারি চাকুরে অসীমের। এই অসীম-রীতারা আছে আজ প্রায় ন’বছর। নিচেরতলার চারটি ঘরের দুটো কোনো কাজে লাগে না বলে ভাড়া দেওয়া হয়েছে বছরখানেক আগে। দু’বছরের একটি ছেলে নিয়ে মজিবর আর ইতির ছোট্টো সংসার সেখানে। কুড়িয়ে পাওয়া দাদু-দিদার দেখা না পেলে ওপরের আর নিচেরতলার বাচ্চাগুলোর একটি বেলাও চলে না।

নিজেদের ছেলেমেয়েগুলো একে একে বাড়িছাড়া হয়েছে। ছোটো এই শহরের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠে এক এক করে নিজেদের জীবন-জীবিকায় চলে গেছে আরো বড়ো বড়ো সব শহরে। এবারক হোসেন নিজে যেমন একসময় দোগাছি গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছিলেন। এক হিসেবে ধরতে গেলে ছড়িয়ে গেছে ওরা পৃথিবীময়। মেজো ছেলেটি একবার বলেছিলো, খেলতে যদি হয় বড়ো মাঠে খেলাই তো উচিত। ভালো লেগেছিলো তাঁর। অসীম-মজিবরদের বাদ দিলে এখন বাড়িতে বাসিন্দা তাঁরা দু’জনই। অবশ্য ভাড়াটেরা কোনোদিনই শুধু ভাড়াটে হয়ে থাকেনি তাঁদের, এক রকমের আত্মীয় হয়ে উঠেছে।

আজ সন্ধ্যায় জোহরা বেগম একবার ওপরে অসীমকে খবর দিতে চেয়েছিলেন। মনে পড়েছিলো, অসীম আজ বাড়িতে নেই। চাকরির কারণে মাঝে মাঝে তাকে শহরের বাইরে দুয়েক রাত থাকতে হয়। ফিরবে আগামীকাল। এই সময় আর কাকে বলবেন! মজিবরকে বলতে যাবেন, এবারক হোসেন নিষেধ করেছিলেন। তাঁর ইচ্ছে নীরবে চলে যাওয়া, ওদের মুখের দিকে তাকালে যেতে বড়ো কষ্ট হবে যে! ‘ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি...’

বুকের ব্যথাটা এবারক হোসেন অনেকক্ষণ ধরেই চেপে রাখার চেষ্টা করছিলেন। বিশেষ করে জোহরা বেগমকে ব্যথার তীব্রতা খুলে বলতে চাননি। যা জানার, তা তো জানবেই। একটু আগে বা পরে, এই যা। শুধু শুধু এখনই উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে কী লাভ! এখন কষ্টটা যন্ত্রণার পর্যায়ে চলে গেছে, সহ্যের সীমার মধ্যেও আর নেই। বুকের ভেতরটা প্রবলভাবে চেপে চেপে আসছে, সারা শরীর ঘামে ভিজে উঠেছে। বললেন, রবি, আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

রবি নিজে ডাক্তার। এবারক হোসেনকে জড়িয়ে ধরে বসে সবই টের পাচ্ছিলো সে। কিন্তু ডাক্তারি বা সাধারণ বিবেচনায় সে জানে, হাসপাতালে পৌঁছার আগে কিছুই করার নেই। রাত দশটার দিকে খবর পেয়েছিলো রবি। মাত্র খেতে বসেছে, এই সময় মজিবর এসেছিলো। তখনই সে জানে, নিতান্ত নিরুপায় না হলে শীতের রাতে অতো দেরিতে কেউ আসে না। হাত ধুয়ে উঠে পড়েছিলো সে মজিবরের সঙ্গে রিকশায়।

রবি বললো, এই তো দাদু, আর একটু, হাসপাতালে পৌঁছে গেলেই একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

ব্যবস্থা করা যদি না যায়, রবি?

এ কথার কোনো উত্তর হয় না। তবু রোগীর মনের জোর টিকিয়ে রাখা দরকার, ডাক্তার রবীন্দ্রনাথ সরকার জানে। বলে, এতো ঘাবড়াচ্ছেন কেন?

বুকের ভেতরে অমানুষিক খামচানির মধ্যেও এবারক হোসেনের হাসতে ইচ্ছে করে। মনে মনে বলেন, শরীরটা তো আমার, রবি! আমি জানি।

তাঁর জানা হয়ে গেছে, এই রাতের পরের ভোরটি আর দেখা হবে না - ‘ঢাকো তবে ঢাকো মুখ, নিয়ে যাও দুঃখ সুখ / চেয়ো না চেয়ো না ফিরে - / হেথায় আলয় নাহি - অনন্তের পানে চাহি / আঁধারে মিলাও ধীরে...’। এখন শুধু সহ্য করে যাওয়া আর অপেক্ষা করা। শেষের সে সময়টা কেমন হবে? ‘হঠাৎ খেলার শেষে আজ কী দেখি ছবি/স্তব্ধ আকাশ নীরব শশী রবি...’

একজন কবিকে মনে পড়ছে তাঁর। মনে পড়ার ব্যাপারও ঠিক নয়, কবি তাঁর জীবন ঘিরে আছেন সেই কবে থেকে! খঞ্জনপুর হাই স্কুলের নিচের ক্লাসের ছাত্র তখন এবারক হোসেন। বীরেন স্যার ক্লাসে এসে কবির মৃত্যুর খবর দিয়ে বলেছিলেন, আজ আমি আর কিছুই পড়াবো না। ক্লাসের পুরোটা সময় তিনি সেই কবির কবিতা পড়ে শুনিয়েছিলেন। সব কবিতা বোঝার বয়স তাঁর তখনো হয়নি। বীরেন স্যারের আবৃত্তির গুণে বা আর যে কোনো কারণেই হোক, কবি তাঁর প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কবির তখন খ্যাতি প্রচুর, কিন্তু একজন কবির মৃত্যুতে ক্লাসের পড়া বন্ধ রাখা খুব অভিনব মনে হয়েছিলো। পৃথিবীর শেষ বড়ো যুদ্ধের দ্বিতীয় বছর চলছে তখন, ঋতু বর্ষা।

কিন্তু কবির কি মৃত্যু হয়? সেই দিনের পরে খুঁজে খুঁজে কবির কবিতা পড়ার শুরু তাঁর। একদিন বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে উঁচু দেওয়ালঘেরা এক বাড়ির ভেতর থেকে কিশোরীকণ্ঠের গান ভেসে আসতে শুনেছিলেন - ‘আজি মর্মরধ্বনি কেন জাগিল রে...’। আগের শোনা কোনো গানের সঙ্গে এই গানের মিল নেই। একেবারে নতুন। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গানটা শুনতে হয়েছিলো। পরে জেনেছিলেন, এ-ও সেই কবির গান। দেওয়ালঘেরা বাড়িটি ছিলো এক সম্পন্ন হিন্দু পরিবারের, মুসলমান বাড়িতে তখনো মেয়েরা গান করে না। সেই গান গাওয়া কিশোরী মেয়েটিকে কোনোদিন চোখে দেখেননি, কিন্তু সেই গান যে কী সুধারস ঢেলেছিলো, আজও তা তাঁর কানে লেগে আছে।

কবির কবিতা আর গান বুকের ভেতরে খোদাই হয়ে যাচ্ছিলো। কলেজ পেরিয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়া, সাহিত্যের শিক্ষকতা - সে-ও কবির কারণে। আজ ষাট বছরের ওপরে কবি তাঁর নিত্যদিনের সখা।

‘কবে আমি বাহির হলেম তোমারই গান গেয়ে
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়।
ভুলে গেছি কবে থেকে আসছি তোমায় চেয়ে -
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়।
ঝরনা যেমন বাহিরে যায়, জানে না সে কাহারে চায়
তেমনি করে ধেয়ে এলেম জীবনধারা বেয়ে
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়।’

আজ এই রাতে, যখন তিনি জেনে গেছেন, যাওয়ার সময় হয়ে গেছে, কবিকে কি তাঁর মনে পড়বে না! কবি বলেছিলেন, আমার কিছুই না থাকলেও গান থেকে যাবে। কবিরা ভবিষ্যৎদ্রষ্টাও হয়ে থাকেন। কবির গান আজও ঠিকই রয়ে গেছে, আজও নতুন। এবারক হোসেনের অকস্মাৎ মনে হয়, আচ্ছা, আমি চলে গেলে আমার কী থাকবে? কিছু থাকবে কি? এই যে এতোগুলো বছর কাটলো এই ধূলি-ধূসরিত পৃথিবীতে, তার যোগফল কি? আনন্দ-সুখ-বেদনা-দুঃখ-চাওয়া-হতাশা-ভয়-দুরাশা-পাওয়া এইসব মিলিয়ে জীবন নামের অত্যাশ্চর্য মহার্ঘ্য একখানা জিনিস, এই তো! ধরাছোঁয়া যায় না, কেবল যাপন করে যেতে হয়। কী পাওয়া হলো? কবি বলেছিলেন, ‘...কী পাইনি, তার হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি...’। সময় নেই, এসব হিসেব মিলিয়ে আর কী হবে? যা পাওয়া গেলো, যা দেওয়া হলো, সবটুকুর শেষ যোগফল এই সত্যে এসে স্থির হয় - চলে যেতে হবে। ‘ভালোবেসেছিনু এই ধরণীরে...’

হাজীপাড়ায় এসে রিকশার চেন পড়ে গেলে রবি বলে, তাড়াতাড়ি কর রে, বাবা। তোর চেন পড়ার আর সময় পেলো না!

রিকশাওয়ালা কোনো জবাব দেয় না। এবারক হোসেন অন্ধকারে চোখ ফেলে চারদিক দেখে নিচ্ছিলেন। রাস্তার বাঁদিকে ছোটোমতো একটা মাঠ, ছেলেরা দিনের বেলায় হৈ-হল্লা করে খেলে। খেলাধুলা নিয়ে তাঁর বিশেষ উৎসাহ কোনোদিন ছিলো না, এই মাঠের পাশ দিয়ে যেতে লক্ষ্য করেও দেখেননি তেমন। আজ এখন মনে হলো, আর দেখা হবে না! ‘এতো কামনা এতো সাধনা, কোথায় মেশে...’


২.

অন্ধকার থাকতে ভোরবেলা উঠে গোসল সেরে ফেলার অভ্যাস। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় সারা বছর এবারক হোসেন কাকভোরে গোসল সেরে হাঁটতে বেরিয়ে যান। কোনো কারণে এদিক-ওদিক হয়ে গেলে মনে হয়, দিনটা ঠিকমতো শুরু করা হলো না। আজও দিনের শুরুতে অন্যরকম কিছু ঘটেনি। মর্নিং ওয়াক সেরে ফিরে আলু ভাজা দিয়ে দুটো রুটি খেয়েছিলেন। আলু খেতে অবশ্য ডাক্তারের নিষেধ আছে, ব্লাড শ্যুগারের বাড়াবড়ির কারণে। মাসকয়েক আগে এইসব গোলমাল নিয়ে দিনকতক হাসপাতালেও থাকতে হলো। তখন ডাক্তার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে খুব সাবধান করে দেয়। সতর্ক এবারক হোসেন বরাবর। কিন্তু বয়স তাঁকে এমন একটা জায়গায় এনে ফেলেছে যে শরীরের কলকব্জাগুলো আর বশে রাখা যাচ্ছে না।

এ দফায় আবার ডাক্তার বলে দিয়েছে, ফলমূলও খেতে হবে খুব বাছাবাছি করে। কী সর্বনাশ! আমের মৌসুম তখন, আমও নাকি খাওয়া যাবে না। দুপুরে খাওয়ার পরে মৌসুমের একটা কোনো ফল মুখে না দিলে খাওয়া শেষ হলো বলে যে মনেই হয় না! আমের সময় তো অবশ্যই আম, তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। হাসপাতাল থেকে ফিরে তিনি পরদিনই আম কিনে এনেছিলেন। ডাক্তারের নিষেধের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন জোহরা বেগম। এবারক হোসেন মিটিমিটি হেসে বলেছিলেন, আগামী বছর আমের সময় যদি আমি আর না থাকি! তখন তো তোমারই মনে হবে, আহা রে, মানুষটা খুব আম খেতে চেয়েছিলো!

আজ সকালে নিজেই আলু ভাজা করতে বলে গিয়েছিলেন। ডাক্তারের নিষেধ মনে করিয়ে দিয়ে লাভ নেই, চুপ করে ছিলেন জোহরা বেগম। সবকিছুতেই ঠাট্টা করার ঝোঁক মানুষটার, ফট করে কী একটা হয়তো বলে দেবেন। রাগও করা যায় না।

দুপুরে খাওয়ার পর খবরের কাগজ পড়তে পড়তে সামান্য ঘুমিয়ে নেওয়ার অভ্যাস অনেকদিনের। আজ ঘুম থেকে উঠতে বিকেল হয়ে গিয়েছিলো। বিছানা ছেড়ে উঠে পাশের ঘরে প্রিয় ইজিচেয়ারে বসতে গিয়ে বুকে অস্পষ্ট চিনচিনে ব্যথামতো টের পেলেন। জিনিসটা খুব অপরিচিত নয়, এই ব্যথার সঙ্গে তাঁর জানাশোনা হয়েছিলো ঠিক আট বছর আগে। সে রাতে জোহরা বেগম বাড়িতে ছিলেন না, গ্রামে ভাইয়ের বাড়ি গিয়েছিলেন। সন্ধ্যা থেকে সেদিন এবারক হোসেন বুকের অস্বস্তি টের পাচ্ছিলেন, রাতের সঙ্গে ব্যথাও বেড়ে যাচ্ছিলো। ঘাড়ের পেছন দিকটা টনটন করতে থাকে, সারা শরীরে ঘাম দেয়। রাত এগারোটায় রিকশা নিয়ে একা একা উপস্থিত হয়েছিলেন ডক্টরস ক্লিনিকে। তাঁর এক পুরনো ছাত্র ডাক্তারি পাশ করে ক্লিনিক খুলেছে। চাকরি নিয়ে এ শহরে এসে প্রথম যে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন এবারক হোসেন, সেই একতলা বাড়িটি এখন তিনতলা হয়ে ডক্টরস ক্লিনিক। ডাক্তার ছাত্রটি তাঁকে পরীক্ষা-টরীক্ষা করে দোতলার ক্যাবিনে শুইয়ে দিয়ে বলেছিলো, এখন আপনার কোথাও যাওয়া চলবে না। ভাগ্য ভালো, সময়মতো এসে পড়েছেন।

কাটাছেঁড়া অবশ্য কিছু করতে হয়নি, কিন্তু এখানে দিনকয়েক চিকিৎসার পর ডক্টরস ক্লিনিকের ডাক্তারদের প্ররোচনায় আর ছেলেমেয়েদের প্রশ্রয়ে ঢাকা পর্যন্ত সাত-আট ঘণ্টার পথ অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে যেতে হয়েছিলো। প্রাইভেট ক্লিনিক আর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল মিলিয়ে মাস দুয়েক কাটানোর পর ডাক্তাররা ঘরে ফেরার অনুমতি দেয়। ছাড়া পেয়ে বনানীতে মেয়ের বাড়ির দোতলায় যখন উঠতে হলো চারজনে ধরাধরি করে তোলা একটি চেয়ারে বসে, সেই প্রথম নতুন একটি সত্য জানা হয়েছিলো - এতো বছর ধরে যে শরীরের মালিকানা, তার অনেক কলকব্জা আর নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করবে না। বড়ো দীনহীন, অথর্ব মনে হয়েছিলো তখন নিজেকে। সোহরাওয়ার্দীতে প্রথম দু’দিন বেডের অভাবে রোগীদের বিছানার ফাঁকে প্যাসেজের মেঝেতে শুয়েও এতো জীর্ণ লাগেনি। সময় বড়ো নির্দয়, কতোকিছু যে কেড়ে নেয় সে!

বিকেলে বুকের ব্যথা যখন টের পেলেন, সেই সময় জোহরা বেগম বাড়ির পেছনে বাগানে শুকোতে দেওয়া কাপড়গুলো গুছিয়ে তুলে নিচ্ছিলেন। একতলা হয়ে গেলে এ বাড়িতে উঠে আসার কিছুদিন পর বাড়ির পেছনের লাগোয়া কিছু জায়গা কিনে ফেলেছিলেন। জায়গাটা তখনো বাঁশঝাড়। সেগুলো কেটেকুটে পরিষ্কার করে উঁচু পাঁচিলে ঘিরে অনেক রকমের গাছপালা লাগানো হয়েছিলো। গাছগুলো এখন সব বড়ো হয়ে উঠেছে, সেখানে রোদও আর আগের মতো পাওয়া যায় না। তবু ওরই ফাঁকে ফাঁকে দড়ি ঝুলিয়ে কাপড় শুকোতে দেওয়া হয়।
জোহরা বেগম ঘরে এলে এবারক হোসেন বলি-বলি করেও বললেন না। ভুলও হতে পারে। পেটে গ্যাস হলেও এরকম হয়, শুধু শুধু ব্যতিব্যস্ত হওয়ার মানে হয় না। বললেন, এক গ্লাস পানি দাও তো!

পানি দিয়ে জোহরা বেগম বললেন, আমি ওপর থেকে একটু ঘুরে আসি।

ওপরতলার অসীম আজ সারাদিন নেই, রীতাও মেয়েগুলোকে নিয়ে বাইরে ছিলো। ফিরেছে একটু আগে, অসীমের ছোটো মেয়েটি ওপর থেকে হাঁক দেয়, দিদা!

তার মানে এখন তুমি ওপরে আসবে, না আমি নিচে আসবো? জোহরা বেগম জবাব দিয়েছিলেন, একটু পরে আসছি রে, দিদি।

জোহরা বেগম ওপরে যাচ্ছেন শুনে এবারক হোসেন একবার ভাবেন বলবেন, থাক, আজ না হয় না গেলে। এখন আমার কাছে একটু থাকো। বললেন না। বললে খুব অস্বাভাবিক কিছু শোনাতো না, জোহরা বেগম কিছুক্ষণ আশেপাশে না থাকলে দিশেহারা লাগে তাঁর। ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়ে যে যার মতো ছড়িয়ে যাওয়ার পর শূন্য বাড়ি। কাজের মেয়ে একজন আছে, সকালে-বিকেলে কাজ করে দিয়ে চলে যায়। ঘুরেফিরে সেই দু’জন মাত্র মানুষ সারা বাড়ি জুড়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁর এক শিক্ষক - খুব বিখ্যাত পণ্ডিত ড. শহীদুল্লাহ - একবার ক্লাসে বলেছিলেন, শেষ বয়সে এখন আমার সম্বল হলো বই আর বউ। ক্লাসে সবাই বেদম হেসেছিলো সেদিন।

এখন এবারক হোসেন জানেন, স্যার একটুও ভুল বলেননি। বই পড়া আজকাল আর তাঁর হয় না, চোখের ওপর বড়ো চাপ পড়ে। চিকিৎসা অনেক রকম করা হলো, খুব একটা কিছু হয়নি। ডাক্তার শেষমেষ বলে দিয়েছে, এ চোখ এখন শুধু খারাপই হতে থাকবে, সেই ধস ঠেকানোর নাকি কোনো উপায় নেই আর। কিন্তু বউ না হলে তাঁর চলে না। অনেক বছরের নির্ভরতা। বন্ধু-বান্ধবরাও একে একে অনেকে চলে গেছে, যারা আছে তাদের সঙ্গেও দেখা-সাক্ষাৎ বড়ো একটা হয় না। সবাই এখন খুব ছোটো জায়গার মধ্যে চলাফেরা করে, একটু দূরে কোথাও একা একা যাওয়া আর হয়ে ওঠে না।

এখন তাঁর সঙ্গী বলতে, বন্ধু বলতে তো এক জোহরা বেগম। এই গত অগাস্টে তাঁদের বিয়ের পঞ্চাশ বছর হলো। ঝর্ণা একটা উৎসবমতো করবে। ঘটা করে এসব পালন করার রীতিনীতির সঙ্গে ভালো পরিচয় ঘটেনি, খানিক আপত্তি তাঁর ছিলোই। তবু রাজি হয়েছিলেন, একটা উপলক্ষ করে সবাইকে একসঙ্গে পাওয়া যাবে, এ-ই বা কম কি! করা হলো একটা ছোটোখাটো অনুষ্ঠান। ঢাকায় চিঠি লিখেছিলেন: আমাদের বিয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ছোটোখাটো একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চাই। জীবনের এই শেষ উৎসবে মনে-প্রাণে তোমাদের জন্যে প্রতীক্ষা করছি। তোমরাই আমাদের আত্মার ধন, আমাদের সামনে যাওয়ার পিছুটান...

দোগাছীর গ্রামের বাড়ি থেকে বড়ো তিন ভাইয়ের ছেলেরা - খোকা, আশরাফ, আফজাল - তাদের বউ-ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসেছিলো। ঢাকা থেকে মেজো ছেলে ফিরোজ আর তার বউ রুবা, ঝর্ণা-রঞ্জু আর তাদের একমাত্র ছেলে রঙ্গন। রীতা আসতে পারেনি, জ্বরে পড়া মেয়েকে নিয়ে ঢাকা থেকে ছুটে আসার কোনো মানে হয় না। এবারক হোসেন ফোন করে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। আর আসেনি বড়ো আর ছোটো দুই ছেলে। দেশের বাইরে থেকে সশরীরে ওদের আসা সম্ভব ছিলো না, ফোনে এসেছিলো। বড়ো ছেলেকে লিখেছিলেন: তোমরা আসতে পারবে না জেনেও এই ভেবে পুলক অনুভব করছি যে তোমরা ছায়ার মতো আমাদের পাশেই আছো...

জোহরা বেগম ওপরে চলে যেতে এবারক হোসেন ইজিচেয়ার থেকে উঠে পড়লেন। শোবার ঘরে গেলেন, বেরিয়েও এলেন আবার। দরজা খুলে বাইরের বারান্দায় একটু দাঁড়ালেন। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। কিছু না দেখেই খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে এলেন ঘরে। অস্থিরতা বোধ করেন। মনে হয়, কী যেন একটা কী করার আছে। কিন্তু কী? মনে পড়ে না। বুকের ব্যথা খানিক বেড়েছে বলে বোধ হয়। অন্ধকার ঘরে ফিরে আলো জ্বালতেও ইচ্ছে হলো না। আবার ইজিচেয়ারে বসতে বুকের ভেতরে একটা তীব্র দংশন টের পেলেন। ধাক্কাটা খুব আচমকা আর জোরালো। এই তো সেই দংশন, চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয়। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকেন ইজিচেয়ারে।

ছোবলটা আর টের পাওয়া যায় না, কিন্তু বুকের ভেতরটা কেমন ভয়ানক ভারি হয়ে চাপ ধরে আছে। যেন বুকের ওপর পাথরচাপা দেওয়া হয়েছে। চোখমুখে গরম ভাপ, এই শীতে সন্ধ্যায়ও কপালে ঘাম জমছে। শরীরের ভেতরে কি ঘটছে, ভাবতে চান না। ভেবে কী হবে! ‘যেতে যদি হয় হবে / যাব, যাব, যাব তবে...’। জীবনের কাজ কিছুই আর বাকি পড়ে নেই। অবশিষ্ট পড়ে আছে কেবল একবুক ভরা মায়া, ভালোবাসার মানুষদের জন্যে পিছুটান। এই লেনদেন শেষ হওয়ার নয়। জীবন যে কী ভীষণ এক তৃষ্ণা! তার পরতে পরতে কতো মায়া আর পিছুটান! ‘এখনো নিজেরই ছায়া, রচিছে কত যে মায়া / এখনো মন যে মিছে চাহিছে কেবলই পিছে...’

এবারক হোসেন জানেন, জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে শুয়ে আছে অস্পষ্ট একটি রেখা। দেখা যায় না, বোঝা যায়না। অনুভবেরও বাইরে। তাহলে? এক মুহূর্তের কারসাজিতে নেই হয়ে যাওয়া! কী করুণ! নিজের জন্মের সময়টি মানুষের স্মৃতিতে থাকে না। আর এই চলে যাওয়ারও তো কোনো স্মৃতি আমার থাকবে না। অদেখা সুতোয় টানা রেখাটি পেরিয়ে গেলেই স্মৃতি-বিস্মৃতি কোনোকিছুরই আর কোনো মূল্য নেই। আমি তখন অন্য মানুষদের কাছে স্মৃতি, আমার সেখানে কোনো ভাগ নেই! কী দুঃসহ এই চলে যাওয়া। কী অর্থ আছে এর! জীবনের পরে কী আছে জানা গেলে হয়তো এই যাওয়া অনেক সহজ হয়ে যেতো। জানা নেই বলেই কি এতো সংশয়! এতো দ্বিধা! এতো পিছুটান! পিছুটান, ভালোবাসা, মায়া না থাকলে বুকভাঙা এমন হাহাকারও বুঝি উঠতো না।

শরীরের ভেতরে এই আকস্মিক আক্রমণ সহনীয় হয়ে ওঠার কথা নয়, কিছু সময় যেতে হয়তো খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে ওঠার ব্যাপার ঘটে। এবারক হোসেন ধীরে ধীরে উঠে বসলেন, অনেকখানি ইচ্ছেশক্তি জড়ো করে দু’পায়ে ভর রেখে দাঁড়ালেন। মাথার ভেতর খালি খালি লাগে, পা সামান্য টলোমলো। ইজিচেয়ারের পাশে খাটে হাত রেখে সামলে নিলেন। পায়ে পায়ে চলে এলেন শোবার ঘরে, পড়ার টেবিলে এসে বসলেন। চোখের আলো কমে আসায় আজকাল আর লেখাপড়ার কোনো কাজ নেই, টেবিলটা তবু রয়ে গেছে এ ঘরে।

টেবিলে কাচের নিচে খুব প্রিয় মুখগুলোর ছবি পরপর সাজিয়ে রাখা। ছেলেমেয়েরা, তাদের ছেলেমেয়েরা ছবির ভেতরে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের দেখা তো আর হলো না, ছবিতে এখন কাকে রেখে কাকে দেখবেন! ভেজা ঝাপসা চোখে দেখাও কি যায়! চোখের কোল মুছে তাকিয়ে দেখেন আবার। ‘নদীতটসম কেবলই বৃথাই প্রবাহ আঁকড়ি রাখিবারে চাই, / একে একে বুকে আঘাত করিয়া ঢেউগুলি কোথা ধায়...’। জানি, জীবন এরকমই, চাইলেও সব ধরে রাখা যায় না। ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়েছে, তাদের নিজেদের জীবন, জগৎ তৈরি হয়েছে। ওরা তাঁর আশেপাশে যে সবসময় থাকবে, তা তো হয় না। তবু এ যে কী বিষম তৃষ্ণা!

ছোটো ছেলেটি ক্যাডেট কলেজ পাশ করে বিদেশে পড়তে গিয়েছিলো। আর তার ফেরা হলো না। চোখের আড়ালেই সে থাকলো প্রায় সারা জীবন। চল্লিশের কাছাকাছি, তবু তাকে সংসারী করে তোলা গেলো না আজও। কী আর করা, সবাই একরকম হয় না। একসময় অনুযোগ করতেন, এখন তা-ও নেই। ওর মুখে তিনি তাঁর নিজের পিতার ছবি দেখতে পান, একমাত্র ওকেই আদর করে বাপজান বলে ডাকতেন। আজও ডাকেন, মনে মনে। তার সঙ্গে দেখা নেই ঠিক পাঁচ বছর, চিঠিপত্র নেই, ফোনও আসে না বড়ো একটা। তাঁদের পঞ্চাশ বছরের বিয়ে বার্ষিকীর সময় ওকে লিখেছিলেন: বাপজান, অনেক দুঃখ-বেদনার মধ্যেও আজ তোমার হাসিমুখ স্মরণ করছি। তুমি সুখে থাকো, ভালো থাকো। আমাদের কথা মনে রেখো...

কীসের অভিমান তার, বোঝা যায় না। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো, কষ্ট আসলে আজও আছে। ওকে শেষবার একনজর দেখার বড়ো ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু তা যে হয়ে উঠবে এমন আশা বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছেন। কিছুদিন আগে ফোনে অনুনয় করে বলেছিলেন অন্তত এখনকার তোলা একখানা ছবি পাঠাতে। ছবি আসেনি। ‘বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা... / হৃদয়বিদারি হয়ে গেল ঢালা...’। তবু ওকে তিনি ক্ষমাও করে দিয়েছেন। সঠিক কিছু জানা না থাকলেও ভেবে নিয়েছেন, হয়তো ওঁরই ভুল হয়েছিলো কোথাও। তিনি জানেন, কোনোকিছু বদলে ফেলার ক্ষমতা না থাকলে তাকে মেনে নিতে হয়।

মেয়েটাই সবসময় খোঁজখবর রাখে। একদিন-দু’দিন পরপর ঢাকা থেকে ফোন করে ঝর্ণা, ঈদে-পরবে আসে। রঙ্গন দাদু-নানীর বড়ো ভক্ত। ও-ই প্রথম নাতি, আর ওকেই তো সবসময় চোখের সামনে পাওয়া যায়। বড়ো ছেলেটির ঘরে ছেলেমেয়ে এলো ওরা দেশের বাইরে যাওয়ার পর। নাতনিকে প্রথম দেখলেন ওরা দেশে বেড়াতে এলে, ডোরার তখন তিন বছর। খানিক পরপর ভুরু-মুখ কুঁচকে হাত দুটো বুকের ওপর আড়াআড়ি রেখে বলতো, আমি রাগ করেছি! এক সকালে গুনেছিলেন, ঊনচল্লিশবার এরকম রাগ করেছিলো সে।

অর্ণব হলো তারও কয়েক বছর পর। তাকে দেখতে দূরদেশে উড়ে যেতে হয়েছিলো। দু’বছর বয়স তখন ওর। দাদুর দেখাদেখি বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে ভাঁজ করা হাঁটুর ওপর পা তুলে বুকের ওপর বই খুলে পড়ার অভিনয় করতো। ডাইনোসরের ছবি দেখতো বই খুলে। ওকে দেখে ভাবতেন, ওর বয়সে আমরা ডাইনোসর বলে কোনোকিছুর নামও জানতাম না। তার ডাইনোসরপ্রীতি এখন আরো বেড়েছে, একদিন ফোনে কথা বলতে বলতে অর্ণব ঘোষণা দিয়েছিলো, বড়ো হয়ে সে ডাইনোসর হবে! ফিরোজ-রুবার ছেলেমেয়ে হয়নি এখনো, কেন কে জানে মিসক্যারেজ হয়ে গেলো কয়েকবার।

রুবার বাবা তরিকুল সাহেব কলেজে তাঁর সহকর্মী ছিলেন। তিনি বাংলায়, তরিকুল সাহেব ইংরেজিতে। একসময় মালতীনগরে তরিকুল সাহেবের করতোয়ার পাড়ের বাড়িতে রোজ বিকেলে ব্রীজ খেলতে যাওয়া হতো। চাকরি জীবন শেষ হওয়ার পরও অনেক দিন বিকেলে তাসের আসর বসতো। দীর্ঘদিন রোগে ভুগে তরিকুল সাহেব চলে গেলেন বছর দুয়েক হয়। এ পাড়ার তাস খেলার সঙ্গী আফসার খোন্দকার, পণ্ডিত সাহেবও আর নেই, এবারক হোসেনের কর্মহীন দীর্ঘ বিকেলগুলো এখন আরো দীর্ঘ হয়েছে।

ব্রীজ খেলায় মনমতো তাস কোনোসময়ই পাওয়া যায় না, এটা আছে তো ওটা নেই। নিজের হাত ভালো তো পার্টনারের হাতভর্তি রাজ্যের জঞ্জাল। তবু তাস বেঁটে দেওয়ার পর হাতে যা আসে, তাই নিয়ে খেলে যেতে হয়। এবারক হোসেন দেখেছেন, মানুষের জীবনও ওরকমই। বড়ো ছেলে লেখাপড়া শেষ করলো, চাকরি-বাকরি করবে না। বছর কয়েক ধরে কীসব ব্যবসাপত্র করার চেষ্টা করলো, বিশেষ সুবিধা হয়নি। বিয়েও করে ফেলেছিলো ততোদিনে। খুব হাসিখুশি বউটি, খানিকটা পাগলাটেও। ব্যবসায় কিছুতেই কিছু ঘটে উঠছিলো না দেখে ওরা দেশের বাইরে চলে গেলো বিয়ের বছর তিনেক পরে।

ঝর্ণার বিয়ে হয়েছিলো পাশ করার পরপরই। সরকারি কলেজে অধ্যাপনার চাকরি পেয়েও করলো না, রঞ্জুর মত নেই বলে। চমৎকার ছেলে রঞ্জু, কখনো কখনো তাঁর নিজের ছেলেদের চেয়েও বেশি সে। কিন্তু এই একটি ব্যাপার নিয়ে ওর ওপরে কিছু ক্ষোভ জন্মেছিলো তাঁর। এবারক হোসেনের মতে মেয়েদের জন্যে অধ্যাপনার মতো ভালো পেশা আর নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো রেজাল্ট করেও ঝর্ণা পড়াশোনাটা কোনো কাজে লাগালো না, এই অনুযোগটি খুব ছিলো তখন। শুধু ঘরসংসারই যদি করবে, তাহলে আর এতোদূর লেখাপড়ার কী দরকার ছিলো? এখন অবশ্য মাঝে মাঝে মনে হয়, চাকরিতে ঢুকে পড়লে ঝর্ণার জীবনটা কীরকম হতো? বাইরের কাজকর্ম করে না বলে তাঁরা ঢাকায় গেলে অখণ্ডভাবে সময় দিতে পেরেছে সে বরাবর। যখন-তখন যে কোনো সঙ্কটে-সমস্যায় তাকে পাওয়া গেছে সহজে।

ফিরোজকে নিয়ে ঝামেলা কম হয়নি, শুরু তার স্কুলে পড়ার সময় থেকে। পড়াশোনায় সে ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে ধারালো, অথচ মনোযোগ নেই মোটে। কোনো কারণ ছাড়া সে প্রথমবার বাড়ি থেকে পালায় ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়। তারপর প্রশ্নবোধক চেহারার বন্ধুবান্ধব, তাদের নিয়ে দলপাকানো, মারপিটে জড়িয়ে পড়া কোনোটাই বাদ যায়নি। এক রাতে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যাকে ছাড়া তার এক মুহূর্ত চলে না, খুন হয়ে যায় প্রকাশ্য রাস্তায়। সেবার ফিরোজকে রাতারাতি ঢাকায় পাচার করে দিতে হয়েছিলো। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত থেকে মুষ্টিযুদ্ধ পর্যন্ত অগণিত বিষয়ে তার প্রবল উৎসাহ এবং এক ধরনের সহজ দক্ষতা, কিন্তু যোগফলে তেমন কিছু দাঁড়ালো না। ধরে-বেঁধে একরকম জোর করে তাকে বি.এ. পরীক্ষা দেওয়ানো হলো, অপ্রত্যাশিত রকমের ভালো ফল করলেও আর পড়াশোনা করলো না। অনেক বছর ধরে অনায়াসে একেকটা চাকরি ধরেছে, তখন তার কী উচ্ছ্বাস-উৎসাহ। কোনোকিছুতে উৎসাহ তার বেশিদিন থাকে না, নির্বিকারভাবে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। আবার নতুন কোনো একটায় লেগে পড়তেও তার সময় লাগেনি। বয়স বাড়ছে, কিন্তু এখনো বদলায়নি সে তেমন।

জীবনভর দূরে দূরে থাকা ছাড়া ছোটোটিকে নিয়ে কোনো গোলমাল ছিলো না। তারপরেও কোথায় কী যে একটা না-বোঝা জট পাকিয়ে গেলো, সে আরো দূরের মানুষ হয়ে উঠলো। হয়তো সবচেয়ে দূরের।
সবাই বাড়িছাড়া হওয়ার পরেও অন্তত রীতা ছিলো, তখনো বাড়ি এতো ফাঁকা ফাঁকা লাগতো না। জোহরা বেগমের ফুপাতো বোনের মেয়ে রীতা, এক্কেবারে শিশুকাল থেকে সে এ বাড়ির একজন হয়ে উঠেছিলো। শান্তাহারে নিজের বাবা-মা’র কাছে মাঝেমধ্যে গেলেও সে এবারক হোসেন আর জোহরা বেগমকে আব্বা-আম্মা জেনেছে। তখন এক বাড়িতে দুই রীতা নিয়ে বেশ গোলমাল লেগে যেতো। নিচে এক রীতা, ওপরে অসীমের বউ রীতা। কখনো নাম ধরে ডাকলে একসঙ্গে দুই রীতাই সাড়া দিয়ে ফেলতো।

ছেলেমেয়েরাও রীতাকে নিজেদের ছোটো বোনটি ছাড়া কিছু ভাবেনি কোনোদিন। একবার তিন ছেলেকে একসঙ্গে পেয়ে এবারক হোসেন বলেছিলেন, আমাদের তো বয়স হচ্ছে, বাড়িঘর আর সামান্য যা কিছু আছে তার একটা ব্যবস্থা কাগজে-কলমে করে রাখতে চাই। তোমরা কী বলো? তিনজনই বলেছিলো, ওদের কিচ্ছু চাই না, সব যেন ঝর্ণা আর রীতার জন্যে থাকে। রীতাও বিয়ের পরে ঢাকায় চলে গেলো বছর পাঁচেক হয়। নাতি-নাতনিদের পাওনা যা-কিছু আদর-প্রশ্রয়, নাগালের মধ্যে আছে বলে রঙ্গন একা লুটেপুটে নিচ্ছিলো অনেকদিন ধরে। এখন ভাগ বসাচ্ছে রীতার মেয়ে শ্রেয়া।

মনে পড়ে, বড়ো ছেলে একবার চিঠিতে তার শোনা একটি ইংরেজি গানের কথা লিখেছিলো। গায়ক বলছে, এই তো মাত্র সেদিনের কথা, আমার ছেলেটি এত্তোটুকু ছিলো। তখন ওর সঙ্গে বল ছুঁড়ে ছুঁড়ে খেলা করতাম। ছেলেটি কেবল আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করে আর বলে, বড়ো হলে আমি আমার বাবার মতো হবো। আমি সারাদিনমান কাজে কাজে বাইরে থাকি, মাঝেমধ্যে দীর্ঘ সময়ের জন্যে শহরের বাইরে চলে যাই, দেখা হয় না দিনের পর দিন। তবু যখনই ঘরে ফিরে আসি, সে ঝাঁপিয়ে চলে আসে আমার কোলে আর বলে, বড়ো হলে আমি ঠিক বাবার মতো হবো। এই তো মোটে সেদিনের কথা...। এখন ছেলে বড়ো হয়েছে, দূরের শহরে থাকে কর্মস্থলে। কাজকর্ম, সংসার নিয়ে সে ব্যস্ত এখন, দেখা হয় কালেভদ্রে। এই তো মোটে সেদিনের কথা, ওর সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিলো। বললো, ছেলেটার শরীর ভালো নয়। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কবে দেখা হবে? ছেলে বললো, বাবা, বোঝোই তো, কতো ব্যস্ত থাকি! আমার তখন মনে হলো, আমার ছেলেটি ঠিক ঠিক তার বাবার মতো হয়েছে!

গানটি এবারক হোসেন শোনেননি। ভিনদেশী গান তিনি তেমন শোনেননি কোনোদিন, কিন্তু এই গানটি তাঁর খুব শুনতে ইচ্ছে হয়েছিলো। অদ্ভুত এক চক্র এই জীবন - যা নিচ্ছি, তা ফিরিয়েও দিতে হবে এই জীবনেই। ভেবেছিলেন, এরপরে ছেলে যখন আসবে দেশে, গানটি সঙ্গে করে আনতে বলবেন। বলা হয়নি, আর কি হবে?

এবারক হোসেন ভাবলেন, এতো অপূর্ণতার পরেও এক জীবনে যা পাওয়া হলো, তা-ও কি কম কিছু? ‘জীবন হয়নি ফাঁকি, ফলে ফুলে ছিল ঢাকি / যদি কিছু রহে বাকি কে তাহা লবে! / দেওয়া-নেওয়া যাবে চুকে, বোঝা-খসে-যাওয়া বুকে / যাব চলে হাসিমুখে - যাব নীরবে।’ ঠাট্টা করে প্রায়ই বলেন, মরার পরে বেহেশত-দোজখ বা স্বর্গ-নরক যেখানেই যাই, কিছু ছাত্র-ছাত্রীকে ঠিক ঠিক পেয়ে যাবো। আমার আর ভাবনা কীসের? আসলে ঠাট্টাও নয়, শিক্ষক হিসেবে প্রায় সর্বজনপ্রিয় ছিলেন তিনি। ছাত্র-ছাত্রীদের ভালোবাসা তিনি ফিরিয়ে দিতে চেয়েছেন বরাবর। পুরনো অনেক প্রিয় ছাত্র তাঁর পরিবারের মানুষ হয়ে আছে দীর্ঘদিন, তিনিও তাদের ঘরের মানুষ। ঈদে-পরবে সালাম করতে আসে তারা, বাড়ির ভিত দেওয়ার জন্যে ডাকে, মেয়ের বিয়ে ঠিক করে স্যারের কাছে একবার পরামর্শ করে যায়।

এক জীবনে কতোকিছু প্রত্যক্ষ করা হলো! কতো আলো-আঁধারি এই পৃথিবীর! বড়ো হয়ে উঠতে উঠতে পেয়েছিলেন পৃথিবীর সর্বশেষ বড়ো যুদ্ধ। পতিত জাপান-জার্মানী। হিরোশিমা-নাগাসাকি। বৃটিশ তাড়াও। এরই মধ্যে দেশে অন্নের অনটন, অনাহারী মানুষের এমনই অবস্থা যে অবস্থাপন্নের দুয়ারে ভাত চাওয়ারও সাহস নেই, ভাতের ফ্যান চায়! হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। বিভক্ত ভারতবর্ষ। পাকিস্তান জিন্দাবাদ এলো। লাল চীন। পাকিস্তানী তাড়াও। শেখ মুজিব। ১৯৭১। যুদ্ধ। নদীতে নদীতে ভেসে আসা অচেনা মানুষের লাশ। বাংলাদেশ। জয় বাংলা। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। সোভিয়েত-মার্কিন ঠাণ্ডা লড়াই। চিৎপাত পরাক্রান্ত সোভিয়েত। চীনে সামরিক শাসন। সৌভাগ্যবশে বাংলার নতুন শতাব্দী আর ইংরেজি নতুন সহস্রাব্দের শুরু দেখাও হলো।

কাচের ওপর দিয়ে ছবিগুলোর ওপর আঙুল বুলিয়ে যাচ্ছিলেন এবারক হোসেন। ‘বুঝি তৃষ্ণার শেষ নেই, নেই...’। তাঁর মনে হলো, কাচের নিচের হাসিমুখগুলোকে ছোঁয়া যায় না। সত্যিই আর যাবে না!

সব প্রিয় মানুষের ছবি সামনে নেই, অ্যালবামে তোলা আছে। অনেকগুলো মুখের ছবি কোনোদিনই ছিলো না, মনের ভেতরে আছে। তাঁর বাবার মৃত্যুর সময় বয়স হয়েছিলো একশোর ওপরে। বাপজান চলে গেছেন ছাব্বিশ বছর হয়, তখন তাঁর নিজেরই বয়স পঞ্চাশ। মা-কে হারিয়েছিলেন তিনি অনেক অল্প বয়সে, মায়ের স্মৃতি খুব বেশি নেই। ‘মাকে আমার পড়ে না মনে। ... / কোলের ’পরে ধ'রে কবে দেখত আমায় চেয়ে, / সেই চাহনি রেখে গেছে সারা আকাশ ছেয়ে...’

সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার ছোটো। চার ভাইয়ের বড়ো দু’জন চলে গেছে, তিন বোনের একজনও আর নেই। ওদের সবার সারাজীবন গ্রামে কাটলো, এক তিনিই লেখাপড়া শিখে শহরবাসী হয়েছিলেন। বাপজান আর ভাইদের আশ্রয়-প্রশ্রয় না হলে তাঁর এ পর্যন্ত আসা হতো না। দূরের শহরে যাননি বলে যাওয়া-আসাও ছিলো। বড়ো ভাইদের ছেলেমেয়েদের কাছে তিনি ছোটোবাবা। ওদের কাছেও তিনি একজন সফল মানুষ, ওদের কেউ কেউ ছোটোবাবার মতো হয়ে উঠতেও চেয়েছে।

বোনদের কারো ছবি নেই তাঁর কাছে। এখন মনে হলো, নেই কেন? কোনোদিন ওদের কারো ছবি রাখার কথা মনে হয়নি! যে মুখগুলো হারিয়ে গেছে, তারা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। দুটি অস্পষ্ট সুদূর মুখ তাঁর আচমকা মনে পড়ে। বিয়ের দু’বছরের মাথায় তাঁদের একটি মেয়ে হয়েছিলো, বেঁচেছিলো মাত্র কয়েকদিন। দুটি ছেলেমেয়ের পরে এসেছিলো আরেকটি ছেলে, নাম রেখেছিলেন ফারুক, মারা যায় দেড় বছর বয়সে। ওদের কোনো ছবি কোথাও নেই। আজ এখন ওদের জন্যে বুক হু হু করে।

বাপজান আর ভাইদের ছবি অ্যালবামে আছে। কোথায় আছে, তিনি জানেন না। জোহরা বেগমকে ডেকে বললে ঠিক বের করে দেবে, ওসব তার হেফাজতে থাকে। এখন হঠাৎ অ্যালবাম বের করার জন্যে তো এখন ওপর থেকে ডেকে আনা যায় না, কী ভেবে বসবে, কে জানে!

জ্যোৎস্নার কথা মনে আসে, জ্যোৎস্নাময় কুণ্ডু। খঞ্জনপুর হাই স্কুলে এবারক হোসেনের সহপাঠী-বন্ধু। কলেজের পড়াও শুরু হয়েছিলো একসঙ্গে, দেশভাগ জ্যোৎস্নাকে নিয়ে গিয়েছিলো অন্য এক দেশে। বহুবছর পর তার খোঁজ পাওয়া যায়, মাঝেমধ্যে চিঠিপত্র লেখালেখি হতো। দেখা হলো সেবার কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে গিয়ে। আগেই চিঠিতে জানিয়েছিলেন, জ্যোৎস্না সস্ত্রীক এয়ারপোর্টে উপস্থিত। কিছুতেই হোটেলে উঠতে দেবে না, নিজেদের বাড়িতে নিয়ে তুলেছিলো। জ্যোৎস্না আর্মিতে কর্নেল হয়ে রিটায়ার করেছে বেশ ক’বছর আগে। তাদের তিনটি মেয়ে, সবাই ডাক্তার।

জ্যোৎস্না পুরনো বন্ধুদের কথা জানতে চেয়েছিলো, দেওয়ান মহসীন আলী এখন কোথায়?

ও তো নেই।

জ্যোৎস্না বলে, কী হয়েছিলো?যুদ্ধের সময় মিলিটারিরা গুলি করে মেরে ফেলে, একটা কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলো তখন ও।

একটু চুপ করে থেকে জ্যোৎস্না জিজ্ঞেস করে, আর আমাদের মুজিবর?

ওর এখনকার খবর ঠিক জানি না। ও পাগল হয়ে গিয়েছিলো। ঠিক পুরোপুরি পাগল নয়। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলো পড়তে। ওর সাবজেক্ট অঙ্ক। ফিরে এসে করাচি ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করে। তারপরে চলে আসে রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে। মাঝে মাঝে আসতো, চিঠিপত্রেও যোগাযোগ ছিলো। আমি রাজশাহীতে কোনো কাজে গেলে দেখা হতো। শিক্ষক হিসেবে খুবই ভালো করছিলো। বিয়ে-টিয়ে করেনি। হঠাৎ করে সে আবোল-তাবোল কথা বলতে শুরু করলো। পাকিস্তান আমলের শেষদিকের কথা। মাথায় কী ঢুকলো কে জানে, সে নিজের নাম ঘোষণা করে বসলো - দেবদাস। আগে-পিছে কিছু নেই, শুধু দেবদাস। মুসলমানের ছেলে দেবদাস হয় কী করে? এই নিয়ে শুধু ইউনিভার্সিটি নয়, সারা রাজশাহীতে হৈচৈ। ওর তখন জীবনসংশয়, মোল্লারা ওকে মেরে ফেলবে বলে শাসাচ্ছে। রাজশাহী ছেড়ে যেতে হলো ওকে। হঠাৎ যুদ্ধ শুরু হওয়ার দিনকয়েক আগে ধুম জ্বর নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। দিনকয়েক থেকে একটু সুস্থ হয়ে চলে গেলো। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আর্মি ওর ভবঘুরে ভাবভঙ্গি দেখে ধরে নিয়ে যায়। নাম জিজ্ঞেস করলে বলে, দেবদাস। নাটোর জেলে ছিলো মাসকয়েক, তারপর ওকে ওরা ছেড়ে দেয় বোধহয় পাগল ভেবেই। পরে মাঝেমধ্যে হঠাৎ হঠাৎ দিনকয়েকের জন্যে আসতো আমাদের বাড়িতে। চাকরি-বাকরি তো গেছে কবেই, কোথায় থাকে, কী করে বললে কোনো জবাব দেয় না। এমন অবস্থা যে, ও নিজে থেকে দেখা না দিলে ওর ভালোমন্দ জানারও কোনো উপায় নেই। অনেকদিন হয়ে গেলো, কোনো খবর নেই। বেঁচে আছে কি না, তা-ও জানি না।

জ্যোৎস্না একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কী ব্রিলিয়ান্ট ছিলো ও।

রাতে খাওয়ার পরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সে জানতে চেয়েছিলো খঞ্জনপুরের কথা। স্কুলটা কি আগের মতো আছে? কাছে ছোটো নদীটা এখন আর খেয়া নৌকায় পারাপার করতে হয় না, তার ওপরে পাকা ব্রীজ হয়ে গেছে শুনে বলেছিলো, যে রাতে আমরা দেশ ছেড়ে চলে আসি, খেয়ানৌকার মাঝি আমাদের কাছে কোনো পয়সা নেয়নি। শুধু বলেছিলো, সাবধানে যাবেন, বাবারা!

জ্যোৎস্না তাদের বাড়িটির কথা জিজ্ঞেস করেনি। একবার বলেছিলো, জানিস, এই শেষ বয়সে পৌঁছে আমার খুব ইচ্ছে করে সেই গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাই। মরে গেলে যেন আমার দাহ করা হয় খঞ্জনপুরে ওই নদীর ধারের শ্মশানে। কিন্তু সে তো আর হবার নয়। নিজের গ্রামেই আমি এখন বিদেশী...

জ্যোৎস্নার জন্যে তাঁর সেদিন কষ্ট হয়েছিলো। রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ মানুষের ছোটো ছোটো ইচ্ছা-অনিচ্ছাকেও কতো অসম্ভব অবাস্তব করে দেয়! জ্যোৎস্নার তুলনায় নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়েছিলো। এখন মনে মনে বললেন, আমার সময় হলো, জ্যোৎস্না। আমি ফিরে যাচ্ছি দোগাছীতে। সবাইকে বলা আছে, আমার বাবা আর ভাইদের পাশে আমার জায়গা হবে। যাত্রাশুরুর জায়গায় ফিরে যেতে পারলে তবেই তো যাত্রা সম্পূর্ণ হয়, তাই না? কিন্তু তোরটা যে সম্পূর্ণ হওয়ার নয় রে, জ্যোৎস্না! রাষ্ট্রের দম্ভের কাছে, শক্তির কাছে তোর-আমার ক্ষমতা যে কিছুই নয়!

পড়ার টেবিল থেকে উঠে আবার ইজিচেয়ারে এসে বসলেন এবারক হোসেন। আলো জ্বালতে ইচ্ছে করেনি, অন্ধকারেই চোখ বন্ধ করে ছিলেন। বুকের ব্যথা এখন আর ততো তীব্র নয়, কিন্তু চাপ ধরা ভাবটা একটুও কমেনি। এই শীতের সন্ধ্যায় এই ঘরের ভেতরের দিকের দরজা-জানালাগুলো এখনো খোলা, তবু তাঁর একটুও শীত করছে না। বন্ধ চোখের সামনে দিয়ে চলচ্চিত্রের ছবির মতো একেকটা মুখ, একেকটা ছবি মুহূর্তের জন্যে আসে, মিলিয়ে যায়। অনেক দিনের ভুলে যাওয়া কতো মুখ আসছে। তিনি বোধহীন দর্শকের মতো শুধু দেখে যাচ্ছেন...


৩.

‘নিভৃত মনের বনের ছায়াটি ঘিরে
না-দেখা ফুলের গোপন গন্ধ ফিরে
আমার লুকায় বেদনা অধরা অশ্রুনীরে
অশ্রুত বাঁশি হৃদয়গহনে বাজে...’

দিনরাত্রি তাঁর সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে সুর খেলা করে, অথচ গলায় সুর নেই। সবার থাকে না। কিন্তু গান শুনতে বা ভালোবাসতে নিজের গলায় সুর না থাকলে কোনো ঊনিশ-বিশ হয় না। এই অন্ধকারে রবির পাশে রিকশায় বসে যখন বুকের তীব্র ব্যথার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে, সেই সময়েও এবারক হোসেনের মাথার ভেতরে তাঁর প্রিয় কবির গান বেজে যায়।

হাজীপাড়া ছাড়িয়ে রিকশা কানচগাড়ির রাস্তায় উঠেছে। হাতের ডানে একটা ছোটো একতলা বাড়ির দিকে চোখ পড়ে এবারক হোসেনের। কোনো আলো নেই বাড়িতে, ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তার অন্ধকার বাড়িটাকে আরো ভুতুড়ে চেহারা দিয়েছে। বাবুদের বাড়ি। সাতমাথায় সপ্তপদী মার্কেটে দোকান আছে বাবুর। আলাপ-পরিচয় তেমন ছিলো না। এক বিকেলে এই রাস্তায় হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন এবারক হোসেন। আকাশ মেঘলা ছিলো, এই বাড়ির সামনে আসতেই ঝেঁপে বৃষ্টি নামে। গা বাঁচাতে বাবুর বাড়ির বাইরের বারান্দায় গিয়ে উঠেছিলেন, বৃষ্টি থামলে চলে যাবেন। একটা খালি রিকশা পেলেও উঠে পড়া যায়।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলেন, এইসময় হঠাৎ তাঁর পেছনে দরজা খুলে যায়। তাকিয়ে দেখেন, ছোট্টো একটি বাচ্চা মেয়ে, বছর ছয়-সাতেকের হবে, দরজায় দাঁড়িয়ে। আধা-চেনা কারো বাড়ির বারান্দায় উঠে একটু অস্বস্তি হচ্ছিলোই, এখন দরজা খুলে যেতে অস্বস্তি আরো বেড়ে যায়। মেয়েটি অসংকোচে বেরিয়ে এসে তাঁর হাত ধরে ফেলে, ভেতরে এসে বসো, দাদু। বৃষ্টিতে ভিজে যাবে যে! বাবুরই মেয়ে হবে। একটু ইতস্তত করছিলেন, মেয়েটি একরকম টানতে টানতে ভেতরে এনে বসিয়েছিলো।

খানিক পরে ওর মা এলে জানা যায়, মেয়েটিকে দাদু ডাকতে কেউ শিখিয়ে দেয়নি। ও যে দরজা খুলে কাউকে ঘরে নিয়ে বসিয়েছে, ভেতরে কেউ জানেও না। মায়া পড়ে গিয়েছিলো, সেদিনের পরে আরো অনেকবার এসেছেন এ বাড়িতে। বাচ্চা মেয়েটি কী সুন্দর পুটপুট করে কথা বলে! আজ রিকশায় বসে ওদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে এবারক হোসেন মনে মনে বললেন, চলি রে দাদু, আর দেখা হবে না!

রিকশা শেরপুর রোডে উঠে এলে রাস্তায় আলো দেখা যায়। ছোটো শহরের রাস্তার মলিন আলোয় এবারক হোসেনের কাছে সবকিছু বড়ো অবাস্তব লাগে। এই যে রবি ছেলেটি তাঁকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে, এর সঙ্গে কি তাঁর যাওয়ার কথা ছিলো? রবিকে এই সেদিনও চিনতেন না। তরুণ ডাক্তার, স্থানীয় সরকারি হাসপাতালে বদলি হয়ে এসেছে। ভাড়া বাড়ির খোঁজে এসেছিলো, তখন এবারক হোসেন নিচেরতলার বাড়তি ঘর দুটো ভাড়া দেবেন ঠিক করেছেন। ঘর দুটো প্রয়োজনের তুলনায় ছোটো বলে রবি কাছাকাছি অন্য বাসা নিয়েছিলো। ক’দিন পরে আবার রবি এসে হাজির। বলেছিলো, বাসা পছন্দ না হলেও দাদু আর দিদাকে খুব পছন্দ হয়েছে। সেই থেকে তো ঘরের মানুষ হয়ে উঠলো রবি আর তার বউ ছায়া। দু’জনকে তিনি রবিচ্ছায়া বলে ডাকেন। শুধু ঘরের মানুষ হয়ে থাকলো না সে, দাদু-দিদার ডাক্তারিও নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলো। ব্লাড শ্যুগার দেখা, হার্ট চেক-আপ করানো তাগিদ দিয়ে দিয়ে সে-ই করাতে থাকে। এবারক হোসেন বরাবর চিকিৎসাবিমুখ, কখনো কখনো রবির অবাধ্য হওয়ারও চেষ্টা করেছেন। তখন রবি একেবারে ছেলেমানুষের মতো কেঁদে ফেললে এবারক হোসেন নিরুপায় হয়ে পড়েছেন।

এই শেষ যাত্রায় এবারক হোসেনের সঙ্গী হয়েছে যে মানুষটি, তার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক কিছু নেই। ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-পরিজন কে কোথায়, কেউ এখনো জানেও না। ভাগ্যের লিখন? না হলে আর কী, জোহরা বেগম এই সময়ে পাশে নেই। সারা জীবনভর যখন যেখানে গেছেন, একসঙ্গেই। বেড়ানো, দেশ দেখার নেশা তাঁর চিরদিনের, রিটায়ার করার পর সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, নেপাল ভুটান বেড়াতে গেছেন দু’জনে। দিল্লী-আগ্রা-জয়পুর-কলকাতা-দার্জিলিং মিলিয়ে ইন্ডিয়াতে অনেকবার। আগ্রায় তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ভেবেছিলেন, শত শত বছর পরেও মানুষেরই কীর্তি কী গৌরবে দাঁড়িয়ে আছে! সোভিয়েত ইউনিয়নে গেছেন ছোটো ছেলের কাছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন তখনও অখণ্ড। লেনিনগ্রাডে গিয়ে মনে হয়েছিলো, এই দেশের মানুষগুলো পৃথিবীতেই স্বর্গ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলো। আমেরিকায়ও দু’বার যাওয়া হয়েছে বড়ো ছেলের কাছে। নায়াগ্রা ঘুরে এসে ছেলের বউকে বলেছিলেন, জানো মা, পূর্ণিমার রাতে জলপ্রপাতের ওই অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য দেখে আমার মনটা ভরে গিয়েছিলো। এমন সুন্দর কোনোকিছু আমি এ জীবনে দেখিনি। মনে হচ্ছিলো, এখন আমার মরে যেতে একটুও দুঃখ হবে না।

সবসময় সব যাত্রায় দু’জনে একসঙ্গে ছিলেন, আজই আলাদা হতে হলো! এই তবে বিচ্ছেদের শুরু?
বুকের ব্যথা অসহ্য হয়ে উঠেছে এখন, খানিক পরপর একটা দংশনের মতো লাগে। শ্বাস নিতেও কষ্ট, মুখ খুলে হাঁ করে শ্বাস নিতে হচ্ছে, শরীর ঘেমে উঠেছে। কোনোমতে বললেন, হাসপাতাল পর্যন্ত বোধহয় যাওয়া যাবে না, রবি।

রবি নিজেও খুব একটা ভরসা পায় না। তবু বলে, এই তো এসে গেছি, দাদু। পৌঁছে গেলে আর ভয় নেই।
রবির মুখে ঘুরে তাকিয়ে এবারক হোসেনের একটা অদ্ভুত কথা মনে এলো, শেষ যাত্রায়ও তাঁর সঙ্গী রবীন্দ্রনাথ! রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই তাঁকে এই দুয়ারটুকু পার হতে হবে!


৪.

রবির সঙ্গে এবারক হোসেন চলে যাওয়ার পরে জোহরা বেগম কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। দিনের বেলা হলে রিকশা না পেলেও পায়ে হেঁটেই হাসপাতালে যাওয়া যেতো, খুব বেশি দূরের পথ নয়। মজিবর গেছে রিকশা খুঁজতে, এখনো ফেরেনি। তিনি ওপরতলায় উঠে অসীমদের দরজায় টোকা দিলেন। ওরা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আরো জোরে ধাক্কা দিলেন এবার, লজ্জা-সংকোচের সময় নয় এখন। আরো বার দু’তিনেক ধাক্কা দিতে ঘুমচোখে দরজা খুলে দেয় রীতা। জোহরা বেগমের ভেজা চোখ দেখে কী বুঝলো, কে জানে। বললো, কী হয়েছে? কাকার শরীর...

রবির সঙ্গে হাসপাতালে গেলো একটু আগে।

মজিবর ফিরলো রিকশা নিয়ে। শব্দ পেয়ে জোহরা বেগম নিচে নেমে এলেন। মজিবর তাঁকে একা কিছুতেই ছাড়বে না, সে-ও উঠে আসে রিকশায়।

এবারক হোসেনকে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। জোহরা বেগম কাছে আসতেই তাকিয়ে দেখলেন একবার। বড়ো ক্লান্ত লাগে তাঁর, ঘুম পায়। অথচ বুকের ভেতরের অসহ্য দংশন তাঁকে জাগিয়ে রাখে। হাত বাড়িয়ে জোহরা বেগমের একটা হাত তুলে নিলেন। ‘আজি কোনোখানে কারেও না জানি / শুনিতে না পাই আজি কারো বাণী হে...’। ‘মুখের পানে তাকাতে চাই, দেখি দেখি দেখতে না পাই...’

এবারক হোসেন চোখ বুজলেন। ভেবে রেখেছিলেন, ‘‘আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো’ এই শেষ কথা ব'লে / যাব আমি চলে’

হলো না। হয় না, তা-ও জানাই ছিলো।

No comments: