সোমবার সকালের এয়ারপোর্ট। হন্তদন্ত হয়ে চেক-ইন কাউন্টারের দিকে ছুটছে লোকটি। ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে কোনোমতে তৈরি হয়ে গাড়ি নিয়ে ছুটতে হয়েছে। দৈনিক ভাড়ার চুক্তিতে গাড়ি পার্ক করে পার্কিং কোম্পানির বাসে করে এয়ারপোর্টে আসা। আজকাল এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি চেকিং-এর ঝামেলা বেড়েছে। এগারো সেপ্টেম্বর-পরবর্তী আমেরিকায় সব বিমানযাত্রীই এখন সন্দেহভাজন, সম্ভাব্য সন্ত্রাসী। তন্ন তন্ন করে ব্যাগপত্র ও শরীর তল্লাশি করা হবে। উপায় কী!
এইসব সেরে নির্দিষ্ট গেটে পৌঁছে যায় লোকটি। হাতে কিছু সময় আছে এখনো। কাঁধে ঝোলানো ব্যাকপ্যাক থেকে ল্যাপটপ কমপিউটার বের করে বসে যায়, তা কতোটা কাজের জন্যে বা কতোটা লোক-দেখানো ব্যস্ততা বোঝা মুশকিল। সেলফোন বাজছে। কমপিউটার স্ক্রীনে চোখ রেখে সেলফোন তুলে নিয়ে বলে, 'হ্যালো।' লোকটির স্ত্রী ফোন করেছে। কথা সেরে আবার কমপিউটারে মনোযোগী হয় সে।
লোকটি একা নয়। কমবেশি ঠিক একই ধরনের মানুষ অনেক আছে এই সাতসকালের এয়ারপোর্টে। কেউ কেউ একপাশে দাঁড়িয়ে সেলফোনে কথা বলছে। কেউ ব্ল্যাকবেরিতে মেসেজ পাঠাচ্ছে। আমেরিকার যে কোনো এয়ারপোর্টে একই দৃশ্য। বয়স তিরিশ-পঁয়তিরিশ থেকে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন, এরা কাজ করতে যাচ্ছে অন্য শহরে। এদের প্রায় কেউই পোশাকে ধোপদুরস্ত নয়। প্রতিভাবানদের স্যুট-টাই দরকার হয় না, এরা একেকজন আইনস্টাইন বা তার সমগোত্রীয় কেউ। সুতরাং, কিছু অবিন্যস্ত চুল বা জীনস-টীশার্ট তাদের অধিকার। চোখেমুখে উদ্বেগ ও ক্লান্তির পাশাপাশি আর্থিক সচ্ছলতাজনিত আত্মবিশ্বাসের ছাপ। গন্তব্যের শহরে পৌঁছে ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে সরাসরি কর্মস্থলে চলে যাবে। দিনশেষে ঢুকে পড়বে আগে থেকে ঠিক করে রাখা হোটেলে। রাত্রিযাপন শেষে পরদিন সকালে আবার কর্মস্থলে। এইরকম চলবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত, শুক্রবার সকালে হোটেল থেকে চেক-আউট করে লাগেজ গাড়িতে রেখে অফিসে ঢুকবে। দুপুরের পরে এয়ারপোর্ট - এবার তারা গৃহমুখী। সন্ধ্যায় মিলিত হবে পরিবারের অন্যদের সঙ্গে। এদের কেউ কেউ বৃহস্পতিবারে ফিরতে পারে, শুক্রবারে ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ পায়।
গৃহছাড়া এই কর্মীবাহিনীর পরিচয়, এরা ইনফরমেশন টেকনোলজির কনসালট্যান্ট। পরামর্শক। কমপিউটার প্রযুক্তির ধারক ও বাহক। এরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলে, সাধারণ মানুষদের কারো বোঝার সাধ্য নেই ঠিক কী নিয়ে কথা হচ্ছে। ফায়ারওয়াল, এফটিপি, ড্রাই রান জাতীয় কথা শুধু তারাই বোঝে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মেয়াদভিত্তিক চুক্তিতে এদের পরামর্শ ও কর্মসহায়তা কিনে থাকে আইটি-সংক্রান্ত স্বল্পমেয়াদী প্রকল্পের জন্যে।
বছর বিশেক আগে এই শ্রেণীর কর্মীর সংখ্যা ছিলো হাতে গোনা। আশির দশকে আমেরিকা অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়লে শুরু হয় বড়ো প্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্বিচার ছাঁটাই। কিন্তু কাজ তো বসে থাকবে না, ছাঁটাই হওয়া মানুষগুলোর কাজ করবে কে? সুতরাং আনো মেয়াদভিত্তিক অস্থায়ী পরামর্শকদের। এর ফলে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সুবিধা হলো এই যে, অস্থায়ী এই কর্মীদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে নেওয়া চলে, যখন-তখন বিদায় করেও দেওয়া যায় কোনো অজুহাত ছাড়াই। একটা থোক টাকা দেওয়া ছাড়া আর কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার দায় থাকে না। অথচ একজন নিয়মিত কর্মীকে বেতন ছাড়াও স্বাস্থ্যবীমা, জীবনবীমা, সবেতন বাৎসরিক ছুটি ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দিতে হয়। কাজ ফুরোলে ছ'মাস পরে বিনা কারণে তাদের বাদ দেওয়া যায় না, দিলে তার জন্যে মোটা মাশুল দিতে হয়। সরকারি তহবিলে ট্যাক্স দিতে হবে তাদের চাকরিতে বহাল রাখলে, এমনকি ছাঁটাই করলেও। সুতরাং চুক্তিভিত্তিক কর্মীবাহিনীর ওপর নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে ক্রমশ।
ছোটোবেলায় গ্রামে নানাবাড়িতে দেখেছি ধানকাটার মৌসুমে দূর-দূরান্ত থেকে দলে দলে মানুষ আসতো। 'রাশি রাশি ভারা ভারা ধানকাটা হলো সারা' - তারপরে ফিরে চলে যেতো তারা। সেই ধানকাটার শ্রমিকদের সঙ্গে আমেরিকার এই পরামর্শক বাহিনীর আসলে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। কাজ সম্পাদন হলে বিদায় হও। ধানকাটার শ্রমিকদের সহায় ছিলো কাস্তে এবং শারীরিক সামর্থ্য। আর আইটি পরামর্শকদের হাতিয়ার ল্যাপটপ কমপিউটার এবং আইটি-বুদ্ধিবৃত্তি।
এদের সবাইকে অবশ্য এরকম অন্যত্র যেতে হয় না, স্বল্পসংখ্যক ভাগ্যবান নিজের শহরেই কাজ করার সুবিধা পেয়ে যায়। ভ্রাম্যমান পরামর্শকদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি, পরিবার ও সন্তানাদির দায় সামলে মেয়েদের জন্যে এ ধরনের কাজ দুরূহ। তবু এই বাহিনীতে মেয়ে সদস্যও কিছু কম নেই।
তা এই পরামর্শকরা কী পরামর্শ দিয়ে থাকে? এ বিষয়ে অনেক ঠাট্টা-মশকরা চলে, মজার গল্পও চালু আছে। তার একটি নিবেদন করা যাক:
এক মেষপালক আপনমনে জনহীন রাস্তার পাশে মেষ চরায়। হঠাৎ একদিন ঝকঝকে নতুন একটি জীপ এসে থামে তার সামনে। এক যুবক অবতীর্ণ হয় গাড়ি থেকে - তার পরণে মহামূল্য স্যুট-টাই, পায়ে দামী জুতা, চোখে রে-ব্যান রোদচশমা। যুবক মেষপালককে জিজ্ঞেস করে, "আমি যদি ঠিক ঠিক বলতে পারি এখানে তোমার কতোগুলো ভেড়া আছে, তাহলে তুমি আমাকে একটি ভেড়া দেবে?"
মেষপালক একবার যুবকের দিকে তাকায়, তারপর ভেড়ার পালের দিকে। বলে, "বেশ তো।"
যুবক ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনে কী সব টেপাটিপি করে, জিপিএস-এ আশপাশের জমিজমাগুলো জরিপ করে, ডেটাবেজ খুলে হরেক রকম কোড ও ফর্মুলা দেখে, তারপর হাইটেক মিনি প্রিন্টারে ১৫০ পাতার একটি রিপোর্ট প্রিন্ট করে ফেলে। মেষপালককে জানায়, "তোমার ঠিক ১৫৮৬টি ভেড়া আছে।"
মেষপালক বলে, "সঠিক বলেছো, একটি ভেড়া তুমি নিতে পারো।"
যুবক একটি ভেড়া নিয়ে তার গাড়ির পেছনে রাখে। মেষপালক এবার জিজ্ঞেস করে, "এখন আমি যদি তোমার পেশাটি সঠিক অনুমান করতে পারি তাহলে তুমি কি আমার ভেড়াটি ফিরিয়ে দেবে?"
যুবক বলে, "নিশ্চয়ই, কেন নয়?"
"তুমি একজন আইটি পরামর্শক।"
"কী করে বুঝলে, বলো তো?", বিস্মিত যুবকের প্রশ্ন।
"খুব সোজা," মেষপালক ব্যাখ্যা করে, "প্রথমত, আমার চাওয়া-না চাওয়ার তোয়াক্কা না করেই তুমি এসে জুটেছো। দ্বিতীয়ত, তুমি ফী দাবি করে বসলে এমন একটি তথ্যের জন্যে যা আমি আগেই জানি। তৃতীয়ত, আমার কাজ বা পেশা সম্পর্কে তোমার বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা নেই, কারণ তুমি আসলে আমার কুকুরটি নিয়েছো, ভেড়া নয়।"
Saturday, October 20, 2007
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment