Sunday, January 6, 2008

‘এই মনোরম মনোটোনাস শহরে…’



এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। রাত এগারোটা পার হয় হয়, এখনো রাস্তার রিকশা চলছে ছল ছল করে যেনো গোটিয়ার বিলে কেউ নৌকা বাইছে, ‘তাড়াতাড়ি করো বাহে, ঢাকার গাড়ি বুঝি ছাড়ি যায়।’ আমার জানালায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারের ভিজে গন্ধভরা সারি, বিষাদবর্ণ দেওয়াল; অনেকদিন পর আমার ভারি ভালো লাগছে। ছমছম করা এই রাত্রি, আমারি জন্যে তৈরি এরকম লোনলী-লগ্ন আমি কতোদিন পাইনি, কতোকাল, কোনোদিন নয়।

গল্পের প্রথম বাক্যে ‘মনোরম’ শব্দটির ঠিক পরে ‘মনোটোনাস’ লিখতে প্রচুর সাহস লাগে। ‘রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক’, ‘লোনলী-লগ্ন’ – এই শব্দ ও শব্দবন্ধগুলিও লক্ষ্য করার মতো। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো কেউ একজন তা পারেন। সর্বসাকুল্যে ৫টি গল্পগ্রন্থে (‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’, ‘খোঁয়ারি’, ‘দুধভাতে উৎপাত’, ‘দোজখের ওম’ ও ‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’) সংকলিত ২৮টি গল্প, ২টি উপন্যাস (‘চিলেকোঠার সেপাই’ ও ‘খোয়াবনামা’) ও একটি প্রবন্ধ সংকলনগ্রন্থ (‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’) নিয়ে যিনি সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম গদ্যলেখকদের একজন হিসেবে স্বীকৃত ও অমরত্বের দাবিদার হবেন।

*******************************************

একটু আগে কনফুসিয়াসের ব্লগ লাট্টু ২ পড়ছিলাম। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মৃত্যুবার্ষিকীর উল্লেখ দেখে নিজের ওপর রাগ হলো, কী করে ভুলে গেলাম? মাত্র ১০ বছরে!

*******************************************
১৯৭৬-এর মে মাসে প্রকাশিত হলো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’। যথার্থ নামকরণ, এই স্বর বাংলা সাহিত্যে এর আগে শোনা যায়নি। আগুন একেকটা গল্প। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এই মুগ্ধ পাঠক তখন সেই বই বালিশের তলায় রেখে ঘুমায়, এমন অবস্থা। তখনো লেখককে চাক্ষুষ দেখিনি। এই বইয়ের প্রচ্ছদ করেছিলেন কাজী হাসান হাবিব, তাঁকেও তখন শুধু নামে চিনি, পরবর্তীকালে যিনি আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠবেন। হাবিবকে নিয়ে একটি পোস্ট ক’দিন আগে সচলে দিয়েছিলাম – হাবিব, বন্ধু আমার ।

আজ দু’জনের কেউ আর পৃথিবীতে নেই। নয় বছরের ব্যবধানে দু’জনেই গেছেন ক্যানসারে – আগে হাবিব, পরে ইলিয়াস। ৯৬ সালের জানুয়ারিতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পায়ে ক্যানসার ধরা পড়ে, দু’মাস পরে ডান পা সম্পূর্ণ কেটে বাদ দেওয়া হয়। মৃত্যু হলো ৯৭-এর ৪ জানুয়ারি।

*******************************************

লেখকের সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় তাঁর হাটখোলার বাসায় ৭৮-এর এক দুপুরে। উপলক্ষ মনে নেই, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায় ও সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে গিয়েছিলাম। ঘনিষ্ঠতা তেমন কিছু হয়নি, হওয়ার কথাও নয়। তবে দুটি স্মরণীয় বিকেল তাঁর সঙ্গে কেটেছিলো বগুড়া শহরে তাঁর পৈত্রিক বাড়িতে। বগুড়া আমারও শহর, গ্রীষ্মের ছুটিতে গেছি। ইলিয়াস ভাইও এসেছেন। পরপর দুই বিকেলে তাঁদের বাড়ির পুবদিকে গাছপালায় ঘেরা খোলা বারান্দায় বসে আড্ডা হয়েছিলো। তাঁর ছোটো ভাই খালিকুজ্জামান ইলিয়াসও অল্পক্ষণ বসে কোথাও বেরিয়ে গেলেন। আমরা দু’জনে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনন্ত বকবক চালিয়ে যাই।

ইলিয়াস ভাইদের জলেশ্বরীতলার বাড়িটির অবস্থান কিছু বিচিত্র। পুবমুখো একতলা বাড়ি বাইরে এলে প্রথম চোখ ধাক্কা খাবে রাস্তার উল্টোদিকে জেলখানার বিশাল উঁচু দেওয়ালে। তার পাশে জেলর সাহেবের বাসস্থান। তার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অফিসার্স ক্লাব, টেনিস কোর্ট, পাশে জেলা প্রশাসকের বাংলো। এগুলির পুব সীমানা ঘেঁষে করতোয়া নদী, ইলিয়াস ভাইদের বাড়ির দরজা থেকে তার দূরত্ব পাঁচশো গজের বেশি হবে না।

সেই দুই বিকেলের আলাপের দুটি বিষয় মনে আছে। ইলিয়াস ভাই জিজ্ঞেস করলেন, জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ পড়েছি কি না। বললাম, পড়তে শুরু করেছিলাম, কিছুদূর গিয়ে দম ফুরিয়ে গেছে। তিনি ‘ইউলিসিস’ পাঠের সহজ রাস্তা বাতলে দিয়ে বললেন, ওই বইয়ে কিছু রগরগে অংশ আছে, খুঁজে খুঁজে ওগুলি আগে পড়ে ফেলো। তারপর গোড়া থেকে শুরু করতে পারো!

আরেকটি প্রসঙ্গ এলো গল্প-উপন্যাসে সংলাপে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের অসুবিধা বিষয়ে। বগুড়া অঞ্চলের ভাষা কিছু দুরূহ ও তার একটি নিজস্ব টান আছে যা লেখায় আনা কঠিন বলে আমি মত দিই। মন্তব্য করি, বগুড়ার ভাষায় সংলাপ লিখলে সঙ্গে স্বরলিপি করে দিতে হবে।

সেদিন ইলিয়াস ভাই মুচকি হেসেছিলেন। আমার ধারণা ও মন্তব্য যে কতোটা অর্বাচীন ছিলো তার প্রমাণ পাওয়া গেলো তাঁর ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসে। তিনি অবলীলায় কী চমৎকারভাবে বগুড়ার পূর্বাঞ্চলের ভাষা সেখানে তুলে আনলেন। কোনো স্বরলিপি দরকার হয়নি।

*******************************************

তাঁর লেখায় যেমন তির্যক রসিকতা ও শ্লেষের সন্ধান পাওয়া যায়, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়ও তার নমুনা অনেক আছে।

কলকাতায় তাঁর একটি পা কেটে বাদ দেওয়ার পর সেখানকার বন্ধু-শুভার্থীদের বললেন, আপনাদের এখানে একটা পা রেখেই গেলাম।

আরেকবার বললেন, আমার নেই পা-টাতে চুলকানোর অনুভূতি হচ্ছে!

ষাটের একজন বিখ্যাত কবি-কাম-গদ্যকারের রচনা আমার পছন্দ নয়। একদিন এক আড্ডায় ইলিয়াস ভাইকে ওই লেখকের লেখা বিষয়ে মন্তব্য করতে বলি। ইলিয়াস ভাই বললেন, ও খুব ভালো লোক, খুব ভালো লোক!

*******************************************

বাংলা সাহিত্য অল্পবিস্তর যা পড়া আছে, তাতে দেখেছি অনেক নমস্য লেখকও অনেক আজেবাজে লেখা লিখেছেন। মানিক-বিভূতি-ওয়ালীউল্লাহ-সমরেশ সবাই। অথচ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সম্পূর্ণ রচনাবলী পড়েও একটি অসার্থক রচনার সন্ধান পাইনি। এটি অবশ্য আমার একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত। তুলনামূলক বিচারের প্রশ্ন নয়, শ্রেষ্ঠত্বের কথাও নয়। কিন্তু এই অসম্ভব কর্মটি তিনি কীভাবে সম্পন্ন করলেন? দুই উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ও ‘খোয়াবনামা’ দুটি সম্পূর্ণ আলাদা পৃথিবীর ছবি। গল্পগুলির মধ্যে ‘খোঁয়ারি’, ‘উৎসব’, ‘অসুখ-বিসুখ’, ‘তারাবিবির মরদ পোলা’, ‘দোজখের ওম’ – কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি?

এই জাতের লেখকরা খুব পাঠকপ্রিয় হন না। তারও একটি নমুনা দিই। লতায়-পাতায় এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় কিছুদিন আগে আমার কাছ থেকে ‘গল্পের বই’ চেয়ে বসলেন। আমি বিপদগ্রস্ত, কারণ সবাইকে বই ধার দিতে আমার মন ওঠে না – বিশেষত যারা বইয়ের যত্ন করে না, আঙুলে থুথু লাগিয়ে পাতা ওল্টায় বা বইয়ের পাতা ভাঁজ করে কদ্দুর পড়া হলো তার চিহ্ন রাখে। আমার এই আত্মীয়টি সেই দলের একজন।

এড়ানোর জন্যে বলি, আমার কাছে যেসব বই আছে আপনার ভালো লাগবে না।

পাল্টা প্রশ্ন এলো, কার লেখা আপনার ভালো লাগে?

উত্তরে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের নাম বলি ইচ্ছে করেই।

আত্মীয় বললেন, তাঁর লেখা চার-পাঁচটা উপন্যাস পড়েছি, আমারও ভালো লাগে।

হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে একটু সময় লাগে। তারপরেও না বলে পারলাম না, এই লেখক সারাজীবনে সাকুল্যে দুটি উপন্যাস লিখেছেন। আর যে লিখবেন সে সম্ভাবনাও নেই, কারণ তিনি মৃত।

No comments: