Wednesday, October 24, 2007

আমাদের সুরাইয়া খানম

সুরাইয়া খানম চলে গেলেন গত ২৫ মে। আমেরিকার মরুময় রাজ্য আরিজোনার একটি শহরে তিনি বাস করতেন জানতাম। হয়তো দুরূহ ছিলো না, তবু যোগাযোগ করা হয়নি তাঁর সঙ্গে। খবর এলো কিছুটা গুজবের মতো, বিশ্বাস হয়নি বা করতে চাইনি বলেই হয়তো গুজব মনে হয়েছিলো। ৬০ আর কী এমন বয়স যে চলে যেতে হবে?

কবি বদিউজ্জামান নাসিম জানালেন, সুরাইয়া খানমের মৃত্যুসংবাদ-সংবলিত একটি ইমেল পেয়েছেন তিনি। অনেককে ফোন করেছেন, নিশ্চিত হতে পারেননি। জিজ্ঞেস করলেন, আমি কিছু শুনেছি কি না। জানতাম না। জানলাম জনকণ্ঠে মাহবুব তালুকদারের লেখায়। তাতে উল্লেখ ছিলো, ওই কাগজের শোক সংবাদ বিভাগে খবরটি ছিলো। কয়েকটি বাংলা সংবাদপত্র প্রতিদিন ইন্টারনেটে পড়া হলেও শোকসংবাদে আমার কী কাজ? কিন্তু সুরাইয়া খানমের চলে যাওয়ার সংবাদটি যে সেখানেই পাওয়া যাবে, কে জানতো!

১৯৭৩-এ আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় সুরাইয়া আপা ছিলেন না, শিক্ষক হয়ে এলেন ওই বছরের শেষের দিকে অথবা ৭৪-এর শুরুতে। ক্যামব্রিজে পড়া বিদুষী এবং অসামান্য রূপসী সুরাইয়া খানম সাড়া জাগালেন অবিলম্বে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে মহিলা শিক্ষকদের আপা বলে সম্বোধন করার প্রচলন ছিলো না। ম্যাডাম বলা হতো, সম্ভবত এখনো হয়।

সেই হিসেবে সুরাইয়া খানমকে আমারও ম্যাডাম সম্বোধন করার কথা। হয়নি, তার পেছনে আমার ছোটো বোন ঝর্ণার খানিকটা অপ্রত্যক্ষ ভুমিকা ছিলো। ঝর্ণা থাকতো শামসুননাহার হলে, সুরাইয়া খানম সেখানে হাউস টিউটর হয়ে এলেন। তাঁর জন্যে আলাদা আবাস বরাদ্দ হলো না। অথবা করতে পারলো না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তিনি তখন সংসারী নন, একা মানুষ। তাঁকে থাকতে দেওয়া হয়েছিলো ছাত্রীদের জন্যে নির্ধারিত একটি কক্ষে।

রুম নম্বর ২৪০। ঠিক পাশেই ২৩৯-এর বাসিন্দা ঝর্ণার সঙ্গে তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠতা হয়। ঝর্ণার জন্যে তাঁর বরাদ্দ প্রশ্রয়ের কিছু আমার ভাগে এসে পড়ায় তিনি সুরাইয়া আপা হয়ে গিয়েছিলেন। ক্লাসে আমার নিয়মিত অনুপস্থিতির ফলে বেশি যোগাযোগ ছিলো না, ছাত্র হিসেবে আমার নিতান্ত অনুজ্জ্বলতাও হয়তো একটি কারণ।

স্নব বলে আমাদের ইংরেজি বিভাগের খ্যাতি ছিলো, হয়তো এখনো আছে। ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থীরা বাংলা সাহিত্য, বিশেষ করে সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য, নিয়ে কথা বলবে বা চর্চা করবে তা যেন খুব নিম্নমানের কাজ, জাত খোয়ানোর মতো নিন্দনীয় অপরাধ।

ব্যতিক্রম অবশ্য সবখানেই থাকে, ইংরেজি বিভাগে নিম্নবর্গীয় সেই সংখ্যালঘুদের একজন ছিলেন সুরাইয়া খানম। নিজে কবিতা লিখতেন, তাঁর একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘নাচের শব্দ’ প্রকাশিত হয়েছিলো সত্তর দশকের মাঝামাঝি। আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে বাংলা ভাষায় লেখালেখিতে যুক্ত ছিলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রাজিয়া খান ও সেলিম সারোয়ার এবং কিছু পরের সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কাশীনাথ রায় ও খোন্দকার আশরাফ হোসেন। সেই সময়ের ইংরেজির ছাত্রদের মধ্যে নূরুল করিম নাসিম ও শিহাব সরকার লেখালেখিতে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বলে মনে পড়ে।

অন্যসব ক্লাসের মতোই সুরাইয়া আপার ক্লাসেও আমার বারকয়েকের বেশি যাওয়া হয়নি। তিনি কী পড়াতেন, তা-ও মনে নেই। অমনোযোগী ছাত্র হলে যা হয় আর কি। আরেকটি কারণ স্বীকার করে নিতে সংকোচ নেই। প্রিয়দর্শিনী সুরাইয়া আপার ছিলো দৃপ্ত ও দৃঢ় বাচনভঙ্গি এবং প্রখর ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বলতা। যে কয়েকবার তাঁর ক্লাসে উপস্থিত হয়েছি, হয়তো এইসব গুণাবলিই বেশি চোখে পড়েছে, বিদ্যা অর্জন গৌণ।

ক্লাসের বাইরে বারকয়েক তাঁর অফিসে গিয়েছি। একা বা দুয়েকজন বন্ধুবান্ধবসহ। তাঁর রূপ ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ আমার দুই লাজুক সহপাঠী কীভাবে যেন আবিষ্কার করে ফেলে যে, সুরাইয়া আপার সঙ্গে আমার সামান্য যোগাযোগ আছে। তাদের খুব ইচ্ছে তাঁর সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলা, কিন্তু কীভাবে সম্ভব জানে না।

মনে আছে, মধুর ক্যান্টিনে চা-সিঙাড়ার বিনিময়ে দুই গুণমুগ্ধকে এক দুপুরে তাঁর অফিসে নিয়ে যাই। সেই সাক্ষাতের সময় একটি মজার ঘটনা ঘটেছিলো। দুই সহপাঠী বন্ধুকে নিয়ে সুরাইয়া আপার কক্ষে গিয়ে দেখি তাঁর উল্টোদিকের চেয়ারে বসা আমাদের দুই-এক বছরের কনিষ্ঠ চশমা-পরা একটি মেয়ে বসে এক নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে। সুরাইয়া আপা আমাদের বসতে ইঙ্গিত করে মেয়েটির কথায় হুঁ হাঁ করে যাচ্ছিলেন।

সে মেয়ের কথা আর থামেই না। তার একটি কথা এখনো আমার মনে আছে। সে সাহিত্যে কতোটা নিবেদিতপ্রাণ তা বোঝাতে গিয়ে জানায়, ‘জানেন ম্যাডাম, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে কিছুক্ষণ সাহিত্যচর্চা না করলে আমার ঘুমই আসে না!’ সুরাইয়া আপার মুখে কৌতুকের হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে যেতে দেখলাম।

তাঁর অফিসে গেলে কথা হতো বাংলা সাহিত্য নিয়ে। ঠিক আড্ডা বলা চলে না, আপা ডাকলেও শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কজনিত দূরত্ব কিছু ছিলোই। যোগাযোগটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কথাবার্তায় তাঁকে খুব আবেগতাড়িত মানুষ বলে মনে হতো। কথা বলতেন সম্পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের গভীর থেকে। অত্যন্ত স্পষ্টভাষী ছিলেন, যা তাঁকে কিছু মানুষের চোখে অপ্রিয়ও করে থাকবে।

সুরাইয়া আপার আরেকটি কীর্তির কথা অনেকের জানা নেই। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ইংল্যান্ডে বাংলাদেশের পক্ষে সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক অভ্যুদয়ের পর লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়্যারে বাঙালিদের বিজয় অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকাটি উত্তোলিত হয়েছিলো তাঁরই হাতে।

১৯৭৫-এর ২৬ নভেম্বর। সকালে ক্লাসে যাওয়ার পথে খবর পাওয়া গেলো, তরুণ কবি আবুল হাসান প্রয়াত। তাঁর কবিতা আমার প্রিয়। আবুল হাসান দীর্ঘকাল অসুস্থ ছিলেন, সরকারি উদ্যোগে চিকিৎসার জন্যে তাঁকে পাঠানো হয়েছিলো বার্লিনে। যতোদূর জানি, একজন কবির চিকিৎসার জন্যে সরকারি তৎপরতা ও সহায়তার ঘটনা বাংলাদেশে সেই প্রথম।

ফিরে আসার পর হাসান অল্প কিছুদিন ভালো ছিলেন, তারপর তাঁকে আবার পি জি হাসপাতালে (এখন শেখ মুজিব হাসপাতাল) ভর্তি করতে হয়। চিকিৎসকরা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, সুরাইয়া আপা ছাড়েননি। আবুল হাসানের সঙ্গে সুরাইয়া আপার বন্ধুত্ব বা ততোধিক ঘনিষ্ঠতা হয়েছিলো, এই মর্মে কথাবার্তা শোনা যেতো। সেসব অবান্তর, কবির সেই শেষ সময়ে সুরাইয়া খানম অবতীর্ণ হয়েছিলেন মমতাময়ীর ভূমিকায়।

প্রিয় কবির মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ক্লাস করতে যাওয়া যায় না। পি জি হাসপাতালে পৌঁছে দেখলাম উদভ্রান্ত সুরাইয়া আপাকে, প্রয়াত কবির বিছানার পাশে দাঁড়ানো। তাঁকে অমন করুণ ও অসহায় আগে কোনোদিন দেখিনি। কিছু কিছু ছবি চিরকালের মতো হৃদয়কন্দরে জেগে থাকে, আজও সে মুখ ভোলা হয়নি।

কবির বন্ধু-আত্মীয়-ভক্তরা তখন ধীরে ধীরে সমবেত হচ্ছেন পি জি হাসপাতালে কবির অন্তিম শয্যাটিকে ঘিরে। অতো মানুষের সংকুলান সেই ছোট্টো কক্ষে হওয়ার কথা নয়, আমরা কেউ কেউ বাইরে বারান্দায় দাঁড়ানো। সুরাইয়া আপা হঠাৎ বেরিয়ে এলেন। কী ভেবে কে জানে, আমার হাত ধরে বললেন, ‘ওরা হাসানের লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। তা কিছুতেই হতে পারে না, হাসানের খুব ইচ্ছে ছিলো তার কবর হবে রেসকোর্সের একপাশে। সে বলে গেছে। আমার কথা কেউ শুনছে না, তুমি একটু বুঝিয়ে বলবে ওদের?’

জীবনে একেকটা অসহায় সময় আসে যখন মানুষ খুব অবুঝ ও যুক্তিহীন হয়ে যায়। তখন অতি সামান্য কিছুকেও শক্ত অবলম্বন ভাবতে ইচ্ছে করে। না হলে এতো মানুষ থাকতে সুরাইয়া আপা আমাকে এই অনুরোধটি কেন করবেন? আমার কী ক্ষমতা, আমি তো সত্যিই কেউ না, আমার কথা কে শুনবে? তাঁর তখন সেসব বিবেচনা করার অবস্থা নেই।

বুঝতে পারি, অনেকের কাছে প্রত্যাখ্যাত ও উপেক্ষিত হয়ে সবাইকে তিনি একই অনুরোধ করে যাচ্ছেন, হাসানের কবর যেন ঢাকায় হয়। হঠাৎ রাহাত খানকে দেখতে পাই। আমি সুরাইয়া আপাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাই। বলি, ‘রাহাত ভাই কিছু একটা করতে পারবেন হয়তো।’

নিজের অসহায়ত্ব নিয়ে সরে এসেছিলাম সেদিন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া আর কোনোদিন হয়নি। পেরে উঠিনি। সুরাইয়া আপা একটিমাত্র অনুরোধ করেছিলেন, যা রক্ষা করার ক্ষমতা আমার ছিলো না।

একটি সাধারণ ধারণা প্রচলিত আছে যে মেয়েদের মেধা ও সৌন্দর্যের সম্মিলন কম দেখা যায়। হয়তো খুব অমূলক নয়। কিন্তু সুরাইয়া খানম সেই সংখ্যালঘুদের একজন যাঁর মধ্যে মেধা, প্রতিভা ও সৌন্দর্য এক হয়ে মিশে গিয়েছিলো। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, রূপসী নারী হিসেবে তিনি যতো প্রচারিত হয়েছেন, মেধাবী শিক্ষক বা প্রতিভাবান কবি সুরাইয়া খানমকে নিয়ে আলোচনা সে তুলনায় ততোটাই কম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে প্রবাসী হয়েছিলেন আশির দশকের শুরুতে। বিয়ে করে সংসার পেতেছিলেন, স্বামী সৈয়দ সালাউদ্দিন এক দুর্ঘটনায় মারা যান বছর দুয়েক আগে। তাঁর মেয়ে সম্প্রতি পড়াশোনা শেষ করেছে, স্বামীসহ ওয়াশিংটন ডি সি-তে বাস করে। সুরাইয়া আপা শেষের দিনগুলিতে সম্পূর্ণ একা ছিলেন শুনেছি। তাঁরও সময় ফুরিয়ে গেলো।

বিদায়, সুরাইয়া আপা। আপনার অন্তর্ধানের খবরে ঝর্ণা বলছিলো, কারণে-অকারণে প্রায়ই আপনাকে তার মনে পড়ে। আপনাকে সে ভোলেনি (‘অমলকে বোলো, সুধা তাকে ভোলেনি!’)। আপনার সম্পর্কে তার শেষ কথা, আপনি সময়ের তুলনায় অনেক অগ্রবর্তী ছিলেন।

আপনার আরেক ছাত্র, আমার বন্ধু বিক্রম ইমেলে জানালো, তাদের ‘পদাতিক’ পত্রিকার জন্যে একটি কবিতা দিয়েছিলেন আপনি। আপনার স্বহস্তে লেখা মূল কপিটি তার কাছে রক্ষিত ছিলো দীর্ঘদিন। এখন খুঁজে না পেয়ে তার অনুশোচনার শেষ নেই। আপনাকেও তো আর পাওয়া যাবে না।

সবশেষে আমার কথাটুকু জানিয়ে রাখি, যতোদিন আয়ু অবশিষ্ট আছে, বছরে অন্তত একবার হলেও আপনাকে মনে পড়বে। আপনার চলে যাওয়ার দিনটির খুব আশেপাশেই যে আমার জন্মদিন। ভুলি কী করে?

--------------
জুন ২০০৬
--------------

No comments: