কাল তিন তিনবার ভুল রাস্তায় চলে গেলাম। আক্ষরিক অর্থেই ‘এ পথে আমি যে গেছি বারবার’ বলার মতো দুশো মাইলের পথ। ইন্টারস্টেট-৩৫ ধরে সরাসরি ড্রাইভ, কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই। তবে হাইওয়ে মাঝেমধ্যে বিভক্ত হয়ে যায় অন্য নানা ঠিকানার দিকে। ভুল হলে অন্য শহরে পৌঁছে যাওয়া, নিদেনপক্ষে একটা চক্কর খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। ডালাস থেকে অস্টিন গিয়েছি, তখন সব ঠিকঠাক। ফেরার পথে ভুল রাস্তায় গিয়ে গোলমাল, চক্কর খেতে হলো।
মেয়েটা বড়ো হয়েই গেলো, চলে যাবে পড়তে অস্টিনে। জুন মাসের মাঝামাঝি খবর জানার পর মনে হলো, দুই মাস সময় এখনো আছে । অথচ কোথা দিয়ে কীভাবে সময়টা চলে গেলো! এই দুই মাসে আমরা অনেক কথা বলবো; জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ’ কনসার্টের ডিভিডি এবং হ্যারিসনের মৃত্যুর পর তাঁর বন্ধুদের আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর জর্জ’-এর ডিভিডি কিনে রাখা আছে দীর্ঘদিন, এখনো সেলোফেন-আবৃত, কথা ছিলো একসঙ্গে বসে দেখবো। সময়গুলি কোথায় গেলো?
পরশু আমাদের চারজনের পরিবার গেলাম অস্টিনে। গতকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মেয়ের পরিচয়-পর্ব (orientation) হলো। ক্লাস শুরু হতে এক সপ্তাহ দেরি, কিন্তু আবার তাকে নিয়ে অস্টিনে আসতে হবে শনিবার, তিনদিন পর। নতুন শহরে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে সে উঠবে সেদিন, গোছগাছ করে ক্লাসের জন্যে তৈরি হওয়ার সময় পাবে দিন তিনেক।
কাল দুপুরের দিকে তার অ্যাপার্টমেন্ট দেখতে যাওয়া হলো। মেয়ে রুমমেট ঠিক করেছে এক প্যালেস্টাইনি মেয়ে ফারাহকে। ফারাহ-র বাবা গতমাসে নিজে এসে ঘুরে ঘুরে সব ঠিকঠাক করে গেছেন। ভদ্রলোকের পছন্দের ওপর কোনো কথা চলে না, অ্যাপার্টমেন্ট এবং কাছাকাছি এলাকা দেখে যে কোনো বাবা-মা নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারে। বস্তুত, সকালের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের রাস্তাঘাট-বাড়িঘর দেখে আমার একটু ফাঁপড় লাগছিলো। বেশ পুরনো, ঘিঞ্জিমতো সব, ডাউনটাউন এলাকায় যেমন হয়। তখনো সঠিক ধারণা নেই, ওদের অ্যাপার্টমেন্ট ঠিক কোথায়, কেমন জায়গা।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইল কয়েকের দূরত্বে অ্যাপার্টমেন্ট দেখে মেয়ে নিজেও মহা উচ্ছ্বসিত। নিজের প্রথম ঠিকানা বলে কথা, বাবা-মায়ের ছায়ার বাইরে তার স্বাধীনতার ঠিকানা।
ফেরার পথে মেয়েকে বলি আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল-জীবনের গল্প। নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্ট দূরের কথা, নিজের বিছানার স্বপ্ন দেখাও কঠিন সূর্যসেন হলের ৪৪৮ নম্বর কক্ষের মেঝেতে শায়িত হয়ে। প্রথম বছরের প্রায় পুরোটাই সেভাবে কেটেছিলো। চোখে অবিশ্বাস নিয়ে মেয়ে তাকিয়ে থাকে, কল্পনাশক্তিও তাকে ছবিটা দেখতে সাহায্য করে বলে মনে হয় না। না হোক, কোনো ক্ষতি নেই। তার এখন সামনে তাকানোর সময়, তাকে স্বপ্ন দেখতে হবে আগামীর, পিতামাতার অতীতের জঞ্জালে তার কোনো প্রয়োজন না থাকাই উচিত।
দীর্ঘ যাত্রায় যেমন হয়, একসময় কথা থামে। ছেলেমেয়েরা এরকম যাত্রায় সচরাচর পালা করে প্যাসেঞ্জার সীটে বসে ডি জে হয়ে গান বাজায়। এখন মেয়ে সেই ভূমিকায়, তার নিজের ও ছোটো ভাইটির পছন্দের গান বাজায়। ওদের বয়সের ব্যবধান আট বছরের, একটা সময় ছিলো তাদের মধ্যে বনিবনা প্রায় ছিলোই না – তাদের দুই পৃথিবীর দূরত্ব এতোটাই বেশি তখন। বছর দুয়েক ধরে সেটা পাল্টাতে শুরু করেছে। দুইজনে মিলে কতোসব বকবক করে, একত্রে বসে গান শোনে। মেয়ে নিজের গরজে প্রতি সপ্তাহে ভাইকে নিয়ে যায় সিনেমা দেখতে। বোনের ফিরতে দেরি হলে ছেলে ‘আপু কখন আসবে? ফোন করি?’ জিজ্ঞেস করতে থাকে। ঠিক এই সময়েই তাদের বিচ্ছিন্ন হতে হবে ভাবলে কষ্ট হয়। এই সময় কি আর তাদের জীবনে ফিরে আসবে?
সেদিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপু চলে গেলে তোমার খারাপ লাগবে?’
ছেলে নিঃশব্দে কাঁধ ঝাঁকায়, সে জানে না। হয়তো সত্যিই জানে না। তার জীবন এরকম চলে যাওয়ার ঘটনা কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। অবিলম্বে জানবে, জীবন তাকে আরো অনেক অভিজ্ঞানে অভিজ্ঞ করে তুলবে ক্রমশ। এইসব ছোটোবড়ো নানা ধরনের দুঃখ-কষ্ট থেকে কে কবে রেহাই পেয়েছে?
সিডি-তে বেজে যাওয়া গান কানে আসে, মরমে পশে না। গাড়ি চালাচ্ছি, বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি। আচমকা মনে হয়, আর মোটে কয়েকদিন পরে যখন অস্টিন থেকে ফিরবো, তখন মেয়ে পাশে বসে থাকবে না। তাকে ছেড়ে আসতে হবে তার নতুন ঠিকানায়। ভেতরটা কেন কে জানে খুব শূন্য লাগতে থাকে। খুব দূরের পথ নয়, চাইলেই যাওয়া-আসা হবে। কিন্তু তবু সে তো দূরেরই একজন হয়ে উঠবে দিনদিন। এখন বলছে, প্রতি সপ্তাহে না হলেও অন্তত দুই সপ্তাহ পরপর সে আসবে। হয়তো আসবে, কিন্তু দুই ক্রমশ তিন বা চার সপ্তাহ হয়ে যাবে, একসময় আরো আরো দীর্ঘ। জীবন এরকমই, নিজেকে দিয়েই জানি, আমার পিতামাতাও আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে এই বোধ নিয়ে চোখ মুছে গৃহকর্মে মন দিয়েছিলেন। এখন আমার পালা। যা কিছু নিয়েছি তা ফিরিয়ে দিতেই হয়।
প্রথম দুইবার ভুল পথে গিয়ে আর কেউ টের পাওয়ার আগেই চুপচাপ ফিরতে সক্ষম হই। ধরা পড়লাম শেষবার ডালাস শহরে ঢোকার পর। ছেলেমেয়ের মা টের পেয়ে যায়, ‘কী হলো তোমার?’
কী করে বলি, এই বাবাটি নিজেকে অনেক শক্ত মনের মানুষ ভাবলেও হয়তো ততোটা শক্ত সে নয়। কিন্তু আর কারো তা জানার দরকার নেই। চোখের কী দোষ? Must be the clouds in my eyes!
২১ অগাস্ট ২০০৮
Friday, August 22, 2008
Tuesday, August 12, 2008
বাঙালির সময়
‘ন’টার গাড়ি ক’টায় ছাড়ে?’ এই রসিকতাটি অথবা এর কাছাকাছি কোনো কোনো শ্লেষ-মেশানো বাক্য বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে চালু আছে দীর্ঘকাল ধরে। একদিন ঠিক সময়ে ট্রেন স্টেশনে এলে যাত্রীরা বিস্মিত, কারণ এই ট্রেনটি কখনোই সময়মতো আসে না। সত্যভাষী স্টেশনমাস্টার জানালেন, এটার আসার কথা ছিলো গতকাল। এই রসিকতাও পুরনো।
কোনো কাজ – তা ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক অথবা রাষ্ট্রীয় যা-ই হোক – যথাসময়ে সম্পন্ন হবে না, এরকমই আমাদের অভিজ্ঞতা। আমরা স্টেশনে পৌঁছিবার পূর্বেই ট্রেন ছাড়িয়া যাইবে। ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা যাইবে। ট্রেন-বাস-লঞ্চ নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে যাত্রা শুরু করবে, বিদ্যুতের বিলটি আসবে পরিশোধের নির্ধারিত তারিখ অতিক্রান্ত হওয়ার পর।
সময়জ্ঞান বা সময়ানুবর্তিতা বিষয়ে বাঙালির খুব সুনাম নেই। আর এ সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত ‘আরে, বাঙালির সময়!’ কথাটি বলার একচ্ছত্র অধিকার আমরা বাঙালিরাই নিয়ে রেখেছি। এই বাক্যটি আমরা সবাই কমবেশি কখনো না কখনো বলেছি। ঠাট্টাচ্ছলে, ক্ষোভে, নিন্দাসূচকভাবে, বিরক্তি প্রকাশের জন্যে, এমনকি নিদারুণ তিক্ততায়।
বস্তুত, নিজেদের দেশ বা জাতিগত পরিচয় নিয়ে বাঙালির মতো নিন্দাসূচক উক্তি সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনো জাতি করে না। এটিকে আত্মসমালোচনা বলে চিহ্নিত করা মুশকিল। কারণ, আত্মসমালোচনা করা হয় একটি সম্ভাব্য উত্তরণ বা সমাধানের আশা ও আগ্রহ থেকে। আমাদের ক্ষেত্রে তার কোনোরকম লক্ষণ দেখা যায় না। আমরা বলার জন্যেই বলি, সংশোধিত হওয়ার আগ্রহ আমাদের কম। এই বিষয়ে প্রত্যেকেরই যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু করণীয় আছে যা আখেরে সমষ্টির অভ্যাসে পরিণত হতে পারে, সেখানে আমরা উদাসীন থাকতে সচ্ছন্দ।
০২
দেশে তো বটেই, পরবাসে বছরের পর বছর বসবাস করেও আমরা সময় নিয়ে হেলাফেলার চর্চাটি দিব্যি চালু রেখেছি। রুটিরুজির মামলা জড়িত বলে কর্মস্থলে আমরা ঠিকই পৌঁছে যাই নির্ধারিত সময়ে, সেখানে সময়জ্ঞানটি টনটনে। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে এবং সামাজিকতায় আবার নির্ভুলভাবে বাঙালি সময় উদযাপন করি। সাতটার অনুষ্ঠান ন’টার আগে শুরু হয় না। সন্ধ্যা ছ’টায় হয়তো কিছু আমন্ত্রিত মানুষজনের আসার কথা। নিমন্ত্রিত এবং নিমন্ত্রণকারী উভয়পক্ষই জানেন তা আটটার আগে ঘটা সম্ভব নয়। নিমন্ত্রিত কেউ সময়মতো এলে দেখবেন গৃহের বাসিন্দারাই তখনো প্রস্তুত নন।
আমার নিজের একটি চরম অভিজ্ঞতার কথা বলি। কয়েক বছর আগে এক তরুণ দম্পতি তাঁদের বিবাহবার্ষিকীতে জনা পঞ্চাশেক অতিথিকে আমন্ত্রণ করেছেন বাসায়। সময় দেওয়া ছিলো সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। স্বীকার করে নিই, আমরা নিজেরাও নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হইনি। বাঙালি তো! অতিথিরা সবাই এলেন ন’টার মধ্যে। গৃহকর্তা হাসিমুখে সবাইকে অভ্যর্থনা করে বসাচ্ছেন, নরম পানীয় সরবরাহ করছেন, ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে কথা বলছেন। গৃহকর্ত্রীর দেখা নেই। কৌতূহলী মহিলাদের প্রশ্নের মুখে গৃহকর্তা জানান, গৃহিনী ওপরতলায় আছেন, তৈরি হয়ে নামবেন একটু পরে। তাঁর সুসজ্জিত হয়ে অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনাটি যখন শেষমেশ ঘটলো তখন ঘড়িতে এগারোটা। আহার-পর্ব ততোক্ষণে শেষ, গৃহকর্তা রেস্টুরেন্ট থেকে কেটার করে আনা খাবার নিজেই পরিবেশন ও তদারক করেছেন। অতিথিদের কেউ কেউ বিদায়ও নিয়েছেন।
ব্যতিক্রমের কথাও বলা দরকার। একবার এক ভদ্রলোক তাঁর মেয়ের বিয়ের ছাপানো কার্ড পাঠিয়েছেন ডাকে। নির্ধারিত দিনের এক সপ্তাহ আগে ফোন করে আমন্ত্রিতদের প্রত্যেককে বিনীতভাবে জানালেন, অনুষ্ঠানটি ঘড়ি ধরে ঠিক সময়মতো অনুষ্ঠিত হবে এবং কারো পক্ষে যথাসময়ে উপস্থিত হওয়া সম্ভব না হলে না এলেও চলবে, তাঁরা কিছু মনে করবেন না। কিন্তু অধিকাংশ অতিথি অভ্যাসবশে যথারীতি বিলম্বে উপস্থিত হয়ে গৃহকর্তার অসন্তোষের কারণ ঘটিয়েছিলেন।
আরেকটি ঘটনার কথা শুনেছি। একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিতদের বারবার বলে দেওয়া হয়েছিলো নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হতে। অনেকে অনুরোধটি রক্ষা করলেও প্রায় অর্ধেক সংখ্যক অতিথি যথার্থ বাঙালি হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন নির্ধারিত সময়ের প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে। ইতোমধ্যে আহারপর্ব শেষ হয়ে গেছে এবং গৃহকর্তা অবশিষ্ট খাবার তুলে রেখে বা ফেলে দিয়ে টেবিল পরিষ্কার করে ফেলেছেন। লেট লতিফরা এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোনো আহার্যবস্তু দেখতে না পেয়ে কিছু বিস্মিত। একজন মুখ ফুটে শেষমেশ গৃহকর্তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের একটু ফেরার তাড়া আছে, খাবার কখন দেওয়া হবে? বিরক্তি ও হতাশা চেপে রেখে গৃহকর্তা নির্বিকার মুখে জানালেন, খাওয়া-দাওয়া তো হয়ে গেছে। আপনি খাননি?
০৩
সময়ের আগেই কাজ করে ফেলা কি বাঙালির চরিত্রে নেই? আছে, নিশ্চয়ই আছে। তবে এই করিৎকর্মারা একটি বিশেষ শ্রেণীর এবং আমাদের জনসংখ্যার একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ। এঁরা বণিক শ্রেণীভুক্ত, যাঁদের আমরা ব্যবসায়ী বলে জানি, আদর-সমীহ করে বিজনেসম্যান বলি। বাংলাদেশে রোজার মাস উপলক্ষে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া একটি বাৎসরিক ঘটনা, ব্যবসায়ীরা রোজার কয়েক সপ্তাহ আগেই দাম বাড়ানোর কাজটি শুরু করেন। মানুষকে অভ্যস্ত করে নেওয়া আর কি! সরকার তখন মাথা চুলকে ভাবতে থাকে, এদের কী করে সামলানো যায়। কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া যায় না, মাথা চুলকাতে চুলকাতেই মৌসুম শেষ। ভোক্তা মানুষের পকেট কাটার কাজটি ততোদিনে সম্পন্ন হয়ে গেছে। আবার হয়তো পেট্রলের দাম বাড়লো, সেই বর্ধিত দামের পেট্রল পাম্পে আসার জন্যে অপেক্ষা করে কে? তার আগেই দাম উঠে গেলো। এই ধরনের উদাহরণ অফুরন্ত। প্রতিদিনই ঘটে বাংলাদেশে। ভুক্তভোগীরা জানেন, নতুন করে বলার অনাবশ্যক।
০৪
বাঙালির সময়জ্ঞান নেই, এই প্রচলিত ধারণার বিপরীতে অনায়াসে দাঁড়ানো যায় এবং ধারণাটি ভুল প্রমাণসাপেক্ষে উল্টোটাই প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে সময় বিষয়ে আমাদের এই ঢিলেঢালা মনোভাবটি মূলত শহরকেন্দ্রিক। অর্থাৎ, বলা চলে এটি এক ধরনের নাগরিক মনোভঙ্গি ও আচরণ। আমরা নিজেরা অপেক্ষা করতে পছন্দ করি বা না করি, অন্যকে অপেক্ষা করিয়ে রাখতে আমাদের বাধে না। কর্মস্থলে নিয়ম করে অনিয়মিত থাকি, সময়ের কাজটি ফেলে রাখি ‘থাক না পরে করলে ক্ষতি কী’ ভেবে।
অথচ বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ গ্রামের বাসিন্দা এবং তাদের পেশা প্রধানত কৃষিকাজ। কৃষকরা ‘থাক, পরে করবো’ বলে যদি তাঁদের চাষবাসের কাজগুলি সময়মতো না করতেন তাহলে কী হতো? বাংলাদেশ আক্ষরিক অর্থে ভাতে মারা পড়তো। কৃষকরা সময়মতো জমিতে হালচাষ করেন, বীজ বপন করেন, শস্যের ও জমির পরিচর্যা করেন, সেচকার্য করেন, ফসল তোলেন – সবই নিয়ম করে, নির্ধারিত সময়ে। কৃষকরা সারা বাংলাদেশের মানুষের মুখে অন্নের যোগান দিয়ে আসছেন যুগ যুগ ধরে। কখনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। উপর্যুপরি প্রাকৃতিক সংকট ও দুর্যোগ তাঁদের টলাতে পারেনি, কর্তব্যকর্ম থেকে নিবৃত্ত করেনি।
অন্যদিকে ছোটোবড়ো শহরাঞ্চলেও এক শ্রেণীর মানুষ আছেন, যাঁরা সময়ের কাজটি সময়ে সম্পন্ন করে থাকেন। শিল্প-কারখানায় কাজ করা মানুষগুলিও নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে উপস্থিত হন, কলের চাকা চালু রাখেন। এর সঙ্গে রুটি-রুজির সম্পর্ক আছে নিশ্চিত, কিন্তু চেয়ার-টেবিলে বসা শহুরে কর্মজীবীদের অধিকাংশের সঙ্গে কর্তব্যকর্ম বিষয়ে এঁদের সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে।
কৃষক-শ্রমিকরা বা শ্রমজীবী মানুষরা বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু, তাঁরা তো দেখতে পাচ্ছি সময়জ্ঞানে নাগরিক বাঙালি নন কোনো অর্থেই। সুতরাং বাঙালির সময়জ্ঞান নেই, এই ধারণার সঙ্গে আমরা একমত হবো কেন?
কোনো কাজ – তা ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক অথবা রাষ্ট্রীয় যা-ই হোক – যথাসময়ে সম্পন্ন হবে না, এরকমই আমাদের অভিজ্ঞতা। আমরা স্টেশনে পৌঁছিবার পূর্বেই ট্রেন ছাড়িয়া যাইবে। ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা যাইবে। ট্রেন-বাস-লঞ্চ নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে যাত্রা শুরু করবে, বিদ্যুতের বিলটি আসবে পরিশোধের নির্ধারিত তারিখ অতিক্রান্ত হওয়ার পর।
সময়জ্ঞান বা সময়ানুবর্তিতা বিষয়ে বাঙালির খুব সুনাম নেই। আর এ সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত ‘আরে, বাঙালির সময়!’ কথাটি বলার একচ্ছত্র অধিকার আমরা বাঙালিরাই নিয়ে রেখেছি। এই বাক্যটি আমরা সবাই কমবেশি কখনো না কখনো বলেছি। ঠাট্টাচ্ছলে, ক্ষোভে, নিন্দাসূচকভাবে, বিরক্তি প্রকাশের জন্যে, এমনকি নিদারুণ তিক্ততায়।
বস্তুত, নিজেদের দেশ বা জাতিগত পরিচয় নিয়ে বাঙালির মতো নিন্দাসূচক উক্তি সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনো জাতি করে না। এটিকে আত্মসমালোচনা বলে চিহ্নিত করা মুশকিল। কারণ, আত্মসমালোচনা করা হয় একটি সম্ভাব্য উত্তরণ বা সমাধানের আশা ও আগ্রহ থেকে। আমাদের ক্ষেত্রে তার কোনোরকম লক্ষণ দেখা যায় না। আমরা বলার জন্যেই বলি, সংশোধিত হওয়ার আগ্রহ আমাদের কম। এই বিষয়ে প্রত্যেকেরই যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু করণীয় আছে যা আখেরে সমষ্টির অভ্যাসে পরিণত হতে পারে, সেখানে আমরা উদাসীন থাকতে সচ্ছন্দ।
০২
দেশে তো বটেই, পরবাসে বছরের পর বছর বসবাস করেও আমরা সময় নিয়ে হেলাফেলার চর্চাটি দিব্যি চালু রেখেছি। রুটিরুজির মামলা জড়িত বলে কর্মস্থলে আমরা ঠিকই পৌঁছে যাই নির্ধারিত সময়ে, সেখানে সময়জ্ঞানটি টনটনে। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে এবং সামাজিকতায় আবার নির্ভুলভাবে বাঙালি সময় উদযাপন করি। সাতটার অনুষ্ঠান ন’টার আগে শুরু হয় না। সন্ধ্যা ছ’টায় হয়তো কিছু আমন্ত্রিত মানুষজনের আসার কথা। নিমন্ত্রিত এবং নিমন্ত্রণকারী উভয়পক্ষই জানেন তা আটটার আগে ঘটা সম্ভব নয়। নিমন্ত্রিত কেউ সময়মতো এলে দেখবেন গৃহের বাসিন্দারাই তখনো প্রস্তুত নন।
আমার নিজের একটি চরম অভিজ্ঞতার কথা বলি। কয়েক বছর আগে এক তরুণ দম্পতি তাঁদের বিবাহবার্ষিকীতে জনা পঞ্চাশেক অতিথিকে আমন্ত্রণ করেছেন বাসায়। সময় দেওয়া ছিলো সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। স্বীকার করে নিই, আমরা নিজেরাও নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হইনি। বাঙালি তো! অতিথিরা সবাই এলেন ন’টার মধ্যে। গৃহকর্তা হাসিমুখে সবাইকে অভ্যর্থনা করে বসাচ্ছেন, নরম পানীয় সরবরাহ করছেন, ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে কথা বলছেন। গৃহকর্ত্রীর দেখা নেই। কৌতূহলী মহিলাদের প্রশ্নের মুখে গৃহকর্তা জানান, গৃহিনী ওপরতলায় আছেন, তৈরি হয়ে নামবেন একটু পরে। তাঁর সুসজ্জিত হয়ে অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনাটি যখন শেষমেশ ঘটলো তখন ঘড়িতে এগারোটা। আহার-পর্ব ততোক্ষণে শেষ, গৃহকর্তা রেস্টুরেন্ট থেকে কেটার করে আনা খাবার নিজেই পরিবেশন ও তদারক করেছেন। অতিথিদের কেউ কেউ বিদায়ও নিয়েছেন।
ব্যতিক্রমের কথাও বলা দরকার। একবার এক ভদ্রলোক তাঁর মেয়ের বিয়ের ছাপানো কার্ড পাঠিয়েছেন ডাকে। নির্ধারিত দিনের এক সপ্তাহ আগে ফোন করে আমন্ত্রিতদের প্রত্যেককে বিনীতভাবে জানালেন, অনুষ্ঠানটি ঘড়ি ধরে ঠিক সময়মতো অনুষ্ঠিত হবে এবং কারো পক্ষে যথাসময়ে উপস্থিত হওয়া সম্ভব না হলে না এলেও চলবে, তাঁরা কিছু মনে করবেন না। কিন্তু অধিকাংশ অতিথি অভ্যাসবশে যথারীতি বিলম্বে উপস্থিত হয়ে গৃহকর্তার অসন্তোষের কারণ ঘটিয়েছিলেন।
আরেকটি ঘটনার কথা শুনেছি। একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিতদের বারবার বলে দেওয়া হয়েছিলো নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হতে। অনেকে অনুরোধটি রক্ষা করলেও প্রায় অর্ধেক সংখ্যক অতিথি যথার্থ বাঙালি হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন নির্ধারিত সময়ের প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে। ইতোমধ্যে আহারপর্ব শেষ হয়ে গেছে এবং গৃহকর্তা অবশিষ্ট খাবার তুলে রেখে বা ফেলে দিয়ে টেবিল পরিষ্কার করে ফেলেছেন। লেট লতিফরা এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোনো আহার্যবস্তু দেখতে না পেয়ে কিছু বিস্মিত। একজন মুখ ফুটে শেষমেশ গৃহকর্তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের একটু ফেরার তাড়া আছে, খাবার কখন দেওয়া হবে? বিরক্তি ও হতাশা চেপে রেখে গৃহকর্তা নির্বিকার মুখে জানালেন, খাওয়া-দাওয়া তো হয়ে গেছে। আপনি খাননি?
০৩
সময়ের আগেই কাজ করে ফেলা কি বাঙালির চরিত্রে নেই? আছে, নিশ্চয়ই আছে। তবে এই করিৎকর্মারা একটি বিশেষ শ্রেণীর এবং আমাদের জনসংখ্যার একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ। এঁরা বণিক শ্রেণীভুক্ত, যাঁদের আমরা ব্যবসায়ী বলে জানি, আদর-সমীহ করে বিজনেসম্যান বলি। বাংলাদেশে রোজার মাস উপলক্ষে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া একটি বাৎসরিক ঘটনা, ব্যবসায়ীরা রোজার কয়েক সপ্তাহ আগেই দাম বাড়ানোর কাজটি শুরু করেন। মানুষকে অভ্যস্ত করে নেওয়া আর কি! সরকার তখন মাথা চুলকে ভাবতে থাকে, এদের কী করে সামলানো যায়। কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া যায় না, মাথা চুলকাতে চুলকাতেই মৌসুম শেষ। ভোক্তা মানুষের পকেট কাটার কাজটি ততোদিনে সম্পন্ন হয়ে গেছে। আবার হয়তো পেট্রলের দাম বাড়লো, সেই বর্ধিত দামের পেট্রল পাম্পে আসার জন্যে অপেক্ষা করে কে? তার আগেই দাম উঠে গেলো। এই ধরনের উদাহরণ অফুরন্ত। প্রতিদিনই ঘটে বাংলাদেশে। ভুক্তভোগীরা জানেন, নতুন করে বলার অনাবশ্যক।
০৪
বাঙালির সময়জ্ঞান নেই, এই প্রচলিত ধারণার বিপরীতে অনায়াসে দাঁড়ানো যায় এবং ধারণাটি ভুল প্রমাণসাপেক্ষে উল্টোটাই প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে সময় বিষয়ে আমাদের এই ঢিলেঢালা মনোভাবটি মূলত শহরকেন্দ্রিক। অর্থাৎ, বলা চলে এটি এক ধরনের নাগরিক মনোভঙ্গি ও আচরণ। আমরা নিজেরা অপেক্ষা করতে পছন্দ করি বা না করি, অন্যকে অপেক্ষা করিয়ে রাখতে আমাদের বাধে না। কর্মস্থলে নিয়ম করে অনিয়মিত থাকি, সময়ের কাজটি ফেলে রাখি ‘থাক না পরে করলে ক্ষতি কী’ ভেবে।
অথচ বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ গ্রামের বাসিন্দা এবং তাদের পেশা প্রধানত কৃষিকাজ। কৃষকরা ‘থাক, পরে করবো’ বলে যদি তাঁদের চাষবাসের কাজগুলি সময়মতো না করতেন তাহলে কী হতো? বাংলাদেশ আক্ষরিক অর্থে ভাতে মারা পড়তো। কৃষকরা সময়মতো জমিতে হালচাষ করেন, বীজ বপন করেন, শস্যের ও জমির পরিচর্যা করেন, সেচকার্য করেন, ফসল তোলেন – সবই নিয়ম করে, নির্ধারিত সময়ে। কৃষকরা সারা বাংলাদেশের মানুষের মুখে অন্নের যোগান দিয়ে আসছেন যুগ যুগ ধরে। কখনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। উপর্যুপরি প্রাকৃতিক সংকট ও দুর্যোগ তাঁদের টলাতে পারেনি, কর্তব্যকর্ম থেকে নিবৃত্ত করেনি।
অন্যদিকে ছোটোবড়ো শহরাঞ্চলেও এক শ্রেণীর মানুষ আছেন, যাঁরা সময়ের কাজটি সময়ে সম্পন্ন করে থাকেন। শিল্প-কারখানায় কাজ করা মানুষগুলিও নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে উপস্থিত হন, কলের চাকা চালু রাখেন। এর সঙ্গে রুটি-রুজির সম্পর্ক আছে নিশ্চিত, কিন্তু চেয়ার-টেবিলে বসা শহুরে কর্মজীবীদের অধিকাংশের সঙ্গে কর্তব্যকর্ম বিষয়ে এঁদের সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে।
কৃষক-শ্রমিকরা বা শ্রমজীবী মানুষরা বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু, তাঁরা তো দেখতে পাচ্ছি সময়জ্ঞানে নাগরিক বাঙালি নন কোনো অর্থেই। সুতরাং বাঙালির সময়জ্ঞান নেই, এই ধারণার সঙ্গে আমরা একমত হবো কেন?
Wednesday, July 30, 2008
আমার কম্পুকানা প্রজন্ম
ঢাকায় এক বন্ধুকে ইমেল করেছি একটা দরকারি প্রশ্ন করে। অপেক্ষায় সপ্তাহ কেটে যায়, উত্তর আসে না। অগত্যা ফোন করি। বন্ধু ঘুমচোখে হ্যালো বলেন।
দোস্ত, তোকে একটা ইমেল পাঠিয়েছি সপ্তাহখানেক আগে। পেয়েছিস?
তাই নাকি? না রে দোস্ত, খুব ব্যস্ত ছিলাম। ইমেল খোলা হয়নি।
এটাই প্রথম বা শেষ নয়, দেশে আমার অনেক বন্ধু আছেন, যাঁদের সঙ্গে এই ধরনের কথোপকথন নিয়মিতই হয়। এঁরা কমপিউটার-বিমুখ অথবা কম্পুকানা প্রজন্মের প্রতিনিধি। এঁদের প্রায় সবারই কর্মস্থলে কমপিউটার ব্যবহার অনেকটা বাধ্যতামূলক। হয়তো নেহাত ছক-বাঁধা কাজগুলি তাঁরা করেন মোটামুটি যান্ত্রিকভাবে, নাক-চোখ-মুখ বন্ধ করে, কোনোমতে শেষ হলেই বাঁচোয়া। কারো কারো বাড়িতেও আছে, তবে তা হয় ছেলেমেয়েদের প্রয়োজনে অথবা স্রেফ শোভাবর্ধনের জন্যে।
ইমেল পাঠিয়ে কয়েকদিন অপেক্ষার পর ফোন করে ইমেল খুলতে বলাটা হাস্যকর বটে। দুঃখেরও। তাহলে আর ইমেল করা কেন? সময় নষ্ট না করে ফোনটাই করা যতো দিনকয়েক আগে।
আগেভাগেই বলে রাখি, আমি নিজে কম্পুকানাদের দলে যদিও কর্মসূত্রে সর্বক্ষণ কম্পু নাড়াচাড়া করতে হয়, ঘরেও অনেকটা সময় কম্পুতেই যায়। কিন্তু সে বিষয়ে আমার বিদ্যা বা দক্ষতা নিচের দিকে। আমার জানার পরিধি ততোটুকুই, যা হলে কোনোমতে কাজ চলে যায়। এর বাইরে আরো কিছু জানা বা শেখা দরকারি মনে হলেও সেই বাসনা নিবারণের মহৌষধ, কী দরকার! এই তো বেশ চলে যাচ্ছে।
কমপিউটারে টাইপিং স্পীড দেখে আমার দশ বছর বয়সী পুত্র হাসাহাসি করে। বলে, এই স্পীড নিয়ে তুমি কাজ করো কী করে?
আমি হাসি আর মনে মনে বলি, চুপ। একদম চুপ, কেউ যেন না শোনে!
বস্তুত আমি এমন এক প্রাচীন এবং প্রযুক্তির বিচারে অক্ষম-অসহায় প্রজন্মের মানুষ যাঁদের কমপিউটার সম্পর্কে এক ধরনের জড়তা ও ভীতি আছে। জড়তার ধরণ, ‘আমি কি পারবো? না পারলে খুব লজ্জার কথা।’ ভীতিটা হলো, ‘টেপাটিপি করতে গিয়ে যদি কম্পু নষ্ট হয়!’
অতি-সতর্কতা ও অর্থহীন ভীতি আমার প্রজন্মের অধিকাংশ মানুষকে কম্পুকানা করে রেখে দিয়েছে। এঁরা একান্ত বাধ্য না হলে কমপিউটারের আশেপাশে ক্কচিৎ-কদাচিৎ ভেড়েন, অন্যথায় সম্পূর্ণ সংস্রবহীন থাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে কমপিউটার ও আনুষঙ্গিক অনেক প্রযুক্তি আজকের পৃথিবীর বাস্তবতা এবং সেসব আমাদের জীবনধারণ ও জীবনাচরণের অংশ হয়ে গেছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তা খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করে এবং তা ব্যবহার করে অনায়াস দক্ষতায়। সমস্যা শুধু অপেক্ষাকৃত বয়স্কদের নিয়ে, যাঁরা আমার প্রজন্মের মানুষ। অথচ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কমপিউটার না জানা মানুষকে অশিক্ষিত গণ্য করা হবে বলে ধারণা করি। আমার বন্ধু ও সমবয়সীরাও তা জানেন এবং স্বীকার করেন, কিন্তু বিচিত্র উপায়ে চোখ ফিরিয়ে রাখতেও তাঁরা সক্ষম।
কম্পুতে বাংলা লেখা সম্ভব জেনে এঁদের কেউ কেউ আজও বিস্মিত হন। যাঁরা অল্পবিস্তর কম্পু ব্যবহার করেন, তাঁরা শেখার আগ্রহ দেখান। সেই আগ্রহ স্থায়ী হয় না। তাঁদের কিছুতেই বোঝাতে পারি না, আমরা যারা দুরূহ বিজয় কীবোর্ড শিখেছিলাম, সে তুলনায় আজকাল কম্পুতে বাংলা কতো সহজ হয়ে গেছে, রোমান হরফ ব্যবহার করেও বাংলা লেখা যায়।
ব্যতিক্রম দেখিনি, তা নয়। আমার এক বন্ধুর অধ্যাপক পিতা আমেরিকা এলেন বেড়াতে। ঐ স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ক্লাস করে কমপিউটার শিখে ফিরে গেলেন।
কমপিউটারে আমার কিছু আগ্রহ জন্মায় আশির দশকের শেষে। হার্ডওয়্যার-সফটওয়্যার ইত্যাদি একদম প্রাথমিক বিষয়গুলি শেখার জন্যে ক্লাস করতে গেলাম, সব মাথার ওপর দিয়ে গেলো। একজন পরামর্শ দিলেন, কমপিউটার কিনে বাড়িতে নিজে হাতেকলমে শেখা সবচেয়ে ভালো। প্রথমটা কিনলাম ৯০-এর অগাস্টে, স্পষ্ট মনে আছে। যন্ত্রটি ছিলো আইবিএম পিএস-টু, সিপিইউ-মনিটর একত্রে। আর কী ওজন তার! একটা আইবিএম প্রিন্টারসহ দাম পড়লো এক হাজার ডলার, হোক না অন্যের ব্যবহার করা পুরনো জিনিস। অপারেটিং সিস্টেম ডস, যতোদূর মনে পড়ে উইন্ডোজ তখন এসে গেছে, কিন্তু এই কমপিউটারে চলবে না। সেই শুরু আমার কম্পু-কম্পু খেলা।
আমেরিকা ও কানাডায় বসবাসকারী আমার সমবয়সী কিছু বন্ধুবান্ধব ছোটোখাটো কম্পু-প্রশ্ন নিয়ে আমাকে মাঝেমধ্যে ফোন করেন। দুরূহ কিছু হলে আমি নেই, কিন্তু এইসব প্রাথমিক স্তরের জিনিসগুলি বিষয়ে সমাধান বাতলে দিতে পারলেও আমাকে তাঁরা বিশেষ প্রতিভাবান মনে করেন। বিশ্বাসই করেন না যে আমার বা তাঁদের ছেলেমেয়েরাও এই সমাধান দিতে সম্পূর্ণ সক্ষম।
একবার এক বন্ধু তাঁর কম্পুতে একটা প্রোগ্রাম ডাউনলোড করে ইনস্টল করবেন। ফোনে তাঁকে আমি কী করতে হবে ধাপে ধাপে বলে যাচ্ছি। এক পর্যায়ে তিনি আটকে গেলেন। ভীষণ গিট্ঠু। আমি যতো সহজ করে বলার চেষ্টা করি, তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। অধৈর্য তিনি প্রায় হাল ছেড়ে দিতে উদ্যত। শেষ চেষ্টা হিসেবে তাঁকে বললাম, আপনার মেয়েকে ফোনটা ধরিয়ে দিন, সে এক মিনিটে বুঝে যাবে।
খুবই অনিচ্ছায় তিনি বিশ্বিবদ্যালয়ে-পড়ুয়া মেয়েকে ডাকলেন এবং আমার অনুমান ঠিক, মেয়ে এক মিনিটে সমাধান করে ফেললো। তার কাছে এটা ডালভাত।
বন্ধুকে বললাম, বলেছিলাম না ও ঠিক পারবে?
বন্ধু গম্ভীর গলায় জবাব দিলেন, দেখতে হবে না কার মেয়ে!
দোস্ত, তোকে একটা ইমেল পাঠিয়েছি সপ্তাহখানেক আগে। পেয়েছিস?
তাই নাকি? না রে দোস্ত, খুব ব্যস্ত ছিলাম। ইমেল খোলা হয়নি।
এটাই প্রথম বা শেষ নয়, দেশে আমার অনেক বন্ধু আছেন, যাঁদের সঙ্গে এই ধরনের কথোপকথন নিয়মিতই হয়। এঁরা কমপিউটার-বিমুখ অথবা কম্পুকানা প্রজন্মের প্রতিনিধি। এঁদের প্রায় সবারই কর্মস্থলে কমপিউটার ব্যবহার অনেকটা বাধ্যতামূলক। হয়তো নেহাত ছক-বাঁধা কাজগুলি তাঁরা করেন মোটামুটি যান্ত্রিকভাবে, নাক-চোখ-মুখ বন্ধ করে, কোনোমতে শেষ হলেই বাঁচোয়া। কারো কারো বাড়িতেও আছে, তবে তা হয় ছেলেমেয়েদের প্রয়োজনে অথবা স্রেফ শোভাবর্ধনের জন্যে।
ইমেল পাঠিয়ে কয়েকদিন অপেক্ষার পর ফোন করে ইমেল খুলতে বলাটা হাস্যকর বটে। দুঃখেরও। তাহলে আর ইমেল করা কেন? সময় নষ্ট না করে ফোনটাই করা যতো দিনকয়েক আগে।
আগেভাগেই বলে রাখি, আমি নিজে কম্পুকানাদের দলে যদিও কর্মসূত্রে সর্বক্ষণ কম্পু নাড়াচাড়া করতে হয়, ঘরেও অনেকটা সময় কম্পুতেই যায়। কিন্তু সে বিষয়ে আমার বিদ্যা বা দক্ষতা নিচের দিকে। আমার জানার পরিধি ততোটুকুই, যা হলে কোনোমতে কাজ চলে যায়। এর বাইরে আরো কিছু জানা বা শেখা দরকারি মনে হলেও সেই বাসনা নিবারণের মহৌষধ, কী দরকার! এই তো বেশ চলে যাচ্ছে।
কমপিউটারে টাইপিং স্পীড দেখে আমার দশ বছর বয়সী পুত্র হাসাহাসি করে। বলে, এই স্পীড নিয়ে তুমি কাজ করো কী করে?
আমি হাসি আর মনে মনে বলি, চুপ। একদম চুপ, কেউ যেন না শোনে!
বস্তুত আমি এমন এক প্রাচীন এবং প্রযুক্তির বিচারে অক্ষম-অসহায় প্রজন্মের মানুষ যাঁদের কমপিউটার সম্পর্কে এক ধরনের জড়তা ও ভীতি আছে। জড়তার ধরণ, ‘আমি কি পারবো? না পারলে খুব লজ্জার কথা।’ ভীতিটা হলো, ‘টেপাটিপি করতে গিয়ে যদি কম্পু নষ্ট হয়!’
অতি-সতর্কতা ও অর্থহীন ভীতি আমার প্রজন্মের অধিকাংশ মানুষকে কম্পুকানা করে রেখে দিয়েছে। এঁরা একান্ত বাধ্য না হলে কমপিউটারের আশেপাশে ক্কচিৎ-কদাচিৎ ভেড়েন, অন্যথায় সম্পূর্ণ সংস্রবহীন থাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে কমপিউটার ও আনুষঙ্গিক অনেক প্রযুক্তি আজকের পৃথিবীর বাস্তবতা এবং সেসব আমাদের জীবনধারণ ও জীবনাচরণের অংশ হয়ে গেছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তা খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করে এবং তা ব্যবহার করে অনায়াস দক্ষতায়। সমস্যা শুধু অপেক্ষাকৃত বয়স্কদের নিয়ে, যাঁরা আমার প্রজন্মের মানুষ। অথচ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কমপিউটার না জানা মানুষকে অশিক্ষিত গণ্য করা হবে বলে ধারণা করি। আমার বন্ধু ও সমবয়সীরাও তা জানেন এবং স্বীকার করেন, কিন্তু বিচিত্র উপায়ে চোখ ফিরিয়ে রাখতেও তাঁরা সক্ষম।
কম্পুতে বাংলা লেখা সম্ভব জেনে এঁদের কেউ কেউ আজও বিস্মিত হন। যাঁরা অল্পবিস্তর কম্পু ব্যবহার করেন, তাঁরা শেখার আগ্রহ দেখান। সেই আগ্রহ স্থায়ী হয় না। তাঁদের কিছুতেই বোঝাতে পারি না, আমরা যারা দুরূহ বিজয় কীবোর্ড শিখেছিলাম, সে তুলনায় আজকাল কম্পুতে বাংলা কতো সহজ হয়ে গেছে, রোমান হরফ ব্যবহার করেও বাংলা লেখা যায়।
ব্যতিক্রম দেখিনি, তা নয়। আমার এক বন্ধুর অধ্যাপক পিতা আমেরিকা এলেন বেড়াতে। ঐ স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ক্লাস করে কমপিউটার শিখে ফিরে গেলেন।
কমপিউটারে আমার কিছু আগ্রহ জন্মায় আশির দশকের শেষে। হার্ডওয়্যার-সফটওয়্যার ইত্যাদি একদম প্রাথমিক বিষয়গুলি শেখার জন্যে ক্লাস করতে গেলাম, সব মাথার ওপর দিয়ে গেলো। একজন পরামর্শ দিলেন, কমপিউটার কিনে বাড়িতে নিজে হাতেকলমে শেখা সবচেয়ে ভালো। প্রথমটা কিনলাম ৯০-এর অগাস্টে, স্পষ্ট মনে আছে। যন্ত্রটি ছিলো আইবিএম পিএস-টু, সিপিইউ-মনিটর একত্রে। আর কী ওজন তার! একটা আইবিএম প্রিন্টারসহ দাম পড়লো এক হাজার ডলার, হোক না অন্যের ব্যবহার করা পুরনো জিনিস। অপারেটিং সিস্টেম ডস, যতোদূর মনে পড়ে উইন্ডোজ তখন এসে গেছে, কিন্তু এই কমপিউটারে চলবে না। সেই শুরু আমার কম্পু-কম্পু খেলা।
আমেরিকা ও কানাডায় বসবাসকারী আমার সমবয়সী কিছু বন্ধুবান্ধব ছোটোখাটো কম্পু-প্রশ্ন নিয়ে আমাকে মাঝেমধ্যে ফোন করেন। দুরূহ কিছু হলে আমি নেই, কিন্তু এইসব প্রাথমিক স্তরের জিনিসগুলি বিষয়ে সমাধান বাতলে দিতে পারলেও আমাকে তাঁরা বিশেষ প্রতিভাবান মনে করেন। বিশ্বাসই করেন না যে আমার বা তাঁদের ছেলেমেয়েরাও এই সমাধান দিতে সম্পূর্ণ সক্ষম।
একবার এক বন্ধু তাঁর কম্পুতে একটা প্রোগ্রাম ডাউনলোড করে ইনস্টল করবেন। ফোনে তাঁকে আমি কী করতে হবে ধাপে ধাপে বলে যাচ্ছি। এক পর্যায়ে তিনি আটকে গেলেন। ভীষণ গিট্ঠু। আমি যতো সহজ করে বলার চেষ্টা করি, তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। অধৈর্য তিনি প্রায় হাল ছেড়ে দিতে উদ্যত। শেষ চেষ্টা হিসেবে তাঁকে বললাম, আপনার মেয়েকে ফোনটা ধরিয়ে দিন, সে এক মিনিটে বুঝে যাবে।
খুবই অনিচ্ছায় তিনি বিশ্বিবদ্যালয়ে-পড়ুয়া মেয়েকে ডাকলেন এবং আমার অনুমান ঠিক, মেয়ে এক মিনিটে সমাধান করে ফেললো। তার কাছে এটা ডালভাত।
বন্ধুকে বললাম, বলেছিলাম না ও ঠিক পারবে?
বন্ধু গম্ভীর গলায় জবাব দিলেন, দেখতে হবে না কার মেয়ে!
Sunday, July 27, 2008
স্বপ্ন-জাগরণের মাঝখানে
পিতৃপুরুষের গ্রামের বাড়ি দোগাছি থেকে ফোন। কান্না-জড়ানো গলায় খোকা ভাই জানালেন, দাদা এইমাত্র মারা গেলেন।
কী বলবো, কী করবো বুঝতে না পেরে হতভম্বের মতো ফোন ধরে আছি। ভাবছি, সবাইকে খবরটা কীভাবে দেওয়া উচিত। ফোনে খোকা ভাই কীসব যেন বলে যাচ্ছেন, আমার মস্তিষ্কে তার কিছুই প্রবেশ করে না। না শোক, না দুঃখবোধ – কিছুই টের পাই না। শুধু মনে হয়, দাদা মারা গেলেন!
ঘুম ভেঙে যায়। ভোর হতে এখনো ঢের বাকি। বিছানায় উঠে বসি। বুঝি, স্বপ্ন দেখছিলাম। তখনো মনে মনে ভাবছি, দাদা মারা গেলেন!
বিছানা থেকে নামি। বাথরুমে যাই ঘুমচোখে। ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার আগেও ভাবছি, দাদা মারা গেছেন।
সকালে অ্যালার্মের কর্কশ শব্দে ঘুম ভাঙলে প্রথমেই মনে আসে, দাদা মারা গেছেন।
দাঁত মাজা শেষে চোখেমুখে পানি দিয়ে ঘোর কাটে। মনে পড়ে, দাদা মারা গেছেন আজ নয়, প্রায় তিরিশ বছর আগে!
অক্টোবর ১৩, ২০০৫
কী বলবো, কী করবো বুঝতে না পেরে হতভম্বের মতো ফোন ধরে আছি। ভাবছি, সবাইকে খবরটা কীভাবে দেওয়া উচিত। ফোনে খোকা ভাই কীসব যেন বলে যাচ্ছেন, আমার মস্তিষ্কে তার কিছুই প্রবেশ করে না। না শোক, না দুঃখবোধ – কিছুই টের পাই না। শুধু মনে হয়, দাদা মারা গেলেন!
ঘুম ভেঙে যায়। ভোর হতে এখনো ঢের বাকি। বিছানায় উঠে বসি। বুঝি, স্বপ্ন দেখছিলাম। তখনো মনে মনে ভাবছি, দাদা মারা গেলেন!
বিছানা থেকে নামি। বাথরুমে যাই ঘুমচোখে। ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার আগেও ভাবছি, দাদা মারা গেছেন।
সকালে অ্যালার্মের কর্কশ শব্দে ঘুম ভাঙলে প্রথমেই মনে আসে, দাদা মারা গেছেন।
দাঁত মাজা শেষে চোখেমুখে পানি দিয়ে ঘোর কাটে। মনে পড়ে, দাদা মারা গেছেন আজ নয়, প্রায় তিরিশ বছর আগে!
অক্টোবর ১৩, ২০০৫
Monday, July 21, 2008
একে একে নিভিছে দেউটি - এবারে কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হক
এইমাত্র পাওয়া খবর, কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হক আর নেই। কয়েক ঘণ্টা আগে আকস্মিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি চলে গেলেন।
হৃদরোগের চিকিৎসাশেষে মাহমুদুল হক মাত্র তিন-চারদিন আগে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছিলেন আপাত-সুস্থ হয়ে, নিজে পায়ে হাঁটতে সক্ষম অবস্থায়। কিন্তু জীবন কী অনিত্য!
আজকের অনেক পাঠকের কাছে মাহমুদুল হক খুব পরিচিত নন। বরাবর কম লিখতেন, ইদানিং প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন লেখালেখি। ষাটের দশকের এই দিশারী লেখকের কাছে আমরা জীবন আমার বোন, নিরাপদ তন্দ্রা-র মতো অসামান্য উপন্যাস পেয়েছি।
ভালো কোনো খবর আজকাল আর পাওয়া হয় না। কীভাবে যেন যাবতীয় দুঃসংবাদ আমার কাছে দ্রুত এসে পড়ে। ব্যক্তিগত পরিচয় মাহমুদুল হকের সঙ্গে আমার ছিলো না, তবু ব্যতিক্রম হলো না।
হৃদরোগের চিকিৎসাশেষে মাহমুদুল হক মাত্র তিন-চারদিন আগে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছিলেন আপাত-সুস্থ হয়ে, নিজে পায়ে হাঁটতে সক্ষম অবস্থায়। কিন্তু জীবন কী অনিত্য!
আজকের অনেক পাঠকের কাছে মাহমুদুল হক খুব পরিচিত নন। বরাবর কম লিখতেন, ইদানিং প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন লেখালেখি। ষাটের দশকের এই দিশারী লেখকের কাছে আমরা জীবন আমার বোন, নিরাপদ তন্দ্রা-র মতো অসামান্য উপন্যাস পেয়েছি।
ভালো কোনো খবর আজকাল আর পাওয়া হয় না। কীভাবে যেন যাবতীয় দুঃসংবাদ আমার কাছে দ্রুত এসে পড়ে। ব্যক্তিগত পরিচয় মাহমুদুল হকের সঙ্গে আমার ছিলো না, তবু ব্যতিক্রম হলো না।
----------------------------------
জুলাই ২০, ২০০৮। সন্ধ্যা ৭:২০
----------------------------------
Saturday, July 19, 2008
খালের এই পাড়ে খাড়াইয়া কই…
বছর চার-পাঁচেক আগে ডালাসে বাঙালিদের একটা অনুষ্ঠানে গেছি। বিরতির সময় অডিটরিয়ামের বাইরে সবাই চা-সিঙাড়া খাচ্ছে, গল্পগুজব করছে, ধূমপায়ীরা ভবনের বাইরে নির্ধারিত এলাকায়। আমি শেষের দলভুক্ত। একসময় খেয়াল করলাম, এক ভদ্রমহিলা বাংলাদেশে ছাপা একটা রসিদবই নিয়ে সবার কাছে যাচ্ছেন চাঁদা সংগ্রহ করতে। একটু কান পেতে বোঝা গেলো, চাঁদা তোলা হচ্ছে মহিলার গ্রামের বাড়িতে মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণের জন্যে। তাঁর বাড়ি কোথায় জানি না। হতে পারে বাংলাদেশের যে কোনো গ্রামে, কথা শুনে বোঝার উপায় নেই। আশ্চর্য লাগলো, বাংলাদেশের কোন প্রত্যন্ত গ্রামে মসজিদ-মাদ্রাসা হবে, তার জন্যে চাঁদা সংগ্রহ করা হচ্ছে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে।
যথাসময়ে মহিলা আমার কাছেও এলেন। তাঁকে স্পষ্ট করে জানাই, মাদ্রাসা-মসজিদের জন্যে চাঁদা আমি দিই না।
অনিচ্ছুক কারো কাছে ঠিক এই জবাব হয়তো তিনি পাননি। ফলে, তাঁর বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখ আমাকে বেশ কয়েক মুহূর্ত নিরীক্ষণ করে। অতঃপর আর কোনো কথা না বলে (মনে মনে সম্ভবত আমার দোজখবাস সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে) তিনি পরবর্তী কোনো ধর্মপ্রাণ দয়ালুর সন্ধানে যান।
কিন্তু বাংলাদেশে এই কথাগুলি ঠিক এইভাবে আমি বলতে পারতাম? নিজের ভেতর থেকে না-সূচক উত্তরই পাই। গত ২০ বছরে বাংলাদেশে মসজিদ-মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে যতো প্রকার গোঁড়ামি ও ধর্মোন্মাদনার বিস্তার ঘটেছে, তা একজন সুস্থ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্যে যথেষ্ট আতংকের। হুমায়ূন আজাদের পরিণতি আমাদের জানা আছে। তিনি নিজেও হয়তো আক্রান্ত হওয়ার আশংকা করতেন। তবু তাঁর স্পষ্টবাদিতা অক্ষুণ্ণ থেকেছে। স্বীকার করে নিই, তাঁকে নিয়ে মুগ্ধ হতে আমার কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু তাঁর অপরিমেয় সাহস ও স্পষ্টবাদিতার ছিঁটেফোঁটাও আমার মধ্যে দেখতে পাই না।
বরং যা দেখি, তা আমাকে বিচলিত করলেও অন্য কাউকে জানতে দিই না। বিপদ চোখের সামনে দেখি না, দেখতেও হয় না, বিপদের একটা সম্ভাবনা অনুমান করা গেলেই শামুকের মতো খোলসে লুকিয়ে থাকি।
তবে আমার সাহস কম, এরকম কথা মানবো কেন? আমি ধর্মীয় উন্মাদনার বিরুদ্ধে, যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে, দেশে জলপাই শাসনের বিরুদ্ধে কি কথা বলি না? নিশ্চয়ই বলি। একশোবার বলি। কীভাবে? না, ইন্টারনেটে। ব্লগ লিখে। তাতে কারো কিছু এসে-গেলো? না যাক, আমি বিপ্লব সম্পন্ন করার পরিতৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে যেতে পারি। আত্মশ্লাঘার বোধ আমাকে একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়। আমি বোধহয় একটা কিছু করেই ফেললাম। ইন্টারনেটের বিপ্লবী না আমি!
তখন আমার এই বোধ ঘুমন্ত থাকে যে, ঘোর বিপদের সম্ভাবনা মাথায নিয়ে, গর্দানহীন হওয়ার আশংকার মধ্যেও বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে অনেকে আজও কাজ করে যাচ্ছেন, ধর্মোন্মাদনা ও রাজাকারতন্ত্রের বিপক্ষে দাঁড়ানোর হিম্মত দেখাচ্ছেন। রাষ্ট্রক্ষমতার সামরিকায়নের বিপক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নিচ্ছেন। প্রকৃত সাহসী তাঁরাই, অভিবাদন তাঁদের প্রাপ্য।
কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে যোজন দূরে আয়েশী ভঙ্গিতে ল্যাপটপে আমার নেট-নির্ভর বিপ্লব সংঘটন অব্যাহত থাকে। যা খুশি বলতে পারি আমি। আমার লেখা কেউ সেন্সর করবে না। আমার কথায় ক্ষুব্ধ হলেও হাত-পায়ের রগ কাটতে কেউ আসবে না। জলপাই-রঙা ঊর্দি মাঝরাতে আমার বাড়ি ঘেরাও করবে না। আমি নির্ভয়। সুতরাং অকুতোভয়। বিপদের সব সম্ভাবনা থেকে বিস্তর দূরে।
একটা গল্প মনে পড়ছে। এক চাষীর বউ মহাদজ্জাল। তার দাপটে চাষী কোনো কথাই মুখ ফুটে বলতে সাহস পায় না। একদিন মাঠের কাজ সেরে ক্লান্ত চাষী ঘরে ফিরে খেতে বসেছে। আয়োজন সামান্য, সামান্য শাক আর ডাল। কিন্তু ডাল একেবারে বিস্বাদ, লবণ দেওয়া হয়নি। মেজাজ খারাপ হলেও বউকে কিছু বলার উপায় নেই। চুপচাপ খায় সে। রান্না কেমন হয়েছে, বউ জানতে চাইলেও সে চুপ করে থাকে। তাকে নিরুত্তর দেখে বউ যথারীতি মুখ ছোটায়, তাকে বোবা, বেআক্কেল ইত্যাদি বলতে থাকে। কোনোমতে খাওয়া শেষ করে চাষী বাড়ির পেছনের খালের ওপারে যায়। চিৎকার করে বলতে থাকে, কাউরে না ডরাইয়া কই, খালের এই পাড়ে খাড়াইয়া কই, ডাইলে তুই লবণ দ্যাস নাই, দ্যাস নাই, দ্যাস নাই…
যথাসময়ে মহিলা আমার কাছেও এলেন। তাঁকে স্পষ্ট করে জানাই, মাদ্রাসা-মসজিদের জন্যে চাঁদা আমি দিই না।
অনিচ্ছুক কারো কাছে ঠিক এই জবাব হয়তো তিনি পাননি। ফলে, তাঁর বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখ আমাকে বেশ কয়েক মুহূর্ত নিরীক্ষণ করে। অতঃপর আর কোনো কথা না বলে (মনে মনে সম্ভবত আমার দোজখবাস সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে) তিনি পরবর্তী কোনো ধর্মপ্রাণ দয়ালুর সন্ধানে যান।
কিন্তু বাংলাদেশে এই কথাগুলি ঠিক এইভাবে আমি বলতে পারতাম? নিজের ভেতর থেকে না-সূচক উত্তরই পাই। গত ২০ বছরে বাংলাদেশে মসজিদ-মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে যতো প্রকার গোঁড়ামি ও ধর্মোন্মাদনার বিস্তার ঘটেছে, তা একজন সুস্থ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্যে যথেষ্ট আতংকের। হুমায়ূন আজাদের পরিণতি আমাদের জানা আছে। তিনি নিজেও হয়তো আক্রান্ত হওয়ার আশংকা করতেন। তবু তাঁর স্পষ্টবাদিতা অক্ষুণ্ণ থেকেছে। স্বীকার করে নিই, তাঁকে নিয়ে মুগ্ধ হতে আমার কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু তাঁর অপরিমেয় সাহস ও স্পষ্টবাদিতার ছিঁটেফোঁটাও আমার মধ্যে দেখতে পাই না।
বরং যা দেখি, তা আমাকে বিচলিত করলেও অন্য কাউকে জানতে দিই না। বিপদ চোখের সামনে দেখি না, দেখতেও হয় না, বিপদের একটা সম্ভাবনা অনুমান করা গেলেই শামুকের মতো খোলসে লুকিয়ে থাকি।
তবে আমার সাহস কম, এরকম কথা মানবো কেন? আমি ধর্মীয় উন্মাদনার বিরুদ্ধে, যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে, দেশে জলপাই শাসনের বিরুদ্ধে কি কথা বলি না? নিশ্চয়ই বলি। একশোবার বলি। কীভাবে? না, ইন্টারনেটে। ব্লগ লিখে। তাতে কারো কিছু এসে-গেলো? না যাক, আমি বিপ্লব সম্পন্ন করার পরিতৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে যেতে পারি। আত্মশ্লাঘার বোধ আমাকে একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়। আমি বোধহয় একটা কিছু করেই ফেললাম। ইন্টারনেটের বিপ্লবী না আমি!
তখন আমার এই বোধ ঘুমন্ত থাকে যে, ঘোর বিপদের সম্ভাবনা মাথায নিয়ে, গর্দানহীন হওয়ার আশংকার মধ্যেও বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে অনেকে আজও কাজ করে যাচ্ছেন, ধর্মোন্মাদনা ও রাজাকারতন্ত্রের বিপক্ষে দাঁড়ানোর হিম্মত দেখাচ্ছেন। রাষ্ট্রক্ষমতার সামরিকায়নের বিপক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নিচ্ছেন। প্রকৃত সাহসী তাঁরাই, অভিবাদন তাঁদের প্রাপ্য।
কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে যোজন দূরে আয়েশী ভঙ্গিতে ল্যাপটপে আমার নেট-নির্ভর বিপ্লব সংঘটন অব্যাহত থাকে। যা খুশি বলতে পারি আমি। আমার লেখা কেউ সেন্সর করবে না। আমার কথায় ক্ষুব্ধ হলেও হাত-পায়ের রগ কাটতে কেউ আসবে না। জলপাই-রঙা ঊর্দি মাঝরাতে আমার বাড়ি ঘেরাও করবে না। আমি নির্ভয়। সুতরাং অকুতোভয়। বিপদের সব সম্ভাবনা থেকে বিস্তর দূরে।
একটা গল্প মনে পড়ছে। এক চাষীর বউ মহাদজ্জাল। তার দাপটে চাষী কোনো কথাই মুখ ফুটে বলতে সাহস পায় না। একদিন মাঠের কাজ সেরে ক্লান্ত চাষী ঘরে ফিরে খেতে বসেছে। আয়োজন সামান্য, সামান্য শাক আর ডাল। কিন্তু ডাল একেবারে বিস্বাদ, লবণ দেওয়া হয়নি। মেজাজ খারাপ হলেও বউকে কিছু বলার উপায় নেই। চুপচাপ খায় সে। রান্না কেমন হয়েছে, বউ জানতে চাইলেও সে চুপ করে থাকে। তাকে নিরুত্তর দেখে বউ যথারীতি মুখ ছোটায়, তাকে বোবা, বেআক্কেল ইত্যাদি বলতে থাকে। কোনোমতে খাওয়া শেষ করে চাষী বাড়ির পেছনের খালের ওপারে যায়। চিৎকার করে বলতে থাকে, কাউরে না ডরাইয়া কই, খালের এই পাড়ে খাড়াইয়া কই, ডাইলে তুই লবণ দ্যাস নাই, দ্যাস নাই, দ্যাস নাই…
Thursday, July 3, 2008
ওবামার ভ্রান্তি-বিভ্রান্তি
ওবামাকে এখন কি আর দেবদূতের মতো শোনাচ্ছে? গত দিন দুয়েক ধরে শুনছি, মার্কিন ধর্মীয় মোল্লাদের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করতে উঠে-পড়ে লেগেছেন তিনি। আমেরিকার আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ওবামা। রিপাবলিকানদের ধর্মভিত্তিক ভোটে ভাগ বসানোর জন্যে নাকি এটা তাঁর কৌশল। সেজন্যে এভানজেলিস্টদের সঙ্গে ওবামা সাক্ষাৎ করছেন, চার্চে চার্চে হাজিরা দিচ্ছেন। কয়্যারের সঙ্গে মাথা দোলাচ্ছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি আট বছর আগে – জুনিয়র বুশ নির্বাচিত হওয়ার পর। বুশ দ্বিতীয় দফা নির্বাচিত হলে এই ঔদাসীন্য রীতিমতো বৈরাগ্যে পরিণত হয়। ফলে, এবারের নির্বাচন বিষয়ে বিশেষ কান পাতিনি। টুকরো-টাকরা যা ছিটকে কানে আসে, তা মরমে পশে না। তবে ডেমোক্র্যাটদের শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা দুই প্রার্থী কিছু আগ্রহ তৈরি করার কারণ ঘটিয়েছিলেন। হিলারি ক্লিনটন বা বারাক ওবামা – এই দু’জনের যে কোনো একজন প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেলেই আমেরিকায় একটা ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে যাবে। আমেরিকার ইতিহাসে এর আগে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ বা নারী কখনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মনোনয়ন পাননি, এতোটাই পুরুষশাসিত ও বর্ণবিদ্বেষী এদের ইতিহাস।
ওবামার ডেমোক্র্যাট দলের মনোনয়ন নিশ্চিত হলে সমর্থকরা উল্লসিত হয়। ওবামা সত্যি সত্যি নতুন কিছু করবেন বলে তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে। এই প্রার্থী তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতার গুণে আমেরিকাকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হন যে তিনি পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
তাঁর সাম্প্রতিক মোল্লা-ভজানো কথাবার্তা শুনে অনেকে এখন বিস্মিত ও অপ্রস্তুত। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই হতাশ। মার্কিন দেশে মোল্লাদের ঠিকানা রিপাবলিকান শিবির, ডেমোক্র্যাটরা কখনো তাদের আস্থা পায় না, তারা নিজেরাও মোল্লাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে গা করেনি। ডেমোক্র্যাটরা তাদের উদারপন্থা নিয়ে সন্তুষ্ট ও গর্বিত ছিলো, যদিও এ দেশে লিবারেল হওয়া এক ধরনের যন্ত্রণাবিশেষ। ওবামা উদারপন্থীদের সেই অহংকারের জায়গাটুকুও বিসর্জন দিতে প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে। বারাক হুসেন ওবামা যে মুসলমান নন, বরং একজন নিবেদিত খ্রীষ্ট ধর্মানুসারী – তা প্রমাণ করার জন্যে মনে হয় রিপাবলিকানদের চেয়ে বড়ো রিপাবলিকান হতেও তিনি সম্মত।
শুধু নির্বাচনী কৌশল হলেও পরিণামে এটা উদারপন্থীদের জন্যে ক্ষতির কারণ ঘটাবে বলে অনায়াসে অনুমান করা চলে। পৃথিবী জুড়ে আর কতো মার খাবে উদারপন্থীরা? দম বন্ধ হয়ে আসছে যে!
Subscribe to:
Posts (Atom)