'এখন অনেক রাত - ঘড়িতে প্রায় সাড়ে তিনটা। বাইরে অঝোর বৃষ্টি। আর আমি আমার একাকী ঘরে জেগে জেগে তোমাকে ভাবছি।'
হুবহু না হলেও প্রথম যৌবনে এই ধরনের বাক্য প্রেমিকাকে উদ্দেশ করে আমরা সবাই কমবেশি লিখেছি। ইংরেজিতে 'সুইট লাইজ' বলে একটি কথা আছে, বাংলায় যাকে মধুময় মিথ্যাচার বলা চলে। নির্দোষ বলা যেতো, কিন্তু তাতে প্রেমানুভূতির অনুষঙ্গ অনুপস্থিত থেকে যায়। এখানে পত্ররচনার সময়ের উল্লেখটি লক্ষ্য করার ব্যাপার। ভালোবাসার গভীরতা বোঝাতে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকার ভূমিকা খুব বড়ো বলে তরুণ প্রেমিকরা মনে করে থাকে। ফলে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাব উল্লেখ করা সময়টি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা যেতেই পারে। অন্য কারো কথা জানি না, সেই বয়সে আমি নিজে যে তা করেছি স্বীকার করতে এখন সংকোচ নেই। চিঠি লেখার প্রকৃত সময় হয়তো রাত দশটা, কিন্তু চিঠিতে জানাচ্ছি এখন রাত দেড়টা।
মহাজনরা বলেন, প্রেম এবং যুদ্ধে সবই বিধিসম্মত। সামান্য মিথ্যাচারে তাই দোষ না ধরলেও চলে। একইভাবে প্রেমিকাও যে তা করছে না তা-ই বা কীভাবে বিশ্বাস করা যাবে? অথচ বয়সটি এমন যে দুই পক্ষই তা নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করে। কৈশোর ও প্রথম যৌবনের কালেই এরকম অকুণ্ঠ বিশ্বাস স্থাপন করা সম্ভব। বয়স বাড়তে থাকলে রাশি রাশি অপ্রিয় অভিজ্ঞতাজনিত কারণে প্রশ্নহীন বিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব বাড়ে। আমাদের মস্তিষ্ক তখন হৃদয়কে উপেক্ষা করতে শিখে যায়, কু-তার্কিকের ভূমিকায় মস্তিষ্ক ক্রমাগত প্রশ্ন ও সংশয়ে আবিষ্ট হয়।
যে সময়ের কথা বলছি তখন ইমেল বলে কোনো বস্তুর অস্তিত্ব ছিলো না। এমনকি দশ বছর আগেও ইমেলের ব্যবহার এতো ব্যাপক হয়ে ওঠেনি। এখন এমন হয়েছে যে একটি ইমেল ঠিকানার মালিক না হওয়া কিঞ্চিৎ বিস্ময় ও কৌতূহলের উদ্রেক ঘটায়। কাউকে ফোন নম্বর জিজ্ঞাসা করার সঙ্গে সঙ্গে ইমেল ঠিকানা জেনে নেওয়াও রীতি হয়ে গেছে। কারো ইমেল ঠিকানা বলে কিছু নেই জানলে আমরা ভাবি, এই মানুষটি কোন যুগে পড়ে আছে?
আজকের তরুণ বয়সীদের কাছে হাস্যকর মনে হবে, কিন্তু আমাদের কালে হাতে লেখা এইসব প্রেমপত্র উদ্দিষ্ট জনের কাছে পৌঁছাতো হাতে হাতে বা ডাক বিভাগের সাহায্যে। অথচ ইমেল কিন্তু 'রাত জেগে তোমার কথা ভাবছি' জাতীয় মধুর মিথ্যাচার করার সুযোগটি সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে দিয়েছে। যে সার্ভারের মাধ্যমে ইমেল আদান-প্রদান হচ্ছে তা নিজ দায়িত্বে প্রেরিত বার্তায় দিন-তারিখ-ঘণ্টা-মিনিটের ছাপ (টাইম স্ট্যাম্প) বসিয়ে দিচ্ছে, বানিয়ে বলার উপায় নেই।
একটি গোলাপের পাঁপড়ি বা সামান্য সুগন্ধি সহযোগে অশুদ্ধ বানানে (প্রেমে অবশ্য সব শুদ্ধ) বা ততো-ভালো-নয় হস্তাক্ষরে লেখা প্রেমপত্রে প্রেমিকার স্পর্শ অনুভব করা যেতো। আমার প্রথম জীবনের বিগত প্রেমিকার হস্তাক্ষর ছিলো বেশ আলাদা ধরনের, এক নজর দেখে তা হিন্দিতে লেখা বলে ভ্রম হওয়ার সম্ভাবনা। এই ঢঙের হস্তাক্ষর সারা জীবনে আর কারো দেখিনি। আমার ভাগ্যে জোটেনি, কিন্তু শুনেছি চিঠির এক কোণে লিপস্টিক-রঞ্জিত ঠোঁটের ছাপসহ 'আমি এখানে চুমু খাইয়াছি, তুমিও খাইও' থাকাও অসম্ভব ছিলো না। যান্ত্রিক ইমেল প্রেমপত্রে এইসব কোথায় পাওয়া যাবে?
ইমেল বস্তুটি এতো আমাদের অপরিহার্য হয়ে উঠলো কীভাবে? আসলে মানুষ একে অন্যের সঙ্গে সবসময়ই কথা বা চিন্তার আদান-প্রদান করতে ইচ্ছুক - তা সে গভীর কোনো তত্ত্বকথা হোক অথবা হোক প্রেমপত্র বা মামুলি কুশল বিনিময়। সংজ্ঞায় ফেললে ইমেল হচ্ছে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বার্তা আদান-প্রদানের ব্যবস্থা। এই সংজ্ঞায় টেলিগ্রাফ ব্যবস্থাটি ইমেলের আদিরূপ, ঊনবিংশ শতকে যার ব্যবহার শুরু হয়। টেলিগ্রাফে অবশ্য প্রেরক ও প্রাপকের যোগাযোগ প্রত্যক্ষ ছিলো না। টেলিগ্রাফ অফিস 'মাদার ইল, কাম শার্প' জাতীয় বার্তাটি গ্রহণ করে প্রাপকের ঠিকানায় পৌঁছে দিতো লোক মারফত। এই তো সেদিনের ঘটনা, ১৩৫ বছর যাবত চালু থাকার পর বাংলাদেশ থেকে টেলিগ্রাফ বিলুপ্ত হয়ে গেছে আনুষ্ঠানিকভাবে। আমাদের বাল্যকালের 'টরে টক্কা টক্কা টরে' জাতীয় ছড়াগুলি এইভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলো।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে আসে টেলেক্স, ব্যবসায়িক তথ্যাদি সঞ্চালনে তা ব্যাপকভাবে ব্যববহার হয়। ইন্টারনেটের সর্বগ্রাসী বিস্তারের ফলে আগের মতো ব্যাপক না হলেও টেলেক্স এখনো চালু আছে। টেলিগ্রাফ ও টেলেক্স দুটিই খরচসাপেক্ষ ছিলো। সে তুলনায় ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে ইমেলে বার্তা আদান-প্রদানটি এখন ব্যয়শূন্য।
ষাট ও সত্তরের দশকে ডাইনোসর-সদৃশ (ডাইনোসরের মতো এগুলিও এখন বিলুপ্তপ্রায়) মেইনফ্রেম ও মিনি কমপিউটারের সঙ্গে সংযুক্ত টার্মিনালগুলি একে অপরের সঙ্গে বার্তা বিনিময় করতে পারতো। একই সময়ে আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগে কমপিউটার নেটওয়ার্ক তৈরির গবেষণা শুরু হয়। এখানেই ১৯৭১ সালে রে টমলিনসন ইমেলের বর্তমান রূপের প্রাথমিক কাজটি সম্পন্ন করেন।
সত্তর দশকের শেষভাগে অ্যাপল ও আইবিএম-এর হাত ধরে পারসোনাল কমপিউটারের জয়যাত্রার শুরু এবং ক্রমে কমপিউসার্ভ, এমসিআই মেল, ইজিলিংক, অ্যাপললিংক সীমিতভাবে ইমেল সেবা চালু করে। এগুলির সীমাবদ্ধতা ছিলো এই যে প্রেরক এবং প্রাপককে একই সার্ভিসের আওতায় থাকতে হয়। যেমন, কমপিউসার্ভ-এর গ্রাহকের পক্ষে ইজিলিংক-এর গ্রাহকের সঙ্গে ইমেল বিনিময় সম্ভব ছিলো না। এগুলির সেবার মানও নির্ভরযোগ্য ছিলো না, ফলে এরাও ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে ইন্টারনেট বিপ্লবের মাধ্যমে ইমেল এখনকার রূপ পরিগ্রহ করেছে। ১৯৯৫ থেকে ইন্টারনেট-নির্ভর ইমেলের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। আইএসপি বা ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের ইমেলের পাশাপাশি বিনামূল্যের ইয়াহু, হটমেল, জিমেল ইত্যাদি চালু হয় এবং পৃথিবী বাঁধা পড়ে যায় এই নেটওয়ার্কের ভেতরে।
ইমেল বদলে দিয়েছে আমাদের জীবন, ভাবনার ধরণ ও প্রত্যাশার সীমানা। আমাদের ব্যবহারিক জীবনের মধ্যে ব্যাপকভাবে ঢুকে পড়েছে ইমেলের সহোদর ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং ও মোবাইল ফোনের এসএমএস। রচনার শুরুর দিকে প্রেমিক-প্রেমিকাদের বদলে যাওয়া যোগাযোগের পদ্ধতি নিয়ে বলছিলাম। অকালে প্রয়াত কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর খুবই জনপ্রিয় কবিতার দুটি লাইন উল্লেখ করা যায় : 'ভালো আছি, ভালো থেকো / আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।' ইমেল তো আসলে আকাশের ঠিকানায়ই লেখা চিঠি। রুদ্র তা দেখে যাননি।
আমার কবিবন্ধু বদিউজ্জামান নাসিম 'ই-চুম্বন' শিরোনামের কবিতায় লিখছেন : 'তোমরা অপেক্ষায় থেকো / একদিন মেঘে মেঘে ভেসে যাবে / তোমাদের প্রার্থিত চুম্বন; / জলে যেমন পদ্ম ভাসে।' কবিরা শুনেছি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হন। সেই ভরসায় আমরা অপেক্ষায় থাকছি। তবু শয়তানের উকিল (ডেভিল'স অ্যাডভোকেট) সেজে জিজ্ঞেস করি, ভুল প্রতিশ্রুতি নয় তো?
Tuesday, October 23, 2007
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment