গত বছর ছেলেমেয়েদের গ্রীষ্মের ছুটিতে নিউ ইয়র্ক গিয়েছিলাম। এর আগেরবার নিউ ইয়র্ক যাওয়া হয়েছিলো ২০০০-এ। তখন পুত্রের বয়স তিন হয়নি, ফলে সেই সফরের কিছুই তার মনে নেই। এবারের যাওয়া মূলত তারই আগ্রহ ও উৎসাহে।
একদিন দুই বাপ-ব্যাটা রওনা হয়েছি বিখ্যাত মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি দেখতে। ডাইনোসর বিষয়ে তার আগ্রহ সেই আধো আধো বোলের বয়স থেকে, ক্রমে বিবিধ প্রকারের ডাইনোসর সংক্রান্ত তথ্যের চলমান ভাণ্ডার হয়ে ওঠে সে। এই মিউজিয়ামে অনেক ডাইনোসর-কংকাল আছে সে জেনেছে। সুতরাং সেখানে যাওয়া তো আবশ্যক।
ছেলেকে নিয়ে সাবওয়েতে। নিউ ইয়র্কের রাস্তাঘাট চিনি না, সাবওয়ে সম্পর্কে ততোধিক অজ্ঞ। আমরা যে শহরে বাস করি, সেখানে সীমিত দূরত্বে কিছু ট্রেন চলাচল সবে শুরু হয়েছে। কোন ট্রেনে উঠতে হবে, কোথায় ট্রেন বদল করতে হবে, কোথায় যাত্রা শেষ করতে হবে এইসব তথ্য লেখা কাগজ পকেটে।
নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে ভূগর্ভে, ফলে ট্রেন চলাকালে বাইরে তাকিয়ে অন্ধকার টানেল ছাড়া কিছু দেখার নেই। পুত্রের বিবিধ কৌতূহল, সে বিষয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব চলছে। এইসব আমাদের হয় নিত্যদিন। ভাবি, আমাদের বাবাদের আমরা এতো প্রশ্ন করতে পারতাম না। ওই বয়সে পিতা সম্পর্কে ভালোবাসার চেয়ে সমীহ বা ভয়ের অনুভূতিই বেশি ছিলো মনে আছে।
ছেলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আচমকা অনেককাল আগের একটি কথা মনে পড়ে যায়। আমি আমার পিতার সঙ্গে ট্রেনে করে যশোর যাচ্ছি। আমার বয়সও তখন দশ হয়েছে কি হয়নি। সেই যাওয়ার উপলক্ষ কী ছিলো, কেন শুধু আমরা দুই পিতাপুত্র যাচ্ছি সেসব কিছুই মনে পড়ে না। সেই ভ্রমণটি আমার স্পষ্ট স্মরণে আছে।
বগুড়া থেকে শান্তাহার জংশন। সেখানে ট্রেন বদলে ব্রডগেজ রেলে ওঠা। ব্রডগেজে এই আমার প্রথম নয়। দাদার বাড়ি জয়পুরহাট যেতে হলেও শান্তাহারে ট্রেন বদলে ব্রডগেজ ট্রেনে উঠতে হয়। তখন বগুড়ার সঙ্গে জয়পুরহাটের নামমাত্র সড়কপথ থাকলেও তা ছিলো অতিশয় দুর্গম এবং বাস সার্ভিস বলে কিছু ছিলো না।
শান্তাহার থেকে জয়পুরহাট মাত্র পাঁচটি স্টেশনের দূরত্ব। এবারে আমরা যাচ্ছি জয়পুরহাটের উল্টোদিকে এবং দূরত্বও অনেক অনেক বেশি।ব্রডগেজে দীর্ঘযাত্রায় ট্রেনের দুলুনি খূব বেশি করে টের পাওয়া যায়। দুলুনিতে শুধু বালক কেন, বয়স্কদেরও ঘুম পেয়ে যায়। মাঝেমধ্যে ঘুম ভাঙিয়ে বাবা আমাকে দর্শনীয়গুলো দেখান। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, রাজশাহীর বিখ্যাত চলনবিলের বিশাল বিস্তার। নাটোরে বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা খাওয়া হলো। আবার ঘুম ভাঙলো বাবার ডাকে। চৌকোনা এক ধরনের মিষ্টি কোনো স্টেশন থেকে কিনেছেন, আমাকে খাওয়াবেন।
ঘুমচোখে বাইরে তাকাই। জানালার পাশে বসেছি বলে বাইরে মুখ বাড়ালে বাতাসের তীব্র ঝাপটা মুখে লাগে। হাত প্রসারিত করে দিলে বাতাসের তোড়ে হাতটা খুলে যাবে মনে হয়। মিষ্টি মুখে দিয়ে বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখি বেশ বড়ো একটা বাঁক নিচ্ছে ট্রেন। আমি পেছনের সবগুলো বগি দেখতে পাচ্ছি। রোদ পড়ে ট্রেনের ধাতব শরীর চকচক করে। ট্রেনের গতির প্রতিক্রিয়ায় রেললাইনের পাশে ধুলোর ছোটো ছোটো ঘূর্ণি। বালক বিস্ময়-বিহ্বল চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তখন সে জানে না, এই দৃশ্য তার সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবে। চোখ বুজলে এই ছবি অবিকল দেখবে সে বারংবার।
নিউ ইয়র্কের চলন্ত সাবওয়েতে বসে পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, অনেক অনেক বছর পর, যখন বাবা আর কোথাও নেই, এই ট্রেনযাত্রা কি তার মনে পড়বে? যেমন আমার পড়লো?
Tuesday, July 31, 2007
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment