Saturday, October 20, 2007

যে কবিতায় প্রথম শামসুর রাহমানকে চিনলাম

তখনো স্কুলের সীমানা পার হইনি। ছোটো জেলা শহরের ছেলে আমি। রেলস্টেশনের স্টলটি বাদ দিলে শহরে একমাত্র সংবাদপত্র ও পত্রিকার এজেন্ট থানা রোডের ফজলুর রহমান। মূলত রেডিও-ট্রানজিসটর বিক্রি ও মেরামতের দোকান, একপাশে সরু ক্ষুদ্র পরিসরের একটি ঘরে পত্র-পত্রিকা। তখনো বগুড়া শহরে একটি বা দুটিমাত্র টিভি, দোকানে টিভি ওঠেনি। ষাট দশকের শেষদিকের কথা।

সেই দোকানে একদিন হঠাৎ একটি নতুন পত্রিকা ঝুলে আছে দেখা গেলো। নাম ললনা। নামই বলে দিচ্ছে মেয়েদের কাগজ। ঢাকার সেগুনবাগিচা থেকে প্রকাশিত। পত্রিকা চালাচ্ছেন সব পুরুষরা। শাহাদত চৌধুরী, শাহরিয়ার কবিররা জড়িত ছিলেন সেই কাগজের সঙ্গে। এর আগে মেয়েদের জন্যে একমাত্র কাগজ ছিলো বেগমবেগম-এর সঙ্গে ললনা-র পার্থক্য সহজেই চোখে পড়ে। আকারে-প্রকারে ললনা অনেক আধুনিক, বেগম গৃহিনী মহিলাদের, ললনা তরুণীদের পত্রিকা। নামে ললনা হলেও শুধু মেয়েদের কাগজ ছিলো না। বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো কাগজটি। সম্ভবত যুদ্ধের সময় বন্ধ হয়ে যায়, পরে আর কখনো প্রকাশিত হয়নি।

ললনা-র এক সংখ্যায় প্রচ্ছদে সুন্দর হস্তাক্ষরে একটি পুরো কবিতা ছাপা হলো। হস্তাক্ষরটি শিল্পী হাশেম খানের। কবিতার নাম কখনো আমার মাকে। রচয়িতার নাম শামসুর রাহমান। তাঁকে নামে চিনতাম। বিধ্বস্ত নীলিমা নামে তাঁর একটি কবিতার বইও বাড়িতে দেখছি, পড়িনি।

প্রচ্ছদে পুরো কবিতা, তা-ও আবার হাতে লেখা, বিষয়টি সবচেয়ে অভিনব মনে হলো, এর আগে কখনো দেখিনি। প্রথম পংক্তি কখনো আমার মাকে গান গাইতে শুনিনি কবিকে মুহূর্তে আপন মানুষ বানিয়ে দিলো। এমন ঘরোয়া জিনিস নিয়ে সহজ করে লেখা যায় কবিতা! আধুনিক কবিতা বলতে যা বোঝায়, মফস্বলের মধ্যবিত্ত পরিবারে তা খুব একটা ঢোকেনি তখনো। শামসুর রাহমান নামের এক কবি সেই বেড়াটি ভেঙে দিলেন।

কখনো আমার মাকে গান গাইতে শুনিনি মনে পড়লে এখনো রোমাঞ্চ হয়। সেই প্রথমবারের মতো।

কখনো আমার মাকে
শামসুর রাহমান

কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।

যখন শরীরে তার বসন্তের সম্ভার আসেনি,
যখন ছিলেন তিনি ঝড়ে আম-কুড়িয়ে বেড়ানো
বয়সের কাছাকাছি হয়তো তখনো কোনো গান
লতিয়ে ওঠেনি মীড়ে মীড়ে দুপুরে সন্ধ্যায়,
পাছে গুরুজনদের কানে যায়। এবং স্বামীর
সংসারেও এসেও মা আমার সারাক্ষণ
ছিলেন নিশ্চুপ বড়ো, বড়ো বেশি নেপথ্যচারিণী। যতদূর
জানা আছে, টপ্পা কি খেয়াল তাঁকে করেনি দখল
কোনোদিন। মাছ কোটা কিংবা হলুদ বাটার ফাঁকে
অথবা বিকেলবেলা নিকিয়ে উঠোন
ধুয়ে মুছে বাসন-কোসন
সেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায় ঝুলিয়ে কাপড়,
ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে মেতে
আমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে আদরে
অবসরে চুল বাঁধবার ছলে কোনো গান গেয়েছেন কি না
এতকাল কাছাকাছি আছি তবু জানতে পারিনি।

যেন তিনি সব গান দুঃখ-জাগানিয়া কোনো কাঠের সিন্দুকে
রেখেছেন বন্ধ ক'রে আজীবন, কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু
ন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে!

No comments: