Saturday, October 27, 2007

আমাদের এই বিপন্নতা



আমাদের সদ্য-পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে আজীবন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করে দিলে কেমন হয়? অনেকগুলো সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান অন্তত হয়ে যায় তাতে। কেন তাঁকে আজীবনের জন্যে ওই পদ দেওয়া দরকার সে কথা বলার আগে দেখা যাক, ঠিক কোন কোন সমস্যার সুরাহা এতে হতে পারে।

১. এই ব্যবস্থা হলে পাঁচ বছর অন্তর 'নিরপেক্ষ' তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের কাঁঠালের আমসত্ত্ব জাতীয় জিনিসটির আর প্রয়োজন থাকে না। ফলে, তার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ইয়াজউদ্দিন ছাড়া কোনো উপযুক্ত লোক পাওয়া গেলো না এই দুঃসংবাদও আমাদের শুনতে হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার না থাকলে তার আবার প্রধান কি? নিরপেক্ষতার ভাণ-ভনিতাও তখন আর দরকার হবে না।

২. নির্বাচন কমিশন বলে কোনো প্রতিষ্ঠানের আর প্রয়োজন থাকে না। তখন কমিশনাররা সবাই চিরস্থায়ীভাবে ছুটি ভোগ করবেন, ছুটিতে যাওয়ার জন্যে তাঁদের হাতেপায়ে ধরে অনুনয়-বিনয় করতে হবে না, সুমতির জন্যে জাতীয় ভিত্তিতে বিশেষ মোনাজাত করার প্রয়োজনও ফুরিয়ে যাবে।

৩. দীর্ঘস্থায়ী মেয়াদে, আমি আজীবন বলছি, একজন প্রধানমন্ত্রী থাকলে দেশের রাজনীতি অনেক স্থিতিশীল হবে, আমাদের প্রভু দাতাগোষ্ঠী ও দণ্ডমুণ্ডের মালিক বিদেশী কূটনীতিকরা খুবই সন্তুষ্ট থাকবেন এবং বিভিন্ন ধরনের পৃষ্ঠকণ্ডুয়নমূলক সার্টিফিকেট দিতে থাকবেন। দেশের 'ভাবমূর্তি' যা নিয়ে বিগত সরকার বড়োই উদ্বিগ্ন ছিলেন গত পাঁচটি বছর, তা নিয়েও আর কিছুমাত্র ভাবতে হবে না।

৪. বিরোধী দল তখন নামেমাত্র থাকলেও আশু ক্ষমতালাভের সুযোগ না থাকায় তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা খুবই হ্রাস পাবে, এমনকি একেবারে বিলীন হয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়। হরতাল-প্রতিবাদ, জ্বালাও-পোড়াও কাকে বলে মানুষ চিরতরে ভুলে যাবে।

৫. বিরোধী দল না থাকলে আমজনতাকে অন্তত এই দেখে লজ্জা পেতে হবে না যে, বিরোধীরা দাবিনামা পেশ করার সময় পর্বত দাবি করবে এবং অতঃপর উইঢিবি-সমান দাবি পূরণ হলে বিজয়ীর হাসি হাসবে এবং জনতার জয় হয়েছে বলে মশকরা করবে।

৬. জনগণকে এ-ও দেখতে হবে না যে সরকারের ক্রমাগত ব্যর্থতা ও দুঃশাসনের কালে জনতা বিদ্রোহ করার জন্যে তৈরি থাকলেও কোনো দরকারি আন্দোলন না করে বিরোধী দল জনগণের নিত্যদিনের জীবনের সমস্যা সংকট যথা বিদু্যৎ-গ্যাস-পানি-সারের আকাল বা লাগামছাড়া দ্রব্যমূল্যের বিষয়ে প্রায় উদাসীন থেকে অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে গৎবাঁধা বুলি আউড়ে সময়ক্ষেপণ করবে এবং সেই ব্যর্থতা ও অক্ষমতার কাফফারা তারা অবিলম্বে গুনবে।

৭. আওয়ামী লীগ বা বিএনপি-র মতো দলগুলি নির্বাচনের সময় প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে এমন বিপদগ্রস্ত হবে না, বিদ্রোহী সামাল দিতে ঘাম ছোটাতে হবে না।

৮. এরশাদের মতো নানা রঙে রঙিন রাজনৈতিক ভাঁড় অথবা জাতীয় পার্টির মতো রাজনৈতিক লাশ টানাটানির নাটুকেপনা ও আদিখ্যেতা আমাদের দেখতে হবে না। প্রকৃতপক্ষে এরশাদ-নাটকের একটি স্থায়ী সমাধান পাওয়া সম্ভব হবে। সকাল-বিকাল 'ভবন' না 'সদন' এই কেবলা-বদলের কেচ্ছার অবসান ঘটবে।

৯. লাস্ট বাট নট লীস্ট, ব্যবসা-বাণিজ্য বা তদবিরের জন্যে কোন ভবনে যেতে হবে, তা-ও স্থায়ীভাবে নির্ধারিত হতে পারবে। দৈবক্রমে ক্ষমতার বদল হলে ঠিকানাটি বদলে গেলে জনগণের জন্যে তা কিছু অসুবিধার কারণ হতেই পারে।




এগুলি তো গেলো খালেদা জিয়া আজীবন প্রধানমন্ত্রী হলে দেশ ও দশের কি কি সুবিধা হতে পারে। এখন দেখা যাক, কেন এই প্রস্তাবটি বিবেচনা করা দরকার। আসলে দরকারের কথাও নয়, তিনি নামে না-থাকলেও কার্যত এখনো যে ক্ষমতাসীন আছেন তাতে কারো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। এই মুহূর্তে কাগজে-কলমে বাংলাদেশের যাবতীয় ক্ষমতা একটিমাত্র ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সেই ব্যক্তি হলেন রাষ্ট্রপতি (এক জীবনে দুই নারীর পতি হওয়ার গৌরবেরও অধিকারী তিনি, এই সৌভাগ্য ক'জনের হয়?) এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ (একই সঙ্গে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দুটি পদে একইসঙ্গে আসীন থাকা অতি বিরল সৌভাগ্য!)। তা এই প্রধান উপদেষ্টার উপদেশটা আসে কোথা থেকে তা কারো জানতে বাকি আছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। দুর্জনেরা লোকটিকে ইয়েসউদ্দিন বলেন, তা তো এমনিতে নয়। সদ্য ক্ষমতাত্যাগী খালেদা জিয়ার অঙ্গুলিনির্দেশ ব্যতিরেকে এই ব্যক্তির প্রাকৃতিক কর্মাদি সমাধা করার ইচ্ছে পোষণ করাও যে সম্ভব নয়, তা-ও দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা জেনে ফেলেছি। না, আমরা জানতে চাইনি। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন মঞ্চে উঠে এমন আনাড়ির মতো অভিনয় করলেন যে উইংসের আড়ালে থাকা প্রম্পটারের কণ্ঠস্বর প্রায় শোনাই গেলো। সুতরাং না জেনে আমাদের উপায় থাকলো না।

বাংলাদেশকে একটি বৃহৎ রঙ্গমঞ্চ (যে মঞ্চে অনেক রঙ্গ হয় তাহাই রঙ্গমঞ্চ) ধরে নিলে বলা যায়, খুব নিকৃষ্ট জাতের নাট্যকার রচিত একটি নিম্নমানের নাটক দেখতে আমরা ঢুকে পড়েছি, যতো অপছন্দ হোক বেরিয়ে যাওয়ার কোনো উপায়ই আসলে নেই। ফলে বিরক্তি, ঘৃণা ও বিবমিষা নিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে আমরা অবলোকন করছি এই তামাশা। গত কয়েকমাস ধরে। যখনই মনে হয় এর চেয়ে নাটকীয় আর কিছু ঘটা সম্ভব নয়, আমাদের রাজনীতিকরা তা ভুল প্রমাণ করেন তাঁদের অতুলনীয় কল্পনা ও উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে।

মেয়াদশেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হওয়ার পর বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দলের অবস্থান একই সমতলে হওয়ার কথা। অর্থাৎ ক্ষমতা দখলের দৌড়টি সবাই একই জায়গা থেকে শুরু করবে। অথচ খালেদা জিয়া এই কদিন আগেও আওয়ামী লীগকে বিরোধী দল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ তিনি জানেন, কাগজে-কলমে যা-ই থাক, তিনিই এখনো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন। আমরাও জানলাম।

সদ্য-উত্তীর্ণ চারদলীয় শাসনের কালে হাতে গোনা কিছুদিন ছাড়া আওয়ামী লীগ সংসদে বসেনি। কেন? তাঁরা জানালেন, তাঁরা সংসদে যান সরকার তা চায় না। বেশ। তা বোঝা গেলো। কিন্তু যা বোঝা গেলো না তা হলো, সরকারি পক্ষের ইচ্ছায় যদি তাঁরা চালিত হন, তাঁদের বিরোধী দল বলা যায় কোন যুক্তিতে? বিরোধী দলের কাজ তাহলে সরকার যা চাইবে তা বাধ্য ছেলের মতো মান্য করা? আশ্চর্য যুক্তি বটে। এখানেও দেখা যাচ্ছে খালেদা জিয়া তাঁর ইচ্ছা বা অনিচ্ছা বিরোধী দলের ওপর আরোপ করতে সক্ষম। এমনই ক্ষমতা তাঁর! তাঁকেই তো আমাদের দরকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চুক্তিতে।

মাত্র কয়েকদিন আগে খালেদা জিয়া বললেন, হিন্দু বা সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক চিরকাল থাকবে তা হতে দেওয়া যায় না, এটি ভুল প্রমাণ করতে হবে। ইঙ্গিতই যথেষ্ট, তা প্রমাণ করা বা নির্দেশটি পালন করা আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই কর্তব্য বিবেচনা করে। চিহ্নিত ধর্মব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাদের চুক্তি সম্পাদিত হলো এই মর্মে যে মোল্লারা ফতোয়া দেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করবে। কে মুসলমান আর কে নয়, তা তারা নির্ধারণ করবে। সুতরাং আহমদীয়ারাসহ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান সকল সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার অভূতপূর্ব ব্যবস্থাপত্র তৈরি হলো। খালেদা জিয়ার ইচ্ছাই আবার পূরণ হলো, সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগকে তাদের রক্ষক বলে আর বিশ্বাস করতে পারবে না।




আওয়ামী লীগের এই চেহারা কেউ কোনোকালে দেখেনি। এটি সম্ভব হলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে উন্মত্ত হওয়ার ফলে। যদিও ইনকিলাব গোষ্ঠীর সঙ্গে দহরম-মহরম এবং সদ্যপ্রয়াত মোহাম্মদ হানিফকে দিয়ে দলের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির বিরুদ্ধে কথা বলিয়ে বাজার যাচাই হচ্ছিলো বলে অনুমান করা গিয়েছিলো। কিন্তু তারা যে সত্যি সত্যি ধর্মব্যবসায়ীদের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে তাদের কোটি কোটি সমর্থক ও নেতাকর্মীদের মুখ অন্ধকারে ঢেকে দিতে ইচ্ছুক বা সমর্থ হবে, তা সম্ভবত তাদের অতি বড়ো সমালোচকও বিশ্বাস করতে পারেননি। সেই অসম্ভবকে তারা সম্ভব করে ফেললো কী নির্বিকার মুখে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান ও প্রসার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের (এই সেই আওয়ামী লীগ যারা এই যুদ্ধের নেতৃত্বের দাবিদার) অনেক অর্জনকে কেড়ে নিয়েছে, আড়াল করেছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ক্রমাগত এই ধর্মীয় রাজনীতির প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়েছে, কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো দল এর কাছে এইভাবে আত্মসমর্পণ করবে তা কারো কল্পনায় আসেনি।

প্রশ্ন ওঠে, এতে আওয়ামী লীগের অর্জন কি হলো? সংসদে হয়তো একটি-দুটি আসন। এর বেশি কিছুতেই নয়। অথচ লক্ষ-কোটি মানুষের ভরসার স্থলটি ডুবিয়ে দিয়ে তারা হয়তো নিজেরাও ডুবতে চায়। ভালোমন্দ সবকিছুতেই থাকে, সব রাজনৈতিক দলের ইতিহাসে ভুলের নমুনা পাওয়া সম্ভব। কিন্তু এতো বড়ো আত্মঘাতী ও অবিমৃষ্যকারী কর্ম আওয়ামী লীগ গত পঞ্চাশ বছরে কখনো করেছে বলে মনে পড়ে না। এমনকি, রক্ষীবাহিনী বা বাকশালের সিদ্ধান্তের চেয়েও আত্মঘাতী এই পদক্ষেপটি (আসলে পদস্খলন বলাই সঙ্গত)।

ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থানের মুখে প্রগতিশীল ও অপেক্ষাকৃত মুক্তমনা রাজনৈতিক দলগুলি কীরকম কোনঠাসা হয়ে পড়েছে তার একটি বড়ো উদাহরণ আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক জোট গঠন। আওয়ামী লীগের দীর্ঘকালের কট্টর সমালোচক ও প্রতিপক্ষ ওয়ার্কার্স পার্টি বা জাসদ পর্যন্ত এখানে সমবেত হয়েছে সম্ভবত এই বিশ্বাস থেকে যে বিকট ডানপন্থীদের বিরুদ্ধে তাদের মিলিত শক্তিই শেষ ভরসার দুর্গ। সেই দুর্গটি এখন ভেঙে পড়ার মুখে। লখিন্দরের লোহার বাসরঘরেও সাপ ঢুকে পড়েছে।

আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ (অন্তত মুখে হলেও, কারণ প্রকাশ্যে এর বিপরীতে তারা কখনো সেভাবে যায়নি) নীতির পেছনে ধর্মপরিচয়-নির্বিশেষে যে অগণিত মানুষ সমবেত ছিলেন, তাঁদের এখন কী হবে? কোথায় যাবেন তাঁরা? শহর-গ্রাম নির্বিশেষে নারীরা ঘরের বাইরে এসেছেন সংসারের প্রয়োজনে, জীবন-জীবিকা ও আত্মনির্ভরতার সন্ধানে, তাঁরা যে মোল্লাদের ফতোয়ার কারণে বিপুলভাবে বিপদগ্রস্ত হবেন তারও কোনো আশু প্রতিকার পাওয়া সম্ভব হবে না। আওয়ামী লীগ এসবের প্রত্যক্ষ সমাধান না হলেও একটি বড়ো ভরসার জায়গা ছিলো, এ কথা সবাই স্বীকার করবেন। কী হবে সেই লক্ষ-কোটি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের যাঁরা আওয়ামী লীগের সংগঠিত শক্তিকে এক ধরনের নিরাপত্তা হিসেবে গণ্য করে এসেছেন এতোকাল? কোথায় যাবেন মুক্তচিন্তার মানুষগুলি? তাঁরাও তো আজ বিপন্ন সংখ্যালঘু!

-----------------
ডিসেম্বর ২০০৬
-----------------

No comments: