যে শহরে বাস করি, তার নাম প্রথম শুনি স্কুলের খুব নিচু ক্লাসে পড়ার সময়। কেনেডি হত্যাকাণ্ডের পরে। আমেরিকার ইতিহাসে এ পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় এই প্রেসিডেন্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছিলেন এ শহরে, ১৯৬৩ সালে। খবরের কাগজ পড়ার বয়স তখনো হয়নি - ছবি দেখা, শিরোনাম পড়া পর্যন্তই। মনে আছে, শহরের নামটি তখন দৈনিক ইত্তেফাকে দেখেছিলাম - ডাল্লাস। ইংরেজিতে দুটো এল দিয়ে লেখা হয় বলে।
আমাদের বাড়িতে তখন আমেরিকার রীডার্স ডাইজেস্ট আসে। মফস্বল কলেজের শিক্ষক আমার পিতার পক্ষে এই পত্রিকার গ্রাহক হওয়ার সামর্থ্য থাকার কথা নয়। যতোদূর মনে পড়ে, এটি বিনামূল্যে বিতরণ করা হতো, পরবর্তীতে যেমন বাংলা ভাষায় প্রকাশিত রুশ ও চীনা পত্রিকার গ্রাহক হওয়া যেতো কোনো পয়সা ছাড়াই। রীডার্স ডাইজেস্ট-এর পাতায় কেনেডির শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের ছবি দেখেছিলাম - সামরিক পোশাক পরা মানুষজন ঘিরে রেখেছে লাল-নীল-সাদা রঙের কফিন। ওই জিনিসের নাম যে কফিন, তখনো জানা ছিলো না। সেই প্রথম এই শহরটি পৃথিবীর মানচিত্রে কিছু গুরুত্ব পেয়ে যায়, এর আগে এ শহরের অস্তিত্ব বাইরের তেমন কেউ জানতো না। পরে জেনেছি, এমনকী এ দেশেও অনেকে এ শহরের নাম সেই প্রথম শুনেছিলো।
কেনেডি-কাণ্ডের অনেক বছর পরে বাংলাদেশ টিভিতে জনপ্রিয় সিরিজটি দেখানোর সময় শহরের নাম জানা গেলো, ডালাস। এবারে বাংলায় লেখা ও উচ্চারণে একটা ল বাদ পড়ে গেছে। ডালাস সিরিজের সুবাদে জে.আর. ইউয়িং, ববি ইউয়িং, প্যাম, স্যু অ্যালেন-এর নাম বাঙালির ঘরে ঘরে জানা হয়ে গেলো। তারা কে কী করে, কেমন তাদের সাজপোশাক, কী পছন্দ করে, জে.আর. ইউয়িং-এর সর্বশেষ মেয়েবন্ধুটি কে - তা নিয়েও আলোচনা হয়। এই রকমই চললো বেশ কয়েক বছর। সিরিজের একটি এপিসোডে জে.আর. গুলিবিদ্ধ হয়, তখন সারা পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের পত্রিকা এবং টিভি দর্শকরাও 'হু শট জে.আর?' জল্পনার অংশীদার হয়েছিলো মনে আছে।
আরো পরে সশরীরে উপস্থিত হয়ে জানলাম, স্থানীয় উচ্চারণে শহরের নাম ড্যালাস। মুখে বলার সময় যা-ই বলি না কেন, লিখতে গিয়ে য-ফলা বাদ দিয়ে ডালাস লিখতেই স্বচ্ছন্দ লাগে।
এখন পর্যন্ত মোটামুটিভাবে আমেরিকা বলতে বাঙালি জানে নিউ ইয়র্ক। গাড়ি বললে বাংলাদেশে একসময় যেমন টয়োটা বোঝাতো, মোটর সাইকেল মানেই হোন্ডা (জানো, পাশের বাড়ির ওরা একটা সুজুকি হোন্ডা কিনেছে!)। দেশে গেলে প্রথম প্রথম সবাই জানতে চায়, নিউ ইয়র্কে থাকো? উত্তরে না বললে কারো কারো মুখে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠতে দেখেছি। সেই তাচ্ছিল্যের একটাই মানে হয় - নিউ ইয়র্ক না হলে আর কীসের আমেরিকায় থাকা! অথবা ভাবে, নিউ ইয়র্কে থাকে না মানে গ্রামেই মনে হয় থাকে। কেউ কেউ কিছু হতাশ হয় - নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা প্রশ্নকর্তার আত্মীয় বা বন্ধুর খবরটি আমার কাছ থেকে পাওয়ার আর কোনো আশাই যে নেই আর!
একবার দেশে গিয়ে খুব অন্যরকম একটি অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। পুরনো এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হতে সে খুব গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করে, ল্যারি হ্যাগম্যান, ভিক্টোরিয়া প্রিন্সিপ্যালরা কেমন আছে?
আমি থতমত খাই, বন্ধুটির রসবোধ সম্পর্কে আমার ধারণা আছে। কিন্তু কোনদিকে সে এগোচ্ছে, ঠিক ধরতে পারি না। বাংলাদেশেও তখন আর ডালাস দেখানো হয় না। জিজ্ঞেস করি, মানে?
বন্ধু নির্বিকার মুখে জানায়, তুমি যে দেশে থাকো, ওখানকার আর কাউকে তো চিনি না যে তার কথা জিজ্ঞেস করবো। টিভি দেখে যাদের চিনি, তাদের কথাই জানতে চেয়েছি!
ডালাস আর ফোর্ট ওয়ার্থ টেক্সাস রাজ্যে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে গড়ে ওঠা দুটি শহর। আ টেল অব টু সিটিজ। বলা হয় টুইন সিটি। এই টুইন সিটির প্রধান বিমানবন্দর ডালাস-ফোর্ট ওয়ার্থ ইন্টারন্যাশনাল। সংক্ষেপে ডিএফডব্লিউ। পুরনো ও ঐতিহ্যশালী শহর ফোর্ট ওয়ার্থ, একশো-দেড়শো বছরের পুরনো বাড়িঘর ও নিদর্শন যত্রতত্র। ওয়াইল্ড ওয়েস্টের কাউবয় ঐতিহ্যের বেশ খানিকটা এখনো টিকিয়ে রাখা হয়েছে। সানড্যান্স স্কোয়্যার (বুচ ক্যাসিডি অ্যান্ড দ্য সানড্যান্স কিড ছবিটির কথা মনে আছে?) নামের জায়গাটিতে কনসার্ট হয়, বিভিন্ন ধরনের জমায়েত হয়ে থাকে। এই শহরের ডাউনটাউনে ক্যাটল শো হয় প্রতি বছর, কাউবয়দের সমাবেশ হয় প্রতি শনিবার সন্ধ্যায়।
সে তুলনায় ডালাস ঝকঝকে নতুন, হঠাৎ পয়সা হওয়া মানুষের বিদ্যাবুদ্ধিহীন ও অহংকারী নতুন বউয়ের মতো। চটক থাকলেও খানিকটা ফাঁপা, গৌরব করে বলার মতো কিছু নেই তো! আকার-আকৃতির দিক থেকে ডালাস আমেরিকার দশ নম্বর বড়ো শহর। বড়োলোকের বউয়ের মতো একখানা আদুরে ডাকনামও আছে - বিগ ডি।
বাংলাদেশ থেকে কেউ এলে সচরাচর নিউ ইয়র্কে আসে, আমেরিকার পূর্ব উপকূলে। অথবা আসে একেবারে পশ্চিমের লস অ্যাঞ্জেলেস-এ। এই দুইয়ের মোটামুটি মাঝামাঝি জায়গায় ডালাস। এখানে একেবারে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন বা নিতান্ত নাছোড়বান্দা বন্ধুবান্ধব ছাড়া দেশ থেকে আসা অতিথি পাওয়া ভাগ্যের কথা। কার দায় পড়েছে পয়সা খরচ করে ডালাসে আসবে? কী আছে দেখার?
উত্তরে বলি, কিচ্ছু নেই। এক আমরা ছাড়া।
এ শহরে সত্যিই দর্শনীয় কিছু নেই। যারা আসে দয়াপরবশ হয়ে, তাদের কাছে দ্রষ্টব্য আমরা নিজেরাই। আমাদের কারণে তাদের আসা। পৃথিবীর সব শহরে জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন থাকে। এখানেও আছে। কিন্তু এতোদূরে ডালাসে এসে ওসব দেখে কারো মন ভরবে, না সেসব জায়গায় কাউকে নিয়ে যাওয়া যায়? নিউ ইয়র্কে স্ট্যাচু অব লিবার্টি আছে, কোনি আইল্যান্ড আছে, কাছাকাছি ওয়াশিংটন ডিসি, নিউ জার্সি আছে, জুয়ায় ভাগ্য পরীক্ষা করতে চাইলে আটলান্টিক সিটি। কিছু না হোক, নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস-এ খানিকক্ষণ হাঁটলে অনেক বছর দেখা হয়নি এরকম অন্তত দু'জন চেনা বাঙালির সঙ্গে দেখা হবেই। সে-ও বড়ো কম পাওয়া নয়। লস অ্যাঞ্জেলেস-এ হলে ডিজনিল্যান্ডে যাও, ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে যাও, অদূরে জৌলুসের শহর লাস ভেগাস - একেকটা দিনরাত কীভাবে চলে যাবে টেরও পাবে না। তারপরেও মনে হবে, আরেকটু সময় পাওয়া গেলে মন্দ হতো না। কলোরাডো যাও পাহাড় দেখতে, সমুদ্রে যাও তো ফ্লোরিডা। এইরকম সব।
অথচ ডালাস নামের এই বাজ-পড়া শহরে (সম্ভবত সেইজন্যেই গাছপালাও কম!) দেখার কিচ্ছু নেই, কাউকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার মতো দর্শনীয় কোনো জায়গা নেই। মানুষের তৈরি কোনো বিস্ময় নেই, কাছাকাছি প্রাকৃতিক কোনো পাহাড়-সমুদ্র-অরণ্য-প্রপাত তা-ও নেই। একেবারে নিরেট 'পুরুষের মতো সমতলভূমি'। বেড়াতে কাউকে আসতে বলি কোন মুখে? আত্মীয়-পরিজন ছাড়া শুধু আমাদের শ্রীমুখ দেখতে আসার দায় আর কার আছে? সবচেয়ে কাছের সমুদ্র দক্ষিণে প্রায় তিনশো মাইলের দূরত্বে। জলাধার বলতে শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃত্রিম কিছু লেক। ট্রিনিটি নামে একখানা নদী আছে, আমাদের করতোয়ার মতোই হাজামজা, মাঝেমধ্যে হঠাৎ খুব বৃষ্টি হলে আশেপাশে কিছু বাড়িঘর জলমগ্ন করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। পাহাড় আছে উত্তরে বা পশ্চিমে, দূরত্ব আরো বেশি। পৃথিবীর সব বড়ো শহরের মতো এখানেও বিভিন্ন দেশের হাজার রকমের ও কেতার রেস্তোরাঁ আছে, অথচ ভোজনবিলাসী হিসেবে বাঙালির সুনাম থাকলেও দেশ থেকে বেড়াতে আসা অধিকাংশের মুখে এসব রোচে না। মাংসটা হালাল কি না তা নিয়েও অনেকেরই বিস্তর দুশ্চিন্তা। ফলে, ঘুরেফিরে সেই ভাত-মাছ-ডাল-মাংস আর সেটা ঘরের হলেই ভালো। তাহলে ডালাসে বাঙালি ভ্রমণার্থীদের নিয়ে কী আর করার থাকে?
তা থাকার মধ্যে আছে দুইখান জিনিস - কেনেডি এবং জে.আর-এর মাজার। বাঙালিদের মধ্যে এই নাম দুটোই চালু। ডালাস ডাউনটাউনে প্রেসিডেন্ট কেনেডির গুলিবিদ্ধ হওয়ার জায়গাটিতে একটি ছোটো মেমোরিয়াল করা আছে, বুক ডিপোজিটরি বিল্ডিং-এর পাঁচতলার যে জানালা থেকে অসওয়াল্ড গুলি করেছিলো বলে বলা হয়, সেটি অবিকৃত রাখা আছে। সেখানে তৈরি হয়েছে কেনেডি মিউজিয়াম। ইতিহাসে উৎসাহী হলে এখানে ঘণ্টাদুয়েক সময় অনায়াসে কাটানো যেতে পারে। না হলে দশ-পনেরো মিনিটেই কেনেডি মেমোরিয়াল দেখা শেষ। ডালাস ডাউনটাউন বিশাল উঁচু কাচের বিল্ডিং-এর জন্যে বিখ্যাত। সেসব দেখে বাঙাল বিস্ময় বোধ করতে পারে, কিন্তু তা আর কতোক্ষণ দেখা যায়?
টেলিভিশনে ডালাস সিরিজের ঘটনাবলি যে সাউথফোর্ককে ঘিরে আবর্তিত, সেই নামের একটি জায়গার অস্তিত্ব সত্যিই আছে মূল ডালাস শহরের সামান্য বাইরে। Southfork Ranch লেখা মূল ফটক, যেমনটি সিরিজে দেখা যেতো, ছাড়াও ভেতরে আছে ইউয়িং-দের বাড়ি ও চারপাশের বিশাল চত্বর। টিকেট করে ভেতরে গেলে দেখা যায়, টিভিতে দেখা ঘরদুয়ার ও আসবাব, সুইমিং পুল, বাথরুম, আস্তাবল ইত্যাদি সবই আছে। গাইডের বিবরণ শুনে জানা যাবে, সিরিজের কিছু কিছু শুটিং এখানেও হয়েছিলো। তবে বেশিরভাগই হলিউডে হয়েছে, সেখানেও হুবহু এই রকমের সব বাড়িঘর তৈরি করা আছে। আরো জানা যাবে, সিরিজের কাজ শুরু করার আগে এটি ব্যবহারের অনুমতির জন্যে মূল মালিকের কাছে আসে হলিউডের প্রোডাকশন কোম্পানি। মালিক প্রথমে রাজি হননি। কিছুদিন পরে হলিউডিরা আবার আসে, এবার অবশ্য তারা চেকবইটি সঙ্গে আনতে ভোলেনি।
সিরিজের জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে সাউথফোর্কও তীর্থস্থানের মর্যাদা পেয়ে যায়। দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়তে থাকলে দর্শনীর প্রথা চালু হয়। প্রথা আজও আছে। ডালাস সিরিজ বন্ধ হয়ে গেছে বহু বছর আগে, পুরনো এপিসোডগুলো আমেরিকার কোনো কোনো চ্যানেলে অবশ্য এখনো দেখানো হয়। কিন্তু দর্শক আজও ভোলেনি ববি-প্যাম বা জে.আর-স্যু অ্যালেনকে, এখনো প্রতিদিন এ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে দল বেঁধে বাসভর্তি মানুষ আসে এই তীর্থদর্শনে। এ দেশীয়দের পাশাপাশি বিদেশী ভ্রমণকারীও কম নেই। একবার এক সুইডিশ দম্পতিকে দেখেছিলাম।
বাংলাদেশ থেকে বা আমেরিকার অন্য কোনো শহর থেকে আসা আত্মীয়-পরিজন বা বন্ধুদের সাউথফোর্ক দেখাতে নিয়ে যাওয়াটা আমাদের জন্যে খানিকটা বাধ্যতামূলক হয়ে আছে দুটি কারণে। প্রথমত, বিশেষ একটি বয়সী বাঙালির স্মৃতিতে ডালাস সিরিজটি এখনো জাগ্রত, স্মৃতিময় পথটি ধরে খানিক হাঁটার লোভ আর ক'জন সামলাতে পারে? এসেই, এমনকী আসার আগেই ফরমায়েশ, সাউথফোর্ক দেখাতে নিয়ে যাবে তো! দ্বিতীয় কারণ, আর কিছুই যে দেখানোর নেই! সেই কেনেডি-জে.আর নামের দুই কুমিরছানা ছাড়া দেখাই কী? এই করে করে সাউথফোর্ক-এ আমার যাওয়া হয়েছে কম করেও বিশ-পঁচিশবার। সর্বশেষ যেবার গিয়েছি, টিকেট করার সময় আমার সঙ্গী দর্শনার্থীকে সে কথা বলছিলাম। টিকেট কাউন্টারের ভদ্রমহিলা শুনতে পেয়ে বললো, তাই নাকি? এতোবার এসেছো? পরের বার এলে আমাকে বোলো, তোমার টিকেট লাগবে না।
মনে মনে বলি, আর যেন আসতে না হয়। এক জিনিস আর কতো দেখা যায়!
বাঙালি দর্শনার্থীদের মধ্যে সাউথফোর্ক দর্শনের বিভিন্ন রকমের প্রতিক্রিয়া দেখেছি। অনেকে, বিশেষ করে মহিলারা বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ে। আমার সমবয়সী বা কাছাকাছি বয়সী বন্ধুদের প্রতিক্রিয়াগুলো ছিলো কিছু বিচিত্র। জাফরউল্লাহ খান লেফট-রাইট পেশা থেকে অবঃ হওয়ার পরে বউ নিয়ে এসেছিলো। তাদের অভিজ্ঞতা বিশুদ্ধ আনন্দের। রাইসুল ইসলাম আসাদ এসেছিলো এখানকার বাঙালিদের একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে। একদিন নিয়ে গেলাম সাউথফোর্কের তীর্থে। পেশাদার অভিনেতা সে, তার দেখাও ছিলো সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এরই মধ্যে 'আপনি রাইসুল ইসলাম আসাদ না?' জিজ্ঞাসা নিয়ে এক সহাস্য বাঙালির মুখ। ইমদাদুল হক মিলন এসেছিলো আরেক অনুষ্ঠানে। ওকে দেখিয়ে এনেছিলাম বাইরে থেকে, ভেতরে যাওয়ার আগ্রহ তার ছিলো না। নিউ ইয়র্ক থেকে আসা সৈয়দ শহীদও তাই। তারা সাউথফোর্কের মূল ফটক আর ঢোকার মুখে স্যুভেনির শপ দেখেই সন্তুষ্ট। ঢাকা থেকে আসা অগ্রজতুল্য বেবি ভাই কিছুটা হতাশ। তাঁর ধারণা ছিলো, খুবই প্রাচীন কোনো একটি বাড়ি দেখবেন যার কিছু সত্যিকারের ইতিহাস আছে। তার বদলে পঞ্চাশ-ষাট বছর বয়সী সাজানো-গোছানো নকল একটি বাড়ি দেখিয়ে লোকগুলো পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে। গ্যালারিতে সাজানো টিভি সিরিজের বিভিন্ন এপিসোডের অসংখ্য স্টিল ছবির প্রদর্শনী দেখতে দেখতে বেবি ভাই দুঃখ করছিলেন, তোর ভাবী এলে খুব পছন্দ করতো!
ডালাসে আসার সময় যে কোনো বাঙালি - সে বাংলাদেশ থেকে আসুক বা আমেরিকার কোথাও থেকেই হোক - এই তীর্থদর্শনের দেখার মানত করে আসে। তারা কেউ জানে না, সাউথফোর্কসহ এ শহরে আছেই মোটে দুটি কুমিরছানা! এই ধরনের মানত না করে ব্যতিক্রম ঘটিয়েছিলো রঞ্জু, আমার ছোটো বোনের বর। আসার আগে ইমেল করে জানিয়ে দিয়েছিলো, সাউথফোর্ক-এ সে যেতেই চায় না! এই ছেলের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব অক্ষুণ্ন আছে কী করে? ঢাকা থেকে আসছে, সাউথফোর্ক-এ একবার যাবে না, এ কী সম্ভব? কোন কোন জায়গায় যেতে হবে লোকে তার তালিকা দেয়, আর এ জানাচ্ছে কোথায় সে যেতে চায় না!
একবার এই সাউথফোর্কে নিয়ে গিয়েছি দেশ থেকে আসা এক বয়স্ক আত্মীয়কে। বছর বারো-চোদ্দো আগের কথা, তখনো ডালাস সিরিজের স্মৃতি পুরনো হয়ে যায়নি। ভদ্রলোক পেশায় ডাক্তার, বেশ গুরুগম্ভীর ধরনের মানুষ। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রটি আমাদের সঙ্গে থাকে। পুত্রের চিন্তা, বাবাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়। কোথায় গেলে তাঁর ভালো লাগবে। সাউথফোর্কের কথা ওঠে অবধারিতভাবে। ওঁর ভালো লাগবে না ভেবে আমি কিঞ্চিৎ আপত্তি করি। কিন্তু আর কোথায়ই বা নিয়ে যাবো? অগত্যা যাওয়া হলো। সঙ্গী আমি এবং তাঁর পুত্র। টিকেট করে ভেতরে যাওয়া হয়। যান্ত্রিক ট্রলিতে করে ইউয়িং পরিবারের বিশাল চত্বরটি ঘুরে মূল বাসভবনে নামি। পুত্রটি তার বাবাকে বিপুল উৎসাহে দেখাতে থাকে বাড়ির বাইরে পার্ক করে রাখা জে.আর-এর গাড়ি। বাঁয়ে সুইমিং পুল রেখে বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখায়, ওই যে জে.আর-এর বেডরুম, জে.আর-এর বাথরুম, জে.আর-এর রাজকীয় বিছানা-বালিশ, জে.আর-এর বসার ঘর, জে.আর-এর ডাইনিং টেবিল, জে.আর-এর অফিস।
দেখা-টেখা শেষ হলে বাইরে আসি। ভদ্রলোক এতোক্ষণ কোনো কথা বলেননি। ধীরেসুস্থে সিগারেট ধরিয়ে সেটাকে মুঠো করে জোরে টান দিয়ে পুত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা যে এতোক্ষণ জে.আর জে.আর করলে, লোকটা আসলে কে বলো তো?
Saturday, October 20, 2007
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment