১০
বিজু অফিস থেকে ফিরেছে, তখন সন্ধ্যা হয় হয়। রিকশা থেকে নামতে গিয়ে প্যান্টের বাঁ পকেটের কাছে ছিঁড়ে গেছে। খুব প্রিয় ছিলো প্যান্টটা, মাত্র মাসখানেক আগে রানু কিনে দিয়েছিলো এলিফ্যান্ট রোডের একটা দোকান থেকে।
রানু বিছানায় শুয়ে ছিলো, এই অসময়ে তার শুয়ে থাকা স্বাভাবিক নয়, একটু অবাক হয় বিজু। কাছে আসতে রানু পাশ ফিরে শোয়। খুব ক্লান্ত গলায় বলে, তুমি না বলেছিলে সাবধানের মার নেই, নাকি মারের সাবধান নেই!
কেন, কী হয়েছে?
হবে আবার কী? যা হওয়ার তাই হয়েছে।
খুলে বলবে তো! শরীর খারাপ লাগছে?
হ্যাঁ, ব্যাপারটা শরীরের। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। পজিটিভ।
বুঝতে একটু সময় লাগে বিজুর। কিন্তু এই নিয়ে রানুর মন খারাপ হবে কেন? পেটে বাচ্চা আসার ব্যাপারটা নিশ্চিত জানা হলে মেয়েরা খুশি হয় বলে এতোদিন জেনে এসেছে। রানুর প্রতিক্রিয়া কি সবসময় উল্টো হবে সবকিছুতে?
ঝুঁকে পড়ে রানুর কপালে ছোটো করে চুমু দেয়, মুখে হাসি ফুটিয়ে বিজু বলে, ভালো খবর তো। কতোদিন?
ডাক্তার বললো আট সপ্তাহ।
তুমি কিছু বলোনি তো আমাকে!
নিজেই টের পাইনি, শুধু একটু সন্দেহ হচ্ছিলো। আর তোমাকে বলার কী হলো?
বাঃ, তোমার সন্দেহের কথাটাও বলতে পারতে।
মনে আছে, আমরা ঠিক করেছিলাম অন্তত তিন বছর বাচ্চাকাচ্চা নেবো না!
বিজু বলে, মনে থাকবে না কেন! সাবধানই তো ছিলাম আমরা, কী করে যে হলো কে জানে! সে যাই হোক, তোমার খুশি হওয়া উচিত। ভালো খবর তো।
রানু শ্লেষের সঙ্গে বলে, তোমার জন্যে তো ভালোই, পৌরুষের প্রমাণ হয়ে গেলো।
বাচ্চা উৎপাদনে সক্ষম হলে পৌরুষের প্রমাণ হয়? বিজু জানতো না তো!
বলে, রানু, পুরুষমানুষের একার কৃতিত্বে বাচ্চা পৃথিবীতে আসে না। সেই কৃতিত্বের বেশিরভাগই মেয়েদের, সেটা তুমিও জানো।
রানু খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। বিজু জিজ্ঞেস করে, কাউকে বলেছো?
না, ইচ্ছে করেনি। আর এক্ষুণি কাউকে জানাতেও চাই না, বিজু।
কী আশ্চর্য, কেন? এটা কি লুকিয়ে রাখা যাবে? লুকানোর দরকারই বা কী?
কিন্তু এখন নয়, প্লিজ।
বিজুর বিভ্রান্ত লাগে। রানুকে সে বুঝতে পারছে না কেন?
রানু একটু থেমে বলে, জানো, আমার খুব মন খারাপ লাগছে!
মন তোমার খারাপ হয়ে আছে দেখছি, কিন্তু কেন, সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না, রানু।
আমার স্কলারশীপের কী হবে? আমেরিকা যাওয়ার?
এই ঘটনা যে রানুর আমেরিকা যাওয়ার ব্যাপারটাকে নড়বড়ে করে দিতে পারে, বিজুর মাথায় আসেনি। চট করে মনে হয়, এখন যদি রানুর সিদ্ধান্ত পাল্টানো যায়, অন্তত স্থগিত করা গেলেও, মন্দ হয় না।
বিজু বলে, সেটা পরে ভাবা যাবে। তোমার শরীরের চিন্তাটা সবার আগে করা দরকার।
সরাসরি আক্রমণে যায় রানু এবার। বিজুর চোখের দিকে তীব্র চোখে তাকিয়ে বলে, তুমি ইচ্ছে করেই এটা করলে। আমার সঙ্গে শত্রুতা।
অপ্রস্তুত না হয়ে বিজুর উপায় কী? বিন্দুবিসর্গও জানা নেই, এমন জিনিসের জন্যে দোষী সাব্যস্ত করা হলে আর কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে? বিনা দোষে অভিযুক্ত হওয়ার জন্যে ক্রোধ? ভালোবাসার ভুল ব্যাখ্যার জন্যে অভিমান? আক্রান্ত হয়ে পাল্টা আক্রমণের বাসনা?
এক এক করে সবগুলো অনুভূতিই এক মুহূর্ত করে খেলে যায় বিজুর ভেতরে। কোনোটাকেই স্থায়ী হতে দেয় না।
ধীর গলায় বলে, একটা কথা তোমার বিশ্বাস করতে হবে, রানু। আমি তোমার শত্রুপক্ষ নই।
রানু বলে, আমার ভালো তুমি চাও না। সেইজন্যে আমেরিকা যেতেও আপত্তি তোমার। আর কোনোকিছু দিয়ে আমাকে আটকাতে পারবে না বুঝে এখন পেটে বাচ্চা দিয়ে ধরে রাখতে চাও!
১১
বসার ঘরে রানু নেই, রান্নাঘরেও না। কোথায় গেলো? বাথরুমে? তাহলে বিজুকে অপেক্ষা করতে হবে গোসলের জন্যে। মেয়ের ঘরের পাশে ছোটো বাথরুমটাতে যাওয়া যায়, কিন্তু গোসলে বিজুর ব্যবহার্য সবই শোয়ার ঘর-সংলগ্ন বাথরুমে। এই ফাঁকে ইমেল কিছু এসেছে কি না দেখে নিলে মন্দ হয় না।
সতেরোশো বর্গফুটের এই অ্যাপার্টমেন্টে দুটো বেডরুম আর আধখানা স্টাডি, লিভিং রুম, কিচেন, ডাইনিং স্পেস, দুই বাথরুম। স্টাডিটা ঠিক আধখানাই, আট ফুট বাই দশ ফুট জায়গার তিন দিকে দেয়াল, দরজা-জানালার কোনো বালাই নেই। দেয়ালের দু’দিক জুড়ে শেলফ তৈরি করা।
একটা ডেস্কের ওপরে বিজুর কমপিউটার আর তার যন্ত্রানুষঙ্গগুলো পরপর সাজানো। টেবিলে হরেক চেহারা ও আকারের কাগজপত্র - স্তপাকার ও ছড়ানো। খোলা এবং না-খোলা কিছু কাগজমেল চোখে পড়ে বিজুর। কিছুকাল আগেও কাগজ ছাড়া আর কোনোভাবে যে চিঠি লেখা যায়, সে ধারণা মানুষের কল্পনায়ও ছিলো না। ইন্টারনেট আর ইমেলের আগে মানুষ অফিস-টফিসে দ্রুত কাজ করতো কী করে? ভাবা যায়!
সব ইমেল যে কাজের তা-ও নয়। সেদিন একটা বিজনেস জার্নাল পড়ছিলো বিজু। বিশাল কোম্পানির সি ই ও লিখেছে, আমার থেকে মাত্র দশ ফুট দূরে যে লোকটি বসে আছে তাকে আমি ইমেল করতে যাবো কোন দুঃখে? এ তো এক ভয়াবহ অপচয় - সময় এবং সম্পদের। অথচ হাজার হাজার মানুষ এই হাস্যকর কাণ্ডটি দিনের পর দিন করে যাচ্ছে। এর নাম প্রোডাক্টিভিটি, না আর কিছু?
বিজু অবশ্য জানে, দশ ফুট দূরে কেন, এক বিছানায় ঘুমানো দু’জন মানুষেরও কখনো কখনো ইমেল দরকার হতে পারে। বলার কথা যখন মুখ ফুটে বলতে বাধে, শর্টসার্কিটের ফলে যোগাযোগও অগম্য, সেই সময়ে চিঠির চেয়ে ভালো আর কী আছে? একবার টিভিতে কোথায় যেন একটা রেস্টুরেন্টের কথা শুনেছিলো। খুবই অভিনব ধরনের রেস্টুরেন্ট - সেখানে আহার্য বা পানীয় কিছুই নেই, মেনুও নয়। শুধু চেয়ার-টেবিল পাতা আছে, প্লেট-ন্যাপকিনও দেওয়া হবে। সেখানে বসে বসে কথা বলো। শুধু কথা বলার রেস্টুরেন্টের ব্যাপারটা মন্দ নয়। পৃথিবীতে কথা বলার সময় কমেই গেছে ক্রমাগত। এই শহরে এরকম একটা থাকলে খুব কাজে লাগতো বলে বিজুর ধারণা। কিন্তু রানু কি রাজি হতো যেতে?
কমপিউটার খুলে বিজু দেখলো ইনবক্সে অনেকগুলো ইমেল। বেশিরভাগই কাজ-সংশ্লিষ্ট, সাবজেক্ট লাইনে চোখ বুলিয়ে দেখে - ওগুলো কাল দেখলেও চলবে। গোটাতিনেক জাংক মেল। পিত্ত জ্বলে যায়। শালার বেনিয়ার দেশে সবাই শুধু কিছু একটা বেচতে চায়। তোমার দরকার আছে কি নেই, তাতে কী এসে গেলো? সবাই তোমাকে নাকি অবিশ্বাস্য কম দামে জিনিস দিতে চায়! তারপরেও কথা আছে, এখন কিনে রাখো, পয়সা পরে দিও। এক্কেরে খাঁটি জিনিস, খাইয়া দাম দিয়েন স্যার!
কাবুলিওয়ালারা গল্পে-কাহিনীতে কুখ্যাত হয়ে আছে - আসল টাকায় তাদের আগ্রহ কম, সুদের টাকা ঠিকমতো পেলেই খুশি। এ দেশও সেরকমের কাবুলিওয়ালায় ভরা, তারাও আগে সুদের টাকা চায়, আসল পরে দেখা যাবে। এমন নয় যে, আসল দিতে হবে না। দিতে হবেই, কিন্তু এমন ভাবভঙ্গি করা হবে যেন তোমাকে বাকিতে জিনিস দিয়ে তারা নিজেদের ধন্য করছে।
কমপিউটার থেকে উঠে পড়ে বিজু, ফিরে আসে বসার ঘরে। এখনো রানুর দেখা নেই। আশ্চর্য তো! পায়ে পায়ে শোয়ার ঘরের দিকে এগিয়ে যায় সে, ঘর অন্ধকার। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে, বাথরুমেও আলো জ্বলছে না। প্যাসেজের আলোয় দেখা যায়, রানু বিছানায় শোয়া।
ঘুমাতে যাওয়ার সময় সাধারণত রানু কাপড় পাল্টায়। বিছানার কাছে একটু এগিয়ে গিয়ে বিজু দেখে, আজ পাল্টায়নি। দুটো মানে হতে পারে। মন ভালো লাগছে না বলে বা আলসেমিতে ওভাবেই শুয়ে পড়েছে। এমনিতে রানু গায়ে চাদর বা কম্বল কিছু একটা না জড়িয়ে ঘুমাতে পারে না। কম্বলটা পায়ের কাছেই এখনো ভাঁজ করে রাখা। ধারণা হয়, একটু পরেই উঠে পড়বে। কোনো নড়াচড়া নেই, রানু আসলেই ঘুমিয়ে গেছে কি না ঠিক বোঝা যায় না। বাথরুমে ঢুকে গোসল করতে গেলে কিছু শব্দ হবে এবং সেটা শোয়ার ঘরেও পৌঁছাবে নিশ্চিত। রানু যদি সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে গিয়ে থাকে, ঘুম ভেঙেও যেতে পারে। ওর ঘুম খুব পাতলা।
এখানেও প্রতিক্রিয়া দু’রকমের হতে পারে। যেহেতু বিজুর গোসলটা পূর্বনির্ধারিত, ঘুম ভেঙে গেলেও রানু বড়জোর পাশ ফিরে শোবে। কিন্তু আবার বলাও যায় না, আচমকা ঘুম ভেঙে গেলে রানুর মেজাজ বিগড়ে যেতেও পারে এবং বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসামাত্র বিজু একটা চোরাগোপ্তা হামলার শিকার হতে পারে। অতিশয় দক্ষ তীরন্দাজ। হামলাটা মৌখিক, কিন্তু ঠিক কী প্রসঙ্গ দিয়ে শুরুটা হবে অনুমান করা সম্ভব নয় বলে চোরাগোপ্তা কথাটা মনে আসে।
যা হওয়ার হবে ভেবে বাথরুমে ঢোকে বিজু। নিঃশব্দে, প্রায় চোরের মতো। কোনো শব্দ না করে দরজা বন্ধ করে, তারপর বাথরুমের আলো জ্বালে। আগে জ্বাললে আলোটা সরাসরি রানুর চোখ লাগতে পারে। তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, বিজু ভাবতেও চায় না।
গোসল করে সে অনেকক্ষণ ধরে। তারপর শেভ করে সামান্য ছেঁটেছুটে গোঁফের পরিচর্যা করে। রানু গোঁফ পছন্দ করে না। অনেক বলেকয়ে বিয়ের পরে রানু একবার তার গোঁফ উচ্ছেদ করাতে সক্ষম হয়েছিলো অল্প কিছুদিনের জন্যে, তখনও পরস্পরের পছন্দ-অপছন্দের মূল্য দেওয়ার রেওয়াজ ছিলো। এখনও মাঝেমধ্যে কথা ওঠে।
গোঁফের ব্যাপারে আলাদা কোনো মোহ নেই বিজুর। গোঁফের আমি গোঁফের তুমি সমিতিরও একজন সে নয়। কেউ কেউ ওটাকে পৌরুষের চিহ্ন হিসেবে গণ্য করে, বিজুর কাছে হাস্যকর মনে হয়। গোঁফ গজানোর বয়সে প্রথম থেকেই সে কামাতে শুরু করেছিলো। মা বোধহয় লক্ষ্য করছিলো, একদিন বলে ফেলে, মুসলমানের ছেলে গোঁফ কামাস কেন?
লাভ হয়নি, মা বলেছিলো বলেই সে তখন গোঁফ রাখেনি। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেওয়ার পর অনেকটা খেয়ালের বশে কিংবা আলসেমিতে শেভ করা বন্ধ রেখেছিলো। চুলও নেমে যাচ্ছিলো ঘাড় ঢেকে। মাস দুয়েকের মধ্যে বিজুর চেহারা দাঁড়িয়ে যায় যৌবন বয়সের রবীন্দ্রনাথের মতো। তখনো মায়ের আপত্তি, বিজু কানে তোলেনি।
বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার আগে চুল ছেঁটে দাড়ি কামিয়ে ফেলেছিলো গোঁফ বাঁচিয়ে। এখন গোঁফের চাষ চালু রেখেছে প্রতিবাদের ঝাণ্ডার মতো। রানু পছন্দ করে না বলে ছেঁটে ফেলতে হবে, তার কোনো মানে নেই।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে বিজু, খুবই সতর্কতার সঙ্গে, কোনো শব্দ না করে, যেভাবে ঢুকেছিলো। ঘরের আবছা আলোয় দেখে, রানু একই ভঙ্গিতে কাত হয়ে শোয়া। সন্দেহ হয়, সত্যিকারের ঘুম? নাকি শুধুই চোখ মুদে পড়ে থাকা? নাইট স্ট্যান্ডে রাখা ডিজিটাল অ্যালার্ম ঘড়িতে দশটা চল্লিশ। দূর থেকে দেখতে যায়, সকালের জন্যে অ্যালার্ম অন করা হয়নি। করলে নিচের দিকে একটা লাল ফুটকি জ্বলে থাকতো। রানু ভুলে গেছে, যদিও জানা নেই আবার সে উঠে পড়বে কি না। ঘুমাতে যাওয়ার আগে মনে করে অ্যালার্ম দিতে হয়। এতো বছর ধরে ভোরে উঠছে প্রতিদিন, অথচ এখনো অভ্যস্ত হওয়া হলো না। হবেও না মনে হয়। অ্যালার্ম ছাড়া বিজুর ঘুম ভাঙে না।
বসার ঘরে এসে বিজু বেকুবের মতো, ভালো বাংলায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে, দাঁড়িয়ে থাকে খানিকক্ষণ। একসময় রাতে ফুলটুস ঘুমিয়ে গেলে দু’কাপ চা নিয়ে দু’জনে পাশাপাশি বসে গল্পগাছা হতো। সারাদিনের কার্যবিবরণী, বিশেষ বিশেষ ঘটনা, একটা-দুটো চুটকি। পুরনো দিনের কোনো কোনো কথাও উঠে আসতো।
একটা শ্বাস চেপে বিজু ভাবে, সেসব দিন কবেই গত হয়েছে। সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই আর! তবে নিজে চা বানিয়ে নিতে কোনো অসুবিধে নেই। চুলা জ্বালিয়ে কেতলিতে পানি বসায় দু’কাপ আন্দাজে। যদি রানু উঠে আসে! পানি ফোটার পরে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে টি ব্যাগে এক কাপ বানিয়ে নেয়। দুধ-চিনির ঝামেলা নেই, শুধু লিকার।
একবার ভাবে, দুধ-চিনি মিশিয়ে আরেক কাপ বানিয়ে রানুকে ডাকলে কেমন হয়? খুব অবাক হবে নাকি সে? হয়তো হবে না, বিজু আগেও কখনো কখনো নিজে দু’জনের জন্যে চা বানিয়েছে। কিন্তু তখন সময় অন্যরকম ছিলো। তবু আজ ফিরে আসার পর থেকে বেশ অন্যরকম লাগছিলো রানুকে। কিছু ইঙ্গিতও কি ছিলো না? 'পরণে ঢাকাই শাড়ি...'!
বস্টন থেকে আনা আধখানা কাপ পেয়েও খুশি মনে হয়েছিলো। হাফ আ কাপ! বিজুর আচমকা মনে হয়, আধাআধি! সম্পূর্ণ আর নেই!
এখন চা বানিয়ে রানুকে ডেকে তোলার ইচ্ছে যেমন আছে, শংকাও ততোখানি। অসময়ে কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্যে যদি রেগে উঠে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়? এই রাতদুপুরে তার কোনো দরকার নেই।
১২
বিজু খুলনা গিয়েছিলো কাল, ফিরেছে সন্ধ্যায়। বেড়াতে নয়, অফিসের কাজ নিয়ে যাওয়া। সুতরাং একাই। বাসায় ফিরে ওপরে নিজের ঘরে যাওয়ার আগে রান্নাঘরে উঁকি দেয়, রানু আছে কি না দেখে। নেই, মা ছিলো। বাবা খাওয়ার টেবিলে, সামনে চায়ের কাপ আর সকালের বাসি খবরের কাগজ। সকালে অফিসে যাওয়ার তাড়ায় বাবার কাগজ পড়া হয় না, পড়ে বিকেলে ফিরে এসে চা খেতে খেতে।
মা বলে, কী রে, এই এখন ফিরলি?
হ্যাঁ।
ঘরে গিয়ে দেখ তো, রানুর বোধহয় শরীর-টরীর খারাপ। সেই দুপুর থেকে শুয়ে আছে, ঘুমাচ্ছে। দুপুরে খেলোও না কিছু। বারকয়েক ডাকাডাকি করেছি, তাও এলো না। শুধু বলে, মাথা ধরে আছে। পরে খাবো, এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।
সিঁড়ি ভেঙে ওপরে যায় বিজু। অন্ধকার ঘরে আবছামতো দেখা যায়, রানু ডানদিকে কাত হয়ে শোয়া। একটা পাতলা কম্বল কোমর পর্যন্ত টেনে দেওয়া। পা টিপে টিপে বিছানার পাশে দাঁড়ায় বিজু। নিশ্বাসের শব্দে বোঝা যায়, গাঢ় ঘুম ঘুমাচ্ছে রানু। গায়ে হাত দিয়ে দেখবে ভেবেও দেয় না, অযথা ঘুম ভাঙানোর দরকার নেই।
কাপড়চোপড় ছেড়ে একবারে গোসল সেরে নেয়। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে রানু একইভাবে ঘুমাচ্ছে। ওর ঘুম এতো গাঢ় নয়, বাথরুমে পানির শব্দে জেগে ওঠার কথা। বিজু সাবধানে কম্বলের তলায় ঢুকে পড়ে। এখন আর দ্বিধা না করে রানুর কপালে হাত রাখে। নাঃ, জ্বরটর নয়। তাহলে কী? শুধু মাথাব্যথায় এরকম কখনো হয়নি রানুর।
গর্ভাবস্থার কোনো বিশেষ সমস্যা কি না, ঠিক বুঝতে পারে না বিজু। মাকে বা অভিজ্ঞ অন্য কারো কাছে কিছু জিজ্ঞেস করারও উপায় নেই। রানু এখনো কাউকে জানাতে চায় না। তর্ক করার কিছু নেই, সময় হলে রানু নিজেই জানাবে বলেছে। এখানে বিজু শুধুই সহযোগী, মূল ভূমিকায় তো রানু। সুতরাং তার সিদ্ধান্তের জন্যে অপেক্ষা করা উচিত।
রানু ক্ষীণ গলায় বলে, কখন ফিরলে?
এই তো একটু আগে। কী হয়েছে তোমার?
কিছু না, শরীর ভালো লাগছে না।
তোমার এমন গাঢ় ঘুম কখনো দেখিনি, তাই দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো। মা বললো, সারাদিন তুমি কিছু খাওনি।
কিছু চিন্তা কোরো না। তুমি বরং যাও, খেয়ে নাও।
এখন তো মোটে সন্ধ্যা হলো, পরে তোমার সঙ্গে খাবো।
তাহলে অন্তত চা খেয়ে নাও। এই সময় তোমার চা খাওয়ার অভ্যাস।
তুমিও চলো।
মাথাটা এমন ভারী হয়ে আছে! আমি আরেকটু শুয়ে থাকি?
রানুর শরীর খারাপ তার শরীরের ভেতরের নতুন প্রাণীটির কারণে কি না, মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হচ্ছিলো বিজুর। সেদিনের অভিযোগের পরে এই বিষয়ে কথা বলা আরো দুরূহ হয়ে গেছে। বিজু জানে, এই সময়ে মেয়েদের মানসিক চাপমুক্ত থাকা দরকার, যতোটা সম্ভব। কিন্তু আমেরিকার চাপ থেকে রানুকে বের করে আনার সাধ্য তার নেই, সে বুঝে গেছে।
বিজু বলে, তাহলে এখানেই দু'কাপ চা দিয়ে যেতে বলি? চা খেলে তোমারও একটু চাঙ্গা লাগতে পারে।
মৃদু অথচ দৃঢ় গলায় স্থির সিদ্ধান্ত জানায় রানু, আমি এখন চা খাবো না। ইচ্ছে করছে না।
বিজু কথা বাড়ায় না। সমস্যাটা কোথায় বোঝা যাচ্ছে না। আসলে শরীর খারাপ, নাকি বাসায় কারো সঙ্গে কিছু হয়েছে?
কয়েক মিনিট চুপচাপ শুয়ে থাকে সে রানুর পাশে। সদ্য বিবাহিতদের মধ্যে শরীরের যে তীব্র ও অবাধ আকর্ষণ থাকার কথা, এই কয়েক মাসে রানুর দিক থেকে তা হয়ে এসেছে নিয়ন্ত্রিত, অনেকটা অনিচ্ছাপ্রসূত অংশগ্রহণের মতো। এরকম হওয়ার কথা ছিলো না, শুরুতে ব্যাপারটা ছিলো যেমন হওয়া স্বাভাবিক - উন্মোচন ও আবিষ্কারের উন্মাদনা যেন শেষ হওয়ার নয়। বিজুর ধারণা, এই অবস্থাটা পাল্টে দিয়েছে আমেরিকা। রাষ্ট্র হিসেবে অবশ্য নয়, আমেরিকা নামের ধুন তাদের দাম্পত্যের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, তছনছ করে দিচ্ছে সব। রচিত হয়ে যাচ্ছে ব্যবধান।
বিজু অবশ্য এই ব্যাপারটাকে সাময়িক বলে মনে করে। একসময় ভালোবাসাই আবার সব ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। 'লাভ উইল কংকার অল।'
উঠে পড়ে বিজু, নিচে নেমে আসে। রান্নাঘরে ঢুকে বলে, মা চা খাবো।
মা বলে, টেবিলে যা, দিচ্ছি। রানু কি এখনো ঘুমাচ্ছে? কী দেখলি, শরীর খারাপ?
এখন মাকে কী বলে বিজু! আগে ভাবা উচিত ছিলো এই প্রশ্নটার সামনে পড়তে হবে। তাহলে নিচে নামতো না সে এখন।
টেবিলে এখন বাবা নেই, নামাজ পড়তে পাড়ার মসজিদে গেছে মনে হয়। বাসি খবরের কাগজটা টেনে নিতে নিতে বলে, মনে হয়। খুব গভীর ঘুম, জাগাইনি। গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম, জ্বরটর কিছু তো মনে হলো না।
মাথাব্যথার কথা বলছিলো। এরকম কখনো হয়নি, কিছু না হলেই ভালো।
রাতে খাওয়ার সময় মা গিয়ে ডাকাডাকি করে এলো, রানু উঠলো না। শুতে গিয়ে ঘরে ঢুকে বিজু টের পায়, রানু জেগে আছে। বলে, তুমি সারাদিন কিছু খেলে না, তোমার জন্যে খাবার এখানে দিতে বলবো?
নাঃ। রানু সংক্ষেপে জবাব দেয়।
বিজু বিছানায় এসে বসলে রানু জিজ্ঞেস করে, তুমি খেয়েছো?
হ্যাঁ।
সিগারেট খেলে না?
রানুর শরীরে ভ্রণসঞ্চারের খবর জানার পর থেকে তার আশেপাশে ধূমপান বন্ধ করে দিয়েছে বিজু। এ ঘরে একেবারেই খায় না। রানুও তা জানে। আজকাল খুব শোনা যায় সিগারেটের পরোক্ষ ধোঁয়ায় পেটের বাচ্চাদেরও ক্ষতি হতে পারে। সতর্ক হতেই হয়। নিজের বাচ্চা না? বিজু বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
মাথার নিচে বালিশটা ঠিক করে নিতে নিতে বলে, বাইরে খেয়ে এসেছি।
এখানেই খেতে পারতে।
রানুর কথায় কিসের সংকেত? বুঝতে না পেরে বলে, এ ঘরে আজকাল খাই না, তা তুমি জানো।
এখন থেকে আবার খেতে পারবে।
কী বলছো, বুঝতে পারছি না।
রানু খুব শান্ত গলায় বলে, যার জন্যে তোমার এতো সাবধান হওয়া, সে আর নেই।
চমকে ওঠে বিজু। বিছানায় উঠে বসেছে সে। বলে, কী হয়েছে, রানু? কী বলছো?
ওটাকে বিদায় করে এসেছি।
অকস্মাৎ ভূমিকম্পে বাড়িটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লেও হয়তো এতোটা বিস্ময় বোধ হতো না। নিজের ইচ্ছায় রানু এটা করেছে, বিশ্বাস হয় না। পারলো কী করে? তেমন ইচ্ছের কোনো আভাসও ছিলো না। কেন এমন কাণ্ড করে বসলো রানু? বিজুরও সেখানে কিছু অংশীদারিত্ব ছিলো, একবার তার সঙ্গে কথা বলারও দরকার মনে করলো না? বললে কী হতো? সে সম্মতি দিতো? নিশ্চয়ই নয় এবং রানু তা খুব ভালোই জানে। সুতরাং, পরামর্শ না করার একটা যুক্তি পাওয়া যায়।
কিন্তু এই আজগুবি, উদ্ভট ও অর্বাচীন সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা কী হয়? হয় না, কোনো ব্যাখ্যা হয় না। বিজু উদভ্রান্ত বোধ করে। এমন নয় যে ওই শিশুটির জন্যে তার কোনো রকমের অনুভূতি বা বোধ তৈরি হয়েছিলো। সে শুধুমাত্র একটা অশরীরী ধারণার মতো ছিলো, একটা অস্ফুট বোধ বা প্রাণের ধারণা, আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠার কথা তার। তাদের মিলিত ইচ্ছের প্রতিনিধি ছিলো সে।
ছিলো কি? তাহলে এখন আর নেই কেন? রানু কী করে পারলো তাকে নিজের শরীর থেকে এমন মমতাহীনের মতো বিচ্ছিন্ন ও বহিষ্কার করতে? আমাকে তুমি কেন বিয়ে করলে-র মতো এই প্রশ্নও কি অমীমাংসিত থেকে যাবে?
কেন করলে, রানু? নিজের গলার স্বরই বিজু যেন চিনতে পারে না।
অন্ধকার ঘরে কেউ কারো মুখ দেখতে পায় না। এই মুহূর্তে হয়তো চায়ও না।
রানু বলে, তুমি জানো আমি এখন বাচ্চা চাইনি।
তাই বলে তাকে মেরে ফেলতে হবে? বিজুর গলায় সামান্য ঝাঁঝ মেশানো।
বাচ্চা তোমার একার নয়, আমারও ছিলো, তাই না? বাধ্য হয়ে করতে হলো।
বিজুর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, কীসে তোমাকে বাধ্য হতে হলো, রানু? কী এমন হয়েছিলো? আমার ওপরে রাগ? ঘৃণা? অভিমান? বলে না, চুপ করে রানুর ব্যাখ্যা শোনার জন্যে অপেক্ষা করে।
আদালতে বিবাদীপক্ষের উকিলের মতো করে রানু বলে, বাধ্য হওয়ার কারণ আমার এবং তোমার ভবিষ্যত। বাচ্চা নিতে গেলে আমার এতো কষ্টে পাওয়া স্কলারশীপ ছেড়ে দিতে হয়। ভেবে দেখলাম, আমেরিকা যাওয়ার পরে বাচ্চা হলেও আমার পড়াশোনা করা আর হতো না। বাচ্চা আমরা পরেও নিতে পারবো, যখন চাইবো তখনই। আমেরিকার এই সুযোগ বার বার আসবে না, বিজু। জানি তুমি আমাকে খুব নিষ্ঠুর ভাববে, স্বার্থপর ভাববে। কিন্তু এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারতো?
বিজুর বলতে ইচ্ছে হয়, সবচেয়ে ভালো হতো বাচ্চাটাকে জন্মাতে দিলে! কী হবে বলে? অসহায়ের মতো বালিশে মাথা এলিয়ে দেয়, চিত হয়ে শুয়ে থাকে সে। দেসারুতে সমুদ্রের ধারে বসে এক সন্ধ্যায় ছেলেমেয়ে, ভবিষ্যত এসব নিয়ে কথা হয়েছিলো। রানু প্রথম ছেলে চায়, বিজু মেয়ে। ঠিক হয়েছিলো, ছেলে হলে নাম হবে তাতাই, মেয়ে হলে টুপুর।
বিজুর মনে হয়, যে চলে গেলো সে কে ছিলো? তাতাই? না টুপুর? জানা হলো না! হবে না কোনোদিন।
সেই রাতে বিজু কেঁদেছিলো। বোধবুদ্ধি হওয়ার পর এমন কান্না সে কাঁদেনি কোনোদিন। পূর্ণবয়স্ক পুরুষমানুষের কান্না আসে, যখন তা হয় অপ্রতিরোধ্য ও অনিবার্য। যখন সে নিজেকে অসহায়, নিরুপায় দেখে। পরাজিত দেখে।
বিজুর কান্না সংক্রমিত হয়েছিলো রানুর মধ্যেও। বিজুর প্রতিক্রিয়া ঠিক এরকম হবে, সে হয়তো আশা করেনি। হয়তো তার মনে হয়েছিলো, বড়োজোর রাগারাগি করবে, অভিমান করে থাকবে কয়েকদিন। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে একসময়। কিন্তু ছেলেমানুষের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠবে বিজু, সেটা খুবই অপ্রত্যাশিত ছিলো। বিজুর প্রতিক্রিয়ায় সে নিজেকে হয়তো প্রথমবারের মতো অপরাধী বোধ করে। মনে হতে থাকে, ঠিক হয়নি, মোটেই ঠিক হয়নি। ততোক্ষণে বড়ো দেরি হয়ে গেছে, কিছু করার নেই আর।
নিদ্রাহীন একটি দুঃসহ রাতও একসময় ভোর হয়। অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে-বসে অস্থিরতায় রাত কাটে। বিজু শুধু একবার বলেছিলো, তুমি কী করে পারলে, রানু? আর কোনো কথা কেউ বলেনি। বলার কিছু ছিলো না।
রানুর কাছেও প্রশ্নের কোনো উত্তর ছিলো না!
১৩
চায়ের কাপ আর সিগারেটের প্যাকেট হাতে বারান্দা ওরফে প্যাটিওতে যায় বিজু। চায়ে একটা চুমুক দিয়ে চেয়ারে বসে। সিগারেট ধরিয়ে মনে পড়ে, অনেকদিন মা-র কোনো খবর নেওয়া হয় না। একটা ফোন করা দরকার। সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ঝুলিয়ে রেখে ভেতরে যায়। কর্ডলেস ফোন নিয়ে ফিরে আসে বারান্দায়। একবার ডায়াল করেই লাইন পাওয়া গেলো।
বারো বছর আগে যখন এসেছিলো, সেই সময় বাংলাদেশে ফোনে লাইন পেতে কখনো কখনো একবেলা লেগে যেতো। আজকাল সহজে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে ডিজিটাল ফোনের যুগ শুরু হওয়ার পর আরো সহজ হয়ে গেছে।
মা, আমি বিজু। কেমন আছো তুমি?
আছি বাবা, এই বয়সে যেমন থাকা যায়। টুকিটাকি এটা-ওটা গোলমাল লেগেই আছে। তা থাক, তোদের খবর বল।
আমরা ভালো আছি।
আমার ফুলটুস বোনটা কোথায় রে?
ঘুমিয়ে গেছে।
ও হ্যাঁ, তোদের ওখানে তো রাত এখন। ক’টা বাজে এখন?
এগারোটার কাছাকাছি। তা তোমার টুকিটাকি গোলমালের কথা কি বলছিলে?
ওই হাতে-পায়ে আর কোমরে একটু ব্যথা হচ্ছে ক’দিন ধরে।
ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে?
এই নিয়ে কেউ ডাক্তারের কাছে যায়? ডাক্তার কী করবে? একগাদা ওষুধ লিখে দেবে, এই তো।
বাংলাদেশের বয়স্ক মানুষদের প্রায় সবাই বিষম রকমের চিকিৎসাবিমুখ। কেন, বোঝা যায় না। বিজুর ধারণা, এই অসুস্থতা বয়ে বেড়ানোর প্রবণতাও এক ধরনের রোগ। এ রোগের চিকিৎসা জানা নেই। বাবা এরকম ছিলো। রানুর বাবা-মাও তাই। এ জীবনে দেশে যতো বয়স্ক মানুষ দেখেছে, এমন কারো কথা বিজু মনে করতে পারে না যে এক কথায় কখনো ডাক্তারের কাছে গেছে। অথচ এ দেশে যে কোনো বয়সী মানুষ সামান্য সর্দি হলেও ডাক্তারের কাছে দৌড়ায়, সুস্থ থাকা এদের কাছে অনেক বেশি জরুরি।
বিজু বলে, তবু তোমার দেখানো দরকার।
আচ্ছা সে দেখা যাবে। আমার রানু মা কেমন আছে? কোথায় সে?
ঘুমিয়ে পড়েছে, বোধহয় শরীরটা ভালো নেই।
বোধহয় আবার কী রে? তুই জানিস না?
অফিসের কাজে আমি বস্টনে গিয়েছিলাম তিনদিনের জন্যে। সন্ধ্যায় ফিরেছি। খাওয়া দাওয়ার পর দেখি হঠাৎ শুয়ে পড়েছে।
তুই কিছু বলিসনি তো?
রানুর সঙ্গে মনোমালিন্য বা মতান্তরের বিষয়ে বিজু মা-র কাছে কোনোদিন বলেনি। শুধু মা কেন, কাউকেই নয়। এসব তাদের দু’জনের শুধু, আর কারো সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। কারো কিছু বলার থাকতে পারে না, করারও নয়।
বিজু হালকা গলায় বলে, বা রে, আমি আবার কী বলবো?
আমার রানু মা খুব লক্ষ্মী মেয়ে, তাকে একদম কষ্ট দিবি না। তোরা বিদেশে পড়ে আছিস, কাছাকাছি নিজের মানুষ তেমন কেউ নেই।
বিজু হাসতে হাসতে বলে, কী আশ্চর্য, ওর তো তবু কাছাকাছি একটা বোন আছে। আমার তা-ও নেই। তুমিও ওর দলে গেলে আমি যাই কোথায়?
মা বলে, মেয়েদের কষ্ট তোরা বুঝবি না!
তর্ক করে লাভ নেই। রানু কী মন্ত্রপড়া দিয়েছে কে জানে, তার ব্যাপারে একেবারে অন্ধ মা। বিজু অবশ্য ব্যাপারটা উপভোগ করে। ছেলের বউয়ের জন্যে শাশুড়ির এমন টান দেখা যায় না। মা-র স্বভাবই এরকম। বড়ো ভাইয়ের বউয়ের বেলায়ও তাই। বিয়ের পর পর রানু একদিন বলেছিলো, শাশুড়ির সঙ্গে কোমর বেঁধে ঝগড়া করবো, আপনার ছেলের কাছে ইনিয়ে-বিনিয়ে নালিশ করবো, বাপের বাড়ি গিয়ে শাশুড়ির নামে এক বস্তা নিন্দামন্দ করে আসবো - আপনি তো মা সে সুযোগ দিচ্ছেন না!
মা হেসে ফেলেছিলো, কারণটা কী জানিস? আমার যে মেয়ে নেই, তোরা দু’জনই এখন আমার মেয়ে। নিজের মেয়ে থাকলে কীরকম হতো তা অবশ্য জানি না।
বিজুর মনে হয়েছিলো, ভেবে দেখার মতো বিষয় বটে। গবেষণা হতে পারে।
আরো মামুলি কিছু কথা বলার পরে ফোন রেখে দিয়ে চা শেষ করে বিজু। সিগারেট ধরায় আবার। রানু তাহলে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে?
‘স্মোকড দ্য ডে’জ লাস্ট সিগারেট রিমেম্বারিং হোয়াট শী সেড...।’
শেষ কথা রানু কী বলেছিলো আজ সন্ধ্যায়? বলছিলো, কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের সম্পর্ক। ঠিকই তো, এ কোথায় এসে পড়লাম আমরা? এখানে এসে পৌঁছানো একদিনে হয়নি। ভুল বা দোষ খুঁজতে যাওয়া বৃথা। এক সময়ের নাব্য নদীতে এখন বিষণ্ণতার পলি। উদ্ধার কীসে? বিজুর মনে হয়, উদ্ধার হয়তো এখনো অসম্ভব নয়।
১৪
নিজেদের একার সংসার শুরু হয়েছিলো আমেরিকা আসার পরে। ইস্কাটনের বাসায় যা ছিলো তাকে দাম্পত্যের শুরু বলা যায়, সংসারের নয়। ওটা মায়ের সংসার। বাইরের সব কর্তৃত্ব বাবার। ওখানে একদিনের জন্যে বাজারও করতে হয়নি বিজুকে, রানুকেও এক কাপ চা বানিয়ে খেতে হয়নি কখনো।
ঢাকা এয়ারপোর্টে তাদের বিদায় দেওয়ার লোকের অভাব হয়নি। রানুর বাবা দু’জনকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, মনে রেখো তোমরা কিন্তু যাচ্ছো ফিরে আসার জন্যে। জানি, যারা যায় তাদের অনেকেই আর ফেরে না। তোমরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নেবে, কিন্তু একশোবার জিজ্ঞেস করলে আমি একশোবারই তোমাদের ফিরে আসতে বলবো।
নিউ ইয়র্কের জে এফ কে-তে ওদের রিসিভ করার জন্যে কেউ ছিলো না। কাগজপত্র সব ঠিকঠাক ছিলো, ইমিগ্রেশনে কোনো ঝামেলা হয়নি। ব্যাগেজ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে চেনা কোনো মুখ দেখতে না পেয়ে ভারি অসহায় একটা অনিশ্চয়তার বোধ তৈরি হয়। এই অপরিচিত জায়গায় কোনো একটা চেনা মুখ না দেখলে তা হতেই পারে। কী করিলে কী হয় জাতীয় সংস্কারে বিজুর বিশ্বাস নেই, কিন্তু এই সময়টাকে চট করে খুব প্রতীকী বলে মনে হয়।
সম্পূর্ণ নতুন এক দেশে পৌঁছে যে সংবর্ধনার মুখোমুখি হতে হলো, তার ভেতরে কি কোনো সংকেত আছে? ‘এলেম নতুন দেশে / তলায় গেল ভগ্নতরী কুলে এলেম ভেসে।’ ভগ্নতরী তলিয়েছে ঠিকই, এখানে যে কেউ তোমার জন্যে অপেক্ষা করেও নেই! তোমাকে কেউ কি চায়! রানুর মুখের দিকে তাকায় বিজু, সেখানেও উদ্বেগ ছাড়া আর কিছু লেখা নেই।
রানুর দূর সম্পর্কের এক মামার এয়ারপোর্টে আসার কথা। ফ্লাইটের বৃত্তান্ত যথাসময়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো, অথচ এখন তার দেখা নেই। হয়তো কোথাও আটকে গেছে, এসে পড়বে ভেবে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত জানায় রানু। ঘণ্টাখানেক পরেও কোনোকিছু বদলায় না, কোনো চেনা মুখ দেখা দিয়ে বলে না, স্যরি, আমার একটু দেরি হয়ে গেলো।
দেখেশুনে এয়ারপোর্টের কর্মী মনে হয় এরকম একজনকে জিজ্ঞেস করে বিজু জেনে নেয় ট্যাক্সি কোথায় পাওয়া যাবে। আর যাই হোক, এয়াপোর্টে তো আর থানা গাড়া যাবে না, কোথাও পৌঁছাতে হবে এবং সেজন্যে ট্যাক্সি ছাড়া গতি নেই এখন। বাস চলাচল দেখা যায়, কিন্তু কোন বাস কোথায় যায় কে জানে!
দু’জনে মালপত্র টেনে নিয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে আসে। মানুষজন, গাড়িটাড়ি সব মিলিয়ে জায়গাটাকে ঢাকার গুলিস্তানের চেয়ে কম কিছু মনে হয় না বিজুর। শুধু রিকশা নেই, এই যা। সিগারেট খাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে আছে সেই কখন থেকে, কিন্তু এয়ারপোর্টের ভেতরে সর্বত্র নো স্মোকিং লেখা দেখেছে। এখানে বাইরে অনেকের হাতে সিগারেট দেখে সাহস করে ধরিয়ে ফেলে একটা। রানু তার ব্যাগ থেকে মামুজানের ঠিকানা লেখা কাগজটা খুঁজে বের করে।
ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে একটা বেঁটেমতো মোটাসোটা লোক ট্যাক্সির খবরদারি করছিলো। বিজু পায়ে পায়ে এগিয়ে তার কাছে ঠিকানা লেখা কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে বলে, এই ঠিকানায় যেতে চাই আমরা।
সাদা চামড়ার লোকটা হাসি হাসি মুখ করে বলে, এ দেশে এই প্রথম?
বিজু হ্যাঁ বললে সে বলে, দেখলেই ঠিক বুঝতে পারি। হাতের ইশারায় একটা ট্যাক্সি দেখিয়ে ওদের উঠে পড়তে বলে সে। ঠিকানার কাগজ ফিরিয়ে দিয়ে বলে, ড্রাইভারকে দিলেই সে ঠিক জায়গামতো পৌঁছে দেবে।
ট্যাক্সির ভেতরে বসতেই, কী আশ্চর্য, ড্রাইভার পরিষ্কার বাংলা ভাষায় বলে, ঢাকাত্থিক্যা আইলেন?
বিজুর ঠিকই মনে হয়েছিলো, এ জায়গাটা সত্যি গুলিস্তানের মোড়। ভিনদেশের প্রথম ট্যাক্সিতে বাঙালি ড্রাইভার, তা বোধহয় শুধু নিউ ইয়র্কে সম্ভব।
বিজু জিজ্ঞেস করে, কেমন করে বুঝলেন আমরা ঢাকা থেকে আসছি?
আপনাগো দেইখ্যাই বুজছি। কতা কইতেও তো হোনলাম।
ঠিকানা খুঁজে বারোতলা পুরনো একটা দালানের সামনে গাড়ি থামায় ড্রাইভার। বলে দেয়, ভেতরে গিয়ে লিফটে সাততলায় উঠে অ্যাপার্টমেন্ট নাম্বারটা খুঁজে নিতে হবে। দরজার ওপরে লেখা থাকবে নাম্বার।
দরজা খুলে দেয় একজন মধ্যবয়স্ক লোক। লুঙ্গিপরা, খালি গা। ভেতরে ঢুকে রানু বলে, মামা আপনার না এয়ারপোর্টে যাওয়ার কথা?
এই তাহলে মামা! মামা বলে, আর বোলো না...
বলার দরকার ছিলো না। বিজু পুরনো এক বন্ধুর ফোন নাম্বার জোগাড় করে এনেছিলো, সে ডালাসে থাকে বছর তিনেক। ফোনে বিজুর সব বৃত্তান্ত শুনে বললো, চলে আয়। এখানে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
দু’দিন পরে ডালাস। বন্ধুর সঙ্গে গিয়ে ইউনিভার্সিটিতে রানুর রেজিস্ট্রেশন, ক্যাম্পাসের ঠিক বাইরে এক বেডরুমের একটা অ্যাপার্টমেন্ট ঠিক করা, পুরনো ফার্নিচারের দোকান থেকে ঘরের জন্যে সামান্য কিছু ফার্নিচার, চাদর-বালিশ, বাসনকোসন কেনা হয়। ডালাসে আসার দিন সাতেকের মধ্যে শুরু হয়েছিলো তাদের সংসার। মাকড়সার জাল বোনার মতো বোনা হতে থাকে দিনযাপন, সংসার। একেকটা প্রয়োজনের লেজ ধরে দু’ঘর বুনে দেখা যায় আরো দুটো দরকার উঁকি দিতে শুরু করেছে। এই তাহলে সংসার। দেশে থাকতে বোঝা যায়নি, অনেককিছু হাতের কাছে তৈরি ছিলো। এখানে একেবারে শূন্য থেকে শুরু বলে প্রতিটি আঁচড় টের পাওয়া যায়।
এ শহরে ট্রেন নেই, বাস যা আছে তা-ও না থাকার মতো। চলাফেরা সীমিত হয়ে ছিলো, বাসা ক্যাম্পাস ঘেঁষে হলেও রানুর পক্ষে হেঁটে ক্লাসে আসা-যাওয়া প্রায় অসম্ভব। বন্ধু নিজে অথবা তার বউ রানুকে ক্লাসে নামিয়ে দেয়, তুলে নিয়ে আসে। হাটবাজার করার দরকার হলেও ওদের বলতে হয় গাড়িতে নিয়ে যেতে। নাহলে সামান্য রুটি বা সিগারেট কিনতেও মাইলখানেক হাঁটো। পরান্মুখ হয়ে আর কতো থাকা যায়!
গাড়ি কেনা হলো। পুরনো। বিজু গাড়ি চালাতে শিখেছিলো দেশে থাকতে খানিকটা শখের বশে, বাবার অফিসের গাড়ির ড্রাইভার শিখিয়েছিলো আগ্রহ করে। লাইসেন্স পেতে অসুবিধা হয় না। এখন বিজু রানুকে ক্লাসে আনা-নেওয়া করতে পারে। গাড়ি কিনতে হাতের টাকাপয়সায় টান পড়ে। দেশ থেকে আনা টাকায় আর বড়োজোর মাস দু’তিনেক চলতে পারে।
রানুর স্কলারশীপের টাকার পরিমাণ প্রথমে অনেক মনে হলেও এখন বোঝা যায়, দু’জনের সংসার চালানোর জন্যে খুব একটা কিছু নয়। মোটামুটি চালানো হয়তো সম্ভব ছিলো যদি না নতুন পাতা সংসারে আজ এটা কাল ওটার দরকার হতো। সংসারে যে এতোকিছু লাগে, আগে কে জানতো!
রোজগারের ধান্দায় বিজুকে নেমে পড়তে হয়। বুয়েট পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার বলে এখানে কেউ পাত্তা দেবে না তাকে, বুঝে ফেলতে সময় লাগে না। আর সে ধরনের কাজকর্ম খোঁজার কৌশল তার জানতে-বুঝতে সময় লাগবে আরো।
ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্টের কাজ সবচেয়ে সহজলভ্য, যার জন্যে বুয়েটের বিদ্যা তুলে রাখতে হয়। ফ্রিজার থেকে বের করা বরফ-জমাট মাংসের প্যাটি গ্রিলে ভেজে মেয়োনেজ-মাস্টার্ড-লেটুস-টমেটো-চীজ দিয়ে বারগার বানানো, টগবগে গরম তেলে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
কাজে ঢুকে আরেক নতুন ঝামেলা, তার কাজ আর রানুর ক্লাসের সময় মেলে না। কয়েকমাস পয়সা জমিয়ে আরেকটা গাড়ি। তারপর রানুকে ড্রাইভিং শেখাও, লাইসেন্স করাতে নিয়ে যাও। ক্রমে রানু নিজে ক্লাসে যাওয়া-আসা করতেও শেখে।
একটা-দুটো করে ঘরের ফার্নিচার বাড়ে, পুরনোর বদলে নতুন আসতে থাকে। ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে আর সব জিনিসপত্র। কিছু শখের, কিছু প্রয়োজনের। প্রয়োজন তৈরি করতে মনুষ্য প্রজাতির তুলনা হয় না। আরো প্রতিভাবান এ দেশের বিজ্ঞাপনের মানুষগুলো। কী করে যে কোনো তুচ্ছ জিনিসকেও যে তারা দরকারি জিনিস ভাবিয়ে ছাড়ে! টিভির বিজ্ঞাপন দেখলে মনে হবে, এই জিনিস এক্ষুণি না হলে চলছে না। কেনা আর শেষ হয় না, শুধু কিনে যাও। আরো কিনতে আরো পয়সা চাই, সুতরাং রোজগার বাড়াও। রানুর ক্লাসে যাতায়াতের চিন্তা নেই, সুতরাং আরেকটা কাজ নিয়ে ফেলো। বিজুর দ্বিতীয় কাজের ব্যবস্থাও হয়ে যায়, গ্যাস স্টেশনে। বাইরে গাড়ির গ্যাসোলিনের পাম্প, ভেতরে ক্যান্ডি-সিগারেট-কোক-কফিসহ রাজ্যের জিনিসপত্রের পসরা। চব্বিশ ঘণ্টা খোলা কনভেনিয়েন্স স্টোর। বিজুর কাজ রাত দশটা থেকে সকাল ছ’টা। রাতে খদ্দের কম থাকে, ব্যস্ততাও কম। কবরখানার স্তব্ধতা বা স্থবিরতা ঠিক নেই, তবু এর নাম গ্রেভইয়ার্ড শিফট।
বসে থাকার জো নেই, কাজের ফর্দ করে দেওয়া আছে - ভেতরের এবং বাইরের সবকিছু ঝকঝকে তকতকে করে রাখতে হবে, সবগুলো গারবেজ ক্যান খালি করে গারবেজ ফেলো, শেলফের জিনিসপত্রগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে রাখো, বাথরুম পরিষ্কার করো।
রাতজাগা কোনো সমস্যা নয়, শারীরিক পরিশ্রমও না, তবু এক ধরনের গ্লানিতে মন ভরে যায় এই কাজ করতে। ঝাড়পোঁছ করতে করতে বিজুর মনে হয়, আমি এখানে কেন, কী করছি? বাথরুমের কমোড-ফ্লোর পরিষ্কার করার সময় কান্না পেয়ে যায়। এই কাজের জন্যে সে পৃথিবীতে এসেছিলো!
দুটো কাজ নিয়ে টাকাপয়সার সংকট কাটে। কিন্তু রানুর সঙ্গে দেখা হয় কখন? বিজুর দিন শুরু হয় রাতের কাজ থেকে ফিরে, তখন রানু তৈরি হচ্ছে ক্লাসে যাওয়ার জন্যে। ঘণ্টাতিনেক ঘুমিয়ে নিয়ে ফাস্ট ফুডের কাজে যায় বিজু। সন্ধ্যায় ফিরে এলে তখন রানু রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত। বিজু হতক্লান্ত শরীরে কিঞ্চিৎ বেড়াল-ঘুমের পর গোসল এবং খাওয়া সেরে নেয়, তারপর আবার গ্রেভইয়ার্ড শিফটের শুরু।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া কোথায় ভালোবাসিবার আর মরিবার অবসর! ভালো করে কেউ কারো চেহারাও দেখে না। দাঁতে দাঁত চেপে বিজু নিজেকে সচল রাখে - এ জীবন দোয়েলের ফড়িং-এর তো নয়ই, এমনকি মানুষেরও নয়।
রানুর পড়াশোনা শেষ হওয়ামাত্র এ দেশ থেকে কেটে পড়তে হবে। রানুও আজকাল সেরকম ভাবতে শুরু করেছে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
মানুষের জীবনে নাটকীয়তাও বড়ো কম নয়। গ্রেভইয়ার্ড শিফটে কাজ করছে, এরকম এক রাতে দুটোর দিকে একজন খদ্দের একটা গ্যাস পাম্পের সামনে গাড়ি থেকে নামতে বিজু লক্ষ্য করে, লোকটা সম্ভবত ভারতীয়। গাড়িতে গ্যাস ভরা হয়ে গেলে লোকটা ভেতরে আসে, বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ আন্দাজ হয়। গাড়ি এবং পোশাক-আশাক দেখে মনে হয়, ভালো কাজকর্ম করে।
গ্যাসের দাম দিয়ে বিজুকে জিজ্ঞেস করে, দেশ কোথায়?
বিজু উত্তর দিতে লোকটা পরিষ্কার বাংলায় বলে, আরে দেশী!
লোকটার তাড়া নেই মনে হয়, দিব্যি গল্প জুড়ে দেয়। কফি নিতে গেলে বিজু বলে, দাঁড়ান কফিটা পুরনো। টাটকা বানিয়ে দিই।
কফি মেশিন চালু করে দিয়ে পরিচয় বিনিময় হয়। ভদ্রলোকের নাম আসাদউল্লাহ কবির, এ দেশে আছে প্রায় বিশ বছর। এসেছিলো পড়াশোনা করতে, শেষ করে এখানেই থেকে গেছে। বিয়ে করেছে এ দেশীয় এক শ্বেতাঙ্গিনীকে। দু’জনে মিলে একটা ব্যবসা চালায়। দুই ছেলেমেয়ে কলেজে পড়াশোনা করে।
বিজু বুয়েট থেকে পাশ করেছে শুনে বলে, এখানে আপনি কী করছেন?
বিজু সংক্ষেপে তার কাহিনী বিবৃত করে বলে, বউয়ের পড়াশোনা শেষ হলেই দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে।
কফি তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। দুধ-চিনি মিশিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে আসাদউল্লাহ বলে, গুড লাক। ইচ্ছেটা মহৎ, স্বীকার করছি। কিন্তু আপনার যাওয়া হচ্ছে না, তা আমি এক্ষুণি সাদা কাগজে লিখে দিতে পারি।
বিজু হাসে, কেন?
শতকরা নিরানব্বুই জন ফিরে যাওয়ার বাসনা নিয়ে এ দেশে আসে। ফিরতে পারে সম্ভবত শতকরা এক-দুই ভাগ। দেখতেই পাচ্ছেন, আমিও ওই মেজরিটির দলে।
আমি খুব চেষ্টা করবো মাইনরিটি হতে।
বলেইছি তো, গুড লাক।
আসাদউল্লাহ পকেট থেকে একটা বিজনেস কার্ড বের করে দিয়ে বলে, যদি সত্যি সত্যি দেশে ফিরে যেতে পারেন, আমাকে ফোন করে জানিয়ে যাবেন।
বিজু ভাবে, অদ্ভুত মানুষ তো! কার্ডটা এক নজর দেখে বলে, বছর দুয়েকের মধ্যে আমার একটা ফোন আপনি আশা করতে পারেন।
আসাদউল্লাহর যাওয়ার কোনো তাড়া ছিলো না মনে হয়। বলে, আপনি আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামটা দেখেছেন লক্ষ্য করে?
বিজু সামান্য লজ্জা পায়, তার অমনোযোগ ভদ্রলোক ঠিক ধরে ফেলেছে। কার্ডটা চোখের সামনে তুলে ধরে দেখে, এ কে ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস। অর্থাৎ আসাদুল্লাহ কবির ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস। ভদ্রলোক কোম্পানির প্রেসিডেন্ট।
বিজু জিজ্ঞেস করে, কী ধরনের কাজ করেন আপনারা?
আসাদুল্লাহ বলে, আমি নিজেও আপনার মতো ইঞ্জিনিয়ার, তবে মেকানিক্যালের। এখানে কয়েক বছর চাকরি করার পর ব্যবসা শুরু করি। প্রথমদিকে মেকানিক্যাল ড্রাফটিং-এর কাজ বেশি করতাম। এখন ইলেকট্রিক্যাল, এনভায়রনমেনটাল, ইলেকট্রনিকস-এর ডিজাইন, ড্রাফটিং, মডিফিকেশন, প্রসেস অটোমশেন সব ধরনের কাজই করি। একটা মেশিন শপও আছে, পার্টস-অ্যাসেম্বলি-প্রোটোটাইপ বানাই।
কফিতে আরেকটা চুমুক দিয়ে আসাদুল্লাহ বলে, আপনাকে কার্ড দিয়েছি দু’বছর পরে ফোন করার জন্যে নয়। আপনার ফোন চাই দিন দুয়েকের মধ্যে। অফিসে এলে আলাপ করে দেখা যায়, আমাকে আপনি পছন্দ করছেন কিনা বা আপনাকে আমার কোনো কাজে লাগবে কি না।
এক সপ্তাহের মধ্যে বিজু এ কে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ কাজ শুরু করেছিলো। পুরোপুরি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর চাকরি নয়, তবু তার লাইনের কাজ তো! তিনশো ডিগ্রী তাপের গ্রিলের পাশে দাঁড়িয়ে বারগার বানানো বা দুই পায়ে ঠায় দাঁড়িয়ে গ্যাস বিক্রির পয়সা গোনার চেয়ে ভালো।
চাকরিতে ঢুকে বিজুর মনে হয়, এটাও এক ধরনের ফাঁদ। এই যে একটা লাইনে ওঠার ব্যাপার ঘটলো, চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করার সুযোগ পাওয়া গেলো, এরপরে আর পিছু হটা নেই। এই নেশা তোমাকে সামনে ঠেলে নিয়ে যেতে থাকবে। তখন দেশে ফিরে যাওয়া কি আর ততো জরুরি মনে হবে? এই ফাঁদে তার পড়া চলবে না, কিছুতেই না। পড়লে নিজের কাছে ছোটো হয়ে থাকবে সে। আত্মবিশ্বাসের অহংকার তাহলে কোথায় থাকবে তার?
রানু অবশ্যই খুশি হয়েছিলো। আত্মীয়-পরিজনবিহীন এই শহরে দু’চারজনের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়, সামান্য ঘনিষ্ঠতাও হয়ে গেছে। তবু শেষ পর্যন্ত পরস্পরকে ছাড়া অবলম্বন আর কোথায় তাদের! এখন দিনের শেষে একত্রে বসে চা খাওয়ার সময় পাওয়া যায়, টিভির সামনে বসা হয়। দরকারি-অদরকারি, সাংসারিক ও সুইট নাথিংস বলাবলি।
তারপরেও অদূর বা সুদূর ভবিষ্যত নিয়ে জরুরি কথাগুলো উহ্য থেকে যাচ্ছিলো। আমেরিকায় স্থিত হওয়া বিষয়ে তাদের ইচ্ছে যে বিপরীতমুখী, তা দুজনেরই কমবেশি জানা। বাচ্চা-টাচ্চা নেওয়ার বিষয়ও এই মুহূর্তে খুব স্পর্শকাতর। ঢাকায় সেই রাতের পরে তারা কেউ এই নিয়ে একটা কথাও উচ্চারণ করেনি। দু’জনে খুব যত্ন করে একটা দেয়াল তুলে রেখে তার পরিচর্যা করে যাচ্ছিলো। ‘আই ফীল ইউ আর স্লিপিং আওয়ে, আই অ্যাম লুজিং ইউ।’
আসাদুল্লাহ একদিন লাঞ্চে নিয়ে যায় বিজুকে। জিজ্ঞেস করে, কাজ কেমন লাগছে আপনার?
বয়সের বিস্তর তফাৎ সত্ত্বেও আসাদুল্লাহ আপনি থেকে তুমিতে নামেনি। বিজু বলে, যা করছিলাম তার তুলনায় তো ভালোই।
একটা কথা আপনাকে স্পষ্ট করে বলি। আমি জানি এই কাজ আপনার খুব বেশিদিন ভালো লাগবে না। আমিও চাই না আপনাকে চিরদিন আটকে রাখতে। কোথাও আপনার শুরু করাটা দরকার ছিলো, আমি সেখানে একটু হয়তো সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। ক্যারিয়ারের জন্যে আপনার এখানে কিছু কোর্স নিয়ে নেওয়া উচিত। আপনার ব্যাকগ্রাউন্ডে আপনি ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমটা নিলে ভালো করবেন বলে আমার মনে হয়। খোঁজখবর নিয়ে ভর্তি হয়ে যান, অফিসের পরে সন্ধ্যায়ও ক্লাস নিতে পারবেন।
কিন্তু আমি এ দেশে থাকতে চাই না, আপনাকে বোধহয় বলেছিলাম।
আসাদুল্লাহ হাত তুলে বিজুকে থামিয়ে দিয়ে বলে, না চাইলে থাকবেন না। কিন্তু যেটা শিখবেন, পৃথিবীর সবখানে সেটা আপনার কাজে লাগবে। আমি আপনার ক্যারিয়ারের কথা ভেবেই বলছি, নতুন কিছু একটা বিদ্যা বা স্কিল আয়ত্ত্ব করার সুযোগ ছেড়ে দেওয়ার কোনো মানে নেই।
অস্বীকার করার বা অসম্মত হওয়ার কারণ খুঁজে পায়নি বিজু। সে ভর্তি হয়েছিলো যখন রানুর এম এস শেষ হতে আর মাসকয়েক বাকি। তাতে ক্ষতি কিছু নেই, দুটো বছর দেখতে দেখতে চলে যাবে। শেষ হলে দেশে ফেরার ব্যাপারটা রানুর সঙ্গে ফয়সালা করে নিতে হবে।
পাশ করার পরপরই রানু চাকরি পেয়ে যায়। সে সময় আর্কিটেক্টদের চাকরির বাজারে বেশ মন্দা, চারদিকে ছাঁটাই হচ্ছিলো। কয়েকজন বাঙালি আর্কিটেক্টের বেকার হয়ে যাওয়ার খবরও শোনা গিয়েছিলো। সেই বাজারে কোনোরকমের অভিজ্ঞতা ছাড়া রানুর চাকরি হওয়াটা অভাবিত বটে।
বিজুর ধারণা ছিলো, চাকরির বাজারের মন্দা অবস্থাটাকে রানুর সঙ্গে দেশে ফেরার দরকষাকষির সময় ব্যবহার করা যাবে - চাকরি না পেলে এখানে থাকা যাবে কী করে! তা বোধহয় আর হলো না।
বিজুর কোর্স শেষ হওয়ার ঠিক আগে এক রাতে রানু জানায়, ডাক্তার কনফার্ম করেছে।
একটু তন্দ্রামতো এসেছিলো বিজুর। সচকিত হয়ে ওঠে সে, কী কনফার্ম করেছে? রানু ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলো, তা-ও জানা ছিলো না তার। কথাটা খুবই আচমকা এবং কোনো প্রসঙ্গ ছাড়া এসেছে। বিজুর মনে হয়, সে যা ভাবছে, তাই কি?
সাড়া না পেয়ে রানু বলে, তুমি কি ঘুমিয়ে গেলে?
না, বলো। শুনছি।
ডাক্তার আজ রিপোর্ট দিয়েছে, দু'মাস চলছে।
এই খবরে খুশি হওয়াটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। বিজু খুশি কি না, নিজে বুঝতে পারে না। এই প্রসঙ্গ চাপা দেওয়া ছিলো এতোদিন, আজ হঠাৎ ঢাকনা উঠে যাওয়ায় সে খানিক অপ্রস্তুত বোধ করে। মুখে কোনো কথা আসে না।
প্রথমবার রানু তার আমেরিকাযাত্রা ঠেকানোর জন্যে বিজুর চেষ্টা বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলো। এবার কি বিজুকে এই দেশে আটকে রাখার ষড়যন্ত্র রানুর? অভিযোগটা এখন ফিরিয়ে দেওয়া যায় না!
রানু অন্ধকারে হাতড়ে বিজুর হাত ধরে, তুমি কিছু বলছো না যে!
কী বলবো বলো তো! অনেক বছর ধরে যে কথাটা মনে না করার চেষ্টা করে আসছি, তোমার কথায় তা মনে পড়ে যাচ্ছে।
তুমি আমাকে এখনো ক্ষমা করোনি, তাই না?
আমি ক্ষমা করার কে, রানু? তুমি নিজেকে ক্ষমা করতে পেরেছো কিনা, সেটা সবচেয়ে বড়ো কথা। আর আমার কথা যদি বলো, তাহলে বলি, ওই ঘটনার পর আমাদের জীবন ওলটপালট হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। যায়নি, এখনো আমরা এক ছাদের নিচে বাস করি।
বিজু একটু থামে। রানু চুপ করে শুনছে। বিজু মৃদু স্বরে বলে, ওই বিষয়ে কোনোদিন কারো কাছে একটা শব্দও উচ্চারণ করিনি। করলে নিজেকে লজ্জিত হতে হতো, তোমাকে ছোটো করা হতো। কিন্তু ভুলে যাওয়া তো সম্ভব হয়নি। সেই ঘটনা ছিলো আমার জন্যে এক ধরনের রূঢ় জাগরণ।
ফুলটুস জন্মানোর সময় বিজু লেবার রুমে ছিলো রানুর সঙ্গে। হাসপাতালে ডাক্তার জিজ্ঞেস করেছিলো, তুমি লেবার রুমে যেতে চাও?
এদেশে সাধারণত কেউ না করে না। রানুও চায় বিজু তার সঙ্গে যাক। বিজু সাহস করে হ্যাঁ বললেও মনে মনে যে একটু দ্বিধা বা ভয় ছিলো না, তা নয়। বাচ্চা জন্মানোর বিষয়ে যা কিছু শোনা ছিলো, তা-ই যথেষ্ট ভয়ংকর। যা কিছু যন্ত্রণা সব যাবে রানুর ওপর দিয়ে, তার ভূমিকা তো শুধু দেখা, সঙ্গে থেকে রানুকে সাহস দেওয়া। তবু মনে হয়, সেই যন্ত্রণা অবলোকনের যন্ত্রণা সহ্য করা যাবে তো?
পরদিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে রানু লেবার রুমে কেমন লাগলো জিজ্ঞেস করে।
বিজু বলে, বিশ্বাস করবে কি না জানি না। কিন্তু লেবার রুমে তোমার সঙ্গে না গেলে একটা অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতাম। মেয়েদের ওপর আমার শ্রদ্ধায় মাথা নিচু হয়ে এসেছিলো। সব পুরুষমানুষের কথা বলতে পারবো না, কিন্তু আমি জানি এই অমানুষিক যন্ত্রণা আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হতো না। এই কষ্টের কথা জেনেও মেয়েরা কীভাবে আবার বাচ্চা নিতে চায়, আমার বুদ্ধিতে কোনোদিন কুলাবে না।
মেয়েকে পাশে নিয়ে শুয়ে ছিলো রানু। পরিতৃপ্ত দেখায় তাকে। মাতৃত্বের অহংকার কথাটা শোনা ছিলো, এবার দেখা হলো বিজুর।
১৫
আগামীকাল ফুলটুসের স্কুলে গ্র্যান্ডপ্যারেন্টস ডে। কালই তো! গত সপ্তাহে স্কুলের নিউজলেটারে দেখেছিলো, মনে পড়ছে বিজুর।
দিনের শেষ সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুঁজে দেয়। রানুকে সে পুরোপুরি বুঝতে পারে, এমন দাবি করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। বিয়ের আগে-পরে মিলিয়ে পনেরো-ষোলো বছর, একজন মানুষকে জানার জন্যে কি সময়টা যথেষ্ট নয়?
হয়তো যথেষ্ট, হয়তো নয়। কিন্তু নয় কেন? এর মধ্যে বারো বছর একই ছাদের নিচে বসবাস করেছে, এক বিছানা ভাগাভাগি করেছে।
শারীরিক নৈকট্য ও সহাবস্থান হয়তো কিছু সাহায্য করে, কিন্তু রানুর রহস্যময়তা ঠিক ঠিক বোঝা আজও হলো না! এই যে আজ এয়ারপোর্ট থেকে ঘরে ফিরে প্রথম পাওয়া উপেক্ষা, ঠিক তার বিপরীতে বিজুর পছন্দমতো পোশাক ও সজ্জা। স্যুভেনির পেয়ে খুশি হওয়া, তার উল্টোদিকে খাবার গরম করা নিয়ে তীক্ষ্ণ বাক্য। মেলে না যে!
টেবিলে বিজুর পছন্দের খাবার সাজিয়ে পাশে এসে বসার পর মনে হতে পারে দিনের শেষে একটি মধুর সমাপ্তি অপেক্ষা করে আছে। অথচ এখন কোনোকিছু না বলে সে ঘুমিয়ে পড়লো, এর ব্যাখ্যা কোথায়? হয়তো ইচ্ছের সঙ্গে মিলিয়ে ঘটনা ঘটে না, ঘটানো যায়ও না। খাবার টেবিলে রানুর বসা নিয়ে বিজুর অস্বস্তি কোনো ভুলে যাওয়া অন্ধকার ঘরে হয়তো অকস্মাৎ আলো ফেলে থাকবে।
উঠে পড়ে বিজু, ভেতরে এসে প্যাটিওর দরজা বন্ধ করে। শোয়ার ঘরে যাওয়ার আগে ফুলটুসের ঘরে ঢোকে। নাইট লাইটের অল্প আলোয় দেখা যায়, উপুড় হয়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে সে। নতুন পাওয়া বারবি এক হাতে জড়িয়ে ধরা। একটা চেয়ারের ওপর কাল স্কুলে যাওয়ার সব কাপড়চোপড়। মেয়ে নিজে ঘুমানোর আগে কোনোসময় এই কাজটা করে রাখে। সকালে উঠে তাড়াহুড়োর মধ্যে কী পরবো, কী সঙ্গে নেবো এই নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হতে হয় না।
টেবিলের পাশে স্কুলের ব্যাকপ্যাক রাখা। ব্যাকপ্যাক খুলে টেক-হোম ফোল্ডার বের করে বিজু। ফোল্ডারে স্কুলের প্রতিদিনের এবং আসন্ন কার্যকমের বিবরণ, ক্যালেন্ডারে মাসের বিশেষ দিনগুলো হাইলাইট করা। অভিভাবকরা আগাম জেনে যায়, স্কুলে কবে কী হচ্ছে। এ ঘরে আলো জ্বাললে ফুলটুসের ঘুম ভাঙবে না ঠিকই, কিন্তু চোখে আলো পড়লেই চোখমুখ কোঁচকাবে মেয়ে।
ফোল্ডার হাতে নিয়ে বসার ঘরে আসে বিজু। হ্যাঁ, কাল গ্র্যান্ডপ্যারেন্টস ডে। ছেলেমেয়েরা তাদের দাদা-দাদী বা নানা-নানীকে কাল স্কুলে নিয়ে যেতে পারবে সঙ্গে করে। ক্লাসে তারা বাচ্চাদের গল্প শোনাবে, একসঙ্গে লাঞ্চ খাবে। ব্যাপারটা খুবই মজার হবে, বিজু আন্দাজ করতে পারে। আচ্ছা, বাংলাদেশে বাচ্চাদের স্কুলগুলোতে এই নিয়মটা নেই কেন? দেশে বাচ্চারা এদের তুলনায় অনেক বেশি দাদা-দাদী বা নানা-নানীর ন্যাওটা হয়।
ফুলটুস তার গ্র্যান্ডপ্যারেন্টদের কতোটুকু চেনে? সামান্য সময়ের যা দেখা-সাক্ষাত হয়েছে, তার বেশি কিছু নয়। নানীর সঙ্গে ছাড়া ঘুমাবো না জাতের আবদার করার মতো ঘনিষ্ঠতা কখনো তৈরি হয়নি!
স্কুল থেকে খবরটা জেনে ফুলটুস জিজ্ঞেস করেছিলো, বাবা, গ্র্যান্ডপ্যারেন্টস ডে-তে আমার সঙ্গে কে যাবে? আমার গ্র্যান্ডপ্যারেন্টরা কেউ এখানে থাকে না কেন?
কী উত্তর দেয় বিজু? কীভাবে বললে মেয়েকে বোঝানো যাবে তার দাদা-দাদী বা নানা-নানী কেন এখানে থাকে না। জানে, বোঝানো সম্ভব নয়। তাই হালকা করে বলেছিলো, তারা ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না, সেইজন্যে মনে হয় এখনে থাকতে চায় না।
ফুলটুস মানতে রাজি নয়। বলে, আমার ক্লাসের ম্যানুয়েল-এর গ্র্যান্ডমা স্প্যানিশ ছাড়া কিচ্ছু জানে না, বলতেও পারে না। সে ম্যানুয়েলদের বাসায় থাকে!
বিজু মনে মনে ভাবে, ম্যানুয়েল ভাগ্যবান। তোর বাবা-মা এখানে স্বেচ্ছা-উদ্বাস্তুর বেশি কিছু নয়, ফুলটুস। তারা তাদের শেকড় ছিঁড়ে চলে এসেছে, এখানে তাদের বাবা নেই, মা নেই, ভাইবোন নেই। তারাও কারো পুত্রকন্যা, আত্মীয়-পরিজন। কিন্তু তা একেবারে অপ্রাসঙ্গিক, অপ্রয়োজনীয় এই দেশে। এখানে শেকড় গেড়ে তারা স্থিত হবে কি না, তাও ঠিক হয়নি এখনো। এই পরিচয়হীনতার বেদনা, বিচ্ছিন্নতার বিষাদ তোকে কেন, তোর মাকেও কি ঠিক বোঝানো যাবে? সে কি এইসব বিপন্নতা টের পায়? ভাবে?
ফুলটুসকে বলে, আচ্ছা, আমি বুড়োর মেকাপ নিয়ে তোর গ্র্যান্ডপা সেজে গেলে হয়?
সেটা নকল হয়ে যাবে, বাবা। সত্যিকারের তো নয়।
বিজু জানে, এ দেশে প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীর ছেলেমেয়েদের কাছে বাবা-মাকে অনেকগুলো ভুমিকায় অভিনয় করতে হয় একই সঙ্গে। বাবা-মা-ভাই-বোন ছাড়া আর কোনো নিকটজনের কোনো অস্তিত্ব তাদের কাছে নেই। মামা, চাচা, ফুপু, খালা এই ধরনের কিছু সম্পর্কের ধারণা আছে তাদের, জানে না সেগুলো সত্যিকারের কি না, তারা ঠিক কারা। মাঝেমধ্যে ছবিতে হয়তো দেখে, দেশে গেলে দেখাশোনা হয় কিছুদিনের জন্যে। তাতে কি কিছু স্পষ্ট হয়? সম্পর্ক, আত্মীয়তা তৈরি হয়? খালা বা ফুপুর কাছে যে স্নেহচুম্বনটি তাদের পাওনা, সেটি আসে মায়ের কাছ থেকে। অনুপস্থিত দাদীর হয়ে গল্প বলার দায়িত্ব হয়তো বাবার। আসলের স্বাদ-গন্ধ-বচন তবু অধরা থেকে যায়। তুমি দাদু সাজতে পারো, কিন্তু তুমি তো দাদু নও!
ফুলটুসের ঘরে ফিরে বিজু ফোল্ডারটা ঢুকিয়ে রাখে ব্যাকপ্যাকে। বিছানার পাশে গিয়ে অভ্যাসবশে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালের ওপর এসে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দেয়। একটু নড়ে ওঠে ফুলটুস, বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে। বোঝা যায় না। ভাবলে খুব অবাস্তব বোধ হয়, পৃথিবীতে বাবা-মা ছাড়া এই শিশুটি কী নিঃসহায়, নিরবলম্ব।
হঠাৎ কখনো কখনো খুব অদ্ভুত একটা ভাবনা আসে। মনে হয়, কোনো একটা দুর্ঘটনায় সে আর রানু যদি মারা যায়, এমন যে ঘটে না তা নয়, ঘটতেই পারে, এই মেয়েটির কী হবে? কার কাছে যাবে সে? যদিও জন্মসূত্রে এটাই তার দেশ, তবু তার আপনজন কেউ থাকবে না। কার অবলম্বন পাবে সে? কীসের আশ্রয়, কীসের নিরাপত্তা সে রেখে যাচ্ছে মেয়ের জন্যে?
ফুলটুস যখন একমনে টিভিতে কার্টুন দেখে, মাঝে মাঝে বিজু পাশে বসে মেয়ের মুখে অপলক তাকিয়ে থাকে। মেয়ের বিস্ময়ভরা চোখ দেখে, কপাল দেখে, ভুরু-ঠোঁট-চিবুক দেখে আর ভাবে, এই শিশুটির বাবা সে! এই অপরূপ বিস্ময়বোধ যায়ই না!
ঘুমাতে যাওয়া উচিত এখন। ঘুম যে পাচ্ছে, তা নয়, তবু যেতে হবে বিছানায়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঝকঝকে নতুন একটি দিন শুরু হলেও পুরনো আর চেনা সব দুরন্ত ব্যস্ততা নিয়ে দৌড় শুরু হবে আবার। এ দেশে যাকে ইঁদুর-দৌড় বলা হয়, তার এক অনিচ্ছুক দৌড়বিদ ইঁদুর সে। তবু দৌড়ে নেমে পিছিয়ে যেতে, থেমে যেতে যে মন চায় না! অন্তর্গত প্রবৃত্তি ছুটিয়ে নেয়, যতোক্ষণ দৌড়ের মধ্যে আছি, সামনের দিকে এগোতে হয়।
গোসল সেরে ঘুমপোশাক পরে নিয়েছিলো বিজু। শোয়ার ঘরে দরজার কাছে দাঁড়ায়। এ ঘর আর ফুলটুসের ঘরের মাঝখানের প্যাসেজে আলো সারারাত জ্বালানো থাকে। কোনো কোনো রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে মেয়ে নিজের বিছানা ছেড়ে ধুপধাপ করে উঠে এসে বাবা-মার মাঝখানে ঢুকে পড়ে। প্যাসেজের আলো জ্বলে ওরই জন্যে, যাতে ঘুমচোখে অন্ধকারে হোঁচট না খায়।
ঘুম পাতলা হলেও ঘুমিয়ে গেলে রানুর আর কিছু হুঁশ থাকে না, বিচিত্র সব ভঙ্গিতে বিছানাময় ঘুরে ঘুরে ঘুমায় সে। প্যাসেজের আলোয় বিজু বিছানায় রানুর অবস্থান দেখে। কতোবার দেখেছে বিজুর জন্যে নির্দিষ্ট জায়গার দখল নিয়ে ঘুমাচ্ছে রানু। আজ এখনো তাকে নিজের জায়গায় আছে দেখে হঠাৎ সন্দেহ হয়, আদৌ কি ঘুমিয়েছে সে?
খুব সাবধানে নিঃশব্দে বিছানায় ওঠে, বালিশে মাথা এলিয়ে দেয়। পা দুটো বিছানায় তুলে সটান চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। রানুর কোনো নড়াচড়া নেই, গভীর নিস্তব্ধতার ভেতরে তার নিয়মিত নিশ্বাসের মৃদু শব্দ পাওয়া যায়। সন্ধ্যারাতের সেই সুগন্ধ স্মৃতির মতো উঠে আসছে তার শরীর থেকে। ডানদিকে কাৎ হয়ে ঘুমাচ্ছে রানু, মুখ বিজুর দিকে ফেরানো।
এরকম অন্ধকারে বিজুর ঘুমাতে ভালো লাগে না। রানু ঘুমানোর সময় আলো একেবারে সহ্য করতে পারে না, তার চোখে লাগে। কতোরকম বিপরীতমুখী পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার যে আছে! সব দাম্পত্যে থাকে? গ্রীষ্মকালে বাইরে যখন ঠা ঠা রোদে সব পুড়ে যাচ্ছে, তাপ ফারেনহাইট একশোতে, রানু তখন এয়ারকন্ডিশনারের অটোসেটিং দিয়ে রাখে পঁচাশিতে। পঁচাত্তর হলে বিজুর ঠিক হয়, তাহলে আবার রানুর শীত করে। শীতকালেও একই অবস্থা, হীটার পঁচাত্তরে দিলেও রানুর গরম লাগে।
একবার ঠাট্টা করে বলেছিলো বিজু, জানো এইসব কারণে বিয়ের আগে লিভ-টুগেদারের ব্যাপারটা খুব জরুরি। চব্বিশ ঘণ্টা একসঙ্গে না থাকলে ঠিকমতো বোঝাই যায় না, তোমার সঙ্গে আমার পোষাবে কি না। টেম্পারেচার টলারেন্স লেভেলটাও খুব জরুরি সংসার করার জন্যে। একসঙ্গে বাস করলে অংকটা অনেক সোজা হয়ে যায়।
বিশুদ্ধ ঠাট্টাই ছিলো। সে নিজে একটি জুটির কথা জানে যারা চোদ্দো বছর একসঙ্গে বসবাসের পর বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। অথচ বিয়ের ছ'মাসের মধ্যে দু'জনে কোর্টে গিয়েছিলো বিচ্ছেদের আবেদন হাতে নিয়ে। রানুর কাছে তা ঠাট্টা মনে হয়নি। গম্ভীর মুখে বলেছিলো, আমাকে বিয়ে করে এতো দুঃখ তোমার!
বন্ধ দরজার নিচ দিয়ে প্যাসেজের আলো ঘরে কিছুটা ঢুকে পড়ে। চোখে অন্ধকার সয়ে আসতে বেশি সময় লাগে না। বিজু মুখ ফিরিয়ে দেখে রানুকে। তার গায়ের ওপর থেকে কম্বল নেমে গেছে হাঁটুর কাছে। গোসলে ঢোকার আগে কম্বলটা পায়ের কাছে গোটানো দেখেছিলো। রানু পরে টেনে নিয়েছে। পরনের শাড়ি সামান্য আলগা হয়ে একপাশে বুকের ওপর থেকে সরে গেছে। ভারি লোভ জাগানো বুক রানুর। তার নিচে থেকে কোমর পর্যন্ত উন্মুক্ত, প্রায় মেদহীন। শাড়ি নাভির সামান্য নিচে।
দেসারুতে বিজুর আগ্রহে ওভাবে শাড়ি পরতে শুরু করেছিলো রানু। 'কালিম্পং-এর কুয়াশায় চাঁদের মতো মনীষার নাভি...' এক কবির লেখা গদ্য থেকে উদ্ধৃত করে রানুকে শুনিয়েছিলো বিজু। সে কতোদিন আগের কথা। অনেকদিন?
বিজু টের পায় তার শরীর জেগে উঠছে। শরীর কোনো বিষাদ, অভিমানের ধার ধারে না। গত কয়েকদিনের মন কষাকষির মেঘ সরিয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত রানু নিজেই দিচ্ছিলো সন্ধ্যায়, আবার আচমকা সে নিজেকে প্রত্যাহারও করে নিয়েছে। তারপরেও বিজু কেমন করে হাত বাড়ায়? হয় না, পারা যায় না। তার অহম, অভিমান তাকে বাধা দেয়। রানুকে স্পর্শ করার, তাকে জাগানোর অবিবেচক, লোভী আকাঙ্ক্ষাকে পাশ কাটিয়ে সে নিজেকে সংহত করার চেষ্টা করে।
ঠিক তখনই তার মনে হয় রানু জেগে আছে, ঘুমায়নি। ঘুমের ভেতরে সে অনেক নড়াচড়া করে, এমন পরিপাটি শোয়া রানুর নয়। কিঞ্চিৎ অগোছালো মনে হলেও তা সাজানো বলে সন্দেহ হয়। বিছানায় পাশাপাশি শোয়া দু’জন মানুষ স্পর্শ করার দূরত্বে। এই দূরত্বও যে কতো দুরূহভাবে অনতিক্রম্য!
বিজু চোখ বন্ধ করে। রানু পারলে সে-ও নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারবে।
১৬
বাচ্চা কার মতো দেখতে হয়েছে?
মেয়েকে দেখে কেউ বলে, ঠিক মা-র মতো দেখতে। কিছু পরেই কেউ বলে, বাবার মতো। বিজু কৌতুক বোধ করে। বিরক্তিও। সদ্য জন্মানো বাচ্চার মুখ দেখে সে কার মতো দেখতে প্রশ্নটা যেমন অবান্তর লাগে, মন্তব্যও তেমনি অর্বাচীন না হয়ে যায় না। হাসপাতালের নার্সারিতে কাচের জানালায় উঁকি দিয়ে দেখেছিলো, সারি সারি শিশু আলাদা ক্রিবে শোয়ানো, নার্সরা তাদের পরিচর্যা করছে। এর মধ্যে তার মেয়েও আছে। শুধু গায়ের রং ছাড়া সবগুলো শিশু দেখতে হুবহু এক রকম। না বলে দিলে বিজু চিনতে পারবে না কোনটা তার মেয়ে।
এক ভদ্রলোকের কথা জানে বিজু। তাঁর দ্বিতীয় ছেলের জন্মের পর ছেলে কার মতো দেখতে প্রশ্নটি শুনতে শুনতে ভদ্রলোক অতিষ্ঠ হয়ে বলেছিলেন, পাশের বাড়ির লোকটার মতো!
রানু অফিসে যেতে শুরু করেছে। ফুলটুসের এখন দু’মাস। বিজুর ইচ্ছে ছিলো, রানু কাজে ফেরার আগে আরো কিছুদিন মেয়ের সঙ্গে থাকুক। মা ছাড়া আর কাউকেই সে এখনো চেনে না, আর কে বুঝবে এখন তাকে? কোন সুদূর থেকে মর্ত্যে নেমে আসা দেবশিশুটিকে এক্ষুণি ডে কেয়ারে পাঠাতে মন সরে?
বিজু বলেছিলো, ও কি এই বয়সে ডে কেয়ারে থাকতে পারবে?
কেন পারবে না? এখন থেকে বরং অভ্যাস করানো দরকার।
যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করে বিজু, ওখানে বাচ্চাকাচ্চাদের অনেক ছোঁয়াচে অসুখবিসুখ হয় শুনেছি। ডে কেয়ারের বাচ্চারা বেশি অসুস্থ হয়।
রানু বলে, এ দেশে লক্ষ লক্ষ বাচ্চা এই বয়সে ডে কেয়ারে যাচ্ছে না? অসুখ-টসুখ এমনিতেও হতে পারে।
তা পারে, বিজু জানে। এও সে জানে, বাচ্চা আরেকটু বড়ো হলে তাদের শরীরের প্রতিরোধ শক্তিও কিছু বাড়ে। তখন ডে কেয়ারে সমস্যা কম হয়। আসলে বিজু মেয়ের ব্যাপারে বোধহয় একটু অতিরিক্ত সতর্ক, কিছুটা প্রাচীনপন্থীও। মায়ের কাছে শিশুর যত্ন সবচেয়ে ভালো হয় বলে এখনো তার বিশ্বাস। ডে কেয়ারে ওরা করবে গণপরিচর্যা।
সে বলে, রানু, অন্যরা যা করে আমাদেরও তাই করতে হবে তার তো কোনো মানে নেই।
তুমি যা চাও তা-ই বা আমাকে মানতে হবে কেন?
ঠিক, বিজুর চাওয়া বা না-চাওয়ায় কী এসে যায়? রানু কি তার নিজের ভালোমন্দ বোঝে না! তা বোঝে, নিজেরটা বোঝে। সংসার বা দাম্পত্য যে একটা যৌথ ব্যাপার, তা কি বোঝে? ‘হোয়াইল ইউ সী ইট ইয়োর ওয়ে, দেয়ার’স আ চ্যান্স দ্যাট উই মে ফল অ্যাপার্ট বিফোর টু লং...’
রানু সম্ভবত সবসময়ই জানে, সে ঠিক কী চায় এবং সেটা অর্জন করার জন্যে যা যা করণীয়, ঠিক তা-ই করবে। বিজু জানেনি, কিন্তু তার ঠিক করা ছিলো কখন সে কাজে ফিরে যাবে। হয়তো সেটা মাথায় রেখে মেয়েকে বুকের দুধেও অভ্যস্ত করেনি। পাম্প করে বোতল বোতল দুধ ফেলে দিয়েছে, বাছুরকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মানুষ যেভাবে গরুর দুধ দুয়ে নেয়। মেয়ের জন্যে এসেছে বাজারের বেবিফুড।
অফিসের ম্যাটারনিটি লীভ শেষ হওয়ার পরেও বাচ্চার দেখাশোনা করার জন্যে লীভ অব অ্যাবসেন্স নেওয়া যায়, তা অনির্দিষ্টকালও হতে পারে। রানু নিজে একদিন বিজুকে বলেছিলো, তার অফিসে এক মহিলা লীভ অব অ্যাবসেন্স থেকে কাজে ফিরে এলো তিন বছর পর। অথচ নিজের বাচ্চা হওয়ার পর এই সুবিধা নেওয়ার কথা রানু মনে রাখেনি।
অতোটা দীর্ঘ সময় রানু অফিসে না ফিরে বাচ্চার সঙ্গে থাকবে, তা অবশ্য আশা করেনি বিজু। তবে এতো তাড়াতাড়ি ফেরারও কোনো দরকার ছিলো না। বাৎসরিক ছুটি অবশ্য খরচ করে ফেলা উচিত হবে না, কখন কী দরকারে লেগে যায়! বাচ্চার অসুখ-বিসুখের মতো জরুরি পরিস্থিতি যখন-তখন হতে পারে। লীভ অব অ্যাবসেন্স নিলে চাকরি হারানোর ভয় নেই, আইন সেটা রক্ষা করবে। শুধু বেতন পাওয়া যাবে না। তাতে সমস্যা কিছু ছিলো না। মাসকয়েক আগে বিজু এ কে সার্ভিসেস ছেড়ে দিয়ে নতুন চাকরি শুরু করেছে, তার একার রোজগারে দিব্যি চলে যাবে।
রানুর কথা, শুধু সংসার চলে গেলেই হলো? ভবিষ্যৎ আছে না! এখন মেয়ের কথাও ভাবতে হবে।
বিজু বলে, ঠিক সেটাই কিন্তু আমি বলছি, মেয়ের কথা ভেবে আরো কিছুদিন পরে কাজে ফিরতে পারো।
আমি ভবিষ্যতের কথা বলছি।
আমি তোমাকে চিরদিন ঘরে থাকতে বলিনি রানু, কোনোদিন চাইনি। তোমার নিজস্ব ক্যারিয়ার তৈরি হোক, তাই-ই চেয়েছি বরাবর।
তুমি আমাকে আমেরিকা আসতে দিতে চাওনি।
এসেছো তো।
কীভাবে আসতে হয়েছে, তুমি জানো।
বিজু চুপ করে যায়। সে জানে। তার চেয়ে বেশি আর কে জানে! মনে মনে বলে, তার জন্যে যে মূল্য দিয়েছো, এই অর্জনের জন্যে তা দরকার ছিলো কি না তাও তো ভাবা দরকার। কিন্তু সেসব সে আর ভাবতে চায় না। তাতাই-টুপুর আর হবে না। ফুলটুস আছে!
১৭
ওই লোকটা কে? আগে কোনোদিন দেখেনি। বসে থাকলেও বোঝা যায় লোকটা যথেষ্ট দীর্ঘকায়, তার মায়াবী চোখ দুটি প্রথমে চোখে পড়ে। সোফায় পা তুলে বসে হাত নেড়ে কিছু একটা বলছে সে। খুব হাসির কথা হবে, রানু উল্টোদিকের সোফায় বসে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। এখনো সেই কলাপাতা সবুজ শাড়ি তার পরণে। মাতাল হাওয়ার মতো সুগন্ধি কি এখনো তার শরীরে লেগে আছে? হাসি থামিয়ে রানু হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে লোকটার সামনে দাঁড়ায়। ঝুঁকে পড়ে তার ঠোঁট একবার চুম্বন করে। লোকটা হাত বাড়ায়, রানু তার আগেই সরে গেছে।
বিজু স্পষ্ট বুঝতে পারছিলো, সে স্বপ্ন দেখছে, তবু সহ্য করা যায় না। পারলে রিমোট কন্ট্রোলে স্টপ চেপে দিয়ে দৃশ্যটাকে অন্তর্হিত করে সে জেগে ওঠে। পারা যায় না। ছবি এখনো সচল। এখন লোকটাকে আর দেখা যায় না। দৃশ্যপট বদলে গেছে।
রানু অনেক উঁচু একটা বিল্ডিং-এর জানালায় দাঁড়ানো। পনেরো তলা? বিশও হতে পারে। রানু জানালায় দাঁড়িয়ে নিচে তাকিয়ে কিছু একটা দেখছে। ঝুঁকে পড়েছে সে, আরো বিপজ্জনকভাবে সামনে ঝুঁকে পড়ছে। তার শরীর হঠাৎ পাক খেয়ে জানালার বাইরে ছিটকে পড়েছে। কিন্তু রানু কোথায়? তাকে দেখা যায় না। এখন বিজু নিজে পড়ে যাচ্ছে অসীম শূন্যতার ভেতেরে - বাড়িঘর, গাছপালা, মানুষজন কিছুই দেখা যায় না নিচে।
এবারে কোনো চেষ্টা ছাড়াই ঘুম ভেঙে যায় বিজুর। শূন্য থেকে অসীম শূন্যে পড়ে ভয় পায়নি সে, নাটকীয় ভঙ্গিতে বিছানায় উঠেও বসেনি। জানে, স্বপ্ন দেখছিলো এতোক্ষণ। পূর্ণচোখে অন্ধকার ঘরে তাকিয়ে মনে পড়ে, স্বপ্নের একটা সংলাপও সে শুনতে পায়নি। শুধু ছবি দেখছিলো, যেন রিমোটে কেউ মিউট চেপে দিয়েছিলো।
পাশে তাকিয়ে দেখে, রানু গুটিসুটি মেরে চিংড়ি মাছের ভঙ্গিতে ঘুমাচ্ছে। মাথা আর বালিশ আলাদা জায়গায়। এখন রানুর ঘুমটাকে সত্যিকারের ঘুম মনে হয়। অ্যালার্ম ঘড়িতে চারটা দশ। আরো ঘণ্টা দুই সময় আছে। চোখ বন্ধ করলেও স্বপ্নের দৃশ্যগুলো টুকরো টুকরো হয়ে চোখের সামনে উঠে আসে।
স্বপ্নের ব্যাখ্যা আছে কোনো? বিজু জানে না, ভাবেও না সেসব নিয়ে। তবু মনে হয়, স্বপ্নটা কেন দেখলো? রানুকে কি কোনো কারণে সন্দেহ করতে শুরু করেছে সে? তেমন কোনোকিছু কখনো ঘটেনি, মনেও হয়নি। নিজেদের মধ্যে বোঝা-না-বোঝার মামলা আছে, দূরত্ব আছে। কোনো তৃতীয় পক্ষের ছায় সেখানে নেই। তবু একে কি কোনো অনিশ্চয়তার বোধ বলে ব্যাখ্যা করা যায়? প্রবল আত্মবিশ্বাসী পুরুষও হয়তো কিছু ভঙ্গুর হয়। ‘ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে...।’
অফিসের জন্যে তৈরি হতে হতে গতরাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে বিজুর। স্বপ্নের দৃশ্যগুলো আর অতো উজ্জ্বল নেই, ফ্যাকাসে হতে শুরু করেছে। একটু হাসি পায়, সামান্য বিষণ্ণতাও কি নেই? তা-ও আছে। স্বপ্নটা খুবই অদ্ভুত, কিন্তু ওই লোকটা কে? কোথা থেকে এলো?
ফুলটুস স্কুলে যাওয়ার পোশাক পরে ব্যাকপ্যাক নিয়ে তৈরি, এখন বসে বসে কার্টুনের প্রাতঃকালীন ডোজ গিলছে। সকালে সে একদম কিছু মুখে তুলতে চায় না। রানু জোর করে অর্ধেকটা ডিমসেদ্ধ, কোনোদিন দুধ-সিরিয়াল জাতীয় কিছু একটা খাইয়ে দেয়।
রানু মেয়েকে খাইয়ে এসে অফিসে যাওয়ার পোশাক পরে ফেলেছে, এখন ড্রেসারের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রসাধন সারছে। প্যান্টের বেল্ট লাগাতে লাগাতে বিজু তাকিয়ে দেখে, আয়নায় রানুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। সামান্য হাসে রানু। বলে, কাল রাতে কখন ঘুমাতে এসেছিলে?
বলতে ইচ্ছে করে, তুমি যে জেগে ছিলে, আমি জানি রানু। বলে না। তার পরিবর্তে সহজ গলায় বলে, খুব বেশি দেরি করিনি, তুমি দেখলাম বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলে।
হ্যাঁ, কেন যেন খুব খারাপ লাগছিলো। তাড়াতাড়ি এসে শুয়ে পড়লাম।
আমি অনেকক্ষণ জানতেই পারিনি তুমি শুয়ে পড়েছো।
রানু হঠাৎ এগিয়ে এসে বিজুকে অবাক করে দিয়ে ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট বোলায়। সত্যিকারের চুমু নয়, অনেকটা প্রতীকী ধরনের। নাহলে এই তাড়াহুড়োর সময়ে আবার নতুন করে লিপস্টিক মাখতে হবে।
স্বপ্নে দেখা চুম্বনদৃশ্যটি মনে পড়ে বিজুর। কিন্তু ওই লোকটা কে? রানুকে বলবে নাকি স্বপ্নের কথা? নাঃ, বলা যায় না।
পড়ার ঘরে ঢুকে বিজু ব্রীফকেসে ল্যাপটপ ঢুকিয়ে দরকারি কাগজপত্রগুলো দেখে নেয়। টেবিলের ড্রয়ার খুলে ঘড়ি পরে। ওয়ালেট পকেটে ঢোকায়। সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার। কোমরে বেল্টের সঙ্গে ক্লিপে আটকানো ইন্টারঅ্যাকটিভ পেজার আর সেলফোন। হাতে চাবির গোছা। বিজুর সশস্ত্র অফিসযাত্রা। অস্ত্রশস্ত্র কিছু বাদ পড়লো কি?
সকালে এক কাপ কফি ছাড়া সাধারণত কিছু খায় না বিজু। এমনিতে চা পছন্দ হলেও সকালে ব্ল্যাক কফি ছাড়া ঘুমের রেশটা ঠিকমতো কাটতে চায় না। হাতে সময় থাকলে কখনো কখনো সিরিয়াল। সকালে না খাওয়া নিয়ে অনেকদিন গজগজ করে রানু ইদানিং ক্ষান্ত দিয়েছে। রানু সকালে নেয় দুধ-সিরিয়াল অথবা জেলি-মাখন ছাড়া শুকনো দুটো টোস্ট আর এক কাপ চা।
ফুলটুসকে উঠে পড়ার তাগাদা দিতে গিয়ে বসার ঘরের দেয়ালে ফুটোটা চোখে পড়ে আবার। কেমন করে যেন একটা ফুটো হয়েছে, ক’দিন আগে দেখেছে। অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স-এর অফিসে বলা দরকার মেরামত করার জন্যে। ভুলে গিয়েছিলো। অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে বাস করার এই এক সুবিধা। কোনো মেরামতির দরকার হলে ফোন করে বলে দাও, ওদের লোকজন এসে সারিয়ে দিয়ে যাবে।
ঘরগুলো রং করার জন্যে আর কার্পেট বদলে না দিলেও অন্তত শ্যাম্পূ ক্লিনিং-এর জন্যে বলা হয়েছিলো মাসখানেক আগে, সেটারও তাগাদা দিতে হবে। এই অ্যাপার্টমেন্টে আছে ওরা চার বছর। এর মধ্যে একবারও রং করে দেয়নি। অনেক জায়গায় রং নষ্ট হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও দেয়ালে ফুলটুসের বিদ্যাচর্চা আর শিল্পকর্মের নমুনা। আজ অফিস থেকে একটা ফোন করে দিতে হবে। মনে থাকলে হয়।
রানুর অবশ্য এই ভাড়া বাসায় আর থাকার ইচ্ছে নেই, সে নিজস্ব বাড়ি চায়। আমেরিকান ড্রীম। এ দেশে আসার পর পরই বিজু আমেরিকান ড্রীম কথাটা শুনেছিলো। বেশ অনেকদিন লেগে গিয়েছিলো ব্যাপারটা জানতে - নিজস্ব একটি বাড়ির মালিক হওয়া নাকি আমেরিকান ড্রীম, অন্তত সেই কথিত স্বপ্নের একটা বড়ো অংশ। ঠিক বোঝা যায়নি।
একটি বাড়ি, আশ্রয় তো মানুষের প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে, এ দেশে তা অর্জন করাও কঠিন কিছু নয়। সেটা স্বপ্ন হবে কেন? স্বপ্নের উচ্চতা কি আরো বেশি, আরো দুরধিগম্য হওয়ার কথা নয়? মানুষ এতো স্বপ্নহীনও হয়! স্বপ্ন-কল্পনা এমন সীমাবদ্ধ! এই প্রাচুর্যের দেশে এতো ছোটো স্বপ্ন দেখা হয় কেন কে জানে। অবশ্য যে দেশে জর্জ বুশের পুত্রের নামও হয় জর্জ বুশ, তাদের কল্পনাশক্তি আর কোন উচ্চতায় যাবে! এর মধ্যে হয়তো এক ধরনের তীব্র আত্মকেন্দ্রিক অহংবোধও প্রকাশ পায়, অথচ স্বপ্ন দেখতে জানলে ভূমিহীন চাষী আতর আলীও তার ছেলের নাম আকাশ রাখতে পারে, মেয়ে হলে ফুলের নামে নাম দেয়।
রানু বেশ কিছুদিন আগে বাড়ি কেনার ইচ্ছে জানিয়েছে, সেই বাবদে নিজের রোজগারের প্রায় পুরোটা সে জমাতেও শুরু করেছে। অবশ্য ঠিক তৈরি বাড়ি কেনা তার ইচ্ছে নয়, শহরের একটু বাইরে কোথাও এক একরের মতো জমি কিনে নিজের পছন্দমতো তৈরি করে নেওয়ার বাসনা তার। অফিসে বসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজের বাড়ির ফ্লোর প্ল্যান কমপিউটারে এঁকে ফেলেছে সে। প্লটারে প্রিন্ট করিয়ে এনে বিজুকে দেখিয়েছিলো। সত্যি চমৎকার প্ল্যান, পেশাদার আর্কিটেক্টের কাজ আর কি। আর্কিটেক্ট বউ থাকলে এরকম সুবিধা পাওয়া যাবে, কখনো ভাবেইনি সে। ক’জনের এমন ভাগ্য হয়!
বিজু নিজে বাড়িঘরের মালিকানায় একেবারে উৎসাহী নয়। টাকাপয়সার সমস্যা নেই, এ দেশে কেউ নগদে পুরো টাকা দিয়ে বাড়ি কেনে না। ব্যাংক বা মর্টগেজ কোম্পানি বাড়ির দাম দিয়ে দেয়, তারপর মাসিক কিস্তিতে সুদে-আসলে পনেরো বা তিরিশ বছরে শোধ করে বাড়ির মালিকানা নিজের হয়। কেনার সময় নিজের পকেট থেকে যতো বেশি টাকা দেওয়া যায়, মাসিক কিস্তি সেই অনুপাতে কমে আসে।
রানুর ইচ্ছে, যতোটা বেশি সম্ভব টাকা আগাম দিয়ে ফেলা এবং তিরিশ বছরের বদলে পনেরো বছরের মেয়াদে যাওয়া। এসব বিষয়ে খোঁজখবর বিজু খুব জানে এমন নয়, তবে এটুকু জানে, বিল্ডাররা তাদের নিজেদের ফ্লোর প্ল্যান অনুযায়ী যেসব বাড়ি তৈরি করে, সেখানে নিজেদের তদারকির তেমন কিছু নেই। ওরাই সব করে দেবে। জায়গা কিনে নিজেদের প্ল্যানে বাড়ি তুলতে যে কী ঝকমারি হবে, রানু বুঝতে পারছে? প্রত্যেকটি জিনিস নিজে পছন্দ করে কিনতে হবে, কাজের দেখাশোনা করতে হবে। এতো সময় কোথায় পাওয়া যাবে? এ তো কুঁজোর চিৎ হয়ে শোয়ার ইচ্ছের মতো ব্যাপার।
দু’জনের চাকরি-বাকরি, বাচ্চার দেখাশোনা, হাটবাজার, রান্নাবান্না, লন্ড্রি, ঘরবাড়ি পরিষ্কার, কিঞ্চিৎ সামাজিকতা করতেই জিভ বেরিয়ে যাচ্ছে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মাঝেমধ্যে দু’কাপ চা নিয়ে কিছুক্ষণ বসা ছাড়া দু’জনের তো তেমন করে দেখাও হয় না। আর এ দেশে থাকা না-থাকার মীমাংসা এখনো হয়নি। যদি না-ই থাকবে তাহলে বাড়ি বানানোর ঝামেলায় গিয়ে কাজ কী!
বিজু জানে, রানুর আগ্রহের মূলেও ওই থাকা-না-থাকা। বাড়ি বানানো হয়ে গেলে দেশে ফেরার কথা উঠলে অনায়াসে বলতে পারবে, নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে কোথায় যাবো! কেন যাবো! বিজু আমেরিকান ড্রীম-এর ফাঁদে পড়তে অনিচ্ছুক।
রানুর বাড়ির প্ল্যান দেখে বিজু বলেছিলো, খুব চমৎকার। এই প্ল্যানে একটা বাড়ি কি আমরা দেশে ফিরেও বানাতে পারি না?
হ্যাঁ, পারি। কিন্তু আমি চাই না।
কেন, জানতে পারি?
রানু গলায় সামান্য উষ্মার ফোড়ন যোগ করে সিদ্ধান্ত জানায়, তোমাকে তো বলেইছি আমরা এখানে থেকে যাচ্ছি। দেশে বছরে বছরে যাবো বেড়াতে, থাকতে নয়।
কিন্তু রানু, আমরা এখানে থাকবো বলে আসিনি, এসেছিলাম তোমার লেখাপড়ার জন্যে। সেটা হয়ে গেছে আগেই, মাঝখানে আমার পড়াশোনার জন্যে খানিকটা দেরি হয়ে গেলো। এখন আরো শেকড়বাকড় না ছড়িয়ে আমাদের গুটিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবা উচিত।
তুমি উচিত মনে করতে পারো, আমি করি না। আমাদের মতো অন্য দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ এ দেশে এসে বসবাস করছে। করছে না?
বিজু বলে, তোমাকে আগেও বলেছি, সবাই যা করবে আমাদেরও তা করতে হবে বলে আমি মনে করি না। আমাদের জীবন আমাদেরই, অন্য কারো সঙ্গে মিলিয়ে ফেললে ভুল হবে। অনেকে এসেছে যারা দেশে কিছু করতে পারেনি বা পারবে না বলে বুঝে গেছে। আমাদের পরিস্থিতি তা নয়। আমরা এসেছিলাম একটা প্রয়োজনে, কর্মজীবনে নিজেদের আরো সাফল্যের জন্যে যোগ্য হতে। সে প্রয়োজন মিটে গেছে। বন্ধু-পরিজন ছেড়ে পরের দেশে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা কেন উচিত আমি বুঝতে পারি না, রানু।
দেশে ফিরে কী হবে? বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন আমার কী কাজে লাগবে?
আমরা আমেরিকা আসার আগে পর্যন্ত যেভাবে লেগেছে সেভাবে লাগবে।
আমি চাই না, তবু যদি যাওয়ার কথা বলো, আরো কয়েক বছর থেকে কিছু টাকাপয়সা গুছিয়ে নিয়ে যেতে চাই যাতে দেশে গিয়ে মাথা গোঁজার একটা নিজস্ব ব্যবস্থা করতে পারি, কিছু একটা করতে পারি নিজে থেকে।
বিজু বলে, এখনই উপযুক্ত সময় বলে আমি মনে করি। দেরি করলে বয়স বাড়বে, তখন নিজে কিছু করার উদ্যম থাকবে না, সাহসও নয়। মেয়ে বড়ো হতে থাকলে ফেরা আরো কঠিন হয়ে যাবে। ওর এখন যা বয়স, ও খুব সহজে নতুন জায়গায় মানিয়ে নিতে পারবে। পরে তা আর অতো সহজে হবে না। আরেকটা কথাও আমার খুব মনে হয়। তুমি মানবে কি না জানি না, কিন্তু আমার ধারণা আমাদের মধ্যে যে একটা ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে তার পেছনে অনেকটাই এই অসহ্য ব্যস্ততার জীবন।
রানু বলে, দেশে ফিরে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে ভাবছো কেন?
যে ব্যস্ততার কথা বললাম, বন্ধু-পরিজনহীনতার কথা বললাম তারও একটা মানসিক চাপের দিক আছে। সেই চাপের ফলে আমাদের অনুভূতিগুলো ধনুকের ছিলার মতো টান টান হয়ে থাকে সারাক্ষণ, একটু টোকাও সহ্য হয় না।
রানু ঠাট্টার সুরে বলে, তুমি সাইকোলজি নিয়ে চর্চা শুরু করলে কবে থেকে?
বিজু বলে যায়, একটা কথা ভেবে দেখো, আজ এখন যদি আমরা দু’জনে একটা ছবি দেখতে যাবো ভাবি, প্রথমে চিন্তা করতে হবে ফুলটুস কোথায় থাকবে? বেবিসিটার খুঁজে রেখে গেলেও একটা চিন্তা মাথায় থাকবেই। অথচ দেশে হলে কী হতো? মেয়েকে তোমার বা আমার মা-র কাছে রেখে নিশ্চিন্ত থাকতে পারতে। সময়টা ভালো কাটতো। এটা শুধু নমুনামাত্র, এরকম হাজারটা পরিস্থিতির কথা তোমাকে বলতে পারি। এই নিশ্চিন্তি এ দেশে আমরা কোনোদিন পাবো না, রানু।
তুমি কী বলছো বুঝতে পারছি, কিন্তু এখানে বসে দেশের যা খবর পাই, কাগজে পড়ি, তাতে নির্ভাবনায় ঘরের বাইরেও নাকি যাওয়া যায় না। গেলে আস্ত ফিরে আসবে কি না, কেউ জানে না। এই অশান্তির মধ্যে গিয়ে আমার দরকারটা কী?
তাই বলে সবাই যে নন্দলাল হয়ে সারাক্ষণ ঘরে বসে আছে, এরকম ভাবারও কোনো কারণ নেই। তুমি অযথা কেন জেদ ধরে আছো, বুঝতে পারি না।
রানু সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়, বুঝতে তোমাকে হবে না। আমি যাচ্ছি না। তুমি চাইলে একা ফিরে যেতে পারো। মেয়েকে নিয়ে আমি বেশ থাকতে পারবো।
ঠিক এই ধরনের কথা সে আগে একবার শুনেছিলো বলে মনে করতে পারে বিজু। তখনকার ভাষ্য ছিলো, তুমি থাকো, আমি চললাম। আর এখন তুমি গেলে যেতে পারো, আমি থাকছি।
তার দেশে ফেরার বাসনা এবং রানুর অনিচ্ছা নিয়ে ভাবতে গিয়ে বিজু দেখেছে, মানলে দু’পক্ষেই একশো একটা যুক্তি আছে, না মানলে একেবারেই নেই। রানু থেকে যেতে চায় বলেই তার চলে যেতে চাওয়া? '...আ কনস্ট্যান্ট ব্যাটল ফর দ্য আলটিমেট স্টেট অব কন্ট্রোল...।'
ফুলটুসকে নিয়ে বেরোনোর সময় বিজু দেখে রানু চায়ে চুমুক দিচ্ছে। ছোটো করে বলে, চলি রানু।
আজ কি তোমার ফিরতে দেরি হবে?
ঠিক বলতে পারছি না, অফিসে যাচ্ছি তিনদিন পর। গেলে বুঝতে পারবো। কেন?
না, এমনিতেই।
ফুলটুস বলে, যাচ্ছি মা।
রানু বলে, এই দুষ্টু মেয়ে, মাকে চুমু দিতে হবে না?
ফুলটুস ছুটে গিয়ে মার গালে চুমু দিয়ে এসে বাবার হাত ধরে।
অফিসে পৌঁছে বিজুকে একটা মিটিং-এ ছুটতে হয়। কোনোমতে এক কাপ কফি নিয়ে ঢুকে পড়ে কনফারেন্স রুমে। মিটিং শেষ হতে হতে সাড়ে দশটা। ফিরে এসে কমপিউটারে বসে। ইনবক্সে উঁকি দিয়ে দেখে, দুশো একুশটা ইমেল তার অপেক্ষায়। প্রেরকের নাম আর সাবজেক্ট লাইন দেখে জরুরি মনে হলে বেছে বেছে মেসেজগুলো দেখতে থাকে। দরকার হলে তাৎক্ষণিক উত্তর। একটা মেসেজের উত্তর লিখছে, এই সময় নতুন ইমেল। রানু।
বিজু সামান্য অবাক হয়, দরকার হলে রানু সাধারণত ফোন করে। আজ ইমেল? কৌতূহল চেপে অর্ধেক লেখা মেসেজটা শেষ করে পাঠিয়ে দেয়।
রানুর ইমেল খোলে বিজু। রানু লিখেছে, কাল রাতের জন্যে আমি খুবই দুঃখিত। মুখ ফুটে বলা হয়নি, কিন্তু তুমি যে ক’দিন বাইরে ছিলে, আমার খুব মন খারাপ ছিলো। তোমাকে খুব মিস করেছি। কাল যখন ঘরে এসে ঢুকলে, না-জানা একটা অভিমান আমাকে গিলে ফেললো। যা কিছু বলবো ভেবেছিলাম, মুখে এলো না। নিজেই জানি না আমি এমন কেন। যে কথাটা যেভাবে বলতে চাই, হয় না। প্রায়ই তা মুখে আসে একেবারে অন্যরকম হয়ে। কাল রাতে খাবার টেবিলে তোমার সামনে গিয়ে বসতে তুমি বললে তোমার অস্বস্তি হচ্ছে। আমার এমন মন খারাপ হলো! তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি, তুমি কি জানো!
চমক দেওয়ায় রানুর জুড়ি নেই, বিজু জানে। কিন্তু ব্যাপারটা কী হচ্ছে, বোঝা দরকার। বাইরে এসে সিগারেট ধরায় সে।
সেলফোনে রানুর নাম্বার ডায়াল করতে শুরু করেও কেটে দেয়, এটা ইমেলেই থাক। ফিরে এসে রানুর মেসেজের জবাব লেখে, তোমার সময় থাকলে একসঙ্গে লাঞ্চ করতে পারি।
পছন্দের গ্রীক রেস্টুরেন্টে বসে রানু বলে, আমরা লাঞ্চে এরকম মাঝে মাঝে একত্র হতে পারি, কী বলো?
খুব ভালো হয়। লাঞ্চ মিটিং জাতীয় কিছু না থাকলে বিপদে পড়ে যাই। মনে হয়, কোথায় যাবো খেতে। যেটাই ভাবি, অরুচি হয়, মনস্থির করতে পারি না। গাড়িতে উঠে যে কোনো এক জায়গায় ঢুকে পড়ি। মাঝে মাঝে যদি বদল হয়, তুমি যদি ঠিক করে দাও কোথায় যেতে হবে খেতে, তাহলে বেঁচে যাই।
আমি তো সবদিনই আসতে পারি। তোমার যেদিন সময় থাকবে, ফোন করে দিও।
খুব ঘন ঘন হলে আবার হজম হবে তো?
বিজুর শ্লেষ গায়ে মাখে না রানু। বলে, একেকদিন একেক ধরনের রেস্টুরেন্টে যাওয়া যায়। কতো দেশের খাবার তো চোখেও দেখা হয়নি - ব্রাজিলিয়ান, কোরিয়ান, ভিয়েতনামী, রাশান।
খাবারটা ভালো ছিলো। বিজুর ধারণা, তার চেয়ে ভালো নিজেদের মধ্যে মতান্তরের বিষয়গুলো খাবার টেবিলে না আনা। সবসময় যদি এমন হতো! গতরাতের স্বপ্ন তখন তার মনেও নেই।
সন্ধ্যায় খুব ফুরফুরে মেজাজে ফিরেছিলো বিজু। ভেতরে ঢুকে বোঝে, কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে। ফুলটুসের এই সময়ে থাকার কথা টিভির সামনে, তার বদলে বসে আছে রানু। গম্ভীর থমথমে মুখ, দুপুরে গ্রীক রেস্টুরেন্টে দেখা মুখের সঙ্গে মেলে না।
বিজু জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে?
গলা চড়িয়ে রানু বলে, কী হয়েছে আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন? তোমার আদরের মেয়েকে ডাকো।
কী হয়েছে, বলবে তো!
হবে আবার কী? বাপের আদরে তো মাথায় উঠে বসে আছেন মহারানী।
জানা কথা। ফুলটুস কিছু একটা ভুলভাল করলে তা শেষ পর্যন্ত বিজুর দোষ বলে সাব্যস্ত হবে। নতুন কিছু নয়। সে ব্রীফকেস পাশে নিয়ে সোফায় বসে। অপেক্ষা করে অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ শোনার জন্যে। কিন্তু ফুলটুস কোথায়? নিজের ঘরে?
রানু বলে, মেয়েটা এমন অবাধ্য আর বেয়াদব হয়েছে, বলার নয়। ওকে ডে কেয়ার থেকে তুলে নিয়ে বাসায় ঢুকেছি, এই সময় হিউস্টন থেকে আপা ফোন করলো। কথা বলছি ফোনে, আর তোমার মেয়ে সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কিছু একটা বলতে চায়। আমি যতো বলি, একটু দেরি করো, ফোনে খালামনির সঙ্গে কথা বলছি, সে ততো চিৎকার করে। শেষ পর্যন্তু পিটিয়ে থামাতে হলো।
বাচ্চাদের মারধর করার পক্ষপাতী বিজু নয়, যদি না সেটা সত্যিকারের গুরুতর কিছু হয়। অথচ রানু তুচ্ছ অজুহাতে মেয়ের গায়ে হাত তোলে। এসব নিয়ে ঝগড়াঝাটি কম হয়নি। বিজু আশেপাশে থাকলে মেয়েকে আগলে রাখে, সরিয়ে নিয়ে যায় রানুর নাগালের বাইরে।
রানুর জবানীতে বেশ বোঝা যাচ্ছে, ফুলটুসের অপরাধ মার খাওয়ার জন্যে যথেষ্ট ছিলো না।
বিজু বলে, শুধু শুধু কেন মারধর করো মেয়েটাকে?
শুধু শুধু? অমন বেয়াদবি করবে কেন?
তোমার জায়গায় আমি হলে আপাকে ফোন একটু ধরতে বলে মেয়ের কথাটা আগে শুনে নিতাম। অথবা ফুলটুসকে বুঝিয়ে বলতাম, ফোনে আমার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে। মারধর করতাম না কিছুতেই। এইসব সামান্য কারণে তুমি ওর গায়ে হাত তুলে কার কী উপকার করছো, তুমিই জানো।
তোমার কাছে তো সামান্যই মনে হবে।
সামান্য না তো কী? তুমিই ভেবে বলো, কার কী ক্ষতি সে করেছে। তার কিছু বলার ছিলো, সে তোমার মনোযোগ চেয়েছে। বাচ্চারা তা সবসময় চায়, তাতে দোষের কিছু নেই। চিৎকার-চেঁচামেচি করে থাকলে নিশ্চয়ই তা অন্যায় হয়েছে। আসলে কী জানো, আমরা হয়তো ওকে ঠিকমতো শেখাতে পারিনি, বাবা-মা ব্যস্ত থাকলে ওকে অপেক্ষা করতে হবে তার কথাটা বলার জন্যে।
তার মানে, তুমি বলছো আমি ওকে কিছু শেখাই না!
বিজু পরিচিত রানুকে দেখতে পাচ্ছে আবার। গ্রীক রেস্টুরেন্টে আজ দুপুরে গিয়েছিলো হয়তো অন্য কেউ, রানু নয়।
সে বলে, আমি কিন্তু বলেছি আমরা, আমিও এর বাইরে না।
রানু তা মানবে কেন? বলে, তোমার ঠেস দিয়ে কথা বলা আমি বুঝি না?
আর কথা নয়। বিজু উঠে পড়ে। পড়ার ঘরে ব্রীফকেস নামিয়ে রাখে। হাতঘড়ি খুলে, পকেট-টকেট খালি করে নিরস্ত্র হয় সে। যুদ্ধবিরতির সময় এখন।
ফুলটুসের ঘরে গিয়ে দেখে, সে ঘুমাচ্ছে। এই সময়ে সে কখনো ঘুমায় না। দিনের ঘুম তার চিরদিনের শত্রু, খুব ছোটোকাল থেকেই। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েকে দেখে বিজু। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে, চোখের পানি শুকিয়ে দাগ রেখে গেছে গালে। দু'হাতে জড়িয়ে ধরা নতুন বারবি। একটা শ্বাস ফেলে বেরিয়ে আসে বিজু।
খানিক পরে ফুলটুসকে ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞেস করে বিজু, কী রে ম্যাকডোনাল্ডস-এ যাবি নাকি আজ?
খুব যাবে। মেয়ের খাওয়া যেমন তেমন, একটা খেলনা তো পাওয়া যাবে! উঠে পড়ে ফুলটুস। বিজু বলে, যা ভালো করে মুখহাতটা ধুয়ে আয়।
গাড়িতে ফুলটুস জিজ্ঞেস করে, আমি না থাকলে মা খুব খুশি হবে, তাই না বাবা?
সে কী রে, এরকম পচা কথা তোর কেন মনে হলো?
মা আমাকে একটুও দেখতে পারে না, শুধু বকে আর মারে।
তুই তো মা-র পেটের ভেতরে কতোদিন ধরে ছিলি, তোকে বলেছি না? ভালো না বাসলে মা তোকে অতোদিন পেটের মধ্যে নিয়ে বেড়াতো নাকি?
ফুলটুস আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, বিজু কথা ঘোরায়। বলে, তোর স্কুল কেমন হলো আজ?
জানো বাবা গ্র্যান্ডপ্যারেন্টস ডে ছিলো আজ! আমার বন্ধু মিশেলের গ্র্যান্ডপা এসেছিলো, অনেক মজার মজার গল্প বলেছে।
মেয়েকে খাইয়ে ফিরে আসতে আসতে ফুলটুসের বিছানায় যাওয়ার সময় হয়ে যায়। সে আবদার তোলে, আজ তো বিকেলে ঘুমিয়েছি, পরে ঘুমাতে যাই, বাবা?
বিজু বলে, কোনো দুষ্টুমি নয়, কাপড় পাল্টে শুয়ে পড়।
ফুলটুসকে বিছানায় পাঠিয়ে সিগারেট নিয়ে প্যাটিওতে যায় বিজু। হঠাৎ খুব ক্লান্ত লাগে তার। পুরো সিগারেট না খেয়েই নিবিয়ে ফেলে। রানু টিভির সামনে বসে আছে তখনো। কিছু বলার আগ্রহ হয় না। রাতে খাওয়ার ইচ্ছে নেই বিজুর। বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে সে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো, কতোক্ষণ ঘুমিয়েছে বিজু জানে না। ঘুম ভাঙলো অন্ধকার ঘরে, রানুর শরীরের স্পর্শে। তার মুখের ওপর রানুর তপ্ত শ্বাস। বিজুর একটা হাত তুলে নিয়ে নিজের বুকের ওপর স্থাপন করেছে রানু। দোষ নিঃশব্দে স্বীকার করে নেওয়ার নিজস্ব পদ্ধতি তার।
বিজু অনড় থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু শরীর বড়ো বিশ্বাসঘাতক। সে শুধুই রক্ত আর মাংস, স্থূল তার চাওয়া। ভয়ানক নির্লজ্জ, লোভী সে। তার অহংবোধ বলে কিছু নেই, আত্মাভিমান নেই। অথচ অহংকার কী ভঙ্গুর!
'যাহাতে অমৃত নাই, তাহা লইয়া আমি কিতা করতাম রে, কিতা করতাম!'
যে অহং কেবল মনে মনে, যাকে শরীরে ধারণ করা যায় না শিরস্ত্রাণের মতো, বর্মের মতো, কী মূল্য আছে তার! কোন কাজে লাগে সে?
'দিস টাইম ইউ'ভ গট নাথিং টু লুজ
ইউ ক্যান টেক ইট ইউ ক্যান লীভ ইট, হোয়াটএভার ইউ চুজ
আই ওন্ট হোল্ড ব্যাক এনিথিং
অ্যান্ড আই'ল ওয়াক আওয়ে আ ফুল অর আ কিং...'
Wednesday, October 24, 2007
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment