Saturday, October 20, 2007

লোপার গন্তব্য ও তার সঙ্গে না-হওয়া বোঝাপড়া

রাত সাড়ে দশটায় বেরিয়েছি। হাতে এক ঘণ্টা সময়, লোপার ফ্লাইট পৌঁছবে সাড়ে এগারোটায়। ট্যাক্সিতে এয়ারপোর্ট বিশ-পঁচিশ মিনিটের দূরত্ব। তবু একটু সময় নিয়ে যাওয়া ভালো। সিঙ্গাপুর শহর সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা হয়েছে, এক সপ্তাহে যতোটা হওয়া সম্ভব।

সাল ১৯৯১। মে মাসের তীব্র গরমে সিঙ্গাপুর এসেছি। স্ত্রী-কন্যা তখনো ডালাসে, এখানে বাড়িঘর ঠিক হলে আসতে বলবো। দু’দিন আগে বউ ফোনে বললো, ছেলেকে নিয়ে লোপা ঢাকা রওনা হচ্ছে আগামীকাল। সিঙ্গাপুরে ওর যাত্রাবিরতি নয় ঘণ্টার। ছোটো বাচ্চাকে নিয়ে সারারাত এয়ারপোর্টে বেচারির খুব কষ্ট হবে। তোমার অসুবিধা না হলে যেয়ো।

ভালো হতো যদি ওকে বাসায় এনে রাতটা তার ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া যেতো। সকালে উঠে দিব্যি ঢাকার ফ্লাইট ধরতে পারতো। কিন্তু আমি তখনকার মতো আছি আরো তিনজন বাঙালির সঙ্গে একটি দুই কামরার বাসায়। দু’জন ব্যাচেলর, শেষজন আমার মতোই সাময়িক পরিবারছাড়া। আমি ঘুমাই বসার ঘরের সোফায়।

লোপার সঙ্গে খুব সামান্য পরিচয়। এমনিতে চিনি, আর সবাই যেমন চেনে। ডালাস শহরে বাঙালিদের অনুষ্ঠানে নাচের জন্যে তার ডাক পড়ে। বুলবুল ললিতকলার ছাত্রী লোপা, শুনেছি তার মা বাংলাদেশের নামী নৃত্যশিল্পী।
সামনাসামনি দেখা এবং আলাপ এক বন্ধুর বাড়িতে। লোপার সঙ্গে কয়েকমাস বয়সী ছেলে। তার বর হুমায়ুন আসতে পারেনি। ছিপছিপে লম্বামতো লোপা দেখতে-শুনতে সাধারণ, আর দশজনের থেকে আলাদা করে চোখে পড়বে না। চোখ দুটি ছাড়া। আয়ত শব্দটি বোধহয় এই ধরনের চোখের বর্ণনায় ব্যবহার করা হয়। তার চোখে এক ধরনের বিষণœতাও স্পষ্ট। আমার বউয়ের সঙ্গে তার আগেই কোথাও আলাপ হয়েছে। অবশ্য মেয়েরা প্রথম আলাপেই এমনভাবে কথা বলতে থাকে যেন কতোদিনের চেনা। লোপার সঙ্গে সেদিন আমার মামুলি দু’একটা কথার বেশি হয়নি। মাস দুই আগের ঘটনা সেটা।

এতো অল্প পরিচয়ে এয়ারপোর্টে বসে রাতভর ওর সঙ্গে কী কথা বলবো? কিছু মানুষ আছে, তাদের কথা শুরু করার জন্যে কোনো প্রসঙ্গ দরকার হয় না। কেউ কেউ কথা থামাতে জানে না। আমার সমস্যা কথা শুরু করা নিয়ে, শুরু করার আগেই থেমে থেমে যেতে চায়।

আচমকা মুশকিল আসানের একটা উপায় মাথায় আসে। মারুফ ভাই আর রাভী ভাবী ভালো করে চেনেন লোপাকে। বন্ধুস্থানীয় এই দম্পতি মেয়ে মনিকাসহ ডালাসে ছিলেন। মারুফ ভাই আইবিএম-এ কাজ করেন, ডালাস থেকে তাঁকে সিঙ্গাপুরে বদলি করা হয়েছে কিছুদিন আগে। তাঁদের বাসায় দিব্যি ছেলেকে নিয়ে রাতটা থাকতে পারে লোপা। মারুফ ভাই আর রাভি ভাবী এক কথায় রাজি। এমনকী, সকালে এয়ারপোর্টে ওদের পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও মারুফ ভাই নিয়ে ফেলেছেন নিজে থেকে। শুধু ওদের নামিয়ে দিতে হবে মারুফ ভাইয়ের বাসায়। লোপা অবশ্য এই ব্যবস্থার কথা জানে না, বলার সময় পাওয়া যায়নি।

এয়ারপোর্টে দোকানপাটগুলো বন্ধ হয়ে গেছে বেশিরভাগ, লাউঞ্জে ভিড় তেমন নেই। লোপার ফ্লাইট অবতরণের ঘোষণা শুনি। তাড়াহুড়োর কিছু নেই, কাস্টমস-ইমিগ্রেশন সেরে বেরোতে আরো কিছু সময় লাগবে। লোপার কি মার্কিন পাসপোর্ট? জানা নেই। না হলেও অসুবিধা হবে না, তখনো সবুজ পাসপোর্টে অন-অ্যারাইভাল ভিসা পাওয়া যায় সিঙ্গাপুরে। অনায়াসে বেরিয়ে আসতে পারবে।

টিকেটধারী যাত্রীদের এলাকা পুরোটা কাচের দেয়ালে ঘেরা। রিসিভ করতে আসা জনগণের এলাকা থেকে ভেতরে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। ব্যাগেজ এলাকায় যাত্রীদের ভিড় জমছে, একে একে তারা বেরিয়ে আসতেও শুরু করেছে। লোপার অবশ্য ব্যাগেজ সংগ্রহ করার ঝামেলা নেই, সেগুলো ঢাকা পর্যন্ত বুক করা থাকবে। ইমিগ্রেশনের কাউন্টার পার হয়ে ছেলে কোলে করে সোজা বেরিয়ে আসতে পারবে। আমেরিকায় শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ পরা কাউকে ক্কচিত দেখতে পাওয়া যায়, এখানে তা অতো বিরল নয়। এ দেশে অনেক ভারতীয় এবং বাঙালির বাস। তার ওপরে সিঙ্গাপুর তো এখন আবার বাড়ির কাছের আরশিনগর। ভারতীয় পোশাক পরা কোনো মহিলাকে দেখলে চোখ অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে উঠছে। আচমকা মনে হয়, লোপাকে চিনতে পারবো তো! অথবা লোপা আমাকে! সামনাসামনি দেখা তো মাত্র একবার। অবশ্য বিষণ্ণ ও আয়ত চোখ দুটো তার সঙ্গে থাকবে, তাহলে আর ভুল হয় কী করে?

কিন্তু কোথায় লোপা? সব যাত্রী বেরিয়ে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। ব্যাগেজের ঘুরন্ত ক্যারুসেল থেমে গেছে, অপেক্ষমাণ কাউকে আর দেখা যাচ্ছে না সেখানে। রিসিভ করতে আসা মানুষজনও নেই হয়ে এসেছে প্রায়। কোনো কারণে যাত্রা বাতিল করেছে? জানার উপায় নেই। হঠাৎ মনে পড়ে, এয়ারপোর্টের ট্রানজিটে যাত্রীদের বিশ্রামের জন্যে রুম ভাড়া পাওয়া যায় শুনেছিলাম। লোপা সেখানে ঢুকে পড়লো নাকি? তা-ও বা জানা যাবে কী করে? নাকি ইমিগ্রেশনে কোনো ঝামেলা? তাহলে বেরোতে পারবে না, ট্রানজিটে বসে থাকতে হবে। এখন আমি করি কী?

ওদিকে মারুফ ভাইরা জেগে অপেক্ষা করছেন। আরো খানিক অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই। খানিক পরে প্লেনের পাইলট-ক্রুরাও বেরিয়ে এলে মনে হয়, আর অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না। এখন বারোটা চল্লিশ। পাবলিক ফোন থেকে মারুফ ভাইয়ের নাম্বার ডায়াল করি। সংক্ষেপে পরিস্থিতি জানাই। আনুমানিক সিদ্ধান্তে আসা হয়, কোনো কারণে লোপা আসা বাতিল করেছে অথবা ফ্লাইট বদলেছে।

ফোন রেখেও কিছুক্ষণ পায়চারি করি। যদি হঠাৎ উদয় হয় লোপা!

বাসায় ফিরে দেখি দুটো বাজতে মিনিট পাঁচেক বাকি। কাপড় পাল্টে শুয়ে পড়ি। রাত্রিজাগরণের ক্লান্তি নয়, বিফলতার অবসাদ। নিজের কোনো হাত নেই, তবু শূন্য হাতে ফিরে আসা। লোপার সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা এমন নয় যে, খুব দুশ্চিন্তা হওয়া আমার উচিত। কথা দিয়েছিলাম, এয়ারপোর্টে যাবো। গিয়েছি। অপেক্ষাও করেছি যতোটা করা সম্ভব। তার দেখা না পাওয়া গেলে আমার আর কী করার ছিলো?

টেলিফোনের কর্কশ শব্দে ঘুম ভাঙে। চোখ তুলে অন্ধকারে দেখি, ডিজিটাল টেবিল ঘড়িতে চারটা দশ। হাত বাড়িয়ে ফোন তুলি, হ্যালো।

আমি লোপা বলছি এয়ারপোর্ট থেকে।

আশ্চর্য তো! বলি, কোথায় ছিলেন আপনি?

লোপা বলে, ভুল আমারই হয়েছে। ট্রানজিটে একজন বললো, এখানে রাতের জন্যে রুম ভাড়া পাওয়া যেতে পারে। ভাবলাম, তাহলে আর আপনাকে কষ্ট দিতে হয় না। কিন্তু রুম পাওয়া গেলো না। বেরিয়ে আসতে দেরি হয়েছে সেজন্যেই।

একটু রাগ হয় আমার। রুম পেয়ে গেলে আমি জানতেও পারতাম না। যেমন এসেছি, তেমনি ফিরে আসতে হতো। আমাকে এয়ারপোর্টে যেতে বলে এটা করার কোনো মানে হয়? সঙ্গে সঙ্গে আবার বুঝতে পারি, মারুফ ভাইয়ের বাসায় যে থাকার ব্যবস্থাটিও তার জানা ছিলো না। ছোট্টো ছেলেটিকে নিয়ে একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার আশায় রুমের খোঁজ করে সে ভুল কিছু করেনি।

কৈফিয়ত-পর্ব শেষ হলে লোপা খানিকটা সঙ্কুচিত গলায় বলে, এখন একটু আসতে পারবেন? আরো ঘণ্টাচারেক বাকি আমার ফ্লাইটের। ছেলেকে নিয়ে একদম নড়াচড়া করতে পারছি না। বাথরুমে যাবো তারও উপায় নেই।
আমি এক্ষুণি বেরোচ্ছি। আসতে যতোটা সময় লাগে আর কী।

বাসার সামনের রাস্তায় সারাদিন ট্যাক্সি পাওয়া যায়, এখন এই সময়ে আশা করা যায় না। মিনিট তিনেক হেঁটে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। চব্বিশ-ঘণ্টা-খোলা একটা দোকান থেকে নিই বিস্কুট, চিপস আর দুই বোতল পানি। এয়ারপোর্টে এইসময় খাবার-টাবার কিছু পাওয়া যাবে না। হাতে যা সময় আছে, মারুফ ভাইয়ের বাসায় যাওয়ারও প্রশ্ন নেই। খাবারগুলো যদি কাজে লাগে।

এয়ারপোর্টে লোকজন বড়ো একটা নেই। কিছু যাত্রী ব্যাগের ওপর মাথা দিয়ে বেঞ্চে ঘুমিয়ে আছে। কেউ কেউ বসে ঢুলছে। এয়ারপোর্টের কর্মীরা ঝাড়ু– দেওয়া, মোছামুছির কাজে ব্যস্ত। কিন্তু লোপা কোথায়? এ মাথা থেকে ও মাথা দুই চক্কর দিয়েও তাকে কোথাও চোখে পড়ে না। গেলো কোথায়? একটু আগেই না ফোন করে আসতে বললো! সে বাইরে আছে বলছিলো।

আরেক দফা হতাশ। এখন আর দ্রুত হাঁটছি না। ধীরেসুস্থে পায়চারির ভঙ্গিতে হাঁটি, সজাগ সতর্ক চোখে চারদিক দেখি। হাঁটাহাঁটি আর দেখাই সার, ফলাফল শূন্য। আচ্ছা, কী ঘটতে পারে? সম্ভাব্য পরিস্থিতিগুলো ভাবার চেষ্টা করি। বাইরের লাউঞ্জের সঙ্গে ট্রানজিট এলাকাকে হয়তো গুলিয়ে ফেলেছে লোপা। ভেতরে বসে ভাবছে, আমি ওর কাছে পৌঁছে যাবো। অতোটা নির্বোধ হলে একা বাচ্চা নিয়ে কি এতো দূরের যাত্রায় সাহস করার কথা!
এমনও হতে পারে, সিঙ্গাপুরে পরিচিত অন্য কাউকে লোপা ফোন করেছে এবং আমি আসার আগেই তার সঙ্গে চলে গেছে। আমি আসছি জেনেও না জানিয়ে চলে যাওয়ার মতো কাণ্ডজ্ঞানহীন সে? ঢাকায় হলে ছিনতাই বা অপহরণের মতো একটা সম্ভাবনার কথা ভাবা যেতো। এ দেশে তা অবান্তর, প্রায় অসম্ভব। এখানে রাত দুটোর সময়ও মেয়েরা একা দিব্যি নিশ্চিন্তে হেঁটে বাড়ি ফেরে, এই নিশ্চিন্তি আমেরিকাতেও সুলভ নয়।

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ে। যা হয় হোক, আমার কী ভেবে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। ফোনে লোপার গলা খানিকটা অসহায় শোনাচ্ছিলো। সাহায্য প্রার্থনার ভঙ্গিটিও ছিলো নিরুপায়ের। কিন্তু গেলো কোথায় সে? তার হলো কী? ট্রানজিটেই লোপা বসে আছে বলে ধারণা হয়। এয়ারপোর্টের কোনো কর্মীকে অবস্থাটা বুঝিয়ে বলে কি একটা খোঁজ করানো যায়? তেমন কাউকে চোখে পড়ে না।

ভারতীয় দেখতে একজনকে পোশাক-আশাকে এয়ারপোর্ট সিকিউরিটির লোক বলে ধারণা হয়। তাকে বলি, আমার পরিচিতি এক ভদ্রমহিলা আমাকে ফোন করে আসতে বলেছেন। বাইরে তাঁকে কোথাও দেখছি না, আমার ধারণা উনি ট্রানজিটে বসে আছেন। একটু খোঁজ কি করা যায়?

লোকটা বলে, তাতে লাভ কী? থাকলেও এখন ইমিগ্রেশন কাউন্টারে কেউ নেই, মহিলা বাইরে আসতে পারবেন না। তোমারও ভেতরে যাওয়া সম্ভব নয়।

উনি ভেতরে আছেন, এটুকু জানতে পারলেই চলবে।

ভদ্রমহিলা দেখতে কেমন একটু বিবরণ দিলে চেষ্টা করে দেখতে পারি। নাম কী?

নাম লোপা কবির। হালকা-পাতলা, চোখ দুটো বড়ো বড়ো। সঙ্গে সাত-আট মাস বয়সী বাচ্চা।
বিবরণ শুনে লোকটা বলে, ভেতরে এরকম চেহারার একজনকে বাচ্চা কোলে বসে থাকতে দেখেছি বলে মনে পড়ছে। ঠিক আছে, আমি দেখছি।

আধঘণ্টা পরে ফিরে এসে লোকটা দুঃখিত মুখে জানায়, কোথাও খুঁজে পেলাম না। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে, তুমি যেরকম বর্ণনা দিয়েছো রাত দুটোর দিকে সেরকম একজনকে আমি দেখেছি বাচ্চা কোলে। ট্রানজিটে বসে ছিলো। এখন নেই!

হতাশ গলায় বলতে হয়, কী আর করা! আমার জন্যে কষ্টটুকু করার জন্যে ধন্যবাদ।

ক্লান্ত লাগে খুব। একটা খালি চেয়ারে বসি। এখন কী করি? আদৌ করণীয় কিছু আছে?

একসময় দেখি যাত্রীরা বিভিন্ন এয়ারলাইনসের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে গেছে চেক-ইন করার জন্যে। বাইরে তাকিয়ে একটি ঝকঝকে সকাল দেখি। সূর্য উঠি-উঠি। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের চেক-ইন কাউন্টারের কাছে দাঁড়াই। আমার খুব বিশ্বাস হচ্ছে, লোপা পরিচিত অন্য কারো বাসায় ছিলো রাতে। এখন তাকে আসতেই হবে ঢাকার ফ্লাইট ধরার জন্যে। এতোকিছুর পরে শেষ না দেখে ফেরা যায় না। সারিবদ্ধ যাত্রীদের দেখি। আশেপাশে তাকাই। নতুন যাত্রীরা এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে ঢুকছে দেখি। লোপাকে কোথাও দেখি না। উৎকণ্ঠা-ক্লান্তি-বিরক্তি-হতাশা মিলিয়ে এমন অদ্ভুত অবস্থায় জীবনে কখনো পড়েছি বলে মনে পড়ে না।

সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের ঢাকাগামী ফ্লাইট ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা শুনি। প্রতিটা যাত্রী আমার চোখের সামনে দিয়ে গেছে, লোপা তাদের মধ্যে ছিলো না।

ফাঁকা বাসায় ফিরি। সবাই অফিসে বেরিয়ে গেছে। খানিক ঘুমিয়ে নিয়ে আমি দুপুরের দিকে যাবো। ফোনের দিকে তাকিয়ে আচমকা মনে হয়, শেষরাতে সত্যি কি কোনো ফোন এসেছিলো? নাকি স্বপ্ন? হয়তো স্বপ্নের ভেতরে লোপার সঙ্গে কথা বলেছি ফোনে এবং তা সত্যি ধরে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। এরকম হয়, হতে পারে শুনেছি। আমার আগে কখনো হয়নি, আজ হবে কেন? অথচ এয়ারপোর্টে লোপার চিহ্নও কোথাও দেখা গেলো না, তার কী ব্যাখ্যা হয়? সিকিউরিটির লোকটা যে বললো, ওরকম একজনকে বাচ্চা কোলে বসে থাকতে দেখেছে ট্রানজিটে? কোনটা সত্যি?

সন্ধ্যায় বাসার বাকি তিন বাসিন্দাকে জিজ্ঞেস করি শেষরাতে ফোন বেজে ওঠার শব্দ তারা কেউ শুনেছে কি না। কেউ কিছু বলতে পারলো না।

মাস দুয়েক পরে দেশ থেকে নতুন-পুরনো কিছু পত্রিকা এসে পৌঁছেছে। শনিবার দুপুরে শুয়ে শুয়ে সেগুলো দেখছিলাম। অকস্মাৎ চমক লাগে। নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না, বিশ্বাস করতেও ইচ্ছে করে না। ছবি না থাকলে হয়তো চোখ এড়িয়ে যেতো। স্বল্প পরিচিত আয়ত চোখের মেয়েটিকে চিনতে ভুল হয় না। সাপ্তাহিক একটি কাগজে ছবিসহ লোপার মৃত্যুসংবাদ! দেশে যাওয়ার পর পরই কী একটা বিদঘুটে জ্বরে পড়ে। অবস্থা আরো খারাপের দিকে যেতে থাকলে হাসপাতালে নেওয়া হয়, আর ফেরেনি।

এতো তাড়াতাড়ি! অসময়ের মৃত্যু মন খারাপ করে, অপচয় মনে হয়। দীর্ঘ জীবনের পরে একটা বয়সের মৃত্যু তবু হয়তো মানা যায় - সময় হয়েছিলো ধরে নিয়ে সান্ত্বনা খোঁজাও সম্ভব। লোপার জীবনটা বড়ো হ্রস্ব থেকে গেলো! আর তার ছেলে? মাকে সে সারাজীবন চিনবে ছবি দেখে, মায়ের কোনো স্মৃতি তার থাকবে না। কোনো মানে হয়!

লোপার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া আমার বাকি থেকে গেলো। সেই রাতে আসলে কী ঘটেছিলো? সে সত্যিই ফোন করেছিলো শেষরাতে? নাকি আমার কাঁচা ঘুমের স্বপ্ন বা অবচেতন কোনো তাগিদ আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো তার খোঁজে? সারাজীবন এই রহস্য আমি বয়ে বেড়াবো, উত্তর আর কোনোদিন জানা হবে না।

No comments: