ঢাকায় এক বন্ধুকে ইমেল করেছি একটা দরকারি প্রশ্ন করে। অপেক্ষায় সপ্তাহ কেটে যায়, উত্তর আসে না। অগত্যা ফোন করি। বন্ধু ঘুমচোখে হ্যালো বলেন।
দোস্ত, তোকে একটা ইমেল পাঠিয়েছি সপ্তাহখানেক আগে। পেয়েছিস?
তাই নাকি? না রে দোস্ত, খুব ব্যস্ত ছিলাম। ইমেল খোলা হয়নি।
এটাই প্রথম বা শেষ নয়, দেশে আমার অনেক বন্ধু আছেন, যাঁদের সঙ্গে এই ধরনের কথোপকথন নিয়মিতই হয়। এঁরা কমপিউটার-বিমুখ অথবা কম্পুকানা প্রজন্মের প্রতিনিধি। এঁদের প্রায় সবারই কর্মস্থলে কমপিউটার ব্যবহার অনেকটা বাধ্যতামূলক। হয়তো নেহাত ছক-বাঁধা কাজগুলি তাঁরা করেন মোটামুটি যান্ত্রিকভাবে, নাক-চোখ-মুখ বন্ধ করে, কোনোমতে শেষ হলেই বাঁচোয়া। কারো কারো বাড়িতেও আছে, তবে তা হয় ছেলেমেয়েদের প্রয়োজনে অথবা স্রেফ শোভাবর্ধনের জন্যে।
ইমেল পাঠিয়ে কয়েকদিন অপেক্ষার পর ফোন করে ইমেল খুলতে বলাটা হাস্যকর বটে। দুঃখেরও। তাহলে আর ইমেল করা কেন? সময় নষ্ট না করে ফোনটাই করা যতো দিনকয়েক আগে।
আগেভাগেই বলে রাখি, আমি নিজে কম্পুকানাদের দলে যদিও কর্মসূত্রে সর্বক্ষণ কম্পু নাড়াচাড়া করতে হয়, ঘরেও অনেকটা সময় কম্পুতেই যায়। কিন্তু সে বিষয়ে আমার বিদ্যা বা দক্ষতা নিচের দিকে। আমার জানার পরিধি ততোটুকুই, যা হলে কোনোমতে কাজ চলে যায়। এর বাইরে আরো কিছু জানা বা শেখা দরকারি মনে হলেও সেই বাসনা নিবারণের মহৌষধ, কী দরকার! এই তো বেশ চলে যাচ্ছে।
কমপিউটারে টাইপিং স্পীড দেখে আমার দশ বছর বয়সী পুত্র হাসাহাসি করে। বলে, এই স্পীড নিয়ে তুমি কাজ করো কী করে?
আমি হাসি আর মনে মনে বলি, চুপ। একদম চুপ, কেউ যেন না শোনে!
বস্তুত আমি এমন এক প্রাচীন এবং প্রযুক্তির বিচারে অক্ষম-অসহায় প্রজন্মের মানুষ যাঁদের কমপিউটার সম্পর্কে এক ধরনের জড়তা ও ভীতি আছে। জড়তার ধরণ, ‘আমি কি পারবো? না পারলে খুব লজ্জার কথা।’ ভীতিটা হলো, ‘টেপাটিপি করতে গিয়ে যদি কম্পু নষ্ট হয়!’
অতি-সতর্কতা ও অর্থহীন ভীতি আমার প্রজন্মের অধিকাংশ মানুষকে কম্পুকানা করে রেখে দিয়েছে। এঁরা একান্ত বাধ্য না হলে কমপিউটারের আশেপাশে ক্কচিৎ-কদাচিৎ ভেড়েন, অন্যথায় সম্পূর্ণ সংস্রবহীন থাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে কমপিউটার ও আনুষঙ্গিক অনেক প্রযুক্তি আজকের পৃথিবীর বাস্তবতা এবং সেসব আমাদের জীবনধারণ ও জীবনাচরণের অংশ হয়ে গেছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তা খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করে এবং তা ব্যবহার করে অনায়াস দক্ষতায়। সমস্যা শুধু অপেক্ষাকৃত বয়স্কদের নিয়ে, যাঁরা আমার প্রজন্মের মানুষ। অথচ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কমপিউটার না জানা মানুষকে অশিক্ষিত গণ্য করা হবে বলে ধারণা করি। আমার বন্ধু ও সমবয়সীরাও তা জানেন এবং স্বীকার করেন, কিন্তু বিচিত্র উপায়ে চোখ ফিরিয়ে রাখতেও তাঁরা সক্ষম।
কম্পুতে বাংলা লেখা সম্ভব জেনে এঁদের কেউ কেউ আজও বিস্মিত হন। যাঁরা অল্পবিস্তর কম্পু ব্যবহার করেন, তাঁরা শেখার আগ্রহ দেখান। সেই আগ্রহ স্থায়ী হয় না। তাঁদের কিছুতেই বোঝাতে পারি না, আমরা যারা দুরূহ বিজয় কীবোর্ড শিখেছিলাম, সে তুলনায় আজকাল কম্পুতে বাংলা কতো সহজ হয়ে গেছে, রোমান হরফ ব্যবহার করেও বাংলা লেখা যায়।
ব্যতিক্রম দেখিনি, তা নয়। আমার এক বন্ধুর অধ্যাপক পিতা আমেরিকা এলেন বেড়াতে। ঐ স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ক্লাস করে কমপিউটার শিখে ফিরে গেলেন।
কমপিউটারে আমার কিছু আগ্রহ জন্মায় আশির দশকের শেষে। হার্ডওয়্যার-সফটওয়্যার ইত্যাদি একদম প্রাথমিক বিষয়গুলি শেখার জন্যে ক্লাস করতে গেলাম, সব মাথার ওপর দিয়ে গেলো। একজন পরামর্শ দিলেন, কমপিউটার কিনে বাড়িতে নিজে হাতেকলমে শেখা সবচেয়ে ভালো। প্রথমটা কিনলাম ৯০-এর অগাস্টে, স্পষ্ট মনে আছে। যন্ত্রটি ছিলো আইবিএম পিএস-টু, সিপিইউ-মনিটর একত্রে। আর কী ওজন তার! একটা আইবিএম প্রিন্টারসহ দাম পড়লো এক হাজার ডলার, হোক না অন্যের ব্যবহার করা পুরনো জিনিস। অপারেটিং সিস্টেম ডস, যতোদূর মনে পড়ে উইন্ডোজ তখন এসে গেছে, কিন্তু এই কমপিউটারে চলবে না। সেই শুরু আমার কম্পু-কম্পু খেলা।
আমেরিকা ও কানাডায় বসবাসকারী আমার সমবয়সী কিছু বন্ধুবান্ধব ছোটোখাটো কম্পু-প্রশ্ন নিয়ে আমাকে মাঝেমধ্যে ফোন করেন। দুরূহ কিছু হলে আমি নেই, কিন্তু এইসব প্রাথমিক স্তরের জিনিসগুলি বিষয়ে সমাধান বাতলে দিতে পারলেও আমাকে তাঁরা বিশেষ প্রতিভাবান মনে করেন। বিশ্বাসই করেন না যে আমার বা তাঁদের ছেলেমেয়েরাও এই সমাধান দিতে সম্পূর্ণ সক্ষম।
একবার এক বন্ধু তাঁর কম্পুতে একটা প্রোগ্রাম ডাউনলোড করে ইনস্টল করবেন। ফোনে তাঁকে আমি কী করতে হবে ধাপে ধাপে বলে যাচ্ছি। এক পর্যায়ে তিনি আটকে গেলেন। ভীষণ গিট্ঠু। আমি যতো সহজ করে বলার চেষ্টা করি, তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। অধৈর্য তিনি প্রায় হাল ছেড়ে দিতে উদ্যত। শেষ চেষ্টা হিসেবে তাঁকে বললাম, আপনার মেয়েকে ফোনটা ধরিয়ে দিন, সে এক মিনিটে বুঝে যাবে।
খুবই অনিচ্ছায় তিনি বিশ্বিবদ্যালয়ে-পড়ুয়া মেয়েকে ডাকলেন এবং আমার অনুমান ঠিক, মেয়ে এক মিনিটে সমাধান করে ফেললো। তার কাছে এটা ডালভাত।
বন্ধুকে বললাম, বলেছিলাম না ও ঠিক পারবে?
বন্ধু গম্ভীর গলায় জবাব দিলেন, দেখতে হবে না কার মেয়ে!
Wednesday, July 30, 2008
Sunday, July 27, 2008
স্বপ্ন-জাগরণের মাঝখানে
পিতৃপুরুষের গ্রামের বাড়ি দোগাছি থেকে ফোন। কান্না-জড়ানো গলায় খোকা ভাই জানালেন, দাদা এইমাত্র মারা গেলেন।
কী বলবো, কী করবো বুঝতে না পেরে হতভম্বের মতো ফোন ধরে আছি। ভাবছি, সবাইকে খবরটা কীভাবে দেওয়া উচিত। ফোনে খোকা ভাই কীসব যেন বলে যাচ্ছেন, আমার মস্তিষ্কে তার কিছুই প্রবেশ করে না। না শোক, না দুঃখবোধ – কিছুই টের পাই না। শুধু মনে হয়, দাদা মারা গেলেন!
ঘুম ভেঙে যায়। ভোর হতে এখনো ঢের বাকি। বিছানায় উঠে বসি। বুঝি, স্বপ্ন দেখছিলাম। তখনো মনে মনে ভাবছি, দাদা মারা গেলেন!
বিছানা থেকে নামি। বাথরুমে যাই ঘুমচোখে। ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার আগেও ভাবছি, দাদা মারা গেছেন।
সকালে অ্যালার্মের কর্কশ শব্দে ঘুম ভাঙলে প্রথমেই মনে আসে, দাদা মারা গেছেন।
দাঁত মাজা শেষে চোখেমুখে পানি দিয়ে ঘোর কাটে। মনে পড়ে, দাদা মারা গেছেন আজ নয়, প্রায় তিরিশ বছর আগে!
অক্টোবর ১৩, ২০০৫
কী বলবো, কী করবো বুঝতে না পেরে হতভম্বের মতো ফোন ধরে আছি। ভাবছি, সবাইকে খবরটা কীভাবে দেওয়া উচিত। ফোনে খোকা ভাই কীসব যেন বলে যাচ্ছেন, আমার মস্তিষ্কে তার কিছুই প্রবেশ করে না। না শোক, না দুঃখবোধ – কিছুই টের পাই না। শুধু মনে হয়, দাদা মারা গেলেন!
ঘুম ভেঙে যায়। ভোর হতে এখনো ঢের বাকি। বিছানায় উঠে বসি। বুঝি, স্বপ্ন দেখছিলাম। তখনো মনে মনে ভাবছি, দাদা মারা গেলেন!
বিছানা থেকে নামি। বাথরুমে যাই ঘুমচোখে। ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার আগেও ভাবছি, দাদা মারা গেছেন।
সকালে অ্যালার্মের কর্কশ শব্দে ঘুম ভাঙলে প্রথমেই মনে আসে, দাদা মারা গেছেন।
দাঁত মাজা শেষে চোখেমুখে পানি দিয়ে ঘোর কাটে। মনে পড়ে, দাদা মারা গেছেন আজ নয়, প্রায় তিরিশ বছর আগে!
অক্টোবর ১৩, ২০০৫
Monday, July 21, 2008
একে একে নিভিছে দেউটি - এবারে কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হক
এইমাত্র পাওয়া খবর, কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হক আর নেই। কয়েক ঘণ্টা আগে আকস্মিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি চলে গেলেন।
হৃদরোগের চিকিৎসাশেষে মাহমুদুল হক মাত্র তিন-চারদিন আগে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছিলেন আপাত-সুস্থ হয়ে, নিজে পায়ে হাঁটতে সক্ষম অবস্থায়। কিন্তু জীবন কী অনিত্য!
আজকের অনেক পাঠকের কাছে মাহমুদুল হক খুব পরিচিত নন। বরাবর কম লিখতেন, ইদানিং প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন লেখালেখি। ষাটের দশকের এই দিশারী লেখকের কাছে আমরা জীবন আমার বোন, নিরাপদ তন্দ্রা-র মতো অসামান্য উপন্যাস পেয়েছি।
ভালো কোনো খবর আজকাল আর পাওয়া হয় না। কীভাবে যেন যাবতীয় দুঃসংবাদ আমার কাছে দ্রুত এসে পড়ে। ব্যক্তিগত পরিচয় মাহমুদুল হকের সঙ্গে আমার ছিলো না, তবু ব্যতিক্রম হলো না।
হৃদরোগের চিকিৎসাশেষে মাহমুদুল হক মাত্র তিন-চারদিন আগে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছিলেন আপাত-সুস্থ হয়ে, নিজে পায়ে হাঁটতে সক্ষম অবস্থায়। কিন্তু জীবন কী অনিত্য!
আজকের অনেক পাঠকের কাছে মাহমুদুল হক খুব পরিচিত নন। বরাবর কম লিখতেন, ইদানিং প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন লেখালেখি। ষাটের দশকের এই দিশারী লেখকের কাছে আমরা জীবন আমার বোন, নিরাপদ তন্দ্রা-র মতো অসামান্য উপন্যাস পেয়েছি।
ভালো কোনো খবর আজকাল আর পাওয়া হয় না। কীভাবে যেন যাবতীয় দুঃসংবাদ আমার কাছে দ্রুত এসে পড়ে। ব্যক্তিগত পরিচয় মাহমুদুল হকের সঙ্গে আমার ছিলো না, তবু ব্যতিক্রম হলো না।
----------------------------------
জুলাই ২০, ২০০৮। সন্ধ্যা ৭:২০
----------------------------------
Saturday, July 19, 2008
খালের এই পাড়ে খাড়াইয়া কই…
বছর চার-পাঁচেক আগে ডালাসে বাঙালিদের একটা অনুষ্ঠানে গেছি। বিরতির সময় অডিটরিয়ামের বাইরে সবাই চা-সিঙাড়া খাচ্ছে, গল্পগুজব করছে, ধূমপায়ীরা ভবনের বাইরে নির্ধারিত এলাকায়। আমি শেষের দলভুক্ত। একসময় খেয়াল করলাম, এক ভদ্রমহিলা বাংলাদেশে ছাপা একটা রসিদবই নিয়ে সবার কাছে যাচ্ছেন চাঁদা সংগ্রহ করতে। একটু কান পেতে বোঝা গেলো, চাঁদা তোলা হচ্ছে মহিলার গ্রামের বাড়িতে মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণের জন্যে। তাঁর বাড়ি কোথায় জানি না। হতে পারে বাংলাদেশের যে কোনো গ্রামে, কথা শুনে বোঝার উপায় নেই। আশ্চর্য লাগলো, বাংলাদেশের কোন প্রত্যন্ত গ্রামে মসজিদ-মাদ্রাসা হবে, তার জন্যে চাঁদা সংগ্রহ করা হচ্ছে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে।
যথাসময়ে মহিলা আমার কাছেও এলেন। তাঁকে স্পষ্ট করে জানাই, মাদ্রাসা-মসজিদের জন্যে চাঁদা আমি দিই না।
অনিচ্ছুক কারো কাছে ঠিক এই জবাব হয়তো তিনি পাননি। ফলে, তাঁর বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখ আমাকে বেশ কয়েক মুহূর্ত নিরীক্ষণ করে। অতঃপর আর কোনো কথা না বলে (মনে মনে সম্ভবত আমার দোজখবাস সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে) তিনি পরবর্তী কোনো ধর্মপ্রাণ দয়ালুর সন্ধানে যান।
কিন্তু বাংলাদেশে এই কথাগুলি ঠিক এইভাবে আমি বলতে পারতাম? নিজের ভেতর থেকে না-সূচক উত্তরই পাই। গত ২০ বছরে বাংলাদেশে মসজিদ-মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে যতো প্রকার গোঁড়ামি ও ধর্মোন্মাদনার বিস্তার ঘটেছে, তা একজন সুস্থ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্যে যথেষ্ট আতংকের। হুমায়ূন আজাদের পরিণতি আমাদের জানা আছে। তিনি নিজেও হয়তো আক্রান্ত হওয়ার আশংকা করতেন। তবু তাঁর স্পষ্টবাদিতা অক্ষুণ্ণ থেকেছে। স্বীকার করে নিই, তাঁকে নিয়ে মুগ্ধ হতে আমার কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু তাঁর অপরিমেয় সাহস ও স্পষ্টবাদিতার ছিঁটেফোঁটাও আমার মধ্যে দেখতে পাই না।
বরং যা দেখি, তা আমাকে বিচলিত করলেও অন্য কাউকে জানতে দিই না। বিপদ চোখের সামনে দেখি না, দেখতেও হয় না, বিপদের একটা সম্ভাবনা অনুমান করা গেলেই শামুকের মতো খোলসে লুকিয়ে থাকি।
তবে আমার সাহস কম, এরকম কথা মানবো কেন? আমি ধর্মীয় উন্মাদনার বিরুদ্ধে, যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে, দেশে জলপাই শাসনের বিরুদ্ধে কি কথা বলি না? নিশ্চয়ই বলি। একশোবার বলি। কীভাবে? না, ইন্টারনেটে। ব্লগ লিখে। তাতে কারো কিছু এসে-গেলো? না যাক, আমি বিপ্লব সম্পন্ন করার পরিতৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে যেতে পারি। আত্মশ্লাঘার বোধ আমাকে একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়। আমি বোধহয় একটা কিছু করেই ফেললাম। ইন্টারনেটের বিপ্লবী না আমি!
তখন আমার এই বোধ ঘুমন্ত থাকে যে, ঘোর বিপদের সম্ভাবনা মাথায নিয়ে, গর্দানহীন হওয়ার আশংকার মধ্যেও বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে অনেকে আজও কাজ করে যাচ্ছেন, ধর্মোন্মাদনা ও রাজাকারতন্ত্রের বিপক্ষে দাঁড়ানোর হিম্মত দেখাচ্ছেন। রাষ্ট্রক্ষমতার সামরিকায়নের বিপক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নিচ্ছেন। প্রকৃত সাহসী তাঁরাই, অভিবাদন তাঁদের প্রাপ্য।
কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে যোজন দূরে আয়েশী ভঙ্গিতে ল্যাপটপে আমার নেট-নির্ভর বিপ্লব সংঘটন অব্যাহত থাকে। যা খুশি বলতে পারি আমি। আমার লেখা কেউ সেন্সর করবে না। আমার কথায় ক্ষুব্ধ হলেও হাত-পায়ের রগ কাটতে কেউ আসবে না। জলপাই-রঙা ঊর্দি মাঝরাতে আমার বাড়ি ঘেরাও করবে না। আমি নির্ভয়। সুতরাং অকুতোভয়। বিপদের সব সম্ভাবনা থেকে বিস্তর দূরে।
একটা গল্প মনে পড়ছে। এক চাষীর বউ মহাদজ্জাল। তার দাপটে চাষী কোনো কথাই মুখ ফুটে বলতে সাহস পায় না। একদিন মাঠের কাজ সেরে ক্লান্ত চাষী ঘরে ফিরে খেতে বসেছে। আয়োজন সামান্য, সামান্য শাক আর ডাল। কিন্তু ডাল একেবারে বিস্বাদ, লবণ দেওয়া হয়নি। মেজাজ খারাপ হলেও বউকে কিছু বলার উপায় নেই। চুপচাপ খায় সে। রান্না কেমন হয়েছে, বউ জানতে চাইলেও সে চুপ করে থাকে। তাকে নিরুত্তর দেখে বউ যথারীতি মুখ ছোটায়, তাকে বোবা, বেআক্কেল ইত্যাদি বলতে থাকে। কোনোমতে খাওয়া শেষ করে চাষী বাড়ির পেছনের খালের ওপারে যায়। চিৎকার করে বলতে থাকে, কাউরে না ডরাইয়া কই, খালের এই পাড়ে খাড়াইয়া কই, ডাইলে তুই লবণ দ্যাস নাই, দ্যাস নাই, দ্যাস নাই…
যথাসময়ে মহিলা আমার কাছেও এলেন। তাঁকে স্পষ্ট করে জানাই, মাদ্রাসা-মসজিদের জন্যে চাঁদা আমি দিই না।
অনিচ্ছুক কারো কাছে ঠিক এই জবাব হয়তো তিনি পাননি। ফলে, তাঁর বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখ আমাকে বেশ কয়েক মুহূর্ত নিরীক্ষণ করে। অতঃপর আর কোনো কথা না বলে (মনে মনে সম্ভবত আমার দোজখবাস সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে) তিনি পরবর্তী কোনো ধর্মপ্রাণ দয়ালুর সন্ধানে যান।
কিন্তু বাংলাদেশে এই কথাগুলি ঠিক এইভাবে আমি বলতে পারতাম? নিজের ভেতর থেকে না-সূচক উত্তরই পাই। গত ২০ বছরে বাংলাদেশে মসজিদ-মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে যতো প্রকার গোঁড়ামি ও ধর্মোন্মাদনার বিস্তার ঘটেছে, তা একজন সুস্থ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্যে যথেষ্ট আতংকের। হুমায়ূন আজাদের পরিণতি আমাদের জানা আছে। তিনি নিজেও হয়তো আক্রান্ত হওয়ার আশংকা করতেন। তবু তাঁর স্পষ্টবাদিতা অক্ষুণ্ণ থেকেছে। স্বীকার করে নিই, তাঁকে নিয়ে মুগ্ধ হতে আমার কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু তাঁর অপরিমেয় সাহস ও স্পষ্টবাদিতার ছিঁটেফোঁটাও আমার মধ্যে দেখতে পাই না।
বরং যা দেখি, তা আমাকে বিচলিত করলেও অন্য কাউকে জানতে দিই না। বিপদ চোখের সামনে দেখি না, দেখতেও হয় না, বিপদের একটা সম্ভাবনা অনুমান করা গেলেই শামুকের মতো খোলসে লুকিয়ে থাকি।
তবে আমার সাহস কম, এরকম কথা মানবো কেন? আমি ধর্মীয় উন্মাদনার বিরুদ্ধে, যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে, দেশে জলপাই শাসনের বিরুদ্ধে কি কথা বলি না? নিশ্চয়ই বলি। একশোবার বলি। কীভাবে? না, ইন্টারনেটে। ব্লগ লিখে। তাতে কারো কিছু এসে-গেলো? না যাক, আমি বিপ্লব সম্পন্ন করার পরিতৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে যেতে পারি। আত্মশ্লাঘার বোধ আমাকে একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়। আমি বোধহয় একটা কিছু করেই ফেললাম। ইন্টারনেটের বিপ্লবী না আমি!
তখন আমার এই বোধ ঘুমন্ত থাকে যে, ঘোর বিপদের সম্ভাবনা মাথায নিয়ে, গর্দানহীন হওয়ার আশংকার মধ্যেও বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে অনেকে আজও কাজ করে যাচ্ছেন, ধর্মোন্মাদনা ও রাজাকারতন্ত্রের বিপক্ষে দাঁড়ানোর হিম্মত দেখাচ্ছেন। রাষ্ট্রক্ষমতার সামরিকায়নের বিপক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নিচ্ছেন। প্রকৃত সাহসী তাঁরাই, অভিবাদন তাঁদের প্রাপ্য।
কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে যোজন দূরে আয়েশী ভঙ্গিতে ল্যাপটপে আমার নেট-নির্ভর বিপ্লব সংঘটন অব্যাহত থাকে। যা খুশি বলতে পারি আমি। আমার লেখা কেউ সেন্সর করবে না। আমার কথায় ক্ষুব্ধ হলেও হাত-পায়ের রগ কাটতে কেউ আসবে না। জলপাই-রঙা ঊর্দি মাঝরাতে আমার বাড়ি ঘেরাও করবে না। আমি নির্ভয়। সুতরাং অকুতোভয়। বিপদের সব সম্ভাবনা থেকে বিস্তর দূরে।
একটা গল্প মনে পড়ছে। এক চাষীর বউ মহাদজ্জাল। তার দাপটে চাষী কোনো কথাই মুখ ফুটে বলতে সাহস পায় না। একদিন মাঠের কাজ সেরে ক্লান্ত চাষী ঘরে ফিরে খেতে বসেছে। আয়োজন সামান্য, সামান্য শাক আর ডাল। কিন্তু ডাল একেবারে বিস্বাদ, লবণ দেওয়া হয়নি। মেজাজ খারাপ হলেও বউকে কিছু বলার উপায় নেই। চুপচাপ খায় সে। রান্না কেমন হয়েছে, বউ জানতে চাইলেও সে চুপ করে থাকে। তাকে নিরুত্তর দেখে বউ যথারীতি মুখ ছোটায়, তাকে বোবা, বেআক্কেল ইত্যাদি বলতে থাকে। কোনোমতে খাওয়া শেষ করে চাষী বাড়ির পেছনের খালের ওপারে যায়। চিৎকার করে বলতে থাকে, কাউরে না ডরাইয়া কই, খালের এই পাড়ে খাড়াইয়া কই, ডাইলে তুই লবণ দ্যাস নাই, দ্যাস নাই, দ্যাস নাই…
Thursday, July 3, 2008
ওবামার ভ্রান্তি-বিভ্রান্তি
ওবামাকে এখন কি আর দেবদূতের মতো শোনাচ্ছে? গত দিন দুয়েক ধরে শুনছি, মার্কিন ধর্মীয় মোল্লাদের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করতে উঠে-পড়ে লেগেছেন তিনি। আমেরিকার আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ওবামা। রিপাবলিকানদের ধর্মভিত্তিক ভোটে ভাগ বসানোর জন্যে নাকি এটা তাঁর কৌশল। সেজন্যে এভানজেলিস্টদের সঙ্গে ওবামা সাক্ষাৎ করছেন, চার্চে চার্চে হাজিরা দিচ্ছেন। কয়্যারের সঙ্গে মাথা দোলাচ্ছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি আট বছর আগে – জুনিয়র বুশ নির্বাচিত হওয়ার পর। বুশ দ্বিতীয় দফা নির্বাচিত হলে এই ঔদাসীন্য রীতিমতো বৈরাগ্যে পরিণত হয়। ফলে, এবারের নির্বাচন বিষয়ে বিশেষ কান পাতিনি। টুকরো-টাকরা যা ছিটকে কানে আসে, তা মরমে পশে না। তবে ডেমোক্র্যাটদের শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা দুই প্রার্থী কিছু আগ্রহ তৈরি করার কারণ ঘটিয়েছিলেন। হিলারি ক্লিনটন বা বারাক ওবামা – এই দু’জনের যে কোনো একজন প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেলেই আমেরিকায় একটা ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে যাবে। আমেরিকার ইতিহাসে এর আগে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ বা নারী কখনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মনোনয়ন পাননি, এতোটাই পুরুষশাসিত ও বর্ণবিদ্বেষী এদের ইতিহাস।
ওবামার ডেমোক্র্যাট দলের মনোনয়ন নিশ্চিত হলে সমর্থকরা উল্লসিত হয়। ওবামা সত্যি সত্যি নতুন কিছু করবেন বলে তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে। এই প্রার্থী তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতার গুণে আমেরিকাকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হন যে তিনি পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
তাঁর সাম্প্রতিক মোল্লা-ভজানো কথাবার্তা শুনে অনেকে এখন বিস্মিত ও অপ্রস্তুত। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই হতাশ। মার্কিন দেশে মোল্লাদের ঠিকানা রিপাবলিকান শিবির, ডেমোক্র্যাটরা কখনো তাদের আস্থা পায় না, তারা নিজেরাও মোল্লাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে গা করেনি। ডেমোক্র্যাটরা তাদের উদারপন্থা নিয়ে সন্তুষ্ট ও গর্বিত ছিলো, যদিও এ দেশে লিবারেল হওয়া এক ধরনের যন্ত্রণাবিশেষ। ওবামা উদারপন্থীদের সেই অহংকারের জায়গাটুকুও বিসর্জন দিতে প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে। বারাক হুসেন ওবামা যে মুসলমান নন, বরং একজন নিবেদিত খ্রীষ্ট ধর্মানুসারী – তা প্রমাণ করার জন্যে মনে হয় রিপাবলিকানদের চেয়ে বড়ো রিপাবলিকান হতেও তিনি সম্মত।
শুধু নির্বাচনী কৌশল হলেও পরিণামে এটা উদারপন্থীদের জন্যে ক্ষতির কারণ ঘটাবে বলে অনায়াসে অনুমান করা চলে। পৃথিবী জুড়ে আর কতো মার খাবে উদারপন্থীরা? দম বন্ধ হয়ে আসছে যে!
Subscribe to:
Posts (Atom)