জানুয়ারির দশ, ঊনিশশো বাহাত্তর। থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে শীতকালের ওই দিনে বাংলাদেশের সমস্ত মানুষ তাকিয়ে ছিলো আকাশের দিকে। একবুক ভরা দুরু দুরু তাদের আশা। আনন্দ-অহংকার- শোক-বিষাদ মিলিয়ে বাংলাদেশে সে এক আশ্চর্য সময়।
মাত্র পঁচিশ দিন আগে শেষ হওয়া যুদ্ধে বিজয়-উল্লাসের সঙ্গে মিলেমিশে আছে ক্রমশ-প্রকাশমান হৃদয়বিদারক নিষ্ঠুর গণহত্যা ও স্বজন হারানোর কাহিনী, নির্যাতিত নারীদের নির্মম স্তব্ধতা। এমন একটি পরিবার সেদিনের বাংলাদেশে ছিলো না যেখানে এইসব বিষাদ-বিষণ্নতার গল্প নেই।
নয় মাসের যুদ্ধে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত একটি নতুন দেশ। কিন্তু তারপরেও আমরা সেদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, কারণ ওই আকাশপথেই আসবেন পরম নিকট অথচ স্বপ্নের একজন মানুষ। তিনিই পারেন কোটি কোটি বাঙালির শোক ও ক্ষতের উপশম ঘটাতে। সবাই জানে, তিনি ফিরে এলে সব হবে। এই দেশ সোনার দেশ হবে, তিনি বলেছেন। রক্তমাংসের মানুষ হয়েও তিনি সেদিন কিংবদন্তীর সমতুল্য। মানুষটির নাম শেখ মুজিবুর রহমান। ওই দিনের আগে দশটি মাস বাংলাদেশের এমন কোনো ঘর ছিলো না যেখানে তাঁর জন্যে প্রার্থনার হাত ওঠেনি। প্রার্থনা ছিলো, ফিরে এসো তুমি আমাদের স্বপ্নপূরণের দূত হয়ে।
হায়, দুঃখ এই যে মানুষের প্রার্থনা চিরদিন শুধু প্রার্থনা হয়েই থেকে যায়। পাওয়া হয় না। সেই মহাপুরুষপ্রতীম মানুষটি শেষ পর্যন্ত রক্তমাংসের আরেকজন সাধারণ মানুষে পরিণত হয়ে গিয়েছিলন কতো অল্প সময়ের মধ্যে! যে ভালোবাসা, আস্থা ও বিশ্বাস মানুষ অর্পণ করেছিলো তাঁকে সর্বান্তঃকরণে, কী নিদারুণভাবে ব্যর্থ হলেন নিজেকে তার যোগ্য প্রমাণ করতে! তাঁকে সামান্যতম অসম্মান না করে বা তাঁর অসাধারণ সাফল্যকে মনে রেখেও বলতেই হবে, শেষ পর্যন্ত তিনি একজন ব্যর্থ শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করেছিলেন। মানুষকে অসম্ভব ভালোবাসতেন তিনি, সকলকে বিশ্বাস করতেন সর্বান্তঃকরণে, মানুষের মঙ্গলচিন্তায় একাগ্র ছিলেন, তাদের দুঃখকষ্টে কাতর হওয়ার গুণও তাঁর ছিলো।
কিন্তু এইসব মানবিক গুণ সফল শাসক হওয়ার প্রতিবন্ধক, তা তিনি জানেননি। কেবলই পিছুটান ও বোঝা হয়ে ওঠে তাঁর বিশাল মমতাময় হৃদয়টি। সফল শাসকদের কিছুটা অনুভূতিনিরপেক্ষ হতে হয়, আবেগ ও যুক্তির ভারসাম্য রচনা করতে হয়। অথচ সেখানেই তিনি বড়ো বেশি মানুষ ছিলেন, মানবিক ছিলেন। ফলে, শেষ বিচারে তিনি দেশের কাণ্ডারী হয়েও থেকে গেলেন শুধুই একজন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে, স্বপ্নপূরণের কোনো কৌশলই যাঁর জানা নেই।
ব্যর্থতার অনেক কারণ যুক্তি হিসেবে আনা যাবে _ পারিপাশ্বর্িকতা, জগৎ-রাজনীতি, ক্ষমতাবান বিশ্বের কূটতৎপরতা - এসবই সত্যি। কিন্তু তাতে ভুল ও ব্যর্থতার চিহ্নগুলি মুছে যাবে না। বিজয়ীকেই মানুষ বীরের সম্মান দিয়ে থাকে, পরাজিতকে নয়। সেরা খেলোয়াড়টি খেলেনি বলে আমার প্রিয় দল পরাজিত হয়েছে - এই যুক্তি ভক্তের সান্ত্বনা হতে পারে, ফলাফল তাতে পরিবর্তিত হয় না। পাঁচ-দশ বা পঞ্চাশ বছর পরে ফলাফলটিই শিরোনামে থেকে যায়, পরাজয়ের কারণ সেখানে গৌণ।
শেখ মুজিব তাঁর যুদ্ধের প্রথম অর্ধেকটা জিতেছিলেন প্রবল পরাক্রমে। তাঁর সাহস, দেশপ্রেম, সুবিবেচনা, মানুষকে সংগঠিত করার প্রায় অলৌকিক ক্ষমতা, নিয়মতান্ত্রিকতার গণ্ডিতে থেকেও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অনিবার্য করে তোলার কৃতিত্ব - এইসব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার সুযোগ নেই। করলে তা শুধুই কুতর্ক এবং দুঃখের কথা, এরকম কুতর্ক করার মতো মানুষের অভাব বাংলাদেশে আজও নেই।
অকালপ্রয়াত আহমদ ছফা শেখ মুজিবের রাজনীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন, কিন্তু যুক্তিবাদী বলেই তাঁর পক্ষে বলা সম্ভব হয়েছিলো : "বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান এ দুটো যমজ শব্দ, একটা আরেকটার পরিপূরক এবং দুটো মিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বল এক অচিন্তিত-পূর্ব কালান্তরের সূচনা করেছে। ... বস্তুত বাঙালী জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য গীতাঞ্জলি নয়, বলাকা নয়, সোনার তরী নয়, 'আর দাবায়ে রাখবার পারবা না।' ... শেখ মুজিবুর রহমান এই জাতির মহান স্থপতি এবং একজন মহান পুরুষ। সমস্ত দোষত্রুটি, রাজনৈতিক প্রমাদ এবং সীমাবদ্ধতাসহ বিচার করলেও তিনি অনন্য। শেখ মুজিবুর রহমানের তুলনা স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান।" বাংলাদেশের স্বাধীনতায় শেখ মুজিবের ভূমিকা অস্বীকার করা মানুষদের সম্পর্কে ছফা তীব্র ও স্পষ্ট ভাষায় লিখেছিলেন : "বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অভিযাত্রার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক না থাকার যে লজ্জা, যে গ্লানি, সেটুকু ঢাকার অপকৌশল হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে তারা অক্ষম।"
কিন্তু শেষ পর্বে শেখ মুজিবের অসহায় পরাজয় ও ব্যর্থতা করুণ এবং অবীরোচিত। আজ তাঁকে নিয়ে যে বিতর্ক, বিক্ষোভ, কিছু বিদ্বেষ - তার কারণগুলিও যে অংশত তাঁর নিজেরই তৈরি তা-ও অস্বীকার করা চলে না।
সাহস ও বীরত্বের জন্যে মহাপুরুষের সম্মান তাঁর প্রাপ্য। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করার ঘটনা পৃথিবীতে প্রতিদিন ঘটে না, সেই অতি বিরল কৃতিত্ব তিনি অর্জন করেছিলেন। বাঙালির যুগ-যুগান্তরের অবদমিত স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাটিকে তিনি বাস্তব করে তুলেছিলেন আপন যোগ্যতার বলে। অথচ বাংলাদেশের মাটি, মানুষ ও তাদের হৃদয়ের নিঃশর্ত আস্থা পেয়েও অনেকটা যেন খেলাচ্ছলেই উদাসীন রাজার মতো সব হারিয়ে ফেললেন।
