Saturday, January 26, 2008

গল্পের শেষ যেভাবে : প্রস্থানোদ্যত আমাদের কালের একজন নায়ক

প্রিয় নান্নু ভাই, আমাকে আপনি চেনেন না। চেনার কথা নয, কোনো উপলক্ষ কখনো সেভাবে তৈরি হয়নি। তবু আপনাকে ভাই সম্বোধন করলাম কেন? কারণ আমি আপনাকে চিনি অনেককাল ধরে। আপনি সেই প্রজাতির মানুষ যাঁকে লক্ষ মানুষ চেনে এবং তাদের অনেকেই আপনাকে ঠিক আমার মতোই খুব কাছের মানুষ বলে জানে। আরেকটি কারণ সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে। আপনার ছোটো ভাই মঞ্জুর সঙ্গে মাস ছয়েক আগে অনেকটা আকস্মিকভাবেই পরিচয়, কিছু ঘনিষ্ঠতাও। তিনি আমার প্রায় সমবয়সী, আমরা পরস্পরকে নামসহ ভাই সম্বোধন করি। মঞ্জু ভাইয়ের স্ত্রী হাসিন ভাবী আমার স্ত্রীর বন্ধু। সুতরাং আপনাকে ভাই ডাকার এক ধরনের অধিকারও আমার জন্মে গেছে।

আপনি পড়েছিলেন কি না জানি না, আপনাদের দুই ভাইকে নিয়ে লেখা একটি গল্প ছাপা হয়েছিলো ১৯৭৮ সালে। তখন আপনারা দুই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী ও মোহামেডানের অধিনায়ক। ঘটনাটি ঐতিহাসিক, দুই সহোদর বড়ো দুই দলের অধিনায়কত্ব করছেন এমন ঘটনা বাংলাদেশ আর কখনো ঘটেনি। সে বছর মৌসুমের শুরুতে আপনারা দুই ভাই দুই বিপরীতমুখী ঘোষণা দিয়েছিলেন। ৭৭-এর অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন আবাহনীর অধিনায়ক আপনি বললেন, শিরোপা ধরে রাখবো। মোহামেডানের দলনেতা মঞ্জু ভাই জানালেন, শিরোপা আমরা নেবো। সে বছর মোহামেডান লীগ-চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো। আপনি পরাস্ত হলেও গর্ব করে বলতেই পারেন, সেই চ্যাম্পয়নশীপ আপনাদের পরিবারেই ছিলো!

১৯৭৮-এ আবাহনী-মোহামেডানের খেলার আগে সহোদর দুই অধিনায়কের করমর্দন

আবাহনী-মোহামেডানের খেলার দিন ‘স্টেডিয়াম’ পত্রিকায় ওই গল্পটি ছাপা হয়। আপনার জানার কথা নয়, আজ জানাই, ‘সেই প্রতিশ্রুতি’ শিরোনামের গল্পটির রচয়িতা ছিলাম আমি। গল্পের কপি আমার কাছে নেই, পুরো গল্পটিও মনে নেই। আবছামতো যতোটুকু মনে পড়ে তা অনেকটা এইরকম : আজ আবাহনী-মোহামেডানের খেলা। দুই দলের অধিনায়ক নান্নু ও মঞ্জু একই বাড়ির বাসিন্দা – দুই সহোদর। সকালে নান্নুর ঘুম ভাঙে স্বপ্ন দেখে, আজকের খেলা নিয়েই একটি স্বপ্নদৃশ্য। গোলমুখ থেকে বলটি হঠাৎ উধাও, যা শুধু স্বপ্নেই সম্ভব। দুই ভাই পরস্পরের শত্রুপক্ষ। আজ এই সকালে তাদের কারো মনে পড়ে অথবা পড়ে না, বাল্যকালে তারা জীবনভর একই দলে খেলবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলো।

আপনার হয়তো মনে আছে, ‘স্টেডিয়াম’-এর মালিক-প্রকাশক আবাহনীতে আপনার সতীর্থ আরেক খেলোয়াড় টুটুল। নামে পাক্ষিক হলেও কাগজটি অনিয়মিত বের হয়। তবে বড়ো খেলার দিনে অবশ্যই একটি সংখ্যা বাজারে আসে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাজার দশেক কপি নিঃশেষ হয়ে যায় স্টেডিয়ামের বাইরে এবং গ্যালারিতে। এর সম্পাদক তখন আবদুর রহমান, গেট-আপ মেকাপ ও ইলাস্ট্রেশনে আফজাল হোসেন। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, ওই সময় আফজাল টিভিতে তার ‘আপনপ্রিয়’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে আপনাদের দুই ভাইকে উপস্থিত করেছিলো।

১৯৭৮ : বিটিভি-তে ‘আপনপ্রিয়’ অনুষ্ঠানে আফজাল হোসেনের সঙ্গে নান্নু ও মঞ্জু

উয়ারি এলাকার সপ্তর্ষি মুদ্রায়ণে ‘স্টেডিয়াম’ কম্পোজ কাজ হয়, ছাপাখানাটি ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের কর্মকর্তা নজরুল ভাইয়ের, পত্রিকার অফিস হিসেবে সেখানে একটি ঘরও তিনি ব্যবহার করতে দিয়েছেন। মাঝেমধ্যে আড্ডা দিতে যাই সেখানে। এরকম এক আড্ডায় রহমান ও আফজাল অকস্মাৎ দাবি করে বসে, আবাহনী-মোহামেডানের খেলা উপলক্ষে পরিকল্পিত সংখ্যার জন্যে একটি গল্প লিখে দিতে হবে। কেন এই বুদ্ধি তাদের মাথায় এলো জানি না, ৮৩ সালে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই কাগজের আয়ুষ্কালে এর আগে বা পরে দ্বিতীয় কোনো গল্প আর ছাপা হয়নি। এই তথ্যটি সম্পর্কে আমি নিশ্চিত এইজন্যে যে, গোড়া থেকেই এই পত্রিকার সঙ্গে একটা সম্পর্ক আমার ছিলো, ৮০ থেকে ৮৩ পর্যন্ত ‘স্টেডিয়াম’-এর যে ক’টি সংখ্যা বেরিয়েছিলো তার সম্পাদনার দায়িত্ব ছিলো আমার।

নান্নু-মঞ্জু দুই ভাই দুই দলের অধিনায়ক, সেই খেলার দিনে গল্পের বিষয় হিসেবে এর চেয়ে ভালো আর কী হয়! খেলা দেখে আপনাদের চিনি, ব্যক্তিগত জীবন প্রায় কিছুই জানি না। দু’জনের পুরো নাম জানি – মনোয়ার হোসেন নান্নু ও শামসুল আলম মঞ্জু। আপনাদের পারিবারিক জীবন, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদি কিছুই জানা নেই। কিন্তু গল্পের জন্যে তথ্য খুব জরুরি নয়। যতোদূর মনে পড়ে, ওই অফিসে বসেই গল্পটি লেখা হয় এবং আফজাল তৎক্ষণাৎ ইলাস্ট্রেশনও করে ফেলে।

‘স্টেডিয়াম’ যথাসময়ে প্রকাশিত হলো, স্টেডিয়ামে খেলাও শুরু হলো। খেলার শুরুতে মাঝমাঠে রেফারি এ লাইনসম্যানদের সামনে নিজ নিজ দলের অধিনায়ক হিসেবে আপনারা দুই ভাই করমর্দন করছেন, এই মুহূর্তটি এখনো চোখে ভাসে। এই লেখাটির সঙ্গে দেওয়ার জন্যে সেই ছবির একটি কপি মঞ্জু ভাইয়ের কাছ থেকে উদ্ধার করা গেলো।

আমি জানি, আপনি ভোলেননি যে সেদিনের খেলা অসমাপ্ত ছিলো। আবাহনী-মোহামেডানের খেলায় চিরাচরিত গোলযোগ নয়, প্রবল বৃষ্টিতে খেলাটি অমীমাংসিত অবস্থায় পরিত্যক্ত হয়। আমার লেখা গল্প-সম্বলিত পত্রিকার কপিগুলিও রক্ষা পায়নি অনুমান করি, বৃষ্টিতে ধুয়ে গিয়ে থাকবে। সেখানেই গল্প আটকে থাকতে পারতো, পরিত্যক্ত ও অসমাপ্ত খেলাটির মতো। প্রায় তিরিশ বছরের ব্যবধানে সেই গল্পের উপসংহার আমাকে লিখতে হবে তা কি জানতাম!

সারাজীবন একসঙ্গে এক দলের হয়ে খেলার প্রতিশ্রুতি আপনাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে বাল্যকালে হয়েছিলো কি না জানা নেই, লেখার জন্যে সেটি তৎক্ষণাৎ কল্পনা করে নিতে হয়েছিলো সেদিন। তেমন প্রতিশ্রুতির ঘটনা থাকলেও তাকে বালখিল্য বলে বিবেচনা করাই সঙ্গত। বাস্তবতা ছিলো এই যে, স্বাধীনতার পর আবাহনী ক্রীড়াচক্র গঠিত হলে মঞ্জু ভাই সেখানে অন্তর্ভুক্ত হন, আপনি তখন মোহামেডানে। ৭৪-এ আপনিও চলে এলেন আবাহনীতে। ঢাকা ফুটবল লীগে ১৯৭৪-এর একটিমাত্র বছর আপনারা এক দলের হয়ে খেলেছিলেন। জাতীয় দলে একসঙ্গে খেলা যদি হিসেবে ধরা না হয়, বাল্যকালে প্রতিশ্রুত হয়ে থাকলে তা বাস্তব হয়েছিলো এই একটি ফুটবল মৌসুমে।

১৯৭৫-এ দু’জনের পথ আলাদা হয়ে যায়, সে বছর মঞ্জু ভাই গেলেন মোহামেডানে, খেলোয়াড়ী জীবন তাঁর শেষ হলো ৮৫-তে। আর আপনি ৮২-তে অবসর নেওয়া পর্যন্ত থেকে যান আবাহনীতে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ফুটবলে একটা নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়। পাকিস্তান আমলে অন্য সবকিছুর মতো ফুটবলেও জাতীয় দলের হয়ে বাঙালির অংশগ্রহণ সীমিত ছিলো। ৭১-এ যুদ্ধের সময় ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ ভারতে অনেকগুলি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে স্বাধীনতার বার্তা তুলে ধরে এবং সেই অভিজ্ঞতা যে এক নতুন অনুভবের জন্ম দেয়, তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের ফুটবল নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠা এবং ইংল্যান্ড থেকে আসা আবাহনীর কোচ জন হার্ট পত্তন করে দিলেন সম্পূর্ণ নতুন ধাঁচের ফুটবল-শৈলীর।

১৯৭৮ : স্টেডিয়াম পত্রিকায় দুই অধিনায়কের যুদ্ধঘোষণা

আবাহনীর জন্মের পর থেকে আমি তার সমর্থক। অবশ্য আমি সেই জাতের সমর্থক যার পক্ষে মোহামেডান গ্যালারিতে বসে খেলা দেখা প্রায় নৈমিত্তিক ঘটনা ছিলো। সুতরাং দলানুগত্যের বাইরে থেকেও বলতে পারি, বাংলাদেশে আধুনিক ফুটবলের শুরু আবাহনীর হাত ধরে। ক্রমশ অন্য দলগুলিও এই ধারা অনুসরণ করতে শুরু করে। ফুটবল তখন বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিলো, এই নবযাত্রায় তা আরো বেগবান হয়। আপনাদের প্রজন্মের ফুটবলাররা এর অনুঘটক ছিলেন, এ কথা কেউ অস্বীকার করবেন বরে মনে হয় না।

শুধু খেলার ধাঁচ নয়, সেই সময়ের খেলোয়াড়দের চেহারা ও পোশাক-আশাকও মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কাঁধসমান লম্বা চুল নিয়ে দ্রুতগামী অশ্বের মতো কেশর দুলিয়ে খেলোয়াড়দের ঢাকার মাঠ দাপিয়ে বেড়াতে এর আগে কে কবে দেখেছে! পৃথিবীর অন্যসব দেশে যেমন হয়, বাংলাদেশেও সালাউদ্দিন-নান্নুর মতো ঝাঁকড়া চুল রাখা এবং খেলোয়াড়দের ফ্যাশন অনুকরণ করার রীতি প্রচলিত হয়ে যায় তখন। ফুটবল ভদ্রলোকের খেলা নয় বলে সেই সময়ে সাধারণভাবে প্রচলিত ধারণাও আপনারা ভাঙতে সক্ষম হলেন। খেলাপাগল মানুষ ও সমর্থকদের উন্মাদনা শুধু নয়, ফুটবল তখন এক ধরণের সামাজিক বিবর্তনের অনুঘটক হয়ে ওঠে। আমার পিতা খেলাধুলা বিষয়ে চরমতম উদাসীন মানুষ ছিলেন, তাঁকেও একসময় ফুটবল ও সালাউদ্দিনকে এক করে জানতে এবং মানতে হয়।

সংকীর্ণ রাজনীতি এবং ধারাবাহিক প্রশাসনিক ব্যর্থতায় আপনাদের হাতে শুরু হওয়া ফুটবলের উত্থান ও অগ্রযাত্রা আমরা অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হয়েছি, তা অন্য প্রসঙ্গ।

খেলোয়াড়ী জীবনে আপনি খেলেছেন মধ্যমাঠে গেমমেকার হিসেবে এবং রক্ষণভাগে লেফট ব্যাক ও স্টপার হিসেবে। মঞ্জু ভাই রাইটব্যাক খেলেছেন বরাবর। খেলোয়াড় হিসেবে আপনারা দুই ভাই নিজেদের পজিশনে তাঁদের সময়ের এবং সম্ভবত বাংলাদেশ ফুটবলে সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। অথচ খেলার স্টাইল ও মাঠ-ব্যক্তিত্বের বিচারে দু’জন সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। আপনি স্থিতি ও প্রশান্ত মেজাজের প্রতীক, আপনার খেলা ধীর অথচ ঋজু কবিতার মতো শিল্পসুষমামণ্ডিত, মনোহর। মঞ্জু ভাই আপনার ঠিক বিপরীতে। তাঁর মাঠ-ব্যক্তিত্ব ছিলো কিছুটা রূঢ়, তীক্ষ্ণমেজাজী ও পৌরুষদীপ্ত। মাথা-গরম ফুটবলার হিসেবে মঞ্জু ভাইয়ের এবং তার অব্যবহিত পরে টুটুলের খ্যাতি (নাকি কুখ্যাতি!) ছিলো। আগে অন্যদের কাছে শোনা ছিলো এবং এখন পরিচয় হওয়ার পর দেখছি, মাঠের মঞ্জুর সঙ্গে এই মঞ্জুকে একদমই মেলানো যায় না। টুটুলের বেলায়ও এই ঘটনা দেখেছি।

রাইটব্যাক যে আক্রমণাত্মক খেলা খেলতে পারে, রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ও আক্রমণে সহায়ক হতে পারে মঞ্জু ভাইয়ের খেলায় দেখে ঢাকার দর্শক তা প্রথম প্রত্যক্ষ করেছিলো। এক অর্থে তা ছিলো এক ধরনের বিপ্লবাত্মক ঘটনা। মঞ্জু ভাই মোহামেডানে চলে গেলে আবাহনীতে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন টুটুল, তিনিও মঞ্জু ভাইয়ের খেলার ধারাটিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। মনে পড়ছে, একবার একটি পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে মঞ্জু ভাই বলেছিলেন, ৭৫ ও ৭৬-এ টুটুল যে খেলা খেলেছিলো তা ধরে রাখতে পারলে মঞ্জু নামে ঢাকার মাঠে কেউ যে কোনোদিন খেলেছিলো তা আর কেউ মনে রাখতো না। রূঢ় ও তীক্ষ্ণমেজাজী বলে পরিচিত মঞ্জু ভাই বলছেন এই কথা তাঁরই সমসাময়িক এবং একই পজিশনের খেলোয়াড় সম্পর্কে। বাংলাদেশে এই বিনয় খুব বেশি দেখতে আমরা অভ্যস্ত নই।

১৯৭৪-এর আইএফএ শীল্ড টুর্নামেন্টের কথা আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে। আবাহনী গেছে কলকাতায় খেলতে। তখন টিভিতে খেলা দেখানোর চল হয়নি। বিটিভি ছিলো, কিন্তু কলকাতায় দূরদর্শন সম্ভবত চালুও হয়নি তখনো। রেডিওতে ধারাবর্ণনা শুনছিলাম, আবাহনী খেলছে কলকাতার অন্যতম সেরা দল ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে। দুর্দান্ত খেলেছিলো আবাহনী সেদিন। একসময় আকাশবাণীর ধারাভাষ্যকারকে যা বলতে শুনলাম তার বক্তব্যটি এরকম: ‘ঝাঁকড়া চুলের দীর্ঘদেহী বাংলাদেশের ছেলেটি মাঝমাঠে কাউকে দাঁড়াতে দিচ্ছে না, যেন এলাকাটি তার একান্ত নিজস্ব’।

ওই ধারাবর্ণনা আপনি শোনেননি, তখন আপনি মাঠে। ‘ঝাঁকড়া চুলের দীর্ঘদেহী ছেলেটি’ বলে যাকে বর্ণনা করা হচ্ছিলো, তার নাম নান্নু। তখন আপনি মাঝমাঠের খেলোয়াড়। হাঁটুতে আঘাতজনিত কারণে পরবর্তী বছরগুলিতে স্টপার হিসেবে খেলেছেন। মাঠে সবচেয়ে দ্রতগতির খেলোয়াড় আপনি ছিলেন না, তা আপনি নিজেও স্বীকার করবেন। আপনি খেলতেন নিজস্ব দক্ষতা, ফুটবলবোধ এবং বুদ্ধি ও সুবিবেচনা মেশানো এক অসাধারণ খেলা। দৃষ্টিনন্দন ছিলো আপনার পাসিং ও নিখুঁত হেডওয়ার্ক। হেড করে বলটি গোলমুখ থেকে সরিয়ে দেওয়াই একমাত্র কাজ নয়, বরং বলটিকে নিজ দলের খেলোয়াড়ের নাগালে পৌঁছে দিতে হবে, তা আপনার মতো করে আর কাউকে করতে ঢাকার মাঠ কখনো দেখেনি।

সবচেয়ে দর্শনীয় ছিলো আপনার স্লাইড ট্যাকল, স্টপারের সর্বশেষ অস্ত্র। খানিকটা জুয়ার মতো। রক্ষণভাগের শেষ খুঁটি স্টপার, যার পরাস্ত বা ব্যর্থ হওয়ার অর্থ বিপক্ষের আক্রমণের সামনে গোলরক্ষক সম্পূর্ণ একা ও অরক্ষতি। অথচ জুয়াটি খেলতেন আপনি খুব হিসেব করে, পেশাদার জুয়াড়ির দক্ষতায়। অধিকাংশ সময়ে আপনি জিতে এসেছেন অসাধারণ সময়জ্ঞানের কারণে। এই অস্ত্রটি আপনি ব্যবহার করতে জানতেন নিখুঁতভাবে। আপনাকে অনায়াসে বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত ও স্টাইলিশ স্টপার বলতে আমাদের একটুও ইতস্তত করতে হবে না।

এমনকি প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় ও সমর্থকদের সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিলেন আপনি। ৮২-তে খেলা থেকে অবসর নেওয়ার আগে আপনার শেষ খেলাটি গ্যালারিতে বসে দেখেছিলাম, মনে আছে খেলার শেষে সতীর্থ ও প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের সঙ্গে আবেগময় বিদায় জ্ঞাপনের দৃশ্যটি। সারা স্টেডিয়ামের দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতায় অভিনন্দিত করেছিলো ঢাকার ফুটবলের রাজসিক খেলোয়াড়টিকে।

আজ আপনাকে লিখছি এই বিদায়ের প্রসঙ্গ নিয়েই। ডাক্তার জবাব দিয়েছে, আর কিছু করণীয় নেই – এর চেয়ে ভয়ংকর কোনো কথা আর হয় না। যার প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে তার জন্যে তো বটেই, তার আশেপাশের মানুষ, প্রিয়জন ও স্বজন-বন্ধুদের জন্যেও এক ভয়াবহ অসহায়তার অনুভব। আপনার জন্যে অচেনা, কোনোদিন না-দেখা অসংখ্য মানুষও কাতর হবে, অশ্রু বিসর্জন দেবে। আপনি তার কিছুই জানবেন না। জেনেই বা কী এসে যাবে!

১৯৯৮ সালে একদিন পত্রিকায় পড়ে চমকে উঠলাম, কর্কটরোগে আক্রান্ত আপনি। এমনই এক রোগ যার নামই অস্তিত্বের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। তবু চিকিৎসায় সেরে উঠলেন আপনি। কিছুকাল পরে আবার ফিরে এলো রোগ। এইভাবে ক্যানসারের সঙ্গে এক ধরনের লড়াই চলছিলো আপনার প্রায় দশ বছর ধরে। এই লড়াইয়ের মাশুল এখন গুনছে আপনার শরীর। কিডনি অকেজো হয়েছে, ডায়ালিসিস চলছে, তার সঙ্গে আরো আনুষঙ্গিক জটিলতা। স্টপার আজ ক্লান্ত, তার স্লাইড ট্যাকল হয়তো এবার ব্যর্থ হতে চললো। আজ একটু আগে জানলাম, সম্প্রতি আপনার ছোটোখাটো স্ট্রোকও হয়ে গেছে বার চারেক। ডায়ালিসিস চলছে ক্রমাগত।

এইসব সময়ে বোঝা যায় আমাদের মনুষ্যজীবনের নশ্বরতা ও সীমাবদ্ধতা। মতি নন্দীর ‘স্টপার’ উপন্যাসের পরাক্রান্ত স্টপার মাঠে অপরাজেয় হলেও বাস্তব জীবনের রূঢ় আক্রমণের সামনে সে প্রতিরোধহীন। মাঠে প্রতিপক্ষের দুরন্ত স্ট্রাইকারকে রুখে দেওয়ার কৌশল আপনার জানা ছিলো, কিন্তু এই যে চলে যাওয়ার কথা উঠছে সেখানে আপনার – বস্তুত সব মানুষেরই – কিছুই করণীয় নেই। অনিবার্য জেনেও এর জন্যে প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয় না।

এদিকে মঞ্জু ভাই কী করেন? তিনি নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা ৯২ থেকে। গত বছর তাঁর ডালাস শহরে চলে আসার কথা, বাড়ি কিনে স্ত্রী-পুত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন, নিজে থেকে গেছেন নিউ ইয়র্কে। বিষণ্ণ মুখে বললেন, কী করে আসি? কখন নান্নুর কী খবর আসে, ওখান থেকে তৎক্ষণাৎ রওনা হয়ে যেতে পারবো। কখন যেতে হয়, কে জানে!

৭২-এ শোনা আকাশবাণীর ধারাভাষ্যকারের বাক্যটি মনে আসে – মাঝমাঠে ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটি কাউকে দাঁড়াতেই দিচ্ছে না। মহামহিম সেই অন্তিম হয়তো বাস্তব হয়ে মাঝমাঠের কর্তৃত্ব নিয়ে নিয়েছে, সেখানে যে সে কাউকে কখনো দাঁড়াতে দেয়নি। দেবে না।

--------------------------------------------
জানুয়ারি ২৪, ২০০৮

৭১-এ তাহলে আমরা যুদ্ধ করে অপরাধ করেছিলাম?


আমার সারা শরীর কাঁপছে। সীমাহীন ক্রোধে। আক্রোশে। কিছু করতে না পারার অক্ষমতায়।

আজ প্রথম আলোতে ওপরের রিপোর্টটি ছাপা হয়েছে।

বাড়তে বাড়তে রাজাকাররা আজ কোথায় এসে পড়েছে। কলাগাছ কাটতে কাটতে নাকি মানুষ ডাকাত হয়। তারা আজ বলতে সাহস পাচ্ছে, যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়া অপরাধ ছিলো না। তারা এখন আমাদের টুঁটি টিপে ধরতে উদ্যত।

দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধের সময় শত্রুর পক্ষ নেওয়া অপরাধ না হলে অপরাধ কোনটা? আমরা যারা যুদ্ধ করেছিলাম, তারাই তাহলে অপরাধী? বিজয়ীরা অপরাধী? পরাজিতরা নয়?

কোথায় তাদের এই দুঃসাহসের উৎস আমার আর জানতেও ইচ্ছে হয় না ...

সত্যি আমি আর লিখতে পারছি না।

------------------------------
জানুয়ারি ২৪, ২০০৮

Monday, January 14, 2008

‘ভাঙনের শব্দ শুনি’



এই রচনার শিরোনাম সেলিম আল দীনের লেখা একটি টিভি নাটক থেকে ধার করা। আশির দশকের গোড়ার দিকে বিটিভিতে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পাওয়া একটি মিনি সিরিয়াল। যতোদূর মনে পড়ে, এই টিভি পর্দায় হুমায়ূন ফরীদির সর্বপ্রথম খল চরিত্রে অভিনয়, অতি তরুণ বয়সে সে করেছিলো মধ্যবয়সী গ্রাম্য মাতবর সেরাজ তালুকদারের চরিত্রটি। ‘আমি তো জমি কিনি না, পানি কিনি, পানি’ সংলাপটি তখন মানুষের মুখে মুখে। নাটকের প্রযোজক ছিলেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু।

সেলিম আল দীন চলে গেলেন, কোনো ঘোষণা না দিয়ে। ৫৮ বছর কি চলে যাওয়ার বয়স? আমাদের মতো কতো হেঁজিপেঁজি মানুষ পৃথিবীতে দীর্ঘকাল বেঁচে আছি, থাকবো। সময় না হতেই চলে যাবেন সেলিম আল দীনের মতো প্রতিভাবানরা। ঠিক সুবিচার মনে হয় না।

আজ আমার মন ভালো নেই। সকালে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েও গেলাম না, ইচ্ছে করলো না। সাতসকালে ঢাকা থেকে ফোন এলো পীযূষ ও ফরীদির। তার আগেই বিডিনিউজ আমাকে খবর দিয়ে দিয়েছে। পেনসিলভানিয়ায় আসাদকে ফোন করি, কানাডায় দিনু বিল্লাহকে, ন্যাশভিলে রেজাকে। কারো সঙ্গেই বেশিক্ষণ কথা বলা সম্ভব হয় না। নিকটজনের প্রয়াণে যেরকম হয়।

না, সেলিম ভাই আমার রক্তসম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন না, ছিলেন আত্মার আত্মীয়। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ও খুব গভীরে যায়নি। অথচ আশ্চর্য এক বাঁধনে তিনি বেঁধে ফেলেছিলেন আমাকে এবং আমার মতো আরো অনেককে তাঁর রচনা, প্রতিভা এবং অসামান্য কর্মদক্ষতায়। আমাদের মুগ্ধ ও মোহিত করে রাখলেন অনেকদিন ধরে। এবং অতঃপর প্রস্থান করলেন।

১৯৭৩-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম কেনা কয়েকটি বইয়ের মধ্যে ছিলো টিএসসি-র বুকস্টোর থেকে কেনা একটি পেপারব্যাক ‘সর্প বিষয়ক গল্প ও অন্যান্য’। রচয়িতা সেলিম আল দীন। তখন তিনি উঠতি নাট্যকার, স্বাধীনতার পরে ঢাকার নতুন ধারার নাটকের প্রধান পুরুষদের একজন। ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ ততোদিনে অভিনীত হয়ে গেছে, গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটছে। ঢাকা থিয়েটার গঠিত হলো, সূচনাপর্ব থেকে অন্তিম দিন পর্যন্ত সেখানে জড়িত ছিলেন তিনি।

সেলিম আল দীনের রচনা এবং নাসিরউদ্দিন ইউসুফের নির্দেশনার যে যুগলবন্দী তৈরি হলো ৭৩-এ, তা বাংলাদেশের নাটককে দিয়েছে অপরিমেয়। সেলিম আল দীনের রচনায় মঞ্চে এলো বাংলাদেশের প্রথম মিউজিক্যাল স্যাটায়ার ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’, ‘শকুন্তলা’, ‘কিত্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘হাতহদাই’, ‘বনপ্রাংশুল’, ‘চাকা’, ‘সাইফুল মুলক বদিউজ্জামাল’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘নিমজ্জন’। ৭৭-এ বাংলাদেশের প্রথম পথনাটক ‘চরকাঁকড়ার ডকুমেন্টারি’। টিভিতে ‘রক্তের আঙুরলতা’, ‘গ্রন্থিকগণ কহে’। এই তালিকা নিতান্তই অসম্পূর্ণ, যা তাঁর রচনার ব্যাপ্তি ধারণ করে না।

সেলিম আল দীনের নাট্যরচনার শুরু ছিলো পাশ্চাত্য ধাঁচে, কিছুটা অ্যাবস্ট্রাক্ট ধরনের। অবিলম্বে তিনি নিজের পথ খুঁজে পেলেন দেশীয় ঐতিহ্য ও লোকজ ধারা এবং প্রাচ্য দর্শনে। তাঁর সব উল্লেখযোগ্য কাজ এই ধারার।

সাহিত্যরচনা তিনি শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে, বেশিদিন থাকেননি সেখানে। রসিকতা করে বলতেন, আমি তো ব্যর্থ কবি, তাই গদ্যরচনা করি।

তবে তাঁর কিছু নাটকে আশ্চর্য কাব্যময় কিছু পংক্তি আমরা পেয়েছি। স্মৃতি থেকে উদ্ধার করি ‘শকুন্তলা’ নাটকের একটি সংলাপ : আমার প্রার্থনা চৈত্রের শিমুল তুলো – লক্ষ্যহীন কেবলই উড়ে যায়, স্পর্শ করে না!

ঠিক তার বিপরীতে মানুষের প্রতিদিনের মুখের ভাষার একটি নমুনা ‘কিত্তনখোলা’ থেকে : ডালিমনের গায়ের ঘাম, চুকা চুকা গন্ধ।

অনেক বড়ো ক্ষমতাবান লেখক ছাড়া এই বৈপরীত্য ধারণ করা সম্ভব নয়। পড়াশোনায় ছিলেন অক্লান্ত, আগ্রহ ছিলো তাঁর বিচিত্র বিষয়ে। সেলিম আল দীন কীরকম বিশুদ্ধতাপিয়াসী পরিশ্রমী লেখক ছিলেন তার পরিচয় দিতে এটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে শকুন্তলা নাটকটি তিনি সতেরো-আঠারোবার লিখেছিলেন। লিখতে বসলে আহার-নিদ্রা ভুলে যেতেন, লিখতেন ঘোরগ্রস্তের মতো। এমন ঘটনাও আছে, একটা লেখা রাত তিনটায় শেষ করে ফরীদিকে ডেকে আনছেন পড়ে শোনাবেন বলে।

কবি রফিক আজাদ আজ পুত্রহারা হলেন। সেলিম আল দীনকে তিনি বলতেন বেটা, সেলিম ভাই তাঁকে বাপ ডাকতেন। বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের বন্ধুত্বে আজ ছেদ পড়লো।

সেলিম ভাইকে আমি প্রথম দেখি ৭৪ বা ৭৫-এ টিএসসির দোতলায় ঢাকা থিয়েটারের রিহার্সালে। একদিকে নাটকের মহড়া চলছে, আর তিনি মেঝেতে বসে গভীর মনোযোগে কাগজপত্র ওল্টাচ্ছেন, পাণ্ডুলিপি সংশোধন করছেন। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। এরপর মগবাজারে আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়ে ঢাকা থিয়েটারের মহড়া হতো, সেখানেও প্রায় একই ভঙ্গিতে তাঁকে দেখতাম। বাচ্চু ভাইয়ের পুরানা পল্টনের বাসায়ও হুবহু এক ভঙ্গিতে তাঁকে দেখেছি। সেলিম ভাইকে ভাবলে মেঝেতে বসা তাঁর এই ছবিটিই আমার মনে আসে।

একটু আগে ঢাকা থেকে আমার আরেক বন্ধু আলমগীর ফোন করে বলে, আজ আমার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে দোস্ত। সেলিম ভাই আমাদের কী ভালোবাসতেন, সেই মানুষ আজ নেই।

ঢাকায় তখন রাত একটা, বান্ধবহীন আলমগীর একা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে সেলিম ভাইয়ের জন্যে মন খারাপ করে। সেলিম ভাই আমাদের চেয়ে বয়সে কয়েক বছরের বড়ো ছিলেন। হয়তো তাঁর এই প্রস্থান (নাটকীয় বলতে লোভ হয়, প্রস্থান শব্দটি নাটকে অপরিহার্য শব্দ) আমাদের ক্রমাসন্ন পরিণতির কথা ভাবায়। মনে হয় ভাঙনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আর আমাদের কালের নায়করা কেউ কেউ প্রস্থান করেছেন, অনেকে প্রস্থানোদ্যত। মৃত্যুর খুব কাছে থেকে ফিরে আসা রাইসুল ইসলাম আসাদ প্রায় পঙ্গু অবস্থা কাটিয়ে নতুন করে হাঁটা শিখছে, ফরীদি হাঁপানি-নিউমোনিয়ার প্রকোপ সামলে হাসপাতাল থেকে সদ্য ফিরেছে, ফুটবলার নান্নুকে ডাক্তার জবাব দিয়ে গেছে। আমরা সবাই আসছি কিছু আগে বা পরে।

বিদায়, সেলিম ভাই। একজন অনুরাগীর অভিবাদন নিন।

একটি সহজ-সরল কবিতা, আমাদের সবার গল্প

এক জন্ম
তারাপদ রায়

অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দু’জনেই দু’জনকে বলবো,
‘অনেকদিন দেখা হয়নি’।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বৎসরের পর বৎসর।
তারপর একদিন হয়ত জানা যাবে
বা হয়ত জানা যাবে না,
যে
তোমার সঙ্গে আমার
অথবাআমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।

Saturday, January 12, 2008

দুশ্চিন্তায় কিছু হয়?

সকালের কফিসহ কমপিউটারে বসেই খবরটা দেখলাম। যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, সেটি কিনে নিয়েছে আরেকটি কোম্পানি। এদেশে এরকম হরহামেশাই হয়। বড়ো মাছ ছোটো মাছকে গিলে খায়, তাতে নতুনত্ব কিছু নেই।

গত মাসকয়েক ধরে অফিসে এইসব নিয়ে নানারকম গুজগুজ, ফিসফাস এবং সশব্দ জল্পনা চলছিলো, শেয়ার মার্কেটে কোম্পানির স্টক দ্রুত পড়ে যাচ্ছে, কোম্পানি টিকবে কি না, ব্যাংকরাপটসি করবে কি না - এইসব। কিছু লে-অফ হলো, কয়েকজন দ্রুত অন্যত্র কাজ নিয়ে চলে গেলো।

আজ অফিসে এসে দেখি, ফিসফাস আর নেই, জোর আলোচনা। অনেকে উদ্বিগ্ন। এই ধরনের মার্জারের ফলে অবধারিতভাবে কিছু কর্মী উদ্বৃত্ত হয়ে পড়ে পদ-পদবীর ডুপ্লিকেশনের কারণে। আরো ঘটে আইটি-ঘটিত এলাকায়, বিশেষত যখন দুই মিলিত প্রতিষ্ঠানের আইটি সংস্কৃতি (সিস্টেমস ইত্যাদি) ভিন্নমুখী হয়। অসম সংস্কৃতির বিবাহের মতো।

অফিসে কেউ কেউ দেখলাম রীতিমতো চিন্তিত, যত্রতত্র জটলা করে আলোচনা চলছে।

আমার বোধহয় বোধবুদ্ধি একটু ভোঁতা ধরনের। এইসব আমাকে স্পর্শ করে না, আমি নিশ্চিন্ত মনে ব্লগ পড়ছি, লিখছি। একজন এসে জিজ্ঞেস করলো, তোমার চিন্তা হচ্ছে না?

বললাম, চিন্তা করে করবো কি? যা হচ্ছে বা হবে তার ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সুতরাং ভেবে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। আমার রেজু্যমেটি আপডেট করে প্রস্তুত থাকা ছাড়া আর তো কিছু করণীয় দেখছি না।

উদ্বিগ্ন সহকর্মী কোনো সান্ত্বনা পায় না।

গত বছর আমার বন্ধু পীযূষ এলো ঢাকা থেকে, তাকে নিয়ে যাচ্ছি হিউস্টনে। পথে ছোটোখাটো একটা দুর্ঘটনায় পড়ি, গাড়ির সামনের বাম্পার গেলো। পরে পীযূষ জানালো, ধাক্কা লাগার পরে তুমি যেভাবে নিশ্চিন্তমনে গাড়ি থেকে নামলে যেন এসব তোমার প্রতিদিনের ঘটনা!

আসলে তা নয়। আমি চিন্তা এবং দুশ্চিন্তাকে পরিষ্কার দুই ভাগে ভাগ করে নিয়েছি। মানুষ হিসেবে চিন্তাশক্তি আছে, তার চর্চা করবো। কিন্তু দুশ্চিন্তায় কার কি উপকার হয় আমি জানি না। দুশ্চিন্তা কোনো সমাধান দেয় না, বরং চিন্তাশক্তিকে ধোঁয়াচ্ছন্ন করে, শরীরে তার প্রভাব পড়ে।

পরপর পাঁচবার উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন বিয়র্ন বর্গ খ্যাত হয়েছিলেন আইসবার্গ নামে। একেকটি ম্যাচ শেষ করার পর নাকি তাঁর পালস রেট থাকতো মিনিটে পঞ্চাশের নিচে। আমার স্ত্রীও আমাকে সেই গোত্রের একজন মনে করে।

Sunday, January 6, 2008

‘এই মনোরম মনোটোনাস শহরে…’



এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। রাত এগারোটা পার হয় হয়, এখনো রাস্তার রিকশা চলছে ছল ছল করে যেনো গোটিয়ার বিলে কেউ নৌকা বাইছে, ‘তাড়াতাড়ি করো বাহে, ঢাকার গাড়ি বুঝি ছাড়ি যায়।’ আমার জানালায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারের ভিজে গন্ধভরা সারি, বিষাদবর্ণ দেওয়াল; অনেকদিন পর আমার ভারি ভালো লাগছে। ছমছম করা এই রাত্রি, আমারি জন্যে তৈরি এরকম লোনলী-লগ্ন আমি কতোদিন পাইনি, কতোকাল, কোনোদিন নয়।

গল্পের প্রথম বাক্যে ‘মনোরম’ শব্দটির ঠিক পরে ‘মনোটোনাস’ লিখতে প্রচুর সাহস লাগে। ‘রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক’, ‘লোনলী-লগ্ন’ – এই শব্দ ও শব্দবন্ধগুলিও লক্ষ্য করার মতো। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো কেউ একজন তা পারেন। সর্বসাকুল্যে ৫টি গল্পগ্রন্থে (‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’, ‘খোঁয়ারি’, ‘দুধভাতে উৎপাত’, ‘দোজখের ওম’ ও ‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’) সংকলিত ২৮টি গল্প, ২টি উপন্যাস (‘চিলেকোঠার সেপাই’ ও ‘খোয়াবনামা’) ও একটি প্রবন্ধ সংকলনগ্রন্থ (‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’) নিয়ে যিনি সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম গদ্যলেখকদের একজন হিসেবে স্বীকৃত ও অমরত্বের দাবিদার হবেন।

*******************************************

একটু আগে কনফুসিয়াসের ব্লগ লাট্টু ২ পড়ছিলাম। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মৃত্যুবার্ষিকীর উল্লেখ দেখে নিজের ওপর রাগ হলো, কী করে ভুলে গেলাম? মাত্র ১০ বছরে!

*******************************************
১৯৭৬-এর মে মাসে প্রকাশিত হলো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’। যথার্থ নামকরণ, এই স্বর বাংলা সাহিত্যে এর আগে শোনা যায়নি। আগুন একেকটা গল্প। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এই মুগ্ধ পাঠক তখন সেই বই বালিশের তলায় রেখে ঘুমায়, এমন অবস্থা। তখনো লেখককে চাক্ষুষ দেখিনি। এই বইয়ের প্রচ্ছদ করেছিলেন কাজী হাসান হাবিব, তাঁকেও তখন শুধু নামে চিনি, পরবর্তীকালে যিনি আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠবেন। হাবিবকে নিয়ে একটি পোস্ট ক’দিন আগে সচলে দিয়েছিলাম – হাবিব, বন্ধু আমার ।

আজ দু’জনের কেউ আর পৃথিবীতে নেই। নয় বছরের ব্যবধানে দু’জনেই গেছেন ক্যানসারে – আগে হাবিব, পরে ইলিয়াস। ৯৬ সালের জানুয়ারিতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পায়ে ক্যানসার ধরা পড়ে, দু’মাস পরে ডান পা সম্পূর্ণ কেটে বাদ দেওয়া হয়। মৃত্যু হলো ৯৭-এর ৪ জানুয়ারি।

*******************************************

লেখকের সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় তাঁর হাটখোলার বাসায় ৭৮-এর এক দুপুরে। উপলক্ষ মনে নেই, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায় ও সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে গিয়েছিলাম। ঘনিষ্ঠতা তেমন কিছু হয়নি, হওয়ার কথাও নয়। তবে দুটি স্মরণীয় বিকেল তাঁর সঙ্গে কেটেছিলো বগুড়া শহরে তাঁর পৈত্রিক বাড়িতে। বগুড়া আমারও শহর, গ্রীষ্মের ছুটিতে গেছি। ইলিয়াস ভাইও এসেছেন। পরপর দুই বিকেলে তাঁদের বাড়ির পুবদিকে গাছপালায় ঘেরা খোলা বারান্দায় বসে আড্ডা হয়েছিলো। তাঁর ছোটো ভাই খালিকুজ্জামান ইলিয়াসও অল্পক্ষণ বসে কোথাও বেরিয়ে গেলেন। আমরা দু’জনে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনন্ত বকবক চালিয়ে যাই।

ইলিয়াস ভাইদের জলেশ্বরীতলার বাড়িটির অবস্থান কিছু বিচিত্র। পুবমুখো একতলা বাড়ি বাইরে এলে প্রথম চোখ ধাক্কা খাবে রাস্তার উল্টোদিকে জেলখানার বিশাল উঁচু দেওয়ালে। তার পাশে জেলর সাহেবের বাসস্থান। তার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অফিসার্স ক্লাব, টেনিস কোর্ট, পাশে জেলা প্রশাসকের বাংলো। এগুলির পুব সীমানা ঘেঁষে করতোয়া নদী, ইলিয়াস ভাইদের বাড়ির দরজা থেকে তার দূরত্ব পাঁচশো গজের বেশি হবে না।

সেই দুই বিকেলের আলাপের দুটি বিষয় মনে আছে। ইলিয়াস ভাই জিজ্ঞেস করলেন, জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ পড়েছি কি না। বললাম, পড়তে শুরু করেছিলাম, কিছুদূর গিয়ে দম ফুরিয়ে গেছে। তিনি ‘ইউলিসিস’ পাঠের সহজ রাস্তা বাতলে দিয়ে বললেন, ওই বইয়ে কিছু রগরগে অংশ আছে, খুঁজে খুঁজে ওগুলি আগে পড়ে ফেলো। তারপর গোড়া থেকে শুরু করতে পারো!

আরেকটি প্রসঙ্গ এলো গল্প-উপন্যাসে সংলাপে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের অসুবিধা বিষয়ে। বগুড়া অঞ্চলের ভাষা কিছু দুরূহ ও তার একটি নিজস্ব টান আছে যা লেখায় আনা কঠিন বলে আমি মত দিই। মন্তব্য করি, বগুড়ার ভাষায় সংলাপ লিখলে সঙ্গে স্বরলিপি করে দিতে হবে।

সেদিন ইলিয়াস ভাই মুচকি হেসেছিলেন। আমার ধারণা ও মন্তব্য যে কতোটা অর্বাচীন ছিলো তার প্রমাণ পাওয়া গেলো তাঁর ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসে। তিনি অবলীলায় কী চমৎকারভাবে বগুড়ার পূর্বাঞ্চলের ভাষা সেখানে তুলে আনলেন। কোনো স্বরলিপি দরকার হয়নি।

*******************************************

তাঁর লেখায় যেমন তির্যক রসিকতা ও শ্লেষের সন্ধান পাওয়া যায়, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়ও তার নমুনা অনেক আছে।

কলকাতায় তাঁর একটি পা কেটে বাদ দেওয়ার পর সেখানকার বন্ধু-শুভার্থীদের বললেন, আপনাদের এখানে একটা পা রেখেই গেলাম।

আরেকবার বললেন, আমার নেই পা-টাতে চুলকানোর অনুভূতি হচ্ছে!

ষাটের একজন বিখ্যাত কবি-কাম-গদ্যকারের রচনা আমার পছন্দ নয়। একদিন এক আড্ডায় ইলিয়াস ভাইকে ওই লেখকের লেখা বিষয়ে মন্তব্য করতে বলি। ইলিয়াস ভাই বললেন, ও খুব ভালো লোক, খুব ভালো লোক!

*******************************************

বাংলা সাহিত্য অল্পবিস্তর যা পড়া আছে, তাতে দেখেছি অনেক নমস্য লেখকও অনেক আজেবাজে লেখা লিখেছেন। মানিক-বিভূতি-ওয়ালীউল্লাহ-সমরেশ সবাই। অথচ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সম্পূর্ণ রচনাবলী পড়েও একটি অসার্থক রচনার সন্ধান পাইনি। এটি অবশ্য আমার একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত। তুলনামূলক বিচারের প্রশ্ন নয়, শ্রেষ্ঠত্বের কথাও নয়। কিন্তু এই অসম্ভব কর্মটি তিনি কীভাবে সম্পন্ন করলেন? দুই উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ও ‘খোয়াবনামা’ দুটি সম্পূর্ণ আলাদা পৃথিবীর ছবি। গল্পগুলির মধ্যে ‘খোঁয়ারি’, ‘উৎসব’, ‘অসুখ-বিসুখ’, ‘তারাবিবির মরদ পোলা’, ‘দোজখের ওম’ – কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি?

এই জাতের লেখকরা খুব পাঠকপ্রিয় হন না। তারও একটি নমুনা দিই। লতায়-পাতায় এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় কিছুদিন আগে আমার কাছ থেকে ‘গল্পের বই’ চেয়ে বসলেন। আমি বিপদগ্রস্ত, কারণ সবাইকে বই ধার দিতে আমার মন ওঠে না – বিশেষত যারা বইয়ের যত্ন করে না, আঙুলে থুথু লাগিয়ে পাতা ওল্টায় বা বইয়ের পাতা ভাঁজ করে কদ্দুর পড়া হলো তার চিহ্ন রাখে। আমার এই আত্মীয়টি সেই দলের একজন।

এড়ানোর জন্যে বলি, আমার কাছে যেসব বই আছে আপনার ভালো লাগবে না।

পাল্টা প্রশ্ন এলো, কার লেখা আপনার ভালো লাগে?

উত্তরে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের নাম বলি ইচ্ছে করেই।

আত্মীয় বললেন, তাঁর লেখা চার-পাঁচটা উপন্যাস পড়েছি, আমারও ভালো লাগে।

হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে একটু সময় লাগে। তারপরেও না বলে পারলাম না, এই লেখক সারাজীবনে সাকুল্যে দুটি উপন্যাস লিখেছেন। আর যে লিখবেন সে সম্ভাবনাও নেই, কারণ তিনি মৃত।