Saturday, June 21, 2008

মেয়েটা চলে যাবে!

দুপুরে একটা মিটিং আছে, তার আগে লাঞ্চ সেরে নেওয়ার কথা ভাবছি। এই সময় মেয়ের ফোন। উত্তেজিত কণ্ঠ তার।

বাবা, ইউটি অস্টিন আমাকে অ্যাকসেপ্ট করেছে।

তার আবেগ-উত্তেজনার অংশীদার আমিও। বলি, তাহলে তো একটা উৎসব করে উদযাপন করতে হয়।

আবেগে মেয়ের গলা বুজে আসছে। কোনোমতে বলে, আমি এতো খুশি! আমি কাঁদছি।

কোনোকিছুতে সম্পূর্ণ একাগ্রতা অথবা যুক্তিরহিত গোঁয়ার্তুমির সফল পরিণতি ঘটলে এরকম আবেগ চলে আসার কথা। মেয়ের ইচ্ছে, সে সাংবাদিকতা পড়বে। University of Texas at Austin-এর এ বিষয়ে সুনাম আছে। সেখানে সে আবেদন করে বসে থাকলো। কোনো কারণে এখানে তার ভর্তির ব্যবস্থা না হলে একটা বিকল্প থাকা যে দরকার, তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হলো। সে কানেও তোলে না। এক কথা তার, অস্টিনেই যাবো আমি। এই বোকা মেয়েকে নিয়ে করি কী! বিকল্প কিছু সে ভাবলোই না। ইউটি অস্টিনে আবেদন করার পর সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত সারাক্ষণ সে অনলাইনে তার আবেদনের ফলাফল এলো কি না দেখে। শেষ পর্যন্ত খবর পাওয়া গেলো গতকাল, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হিসেবে সে গৃহীত হয়েছে।

মেয়ের বাবা-মা হিসেবে আমরাও যে যথেষ্ট বোকা, তা এখানকার পরিচিত বাঙালিদের অনেকেই বিশ্বাস করেন। নিজে থেকে বলার দরকার হয় না, সামাজিক সাক্ষাতে প্রশ্ন শুনতে হয়, মেয়ে কী পড়বে? সাংবাদিকতা কেন, কমপিউটার বিজ্ঞান বা ব্যবসা প্রশাসন, নিদেনপক্ষে হিসাব বিজ্ঞান কেন নয় – এরকম পরোক্ষ হতাশা প্রকাশ করেন অনেকে। কেউ কেউ এমনও ইঙ্গিত দেন, বাবা-মা হিসেবে আমাদের উচিত এ বিষয়ে তাকে নির্দেশনা দেওয়া।

ক্যালিফোর্নিয়াবাসী এক কবিবন্ধু মেয়ের সাংবাদিকতা পড়ার আগ্রহ জেনে ঠাট্টা করে বলে, নাপতালিটা তুমিই করলে? তোমার লেখালেখির আগ্রহটা ওর মধ্যে দেখতে চাও, তুমিই ওকে উৎসাহ দিয়েছো।

কী করে বোঝাবো, সে নিজে তার জীবন যাপন করবে, আমরা নই। তার প্রবণতা ও আগ্রহের অনুগামী হবে সে, যে সুযোগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের বাবা-মা আমাদের দিতে চাননি, আমরা পাইনি। এই বিজ্ঞ শুভার্থীদের জানানোর দরকার মনে করি না যে, কথা ফোটার বয়স থেকে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের মতামত সবসময় মান্য না করলেও জিজ্ঞেস করার ব্যবস্থাটা চালু রেখেছি। এমনকি প্রতি বেলার খাবার কী চায়, তা-ও তাদের মর্জি অনুযায়ী হয় সাধারণত, তাদের কখনো বলা হয়নি, টেবিলে যা আছে তাই চুপচাপ খেতে হবে। আমাদের আত্মীয়-বন্ধুসহ অনেকে এটাকে বাড়াবাড়ি রকমের আদিখ্যেতা বলে মনে করেছেন, এখনো করেন।

এর বিপরীতে আমার অভিজ্ঞতা এরকম যে, সব বিষয়ে তাদের মত জানতে চাওয়া এবং তাদের মনোভাবকে মূল্য দেওয়ার একটা অসাধারণ ও অমূল্য প্রতিক্রিয়া ঘটে। তারা আত্মবিশ্বাসী হতে শেখে এবং তার প্রতিফলন ঘটে তাদের ব্যক্তিত্বে। তারা বুঝতে শেখে, তাদের আস্থায় নেওয়া হচ্ছে এবং সেই আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতি অনুগত হওয়াটাই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। বয়স যা-ই হোক, ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি সব মানুষকেই শুদ্ধ হতে সাহায্য করে।

এ দেশে টিন-এজারদের নিয়ে সব বাবা-মাকেই কিছু সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। অনভিজ্ঞতা ও অজ্ঞানতাজনিত এবং বয়সোচিত ছোটোখাটো দুয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে এই আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত মেয়ে আমাদের কিছুমাত্র হতাশ করেনি দেখে মনে হয়, ছেলেমেয়েদের বিষয়ে বোধহয় আমরা ভুল কিছু করিনি। মেয়ে বৃহত্তর পৃথিবীর জন্যে প্রস্তুত বলে বিশ্বাস করতে ভরসা পাই।

কবিবন্ধুকে বলা হয়নি, এই মেয়ে পনেরো বছর বয়সে One Hundred Years of Solitude, Chronicle of a Death Foretold, No One Writes to the Colonel পড়ে মার্কেজকে প্রিয় লেখকের তালিকায় তুলে ফেলেছে। কাফকার লেখা ও জীবন তার কাছে বিস্ময়ের আধার। ঝুম্পার The Namesake-এ সে নিজের সংকটের সাযুজ্য পেয়ে যায়। নিজের মতো লেখালেখিও করে, যদিও কাউকে দেখাতে অনিচ্ছুক সে। তার কিছু কিছু নজরে এলে মনে মনে স্বীকার করে নিয়েছি, ঐ বয়সে ওরকম উপলব্ধির বা লেখার ক্ষমতা আমার হয়নি। গত বছর তার একটি লেখার নমুনা সচলে তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি।

আসলে সে নিজেই নিজেকে তৈরি করেছে। বাবা-মা হিসেবে আমরা সেখানে শুধু সঙ্গত করে গেছি।

মেয়ে তার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে, এই প্রাথমিক আনন্দের আতিশয্য কেটে গেলে এক ধরনের বিষাদের মেঘ মাথার ভেতরে ঘন হয়ে উঠতে থাকে। মনে হয়, মেয়েটা চলে যাবে!

বেশি দূরে সে যাচ্ছে না, মাত্র দুশো মাইলের দূরত্বে। যাওয়া-আসা নিয়মিতই হবে। তবু এ-ও তো সত্যি, এই যে তার বাইরের পৃথিবীতে যাত্রা শুরু হলো, সে আর আমাদের কাছে ফিরবে না। একদা আমরাও আমাদের বাবা-মায়ের পরিচিত ছায়া থেকে বহির্গত হয়ে গিয়েছিলাম। আর ফেরা হয়নি। হয় না। আমাদের মেয়েরও সেই যাত্রা শুরু হবে এখন থেকে ঠিক দু’মাস পর।

মনে মনে রড স্টুয়ার্টের একটি গানের দুটি পঙক্তি আওড়াই (খুব ছোটোবেলায় এই গানটি মেয়ের প্রিয় ছিলো):

When you finally fly away
I’d be hoping that I’ve served you well
For all the wisdom of a lifetime
No one can ever tell…

No comments: