Saturday, June 28, 2008

ঈদ সংখ্যার উপন্যাস : পাঠক-ঠকানোর বার্ষিক পার্বণ

কোনো পত্রিকা যদি পাঁচখানি ‘পূর্ণাঙ্গ’ উপন্যাস ছাপলো, প্রতিযোগী ছাপলো সাতখানি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস। তার পরে ‘পূর্ণাঙ্গ’ উপন্যাসের ঢল নামল। এখন সহজেই অনুমেয় এইসব উপন্যাসের পূর্ণাঙ্গতা নামে মাত্র, খুব বেশী হবে তো ৪/৫ ফর্মা। তার পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় আরও ২/৩ ফর্মা বাড়ানো …। ফলে দাঁড়ালো এসব না ছোটগল্প না উপন্যাস। এরা রক্তপায়ী জোঁকের মতো স্ফীতোদর একটা প্রাণী। এতে না আছে ছোটগল্পের সূক্ষ্ম কলা-কৌশল, না আছে উপন্যাসের জীবন বিস্তার, আছে স্ফীতোদর ব্যবসায়িকতা। এ শ্রেণীর দায়িত্বহীন রচনার মতো সহজ কাজ আর নেই।

মনে হতে পারে, ওপরের উদ্ধৃতিটি বাংলাদেশের পত্রিকাগুলিতে উপন্যাস প্রকাশের সাম্প্রতিক প্রবণতা সম্পর্কে লেখা । অথচ সত্য এই যে, বাক্যগুলি লেখা হয়েছিলো আজ থেকে ৭২ বছর আগে, ১৯৩৬ সালে। প্রমথনাথ বিশী লিখেছিলেন ‘ছোটগল্পের আত্মহত্যা’ প্রবন্ধে। অথচ কী আশ্চর্য, একটি অক্ষরও অদল-বদল না করে এই কথাগুলি আজও বাংলাদেশের উপন্যাসের বেলায় সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

কলকাতার শারদীয় দেশ-আনন্দবাজারের আদলে বাংলাদেশে ঈদ উপলক্ষে বার্ষিক সাহিত্য-সম্ভার নিয়ে উপস্থিত হওয়ার প্রচলন প্রথম করে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’, যতোদূর মনে পড়ে, আশির দশকের শুরুতে। এর অনেক আগে থেকেই অবশ্য ‘বেগম’-এর ঈদসংখ্যা বেরোতো, সাহিত্যমূল্যের বিচারে তার মান উল্লেখ করার মতো কিছু ছিলো না। ‘বিচিত্রা’-র পর ঈদ সংখ্যা প্রকাশ শুরু করে ‘সচিত্র সন্ধানী’ ও ‘রোববার’। শুরুর দিকে বেশ কিছু উৎকৃষ্ট উপন্যাস পাওয়া গিয়েছিলো এই ঈদ সংখ্যাগুলিতে। এরপর অন্য সাপ্তাহিকগুলি এবং কয়েকটি দৈনিকও ঈদ সংখ্যা প্রকাশ শুরু করে। এখন তো ঈদ সংখ্যা মহামারীর আকার ধারণ করেছে।

মহামারী কথাটা বলা নিতান্ত অনিচ্ছায়। ঈদ সংখ্যার নামে যা পাওয়া যাচ্ছে, পাঠককে যা ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে – তারই পরিপ্রেক্ষিতে। ছোটোখাটো পত্রিকাগুলিকে আপাতত সরিয়ে রাখি। বড়ো ও নামী সাপ্তাহিক ও দৈনিকগুলির ঈদ সংখ্যার গড় পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫০০। এই পরিসরে গড়ে ১০ থেকে ১২টি উপন্যাস থাকে। আর থাকে ১০-১২টি করে গল্প, স্মৃতিকথা/আত্মজীবনীমূলক রচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, একগুচ্ছ করে কবিতা, একটি-দুটি অনুবাদ রচনা, চলচ্চিত্র-ক্রীড়া-নাটক-টিভি-সঙ্গীত ইত্যাদি বিষয়ে রচনা, ঈদের ফ্যাশন এবং রান্নার রেসিপি ও মেয়েদের সাজসজ্জা বিষয়ে কয়েক পাতা করে বরাদ্দ।

দেশ-আনন্দবাজারে শারদীয় সংখ্যাগুলি যেখানে মূলত সাহিত্যমুখী, আমাদের ঈদ সংখ্যার চরিত্র কিন্তু পত্রিকার সাধারণ সংখ্যারই বর্ধিত রূপ। ব্যতিক্রম বলতে শুধু উপন্যাস, যা সাধারণ সংখ্যায় থাকে না। ঈদ উপলক্ষে উপন্যাস থাকে বেশুমার। সবগুলি পত্রিকা দেখিনি, তবে গত কয়েক বছরে আমার দেখা ঈদ সংখ্যাগুলির মধ্যে একটিতে উপন্যাসের সর্বোচ্চ সংখ্যা দেখেছি ১৬টি।

কিন্তু উপন্যাস নামে যা পাওয়া হয়, তা আসলে কী বস্তু? একটি ঈদ সংখ্যার মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা যদি ৫০০ ধরে নিই, সেই হিসেবে বিজ্ঞাপনসহ অন্য সবকিছু বাদ দিলেও ১৬টি উপন্যাসের একেকটির জন্যে সোয়া ৩১ পৃষ্ঠা বরাদ্দ করা সম্ভব। কিন্তু শুধু উপন্যাস দিয়ে পত্রিকার পেট ভরে না!

নাসিরউদ্দিন হোজ্জার গল্প মনে পড়ে। হোজ্জা একদিন আধাসের মাংস কিনে এনে বউকে রান্না করতে বলে বাইরে গেছে। বউ রান্না শেষ করেছে, এমন সময় তার বোন বেড়াতে এলে ওই মাংস দিয়েই সে আতিথেয়তা সারে। হোজ্জা খেতে বসে দেখে মাংস নেই। বউ কৈফিয়ত দিয়ে বললো, পাজি বেড়ালটা সব মাংস খেয়ে গেছে। হোজ্জা তৎক্ষণাৎ উঠে বেড়ালটাকে ধরে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে দেখে, ওজন ঠিক আধ সের। হোজ্জার প্রশ্ন, এই যদি বেড়াল হয় তাহলে মাংস কোথায় গেলো? আর এটা যদি মাংস হয়, বেড়ালটা কোথায়?

ঈদ সংখ্যা দেখে আমাদের তখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, এই যদি পত্রিকা হয় তাহলে উপন্যাস কোথায়? আর এগুলি যদি উপন্যাস হবে, পত্রিকা থাকলো কোথায়? এতোসব জিনিস শ’ পাঁচেক পৃষ্ঠার ভেতরে হাঁসফাঁস করতে থাকে এবং সবচেয়ে বেশি ভোগে উপন্যাস। কারণ, চরিত্রগতভাবেই এই জিনিস কিছু বেশি জায়গা দাবি করে। কাহিনীর বিন্যাস ও বিস্তার, চরিত্রসমূহের বিকাশ ইত্যাদি মিলিয়ে বাড়তি পরিসর দরকার হয়।

উপন্যাসের আকার-আকৃতি কী হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে পুরনো আলোচনায় যাওয়ার দরকার নেই। এ যুগে War and Peace আকারের উপন্যাস লিখিত হওয়ার সম্ভাবনা বলতে গেলে শূন্য। এর বিপরীতে The Old Man and the Sea-এর ক্ষুদ্রায়তনও বহুল আলোচিত। বাংলা ভাষায় রচিত ‘ঘুণপোকা’ কি পূর্ণ উপন্যাস নয়? আসলে একটি উপন্যাসের উপন্যাস হয়ে ওঠা তার আকার-আকৃতির ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে বিষয়বস্তু ও কাহিনী, লেখকের বক্তব্য ও দর্শন এবং রচনাকৌশলের ওপর। তবে এটাও মানতে হবে যে, ছোটোগল্পে ঘটনা ও চরিত্র রচনায় আঁচড় কেটে যাওয়ার সুযোগ থাকে, উপন্যাস তা অনুমোদন করে না। উপন্যাসে বিস্তারের কাজটা আবশ্যিক, পারম্পর্য রক্ষাও। যথাযথ পরিসর উপন্যাসের জন্যে প্রাথমিক শর্ত।

মুশকিল হলো, আমাদের পত্রিকাগুলি এই পরিসর অনুমোদন করতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক অথবা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ বোধহীন ও কাণ্ডজ্ঞানরহিত। তাদের লক্ষ্য ‘উপন্যাসের’ সংখ্যা বাড়ানো, উপন্যাস হলো কি না, লেখক লিখে তৃপ্ত হলেন কি না, পাঠককে উপন্যাসের নামে বড়োগল্প বা ছোটোগল্প দিয়ে প্রতারণা করা হলো কি না – এসব তাদের বিবেচ্য বলে মনে করা কঠিন। ম্যাগাজিন আকারের ঈদ সংখ্যায় একটি ‘উপন্যাস’ দেখেছি ৭ পৃষ্ঠায় শেষ! স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। অথচ একটি ছোটোগল্প লিখতেও এই পরিসর প্রয়োজন হতে পারে। রচনার গুণমানের কথা না হয় পরে, কিন্তু উপন্যাসের নামে এটাকে ইয়ার্কি ছাড়া আর কী বলা যায় আমার জানা নেই।

বাংলাদেশে হাতে গোনা যে কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা আছে, তাদের প্রভাব সামান্যই। যেহেতু প্রচার ও পাঠক সীমিত। পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিজ্ঞাপনদাতারা এসব পত্রিকার বিষয়ে উৎসাহী নয়। ফলে, বহুকাল ধরে আমাদের সাহিত্য মূলত দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য/সাময়িকী পাতাকেন্দ্রিক হয়ে আছে। দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে দৈনিক কাগজগুলি তাদের সাময়িকী পাতার বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী বলে মনে হয় না, যেনতেন প্রকারে পাতা ভরানোর দায়িত্বটাই তারা পালন করে। সাপ্তাহিক কাগজগুলির অধিকাংশই তাদের নিয়মিত সংখ্যায় সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে না। ধারাবাহিক উপন্যাস দূরের কথা, একটি-দুটি গল্প-কবিতাও তাদের পাতায় জায়গা পায় না। অথচ ঈদ মৌসুমে তাদের সাহিত্যপ্রেম উথলে ওঠে, প্রতিযোগিতা হয় কে কতোগুলি ‘উপন্যাস’ ছাপতে পারে!

এককালে যখন হিন্দুরা মুরগি খেতো না, তখন মুসলমানের মুরগিপ্রেম বলে একটা রসিকতা চালু ছিলো। বলা হতো, মুসলমানরা খুব যত্ন করে মুরগি পোষে, তবে সময় ও সুযোগ বুঝে জবাই করে খেয়েও ফেলে। আমাদের পত্রিকাওয়ালাদের ঈদকেন্দ্রিক সাহিত্যপ্রেমও যে আসলে ঐ মুসলমানের মুরগিপ্রেমের সমতুল্য, তার প্রমাণ ঈদ সংখ্যাগুলির পাতায় পাতায়। প্রয়োজনে ঐ ক্ষুদ্রাকার ‘উপন্যাসের’ হাত-পা-নাক-কান বা লেজ কেটে বরাদ্দ করা নির্দিষ্ট আকারের মধ্যে আঁটাতে হবে। যতোদূর জানি, এইসব কাটছাঁটের বেলায় লেখককে জানানোর সৌজন্যও দেখানো হয় না। ভাবটা এমন যে, লেখা ছেপে পত্রিকাগুলি লেখকদের ধন্য করে দিচ্ছে। অথচ বিষয়টা হওয়া উচিত পারস্পরিক প্রয়োজন ও সম্মানের।

এই কাটছাঁট মামলার আমি নিজে এর ভুক্তভোগী , এবং আমিই একমাত্র নই। শওকত আলী বা সৈয়দ শামসুল হকের মতো লেখকদের বেলায় এটা ঘটে না অবশ্য। তবে আমি নিশ্চিত, তাঁদেরও ‘সাইজ’ মনে রেখেই লিখতে হয়। হুমায়ূন আহমেদ বা ইমদাদুল হক মিলনরা অবশ্য এই সাইজের ‘উপন্যাসের’ মূল প্রবর্তক, সুতরাং তাঁরা নিয়ম চালু রাখেন। আনিসুল হকরাও এই প্রথার ইচ্ছুক অনুগামী। বিপদ হয় অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ও নবীন লেখকদের এবং তাঁরাই নির্বিচারে বলির শিকার হয়ে থাকেন।

সর্বগ্রাসী বাণিজ্যমুখীনতার মুখে টিকে থাকতে হলে পত্রিকাগুলিকে নিশ্চয়ই বিক্রি এবং বিজ্ঞাপন নিতে হবে, সেগুলির ওপর নির্ভর করতেও হবে। কিন্তু লাগামছাড়া মুনাফার লোভে পড়ে নামী ও প্রতিষ্ঠিত পত্রিকারাও ঈদ সংখ্যায় ১২-১৪টি করে ‘উপন্যাস’ ছাপার প্রতিযোগিতায় নামলে তা শুধু হতাশার কারণ ঘটায়। আরেকটি বিস্ময়কর ঘটনা শুনেছি। আজকাল ঈদ সংখ্যা উপন্যাসগুলির প্রতি পাতার মাঝখানে ছোটো করে বিজ্ঞাপন থাকে, অনেক পত্রিকায় সেগুলি নাকি বিজ্ঞাপনদাতারা বরাদ্দ করেন লেখকের নাম-পরিচিতি দেখে। অর্থাৎ, এই লেখাগুলিও আসলে স্পনসর করা। কিন্তু স্বল্প-পরিচিত ও নবীন লেখকদের কে স্পনসর করবে?

প্রচলিত ও প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া এই রীতির ফলে বোদ্ধা পাঠকরা মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন, ঈদ সংখ্যার ‘উপন্যাস’ পড়ার আগ্রহ তাঁদের অন্তর্হিত হয়েছে অনেক আগেই। আর ‘গল্পের বই’ পড়া আর সব গড় পাঠকদের ধারণা জন্মাচ্ছে, এই বুঝি উপন্যাস! নিশ্চয়ই কারো কারো মনে এই প্রশ্নও উঠবে, তাহলে গল্প কাকে বলে!

উপন্যাসের তাহলে কী হবে? এখন একজন লেখক যদি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লিখতে চান, লেখাটি তিনি ছাপবেন কোথায়? ঈদ সংখ্যার অবস্থা তো জানাই হলো। কোনো পত্রিকার নিয়মিত সংখ্যায় উপন্যাস লেখার সুযোগ নেই। আমার জানামতে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের দুটি মাত্র পত্রিকা ধারাবাহিক উপন্যাস ছাপছে। মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘কালি ও কলম’ একই সঙ্গে দুটি ধারাবাহিক ছাপে – কে জানে কী কারণে তার একটি আবশ্যিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের লেখকের হয়ে থাকে। আর মাসিক পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাসে কারো আগ্রহ কীভাবে টিকে থাকে আমার জানা নেই। ‘দৈনিক সংবাদ’ হলো দ্বিতীয় পত্রিকাটি যেখানে সাময়িকী পাতায় ধারাবাহিক উপন্যাস ছাপা হচ্ছে। আগেই বলেছি, সাপ্তাহিকগুলি যেখানে তাদের নিয়মিত সংখ্যায় গল্প-কবিতাও ছাপে না, ধারাবাহিক উপন্যাসের আশা তাদের কাছে না করাই যুক্তিসঙ্গত। তাহলে? লেখক যাবেন কোথায়?

লেখার উদ্দেশ্যই হলো তা উদ্দিষ্ট পাঠকের কাছে পৌঁছানো। প্রকাশিত না হলে পাঠকের কাছে তা কী উপায়ে যাবে? প্রতিষ্ঠিত লেখক হলে সরাসরি প্রকাশকের কাছে চলে যেতে পারেন গ্রন্থাকারে বের করার জন্যে, নবীন লেখকের সেই বিলাসিতা নেই। লিখবো, কিন্তু তা কোথাও ছাপার উপায় নেই – তাহলে লেখক তাঁর উপন্যাসটি (পত্রিকার শূন্যস্থান পূরণের ‘উপন্যাস’ নয়) লেখার আগ্রহ কোথা থেকে পাবেন? উত্তর নেই। পত্রিকানির্ভর উপন্যাসের জন্যে কোথাও কোনো আলোর রেখাও নেই।

Saturday, June 21, 2008

মেয়েটা চলে যাবে!

দুপুরে একটা মিটিং আছে, তার আগে লাঞ্চ সেরে নেওয়ার কথা ভাবছি। এই সময় মেয়ের ফোন। উত্তেজিত কণ্ঠ তার।

বাবা, ইউটি অস্টিন আমাকে অ্যাকসেপ্ট করেছে।

তার আবেগ-উত্তেজনার অংশীদার আমিও। বলি, তাহলে তো একটা উৎসব করে উদযাপন করতে হয়।

আবেগে মেয়ের গলা বুজে আসছে। কোনোমতে বলে, আমি এতো খুশি! আমি কাঁদছি।

কোনোকিছুতে সম্পূর্ণ একাগ্রতা অথবা যুক্তিরহিত গোঁয়ার্তুমির সফল পরিণতি ঘটলে এরকম আবেগ চলে আসার কথা। মেয়ের ইচ্ছে, সে সাংবাদিকতা পড়বে। University of Texas at Austin-এর এ বিষয়ে সুনাম আছে। সেখানে সে আবেদন করে বসে থাকলো। কোনো কারণে এখানে তার ভর্তির ব্যবস্থা না হলে একটা বিকল্প থাকা যে দরকার, তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হলো। সে কানেও তোলে না। এক কথা তার, অস্টিনেই যাবো আমি। এই বোকা মেয়েকে নিয়ে করি কী! বিকল্প কিছু সে ভাবলোই না। ইউটি অস্টিনে আবেদন করার পর সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত সারাক্ষণ সে অনলাইনে তার আবেদনের ফলাফল এলো কি না দেখে। শেষ পর্যন্ত খবর পাওয়া গেলো গতকাল, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হিসেবে সে গৃহীত হয়েছে।

মেয়ের বাবা-মা হিসেবে আমরাও যে যথেষ্ট বোকা, তা এখানকার পরিচিত বাঙালিদের অনেকেই বিশ্বাস করেন। নিজে থেকে বলার দরকার হয় না, সামাজিক সাক্ষাতে প্রশ্ন শুনতে হয়, মেয়ে কী পড়বে? সাংবাদিকতা কেন, কমপিউটার বিজ্ঞান বা ব্যবসা প্রশাসন, নিদেনপক্ষে হিসাব বিজ্ঞান কেন নয় – এরকম পরোক্ষ হতাশা প্রকাশ করেন অনেকে। কেউ কেউ এমনও ইঙ্গিত দেন, বাবা-মা হিসেবে আমাদের উচিত এ বিষয়ে তাকে নির্দেশনা দেওয়া।

ক্যালিফোর্নিয়াবাসী এক কবিবন্ধু মেয়ের সাংবাদিকতা পড়ার আগ্রহ জেনে ঠাট্টা করে বলে, নাপতালিটা তুমিই করলে? তোমার লেখালেখির আগ্রহটা ওর মধ্যে দেখতে চাও, তুমিই ওকে উৎসাহ দিয়েছো।

কী করে বোঝাবো, সে নিজে তার জীবন যাপন করবে, আমরা নই। তার প্রবণতা ও আগ্রহের অনুগামী হবে সে, যে সুযোগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের বাবা-মা আমাদের দিতে চাননি, আমরা পাইনি। এই বিজ্ঞ শুভার্থীদের জানানোর দরকার মনে করি না যে, কথা ফোটার বয়স থেকে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের মতামত সবসময় মান্য না করলেও জিজ্ঞেস করার ব্যবস্থাটা চালু রেখেছি। এমনকি প্রতি বেলার খাবার কী চায়, তা-ও তাদের মর্জি অনুযায়ী হয় সাধারণত, তাদের কখনো বলা হয়নি, টেবিলে যা আছে তাই চুপচাপ খেতে হবে। আমাদের আত্মীয়-বন্ধুসহ অনেকে এটাকে বাড়াবাড়ি রকমের আদিখ্যেতা বলে মনে করেছেন, এখনো করেন।

এর বিপরীতে আমার অভিজ্ঞতা এরকম যে, সব বিষয়ে তাদের মত জানতে চাওয়া এবং তাদের মনোভাবকে মূল্য দেওয়ার একটা অসাধারণ ও অমূল্য প্রতিক্রিয়া ঘটে। তারা আত্মবিশ্বাসী হতে শেখে এবং তার প্রতিফলন ঘটে তাদের ব্যক্তিত্বে। তারা বুঝতে শেখে, তাদের আস্থায় নেওয়া হচ্ছে এবং সেই আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতি অনুগত হওয়াটাই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। বয়স যা-ই হোক, ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি সব মানুষকেই শুদ্ধ হতে সাহায্য করে।

এ দেশে টিন-এজারদের নিয়ে সব বাবা-মাকেই কিছু সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। অনভিজ্ঞতা ও অজ্ঞানতাজনিত এবং বয়সোচিত ছোটোখাটো দুয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে এই আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত মেয়ে আমাদের কিছুমাত্র হতাশ করেনি দেখে মনে হয়, ছেলেমেয়েদের বিষয়ে বোধহয় আমরা ভুল কিছু করিনি। মেয়ে বৃহত্তর পৃথিবীর জন্যে প্রস্তুত বলে বিশ্বাস করতে ভরসা পাই।

কবিবন্ধুকে বলা হয়নি, এই মেয়ে পনেরো বছর বয়সে One Hundred Years of Solitude, Chronicle of a Death Foretold, No One Writes to the Colonel পড়ে মার্কেজকে প্রিয় লেখকের তালিকায় তুলে ফেলেছে। কাফকার লেখা ও জীবন তার কাছে বিস্ময়ের আধার। ঝুম্পার The Namesake-এ সে নিজের সংকটের সাযুজ্য পেয়ে যায়। নিজের মতো লেখালেখিও করে, যদিও কাউকে দেখাতে অনিচ্ছুক সে। তার কিছু কিছু নজরে এলে মনে মনে স্বীকার করে নিয়েছি, ঐ বয়সে ওরকম উপলব্ধির বা লেখার ক্ষমতা আমার হয়নি। গত বছর তার একটি লেখার নমুনা সচলে তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি।

আসলে সে নিজেই নিজেকে তৈরি করেছে। বাবা-মা হিসেবে আমরা সেখানে শুধু সঙ্গত করে গেছি।

মেয়ে তার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে, এই প্রাথমিক আনন্দের আতিশয্য কেটে গেলে এক ধরনের বিষাদের মেঘ মাথার ভেতরে ঘন হয়ে উঠতে থাকে। মনে হয়, মেয়েটা চলে যাবে!

বেশি দূরে সে যাচ্ছে না, মাত্র দুশো মাইলের দূরত্বে। যাওয়া-আসা নিয়মিতই হবে। তবু এ-ও তো সত্যি, এই যে তার বাইরের পৃথিবীতে যাত্রা শুরু হলো, সে আর আমাদের কাছে ফিরবে না। একদা আমরাও আমাদের বাবা-মায়ের পরিচিত ছায়া থেকে বহির্গত হয়ে গিয়েছিলাম। আর ফেরা হয়নি। হয় না। আমাদের মেয়েরও সেই যাত্রা শুরু হবে এখন থেকে ঠিক দু’মাস পর।

মনে মনে রড স্টুয়ার্টের একটি গানের দুটি পঙক্তি আওড়াই (খুব ছোটোবেলায় এই গানটি মেয়ের প্রিয় ছিলো):

When you finally fly away
I’d be hoping that I’ve served you well
For all the wisdom of a lifetime
No one can ever tell…

Tuesday, June 17, 2008

‘পৌরুষ’ : একটি উপন্যাস ও তা নিয়ে সব কেচ্ছাকাহিনী

ঢাকা থেকে এক লেখক বন্ধু ফোনে বললো, দোস্ত, এবারে ঈদ সংখ্যার জন্যে গোটাচারেক উপন্যাস লিখে পাঠা, ছাপার দায়িত্ব আমার।

আমি বলি, পাগল নাকি? বড়োজোর একটা লেখার চেষ্টা করতে পারি।

আমার এই বন্ধু লেখার জন্যে চার হাত-পায়ের সবগুলিই ব্যবহার করে, নাহলে এতো বিস্তর লেখা তার পক্ষে সম্ভব কী করে বুঝে পাই না। চাইলেই মাসখানেকেরর মধ্যে চার-পাঁচটা উপন্যাস আমার পক্ষে লেখা সম্ভব, এই আস্থার জবাবে তাকে আস্তে করে বলি, দোস্ত, আমি তো তুই না!

এই ঘটনা ২০০৪ সালের। কষ্টেশিষ্টে একটা লেখা দাঁড় করানো গেলো। প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হচ্ছিলো, লেখার আকার যেন খুব বড়ো না হয়ে যায়। জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো, বেশি বড়ো হয়ে গেলে পত্রিকাওয়ালারা ছাপতে চায় না। বিজয়ের ১৪ পয়েন্ট সুতন্বী ফন্টে লেখাটা শেষ হলো ৬৭ পাতায়। যথাসময়ে পাঠানো হলো। ছাপা হলো সাপ্তাহিক ২০০০-এ। না, যেহেতু বড়ো লেখক নই, লেখাটি মূল ঈদ সংখ্যায় জায়গা পায়নি। ঐ পত্রিকা যে বাচ্চা ঈদোত্তর সংখ্যা বের করে ‘ঈদ সংখ্যা ২’ নামে, সেখানে ছাপা হয়েছে। তবু তো হলো!

মুদ্রিত পত্রিকার কপি হাতে এলে উল্টেপাল্টে দেখলাম। ধ্রুব এষ-এর ইলাস্ট্রেশন ভালো লাগলো। নিজের লেখা ছাপা হওয়ার পর পড়ার উৎসাহ এমনিতেই হয় না, তখন অন্য ব্যস্ততাও ছিলো বলে খুব একটা মনোযোগ দেওয়া হয়নি। একদিন পত্রিকার ঐ সংখ্যাটির পাতা ওল্টাতে গিয়ে চোখ আটকে গেলো এক জায়গায় – একটি পরিচ্ছেদ দেখছি মোট আট-দশ লাইনের। এতো ছোটো কোনো পরিচ্ছেদ লিখেছি বলে মনে পড়ে না তো! এখন আর না পড়ে উপায় নেই।

সংক্ষেপে বলি সেই হতভাগ্য লেখার পরিণতি। কোনোরকম যুক্তি-টুক্তির বালাই নেই, যত্রতত্র লাইনের পর লাইন নেই হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও বাক্য বা ঘটনার পরম্পরা খোঁজার চেষ্টা বৃথা। পুরো লেখাটি মিলিয়ে দেখা গেলো, ৬৭ পাতার মধ্যে ১৮ পাতা স্রেফ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এক-চতুর্থাংশই নেই। যে উপন্যাসের নাম ‘পৌরুষ’ তার এক-চতুর্থাংশ ছেঁটে দিলে আর কী থাকে – এই ধরনের রসিকতা করে সান্ত্বনা পাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই তখন।

বন্ধু খোঁজ করে সাপ্তাহিক ২০০০-এর একটা কৈফিয়ত আদায় করে আনলো যার সারকথা হলো, প্রুফ রীডাররা নাকি এইসব কাটাকুটি করেছে।

বটে! পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব এখন তাহলে প্রুফ রীডারদের হাতে চলে গেছে! প্রুফ রীডাররা সম্পাদক হতে পারবেন না এমন কোনো কথা নেই। বাংলাদেশেই প্রুফ রীডার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক হওয়া এবং প্রেস ইনসটিটিউটের মহাপরিচালক হওয়ার দুটি ঘটনা আমাদের জানা আছে। কিন্তু সম্পাদকের বর্তমানে প্রুফ রীডাররা সম্পাদনার কাজ করছেন, ভাবা যায়!

আসলে বাজে অজুহাত, দোষ প্রুফ রীডারদের নয়। মন খারাপ করা ছাড়া আর কী করা যায়!

এই লেখাটি নিয়ে যা ঘটেছে তার সঙ্গে সম্পাদনারও কোনো সম্পর্ক নেই। আমার লেখার একটি শব্দ বা বাক্যও পরিবর্তন করা হয়নি। বিষয়টি স্থান সংকুলানের। যখন একটি ঈদ সংখ্যায় ১৫/১৬টি 'সম্পূর্ণ উপন্যাস'-এর জায়গা করতে হয়, তখন সব লেখাগুলিকে দরকারমতো 'সাইজ' না করে উপায় থাকে না। আমার লেখাটিকে 'বরাদ্দ' করা নির্দিষ্টসংখ্যক পাতায় আঁটাতে গিয়ে কেটেছেঁটে দেওয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আমিই একমাত্র নই, আরো অনেকের বেলায় একই ঘটনা ঘটেছে।

গত বছর এপ্রিলে, ব্লগিং-এ তখন আমি নতুন, সামহোয়্যারে লেখালেখি করি, হঠাৎ মনে হলো ব্লগে উপন্যাসটা ধারাবাহিক পোস্ট করলে কেমন হয়? দুয়েকজনকে দেখেছি ধারাবাহিক উপন্যাস শুরু করেছেন, দু’তিন পর্বের পর তা আর এগোয়নি। আমার সে ভয় নেই, পুরোটাই তৈরি আছে। ব্লগে বেশি বড়ো লেখা পড়ার ধৈর্য কারো নেই, সুতরাং ৮০০ থেকে ৯০০ শব্দের ছোটো ছোটো কিস্তিতে ভাগ করা গেলো। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় দুটি করে কিস্তি পোস্ট দিয়ে মোট ৩৮ কিস্তিতে শেষ হয়েছিলো। সঠিক জানা নেই, তবে পুরনো ও অভিজ্ঞ দুয়েকজন ব্লগার জানিয়েছিলেন, বাংলা ব্লগে এটাই সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ হওয়া উপন্যাস।

লেখাটিতে সম্প্রসারণের প্রয়োজন এবং জায়গা দুই-ই ছিলো, এখনো আছে। ব্লগে পোস্ট করার উদ্দেশ্য ছিলো, পাঠক-প্রতিক্রিয়া যাচাই করা। মুদ্রিত পত্রিকার লেখা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানার আশা করা মরুভূমিতে তুষারপাতের আশা করার মতোই অলীক কল্পনা। মনে হলো, পাঠক-প্রতিক্রিয়া কিছু পেলে লেখার সংশোধনের সময় কাজে লাগবে। সে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়নি। যদিও সংশোধন-পরিবর্ধনের কাজ এখনো বকেয়া।

লেখাটি সম্পর্কে একটি মন্তব্য (হয়তো অভিযোগও) এসেছে যে, উপন্যাসের নারী চরিত্রটির ওপরে খানিকটা অবিচার করা হয়েছে, তাকে সবকিছুর জন্যে দোষী করে পুরুষ চরিত্রটিকে সাধূপুরুষ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই অভিযোগ আংশিক সত্যি। তার কারণও অবশ্য লেখার নামকরণেই পাওয়া যাচ্ছে – লেখাটি পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা, যদিও পুরুষ-চরিত্রের ভালোমন্দ, যুক্তি ও যুক্তিহীনতা, পৌরুষের অহং-এর ভঙ্গুরতা – এইসবই তুলে আনার চেষ্টা করেছি। অন্তত সেটাই উদ্দেশ্য ছিলো।

Saturday, June 14, 2008

যাচ্চলে!

সকালে হঠাৎই মনে এলো, যাচ্চলে!

আজ জুনের তেরো তারিখ, ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থ। ১৩ যে অশুভ সংখ্যা বা সেই তারিখ শুক্রবারে পড়লে তা বহুগুণ বেশি অশুভ ও ভয়ংকর – এইসব বিশ্বাস আমার আদৌ নেই। বিশ্বাস থাক বা না থাক, যথাসময়ে ও কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে এই বহু-প্রচলিত ধারণা বা বিশ্বাসগুলি মনে আসবে না, এমন কোনো ব্যবস্থা নেই। অন্ধকার রাতে হঠাৎ একটি কালো বিড়াল দেখলে কেউ খুশি হয়? একা একটি শালিককে দেখলে কি কিছু একটা মনে হয় না? দুটি শালিকে আবার অন্যরকম হয়ে যায়!

আমি জানি, শিরোনামে ব্যবহার করা শব্দ বা প্রকাশভঙ্গিটি বাংলাদেশে প্রচলিত নয়। পশ্চিমবঙ্গে খুব-একটা-ক্ষতি-নেই-তবে-হলে-ভালো-হতো ধরনের মৃদু আক্ষেপ বা হতাশার অনুভূতি প্রকাশে ব্যাপক চালু।

তবু আজ সকালে আমার ‘যাচ্চলে’ বলতে ইচ্ছে করলো জুনের ১০ তারিখটা ভুলে গেলাম বলে। গত বছর ঐ তারিখে আমার সচলে আসা। তখনো সচলায়তনের আনুষ্ঠানিক উন্মোচন হয়নি, হাতে গোনা কয়েকজনকে নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। নিজেকে সেই দলে অন্তর্ভুক্ত দেখে খুশি হয়েছিলাম, সম্মানিতও বটে। সেই হিসেবে আমি প্রাচীনতম সচলদের একজন।

কয়েক সপ্তাহ আগে ঠিক করে রেখেছিলাম, গত এক বছরের সচল নিয়ে আমার কথাগুলি লিখবো। অথচ দিনটা কীভাবে কখন এলো-গেলো, টেরও পেলাম না। মনে পড়লো তিনদিন পরে, টিউবলাইট আর কাকে বলে!

একেবারে গোড়া থেকে আমি সচলে যুক্ত ছিলাম না, এর পরিকল্পনা-প্রস্তুতি সম্পর্কেও কিছু জানতাম না। জেনেছি পরে, অরূপের স্বপ্নের শুরু যেভাবে পোস্ট থেকে। ব্লগে আমার লেখালেখির শুরু ২০০৭-এর জানুয়ারিতে, যখন ব্লগ সম্পর্কে আমার ধারণা খুবই ভাসা-ভাসা (এখনো খুব বেশি জানি-বুঝি, তা বলা কঠিন)। প্ল্যাটফরম সেই সময়ের একমাত্র বাংলা ব্লগিং কমিউনিটি সামহোয়্যারইন। জুনের প্রথমদিকে একদিন সেখানে দেখি অরূপ একটা পোস্ট দিয়ে আমাকে এমএসএনে ডাকছে। মন্তব্য করে জানাতে হলো, তখন আমি কর্মক্ষেত্রে, সম্ভব নয় (সেখানে ইন্টারনেটে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু চ্যাট-ইমেল ব্লক করা)। আরিফ জেবতিকের ইমেল-আমন্ত্রণও এলো। ১০ তারিখে আমি সচলায়তনের সদস্য।

এসে দেখি, এখানকার সবাই আমার পূর্ব-পরিচিত। ভার্চুয়াল পরিচয় আর কি। কাউকে চাক্ষুষ দেখিনি, ফোনে কথা বলাও নয়। তবু অপরিচিত নন কেউ, তাঁদের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে গেছে আগের ছয় মাসে। হয়তো আমাকেও সেভাবেই কিঞ্চিৎ চিনে নিয়েছিলেন তাঁরাও।

এক বছরে সচলায়তনের পরিধি বেড়েছে অনেক, নতুন নতুন লেখক এসেছেন, আসছেন এবং আরো আসবেন। আমার অনুমান, বয়সের হিসেবে আমি বোধহয় জ্যেষ্ঠতম সদস্য এখানে। তরুণতর এবং তরুণতমদের লেখা পড়ি, তাদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচয় হয়। অনেকের লেখা পড়ে রীতিমতো মুগ্ধ ও চমৎকৃত হই। এটা আমার একটা বড়ো প্রাপ্তি।

বর্তমান সচলদের মধ্যে সর্বার্থে আমার পূর্ব-পরিচিত পরে আসা রহমান ব্রাদার্সের তিনজন – লুৎফর রহমান রিটন, মাহবুবুর রহমান জালাল ও আরশাদ রহমান (দীর্ঘদিন অনুপস্থিত সে)। গত এক বছরে মাত্র আর একজনের সঙ্গে ঘণ্টাখানেকের চাক্ষুষ দেখা হয়েছে, তার নাম সুবিনয় মুস্তফী, গত মার্চে তার ডালাস সফরের সময়। ফোন-ইমেল-চ্যাটে এবং সচলের ব্যক্তিগত মেসেজে হিমু, মাহবুব মুর্শেদ, অরূপ, ইশতিয়াক রউফ, আনোয়ার সাদাত শিমুল, কনফুসিয়াস, নজমুল আলবাব এবং এরকম আরো অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। অথচ ভার্চুয়াল সম্পর্কের বিচারে কাউকে অচেনা লাগে না। পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এই ভার্চুয়াল বন্ধুদের (কনিষ্ঠ হলেও তাদের বন্ধু ভাবি) কারণে মনে হয়, যেখানেই যাই না কেন, একজন বন্ধুকে সেখানে পাওয়া যাবেই। সবখানেই আমার ঠাঁই আছে।

Thursday, June 12, 2008

বালক ও চার সৈনিক

এখন রোহনের মনে হচ্ছে, বাসে গেলে ভালো হতো। মা টাকা দিয়েছিলো সেই হিসেবে – যাওয়ার সময় বাসে, আর ট্রেনে ফেরা। সে জানে, মা প্রতিবার একই কথা বলবে, শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। প্রথমবার একা গিয়েছিলো, তখন তার ক্লাস এইটের অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তারপর দুই বছরে আরো চার-পাঁচবার। প্রথমবারের কথা স্পষ্ট মনে আছে। বাবা বললো, তোর বুলি ফুপু আসতে চায়। একা পারবে না, আমারও সময় হচ্ছে না, তুই যেতে পারবি?

রোহন রাজি, পারবে না কেন? কেউ সঙ্গে যাবে না, সে একা বড়োদের মতো যাবে!

মা অবশ্য আপত্তি তুলেছিলো, এই ভ্যাবলা ছেলে একা কোথায় যেতে কোথায় যাবে ঠিক আছে?

খুবই অপমানের কথা। মা তাকে কী ভাবে? এখনো ছোটো আছে সে? মাত্র পাঁচটা স্টেশন দূরের শান্তাহার থেকে ফুপুকে সঙ্গে নিয়ে আসা কী এমন কঠিন কাজ? সকালে গিয়ে বিকেলের মধ্যে ফিরে আসা, এই তো। সে একা একা সাইকেল নিয়ে সারা শহর ঘুরছে না? ওদিকে দত্তবাড়ি-শিববাটী-কালিতলা, এদিকে জলেশ্বরীতলা-মালতীনগর। করতোয়ার পাড়ে শ্মশানঘাটে কেউ দিনদুপুরেও যেতে চায় না, ভয় পায়। অথচ সে কতোদিন বিকেলে একা বসে থেকেছে সেখানে। নির্জন বলে। মা জানে?

বাবার মধ্যস্থতায় সেই প্রথম একা শান্তাহার যাওয়া। বিরাট জংশন, অনেক মানুষের ভিড়, ব্যস্ততা। কিন্তু অচেনা নয় একটুও। ছোটোবেলা থেকেই বছরে কয়েকবার বাবা-মায়ের সঙ্গে এখানে যাতায়াত। দাদাবাড়ি যাও তো শান্তাহার। নানাবাড়ি যাও, তা-ও শান্তাহার হয়ে। স্টেশন থেকে কলসা পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ। বুলবুলি ফুপুর নাম কী করে যেন বুলি হয়ে গেছে। বুলবুলি নামটা কী সুন্দর! ভালো জিনিসকে কেটেছেঁটে মানুষের যে কী আনন্দ, রোহনের মাথায় আসে না। কলেজে পড়া বুলি ফুপু রোহনের চেয়ে বছর চারেকের বড়ো। ছুটিছাটায় ভাইয়ের বাড়িতে আসার জন্যে ব্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু দাদা কিছুতেই তাকে একা আসতে দেবে না, চাচারাও না। কাউকে গিয়ে আনতে হবে। অথবা ও বাড়িতে কারো সময় হলে ফুপুকে পৌঁছে দিয়ে যাবে।

আজ মায়ের হাত থেকে টাকা নিচ্ছে, মনে মনে রোহন তখনই জানে সে ট্রেনে যাবে। বাসে গাদাগাদি করে কে যায়! থামে যেখানে-সেখানে, জায়গা না থাকলেও যাত্রী তোলে। অথচ দুপুরের লোকাল ট্রেনে ভিড় বেশি থাকে না, মাঝেমধ্যে একেবারে ফাঁকা কামরা পাওয়াও অসম্ভব নয়। ফেরার পথে বরাবর ট্রেনে ফেরা হয়, বুলি ফুপু বাসে একদম উঠতে চায় না, তার বমি পায়।

বয়সে বড়ো হলেও বুলি ফুপুর সঙ্গে রোহনের জমে খুব। শ্যামলা ছোটাখাটো দেখতে বুলি ফুপু কী সুন্দর! হাসলে তার চোখ দুটোও হেসে ওঠে, গালে টোল পড়ে, আরো সুন্দর লাগে। গল্পের বইয়ে পড়া হাসিতে মুক্তা ঝরা তখন চোখের সামনে। ট্রেনে বসে অনেক গল্প করে ফুপু। কোন বান্ধবীর বিয়ে হলো, বর কেমন, কলেজে কোন স্যারের ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করে না স্যার কেমন করে তাকায় বলে – এইসব নানা কথা। রোহনও তার গল্পের ঝুলি খুলে দেয়। বড়োদের মধ্যে এক বুলি ফুপু ছাড়া এতো মনোযোগ দিয়ে তার কথা আর কেউ শোনে না।

আরেকটা খুব গোপন কথা আছে, কাউকে বলা যাবে না। সে নিজেই ঠিক বোঝে না, বলবে কী! ট্রেন থেকে নেমে বাসায় ফেরার জন্যে রিকশা নেওয়া হয়। পাশাপাশি বসে বুলি ফুপুর গায়ের স্পর্শে কীরকম যেন একটা অনুভূতি হয়, শরীরে কিছু একটা শিহরণের মতো বোধ। আড়চোখে বুলি ফুপুর মুখের দিকে তাকায় রোহন, সেখানে কোনোকিছু লেখা নেই।

আজ টিকেট কেটে স্টেশনে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। ট্রেন প্ল্যাটফরমে এসে থামলে রোহন দ্রুত পায়ে হেঁটে একবার টহল দেয়। পেছনের দিকে একেবারে ফাঁকা একটা কামরা। সে অপেক্ষা করে, অন্য কোনো যাত্রী উঠে পড়তে পারে। কেউ আসে না। গার্ডের বাঁশি বাজার পর ট্রেনটা চলন্ত হওয়ার আভাস দিলে রোহন ফাঁকা কামরার একমাত্র যাত্রী হিসেবে উঠে পড়ে। আঃ, কী আনন্দ! প্রথম দুটো স্টেশন নিজের মতো করে সে একা। পুরো রাজ্যের একচ্ছত্র দখল, ভাগ বসানোর কেউ নেই। স্টেশন ছেড়ে যেতেই একবার এই সীটে বসে, উঠে গিয়ে আবার ওই সীটে। জানালার পাশে বসে মাথা বাইরে ঠেলে দিলে হু হু বাতাসে চুল ওড়ে। উদ্দাম বাতাস পারলে চোখ বুজিয়ে দেয়। আশেপাশে কেউ না থাকলে গলা ছেড়ে গান গাইতে কোনো অসুবিধা নেই। চলন্ত ট্রেনের শব্দের তলায় নিজের গলা যে কোনো বিখ্যাত গায়কের মতো হয়ে যায় – অর্ণব বা হাবিব, অঞ্জন অথবা নচিকেতা। গানগুলো ঠিকমতো সুরে খেলে, তখন গানগুলো তার নিজের। খোলা চোখেও মনে মনে রোহন দেখে, মঞ্চে উঠে একটার পর একটা গান করছে সে, একেকটা গানের শেষে শ্রোতাদের হাততালি ও উল্লাস।

আলতাফনগরে ট্রেন থামলে চারজন লোক এই কামরার নতুন যাত্রী হয়ে উঠে এলো। তাদের পরণে ছোপ-ছোপ জলপাই সবুজ পোশাক। পোশাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিহ্ন আঁকা, বুকের বাঁ দিকে নাম লেখা ট্যাগ। পায়ে বুট, হাতে রাইফেল।

কাঁধে ঝোলানো ব্যাকপ্যাক নামিয়ে লোকগুলো রোহনকে দেখে। চার জোড়া চোখ একত্রে। রোহনের অস্বস্তি হয়, চোখ নামিয়ে ফেলে সে। মুখ ঘুরিয়ে জানালার বাইরে চোখ ফেলার আগে আড়চোখে দেখে, সৈনিকরা তখনো তাকে দেখছে। কী এমন দর্শনীয় বস্তু হয়ে গেলো সে?

এতো কাছে থেকে কোনো সৈনিককে কখনো দেখেনি রোহন। অবশ্য আলাদা করে দেখার কী আছে তা-ও বোঝে না। লোকগুলোর পোশাক-আশাক আলাদা, চুল খুব ছোটো ছোটো করে ছাঁটা – এই তো। অন্যসব মানুষের চেয়ে আর কিছুতে আলাদা লাগে না। তবু ঠিক যেন একরকমও নয়। কোথাও তারা অন্যরকম। সামনাসামনি না দেখলেও শোনা কথা কম নেই। রোহনের জন্মেরও অনেক বছর আগে এ দেশে যুদ্ধ হয়েছিলো, পাকিস্তানী সৈন্যদের নিষ্ঠুরতার গল্প সে শুনেছে বাবার কাছে। অকারণে তারা পাখি মারার মতো মানুষ মারতো, দুধের শিশুকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে বেয়োনেটের ডগায় গেঁথে ফেলার গল্প শুনে রোহনের অসহ্য লেগেছিলো। সে জানে, তারা ছিলো অন্য দেশের সৈন্য। রোহন নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে, ওদের সঙ্গে তার কখনো দেখা হয়নি। কেমন ছিলো দেখতে তারা? এই লোকগুলোর মতোই? না অন্যরকম? বাবা আজও মিলিটারি একদম সহ্য করতে পারে না।

রোহনের মনে হয়, এই চারজন আমাদের দেশের সৈনিক। তারা নিশ্চয়ই পাকিস্তানীদের থেকে আলাদা। অতো নিষ্ঠুর হওয়া এদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবু স্বস্তি পাওয়া যায় না। বাবাকে বলতে শুনেছে, বছরখানেক ধরে সৈনিকরাই আড়ালে থেকে দেশ চালাচ্ছে। সেনানায়কের চেহারা সেজন্যেই আজকাল এতো ঘন ঘন টিভিতে দেখা যায়। অন্য হোমরা-চোমরা যাদের দেখা যায়, তারা তারই হুকুমে ওঠে-বসে, যা বলে তাই শোনে। তারাও এক হিসেবে সৈনিকদের হুকুমের দাস সৈনিক হয়ে গেছে, শুধু সাজপোশাকে তারা আলাদা।

কয়েকবার এরকম নাকি হয়েছে এ দেশে, তখনো রোহনের জন্ম হয়নি। এতোকিছু তার বোঝার কথা নয, তবে বাবা ভুল কিছু বলেনি – সেনানায়ককে যে খুব আজকাল টিভিতে দেখা যায় তা সে লক্ষ্য করেছে। কিছুদিন আগেও এরকম ছিলো না, তা-ও বেশ মনে আছে। সামনে বসা লোকগুলো সেই ক্ষমতাবানের প্রতিনিধি বলেই এরকম অস্বস্তি? সে নিতান্ত এক নিরীহ স্কুলছাত্র, তাকে ভালো ছেলে বলে সবাই জানে। তার ভয় কীসে? তবু বলা যায় কিছু? তারা যা খুশি করতে পারে শোনা যায়। ঢাকায় ছাত্রদের সঙ্গে তাদের গোলমালের কথা খবরের কাগজেই পড়েছে। শিক্ষকদের ধরে জেলে আটকে রাখা হলো কতোদিন! কোনো দোষ না করেও নিজেকে খুব নিরাপদ ভাবা চলে কি না, কে জানে!

ট্রেন এখন ছুটছে শস্যভরা উন্মুক্ত মাঠের বুক চিরে। ক্ষেতে কর্মব্যস্ত কৃষক। রেললাইন বরাবর সরু অগভীর জলাশয়, টেলিগ্রাফের তারে বসা নানা জাতের পাখি। হঠাৎ রোহনের চোখে পড়ে, আকাশে ছোটো একখণ্ড কালো মেঘ মাঠের এক জায়গায় ধূসর ছায়া ফেলেছে। তার চারপাশ সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় আলোময়। ধূসর ছায়াটা স্থির হয়ে নেই, বাতাসে মেঘ সরে সরে যায়, সঙ্গে ধূসর ছায়া। ‘শরতের মিছা মেঘ’ কথাটা কোথাও লেখা দেখেছিলো, এখন মনে আসে। এই মেঘ শুধুই মেঘ, বৃষ্টি ঝরানোর ক্ষমতাও নেই।

বাইরে থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে রোহন সৈনিকদের দিকে তাকায়। চারজন পাশাপাশি বসা। এতোক্ষণ নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি করছিলো, রোহনের মুখ ফেরানো যেন সবাই একসঙ্গে টের পেয়ে এখন আবার তাকে নজর করে দেখছে। কী দেখে তারা? কেন?

ঘন গোঁফওয়ালা সৈনিক, চারজনের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে বেঁটে, হঠাৎ রোহনের দিকে তাকায়। তার ঠোঁটটা কি একটু নড়ে উঠলো? লোকটা মুচকি হাসি হাসলো? হয়তো দেখার ভুল। গোঁফওয়ালার পাশের জন রোহনের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে। লোকটার চোখগুলো কী তীব্র, যেন ভেতরটা ভেদ করে সব দেখতে পাচ্ছে। রোহনের বুকে ধুকপুক যে একটু বেশি জোরে হচ্ছে, লোকটা কি টের পেয়ে গেলো? চোখ সরিয়ে না নিয়ে তার উপায় কী! সে বুঝতে দেবে কেন? নিজেকে বোঝায়, সে একটুও ঘাবড়ায়নি। তবে কিছু একটা আছে, তাকে নিশ্চিন্ত থাকতে দিচ্ছে না। ভেতরটা আপনা থেকেই টানটান হয়ে আছে।

লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে কথায় ব্যস্ত হয়ে গেছে। সবই কানে আসছে, অথচ ভেতরের উৎকণ্ঠায় রোহন কিছুই শুনতে পায় না। তাদের সম্মিলিত উচ্চকণ্ঠ হাসি শোনা যায় এবার। রোহন ফিরে তাকায় সৈনিকদের দিকে। চার জোড়া চোখ তাকে দেখছে। মানুষের হাসির শব্দ যে এতো বিরক্তিকর ও অনাকাঙ্ক্ষার বিষয় হতে পারে, তার জানা ছিলো না। তার চেয়ে বড়ো কথা, তাদের চাউনি রোহনের ভেতরের অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিচ্ছে। পরের স্টেশনে ট্রেন থামলে নেমে যাবে স্থির করে সে, অন্য কোনো কামরায় উঠে পড়লেই হলো, তারপরে একটা তো মোটে স্টেশন। এখন তার আক্ষেপ হয়, মায়ের কথা মান্য করে বাসে গেলেই ভালো হতো।

এ্যাই ছেলে, তুমি কই যাইতেছো?

প্রশ্নটা তাকেই করা হয়েছে বুঝতে সময় লাগে রোহনের। দাড়িগোঁফে আচ্ছন্ন মুখের সৈনিক প্রশ্নকর্তা। তার ওপরে নিবদ্ধ চার জোড়া চোখকে তার হঠাৎ ক্ষুধাকাতর বাঘের চোখের মতো লাগে। খুব আড়ষ্ট বোধ করে সে। ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠে, শরৎকালের রোদ ঝলমল দিনেও তার শীত শীত করে।

তার অনিশ্চিত কণ্ঠস্বর থেকে একটিমাত্র শব্দ নিঃসৃত হয়, শান্তাহার।

একলা ক্যান? বাড়ি পলাইছো?

রোহন না-সূচকভাবে দুইদিকে মাথা নাড়ে। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, চোখগুলোকে আর তার সহ্য হচ্ছে না। এই ভয়ের অনুভূতি আর বহন করা যাচ্ছে না।

ট্রেনের গতি কমে এসেছে, আদমদীঘি স্টেশন এসে পড়লো। এবার নেমে যাওয়া দরকার। উঠে দাঁড়াবে ভাবছে, তখন তার হাত-পা স্থির হয়ে যায়। একটা কথা মনে পড়ে গেছে। একটু আগে সে শান্তাহার যাবে বলেছে, এখন আদমদীঘিতে নেমে যায় কী করে? ওদের অনুমান, সে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। এখানে নামতে চাইলে ওদের সন্দেহ আরো মজবুত হবে। নিজের ওপর মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সে, কী দরকার ছিলো শান্তাহার বলার? এই তো যাচ্ছি আর কী – এই ধরনের একটা অনির্দিষ্ট উত্তরও তো দেওয়া যেতো। এখন থাকো বসে!

প্রায়-দুপুর রোদে আদমদীঘি স্টেশনের প্ল্যাটফরমে লোকজনের ভিড় বেশি নেই। মুখ বাড়িয়ে রোহন যাত্রীদের ওঠানামা দেখে। একবার ভাবে, ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে এক দৌড়ে নেমে গেলে কেমন হয়? ওরা তখন আর তার পিছু নেবে না নিশ্চয়ই। কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে অন্য কামরায় উঠে পড়া যদি না যায়? তখন আদমদীঘিতে বসে থাকতে হবে, পরের ট্রেন যে কখন তা-ও জানা নেই। বুকভরা অস্বস্তি-উৎকণ্ঠা, ভয়-দুঃখ-ক্রোধ মিলিয়ে রোহনের এখন কাঁদতে ইচ্ছে করছে। অথচ মনে হচ্ছে, তার ভয় করবে কেন? এই ভয়ের কোনো মানে নেই।

পান-বিড়ি-সিগারেট হেঁকে যাওয়া হকারকে হাত তুলে ডাকে রোহন। এক শলা সিগারেট আর একটা দেশলাই কেনে। এখন ধরাবে। এক মুহূর্ত আগেও ভাবেনি, এখনো স্পষ্ট জানে না সে কেন কিনলো। ধরিয়ে টানা পরের কথা, সিগারেট জীবনে কখনো সে ছুঁয়েই দেখেনি। বয়স্ক কারো সামনে সিগারেট খাওয়াও চলে না। অথচ কামরার উল্টোদিকে বসা চারজনকে সে এখন সম্পূর্ণ অস্বীকার ও অবজ্ঞা করতে ইচ্ছুক। যেন তারা একেবারে নেই।

একবার মনে হয়, জীবনে কখনো সিগারেট না-ধরা হাতে দেশলাই-সিগারেট সামলাতে পারবে তো? পারবে, অন্যদের ধরাতে দেখেছে। সিগারেটটা দুই ঠোঁটের ফাঁকে রেখে দেশলাইয়ে কাঠি ঠুকে দেয় রোহন। এই তো আগুন জ্বলেছে। জ্বলন্ত দেশলাই-কাঠির দিকে চোখ স্থির করে সে।

ট্রেন চলতে শুরু করেছে। চার সৈনিকের দিকে একবারও ফিরে তাকায় না রোহন। এখন তার কোনো উৎকণ্ঠা নেই, একটুও ভয় করছে না।

Sunday, June 8, 2008

শহীদ কাদরী গুরুতর অসুস্থ

নিউ ইয়র্কে প্রবাসী কবি শহীদ কাদরী দীর্ঘকাল ধরে দুই অকেজো কিডনি নিয়ে চিকিৎসাধীন। একটি কিডনি প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় আছেন পাঁচ বছর। সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালিসিস তাঁকে সীমিতভাবে সচল রেখেছে। সপ্তাহ দেড়েক আগে পিঠে অসহ্য ব্যথা বোধ করলে তাঁকে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে নেওয়া হয়। দু’দিন আগে তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হয়েছে একাধিক গুরুতর শারীরিক জটিলতার কারণে। তখন থেকে তাঁকে সিসিইউ-তে পর্যবেক্ষেণে রাখা হয়েছে, নানাবিধ পরীক্ষা চলছে।

রক্তে সংক্রমণ ও নিচু রক্তচাপ চিকিৎসকদের সবচেয়ে বেশি চিন্তায় রেখেছে। হার্টবিট নেমেছে ৪৭-এ। অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। এপিলেপসির লক্ষণও দেখা গেছে, পরশু এবং আজ সিজার হয়েছে। নিউরোলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। তবে রক্তচাপ স্বাভাবিকের কাছাকাছি না এলে তা করা সম্ভব হবে না।

এইসব জটিলতার কারণে নিয়মিত ডায়ালিসিস করা যাচ্ছে না, করা হচ্ছে আংশিক। একটাই হয়তো ভালো খবর, তাঁর হার্টে কোনো গোলযোগ পাওয়া যায়নি। সেটা হলে দুর্যোগ আরো বড়ো ও জটিল হতে পারতো।

শারীরিক এতোসব সংকট সম্পর্কে আমার ধারণা প্রায় শূন্য, তবে কবির অসুস্থতা যে গুরুতর তা কোনো বালকও বুঝবে। নীরা ভাবী ফোনে যা জানিয়েছেন, তাই বয়ান করছি। শহীদ ভাইয়ের অনুরাগী-শুভার্থীদের খবর জানাতে অনুরোধ করে তিনি বললেন, আমি নিজেও অসুস্থ, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। সবাইকে এইসব বলতে বলতে আমি ভেঙে পড়ছি। কেউ যদি আমাকে এখন কিছু জিজ্ঞাসা না করেন, তাহলে সবচেয়ে ভালো হয়।

শহীদ কাদরী আছেন লং আইল্যান্ড জ্যুয়িশ হাসপাতালের সিসিইউ-এর ১৩ নম্বর কক্ষে। নিউ ইয়র্কবাসী কেউ ইচ্ছে করলে হাসপাতালে যেতে পারেন। হাসপাতালে ফোন (৭১৮.৪৭০.৭০০০) করলে ঠিকানা ও দিক-নির্দেশনা পাওয়া যাবে।

ডাক্তাররা বলেছেন, শহীদ ইজ আ ফাইটার।

আমরা চাই, যোদ্ধা যেন জয়ী হয়ে ফেরেন।

যাঁরা বিশ্বাসী, তাঁরা প্রার্থনা করতে পারেন কবির জন্যে। আর আমরা অবশিষ্টরা উদ্বেগ-ঊৎকণ্ঠা নিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকা ছাড়া আর কী করতে পারি?

-----------------
জুন ০৭, ২০০৮
-----------------

Tuesday, June 3, 2008

কী করতে চাই আর কী করি

কলেজে ভর্তি হওয়ার অল্পকালের মধ্যেই প্রেমে পড়ি। ঐ বয়সে সবাই যেমন পড়ে। সম্পর্কটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কিন্তু সেই সময়ের একটি অভ্যাস আমার চিরকালের সঙ্গী হয়ে গেলো। অভ্যাসটি রাত্রি জাগরণের।

প্রেমের সঙ্গে রাত্রি জাগরণের খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা আছে, ভুক্তভোগীরা এই সাক্ষ্যই দেবেন। আমার পক্ষেও ব্যতিক্রম হওয়া সম্ভব ছিলো না। অভ্যাসটি এমনই হয়ে গেছে যে কখন ঘুমাতে যাবো তা সম্পূর্ণ আমার ইচ্ছে। কিন্তু বিপদ হয় জেগে ওঠার সময়, তার নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে নেই। ভোরবেলার অ্যালার্মঘড়ি আমাকে জাগায়, যেহেতু জীবিকা নির্বাহের জন্যে একটি কর্ম আমাকে করতে হয় এবং সেখানে সকালেই হাজিরা দেওয়া বাধ্যতামূলক।

প্রাতঃকালের জাগরণটি ততোটা রূঢ় যাতে না হয়, সেজন্যে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়ে গেছে। কর্কশ ক্যাঁ ক্যাঁ আওয়াজের অ্যালার্মের বদলে রেডিওর গান ঘুম ভাঙাবে, এই আশায় রেডিওসহ অ্যালার্ম ঘড়ি এলো। কিন্তু যে গানটি তখন বাজছে তা আমার খুব অপছন্দের হলে? সাতসকালে গানের বদলে তারস্বরে বিজ্ঞাপন শুনে ঘুম ভাঙলে তা-ও খুব সুখের হয় না। এরপরে একটি অ্যালার্মঘড়ি কেনা হলো যেখানে ইচ্ছে করলে সমুদ্রের কল্লোল শোনা যাবে, অথবা পাখির ডাকে নিদ্রাভঙ্গ হবে।

কিছুই আসলে বদলায়নি। একই অনিচ্ছা ও বিরক্তি নিয়ে সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠি। বিছানায় উঠে বসে প্রতিদিন ভাবি, আজ কাজে না গেলে কী হয়? অথবা একেবারে কাজ না করতে হলে? কাজ ছেড়ে দিলে?

গ্রাসাচ্ছদনের চিন্তা আসে, পরিবারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয়। অনিচ্ছুক শরীর ও মনকে প্রস্তুত করতে হয় আরেকটি দিনের জন্যে।

জীবন নির্বাহ করার জন্যে কাজ করতে না হলে কী করতাম আমার একেকটি দিন নিয়ে? আহ, কতো দীর্ঘ সেই ইচ্ছেগুলির তালিকা!

শয্যা ত্যাগ করা যেতো অ্যালার্মের নির্দেশ ছাড়া, ঘুমের বরাদ্দ আদায় পূর্ণ হলে। জানালার পর্দা সরালে আলোয় আলোময় একটি ঝলমলে দিন বাইরে। মেঘলা হলেই কী এমন ক্ষতি? অথবা হোক না যে কোনো রকমের বৃষ্টি - ঝিরঝিরে বা ঝমঝম।

পড়বো বলে জমিয়ে রেখেছি অগণন বই, তার একটা খুলে বসা যায়। অসংখ্য সিডি কেনা আছে, অনেকগুলি বছরের পর বছর ধরে পড়ে আছে সেলোফেনের মোড়কমুক্ত হওয়ার অপেক্ষায়। আমার মেয়ে জিজ্ঞেস করে, শোনো না, তাহলে কিনেছো কেন?

আমি তাকে বলি, এগুলি আমার অবসর জীবনের সঞ্চয়। মানুষ টাকাপয়সা জমায়, আমি রাখি বই আর গানের সঞ্চয়।

বিকেলে ছেলেকে নিয়ে পার্কে যাওয়া যায়। তার খুব ইচ্ছে, একা একা বাস্কেটবল প্র্যাকটিস করার বদলে বাবাও তার সঙ্গে থাকবে। স্ত্রীর ইচ্ছে একত্রে কোনো সিনেমা দেখতে যাই, অনেক বছর হয়নি। চাইলে তাদের ইচ্ছেপূরণ ঘটানো যায়।

না-লেখা ও অসমাপ্ত গল্প-উপন্যাসগুলি লিখতে বসতে পারি। গভীর রাত পর্যন্ত একটানা লিখবো। ভালোমন্দ যা-ই হোক, একেকটি লেখা শেষ করার কী গভীর পরিতৃপ্তি! সেই স্বাদ কতোদিন পাওয়া হয়নি।

প্রকৃতপক্ষে কোনোকিছুই ঘটে না। সঞ্চয় করে রাখা বইয়ের বদলে অফিসে বসে এটা-ওটার ম্যানুয়াল পড়ি, ইমেল পড়ি। গান শোনার বাসনা ত্যাগ করে হেডফোন কানে লাগিয়ে কনফারেন্স কলের অনন্ত বকরবকর শুনি। লেখালেখিও হয় বটে। নালিশ এটুকুই, লিখতে হয় যা লিখতে চাই না।

দিনের শেষে জগতের সমস্ত অবসাদ নিয়ে ঘরে ফিরে স্ত্রী বা ছেলের বাসনা পূরণের ধারেকাছেও যাওয়া হয় না। সবশেষে একটু রাতে যখন অবসর মেলে, কমপিউটারের সামনে বসি। মনে ক্ষীণ আশা, আজ কয়েক পাতা লিখবো। হয় না, ইমেল-ইন্টারনেট সে সময়টুকু গ্রাস করে ফেলে। এইসব শেষ হলে তখন মনে হয়, আজ থাক, কাল থেকে ঠিক ঠিক হবে।

সেই আগামীকালের আশাটুকুই এখনো জাগ্রত।