Friday, August 22, 2008

দুই মাস যখন দুই দিনে নেমে আসে

কাল তিন তিনবার ভুল রাস্তায় চলে গেলাম। আক্ষরিক অর্থেই ‘এ পথে আমি যে গেছি বারবার’ বলার মতো দুশো মাইলের পথ। ইন্টারস্টেট-৩৫ ধরে সরাসরি ড্রাইভ, কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই। তবে হাইওয়ে মাঝেমধ্যে বিভক্ত হয়ে যায় অন্য নানা ঠিকানার দিকে। ভুল হলে অন্য শহরে পৌঁছে যাওয়া, নিদেনপক্ষে একটা চক্কর খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। ডালাস থেকে অস্টিন গিয়েছি, তখন সব ঠিকঠাক। ফেরার পথে ভুল রাস্তায় গিয়ে গোলমাল, চক্কর খেতে হলো।

মেয়েটা বড়ো হয়েই গেলো, চলে যাবে পড়তে অস্টিনে। জুন মাসের মাঝামাঝি খবর জানার পর মনে হলো, দুই মাস সময় এখনো আছে । অথচ কোথা দিয়ে কীভাবে সময়টা চলে গেলো! এই দুই মাসে আমরা অনেক কথা বলবো; জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ’ কনসার্টের ডিভিডি এবং হ্যারিসনের মৃত্যুর পর তাঁর বন্ধুদের আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর জর্জ’-এর ডিভিডি কিনে রাখা আছে দীর্ঘদিন, এখনো সেলোফেন-আবৃত, কথা ছিলো একসঙ্গে বসে দেখবো। সময়গুলি কোথায় গেলো?

পরশু আমাদের চারজনের পরিবার গেলাম অস্টিনে। গতকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মেয়ের পরিচয়-পর্ব (orientation) হলো। ক্লাস শুরু হতে এক সপ্তাহ দেরি, কিন্তু আবার তাকে নিয়ে অস্টিনে আসতে হবে শনিবার, তিনদিন পর। নতুন শহরে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে সে উঠবে সেদিন, গোছগাছ করে ক্লাসের জন্যে তৈরি হওয়ার সময় পাবে দিন তিনেক।

কাল দুপুরের দিকে তার অ্যাপার্টমেন্ট দেখতে যাওয়া হলো। মেয়ে রুমমেট ঠিক করেছে এক প্যালেস্টাইনি মেয়ে ফারাহকে। ফারাহ-র বাবা গতমাসে নিজে এসে ঘুরে ঘুরে সব ঠিকঠাক করে গেছেন। ভদ্রলোকের পছন্দের ওপর কোনো কথা চলে না, অ্যাপার্টমেন্ট এবং কাছাকাছি এলাকা দেখে যে কোনো বাবা-মা নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারে। বস্তুত, সকালের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের রাস্তাঘাট-বাড়িঘর দেখে আমার একটু ফাঁপড় লাগছিলো। বেশ পুরনো, ঘিঞ্জিমতো সব, ডাউনটাউন এলাকায় যেমন হয়। তখনো সঠিক ধারণা নেই, ওদের অ্যাপার্টমেন্ট ঠিক কোথায়, কেমন জায়গা।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইল কয়েকের দূরত্বে অ্যাপার্টমেন্ট দেখে মেয়ে নিজেও মহা উচ্ছ্বসিত। নিজের প্রথম ঠিকানা বলে কথা, বাবা-মায়ের ছায়ার বাইরে তার স্বাধীনতার ঠিকানা।

ফেরার পথে মেয়েকে বলি আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল-জীবনের গল্প। নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্ট দূরের কথা, নিজের বিছানার স্বপ্ন দেখাও কঠিন সূর্যসেন হলের ৪৪৮ নম্বর কক্ষের মেঝেতে শায়িত হয়ে। প্রথম বছরের প্রায় পুরোটাই সেভাবে কেটেছিলো। চোখে অবিশ্বাস নিয়ে মেয়ে তাকিয়ে থাকে, কল্পনাশক্তিও তাকে ছবিটা দেখতে সাহায্য করে বলে মনে হয় না। না হোক, কোনো ক্ষতি নেই। তার এখন সামনে তাকানোর সময়, তাকে স্বপ্ন দেখতে হবে আগামীর, পিতামাতার অতীতের জঞ্জালে তার কোনো প্রয়োজন না থাকাই উচিত।

দীর্ঘ যাত্রায় যেমন হয়, একসময় কথা থামে। ছেলেমেয়েরা এরকম যাত্রায় সচরাচর পালা করে প্যাসেঞ্জার সীটে বসে ডি জে হয়ে গান বাজায়। এখন মেয়ে সেই ভূমিকায়, তার নিজের ও ছোটো ভাইটির পছন্দের গান বাজায়। ওদের বয়সের ব্যবধান আট বছরের, একটা সময় ছিলো তাদের মধ্যে বনিবনা প্রায় ছিলোই না – তাদের দুই পৃথিবীর দূরত্ব এতোটাই বেশি তখন। বছর দুয়েক ধরে সেটা পাল্টাতে শুরু করেছে। দুইজনে মিলে কতোসব বকবক করে, একত্রে বসে গান শোনে। মেয়ে নিজের গরজে প্রতি সপ্তাহে ভাইকে নিয়ে যায় সিনেমা দেখতে। বোনের ফিরতে দেরি হলে ছেলে ‘আপু কখন আসবে? ফোন করি?’ জিজ্ঞেস করতে থাকে। ঠিক এই সময়েই তাদের বিচ্ছিন্ন হতে হবে ভাবলে কষ্ট হয়। এই সময় কি আর তাদের জীবনে ফিরে আসবে?

সেদিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপু চলে গেলে তোমার খারাপ লাগবে?’

ছেলে নিঃশব্দে কাঁধ ঝাঁকায়, সে জানে না। হয়তো সত্যিই জানে না। তার জীবন এরকম চলে যাওয়ার ঘটনা কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। অবিলম্বে জানবে, জীবন তাকে আরো অনেক অভিজ্ঞানে অভিজ্ঞ করে তুলবে ক্রমশ। এইসব ছোটোবড়ো নানা ধরনের দুঃখ-কষ্ট থেকে কে কবে রেহাই পেয়েছে?

সিডি-তে বেজে যাওয়া গান কানে আসে, মরমে পশে না। গাড়ি চালাচ্ছি, বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি। আচমকা মনে হয়, আর মোটে কয়েকদিন পরে যখন অস্টিন থেকে ফিরবো, তখন মেয়ে পাশে বসে থাকবে না। তাকে ছেড়ে আসতে হবে তার নতুন ঠিকানায়। ভেতরটা কেন কে জানে খুব শূন্য লাগতে থাকে। খুব দূরের পথ নয়, চাইলেই যাওয়া-আসা হবে। কিন্তু তবু সে তো দূরেরই একজন হয়ে উঠবে দিনদিন। এখন বলছে, প্রতি সপ্তাহে না হলেও অন্তত দুই সপ্তাহ পরপর সে আসবে। হয়তো আসবে, কিন্তু দুই ক্রমশ তিন বা চার সপ্তাহ হয়ে যাবে, একসময় আরো আরো দীর্ঘ। জীবন এরকমই, নিজেকে দিয়েই জানি, আমার পিতামাতাও আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে এই বোধ নিয়ে চোখ মুছে গৃহকর্মে মন দিয়েছিলেন। এখন আমার পালা। যা কিছু নিয়েছি তা ফিরিয়ে দিতেই হয়।

প্রথম দুইবার ভুল পথে গিয়ে আর কেউ টের পাওয়ার আগেই চুপচাপ ফিরতে সক্ষম হই। ধরা পড়লাম শেষবার ডালাস শহরে ঢোকার পর। ছেলেমেয়ের মা টের পেয়ে যায়, ‘কী হলো তোমার?’

কী করে বলি, এই বাবাটি নিজেকে অনেক শক্ত মনের মানুষ ভাবলেও হয়তো ততোটা শক্ত সে নয়। কিন্তু আর কারো তা জানার দরকার নেই। চোখের কী দোষ? Must be the clouds in my eyes!

২১ অগাস্ট ২০০৮

5 comments:

Anonymous said...

you and i never talked. there was no reason or need for a conversation between us. but i knew you. i knew you through your writings. no, not the novels or stories that you are so famous for. i read your blog entries, your simple day to day logs, your happiness, your sorrow, your loss...

when i first saw your gtalk nick (you are on one of my close friend's gtalk list), i was amazed. it was mz1971. 1971 meant more to you than yourself! at least i saw it that way.

i don't know where you are right now, i don't know if people even exist in something called afterlife...but it's true that you will be remembered. if an insignificant existence like me is feeling a bit lost after your death, god knows how the people you were close with are feeling right now. wherever you are, or your aren't, you'll be remembered. that's all i wanted to say.

সৌরভ said...
This comment has been removed by the author.
সৌরভ said...

এইখানে আর কেউ কখনো লিখবে না।

Anonymous said...

You write very well..How come you don't blog anymore? Is everything alright?

বোহেমিয়ান said...

শেষ কমেণ্টকারী জানেন ও কি ঘটে গেছে! :(


ভালো থাকুন ।