বাহাত্তরের জানুয়ারিতে তাঁর অঙ্গুলিহেলনে কী না হতে পারতো এই দেশে। তাঁর মুখের কথায় গণআত্মাহুতি দেওয়ার জন্যে কয়েক লক্ষ মানুষ পাওয়া তখন অসম্ভব ছিলো না। সেই সময়টিকে যাঁরা দেখেননি, তাঁদের পক্ষে এটি অনুমান করাও অতি দুরূহ। তবু তিনি ব্যর্থ হলেন। ক্রমাগত ভুল সিদ্ধান্ত নিতে লাগলেন, পিছু হটতে বাধ্য হলেন। মিত্রদের থেকে একে একে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘেরাও হয়ে থাকলেন পরীক্ষিত অবিশ্বস্তদের মধ্যে। তাঁর অসময়োচিত ও নৃশংস মৃত্যু এক অর্থে আত্মহত্যারই শামিল, তিনি নিজেই তা অনিবার্য করে তুলেছিলেন বলে মনে হয়।
বাহাত্তরের জানুয়ারির দশ তারিখেই সম্ভবত এ দেশের মানুষের সর্ববৃহৎ আশাভঙ্গের বীজটি রোপিত হয়েছিলো। ওই দিনের মতো এমন তীব্র একাগ্রতা নিয়ে বাঙালি আর কোনোদিন কারো কাছে কিছুর আশা করেনি। শেখ মুজিবের মতো একজন মানুষ আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে বাঙালির ইতিহাস গৌরব করতে পারে। আহমদ ছফা লিখছেন : "আজ থেকে অনেকদিন পরে হয়তো কোনো পিতা তাঁর শিশুপুত্রকে বলবেন জানো, খোকা, আমাদের দেশে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিলেন যাঁর দৃঢ়তা ছিল, তেজ ছিল আর ছিল অসংখ্য দুর্বলতা। কিন্তু মানুষটির হৃদয় ছিল, ভালবাসতে জানতেন। দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিকচিক করে জ্বলে তা হলো মানুষটির সাহস। আর জ্যোৎস্নারাতে রূপালী কিরণধারায় মায়ের স্নেহের মত যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি ও নিশ্চয়তার বোধ জাগিয়ে তোলে তা হলো তাঁর ভালবাসা। জানো খোকা তাঁর নাম? শেখ মুজিবুর রহমান।"
Tuesday, July 31, 2007
অনেককালের পুরনো একটি দিন ফিরে এলো
গত বছর ছেলেমেয়েদের গ্রীষ্মের ছুটিতে নিউ ইয়র্ক গিয়েছিলাম। এর আগেরবার নিউ ইয়র্ক যাওয়া হয়েছিলো ২০০০-এ। তখন পুত্রের বয়স তিন হয়নি, ফলে সেই সফরের কিছুই তার মনে নেই। এবারের যাওয়া মূলত তারই আগ্রহ ও উৎসাহে।
একদিন দুই বাপ-ব্যাটা রওনা হয়েছি বিখ্যাত মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি দেখতে। ডাইনোসর বিষয়ে তার আগ্রহ সেই আধো আধো বোলের বয়স থেকে, ক্রমে বিবিধ প্রকারের ডাইনোসর সংক্রান্ত তথ্যের চলমান ভাণ্ডার হয়ে ওঠে সে। এই মিউজিয়ামে অনেক ডাইনোসর-কংকাল আছে সে জেনেছে। সুতরাং সেখানে যাওয়া তো আবশ্যক।
ছেলেকে নিয়ে সাবওয়েতে। নিউ ইয়র্কের রাস্তাঘাট চিনি না, সাবওয়ে সম্পর্কে ততোধিক অজ্ঞ। আমরা যে শহরে বাস করি, সেখানে সীমিত দূরত্বে কিছু ট্রেন চলাচল সবে শুরু হয়েছে। কোন ট্রেনে উঠতে হবে, কোথায় ট্রেন বদল করতে হবে, কোথায় যাত্রা শেষ করতে হবে এইসব তথ্য লেখা কাগজ পকেটে।
নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে ভূগর্ভে, ফলে ট্রেন চলাকালে বাইরে তাকিয়ে অন্ধকার টানেল ছাড়া কিছু দেখার নেই। পুত্রের বিবিধ কৌতূহল, সে বিষয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব চলছে। এইসব আমাদের হয় নিত্যদিন। ভাবি, আমাদের বাবাদের আমরা এতো প্রশ্ন করতে পারতাম না। ওই বয়সে পিতা সম্পর্কে ভালোবাসার চেয়ে সমীহ বা ভয়ের অনুভূতিই বেশি ছিলো মনে আছে।
ছেলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আচমকা অনেককাল আগের একটি কথা মনে পড়ে যায়। আমি আমার পিতার সঙ্গে ট্রেনে করে যশোর যাচ্ছি। আমার বয়সও তখন দশ হয়েছে কি হয়নি। সেই যাওয়ার উপলক্ষ কী ছিলো, কেন শুধু আমরা দুই পিতাপুত্র যাচ্ছি সেসব কিছুই মনে পড়ে না। সেই ভ্রমণটি আমার স্পষ্ট স্মরণে আছে।
বগুড়া থেকে শান্তাহার জংশন। সেখানে ট্রেন বদলে ব্রডগেজ রেলে ওঠা। ব্রডগেজে এই আমার প্রথম নয়। দাদার বাড়ি জয়পুরহাট যেতে হলেও শান্তাহারে ট্রেন বদলে ব্রডগেজ ট্রেনে উঠতে হয়। তখন বগুড়ার সঙ্গে জয়পুরহাটের নামমাত্র সড়কপথ থাকলেও তা ছিলো অতিশয় দুর্গম এবং বাস সার্ভিস বলে কিছু ছিলো না।
শান্তাহার থেকে জয়পুরহাট মাত্র পাঁচটি স্টেশনের দূরত্ব। এবারে আমরা যাচ্ছি জয়পুরহাটের উল্টোদিকে এবং দূরত্বও অনেক অনেক বেশি।ব্রডগেজে দীর্ঘযাত্রায় ট্রেনের দুলুনি খূব বেশি করে টের পাওয়া যায়। দুলুনিতে শুধু বালক কেন, বয়স্কদেরও ঘুম পেয়ে যায়। মাঝেমধ্যে ঘুম ভাঙিয়ে বাবা আমাকে দর্শনীয়গুলো দেখান। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, রাজশাহীর বিখ্যাত চলনবিলের বিশাল বিস্তার। নাটোরে বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা খাওয়া হলো। আবার ঘুম ভাঙলো বাবার ডাকে। চৌকোনা এক ধরনের মিষ্টি কোনো স্টেশন থেকে কিনেছেন, আমাকে খাওয়াবেন।
ঘুমচোখে বাইরে তাকাই। জানালার পাশে বসেছি বলে বাইরে মুখ বাড়ালে বাতাসের তীব্র ঝাপটা মুখে লাগে। হাত প্রসারিত করে দিলে বাতাসের তোড়ে হাতটা খুলে যাবে মনে হয়। মিষ্টি মুখে দিয়ে বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখি বেশ বড়ো একটা বাঁক নিচ্ছে ট্রেন। আমি পেছনের সবগুলো বগি দেখতে পাচ্ছি। রোদ পড়ে ট্রেনের ধাতব শরীর চকচক করে। ট্রেনের গতির প্রতিক্রিয়ায় রেললাইনের পাশে ধুলোর ছোটো ছোটো ঘূর্ণি। বালক বিস্ময়-বিহ্বল চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তখন সে জানে না, এই দৃশ্য তার সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবে। চোখ বুজলে এই ছবি অবিকল দেখবে সে বারংবার।
নিউ ইয়র্কের চলন্ত সাবওয়েতে বসে পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, অনেক অনেক বছর পর, যখন বাবা আর কোথাও নেই, এই ট্রেনযাত্রা কি তার মনে পড়বে? যেমন আমার পড়লো?
একদিন দুই বাপ-ব্যাটা রওনা হয়েছি বিখ্যাত মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি দেখতে। ডাইনোসর বিষয়ে তার আগ্রহ সেই আধো আধো বোলের বয়স থেকে, ক্রমে বিবিধ প্রকারের ডাইনোসর সংক্রান্ত তথ্যের চলমান ভাণ্ডার হয়ে ওঠে সে। এই মিউজিয়ামে অনেক ডাইনোসর-কংকাল আছে সে জেনেছে। সুতরাং সেখানে যাওয়া তো আবশ্যক।
ছেলেকে নিয়ে সাবওয়েতে। নিউ ইয়র্কের রাস্তাঘাট চিনি না, সাবওয়ে সম্পর্কে ততোধিক অজ্ঞ। আমরা যে শহরে বাস করি, সেখানে সীমিত দূরত্বে কিছু ট্রেন চলাচল সবে শুরু হয়েছে। কোন ট্রেনে উঠতে হবে, কোথায় ট্রেন বদল করতে হবে, কোথায় যাত্রা শেষ করতে হবে এইসব তথ্য লেখা কাগজ পকেটে।
নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে ভূগর্ভে, ফলে ট্রেন চলাকালে বাইরে তাকিয়ে অন্ধকার টানেল ছাড়া কিছু দেখার নেই। পুত্রের বিবিধ কৌতূহল, সে বিষয়ে প্রশ্নোত্তর পর্ব চলছে। এইসব আমাদের হয় নিত্যদিন। ভাবি, আমাদের বাবাদের আমরা এতো প্রশ্ন করতে পারতাম না। ওই বয়সে পিতা সম্পর্কে ভালোবাসার চেয়ে সমীহ বা ভয়ের অনুভূতিই বেশি ছিলো মনে আছে।
ছেলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আচমকা অনেককাল আগের একটি কথা মনে পড়ে যায়। আমি আমার পিতার সঙ্গে ট্রেনে করে যশোর যাচ্ছি। আমার বয়সও তখন দশ হয়েছে কি হয়নি। সেই যাওয়ার উপলক্ষ কী ছিলো, কেন শুধু আমরা দুই পিতাপুত্র যাচ্ছি সেসব কিছুই মনে পড়ে না। সেই ভ্রমণটি আমার স্পষ্ট স্মরণে আছে।
বগুড়া থেকে শান্তাহার জংশন। সেখানে ট্রেন বদলে ব্রডগেজ রেলে ওঠা। ব্রডগেজে এই আমার প্রথম নয়। দাদার বাড়ি জয়পুরহাট যেতে হলেও শান্তাহারে ট্রেন বদলে ব্রডগেজ ট্রেনে উঠতে হয়। তখন বগুড়ার সঙ্গে জয়পুরহাটের নামমাত্র সড়কপথ থাকলেও তা ছিলো অতিশয় দুর্গম এবং বাস সার্ভিস বলে কিছু ছিলো না।
শান্তাহার থেকে জয়পুরহাট মাত্র পাঁচটি স্টেশনের দূরত্ব। এবারে আমরা যাচ্ছি জয়পুরহাটের উল্টোদিকে এবং দূরত্বও অনেক অনেক বেশি।ব্রডগেজে দীর্ঘযাত্রায় ট্রেনের দুলুনি খূব বেশি করে টের পাওয়া যায়। দুলুনিতে শুধু বালক কেন, বয়স্কদেরও ঘুম পেয়ে যায়। মাঝেমধ্যে ঘুম ভাঙিয়ে বাবা আমাকে দর্শনীয়গুলো দেখান। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, রাজশাহীর বিখ্যাত চলনবিলের বিশাল বিস্তার। নাটোরে বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা খাওয়া হলো। আবার ঘুম ভাঙলো বাবার ডাকে। চৌকোনা এক ধরনের মিষ্টি কোনো স্টেশন থেকে কিনেছেন, আমাকে খাওয়াবেন।
ঘুমচোখে বাইরে তাকাই। জানালার পাশে বসেছি বলে বাইরে মুখ বাড়ালে বাতাসের তীব্র ঝাপটা মুখে লাগে। হাত প্রসারিত করে দিলে বাতাসের তোড়ে হাতটা খুলে যাবে মনে হয়। মিষ্টি মুখে দিয়ে বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখি বেশ বড়ো একটা বাঁক নিচ্ছে ট্রেন। আমি পেছনের সবগুলো বগি দেখতে পাচ্ছি। রোদ পড়ে ট্রেনের ধাতব শরীর চকচক করে। ট্রেনের গতির প্রতিক্রিয়ায় রেললাইনের পাশে ধুলোর ছোটো ছোটো ঘূর্ণি। বালক বিস্ময়-বিহ্বল চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তখন সে জানে না, এই দৃশ্য তার সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে থাকবে। চোখ বুজলে এই ছবি অবিকল দেখবে সে বারংবার।
নিউ ইয়র্কের চলন্ত সাবওয়েতে বসে পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, অনেক অনেক বছর পর, যখন বাবা আর কোথাও নেই, এই ট্রেনযাত্রা কি তার মনে পড়বে? যেমন আমার পড়লো?
Subscribe to:
Posts (Atom)