Sunday, October 21, 2007

টেলিফোনে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে

হ্যালো, পীযূষবাবুর সঙ্গে কথা বলতে পারি?

ও তো এই মুহূর্তে অফিসে নেই। কে কথা বলছিলেন জানলে পীযূষ ফিরলে জানিয়ে দেবো।

আমার নাম শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতা থেকে এসেছি।

লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়?

তাঁর লেখা কেউ পড়ে না বলে তিনি বিশ্বাস করেন। অনেক লেখায় উল্লেখ করেছেন ঠাট্টা করে, আক্ষেপ করে। সুতরাং শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমি চিনি - তখনো বলিনি, আমি তাঁর লেখার অনুরাগী পাঠক - জেনেই আগ্রহী হয়ে উঠলেন মনে হলো। বললেন, আপনি আমার লেখা পড়েছেন?

হ্যাঁ, পড়েছি।

কোন কোন লেখা?

কুবেরের বিষয় আশয়, ঈশ্বরীতলার রূপোকথা, রূপোকুঠির পরী, সরমা ও নীলকান্ত, বৃহন্নলা, নির্বান্ধব ইত্যাদি এবং অনেকগুলো গল্প। এবারের বইমেলা থেকে কিনেছি হাওয়াগাড়ি-র দু’খণ্ড, হিম পড়ে গেল, সওদাগর আর দূরবীণের উল্টোদিকে। এগুলো এখনো পড়া হয়নি।

তালিকা শুনে বললেন, ঢাকায় বসে আমার এতোগুলো লেখা কেউ পড়েছেন ভাবতেই পারছি না।

এই টেলিফোন সংলাপের সময় ১৯৮২, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর ঊনিশ বছর আগে।

কুবেরের বিষয় আশয় দিয়ে আমার শ্যামলে হাতেখড়ি। তারপর নির্বাচিত গল্প। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পশ্চিম বাংলার সাম্প্রতিক লেখালেখির খোঁজখবর রাখার উপায় প্রায় ছিলোই না। ‘...তাই দেরি হলো যে তোমার কাছে আসিতে...।’

নির্বাচিত গল্পের ভূমিকায় সেই ১৯৭২ সালে সন্তোষকুমার ঘোষ লিখেছিলেন, শ্যামলের লেখালেখি নিয়ে কোনোরকমের ভবিষ্যদ্বাণী করা চলে না। ‘...শ্যামল কখনও “অলসো র‌্যান্” হবে না। ও সেই জাতের লেখক, যারা হয় এস্পারে নয় উস্পারে। কোন না কোন চরম বিন্দুতে। গণ্ডার মারবে অথবা ভাণ্ডার লুটবে। নতুবা থাকবে বিলকুল ফতুর হয়ে। মাঝামাঝি ত্রিশঙ্কু দশায় কিছুতেই না।’ ভবিষ্যদ্বাণীটি সত্যি হয়েছিলো, শ্যামল ফতুর হয়ে থাকেননি, গণ্ডারই মেরে যাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত।

কৃত্তিবাস পত্রিকায় রূপোকুঠির পরী পড়ে মনে হয়েছিলো, এভাবেও লেখা যায়! নিতান্ত মজা, কিছু শ্লেষ আর ইয়ার্কি-ঠাট্টা করার ভঙ্গির মধ্যেও না-বলা কিছুই থাকে না - গভীর কথাগুলো, ভাবনাগুলো নির্বিকারভাবে মিশেল দেওয়া।

আর ঈশ্বরীতলার রূপোকথা। তাঁর গড়া আরেক আশ্চর্য জগত। শহুরে অনাথ বসু মফস্বলে বসতি করেছে, চাষবাস করে। একটা নতুন কিছু করতে চায়, তার ভেতরে মজা খোঁজে। ব্যর্থ হয়ে শেষমেষ আবার কলকাতায় ফিরে আসে। ওপরে ওপরে মোটা দাগে এই তো গল্প। কিন্তু শ্যামল শুধু গল্প বলবেন না। বলবেন আরো অনেককিছু। আর সেখানেই লেখক শ্যামলের প্রকৃত ক্ষমতার পরিচয়।

ঈশ্বরীতলায় মানুষ এবং জন্তু-জানোয়ার সবাই একেকটি চরিত্র, কোনো পার্থক্য নেই। অনাথের পোষা কুকুরটির নাম বাঘা, ধাড়ি ছাগলের নাম শুক্লা, গাইয়ের নাম উমা, উমার বাছুর কানাই, হুলো বেড়ালের নাম বজ্জাত, অরুণ-বরুণ দুই রাজহাঁস। অনাথের বাড়ির বাসিন্দাদের বিবরণ শ্যামল প্রথমে দিচ্ছেন বেশ একটা তালিকা দেওয়ার ঢঙে। পোষা জীবজন্তুগুলোর সঙ্গে মানুষগুলোও তালিকায় একই বাক্যে জায়গা করে নেয়। মানুষগুলোর আলাদা মর্যাদা দেওয়া নেই কিন্তু।

‘...গাঁয়ে এসে বাড়ি করেছে আজ আট বছর। এখানে আসার সময় ছোট খুকীর বয়স ছিল তিন মাস। বড় খুকীর চার বছর। এখন ওরা দু’জন বড়টি হয়ে উঠছে। ...একেই কলকাতা থেকে এলে অনাথের বাড়িটাকে চিড়িয়াখানা বলে। পাতিহাঁস আটটা রাজহাঁস দুটো (বড় খুকীর শখ), ছাগল পাঁঠাপাঁঠি নিয়ে এগারোটা, অ্যালসেসিয়ান একটা (মাদি), মুরগি একান্নটা (সবই হোয়াইট লেগহর্ন), শান্তার তিনটি আশ্রিত বেড়াল (একটি হুলো), দুটি খুকী আর একটি বউ নিয়ে অনাথের এই চিড়িয়াখানা।

‘এ ছাড়া বাড়ির গায়েই ঝোপেঝাড়ে গুটিকয় বিষধর এবং কয়েকটি নির্বিষ জিনিস আছে। সাপুড়েরা এসে কেউটে পেলে ধরে নিয়ে যায়। নির্বিষ দাঁড়াশ সাপ পেলে ছেড়ে দেয়। তারা কিশোর বালকের মতই ফন ফন করে আলের ওপর ফণা তুলে মৌজা ঈশ্বরীতলার এক দাগ থেকে আরেক দাগে চলে যায়। লম্বায় সাত-আট ফুট। এক বেলায় তিন-চারটে মৌজা পার হয়ে যাবে পাখির ডিমের লোভে। যখন যেমন পায় আর কি।’

কলকাতায় অফিস করে অনাথ। ঈশ্বরীতলা স্টেশনে নেমে সন্ধ্যায় সে বাড়ি ফিরছে। স্টেশন থেকে তার বাড়ির পথের বিবরণও ভারি সংক্ষিপ্ত, অথচ কী জীবন্ত। চোখের সামনে ছবি হয়ে উঠতে থাকে তার আলো ঝলমল বাড়িটি।

‘ফাল্গুন মাসের জ্যোৎøা রাত। ইলেকট্রিক ট্রেন, স্টেশনবাজার, ধানের গোলা, ব্যাঙ্কবাড়ি, গম ভাঙানোর কল, আলুরচপের দোকান, ইরিগেশনের ক্যানাল ব্রীজ পেরিয়ে এসে অনাথবন্ধু বসু তার বাড়ির রাস্তা ধরল। এখন এ জায়গায় সত্যযুগ। ক্যানালের গা ধরে লাল সুরকির রাস্তা। এই আধা গাঁ-গঞ্জের সবেধন খেলার মাঠ এদিকেই। তারপর কলাগাছের জঙ্গলে ঘেরা এক-একখানা বসতবাড়ি। রাস্তার মাঝে মাঝে ডালপালা ছড়ানো খিরিশ গাছের বিশাল ছাতা। তিনখানা গেরস্থ ঘর ছাড়িয়ে অনাথের নতুন বাড়ি। নতুন লাইনটানা ইলেকট্রিক আলোয় বাড়িটা এখন সন্ধ্যেরাতের স্টীমারের ডেক একদম। চারদিকে অন্ধকার। মাঝখানে উঁচু ভিতের বাড়িটা আলো-ঝলমলানো।’

‘এখন এ জায়গায় সত্যযুগ’ - একটিমাত্র ছোটো বাক্যে ঈশ্বরীতলার চরিত্র বলা হয়ে যায়। অনাথের পোষা জীবজন্তুগুলো অবলীলায় অনাথের সঙ্গে কথা বলাবলি করে তাদের নিজস্ব ভাষায়, লেখক আমাদের তা অনুবাদ করে শোনান :

‘প্রথমে তীরবেগে ছুটে এসে বাঘা তাকে রিসিভ করল। বয়স দেড় বছর। এর ভেতরেই তিনজন চাষীকে কামড়েছে। তাদের প্রত্যেককে পনর টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। গম্ভীর কালোয়াতি গলায় ডাকে। ভীষণ ভীতু। গাঁয়ের দিশী কুকুররা একজোট হয়ে তাড়া করলে লেজ তুলে পালাবে। উঠোনে শান্তা একটা গর্ত করে ফ্যান ঢেলে দেয় রোজ। চুক চুক করে খায়। ইদানীং বড়ি দিয়ে রান্না লাউশাকও ফেলে না। চেটে খেয়ে নেয়।

‘বাড়ির কম্পাউণ্ডে ঢুকতে ছাগলগুলো প্রথম কান লটপট করে অনাথকে বলল, এত দেরিতে ফিরলে?
‘অনাথ বলল, ব্যা। ব্যা। জায়গাটা নির্জন। সাক্ষী শুধু বাঘা। সে লেজ তুলে আর গলা তুলে অনাথের আদর চাইছিল। শান্তা কিংবা খুকীরা বাড়ির ভেতরে। তারা তখনো জানে না, তাদের সবচেয়ে বড় জন্তুটা এইমাত্র বাড়ি ফিরল।

‘ছাগলরা শুনলো, সোনারপুরে গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ। কৈফিয়ৎ শুনে তারা অনাথকে আর কিছু বলল না। ...’

সরল ছোটো ছোটো বাক্যে চারপাশকে কী জীবন্ত করে ফেলেন শ্যামল। কেমন জায়গা ঈশ্বরীতলা? কোথায়? ‘...এখন ঈশ্বরীতলা গ্লোবের বাইরে। দূরে জ্যোৎস্নার ভেতরে একটা লাল দগদগা আগুনের ফুলকি। ডিসট্যান্ট সিগন্যালের ওই স্মৃতিটাই শুধু পৃথিবীর সঙ্গে এখন ঈশ্বরীতলার একমাত্র যোগ।’

এই বইয়ে শ্যামলের নিজের লেখা ভূমিকাটি নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। এখানে তিনি জানাচ্ছেন তাঁর লেখকজীবনের শুরুটা কেমন করে হয়েছিলো। লিখেছেন তাঁর দেখা পৃথিবীর কথা, সমাজ-সম্পর্কের কথা। অভিজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কথা। বিশ্বাসের কথা। এই রচনাটি লেখালেখির খুদে ব্যাকরণ হিসেবেও চলে যেতে পারে। নিজের লেখালেখির শুরুর কথা শ্যামল বলছেন এভাবে :

‘...দু’একখানা বই ভীষণ ভাল লাগতে লাগল। দু’একটা গল্প। একটি দুটি ঘটনা। দুটি একটি মানুষ। একবার জ্বর থকে উঠে আন্দাজে খাতায় কাটাকুটি করতে করতে লিখতে লাগলাম। খানিক পরে দেখি - আমি জানিনা - এমন সব জিনিস লিখছি। কতকগুলো চরিত্র নিজেরা বানিয়ে বানিয়ে কথাও বলছে। খেলাটা মন্দ না তো!
‘এরকম ভাবে লেখা প্রথম লেখাটি পরে ছাপা হয়েছিল। খুবই সাধারণ লেখা। কিন্তু লিখে ফেলে অবাক হয়েছিলাম। জানতে পেরেছিলাম - ও, তাহলে এইভাবে লেখে!

‘দেশ বিভাগের দিনেও বুঝতে পারিনি - আমাদের সাজানো বাড়ি, সুন্দর সম্পর্কগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রথম দর্শনে কলকাতাকে বড় নিষ্ঠুর লেগেছিল। ভাবতেই পারিনি - পরে এমনভাবে কলকাতার প্রেমে পড়ব। এখন জানি - যদি কোথাও কিছু হয়ে থাকি - তার মূলে কলকাতা। এত বড় শিক্ষয়িত্রী খুব কম দেখা যায়।

‘একজন লোক তখনই লেখে - যখন লিখতে বসে তার বিশ্বাস হয় - এমন জিনিসটি আগে আর কেউ লেখেনি। পরে হয়ত সে বিশ্বাস ভুলও প্রমাণিত হয়। কিন্তু লেখার সময় ওই বিশ্বাসটুকু চাই-ই চাই। নয়ত লেখা যায় না।
‘কিন্তু আমার তো তেমন কোন বিশ্বাস ছিল না। থাকবার কথাও নয়। কারণ সত্যিই দাবি করবার মত আমি তো তেমন কোন জিনিসই জানি না।’


ছোটো ছোটো সাফল্য আসছিলো কিন্তু অনেক বড়ো দামে। অপমান আর হতাশার সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধের মূল্যে শ্যামলের সেইসব সাফল্য।

‘সেই সময় একটি জিনিস আমাকে সাহায্য করেছিল। সব দিক থেকে অপমানের ঝাপটা। সব দিক থেকে ব্যর্থতার বাতাস। বেসরকারী কলেজের অধ্যক্ষ ছাত্র-রাজনীতির জন্য আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে স্বচ্ছন্দে ফোর্থ ইয়ারের শেষে ডিসকলেজিয়েট করলেন। তখন আর কিছুই করার নেই। এর কিছু আগে আমার এক সহোদরকে পটাসিয়াম সায়ানাইডে শেষ হতে দেখলাম। নিুবিত্ত পরিবারে একটি গ্র্যাজুয়েট মানে কিছু আশা। তা হওয়া গেল না। কলকাতা কখনো কলকাতা। খালাসীর চেয়ে কিছু ওপরে - ফারনেস-হেলপার হয়ে তিরিশ টনের ওপেন হার্থ ফারনেসে ঢুকলাম। ...

‘অনেক পরে একবার গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলাম। জিনিসটা এত বাজে তার আগে জানতাম না। গ্র্যাজুয়েট হয়ে গেলাম - অথচ গায়ে একটা ঘামাচিও বেরোলো না।

‘...ঘুরে ফিরে যার কথা লিখতে চেয়েছি সে আমারই জানাশুনো একজন লোক। তার নাম শ্যামল গাঙ্গুলী। তার মজা তার আনন্দ। কল্পনায় তার গুলি চালানো কিংবা স্বপ্নে তার ডানা মেলে ওড়া। এই লোকটিকে কখনো শস্তার ফার্নিচারের দোকানদার হিসেবে গাঁয়ের বুনো তেঁতুল গাছ কিনতে পাঠিয়েছি। এই লোকটিই খুনের বাড়ি ভাড়া নিচ্ছে। আবার এই লোকই গাঁয়ের হাতুড়ে ডাক্তার হিসেবে অভাবী তাড়িখোর মাতালের বউকে সংসার থেকে ভেগে চলে আসার পরামর্শ দিচ্ছে।...'

গ্রামীণ জীবন নিয়ে, চাষবাস এবং চাষীদের নিয়ে শ্যামলই প্রথম লিখেছেন বাংলা সাহিত্যে, তা নয়। বিভূতি-মানিক-তারাশঙ্কর লিখেছেন পথের পাঁচালী, পদ্মানদীর মাঝি আর হাঁসুলী বাঁকের উপকথা। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় নিজে বারবার এই তিন ব্যানার্জীর রচনার নিরিখে নিজেকে যাচাই করতে চেয়েছেন। তাঁদের অতিক্রম করতে পারেননি, এই ধারণায় খেদও করেছেন। সমরেশ বসুও গ্রামীণ জীবনের ছবি এঁকেছেন গঙ্গা-য়। এঁদের সাহিত্যের তুলনামূলক বিচার বা সেই নিরিখে শ্যামলের জায়গা কোথায়, সে অনেক বিশদ আলোচনার ব্যাপার। কিন্তু দেখার বা বলার একটি নিজস্ব ধরণ যে শ্যামলের আয়ত্ত্বে, তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না। তিনি এখনকে দেখেন পেছনের দিনগুলোর কথা মনে রেখে, চিরকালের প্রবহমানতার ভেতরে। মানুষের মৌলিক প্রবণতাগুলি ভোলেন না। সে তুলনায় প্রকৃতি কতো উদাসীন, নির্বিকার ও স্বয়ম্ভু তা-ও তাঁর চোখ এড়ায় না।

‘জমি। এর সঙ্গে জড়িত দখল। এর সঙ্গে জড়িত আশ্রয়। এর সঙ্গে জড়িত অঙ্কুর। কিংবা নবজন্ম। আর জড়িত লোভ।

‘...আকাশের নিচে নির্জনে কত মাঠ পড়ে থাকে। তাদের ওপর দিয়ে হাঁটবার সময় অদ্ভুত লাগে। প্রান্তরের সাতটা তালগাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। এরাই এই প্রান্তরের রক্ষক। ধানক্ষেত খুঁড়ে লোকে কচ্ছপ বের করছে। পুকুর কাটতে গিয়ে বারো হাত নিচে নৌকার গলুই পাওয়া গেল। একদা তাহলে এখানে নদী ছিল! জমির অনন্ত রহস্য। তার সঙ্গে কোর্ট-কাছারি। দলিল-দস্তাবেজ। উকিল-মুহুরি। লোভ। শরিকানি। অন্তহীন।

‘আসলে পৃথিবীটা যেমন আছে তেমন থাকে। যুগে যুগে মানুষ এসে দখল দাবি করে। কখনো অর্থবলে। কখনো লোকবলে।

‘এই ব্যাপারগুলো লেখায় চলে আসতে লাগল।

‘জমির সঙ্গে সঙ্গে আমার অজান্তেই আমি ফসলে চলে গিয়েছিলাম। একটি ধানচারা। তাকে বড় করে তার থেকে ধান তোলা। তার স্বভাব। সেই ধানের সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষের কোন অতীত থেকে নাড়ির যোগ - সবই আমাকে ভাবাতে লাগল। সেই প্রথম দেখলাম - হাল দিতে দিতে চাষী বলদের সঙ্গে আপন মনেই জীবন, সংসার, বর্ষা, বউ, চাষবাস নিয়ে কথা বলে আর তার লেজ মোচড়ায়। চাষী ও বলদ একসঙ্গে ডোবার জলে মুখের ছায়া দেখে। চাষী-বউয়ের হাতেগড়া রুটি গোহাটা থেকে ফেরার পথে চাষী খিদের চোটে নতুন বলদের সঙ্গে ভাগ করে খায়। ...এর পাশে সোফিস্টিকেটেড ইস্পাত কারখানা, ফানুস, গড়িয়াহাটার মোড়, এককালের ছাত্ররাজনীতি সবই তুচ্ছ লাগতে লাগল। ...ফসলেরও একটা নেশা আছে। সে নেশা আসলে দখলের। আরও কত করায়ত্ত করা যায়!’

একজন লেখক কি লিখবেন, লেখার বিষয়বস্তু কি হবে তা নিজেকেই ঠিক করে নিতে হয়। এই ঠিক করে নেওয়াটাও লেখকের মনোভঙ্গির কাঠামোর ওপর নির্ভর করে। সেটিও পাল্টে যায় সময়ের সঙ্গে। আবার কেন লিখছি, এই বিষয়টি ঠিক জানা থাকাও লেখকের জন্যে জরুরি। শ্যামল তাঁর নিজের উত্তরণের বিবরণ দিচ্ছেন এইভাবে :

‘...এক সময় ধারণা হয়েছিল, বেকার যৌবন নিয়েই বোধ হয় লিখে যাব। কেননা এ বিষয়ে অন্তত দু’খানি উপন্যাস এবং অনেকগুলো গল্প লিখেছিলাম। এক সময় মনে হয়েছিল, সদ্যযৌবনের প্রেম ভালবাসাই বুঝি আমার লেখার বিষয়। একদিন দেখলাম এসব লিখতে গিয়ে তো মেয়েটির চেহারা-স্বাস্থ্য কেমন তাও লিখতে হয়। এক জিনিস কতবার লেখা যায়! হঠাৎ দেখা হল সুজাতার সঙ্গে। তার পরণে বাসন্তী রঙের শাড়ি। মোটা বেণীটা বুকের ওপর এসে পড়েছে। তারপর? তারপর কি লিখব? রিডিকিউলাস!

‘আরও মুশকিলের কথা - আমার কোন রাজনৈতিক বিশ্বাস নেই। কোনদিন মনে হয়নি - অমুকে ক্ষমতাচ্যুত হলে এবং সে জায়গায় অমুক এলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি সর্বদাই জানি - রাষ্ট্র ও প্রশাসন মানে একটি অন্ধ কবন্ধ দানব। সেজন্যে কেউ ব্যক্তিগতভাবে দায়ী নয়। এটা একটা ব্যবস্থা বা প্রথা। এক সময় ছিল, যখন আমেরিকা পরমাণু বোমা ফাটালেই খবরের কাগজের প্রতিবাদপত্রে আমরা সই দিতাম। রাশিয়াও যখন ফাটালো তখন কোন কোন রাজনৈতিক-বিশ্বাসী সমসাময়িক সই দিলেন না। তারপর সময় যেতে বুঝলাম - লিখতে হলে এই সইসাবুদ সর্বৈব বাজে ব্যাপার। ...

‘লেখার উদ্দেশ্য একটিই। তা হল উন্মোচন। অনুসন্ধানের পথে পথে এই উন্মোচন। বিনা মন্তব্যে সরল বাক্য সাজিয়ে এগিয়ে যাওয়াই আমার পদ্ধতি। আমি লিখতে চাই সবচেয়ে কম। আর চাই আমার না-বলাটুকু পাঠকের মনে ক্রমিক পুনঃসৃষ্টি করে চলুক। সে-ই পথ খুঁজে পাক। তাই সাধারণত আমার কোন রচনাতেই জটিল বাক্য থাকে না। কেউ বলেন বড় কাটা-কাটা লাগে। আমি এটা ইচ্ছে করেই করি। কেননা এটাই আমার পদ্ধতি।...’

শ্যামলের লেখার সঙ্গে পরিচিত হতে গিয়ে প্রথমেই মনে হয়, এমন তো আগে পড়িনি! লেখার বিষয়বস্তু, বলার ধরণ সবই অভিনব। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা টেনেছিলো আমাকে, তা হলো তাঁর বৃষ্টিবাহী মেঘদলের মতো ইঙ্গিতবাহী ও সম্ভাবনাময় বাক্য গঠনের একেবারে নিজস্ব একটি ভঙ্গি। আর এতো অল্প কথায়ও যে কতো বেশি বলে ফেলা যায়, আগে কে জানতো! মাত্র দু’চারটি সংক্ষিপ্ত সরল বাক্যে একেকটি চরিত্রের ছবি এঁকে ফেলা। যে কোনো কিছু নিয়েই পরিহাস করার ঝোঁক। আর সেই পরিহাসের ভেতরেই মেশানো বুক মোচড়ানো বিষাদ। ঈশ্বরীতলার রূপোকথা থেকেই আবার উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। অনাথবন্ধু বসু তার জীবন, সংসার, তার চারপাশের পৃথিবী নিয়ে কি ভাবে, শ্যামল লিখছেন :

‘...এ ক’বছরে সে অন্তত দু’খানা এমন মোটা ডাইরিতে নানা কথা লিখে রেখেছে।...একবার একখানা ডাইরির ওপর লিখে রেখেছিল - ‘জীবনের মানে’। এখানে সে বাতাসের ভেতর আলো দেখতে পায়। রোজ ভোরবেলা উঠে পরিষ্কার বুঝতে পারে - এখন তার খরচের জন্যে সামনে টাটকা, আনকোরা একটা পুরো দিন পড়ে আছে। রোজকার ভোরবেলার সূর্যের আলো তার নতুন লাগে। এইভাবে কত কোটি বছর ধরে দিন আসে সকালবেলা। তার মাঝখানে এই সংসার করা আসলে একটি নিরর্থক খেলা। ব্যাপারটার আলুনি দোষ যাতে না ধরা পড়ে সেজন্যে কটু কথায় মেশানো একজন বউ থাকে। তার ছেলেমেয়ে হলে দয়ামায়া জিনিসটা পেঁপের আঠা হয়ে গড়াতে থাকে। তাই দিয়েই কোনক্রমে জোড়াতোড়া দিয়ে একটা সংসার।...

‘অনাথবন্ধু বসু বুঝলো, তার জীবনটা এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। আর এগোচ্ছে না। ঊনচল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত এতগুলো স্টেশনের সব জায়গার কথা মনে নেই তার। একটা জংশনের নাম - বাবা। একটা বড় স্টেশন ছিল - মা। এসব জায়গায় সে জল খেতে নেমেছে। চা খেয়েছে। চোখে কয়লার গুঁড়ো পড়লে ওখানে নেমে স্টেশনের কল থেকে জলের ছিটে দিয়েছে।’

স্বীকার করতেই হবে, দুপুরে ভাতঘুমের আগে ‘গল্পের বই’ পড়া যাঁদের শখ, শ্যামলের লেখা সেইসব ক্যাজুয়াল পাঠকের কাছে দুরূহ মনে হবে। তাঁর লেখার ভেতরের প্রচ্ছন্ন শ্লেষ ও পরিহাসপ্রিয়তা অনভ্যস্ত পাঠকের কাছে খানিকটা ধোঁয়াটে ও অপ্রাসঙ্গিক, এমনকি অপ্রিয়ও লাগতে পারে। কিন্তু শ্যামল খুব সচেতনভাবেই এসব পাঠকের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চাননি। তিনি চেয়েছেন নিজের ভাবনাকে পাঠকের মধ্যে সঞ্চারিত করতে। চেয়েছেন পাঠককে ভাবাতে। তিনি সেই পাঠক চেয়েছেন যে ভাবতে ইচ্ছুক। চাননি, ভাতঘুমের আমেজের মধ্যে তাঁর লেখা ডুবে যাক।

লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কোন জিনিসগুলো তাঁর লেখায় তুলে আনতে চান? এক জায়গায় লিখছেন :
‘পৃথিবীতে একেক সময় মনে হয় - কোনো ঘড়ি নেই, দিন নেই, নাম নেই, বন্ধু নেই, আত্মীয় নেই। এ কোথায় এসে পড়লাম। আর কতদিন এখানে থাকতে হবে। যাবার সময়টা কেমন হবে কে জানে। আবার নিশুতি রাতে ঝমঝম বৃষ্টির ভেতর মশারিতে আর কেউ নেই। সন্তানরা বড়ো হয়ে চলে গেছে। বৃষ্টির ধারায় পাশের পুকুরটাও মুছে গেছে। পুরনো ক্যালেণ্ডারে বাদুলে পোকা বসলো থপ করে। বর্ষীয়সী স্ত্রী আত্মীয়-বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ফেরেননি। তখন বিছানায় শুকনো কাঁথা জড়িয়ে টের পাওয়ার চেষ্টা করি - বিশ-পঁচিশ বছর আগে সন্তানদের এ্যা করা ভিজে গন্ধ কাঁথায় আছে কি না। ভাবতে ভাবতে সেই কাঁথা জড়িয়েই ঘুমিয়ে পড়ি। ভাবি আর যেন বেঁচে না উঠি। একদম মরে যাই। - এসব কথা তো লিখতে পারিনি।

‘আবার ভাই-বোন-বন্ধুবান্ধব-ছেলে-মেয়েতে ভরা বারান্দা আনন্দে টলটল করছে। একেকটা কথায় হৃদয়ের ভেতরকার মানুষকে ছুঁয়ে থাকার মানুষী সুখ তিরতির করে বহে যায়। সবাই সবার ওমের ভেতর রয়েছি। পরদিন দুপুরে সেই বারান্দায় একটি ডেয়ো পিঁপড়ে আড়াআড়ি একা পার হচ্ছে। কী শূন্যতা! - এ কথা লিখতে পারিনি।’

কিন্তু এক জীবনে শ্যামল যা লিখতে পেরেছেন, তা-ও সামান্য নয়।

তাঁর মৃত্যুর সংবাদ পাই এক বয়ঃকনিষ্ঠ কবিবন্ধুর ই-মেল থেকে। ই-মেল-এর সূত্র ধরে আনন্দবাজারের সংবাদটি পড়ে কষ্ট আরো বাড়ে। সংবাদ পরিবেশনের ভঙ্গিটি বড়ো দায়সারা লাগে। যে লেখক এই পত্রিকাগোষ্ঠীকে এতো দিয়েছেন চাকরি এবং লেখালেখির সূত্রে, তাঁর মৃত্যুসংবাদের লাইন ক’টি বড়ো অপ্রতুল বলে মনে হয়। শ্যামলের সঙ্গে আনন্দবাজারের মাঝখানে একসময় খুবই খারাপ সম্পর্ক গেছে, সবাই জানে। ইদানিং সেটি জোড়া লাগছিলো।

কিন্তু সংবাদ পড়ে সংশয় থাকে না, পুরনো ঘা শুকিয়ে যায়নি। আনন্দবাজারের প্রচুর সুকৃতি আছে। লেখক তৈরি, প্রকাশনায় সৌকর্য ও আধুনিকতার প্রচলন এবং পাঠকের রুচির মানদণ্ড তৈরি করার কাজটা তারা বহু বছর ধরে করে আসছে। কিন্তু তাদের সুবিখ্যাত গোষ্ঠীপ্রীতি আর দলাদলির খবর সাহিত্যের খবর যাঁরা রাখেন তাঁদের সবারই কমবেশি জানা। আনন্দ পুরস্কার কে না পেয়েছে! অনেক যোগ্য লেখক যেমন পেয়েছেন, তেমনি অনেকে ভুল কারণেও সেটি দখলে পেয়ে গেছে। শ্যামলের কপালে আনন্দ পুরস্কার জোটেনি। কেননা, নিয়মছাড়া উদ্ধত শ্যামলের পক্ষে আনন্দবাজারের গুড বুকস-এ থাকা সম্ভব ছিলো না। আনন্দ পুরস্কার পাওয়ার ব্যাপারে সেটি একটি যোগ্যতা বটে।

পুরস্কারের ব্যাপার কিছু গোলমেলে। ভালো লেখার বিচার পুরস্কার দিয়ে হয়না ঠিকই, কিন্তু ওতে অনেক পাঠক নড়েচড়ে ওঠে, পুরস্কৃত লেখকের লেখা নিয়ে কিছুটা আগ্রহ জন্মায়। আনন্দবাজার শ্যামলকে সম্ভবত সেটি দিতে চায়নি। অকাদেমি অবশ্য দিয়েছিলো। বেশ দেরিতেই।

আমার ধারণায় আনন্দবাজার গোষ্ঠী শ্যামলের ওপরে সবচেয়ে বড়ো অবিচারটি করেছিলো দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত পঞ্চাশ বছরের বাছাই গল্প সংকলনটি নিয়ে। শ্যামল তখন আনন্দবাজারের এক বিখ্যাত ঘোষের সঙ্গে ঘুষোঘুষি করে চলে গেছেন যুগান্তরে। দেশ-এর ওই সংকলনে অনেক অপ্রয়োজনীয় লেখকের রচনাও অনায়াসে জায়গা পেয়েছে, অথচ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে সূচীপত্রে না দেখে বইটি পড়ার আগ্রহই নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। পয়সা দিয়ে কেনা বইটি পরে সযতেœ হারিয়ে ফেলতে সক্ষম হই। অথচ এই দেশ-আনন্দবাজারেই শ্যামলের হাজরা নস্করের যাত্রাসঙ্গী, ধানকেউটে-র মতো অসাধারণ গল্প ছাপা হয়ে গেছে। কী বিস্ময়কর নির্লজ্জ গোষ্ঠীপরায়ণতা! আনন্দবাজার গোষ্ঠী এই করে আসলে তাদের পত্রিকার মুদ্রিত পৃষ্ঠাগুলোকেই অপমান ও অস্বীকার করেছিলো। ক্ষতি শ্যামলের কিছুই হয়নি। বাংলা সাহিত্যের স্বঘোষিত দারোয়ানদের অসমীচীন দৌরাত্ম্য আর হিংস্র দস্যুতার চেহারাই বেরিয়ে পড়েছিলো।

এ বিষয়ে শ্যামল নিজেও আক্ষেপ করে লিখেছিলেন : ‘আমাদের সময় কয়েকজন বিশিষ্ট সম্পাদকে আলোকিত। যেমন: সাগরময় ঘোষ। যেমন: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এঁদের সাহস, এঁদের সুবিচার সুবিদিত। তবে এ কথাও ঠিক - সময়ের জিনিস সময়ে না হলে আর হয় না। পরে তার কোন সংশোধনও নেই। এমন অনেক লেখাই ভালো ছাত্রর মতো ভালো স্কুলে পড়াতে পারিনি বলে স্বল্প প্রচারের খুদে স্কুলে পড়ে সেই ছাত্র বা লেখা বিস্মৃতিতে তলিয়ে গেছে। এক জীবন দিয়ে তার দাম দিতে হচ্ছে। আর ফিরে আসার নয়। এখন চেষ্টা করলেও আর সে-রকম লেখা বেরোবে না। অবহেলা অনেক ক্ষতি করে। কোন সম্পাদকের সুবিচার যদি কারও প্রতি ওজন করে দেখা যায় - ওজনে দেড় মণ - সেই সম্পাদকের অবিচারের ওজন আমার বেলায় ঠিক ততখানিই - দেড় মণ। এর নাম প্রতিবন্ধকতা না বলে আমি বলব ভবিতব্য। এটাই কপালে ছিল।’ এসব কথা তিনি যখন লিখছেন তখনো আনন্দবাজারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নষ্ট হয়নি!

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার টেলিফোন সংলাপটি যখন হয়, আমরা কয়েক বন্ধু মিলে পুরানা পল্টনে হাউজ বিল্ডিং-এর গলিতে তখন বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান চালানোর ব্যবসা ব্যবসা খেলা খেলি। এখন খেলাই মনে হয়, আসলে আমরা তো সত্যি সত্যিই কিছু করে উঠতে পারিনি, আড্ডা দিয়ে, হৈ-হুল্লোড় করে সময় গেছে। দুপুরে দল বেঁধে হৈ হৈ করে রাস্তার উল্টোদিকে কস্তুরী-তে (তখন কস্তুরী ছিলো ওই গলিতে স্মরণিকা জেনারেল স্টোরের পাশের একটা সরু ঘরে, এখনকার অট্টালিকা দেখে সেদিনের কস্তুরী-র চেহারা অনেকের কল্পনায়ও আসবে না) মাছের পেটি দিয়ে ভরপেট ভাত খেতে গিয়েছি। ফিরে এসে ঘন কনডেন্সড মিল্কের সঙ্গে কড়া পাত্তি মারা আইনুলের বানানো চা, সিগারেট, ফের আড্ডা। বিশ্ববিদ্যালয় পাশ দেওয়ার কথা ছিলো, দিয়ে ফেলেছি। গা থেকে তখনো ছাত্র-ছাত্র গন্ধ যায়নি। কিছু একটা করা দরকার, তাই এই করে দিন যায়। কাজ যতোটুকু করি, ভালো করেই করতে চাই, কিন্তু জীবিকা অর্জন জাতীয় ভারি জাগতিক জিনিসগুলো তখনো মগজ একেবারে পচিয়ে ফেলেনি।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ঢাকায় এসেছেন শুনেছিলাম আগেই। আগের দিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরোবার সময় পীযূষ বলছিলো, ও যাচ্ছে দেখা করতে। আমি ইচ্ছে করলে যেতে পারি ওর সঙ্গে।

যাঁদের লেখা পড়ে আমার বিস্ময়মিশ্রিত মুগ্ধতা আছে তাঁদের ব্যক্তিগতভাবে জানার ইচ্ছে আমার কোনোদিনও হয়নি। ভয়, যদি মোহভঙ্গ ঘটে! ঘটনাক্রমে মুখোমুখি হয়ে গেলে গেছে, কিন্তু যেচে যাওয়া আমার কোনোদিনই হয়নি। একটা সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছিলো, বিশেষ করে তাঁর গদ্য রচনার ধাঁচটির আমি এখনো ভক্ত। সুনীল ঢাকায় অনেকবার এসেছেন, অনেকে দেখা করতে যাওয়ার জন্যে সেধেছে। যাইনি।

আরেকটা ব্যাপারও ছিলো। পশ্চিমবঙ্গ থেকে নামী কোনো কবি-লেখক এলে আমাদের এখানকার কিছু কিছু কবি-লেখককে দেখেছি কাঁথা-বালিশসহ হাজিরা দিয়ে পড়ে থাকতে। লেখাটেখা বিষয়ে যদি দু’একটা প্রশংসাবাক্য পাওয়া যায়! তখন বলা যাবে, সুনীলদা আমার এই লেখাটা পড়ে বলেছিলেন, ... ইত্যাদি। কী অদ্ভুত হীনমন্যতা! ব্যক্তিগত জানাশোনা বা বন্ধুত্ব থাকলে অন্য কথা, যেমন সুনীলের সঙ্গে বেলাল চৌধুরী বা রফিক আজাদের। কিন্তু সুনীলের সঙ্গে আমার আলাপ নেই, আমার লেখার সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে কি নেই, আমার সঙ্গে তাঁর কী বিষয়ে কথা হতে পারে! শুধু আড্ডা! কিন্তু এরকম অসমান সম্পর্কের অস্বস্তি নিয়ে আড্ডাও কি হয়! হয় না, যদি আত্মসম্মানবোধের ছিটেফোঁটা থাকে। লেখকের অহংকার তো আরো বড়ো জিনিস। বড়ো বা বিখ্যাত লেখকদের কাছে স্বীকৃতির জন্যে কাঁথা-বালিশ নিয়ে তাঁদের দরজায় যেতে হয় না। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি লেখা থেকেই আবার উদ্ধৃতি দিই :

‘...‘চর’ গল্পটি এক জায়গায় হাতে করে পড়তে নিয়ে গিয়েছিলাম। সভাপতি তখনকার যুবক প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র। সেখানে পড়বার পর রোগামত বয়স্ক এক ভদ্রলোক বললেন, কাল সকালে গল্পটি আমার বাড়িতে নিয়ে যেও।

আপনার ঠিকানা?

ফোন গাইডে পাবে।

আপনার নাম? এ প্রশ্নে সবাই দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।’

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার প্রস্তাব বিবেচনা করার দরকার ছিলো না আমার। পীযূষ সম্ভবত জানতো, শুধু বলার জন্যেই বলা। দ্বিতীয়বার অনুরোধ না করেই বেরিয়ে গিয়েছিলো।

প্রস্তাবটি এবার শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় নিজেই দিলেন ফোনে, আমি পূর্বাণীতে উঠেছি। বিকেলের দিকে চলে আসুন না, আড্ডা দেওয়া যাবে।

পীযূষ আমাকে কাল বলেছিলো যেতে। যাইনি।

সে কি কথা? আজ তাহলে চলে আসুন।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের তো জানার কোনো কারণই নেই যে, আমিও দু’চার পাতা গদ্য লিখে থাকি যা আবার ছাপার অক্ষরে দেখাও যায়। একটা বয়সে নবীন লেখকদের অকারণ অহংকারের পাশাপাশি আরেকটা জিনিস একটু বেশি পরিমাণেই থাকে, এক ধরনের অ্যারোগ্যান্স। আমারও তখন সেই পর্যায় চলছে। নতুন শিং-ওঠা বাছুরের মতো সবকিছুকেই একটুখানি গুঁতিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে। তবু গলাটা যথাসম্ভব নরম করে বললাম, আসলে আপনার সঙ্গে তো আমার দেখা হওয়ার কোনো দরকার নেই।

একটু থমকে গেলেন মনে হলো। কি বুঝলেন, কে জানে! বললেন, এমন করে বলছেন কেন? আমিই তো আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাইলাম।

তা জানি। কিন্তু আপনার লেখা আমি আগ্রহ নিয়ে পড়ি মানেই যে আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে আমার আগ্রহ হবে তার তো কোনো মানে নেই। ধরা যাক আমি গেলাম আপনার কথামতো। কী বিষয়ে আমার সঙ্গে আপনার কথা হতে পারে? আপনি অমুক বইতে এমনটা কেন লিখেছেন, অমুক চরিত্রটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে এসব কথা আমি আপনাকে একদমই বলতে পারবো না। কিন্তু আমার বন্ধুদের সঙ্গে এসব নিয়ে গলা ফাটিয়ে তর্ক করবো। ভুল বুঝবেন না, আপনার সঙ্গে আমার আলাপ করার কমন গ্রাউণ্ডটা তাহলে কোথায়? আর আপনার আশেপাশে অনেক ভক্ত, বন্ধুবান্ধব থাকবে, আমি সেখানে খুবই বেমানান। আমার জন্যে খুব অস্বস্তিকর হবে।

আপনার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে, সামনাসামনি কথা বলতে ইচ্ছে করছে।

যদি সত্যিই আগ্রহী হন, তাহলে পীযূষের সঙ্গে আমাদের অফিসে এসে চা খেয়ে যাবেন। কিন্তু আপনার ওখানে আমার যাওয়া হয়ে উঠবে না।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এবার হঠাৎ বললেন, এতোক্ষণ কথা বলছি, আপনার নামটাই তো জানা হয়নি।

নাম বললাম। এই নামের ঢাকার কোনো নবীন লেখকের নাম তিনি শোনেননি, নিশ্চিত হওয়া গেলো। আমি আশাও করিনি। আর লেখালেখি করার ব্যাপারটা আজও পর্যন্ত নিজে থেকে কাউকে বলতে পারিনি, সেদিন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কেও বলার প্রশ্নই ছিলো না। অর্থহীন। সেরকম কিছু কোনোদিন লিখে উঠতে পারলে নিজেকে বলতে হয় না!

পরের প্রশ্ন এলো, বেলাল চৌধুরীকে চেনেন? আপনার সঙ্গে আলাপ আছে?

সচিত্র সন্ধানীর সম্পাদক হিসেবে বেলাল ভাই আমার দু’একটা লেখা ছেপেছিলেন। এতো কথা না বলে সংক্ষেপে জবাব দিলাম, হ্যাঁ, চিনি। সামান্য আলাপও আছে।

তাঁর শেষ প্রশ্নটিতে খুব মজা পেয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বয়স কতো?

আজ এখন এই পরবাসে বসে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে হঠাৎ এই প্রশ্নটাই যেন স্পষ্ট শুনতে পেলাম আবার, বয়স কতো! ঊনিশ বছর আগে যে প্রশ্নটি আমার কাছে কৌতুককর মনে হয়েছিলো, আজ এখন সেই প্রশ্নই আমাকে বিষণ্ণ করে তোলে।

ওই টেলিফোন সংলাপের সময় তাঁর যা বয়স ছিলো, এখন সেই বয়সের কাছাকাছি পৌঁছতে আমার আর সামান্যই বাকি। নিশ্চিত জানি, এই সময়ে যদি টেলিফোন আলাপটি হতো, সংলাপগুলো অন্যরকম হতো। ওই বয়সে তাঁর লেখালেখির যে সাফল্য, তার কণামাত্রও আমার অর্জন করা হয়নি আজও। সেই নবীন বাছুরের শিং কবেই ভোঁতা হয়ে গেছে। সেদিনের নবীন লেখক আজ পৌঁছে গেছে প্রায় মধ্যবয়সে, লেখালেখির চেষ্টা বন্ধ বহু বছর। অহংকারের কিছু আর অবশিষ্ট আছে?

-------------------------------
রচনাকাল : অক্টোবর ২০০১
-------------------------------

No comments: