Monday, November 12, 2007
প্রলয়ের একরাত্রি : ‘ঘুমো বাছা ঘুমো রে / সাগর দিলো চুমো রে...’
১৯৭০ সাল। আর মাসখানেক পর পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন। ৪৭-এ পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ২৩ বছরে এই দ্বিতীয়বার। আগের বছর প্রবল গণঅভ্যুত্থানে লৌহমানব বলে কথিত আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের জগদ্দল ভেসে গেছে খড়কুটোর মতো। এই বিজয়ের জন্যে মূল্য অবশ্য কম দিতে হয়নি পূর্ব বাংলাকে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর নির্দয় প্রহার, টিয়ারগ্যাস, গুলি সবই বিপুল পরিমাণে জুটেছিলো। এর প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে এই নির্বাচন। স্পষ্ট মনে আছে, আসন্ন এই নির্বাচনটিকে অনেকে বাঙালির অস্তিত্বের প্রশ্ন হিসেবে নিয়েছিলেন। তাদের দূরদর্শিতা প্রমাণিত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। তা অন্য প্রসঙ্গ।
এই নির্বাচনকে সামনে রেখে এবং উপলক্ষ করে যখন সারা দেশ জেগে উঠেছে, তখন এসেছিলো এক মরণ ছোবল। এই ভূখণ্ডের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রায় সমগ্র সমুদ্র-উপকূলে হারিকেন ও প্রবল সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে মাত্র এক রাতে কয়েক লক্ষ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ঘরবাড়ি, গবাদি পশু কিছুই রক্ষা পায়নি। তারিখ ১২ নভেম্বর। ঘটনার ভয়াবহতা প্রকাশিত হতেও সময় লেগেছিলো। যখন জানা গেলো যে মৃত মানুষের সংখ্যা বারো লক্ষ (মতান্তরে দশ লক্ষ), তখন পৃথিবী থমকে যাওয়ার অনুভূতি হওয়াই স্বাভাবিক।
প্রকৃতির আঘাত যখন আচমকা আসে তখন মানুষ সত্যিই অসহায়। কিছু সতর্কতা হয়তো সম্ভব, তাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিছু কমে। কিন্তু ১২ নভেম্বরের ওই দুর্যোগের আভাস খুব সামান্যই জানা গিয়েছিলো। পরে প্রকাশিত হলো এই অবিশ্বাস্য তথ্য যে এই ঝড় সম্পর্কে তথ্য থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার তা আমলে নেয়নি, যথাসময়ে সতর্কতাও আসেনি। ঝড়ের পূর্বাভাস ছিলো, তার ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছুমাত্র আভাসও ছিলো না। ফলে এই অঞ্চলের মানুষ যারা এইসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে বেচে থাকে তারা এই পূর্বাভাস নিয়ে আলাদা করে মাথা ঘামায়নি। অনিবার্য ফল হিসেবে কয়েক লক্ষ মানুষ নেই হয়ে গেলো একরাত্রির ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে। এই সেদিনের হারিকেন কাটরিনার তুলনায় সে দুর্যোগ কিছুমাত্র খাটো ছিলো না।
এই বিপুল প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরেও পাকিস্তানী শাসকদের তৎপরতা খুব বেশি দৃশ্যমান হয়নি, তা ত্রাণে, না সহানুভূতিতে। আরো একবার বোঝা গিয়েছিলো পূর্ব বাংলা ঠিক পাকিস্তান নয়।
আমাদের বাড়িতে তখন দৈনিক পূর্বদেশ রাখা হতো। এই কাগজটি এই দুর্যোগের অসাধারণ কাভারেজ করেছিলো মনে আছে। বিশাল ব্যানার হেডিং করেছিলো : ‘কাঁদো বাংলার মানুষ কাঁদো’ এবং সেদিন কাগজের প্রথম পাতার মাস্টহেড নামিয়ে দেয় একেবারে তলায়। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে এই ঘটনা আমার জানামতে ওই একবারই ঘটেছিলো।
তখন কেন্দ্রীয় সরকারে ছয়জন বাঙালি মন্ত্রী ছিলেন। একদিন প্রথম পাতায় পাশাপাশি তাঁদের ছোটো ছবি ছাপা হলো, তার নিচে জনসভায় বক্তৃতারত ভাসানীর বিশাল ছবি, তাঁর উদ্যত তর্জনী ওই ছবিগুলোকে নির্দেশ করছে। সঙ্গে হেডিং : ‘ওরা কেউ আসেনি’।
মনে পড়ে গেলো এইসব কথা। আসলে ভোলা তো হয় না। এই কাগজগুলি আমাদের বাড়িতে এখনো সযত্নে রক্ষিত আছে। হাজার হাজার মাইলের ব্যবধানে না থাকলে এগুলি স্ক্যান করে তুলে দেওয়া যেতো। তা তো আর হওয়ার নয়, পরবাস যাপনের মাশুল।
পূর্বদেশ-এ দিনের পর দিন ওই দুর্যোগে নিহত মানুষের, গবাদি পশুর পড়ে থাকা লাশের ছবি ছাপা হয়েছে। একদা কোলাহলময়, এখন বিরান সব জনপদের ছবি দেখে মন ভারি হয়ে ওঠে। একদিন এরকম কিছু ছবির সঙ্গে রফিকুল হক লিখলেন একটি অবিস্মরণীয় ছড়া :
ছেলে ঘুমলো বুড়ো ঘুমলো ভোলাদ্বীপের চরে
জেগে থাকা মানুষগুলো মাতম শুধু করে
ঘুমো বাছা ঘুমো রে
সাগর দিলো চুমো রে
খিদে ফুরোলো জ্বালা জুড়লো কান্না কেন ছি
বাংলাদেশের মানুষ বুকে পাষাণ বেঁধেছি।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment