Wednesday, May 28, 2008

আপনি তুমি বা তুই

অন্তত দুটি দম্পতিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি যাঁরা পরস্পরকে তুই করে বলেন। আমাদের মধ্যবিত্ত নাগরিক সংস্কৃতিতে স্বাভাবিক তো নয়ই, রীতিমতো ব্যতিক্রম ও বিপ্লবাত্মক। এর বিপরীতে এমন উদাহরণও জানি যেখানে বিবাহপূর্বকালে দু’জন দু’জনকে তুই-তোকারি করতেন, বিবাহের আনুষ্ঠানিকতার ফলে তা তুমিতে উত্তীর্ণ হয়ে প্রথাসিদ্ধ রূপ পেয়ে গেছে।

ঠিক জানা নেই, তবে পৃথিবীর খুব বেশি ভাষায় আমাদের মতো আপনি-তুমি-তুই এরকম তিন স্তরের সম্বোধন আছে বলে মনে হয় না। হিন্দি-ঊর্দূতে আছে জানি।

বাংলাদেশে যে কোনো শহরের বাইরে দুই পা গেলে অবশ্য অন্য বাস্তবতা। গ্রামবাংলায় আজও পুরুষরা সচরাচর বউদের তুই করে বলেন, যদিও মেয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বামীদের (স্বামী শব্দটি আমার ভয়ানক অপছন্দ, অথচ যুৎসই বিকল্পও নেই) তুমি, এমনকি আপনি বলে সম্বোধন করে থাকেন। কখনো কখনো আপনি-তুমির সীমানা বাঁচিয়ে ভাববাচ্যে বলা হয়। স্বামী বলে কথা, যার অর্থ প্রভু। আজকাল অবশ্য কিছু লেখাপড়া জানা মানুষও গ্রামে বসবাস করেন, তাঁরা আবার এই নিয়মের ব্যতিক্রম – বউকে তুই-তোকারি করা অরুচিকর ও অশোভন, বিবেচনা করেন। তাঁদের মনোভাব শহরের তুমি-সংস্কৃতির অনুসারী হয়ে স্বস্তি বোধ করে।

এই কিছুকাল আগেও গ্রামাঞ্চলে বাবা-মা, চাচা-চাচী, দাদা-দাদী, নানা-নানী, ভাই-ভাবী বা গ্রামের বয়স্ক মুরুব্বীদেরও তুই বলা কিছুমাত্র অস্বাভাবিক ছিলো না, অসঙ্গত বলেও গণ্য হতো না। আর ভাইয়ে-ভাইয়ে বা ভাইবোনের মধ্যে তুই ছাড়া কিছু তো হিসেবের বাইরেই ছিলো। আমাদের বাড়িতে ভাইবোনদের মধ্যে পরস্পরকে তুই/তুমি বলার চল, আব্বা-আম্মাকে আপনি। ওইরকমই আমাদের শেখানো হয়েছিলো, যেমন হয়েছিলো বাবা-মা সম্বোধনের পরিবর্তে আব্বা-আম্মা। আমাদের গ্রামের বাড়ির আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ভাইবোনকে তো বটেই, মাকে তুই বলা আজও প্রায় সর্বাংশেই চালু আছে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নিয়মিত আড্ডায় আমাদের ঘনিষ্ঠ পাঁচ বন্ধুর মধ্যে আপনি/তুমি/তুই-এর এক খিচুড়ি প্রচলিত ছিলো। আমাকে বাদ দিলে অন্য চারজন ছিলো হাবিব, সিরাজ, মিলন ও সারোয়ার। বয়সের পার্থক্য অবশ্য ছিলো, কিন্তু তারপরেও আপনি/তুমি/তুই-এর যুক্তিসঙ্গত হিসেব মেলানো কঠিন। হাবিব আর্ট কলেজের ও সিরাজ বুয়েটের পড়াশোনা শেষ করেছে আগেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া সারোয়ার ও আমি সমবয়সী। মিলন জগন্নাথ কলেজের এবং আমাদের এক বছরের ছোটো, সিরাজ তিন বছরের ও হাবিব ছয় বছরের বড়ো।

হাবিবের সঙ্গে আমাদের প্রত্যেকের আপনি চলে। বয়োজ্যষ্ঠ হিসেবে হাবিবের পক্ষে আমাদের সবাইকে তুমি, এমনকি করে বলা স্বাভাবিক ও সঙ্গত হতো। কিন্তু হয়নি। সিরাজ-মিলনের মধ্যে তুই-সম্পর্ক। সিরাজের সঙ্গে আমার ও সারোয়ারের আপনি। আমার সঙ্গে মিলনের তুই চলে, সারোয়ারের সঙ্গে আপনি। আপনি সম্বোধনের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে সিরাজ একদিন এই মর্মে এক তত্ত্ব উপস্থিত করে যে, আপনি বললে কিছু দূরত্ব বজায় রাখা যায় এবং পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ অটুট থাকে। তুই-তোকারির বন্ধুকে শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দেওয়া যায়, আপনি সম্বোধনের কাউকে শুয়োরের বাচ্চা বলা সম্ভব নয়।

সৌম্য দাশগুপ্ত কবি। বয়সে অনেক ছোটো হলেও সে আমার বন্ধুস্থানীয়। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতা শহরে। তার বাবা বরিশালের, মা চট্টগ্রামের (সেই বাবদে সে চট্টগ্রামের আহমদ ছফাকে মামা বানিয়ে ফেলেছিলো)। সৌম্য সামগ্রিকভাবে নিজেকে বাঙালি এবং আধা-বাংলাদেশী বলে পরিচয় দেয়। আংশিকভাবে তা পিতামাতার জন্মভূমির সূত্রে, বাকিটা বাংলাদেশের বিস্তর মানুষজনের সঙ্গে তার অতি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সম্পর্কের কারণে। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, বাংলাদেশে আমার চেয়ে তার চেনাজানা বেশি।

পরিচয়ের শুরুতে সৌম্যকে আপনি বলতাম। একদিন সে তুমি করে বলার অনুরোধ করলে আমি তাকে কিছুটা অবাক করে বলি, আমাকে জুবায়ের ভাই ডাকো ঠিক আছে, কিন্তু আমাকেও তুমি করে বলবে।

