Saturday, October 27, 2007

'শিরে হৈলে সপ্যাঘাত, তাগা বাঁধব কুথা?'

এই মোক্ষম সংলাপটি ছিলো তারাশঙ্করের 'নাগিনীকন্যার কাহিনী' উপন্যাসে একটি চরিত্রের মুখে। সাপ মাথায় ছোবল দিলে বিষ আটকানোর জন্যে তাগা বাঁধার জায়গা তো আর থাকে না। ইন্টারনেটে প্রতিদিন বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো দেখতে দেখতে (সত্যি কথা এই যে আজকাল আর পড়তে হয় না, দেখেই নয়ন-মন সার্থক হয়ে যায়!) মনে হয়, আজকের বাংলাদেশের জন্যেই কি এই সংলাপ দূরদর্শী তারাশঙ্কর লিখেছিলেন?

সত্তর দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজের (স্বাধীনতাবিরোধীদের মধ্যে এই ব্যক্তির সরকারি গাড়িতে সর্বপ্রথম জাতীয় পতাকা উড়েছিলো, সুতরাং চরিত্রটি ঐতিহাসিক বটে!) মুখে এই মর্মে ঘোষণা শোনা গিয়েছিলো যে, শতকরা পঞ্চাশ ভাগ দুর্নীতি কমিয়ে ফেলা হবে। পরদিন সকালে দৈনিক ইত্তেফাক-এ এই খবরের একটি চমকপ্রদ ও বুদ্ধিদীপ্ত শিরোনাম দেখা গেলো - 'শতকরা পঞ্চাশ ভাগ দুর্নীতি জায়েজ'। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে এই ঘটনার পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর পরে দুর্নীতি দমন কমিশন নামে যে চোদ্দো মাস বয়সী কানা-খোঁড়া-নুলো এবং সর্বোপরি মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুটিকে আমাদের দেশে লালন-পালন করা হচ্ছে, তার প্রধান কর্তাব্যক্তিও দেখলাম একই কথা আবার বলেছেন - পঞ্চাশ ভাগ দুর্নীতি দূর করা হবে। ইনি আবার আরো একধাপ এগিয়ে সময় নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছেন তা করা হবে এক বছরের মধ্যে। পুরনোকালের নামী ডাকাতরা নাকি গৃহস্থকে আগেভাগে খবর দিয়ে ডাকাতি করতে আসতো। ব্যাপারটা সেরকম হলে অবশ্য আমরা হৃষ্টচিত্তে মেনে নিয়ে এক বছর অপেক্ষা করতে প্রস্তুত। কিন্তু আমাদের মতো ঘরপোড়া গরু-সদৃশ জনগণ বিশ্বাস করতে পারে এমন কথা বহুকাল তো শোনাই হয়নি। বাংলা ভাষার বহুল প্রচলিত 'ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার' প্রবচনটি মনে না পড়ে উপায় নেই। কারণ সোয়া বছরে যে দুর্নীতি দমন কমিশন হাঁটি হাঁটি পা পা পর্যন্ত করতে পারেনি, তার কর্তাব্যক্তিটি এরকম ঘোষণা দিলে বলতেই হয়, বাঘের বাচ্চা! নাকি বলবো, বাপকা বেটা, সিপাইকা ঘোড়া...

ড. ইউনূস একবার এরকম একটি কথা বলেছিলেন যে আমাদের রাজনীতিক ও কর্তাব্যক্তিরা প্রায়ই একেবারে বাচ্চাদের মতো কথা বলেন, যেন অন্য কেউ সত্য জানতেই পারবে না। তিনি অবশ্য বলতে পারতেন, আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা যা বলেন তা অতি কল্পনাপ্রবণ শিশুদের অর্থহীন বকবকানির চেয়ে বেশি কিছু নয়। এই ধরনের বাচ্চারা জানে না, তারা যা বলছে তা ঘটা একেবারেই অসম্ভব। বাংলাদেশে গ্রেনেড ও বোমা হামলার জন্যে কোনো বিদেশী শক্তি দায়ী, আওয়ামী লীগই এসব ঘটাচ্ছে বলে প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীসভার সবাক মন্ত্রীরা ক্রমাগত বলছেন। আমরা তাঁদের কথায় সংশয় প্রকাশ করবো কোন সাহসে? কিন্তু আওয়ামী লীগের কাউকে তো এ যাবত গ্রেফতার করা হলো না। তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি যে আওয়ামী লীগকে এই কৃত অপরাধের জন্যে আশ্রয়-প্রশ্রয় জোট সরকারই দিচ্ছে? না হলে যখন জানাই আছে কারা ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাদের ধরা হবে না কেন?

এ বাবদ এ পর্যন্ত সারাদেশে কয়েকশো সন্দেহভাজন গ্রেফতার হয়েছে, তাদের স্বীকারোক্তিতে আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো লীগের নাম পাওয়া যাচ্ছে না। যাদের কথা তারা বলেছে, তারা মহাক্ষমতাবান বলে তাদের সম্পর্কে সরকারি ব্যক্তিরা চুপ। এই অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও র‌‌্যাব, তারাও সরকারি লোক। তাহলে? ব্যাপারটি কি এরকম দাঁড়ায় না যে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর অনুগামী মন্ত্রীরা অসত্য বলছেন, অথবা র‌‌্যাব-পুলিশ ভুল লোকজনদের ধরে হয়রানি করছে? জোট সরকারের অন্তত দুটি শরিক অতি মৃদু গলায় এরকম কথা বলেছে বটে! মন্ত্রী ও পুলিশ - সরকারি এই দুই তরফের বিপরীতমুখী কথা ও কাজের মীমাংসা তাহলে কীভাবে হবে? আসলে কাকে আমরা বলবো, এইসব অপকর্মের সঙ্গে যারাই জড়িত হোক - রাজনৈতিক পরিচয়ে তারা আওয়ামী লীগ হোক বা জামাত হোক বা জাসদ হোক, কিংবা হোক বিএনপি অথবা একেবারে দলগোত্রবিহীন - আইন অনুসারে তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়া দরকার, দেশের মানুষকে এই আতংক ও অনিশ্চয়তা এবং বিশ্বাসহীনতার গহ্বর থেকে উদ্ধার করা দরকার। এই ধরনের বেপরোয়া বোমাবাজি মানুষকে স্বস্তি দিচ্ছে তা মনে করার কোনো কারণ থাকতে পারে না।

আসলে যেদিকে যতোদূরে চোখ যায়, সর্বগ্রাসী এক শূন্যতা ছাড়া তো কিছু চোখে পড়ে না। সাধারণীকরণের ঝুঁকি নিয়েও বলা যায় শিক্ষকরা আজ শিক্ষকতা ছাড়া আর সবই করেন, সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের আত্মা গচ্ছিত রাখেন ক্ষমতাবানদের স্তুতি ও ভজনায়, হাসপাতালে ডজন ধরে শিশুর মৃত্যু ঘটলেও চিকিৎসকদের ঈদের খুশি কিছুমাত্র ব্যাহত হয় না, মানুষের শেষ ভরসার জায়গা বিচারালয়ও প্রশ্নের উর্ধে থাকতে পারে না। আমরা সাধারণ জনতা কথায় কথায় হরতালের পক্ষে নই, তারপরেও হরতাল হয়। আর যে জনগণের কথা বলে হরতাল করা হয়, তার অধিকাংশ কৃষিজীবী, তারা কোনোদিন কৃষিকর্ম বন্ধ রেখেছে এমন শোনা যায়নি এবং এই কৃষিই বাংলাদেশকে আজও ভাত খাওয়াচ্ছে। জেলে হরতালের খবর না জেনে মাছ ধরে সে মাছ শহরের বাজারে বিক্রি করতে না পেরে হতাশায় ডুবে যাচ্ছে। তাতে কিছু কি আসে-যায় কারো?

হরতাল হবে, আমাদের ঠেকানোর সামর্থ্য নেই। তবু বলতে হয় হরতাল হলে, মিছিল হলে পুলিশের নির্বিচার লাঠিপেটাকেও আমরা ন্যায্য বলতে পারি না। দেশের নাগরিক হিসেবে অধিকারের দাবি করলে পুলিশের গুলি মানুষের প্রাপ্য হবে কেন - তা সে চাঁপাইনবাবগঞ্জে হোক অথবা মধুপুরের আদিবাসীদের ওপরে হোক। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন ব্যাহত করতে ধর্মীয় অনুশাসনের দোহাই পেড়ে শতকথা বলার মানুষের অভাব নেই, অথচ সন্তানসন্ততিসহ অনাহারের কালে তাদের কাছে এই ধার্মিকরা যাবে না কস্মিনকালেও। আহমদীয়ারা মুসলমান কিনা, তার বিচার করার দায় আমাদের হবে কেন? কিছু ক্ষমতাদম্ভী ধর্মব্যবসায়ীর দাপটে সংখ্যালঘু হিন্দুরা অত্যাচারিত হলে, দেশছাড়া হলে রাষ্ট্র নিশ্চুপ ও নির্বিকার থাকে কেন? শুধু চুপ থাকা নয়, জোর গলায় অস্বীকারও তো করা হয়েছে। অথচ সত্যি কথা চাপা থাকেনি। সমাজে যে যতো অন্যায় করছে তাদের ততো শক্তি ও দাপট, তার আর অন্ত নেই। সুশাসন ও সুবিচারের জন্যে মানুষ যাবে কোথায়, কার কাছে?

এই লেখাটি বড়ো অসংলগ্ন হয়ে গেলো। শিরে সর্পাঘাত হলে হয়তো এরকমই হওয়ার কথা।

-----------------
জানুয়ারি ২০০৬
-----------------

No comments: