কাল তিন তিনবার ভুল রাস্তায় চলে গেলাম। আক্ষরিক অর্থেই ‘এ পথে আমি যে গেছি বারবার’ বলার মতো দুশো মাইলের পথ। ইন্টারস্টেট-৩৫ ধরে সরাসরি ড্রাইভ, কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই। তবে হাইওয়ে মাঝেমধ্যে বিভক্ত হয়ে যায় অন্য নানা ঠিকানার দিকে। ভুল হলে অন্য শহরে পৌঁছে যাওয়া, নিদেনপক্ষে একটা চক্কর খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। ডালাস থেকে অস্টিন গিয়েছি, তখন সব ঠিকঠাক। ফেরার পথে ভুল রাস্তায় গিয়ে গোলমাল, চক্কর খেতে হলো।
মেয়েটা বড়ো হয়েই গেলো, চলে যাবে পড়তে অস্টিনে। জুন মাসের মাঝামাঝি খবর জানার পর মনে হলো, দুই মাস সময় এখনো আছে । অথচ কোথা দিয়ে কীভাবে সময়টা চলে গেলো! এই দুই মাসে আমরা অনেক কথা বলবো; জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ’ কনসার্টের ডিভিডি এবং হ্যারিসনের মৃত্যুর পর তাঁর বন্ধুদের আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর জর্জ’-এর ডিভিডি কিনে রাখা আছে দীর্ঘদিন, এখনো সেলোফেন-আবৃত, কথা ছিলো একসঙ্গে বসে দেখবো। সময়গুলি কোথায় গেলো?
পরশু আমাদের চারজনের পরিবার গেলাম অস্টিনে। গতকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মেয়ের পরিচয়-পর্ব (orientation) হলো। ক্লাস শুরু হতে এক সপ্তাহ দেরি, কিন্তু আবার তাকে নিয়ে অস্টিনে আসতে হবে শনিবার, তিনদিন পর। নতুন শহরে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে সে উঠবে সেদিন, গোছগাছ করে ক্লাসের জন্যে তৈরি হওয়ার সময় পাবে দিন তিনেক।
কাল দুপুরের দিকে তার অ্যাপার্টমেন্ট দেখতে যাওয়া হলো। মেয়ে রুমমেট ঠিক করেছে এক প্যালেস্টাইনি মেয়ে ফারাহকে। ফারাহ-র বাবা গতমাসে নিজে এসে ঘুরে ঘুরে সব ঠিকঠাক করে গেছেন। ভদ্রলোকের পছন্দের ওপর কোনো কথা চলে না, অ্যাপার্টমেন্ট এবং কাছাকাছি এলাকা দেখে যে কোনো বাবা-মা নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারে। বস্তুত, সকালের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের রাস্তাঘাট-বাড়িঘর দেখে আমার একটু ফাঁপড় লাগছিলো। বেশ পুরনো, ঘিঞ্জিমতো সব, ডাউনটাউন এলাকায় যেমন হয়। তখনো সঠিক ধারণা নেই, ওদের অ্যাপার্টমেন্ট ঠিক কোথায়, কেমন জায়গা।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইল কয়েকের দূরত্বে অ্যাপার্টমেন্ট দেখে মেয়ে নিজেও মহা উচ্ছ্বসিত। নিজের প্রথম ঠিকানা বলে কথা, বাবা-মায়ের ছায়ার বাইরে তার স্বাধীনতার ঠিকানা।
ফেরার পথে মেয়েকে বলি আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল-জীবনের গল্প। নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্ট দূরের কথা, নিজের বিছানার স্বপ্ন দেখাও কঠিন সূর্যসেন হলের ৪৪৮ নম্বর কক্ষের মেঝেতে শায়িত হয়ে। প্রথম বছরের প্রায় পুরোটাই সেভাবে কেটেছিলো। চোখে অবিশ্বাস নিয়ে মেয়ে তাকিয়ে থাকে, কল্পনাশক্তিও তাকে ছবিটা দেখতে সাহায্য করে বলে মনে হয় না। না হোক, কোনো ক্ষতি নেই। তার এখন সামনে তাকানোর সময়, তাকে স্বপ্ন দেখতে হবে আগামীর, পিতামাতার অতীতের জঞ্জালে তার কোনো প্রয়োজন না থাকাই উচিত।
দীর্ঘ যাত্রায় যেমন হয়, একসময় কথা থামে। ছেলেমেয়েরা এরকম যাত্রায় সচরাচর পালা করে প্যাসেঞ্জার সীটে বসে ডি জে হয়ে গান বাজায়। এখন মেয়ে সেই ভূমিকায়, তার নিজের ও ছোটো ভাইটির পছন্দের গান বাজায়। ওদের বয়সের ব্যবধান আট বছরের, একটা সময় ছিলো তাদের মধ্যে বনিবনা প্রায় ছিলোই না – তাদের দুই পৃথিবীর দূরত্ব এতোটাই বেশি তখন। বছর দুয়েক ধরে সেটা পাল্টাতে শুরু করেছে। দুইজনে মিলে কতোসব বকবক করে, একত্রে বসে গান শোনে। মেয়ে নিজের গরজে প্রতি সপ্তাহে ভাইকে নিয়ে যায় সিনেমা দেখতে। বোনের ফিরতে দেরি হলে ছেলে ‘আপু কখন আসবে? ফোন করি?’ জিজ্ঞেস করতে থাকে। ঠিক এই সময়েই তাদের বিচ্ছিন্ন হতে হবে ভাবলে কষ্ট হয়। এই সময় কি আর তাদের জীবনে ফিরে আসবে?
সেদিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপু চলে গেলে তোমার খারাপ লাগবে?’
ছেলে নিঃশব্দে কাঁধ ঝাঁকায়, সে জানে না। হয়তো সত্যিই জানে না। তার জীবন এরকম চলে যাওয়ার ঘটনা কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। অবিলম্বে জানবে, জীবন তাকে আরো অনেক অভিজ্ঞানে অভিজ্ঞ করে তুলবে ক্রমশ। এইসব ছোটোবড়ো নানা ধরনের দুঃখ-কষ্ট থেকে কে কবে রেহাই পেয়েছে?
সিডি-তে বেজে যাওয়া গান কানে আসে, মরমে পশে না। গাড়ি চালাচ্ছি, বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি। আচমকা মনে হয়, আর মোটে কয়েকদিন পরে যখন অস্টিন থেকে ফিরবো, তখন মেয়ে পাশে বসে থাকবে না। তাকে ছেড়ে আসতে হবে তার নতুন ঠিকানায়। ভেতরটা কেন কে জানে খুব শূন্য লাগতে থাকে। খুব দূরের পথ নয়, চাইলেই যাওয়া-আসা হবে। কিন্তু তবু সে তো দূরেরই একজন হয়ে উঠবে দিনদিন। এখন বলছে, প্রতি সপ্তাহে না হলেও অন্তত দুই সপ্তাহ পরপর সে আসবে। হয়তো আসবে, কিন্তু দুই ক্রমশ তিন বা চার সপ্তাহ হয়ে যাবে, একসময় আরো আরো দীর্ঘ। জীবন এরকমই, নিজেকে দিয়েই জানি, আমার পিতামাতাও আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে এই বোধ নিয়ে চোখ মুছে গৃহকর্মে মন দিয়েছিলেন। এখন আমার পালা। যা কিছু নিয়েছি তা ফিরিয়ে দিতেই হয়।
প্রথম দুইবার ভুল পথে গিয়ে আর কেউ টের পাওয়ার আগেই চুপচাপ ফিরতে সক্ষম হই। ধরা পড়লাম শেষবার ডালাস শহরে ঢোকার পর। ছেলেমেয়ের মা টের পেয়ে যায়, ‘কী হলো তোমার?’
কী করে বলি, এই বাবাটি নিজেকে অনেক শক্ত মনের মানুষ ভাবলেও হয়তো ততোটা শক্ত সে নয়। কিন্তু আর কারো তা জানার দরকার নেই। চোখের কী দোষ? Must be the clouds in my eyes!
২১ অগাস্ট ২০০৮
Friday, August 22, 2008
Tuesday, August 12, 2008
বাঙালির সময়
‘ন’টার গাড়ি ক’টায় ছাড়ে?’ এই রসিকতাটি অথবা এর কাছাকাছি কোনো কোনো শ্লেষ-মেশানো বাক্য বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে চালু আছে দীর্ঘকাল ধরে। একদিন ঠিক সময়ে ট্রেন স্টেশনে এলে যাত্রীরা বিস্মিত, কারণ এই ট্রেনটি কখনোই সময়মতো আসে না। সত্যভাষী স্টেশনমাস্টার জানালেন, এটার আসার কথা ছিলো গতকাল। এই রসিকতাও পুরনো।
কোনো কাজ – তা ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক অথবা রাষ্ট্রীয় যা-ই হোক – যথাসময়ে সম্পন্ন হবে না, এরকমই আমাদের অভিজ্ঞতা। আমরা স্টেশনে পৌঁছিবার পূর্বেই ট্রেন ছাড়িয়া যাইবে। ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা যাইবে। ট্রেন-বাস-লঞ্চ নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে যাত্রা শুরু করবে, বিদ্যুতের বিলটি আসবে পরিশোধের নির্ধারিত তারিখ অতিক্রান্ত হওয়ার পর।
সময়জ্ঞান বা সময়ানুবর্তিতা বিষয়ে বাঙালির খুব সুনাম নেই। আর এ সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত ‘আরে, বাঙালির সময়!’ কথাটি বলার একচ্ছত্র অধিকার আমরা বাঙালিরাই নিয়ে রেখেছি। এই বাক্যটি আমরা সবাই কমবেশি কখনো না কখনো বলেছি। ঠাট্টাচ্ছলে, ক্ষোভে, নিন্দাসূচকভাবে, বিরক্তি প্রকাশের জন্যে, এমনকি নিদারুণ তিক্ততায়।
বস্তুত, নিজেদের দেশ বা জাতিগত পরিচয় নিয়ে বাঙালির মতো নিন্দাসূচক উক্তি সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনো জাতি করে না। এটিকে আত্মসমালোচনা বলে চিহ্নিত করা মুশকিল। কারণ, আত্মসমালোচনা করা হয় একটি সম্ভাব্য উত্তরণ বা সমাধানের আশা ও আগ্রহ থেকে। আমাদের ক্ষেত্রে তার কোনোরকম লক্ষণ দেখা যায় না। আমরা বলার জন্যেই বলি, সংশোধিত হওয়ার আগ্রহ আমাদের কম। এই বিষয়ে প্রত্যেকেরই যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু করণীয় আছে যা আখেরে সমষ্টির অভ্যাসে পরিণত হতে পারে, সেখানে আমরা উদাসীন থাকতে সচ্ছন্দ।
০২
দেশে তো বটেই, পরবাসে বছরের পর বছর বসবাস করেও আমরা সময় নিয়ে হেলাফেলার চর্চাটি দিব্যি চালু রেখেছি। রুটিরুজির মামলা জড়িত বলে কর্মস্থলে আমরা ঠিকই পৌঁছে যাই নির্ধারিত সময়ে, সেখানে সময়জ্ঞানটি টনটনে। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে এবং সামাজিকতায় আবার নির্ভুলভাবে বাঙালি সময় উদযাপন করি। সাতটার অনুষ্ঠান ন’টার আগে শুরু হয় না। সন্ধ্যা ছ’টায় হয়তো কিছু আমন্ত্রিত মানুষজনের আসার কথা। নিমন্ত্রিত এবং নিমন্ত্রণকারী উভয়পক্ষই জানেন তা আটটার আগে ঘটা সম্ভব নয়। নিমন্ত্রিত কেউ সময়মতো এলে দেখবেন গৃহের বাসিন্দারাই তখনো প্রস্তুত নন।
আমার নিজের একটি চরম অভিজ্ঞতার কথা বলি। কয়েক বছর আগে এক তরুণ দম্পতি তাঁদের বিবাহবার্ষিকীতে জনা পঞ্চাশেক অতিথিকে আমন্ত্রণ করেছেন বাসায়। সময় দেওয়া ছিলো সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। স্বীকার করে নিই, আমরা নিজেরাও নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হইনি। বাঙালি তো! অতিথিরা সবাই এলেন ন’টার মধ্যে। গৃহকর্তা হাসিমুখে সবাইকে অভ্যর্থনা করে বসাচ্ছেন, নরম পানীয় সরবরাহ করছেন, ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে কথা বলছেন। গৃহকর্ত্রীর দেখা নেই। কৌতূহলী মহিলাদের প্রশ্নের মুখে গৃহকর্তা জানান, গৃহিনী ওপরতলায় আছেন, তৈরি হয়ে নামবেন একটু পরে। তাঁর সুসজ্জিত হয়ে অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনাটি যখন শেষমেশ ঘটলো তখন ঘড়িতে এগারোটা। আহার-পর্ব ততোক্ষণে শেষ, গৃহকর্তা রেস্টুরেন্ট থেকে কেটার করে আনা খাবার নিজেই পরিবেশন ও তদারক করেছেন। অতিথিদের কেউ কেউ বিদায়ও নিয়েছেন।
ব্যতিক্রমের কথাও বলা দরকার। একবার এক ভদ্রলোক তাঁর মেয়ের বিয়ের ছাপানো কার্ড পাঠিয়েছেন ডাকে। নির্ধারিত দিনের এক সপ্তাহ আগে ফোন করে আমন্ত্রিতদের প্রত্যেককে বিনীতভাবে জানালেন, অনুষ্ঠানটি ঘড়ি ধরে ঠিক সময়মতো অনুষ্ঠিত হবে এবং কারো পক্ষে যথাসময়ে উপস্থিত হওয়া সম্ভব না হলে না এলেও চলবে, তাঁরা কিছু মনে করবেন না। কিন্তু অধিকাংশ অতিথি অভ্যাসবশে যথারীতি বিলম্বে উপস্থিত হয়ে গৃহকর্তার অসন্তোষের কারণ ঘটিয়েছিলেন।
আরেকটি ঘটনার কথা শুনেছি। একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিতদের বারবার বলে দেওয়া হয়েছিলো নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হতে। অনেকে অনুরোধটি রক্ষা করলেও প্রায় অর্ধেক সংখ্যক অতিথি যথার্থ বাঙালি হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন নির্ধারিত সময়ের প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে। ইতোমধ্যে আহারপর্ব শেষ হয়ে গেছে এবং গৃহকর্তা অবশিষ্ট খাবার তুলে রেখে বা ফেলে দিয়ে টেবিল পরিষ্কার করে ফেলেছেন। লেট লতিফরা এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোনো আহার্যবস্তু দেখতে না পেয়ে কিছু বিস্মিত। একজন মুখ ফুটে শেষমেশ গৃহকর্তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের একটু ফেরার তাড়া আছে, খাবার কখন দেওয়া হবে? বিরক্তি ও হতাশা চেপে রেখে গৃহকর্তা নির্বিকার মুখে জানালেন, খাওয়া-দাওয়া তো হয়ে গেছে। আপনি খাননি?
০৩
সময়ের আগেই কাজ করে ফেলা কি বাঙালির চরিত্রে নেই? আছে, নিশ্চয়ই আছে। তবে এই করিৎকর্মারা একটি বিশেষ শ্রেণীর এবং আমাদের জনসংখ্যার একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ। এঁরা বণিক শ্রেণীভুক্ত, যাঁদের আমরা ব্যবসায়ী বলে জানি, আদর-সমীহ করে বিজনেসম্যান বলি। বাংলাদেশে রোজার মাস উপলক্ষে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া একটি বাৎসরিক ঘটনা, ব্যবসায়ীরা রোজার কয়েক সপ্তাহ আগেই দাম বাড়ানোর কাজটি শুরু করেন। মানুষকে অভ্যস্ত করে নেওয়া আর কি! সরকার তখন মাথা চুলকে ভাবতে থাকে, এদের কী করে সামলানো যায়। কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া যায় না, মাথা চুলকাতে চুলকাতেই মৌসুম শেষ। ভোক্তা মানুষের পকেট কাটার কাজটি ততোদিনে সম্পন্ন হয়ে গেছে। আবার হয়তো পেট্রলের দাম বাড়লো, সেই বর্ধিত দামের পেট্রল পাম্পে আসার জন্যে অপেক্ষা করে কে? তার আগেই দাম উঠে গেলো। এই ধরনের উদাহরণ অফুরন্ত। প্রতিদিনই ঘটে বাংলাদেশে। ভুক্তভোগীরা জানেন, নতুন করে বলার অনাবশ্যক।
০৪
বাঙালির সময়জ্ঞান নেই, এই প্রচলিত ধারণার বিপরীতে অনায়াসে দাঁড়ানো যায় এবং ধারণাটি ভুল প্রমাণসাপেক্ষে উল্টোটাই প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে সময় বিষয়ে আমাদের এই ঢিলেঢালা মনোভাবটি মূলত শহরকেন্দ্রিক। অর্থাৎ, বলা চলে এটি এক ধরনের নাগরিক মনোভঙ্গি ও আচরণ। আমরা নিজেরা অপেক্ষা করতে পছন্দ করি বা না করি, অন্যকে অপেক্ষা করিয়ে রাখতে আমাদের বাধে না। কর্মস্থলে নিয়ম করে অনিয়মিত থাকি, সময়ের কাজটি ফেলে রাখি ‘থাক না পরে করলে ক্ষতি কী’ ভেবে।
অথচ বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ গ্রামের বাসিন্দা এবং তাদের পেশা প্রধানত কৃষিকাজ। কৃষকরা ‘থাক, পরে করবো’ বলে যদি তাঁদের চাষবাসের কাজগুলি সময়মতো না করতেন তাহলে কী হতো? বাংলাদেশ আক্ষরিক অর্থে ভাতে মারা পড়তো। কৃষকরা সময়মতো জমিতে হালচাষ করেন, বীজ বপন করেন, শস্যের ও জমির পরিচর্যা করেন, সেচকার্য করেন, ফসল তোলেন – সবই নিয়ম করে, নির্ধারিত সময়ে। কৃষকরা সারা বাংলাদেশের মানুষের মুখে অন্নের যোগান দিয়ে আসছেন যুগ যুগ ধরে। কখনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। উপর্যুপরি প্রাকৃতিক সংকট ও দুর্যোগ তাঁদের টলাতে পারেনি, কর্তব্যকর্ম থেকে নিবৃত্ত করেনি।
অন্যদিকে ছোটোবড়ো শহরাঞ্চলেও এক শ্রেণীর মানুষ আছেন, যাঁরা সময়ের কাজটি সময়ে সম্পন্ন করে থাকেন। শিল্প-কারখানায় কাজ করা মানুষগুলিও নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে উপস্থিত হন, কলের চাকা চালু রাখেন। এর সঙ্গে রুটি-রুজির সম্পর্ক আছে নিশ্চিত, কিন্তু চেয়ার-টেবিলে বসা শহুরে কর্মজীবীদের অধিকাংশের সঙ্গে কর্তব্যকর্ম বিষয়ে এঁদের সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে।
কৃষক-শ্রমিকরা বা শ্রমজীবী মানুষরা বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু, তাঁরা তো দেখতে পাচ্ছি সময়জ্ঞানে নাগরিক বাঙালি নন কোনো অর্থেই। সুতরাং বাঙালির সময়জ্ঞান নেই, এই ধারণার সঙ্গে আমরা একমত হবো কেন?
কোনো কাজ – তা ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক অথবা রাষ্ট্রীয় যা-ই হোক – যথাসময়ে সম্পন্ন হবে না, এরকমই আমাদের অভিজ্ঞতা। আমরা স্টেশনে পৌঁছিবার পূর্বেই ট্রেন ছাড়িয়া যাইবে। ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা যাইবে। ট্রেন-বাস-লঞ্চ নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে যাত্রা শুরু করবে, বিদ্যুতের বিলটি আসবে পরিশোধের নির্ধারিত তারিখ অতিক্রান্ত হওয়ার পর।
সময়জ্ঞান বা সময়ানুবর্তিতা বিষয়ে বাঙালির খুব সুনাম নেই। আর এ সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত ‘আরে, বাঙালির সময়!’ কথাটি বলার একচ্ছত্র অধিকার আমরা বাঙালিরাই নিয়ে রেখেছি। এই বাক্যটি আমরা সবাই কমবেশি কখনো না কখনো বলেছি। ঠাট্টাচ্ছলে, ক্ষোভে, নিন্দাসূচকভাবে, বিরক্তি প্রকাশের জন্যে, এমনকি নিদারুণ তিক্ততায়।
বস্তুত, নিজেদের দেশ বা জাতিগত পরিচয় নিয়ে বাঙালির মতো নিন্দাসূচক উক্তি সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনো জাতি করে না। এটিকে আত্মসমালোচনা বলে চিহ্নিত করা মুশকিল। কারণ, আত্মসমালোচনা করা হয় একটি সম্ভাব্য উত্তরণ বা সমাধানের আশা ও আগ্রহ থেকে। আমাদের ক্ষেত্রে তার কোনোরকম লক্ষণ দেখা যায় না। আমরা বলার জন্যেই বলি, সংশোধিত হওয়ার আগ্রহ আমাদের কম। এই বিষয়ে প্রত্যেকেরই যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু করণীয় আছে যা আখেরে সমষ্টির অভ্যাসে পরিণত হতে পারে, সেখানে আমরা উদাসীন থাকতে সচ্ছন্দ।
০২
দেশে তো বটেই, পরবাসে বছরের পর বছর বসবাস করেও আমরা সময় নিয়ে হেলাফেলার চর্চাটি দিব্যি চালু রেখেছি। রুটিরুজির মামলা জড়িত বলে কর্মস্থলে আমরা ঠিকই পৌঁছে যাই নির্ধারিত সময়ে, সেখানে সময়জ্ঞানটি টনটনে। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে এবং সামাজিকতায় আবার নির্ভুলভাবে বাঙালি সময় উদযাপন করি। সাতটার অনুষ্ঠান ন’টার আগে শুরু হয় না। সন্ধ্যা ছ’টায় হয়তো কিছু আমন্ত্রিত মানুষজনের আসার কথা। নিমন্ত্রিত এবং নিমন্ত্রণকারী উভয়পক্ষই জানেন তা আটটার আগে ঘটা সম্ভব নয়। নিমন্ত্রিত কেউ সময়মতো এলে দেখবেন গৃহের বাসিন্দারাই তখনো প্রস্তুত নন।
আমার নিজের একটি চরম অভিজ্ঞতার কথা বলি। কয়েক বছর আগে এক তরুণ দম্পতি তাঁদের বিবাহবার্ষিকীতে জনা পঞ্চাশেক অতিথিকে আমন্ত্রণ করেছেন বাসায়। সময় দেওয়া ছিলো সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। স্বীকার করে নিই, আমরা নিজেরাও নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হইনি। বাঙালি তো! অতিথিরা সবাই এলেন ন’টার মধ্যে। গৃহকর্তা হাসিমুখে সবাইকে অভ্যর্থনা করে বসাচ্ছেন, নরম পানীয় সরবরাহ করছেন, ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে কথা বলছেন। গৃহকর্ত্রীর দেখা নেই। কৌতূহলী মহিলাদের প্রশ্নের মুখে গৃহকর্তা জানান, গৃহিনী ওপরতলায় আছেন, তৈরি হয়ে নামবেন একটু পরে। তাঁর সুসজ্জিত হয়ে অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনাটি যখন শেষমেশ ঘটলো তখন ঘড়িতে এগারোটা। আহার-পর্ব ততোক্ষণে শেষ, গৃহকর্তা রেস্টুরেন্ট থেকে কেটার করে আনা খাবার নিজেই পরিবেশন ও তদারক করেছেন। অতিথিদের কেউ কেউ বিদায়ও নিয়েছেন।
ব্যতিক্রমের কথাও বলা দরকার। একবার এক ভদ্রলোক তাঁর মেয়ের বিয়ের ছাপানো কার্ড পাঠিয়েছেন ডাকে। নির্ধারিত দিনের এক সপ্তাহ আগে ফোন করে আমন্ত্রিতদের প্রত্যেককে বিনীতভাবে জানালেন, অনুষ্ঠানটি ঘড়ি ধরে ঠিক সময়মতো অনুষ্ঠিত হবে এবং কারো পক্ষে যথাসময়ে উপস্থিত হওয়া সম্ভব না হলে না এলেও চলবে, তাঁরা কিছু মনে করবেন না। কিন্তু অধিকাংশ অতিথি অভ্যাসবশে যথারীতি বিলম্বে উপস্থিত হয়ে গৃহকর্তার অসন্তোষের কারণ ঘটিয়েছিলেন।
আরেকটি ঘটনার কথা শুনেছি। একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিতদের বারবার বলে দেওয়া হয়েছিলো নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হতে। অনেকে অনুরোধটি রক্ষা করলেও প্রায় অর্ধেক সংখ্যক অতিথি যথার্থ বাঙালি হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন নির্ধারিত সময়ের প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে। ইতোমধ্যে আহারপর্ব শেষ হয়ে গেছে এবং গৃহকর্তা অবশিষ্ট খাবার তুলে রেখে বা ফেলে দিয়ে টেবিল পরিষ্কার করে ফেলেছেন। লেট লতিফরা এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোনো আহার্যবস্তু দেখতে না পেয়ে কিছু বিস্মিত। একজন মুখ ফুটে শেষমেশ গৃহকর্তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের একটু ফেরার তাড়া আছে, খাবার কখন দেওয়া হবে? বিরক্তি ও হতাশা চেপে রেখে গৃহকর্তা নির্বিকার মুখে জানালেন, খাওয়া-দাওয়া তো হয়ে গেছে। আপনি খাননি?
০৩
সময়ের আগেই কাজ করে ফেলা কি বাঙালির চরিত্রে নেই? আছে, নিশ্চয়ই আছে। তবে এই করিৎকর্মারা একটি বিশেষ শ্রেণীর এবং আমাদের জনসংখ্যার একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ। এঁরা বণিক শ্রেণীভুক্ত, যাঁদের আমরা ব্যবসায়ী বলে জানি, আদর-সমীহ করে বিজনেসম্যান বলি। বাংলাদেশে রোজার মাস উপলক্ষে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া একটি বাৎসরিক ঘটনা, ব্যবসায়ীরা রোজার কয়েক সপ্তাহ আগেই দাম বাড়ানোর কাজটি শুরু করেন। মানুষকে অভ্যস্ত করে নেওয়া আর কি! সরকার তখন মাথা চুলকে ভাবতে থাকে, এদের কী করে সামলানো যায়। কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া যায় না, মাথা চুলকাতে চুলকাতেই মৌসুম শেষ। ভোক্তা মানুষের পকেট কাটার কাজটি ততোদিনে সম্পন্ন হয়ে গেছে। আবার হয়তো পেট্রলের দাম বাড়লো, সেই বর্ধিত দামের পেট্রল পাম্পে আসার জন্যে অপেক্ষা করে কে? তার আগেই দাম উঠে গেলো। এই ধরনের উদাহরণ অফুরন্ত। প্রতিদিনই ঘটে বাংলাদেশে। ভুক্তভোগীরা জানেন, নতুন করে বলার অনাবশ্যক।
০৪
বাঙালির সময়জ্ঞান নেই, এই প্রচলিত ধারণার বিপরীতে অনায়াসে দাঁড়ানো যায় এবং ধারণাটি ভুল প্রমাণসাপেক্ষে উল্টোটাই প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে সময় বিষয়ে আমাদের এই ঢিলেঢালা মনোভাবটি মূলত শহরকেন্দ্রিক। অর্থাৎ, বলা চলে এটি এক ধরনের নাগরিক মনোভঙ্গি ও আচরণ। আমরা নিজেরা অপেক্ষা করতে পছন্দ করি বা না করি, অন্যকে অপেক্ষা করিয়ে রাখতে আমাদের বাধে না। কর্মস্থলে নিয়ম করে অনিয়মিত থাকি, সময়ের কাজটি ফেলে রাখি ‘থাক না পরে করলে ক্ষতি কী’ ভেবে।
অথচ বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ গ্রামের বাসিন্দা এবং তাদের পেশা প্রধানত কৃষিকাজ। কৃষকরা ‘থাক, পরে করবো’ বলে যদি তাঁদের চাষবাসের কাজগুলি সময়মতো না করতেন তাহলে কী হতো? বাংলাদেশ আক্ষরিক অর্থে ভাতে মারা পড়তো। কৃষকরা সময়মতো জমিতে হালচাষ করেন, বীজ বপন করেন, শস্যের ও জমির পরিচর্যা করেন, সেচকার্য করেন, ফসল তোলেন – সবই নিয়ম করে, নির্ধারিত সময়ে। কৃষকরা সারা বাংলাদেশের মানুষের মুখে অন্নের যোগান দিয়ে আসছেন যুগ যুগ ধরে। কখনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। উপর্যুপরি প্রাকৃতিক সংকট ও দুর্যোগ তাঁদের টলাতে পারেনি, কর্তব্যকর্ম থেকে নিবৃত্ত করেনি।
অন্যদিকে ছোটোবড়ো শহরাঞ্চলেও এক শ্রেণীর মানুষ আছেন, যাঁরা সময়ের কাজটি সময়ে সম্পন্ন করে থাকেন। শিল্প-কারখানায় কাজ করা মানুষগুলিও নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে উপস্থিত হন, কলের চাকা চালু রাখেন। এর সঙ্গে রুটি-রুজির সম্পর্ক আছে নিশ্চিত, কিন্তু চেয়ার-টেবিলে বসা শহুরে কর্মজীবীদের অধিকাংশের সঙ্গে কর্তব্যকর্ম বিষয়ে এঁদের সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে।
কৃষক-শ্রমিকরা বা শ্রমজীবী মানুষরা বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু, তাঁরা তো দেখতে পাচ্ছি সময়জ্ঞানে নাগরিক বাঙালি নন কোনো অর্থেই। সুতরাং বাঙালির সময়জ্ঞান নেই, এই ধারণার সঙ্গে আমরা একমত হবো কেন?
Subscribe to:
Posts (Atom)