১৯৭৫-এ শেখ মুজিবকে সপরিবারে খুন করার পর সেনাতন্ত্র শুরু হয়েছিলো। স্বাধীন বাংলাদেশে সেই প্রথম। এখনকার বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ ছিলো ২৩ বছর, তার শেষ ১৩টি বছর কেটেছে সামরিক শাসনের জগদ্দল কাঁধে নিয়ে। আমরা তা থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম বলে যুদ্ধ হলো। অথচ নবীন রাষ্ট্রের জন্মের সাড়ে তিন বছরের মাথায় আবার সেনাশাসনের ভূত।
হতভম্ব, বিহ্বল মানুষ। কাঁদতেও যেন ভুলে গেলো। তার খানিকটা আতংকেও। পাকিস্তানী সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা এবং যুদ্ধের সময়ে সেনাবাহিনীর অপরিমেয় নৃশংসতার স্মৃতি তখনো টাটকা। তারা জানে উর্দিধারীদের কাছে যুক্তির কোনো জায়গা নেই।
সরল যুক্তিতে অবশ্য মানুষ বোঝে, যেহেতু শেখ মুজিবের হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতরা এবং সেই হত্যকাণ্ডের বেনিফিশিয়ারিরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, শেখ মুজিবের নাম প্রকাশ্যে উচ্চারণ করাও অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে। হত্যাকারীরা শেখ মুজিবকে বেঈমান হিসেবে বেতার-টিভিতে ঘোষণা দিয়েছিলো, যদিও কথিত সেই বেঈমানী আজও প্রমাণিত হলো না। সুতরাং চুপ করে না থেকে মানুষের তখন আর উপায় কী?
একটা কথা খুব জোরেশোরে বহুদিন ধরে প্রচারিত - শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডে অসংখ্য মানুষ নাকি খুশিতে পাড়ায় পাড়ায় মিষ্টি বিতরণ করেছিলো। এরকম আদৌ ঘটেনি, তা নয়। কিন্তু তা ব্যতিক্রমের হিসেবে থাকা উচিত। এই ঘটনাগুলি ছিলো নিতান্তই কিছু কিছু শহরাঞ্চলে, গ্রামে এই ধরনের ঘটনার কথা কেউ শুনেছেন বলে জানা যায় না।
অঘাষিতভাবে 'নিষিদ্ধ' শেখ মুজিবের নাম প্রথম প্রকাশ্যে উচ্চারিত হলো একজন কবির মুখে। ১৯৭৭ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে। শহীদ মিনার হয়ে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছেন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে। বইমেলার শেষদিন (তখন একুশে ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা শেষ হতো) বলে অতিরিক্ত কিছু ভিড়।
মঞ্চে কবিতাপাঠ চলছে। কবিরা একে একে মঞ্চে উঠে কবিতা পড়ে চলে যাচ্ছেন। পরেরজন আসছেন। কবিতার শ্রোতা খুব বেশি কোনোকালেই হয় না, কেউ কেউ মনোযোগ দিয়ে শুনছেন, বেশিরভাগই ব্যস্ত অন্যকিছুতে। শীর্ণ ও দীর্ঘকায় শশ্রুমণ্ডিত নির্মলেন্দু গুণ মঞ্চে এলে কিছু মনোযোগ আকর্ষণ করেন। তাঁর বেশ কিছু কবিতা পাঠকপ্রিয়তা পেয়ে গেছে তখন। কিন্তু আজ তিনি যা করবেন, তার জন্যে কেই তৈরি ছিলেন না। মাইক্রোফোনে শেখ মুজিবের নাম উচ্চারিত হতেই সবাই সচকিত। কী হচ্ছে এটা? লোকটা পাগল নাকি? এক্ষুণি তো তাকে ধরে নিয়ে যাবে!
কাউকে কাউকে ত্রস্তপায়ে বাংলা একাডেমির সীমানা ছেড়ে চলে যেতেও দেখা যায়।
নাঃ, এই নিয়ে অবশ্য নির্মলেন্দু গুণকে বিশেষ কোনো হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়নি শেষ পর্যন্ত। তবে এই ঘটনা অন্য অনেক সম্ভাবনা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলো।
নির্মলেন্দু গুণের কবিতাটি নিচে তুলে দেওয়া হলো:
আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি
নির্মলেন্দু গুণ
সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হ’য়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
শহীদ মিনার থেকে খ’সে পড়া একটি রক্তাক্ত ইট গতকাল আমাকে বলেছে
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল খুব ভালোবাসি, ‘সমকাল’
পার হয়ে যেতে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
শাহবাগ এ্যভিন্যুর ঘূর্ণায়িত জলের ঝর্ণাটি আর্তস্বরে আমাকে বলেছে
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে,
ভালোবাসা আছে শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
এই বসন্তের বটমূলে সমবেত ব্যথিত মানুষগুলো সাক্ষী থাকুক,
না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুষ্কভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের ঐ গোপন মঞ্জরীগুলো
কান পেতে শুনুক,
আসন্ন সন্ধ্যায় এই কালো কোকিলটি জেনে যাক -
আমার পায়ের তলার পুণ্য মাটি ছুঁয়ে
আমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম, আজ সেই পলাশের কথা
রাখলাম, আজ সে স্বপ্নের কথা রাখলাম।
আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।
Saturday, October 20, 2007
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment