বছর চার-পাঁচেক আগে ডালাসে বাঙালিদের একটা অনুষ্ঠানে গেছি। বিরতির সময় অডিটরিয়ামের বাইরে সবাই চা-সিঙাড়া খাচ্ছে, গল্পগুজব করছে, ধূমপায়ীরা ভবনের বাইরে নির্ধারিত এলাকায়। আমি শেষের দলভুক্ত। একসময় খেয়াল করলাম, এক ভদ্রমহিলা বাংলাদেশে ছাপা একটা রসিদবই নিয়ে সবার কাছে যাচ্ছেন চাঁদা সংগ্রহ করতে। একটু কান পেতে বোঝা গেলো, চাঁদা তোলা হচ্ছে মহিলার গ্রামের বাড়িতে মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণের জন্যে। তাঁর বাড়ি কোথায় জানি না। হতে পারে বাংলাদেশের যে কোনো গ্রামে, কথা শুনে বোঝার উপায় নেই। আশ্চর্য লাগলো, বাংলাদেশের কোন প্রত্যন্ত গ্রামে মসজিদ-মাদ্রাসা হবে, তার জন্যে চাঁদা সংগ্রহ করা হচ্ছে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে।
যথাসময়ে মহিলা আমার কাছেও এলেন। তাঁকে স্পষ্ট করে জানাই, মাদ্রাসা-মসজিদের জন্যে চাঁদা আমি দিই না।
অনিচ্ছুক কারো কাছে ঠিক এই জবাব হয়তো তিনি পাননি। ফলে, তাঁর বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখ আমাকে বেশ কয়েক মুহূর্ত নিরীক্ষণ করে। অতঃপর আর কোনো কথা না বলে (মনে মনে সম্ভবত আমার দোজখবাস সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে) তিনি পরবর্তী কোনো ধর্মপ্রাণ দয়ালুর সন্ধানে যান।
কিন্তু বাংলাদেশে এই কথাগুলি ঠিক এইভাবে আমি বলতে পারতাম? নিজের ভেতর থেকে না-সূচক উত্তরই পাই। গত ২০ বছরে বাংলাদেশে মসজিদ-মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে যতো প্রকার গোঁড়ামি ও ধর্মোন্মাদনার বিস্তার ঘটেছে, তা একজন সুস্থ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্যে যথেষ্ট আতংকের। হুমায়ূন আজাদের পরিণতি আমাদের জানা আছে। তিনি নিজেও হয়তো আক্রান্ত হওয়ার আশংকা করতেন। তবু তাঁর স্পষ্টবাদিতা অক্ষুণ্ণ থেকেছে। স্বীকার করে নিই, তাঁকে নিয়ে মুগ্ধ হতে আমার কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু তাঁর অপরিমেয় সাহস ও স্পষ্টবাদিতার ছিঁটেফোঁটাও আমার মধ্যে দেখতে পাই না।
বরং যা দেখি, তা আমাকে বিচলিত করলেও অন্য কাউকে জানতে দিই না। বিপদ চোখের সামনে দেখি না, দেখতেও হয় না, বিপদের একটা সম্ভাবনা অনুমান করা গেলেই শামুকের মতো খোলসে লুকিয়ে থাকি।
তবে আমার সাহস কম, এরকম কথা মানবো কেন? আমি ধর্মীয় উন্মাদনার বিরুদ্ধে, যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে, দেশে জলপাই শাসনের বিরুদ্ধে কি কথা বলি না? নিশ্চয়ই বলি। একশোবার বলি। কীভাবে? না, ইন্টারনেটে। ব্লগ লিখে। তাতে কারো কিছু এসে-গেলো? না যাক, আমি বিপ্লব সম্পন্ন করার পরিতৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে যেতে পারি। আত্মশ্লাঘার বোধ আমাকে একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়। আমি বোধহয় একটা কিছু করেই ফেললাম। ইন্টারনেটের বিপ্লবী না আমি!
তখন আমার এই বোধ ঘুমন্ত থাকে যে, ঘোর বিপদের সম্ভাবনা মাথায নিয়ে, গর্দানহীন হওয়ার আশংকার মধ্যেও বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে অনেকে আজও কাজ করে যাচ্ছেন, ধর্মোন্মাদনা ও রাজাকারতন্ত্রের বিপক্ষে দাঁড়ানোর হিম্মত দেখাচ্ছেন। রাষ্ট্রক্ষমতার সামরিকায়নের বিপক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নিচ্ছেন। প্রকৃত সাহসী তাঁরাই, অভিবাদন তাঁদের প্রাপ্য।
কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে যোজন দূরে আয়েশী ভঙ্গিতে ল্যাপটপে আমার নেট-নির্ভর বিপ্লব সংঘটন অব্যাহত থাকে। যা খুশি বলতে পারি আমি। আমার লেখা কেউ সেন্সর করবে না। আমার কথায় ক্ষুব্ধ হলেও হাত-পায়ের রগ কাটতে কেউ আসবে না। জলপাই-রঙা ঊর্দি মাঝরাতে আমার বাড়ি ঘেরাও করবে না। আমি নির্ভয়। সুতরাং অকুতোভয়। বিপদের সব সম্ভাবনা থেকে বিস্তর দূরে।
একটা গল্প মনে পড়ছে। এক চাষীর বউ মহাদজ্জাল। তার দাপটে চাষী কোনো কথাই মুখ ফুটে বলতে সাহস পায় না। একদিন মাঠের কাজ সেরে ক্লান্ত চাষী ঘরে ফিরে খেতে বসেছে। আয়োজন সামান্য, সামান্য শাক আর ডাল। কিন্তু ডাল একেবারে বিস্বাদ, লবণ দেওয়া হয়নি। মেজাজ খারাপ হলেও বউকে কিছু বলার উপায় নেই। চুপচাপ খায় সে। রান্না কেমন হয়েছে, বউ জানতে চাইলেও সে চুপ করে থাকে। তাকে নিরুত্তর দেখে বউ যথারীতি মুখ ছোটায়, তাকে বোবা, বেআক্কেল ইত্যাদি বলতে থাকে। কোনোমতে খাওয়া শেষ করে চাষী বাড়ির পেছনের খালের ওপারে যায়। চিৎকার করে বলতে থাকে, কাউরে না ডরাইয়া কই, খালের এই পাড়ে খাড়াইয়া কই, ডাইলে তুই লবণ দ্যাস নাই, দ্যাস নাই, দ্যাস নাই…
Saturday, July 19, 2008
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
1 comment:
বা! ভাল বলেছেন তো! আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। অন্তত: ইন্টারনেটে মুক্তচিন্তা প্রকাশে সক্রিয় থাকার জন্য। তবে এটাকেই বা ছোট ভাববেন কেন? মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে থাকাটাই বড়। হয়ত কিছু না করতে পারছেন, তবু মনে মনে তো সমর্থন করতে পারতেন। আপনি তো শুধু মনে মনে নয় লেখালেখি দিয়েও সচেতনতা প্রকাশ করছেন। এটাও রাজাকার আলবদরদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনেক শক্তি যোগায়। মনে হয় কেউ না কেউ তো পাশে আছে। জানা যায়, অন্তত আমরা একা নই।
ধন্যবাদ
Post a Comment