অবাক হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে সে বলে, বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে আপনি-আপনি বলার প্রবণতাটা খুব বেশি দেখি। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও পরস্পরকে আপনি বলেন দেখেছি। অথচ পষ্চিম বাংলায় অত্যন্ত দূরবর্তী বা শিক্ষক ও গুরুস্থানীয় কেউ না হলে আপনি বলা হয় না।

পশ্চিম বঙ্গে বাস্তবতা আসলেও তাই। বয়স্করা শিশুদের অবধারিতভাবে তুই করে বলবে। বাবা-মা ও অন্য সব বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়-পরিজনকে তুমি বলার রেওয়াজ। আপনি দিয়ে শুধু সম্পর্কের দূরত্ব বা শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশিত হবে। সেখানেও বন্ধুদের মধ্যে কোথাও কোথাও আপনি সম্বোধন বলবৎ থাকে, তবে তা ব্যতিক্রম বলেই ধরা হয়।

আমাদের দেশেও শহরাঞ্চলে কিছু বদল ঘটেছে। আজকাল শিশুরা বাবা-মাসহ বড়োদের আপনির চেয়ে তুমি বেশি বলে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তুই-তুমি প্রাধান্য পাচ্ছে। এগুলি চমৎকার ও সহজ সম্পর্কের নির্দেশক বলেই আমার বিশ্বাস।

গত কিছুদিনে সচলায়তনে কারো কারো সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। বয়সে বড়ো হওয়ার কারণে এদের অনেককেই তুমি বলার অনুমোদন পেয়ে গেছি। অথচ কাউকেই বলা হয়ে ওঠেনি যে, তারাও আমাকে জুবায়ের ভাই, তুমি বললে খুশি হই। সৌম্যকে সহজে বলতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে ওই চল এখনো গড়ে ওঠেনি বলেই হয়তো বলা যায়নি।

মানুষের জীবন যে কতো অসঙ্গতিতে ভরা তার একটি উদাহরণ আমি ঘরেই তৈরি করে রেখেছি। একদিন খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমি আমার মেয়েকে তুই বললেও ছেলেকে তুমি করে বলি। কী করে ঘটলো জানি না। কারণ খুঁজে পাওয়া গেলো না। মানুষের আচরণ আসলে খাপছাড়া হয়েই থাকে – এরকম একটা যুক্তিহীন যুক্তি দিয়েই তাকে যুক্তিসিদ্ধ করা সম্ভব। আর কোনোভাবে নয়।

Monday, May 26, 2008

বামন-গল্প : বয়স

বেশ কিছুদিন ধরে সচলায়তনে অণু-পরমাণু গল্পের ঢল নেমেছে। একটা সংকলনও হয়ে গেছে। সেই সংকলনে লেখার জন্যে আমন্ত্রিত হয়ে দুই সম্পাদককে জানিয়েছিলাম, ছোটো লেখা আমাকে দিয়ে হয় না, সুতরাং মাফ চাই।

অনেকদিন লেখালেখি কিছুই হয়ে উঠছে না। আজ ছুটির দিন বলে বসা গেলো। যা লিখতে গিয়েছিলাম তার আশেপাশেও যাওয়া হলো না, সম্পূর্ণ অন্য একটা জিনিস মাথায় এলো। তা-ও আবার ক্ষুদে গল্পের আকারে।

কিছু হলো কি?

* * * * * * * * * *

বয়স

যুদ্ধে গিয়েছিলে?
তখন বয়স হয়নি, ছোটো ছিলাম।
এখন হলে যাবে?
বয়স হয়ে গেছে।

Saturday, May 17, 2008

গোলমালচরিত

এক রাতে ঢাকা থেকে ফোন। হ্যালো বলতেই ওপাশে রীতিমতো গোলাবর্ষণ (গলাবর্ষণ আর কি!)। ফারুকের গলা। কোনোরকম সম্ভাষণ নয়, কয়েক বছর পর কথা হচ্ছে, ভালোমন্দ খোঁজখবর নেওয়ারও যেন দরকার নেই। সরাসরি প্রসঙ্গে চলে গেছে সে, কী একখান নাম দিয়া গ্যালেন মিয়া, এখনো সবাই আমারে ওই নামে ডাকে!

পুরো নাম গোলাম ফারুক। এক মুহূর্ত সুস্থির হতে জানে না – তড়বড় করে ছুটে বেড়াচ্ছে, পোশাক-আশাকে ভদ্রস্থ থাকার চেষ্টা থাকলেও বেশিরভাগ সময় প্যান্টের জিপার ওপরের দিকে খানিকটা আলগা প্রায় সারাক্ষণ, সঙ্গে আধভাঙা গলায় ক্রমাগত কথার খই ফুটছে। এতো দ্রুত কথা বলে যে অভ্যস্ত না হলে মর্মোদ্ধার করা কঠিন। এই চরিত্রের নামের প্রথমাংশের গোলামকে গোলমাল বানিয়ে ফেলা কঠিন কিছু নয়, স্বাভাবিক বলেই ধরে নেওয়া উচিত। ভুলও হয় না। অবিলম্বে নামটি আমাদের বন্ধুদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা পায়। প্রায় তিরিশ বছর ধরে চালু আছে। কোন ফারুক জিজ্ঞেস করলে এই ফারুককে চেনাতে হলে বলতে হয়, গোলমাল ফারুক।

ফোনে তখনো ফারুকের কথা শেষ হয়নি। সে বলে যায়, আমার পোলা সেদিন জিগায়, আচ্ছা বাবা সবাই তোমারে গোলমাল কয় ক্যান?

ফারুককে চিনি ১৯৭৮ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা তখনো হয়নি, বিজয়নগরে ‘নান্দনিক’ নামে একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানে কপিরাইটারের কাজ করি। সেখানেই ফারুকের সঙ্গে প্রথম দর্শন ও পরিচয়। তার সঙ্গে বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠতা হওয়ার কথা নয়, কিন্তু তার নির্ভেজাল সরলতা ও স্বভাবের কারণে তাকে উপেক্ষা করাও কঠিন। নান্দনিক যুগের পরে পুরানা পল্টনে হাউজ বিল্ডিং ভবনের পেছনে ‘অ্যাডবেস্ট’ নামের বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানেও একসঙ্গে কাজ করেছি। তারপরেও আমাদের যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব অটুট।

ফারুকের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। তার দ্রুতকথনে তা অনায়াসে হয়ে যায় ন্যাঞ্জো, তাকে দিয়ে নারায়ণগঞ্জ শব্দটা কখনো উচ্চারণ করানো যায়নি। ফারুকের শর্টহ্যান্ডসদৃশ দ্রুতকথনের আরো কিছু নমুনা দিই। মুন্নি নামে একটি মেয়ে অ্যাডবেস্টের একটি বিজ্ঞাপনে মডেলিং করেছিলো। একদিন দুপুরে প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ফারুক বলে, মুন্নি অ্যারেস্ট হইছে।

অবাক হয়ে বলি, কেন কী হয়েছে? মুন্নি অ্যারেস্ট হবে কেন?

আরে না না, মুন্নি অ্যারেস্ট হইয়া গেছে তো।

এই ধরনের কথোপকথন আরো খানিকক্ষণ চলার পরে উপস্থিত একজন কেউ ফারুকের কথার অনুবাদ করতে সক্ষম হয়। অনুবাদে যা পাওয়া গেলো তা এইরকম: মুন্নি বিমানে এয়ারহোস্টেস হয়েছে!

আমার বিয়ের কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় এসেছে সে। চা খেতে খেতে একসময় বউকে জিজ্ঞেস করে, ফ্রিজ কই?

খাবার টেবিলের পাশে ফ্রিজ দেখিয়ে বউ বলে, ওই তো!

না না, ফ্রিজ ফ্রিজ। ফ্রিজ কই?

আমি ততোক্ষণে বুঝে গেছি। আমার ছোটো ভাইয়ের নাম ফিরোজ, ফারুক তার খোঁজ করছে।

ভাতের জন্যে ফারুকের খুব দুর্বলতা। কোনোদিন হয়তো অফিসের সবাই মিলে ভরপেট চাইনিজ খেয়ে ফিরেছি। অফিসে ঢুকেই সে পিয়নকে ডেকে বলবে, জলদি ভাতমাছ লইয়া আয়।

অ্যাডবেস্ট ছিলো উৎকৃষ্ট আড্ডার জায়গা। দিনমান বিভিন্ন জাতের মানুষের আনাগোনার শেষ নেই, আড্ডার জন্যে একটি বড়ো কক্ষ আলাদা বরাদ্দ ছিলো। ক্রমাগত চা সরবরাহ চলছে। গ্রুপ থিয়েটারের দল, সাহিত্যের দল, আঁকিয়েদের দল তো ছিলোই। আরো আসতো ফুটবল-ক্রিকেট খেলোয়াড়দের দল, এমনকি বিশুদ্ধ আড্ডাবাজরা স্রেফ আড্ডার টানেই সেখানে সমবেত হতো। একসময় বলা হতো, এটা অ্যাডবেস্ট নয়, আড্ডাবেস্ট।

আমাদের গোলমাল ফারুক ফুটবলে মোহামেডানের পাঁড় সমর্থক। তার তখন স্বপ্ন ছিলো, একদিন অনেক টাকার মালিক হয়ে সে মোহামেডান ক্লাবের কর্মকর্তা হবে। সত্যি কথা বলতে কী, এমন মোহামেডান-অন্তপ্রাণ আর কাউকে আমি দেখিনি। মোহামেডানের খেলার দিন বিকেলে তাকে কিছুতেই অফিসে পাওয়া সম্ভব নয়। অফিস থেকে পায়ে হেঁটে তিন মিনিটে স্টেডিয়াম, তাকে আর পায় কে! একদিন সন্ধ্যায় খেলা দেখে থমথমে মুখ করে ফিরেছে ফারুক। জিজ্ঞেস করার দরকার নেই, তার মুখই খেলার ফলাফল বলে দিচ্ছে। জানা গেলো, খুব বাজে টীমের কাছে সেদিন হেরেছে মোহামেডান। অফিসে কয়েক মিনিট অস্থিরভাবে পায়চারি করে ফারুক, তারপর একসময় ছুটে বাইরে যায়। কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলে বলে, শালার মোহামেডান ক্লাবে ঢিল মারতে যাই!

সে সময়ের আবাহনীর তারকা ফুটবলার টুটুলও নিয়মিত আসে আড্ডা দিতে। ফারুকের সঙ্গে তার বিশেষ সখ্য যেমন ছিলো, আবাহনী-মোহামেডান নিয়ে তর্কবিতর্ক, খোঁচাখুঁচিও কম হতো না। ঠাট্টার ছলে মোহামেডানকে হেয় করা ছোটো ছোটো মন্তব্যে ফারুককে উত্যক্ত করায় টুটুল ছিলো এক প্রতিভাবিশেষ। ফারুক রেগেমেগে হৈ চৈ শুরু করে দিলে আমরা মজা দেখি। একদিন এরকম খোঁচাখুঁচি চলছে, ফারুকের গলাও চড়ছে। মিটিমিটি হাসতে হাসতে টুটুল কিছু একটা মন্তব্য করতেই ফারুকের উত্তেজনা চরমে উঠে যায়। তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে, হাত-পা নেড়ে চিৎকার করতে করতে চেয়ারে ওপর উঠে দাঁড়ায় এবং আমার জীবনে শোনা শ্রেষ্ঠতম কৌতুককর প্রশ্নটি সে করে টুটুলকে, আপনে মিয়া ফুটবলের কী বোঝেন?

Thursday, May 8, 2008

রবীন্দ্রসংগীতের শক্তি : আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটি রচনা

১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারিতে মৃত্যুর আগে এটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সর্বশেষ রচনা। প্রথমে লেখা হয় ৯৬-এর ৮ ডিসেম্বর জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ঢাকা সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের বার্ষিক সম্মেলনের জন্যে লিখিত বক্তব্য হিসেবে। অসুস্থতার জন্যে ইলিয়াস উপস্থিত হতে না পারায় লেখাটি সেখানে পাঠ করে শোনানো হয়। পরে বদরুদ্দীন উমরের ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশে লেখক সম্মতি দিয়ে জানান, তিনি আরো কিছু কথা সংযোজন করতে চান। তখন তাঁর আর নিজে লেখার অবস্থা নেই, ডান হাত ভাঙা। ডিকটেশন দেবেন, গলা ও ফুসফুসের সমস্যায় কথা বলায়ও সমস্যা। তারপরেও এই রচনায় আরো কিছু সংযোজন তিনি করতে পেরেছিলেন। ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো নিচের ভাষ্যটি।

রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁকে নিয়ে লেখা বাংলা ভাষার আরেকজন প্রধান (এবং প্রয়াত) লেখকের এই রচনাটি প্রাসঙ্গিক মনে হলো। তাই তুলে আনা।


তথাকথিত পাকিস্তানি সংস্কৃতির অজুহাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা কখনো স্তিমিত হয়নি। বরং সরকারি প্রচারমাধ্যমগুলো রাজনীতি প্রচার ও সংস্কৃতিচর্চায় কোনোরকম ভূমিকা পালন করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। নইলে ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্ভব হল কী করে? সুস্থ সংস্কৃতিচর্চায় সরকারি রক্তচক্ষু বিঘ্নের সৃষ্টি তো করতে পারেইনি বরং শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের রুখে দাঁড়াবার জন্য প্ররোচিত করেছে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে পাশ্চাত্যের ব্যান্ড মিউজিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলে বোঝা যায় রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা বেড়েছে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি। রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করা কিংবা ছোট করার অপচেষ্টা এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষিত মানুষের সমর্থন পায়নি, এখনও পায় না।

এটা রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিশেষ কোনো অনুরাগ বা ভক্তির নিদর্শন নয়। রবীন্দ্রনাথের গানের প্রধান আবেদন ব্যক্তির কাছে। এই আধুনিক ব্যক্তি যে-সমাজে গড়ে ওঠে, আমাদের দেশে সেই সমাজ এখন নির্মীয়মান। নানা কারণে এ-সমাজে ব্যক্তির বিকাশ স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক হচ্ছে না। এই সমাজগঠনের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বনির্ভর রাষ্ট্র। কিন্তু বিদেশি সাহায্য সংস্থাসমূহের রাষ্ট্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ, তাদের পরোক্ষ উস্কানিতে ধর্মান্ধ অপশক্তির উৎপাত প্রভৃতির কারণে রাষ্ট্র যেমন শক্ত হতে পারে না, ব্যক্তির স্বাভাবিক বিকাশেও তেমনি পদে পদে বিঘ্ন ঘটে।

রবীন্দ্রচর্চায় মাঝে মাঝে যে বিঘ্নের সৃষ্টি করা হয় তার কারণ কিন্তু তথাকথিত পাকিস্তানি সংস্কৃতি নয়। বরং সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট ধর্মান্ধদের উৎপাত। এই উৎপাত কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন এইসব ইতর লোকদের বিরুদ্ধে একটু সংঘবদ্ধ হলেই এরা গর্তে ঢুকে পড়ে।

সিংহভাগ শিক্ষিত মানুষের রাজনৈতিক মতামত যা-ই হোক-না কেন, একটি আধুনিক সমাজের সদস্য হওয়ার জন্য তারা উদগ্রীব। সুতরাং পঙ্গু হোক, রুগ্ণ হোক, ব্যক্তির বিকাশ এখানে কোনো-না-কোনোভাবে ঘটেই চলেছে।

এই ব্যক্তির একান্ত অনুভব সবচেয়ে বেশি সাড়া পায় রবীন্দ্রসংগীতে। তাই এই পঙ্গু বা রুগ্ণ ব্যক্তিটিকে বারবার যেতে হয় তাঁর গানের কাছেই।

রবীন্দ্রনাথ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যে-ব্যক্তিকে তিনি শক্তসমর্থ মানুষ। আমাদের পঙ্গু ব্যক্তি রবীন্দ্রসংগীতে নিজেকে শনাক্ত করতে চায় শক্ত মানুষ হিসেবে। হয়তো এই দেখাটা ভুল কিন্তু এই ভুল দেখতে দেখতেই সে একদিন শক্ত একটি ব্যক্তিতে বিকশিত হতেও তো পারে। তখনই গড়ে ওঠে ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্ববান মানুষ দায়িত্বশীল, সে কেবল নিজেকে নিয়ে মুগ্ধ থাকতে পারে না। তাই তার চারদিকের মানুষের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে ওঠে। রাশিয়ার চিঠিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আকর্ষণে কোনো ভ্রান্তি ছিল না। অসাধারণ শক্তিমান মানুষ যে-কোনো জনগোষ্ঠীর কল্যাণ ও মঙ্গল দেখে সন্তুষ্ট হতে বাধ্য।

বাংলাদেশেও ব্যক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গান যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছে। এবং শক্তসমর্থ ব্যক্তিগঠনে এই গান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। রবীন্দ্রনাথের গান মানুষকে বিপ্লবের দিকে উদ্বুদ্ধ করবে না। কিন্তু শক্তসমর্থ ব্যক্তিগঠনে রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষমতা অসাধারণ। শক্ত মানুষের সমবেত শক্তি মানববিরোধী অচলায়তন ভাঙার অন্যতম প্রেরণা তো বটেই।

* * * * * * * *

লেখাটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনাসমগ্র ৩ থেকে নেওয়া হয়েছে।

Sunday, May 4, 2008

ঠিক আত্মপক্ষ সমর্থন নয়

ঢাকায় আমার কিছু প্রতিভাবান বন্ধু আছেন। এঁরা কোনো বিখ্যাত সেলিব্রিটি নন, কিন্তু এঁদের বিস্ময়কর উদ্ভাবনী প্রতিভায় আমি বরাবর মুগ্ধ কখনো কখনো ভুক্তভোগী। ২০০৬ সালে রমজান মাস শুরু হবো-হবো, ঢাকায় পত্রিকাগুলির ঈদসংখ্যার প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে, দুয়েকটা এমনকি বাজারে এসেও গেছে। এইসময় ঢাকা থেকে এক বন্ধু (ইনি প্রতিভাবান নন) ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি নাকি অমুক পত্রিকায় উপন্যাস লিখছো?

বিস্মিত না হয়ে উপায় কী! প্রথমত, ঐ অমুক পত্রিকাটির নাম শুনেছি, চোখে দেখিনি। তবে আমাদের এক বন্ধু (যাঁর প্রতিভার আগুনে আমি দগ্ধ হবো অচিরে) সে পত্রিকায় খণ্ডকালীন কাজ করেন জানি। কিন্তু ঐ কাগজে ঈদসংখ্যা দূরে থাক, এমনিতেও লেখালেখি বিষয়ে আমার বন্ধুর সঙ্গে কখনো কথা হয়নি। সুতরাং আমি উপন্যাস লিখছি? কই, জানি না তো! ছাড়া অন্য কোনো কথা মুখে আসে না।

ফোনের অন্য প্রান্তে বন্ধুটি ধন্দে পড়ে, আমি হলেও পড়তাম। বস্তুত, ধন্দে আমি ততোক্ষণে পড়ে গেছি। কথাটা এলো কোত্থেকে? সেই অমুক কাগজের খণ্ডকালীন কর্মী আমার বন্ধুকে ফোনে ধরি অনেক কষ্টে। তিনি একটি মোবাইল ফোন বহন করেন বটে, তবে প্রায়ই তার উপস্থিতি ভুলে যান অথবা রিং এলে না-ধরলে-কী-হয় জাতীয় দার্শনিকতায় উপেক্ষা করতে পারেন। দয়াপরবশ হয়ে যখন তিনি ফোনে হ্যালো বললেন এবং ঘটনার বিবরণ দিলেন, আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হওয়ার অবস্থা। আমার সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ না করে তিনি তাঁর সম্পাদককে জানিয়ে দিয়েছেন, আমার কাছ থেকে তিনি একটি উপন্যাসের প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন এবং লেখাটি এই এলো বলে!

তার চেয়েও ভয়ংকর কথা, সম্পাদকের কাছে অলিখিত ও অকথিত উপন্যাসটি আসছে বলার পরও তিনি আমাকে বিষয়টি জানানোর দরকারই মনে করেননি। আমি কিছু উষ্মা প্রকাশ করলে তিনি নির্বিকার বললেন, আমি জানি আপনার কাছে লেখা তৈরি আছে। আর না থাকলেও এক সপ্তাহের মধ্যে একটা নামিয়ে দিতে পারবেন।

‘যদি সে ভালো না বাসে’ লিখতে হলো দুই সপ্তাহের মধ্যে। বিরক্তি, প্রস্তুতিহীনতা, সময়ের স্বল্পতা, ঈদসংখ্যায় ফরমায়েশি আকৃতির ‘উপন্যাস’ লেখার অনিচ্ছা নিয়েও। বন্ধুর প্রতিশ্রুতির (হোক তা বাগাড়ম্বর, আর কারো তা জানারও দরকার নেই) সম্মানটুকু আমাকে রাখতে হয়।

কোথা থেকে কে জানে, ডিমের ভাঙা কুসুমের মতো সূর্যের আলো কথাটা মাথায় এলো। ঠিক আছে, তাই দিয়েই শুরু হোক। দেখা যাবে কোথায় গিয়ে ঠেকে। চরিত্রগুলির মধ্যে এক জামাল খানিকটা পরিচিত। নীলা-নিশি-ইরফান বা আর কাউকে চিনি না। তাদের তৈরি করতে হলো একাধিক চেনা মানুষের এটা-ওটা মিলিয়ে। প্লুটোর গ্রহত্বমোচন নিয়ে তখন কিছু হৈ চৈ, আচ্ছা তাকেও ঢুকিয়ে ফেলো।

সময় কম তো বটেই, এদিকে আকৃতি যাতে খুব বড়ো না হয় তা-ও দেখতে হবে। শেষ না হলেও শেষ করে ফেলো। তাই হলো।

এই রচনা অসম্পূর্ণ। উপন্যাস তো নয়ই। হয়তো টেনে লম্বা করা একটি বড়োগল্প, অথবা দু’তিনটি গল্প জোড়া দিয়ে একটা পাঠক-ঠকানোর গোঁজামিল। আনোয়ার সাদাত শিমুলকে উদ্ধৃত করে বলা যায় ‘বনসাই উপন্যাস’। কী সর্বনাশ, আমার তৈরি অস্ত্রে আমি নিজে আক্রান্ত – ‘দিয়াশলাই’ সংকলনের কিছু গল্পকে আমি ‘বনসাই গল্প’ বলে চিহ্নিত করেছিলাম।

প্রশ্ন হলো, লেখাটি সচলায়তনে ধারাবাহিকভাবে কেন পোস্ট করলাম? একটিমাত্র কারণে। লেখাটির মধ্যে সম্পূর্ণ উপন্যাস হয়ে ওঠার একটা সম্ভাবনা আমি দেখতে পাই। পোস্ট করে কিছু পাঠক মতামত পেলে কাজটা সম্পূর্ণ করার বাসনা ছিলো। বিশেষ করে লেখার দুর্বলতার দিকে কেউ কেউ নির্দেশ করবেন ভাবছিলাম। সে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সফল যেমন হয়নি, একেবারে ব্যর্থ তা-ও বলা চলে না। টুকরো কিছু মন্তব্য ছাড়াও শেষ পোস্টে আনোয়ার সাদাত শিমুলের নাতিদীর্ঘ আলোচনায় অনেকগুলি জিনিসই সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তার নির্দেশ করা দুর্বলতা ও অসম্পূর্ণতাগুলি নিয়ে আমার কিছুমাত্র দ্বিমত নেই। বরং সমালোচনাটি আরো তীব্র হতে পারতো, শিমুল ভদ্রতাবশে হয়তো কিছু চেপে গেছে। বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে কিছু ছাড়ও হয়তো পেয়ে গেছি।

‘যদি সে ভালো না বাসে’ যাঁরা পড়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন, তাঁদের কাছে আমার অসীম কৃতজ্ঞতা। যাঁরা পড়েননি, তাঁরাও এক অর্থে আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন! সুতরাং ধন্যবাদ তাঁদেরও।

--------------------
২৭ এপ্রিল ২০০৮
--------------------

জাদুস্পর্শ

বাবা, কী হয়েছে তোমার বলো তো?
এই তো সামান্য অসুস্থ।
তুমি কিছু লুকাচ্ছো?
না তো, কেন?
আজ চারদিন ধরে দেখছি তুমি বেশিরভাগ সময় ঘুমাচ্ছো, না হয় চুপ করে শুয়ে আছো।
বুকে কফ জমেছে।
তা জানি, কাশি শুনতে পাই। জ্বরও আছে জানি। আর কিছু তো জানতে পারছি না।
একটু আগে ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরেছি, মেয়ে তখন ক্লাসে ছিলো। তাকে বলি না, আর দু’একদিন দেরি হলে আমার নিউমোনিয়া হয়ে যেতে পারতো। অযথা তার উদ্বেগ বাড়িয়ে কাজ কী? বলি, তেমন কিছু না।
তোমাকে এতো লম্বা সময় বিছানায় দেখি না। সত্যি বলো, তুমি কিছু লুকাচ্ছো না!
মিথ্যা করে বলি, সত্যি না। এই যে তুই ছুঁয়ে দিলি, এখন আমি সেরে উঠবো।
মেয়ে, কে জানে কেন, হঠাৎ দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠে।
বলি, এই তোর আবার কী হলো? তোকে বলা হয়নি, কাল আমি সারাদিনে সাতটা সিগারেট খেয়েছি, আজ এ পর্যন্ত দুটো।
চোখ মুছে মেয়ে বলে, তুমি সত্যি বলছো এবার ছাড়বে?
মনে মনে বলি, তোদের জন্যে আমি হয়তো মরতেও পারবো না। আমি এতো দরকারি মানুষ কবে হয়ে উঠলাম? কীভাবে?

------------------
২৬ এপ্রিল ২০০৮
------------------

‘দিয়াশলাই’-এর গল্পগুলি : এক পলকে একটু দেখা

প্রথমে বন্দনা করি….

সচলায়তনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর বর্ষপূর্তি হতে এখনো প্রায় আড়াই মাস বাকি। সে হিসেবে বয়স দশ মাসও হয়নি। এরই মধ্যে শতকরা একশোভাগ নিজস্ব মালমশলা দিয়ে তিন তিনটি প্রকাশনা রীতিমতো গর্ব করার মতো অর্জন তো বটেই। সবগুলি ই-বুক, সচলায়তন যার নাম দিয়েছে বe, হিসেবে ধরছি না, কারণ এগুলির কোনোটা আগেই মুদ্রিত গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত, কোনোটা অসম্পূর্ণ ইত্যাদি। এই তিনটি পূর্ণাঙ্গ প্রকাশনার একটি প্রথাগত মুদ্রণ মাধ্যমে, বাকি দুটি আন্তর্জালিক (নাকি অন্তর্জাল? এই সংশয় আমার আজও গেলো না। ইন্টারন্যাশনাল যদি আন্তর্জাতিক হয়, ইন্টারডিপার্টমেন্ট যদি আন্তবিভাগীয় হয়, তাহলে ইন্টারনেট আন্তর্জাল নয় কেন?)।

মুদ্রিত গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত সংকলনটি এখনো দেখা হয়নি। শুনেছি মুদ্রণঘটিত ও দূরপাল্লার সম্পাদনা সংক্রান্ত কিছু গোলমাল থেকে গেছে। প্রথম ভার্চুয়াল বই আরিফ জেবতিকের সম্পাদনায় ফেলে আসা ছেলেবেলা-ও জন্মেছিলো কিছু ত্রুটি নিয়ে। দুটি ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট কাউকে দোষারোপ করার উপায় নেই। তবে দিয়াশলাই-এর তিন তরুণ সম্পাদক আগের অসম্পূর্ণতাগুলি সম্পর্কে আগাগোড়া সজাগ ছিলেন তা স্পষ্ট বোঝা যায় এই বইয়ের পরিপাটি সাজসজ্জা দেখে।

একটা বিষয় ভেবে মজা লাগে, বিস্ময়ও কম হয় না। সম্পাদক তিনজনের বসত পৃথিবীর তিন মহাদেশে – অমিত আহমেদ উত্তর আমেরিকায়, আনোয়ার সাদাত শিমুল এশিয়ায় এবং কনফুসিয়াস ওরফে মু. নূরুল হাসান অস্ট্রেলিয়ায়। আফ্রিকায় সচল কেউ আছেন কি না আমি নিশ্চিত নই, তবে ইউরোপ থেকেও একজনকে রাখলে মন্দ হতো না। তা এই তিন ভুবনের তিন বাসিন্দা স্থানকালের বিস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও প্রযুক্তিকে সম্বল করে এক অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছেন। এখন থেকে দশ বছর আগেও হয়তো তা প্রায়-অসম্ভব ছিলো। অভিনন্দন তাঁদের প্রাপ্য।

অণুগল্প

অণুগল্প কী? তার সংজ্ঞা কীভাবে নির্ধারিত হয়? তার বৈশিষ্ট্য কী? স্পষ্ট কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ হয়তো সম্ভব নয়। তবে আমি যা বুঝি তা অনেকটা এরকম: পরিসরে অবশ্যই ছোটো, কিন্তু এতে থাকতে হবে পাঠককে সচকিত করে তোলার মতো কিছু একটা। থাকবে তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতা। তীরের মতো ঋজু ও লক্ষ্যভেদী। স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠা কোনো অনুভূতি। কোনো ধোঁয়াশাময় বর্ণনা নয়। হয়তো স্কেচ, কিন্তু স্পষ্ট দাগে আঁকা। অল্প কথায় অনেক কথা বলে যাওয়া, তবে পাঠককে যেন বোঝার আশা জলাঞ্জলি দিতে না হয়। সচলায়তনে নজমুল আলবাব ও সুমন চৌধুরী এই গোত্রের গল্পলেখক।

আবার অন্যদিকে কোনো একটা লেখা শুধু পড়ে যেতে ভালো লাগছে, মজা লাগছে, লেখক খুব আবছা কোনো বক্তব্য/ইশারা সেখানে মিশিয়ে রেখেছেন, পাঠক লক্ষ্য না করলেও ওই মজা ও পড়তে ভালো লাগার কারণেই তা সার্থক গল্প হয়ে ওঠে। সচলায়তনে এই ঘরানার একজন লেখক আছেন, তিনি সবুজ বাঘ।

অণুগল্প সংকলন ‘দিয়াশলাই’

এখন সুদৃশ্য প্রচ্ছদের ওপারে যাওয়া যাক। দিয়াশলাই সংকলনে জায়গা পেয়েছে ৩০ জন লেখকের মোট ৩৫টি গল্প। এর মধ্যে ১টি অনুবাদ।

দিয়াশলাই সংকলনের গল্পগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারি – পরমাণু, অণু, স্বয়ংসম্পূর্ণ, বনসাই এবং হলো না লো হলো না

পরমাণু

‘দিয়াশলাই’ সংকলনে বিস্ফোরক শক্তিধর মৌলিক পরমাণু গল্পগুলির লেখক সুমন চৌধুরী ও অলৌকিক হাসান। মোট ৫টি গল্প এই শ্রেণীতে। সম্পাদকরা ৫০০ শব্দে গল্প লিখতে বলেছিলেন, সুমন চৌধুরী সর্বসাকুল্যে ২০৪টি শব্দ খরচ করে (শিরোনামসহ ২০৮) ৪টি গল্প লিখে ফেলেছেন। প্রতিটি গল্পের ভাষা অতিশয় সাদামাটা, অথচ কী উজ্জ্বল, সম্পূর্ণ ও লক্ষ্যভেদী। প্রথম গল্পের নাম । স্বরবর্ণের ব্যবহার ছাড়াই ব্যঞ্জনবর্ণের একটিমাত্র অক্ষরে পরমাণু গল্পের পরমাণুসম শিরোনাম। পরমাণুর শেষতম ধাপে, আর ভাঙা যাবে না। সুমনের ৪টি গল্প ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের, তবে প্রথম () ও শেষ গল্প (বাটোয়ারা) দুটিকে অসাধারণ বললেও যথেষ্ট বলা হয় না।

৮৭টি শব্দে অলৌকিক হাসান লিখেছেন পাস ফেল। খুব নিটোল সুন্দর একটি গল্প। যথার্থ পরমাণু। একটু যত্নবান হলে শব্দসংখ্যা আরো কমানো যেতো। ছোটো একটি ঘটনা, ছোটো একটি অনুভব – এইটুকুই গল্পের সম্বল, অথচ মনোহর ও চমৎকার। একটি খচখচ করা ত্রুটি। ‘মরার মতো’ বা ‘মরার ঘুম’ ৪ প্যারার এই গল্প ৪ বার ব্যবহার করা হয়েছে ভুল বানানে। শব্দটি ‘মড়ার’।

সংকলনের একমাত্র অনুবাদ গল্পটিও (লাভ স্টোরি) পরমাণু শ্রেণীভুক্ত। শব্দসংখ্যা ৮০-র নিচে। শুরু থেকে গল্পটিকে এক যুগলের প্রেমের সংলাপ বিনিময় বলে ধারণা হয়, যদিও স্বামী ও স্ত্রী বলে দেওয়া আছে, সেভাবেই সংলাপগুলি পরপর সাজানো। পড়ার সময় কে আর অতো খেয়াল করে। মনে হতে থাকে, অনেক নিষেধ ভেঙে তাদের সম্পর্ক স্বপ্নময় একটি পরিণতির দিকে যাচ্ছে। অথচ শেষের একটিমাত্র বাক্যে জানা যায় তারা যাচ্ছে ডিভোর্সের জন্যে। গল্পের মূল লেখক ম. লিপস্কেরভ। দুর্দান্ত গল্পটির অসাধারণ অনুবাদ করেছেন সংসারে এক সন্ন্যাসী। শিরোনামটিকেও অনুবাদে প্রেমকাহিনী বলা যেতো বোধ করি।

অণু

অণুগল্প শ্রেণীতে পাচ্ছি ৫টি গল্প। হিমু ওরফে মাহবুব আজাদের ২টি এবং কনফুসিয়াস, আনোয়ার সাদাত শিমুল, নিঘাত তিথি ও মুজিব মেহদীর ১টি করে গল্প।

হিমুর গল্প দুটির নাম হাতিসোনাকপাল। হিমুর প্রায় সব রচনাতেই ব্যঙ্গ-পরিহাসের একটা ঝোঁক থাকে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হাতিসোনা অনেকটা কৌতুকের ছলে বলা হলেও চাপা-পড়া কষ্টও আগাগোড়া টের পাওয়া যায়। ‘হাতিরা ভোলে না’ – গল্পের এই অন্তিম বাক্যে ঠোঁটের কোণে অকস্মাৎ একটা স্মিতহাস্য উঠে আসার উপক্রম হতেই কোথাও একটা টান পড়ে। সে হাসি তখন আর কৌতুকের নয়, তা ফাটা-ঠোঁটে হাসতে যাওয়ার বিড়ম্বনার মতো বোধ হতে থাকে। কপাল-ও একটি নিখুঁত অণুগল্প। তবে ছোটো একটি নালিশ। মোনোপোলি খেলার সঙ্গে যাঁদের পরিচয় নেই, তাঁদের কাছে এই গল্পের কোনো আবেদন থাকবে বলে মনে হয় না।

কনফুসিয়াস অথবা মু. নূরুল হাসান গল্পসহ বিবিধ ধরনের গদ্যরচনা করে থাকেন। এই সংকলনে তাঁর বনসাই আমার প্রত্যাশা মেটায় না। গল্পটি সাদামাটা, বর্ণনা ও ভাষায়ও ধারালো লাগলো না। রচনাটি লেখকের শক্তিমত্তার পরিচায়ক নয়, এর চেয়ে অনেক উৎকৃষ্ট গল্প আমরা তাঁর কাছে পেয়েছি। সম্পাদনার ব্যস্ততায় হয়তো গল্পে মনোযোগ দিতে পারলেন না।

আনোয়ার সাদাত শিমুলের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় বছরখানেকের কিছু বেশি হবে। লেখক হিসেবে এই নবীন যুবক ক্রমশ অগ্রসরমান। দুর্বলতাগুলি কাটিয়ে উঠছেন, লেখালেখির পাঠশালায় অক্লান্ত পরিশ্রমী শিক্ষার্থীর মতো মনে হয়, নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়ার চেষ্টাও দেখা গেছে। দৈনন্দিন শিমুলের এই এগিয়ে যাওয়ার একটি স্মারক হয়ে থাকছে বলে আমার ধারণা। এই গল্পটি বোধহয় কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বাঁধা পড়ে না, এটি মানুষের নিজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার চিরকালের গল্প।

নিঘাত তিথির বন্ধু গল্পটা ভালো লাগে। সন্ধ্যার মুখে এক নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ ও বাড়ির কিশোর বয়সী কাজের ছেলেটি কোনো কথা না বলেও কথা বিনিময় করে, এইটুকুই গল্প। আদর্শ অণুগল্প। বর্ণনার অংশে নিঘাত তিথি আরেকটু সতর্ক ও যত্নবান হলে লেখাটির ধার অনেক বেড়ে যেতে পারতো। ‘এখন হাতে থাকা অফুরন্ত সময়ের অধিকাংশই কাটে অলস ভাবনা আর বিগত দিনের দেনা-পাওনার হিসেব কষে।’ – এই ধরনের বাক্য কিন্তু একটু ক্লিশে ও জীর্ণ-প্রাচীন মনে হয়।

মুজিব মেহদীর তর্কপ্রগতির জন্য প্রকল্পিত একটি অসমাপ্ত সেমিনারের প্রতিবেদন গল্পটি চমৎকার, গতানুগতিক গল্পের অনুগামী নয়। তবে অণুগল্পের নামটি মাইলখানেক দীর্ঘ কেন বোঝা গেলো না। গল্পে কমা ছাড়া অন্য কোনো যতিচিহ্নের ব্যবহার নেই। হয়তো পাঠককে চমকে দেওয়ার চেষ্টা। নাকি এসবের অন্য কোনো ব্যাখ্যা/ব্যঞ্জনা আছে যা আমি ধরতে পারিনি! ভুল বোঝাবুঝির ঝুঁকি নিয়েও বলি, সংলাপে ‘মশাই’ শব্দটি কানে লাগে, বড্ড কৃত্রিম শোনায়।

স্বয়ংসম্পূর্ণ

অণুগল্প সংকলনের বেশ কয়েকটি রচনা স্বল্প পরিসরেও সম্পূর্ণ গল্প হয়ে উঠেছে। এই গল্পগুলি প্রথাসম্মতভাবে লেখা, আকারে ছোটো বলেই সেগুলিকে অণুগল্প বলে সায় দিতে ইচ্ছে করে না।

বিবাগিনীর বাবা আর কাঠগোলাপ গাছ একটি সুন্দর মন-ভালো-করা গল্প।

অমিত ওরফে আহমেদ রাহিদ নিয়মিত লেখেন না। তাঁর এগারোটি রজনীগন্ধা পড়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, কেন লেখেন না? মনে হয় গল্পটি ঠিক অণুগল্প হিসেবে লেখার কথা ভাবাই হয়নি। গল্পের অতি দীর্ঘ প্রথম প্যারা অণুগল্পের উপযুক্ত বলে ভাবা মুশকিল। সম্ভবত লেখার চর্চা অনিয়মিত বলেই অমিতের ভাষা ও বর্ণনা কিছুটা আড়ষ্ট। কোনো মিল নেই, কিন্তু এই গল্পটা পড়তে পড়তে হঠাৎ ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখা ছবিটার কথা মনে পড়লো।

মোহাম্মদ আবদুল মুকিত, যাঁর ব্লগনাম জ্বিনের বাদশা, লিখেছেন টান নামে একটি গল্প। সহজ-সরল ভাষায় লেখা নিটোল ও সম্পূর্ণ গল্প। অণু বা পরমাণূ গল্প হিসেবে এর একটি সম্ভাবনা ছিলো। গল্পের শেষ বাক্য ‘হঠাৎ বাসার কড়াটার কথা খুব করে মনে পড়তে থাকে’ সেই ইঙ্গিতই দেয়।

মাহবুর লীলেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখার ক্ষমতা রাখেন। গল্প-কবিতা ছাড়াও লিখতে পারেন যা-খুশি ও যেমন-খুশি। তিনি ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন ছোট্টো পরিসরে লেখা তাঁর পোষায় না। কিন্তু সেখানেও যে উত্তমরূপে পারঙ্গম তিনি, চিঠির আকারে লেখা তৃষ্ণা গল্পটি সেই সাক্ষ্যই দেবে। সম্পাদকদের নির্ধারিত শব্দসংখ্যার মধ্যেই হৃদয়গ্রাহী একটি সম্পূর্ণ গল্প দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। লীলেন প্যারার শেষে কোনো যতিচিহ্ন ব্যবহার করেন না, শুধুমাত্র প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছাড়া। নিশ্চয়ই এর একটা ব্যাখ্যা আমরা কখনো পাবো। এই গল্পের একটি বাক্যে আপত্তি জানিয়ে রাখি। ‘… মরার পরেও আমাকে তুই জেলাস করিস প্লিজ’ বাক্যে ‘জেলাস’ শব্দটিতে ব্যাকরণগত ত্রুটি ঘটে। আমি জানি মুখে বলার সময় এই কথাটি খুবই চালু। কিন্তু জেলাস করা যায় না, হওয়া যায়। এখানে জেলাস-এর বদলে ইংরেজি হলে এনভি লেখা যেতো। অথবা চমৎকার বাংলা শব্দ ঈর্ষা ব্যবহারটা আরো বেশি যুক্তিযুক্ত ও প্রত্যাশিত ছিলো।

মাশীদ আহমেদ গল্পের নামই দিয়ে রেখেছেন অণু-পরমাণু এবং শুরুতেই লিখছেন, ‘ এই গল্পের কোনো শুরু নেই, শেষও নেই। আবার হতে পারে, এটা কোনো গল্পও না…’। এবং গল্প শেষ করছেন এইভাবে, ‘… ততদিন গল্পটাও চলতে থাকবে। শুধু একেক সময় গল্পটা হবে একটা ল্যাব রিপোর্ট, একটা কনসার্ট, একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়া, একটা মুভি বা বই রিভিউ, একটা বিয়ে বা একটা ঝগড়া। এরকম একেকটা অণুগল্প-পরমাণুগল্প নিয়ে চলতে থাকে গোটা জীবনের উপন্যাস।’ সুন্দর সুলিখিত গল্প আগাগোড়া। শুধু শেষ বাক্যটা গল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, একদমই প্রয়োজন ছিলো না।

নজমুল আলবাব যথারীতি একটি দুর্ধর্ষ গল্প লিখেছেন। গল্পের নাম নিশি-নেশা। নামকরণে চমৎকারিত্ব কিছু নেই, কার্যকারণও ঠিক বুঝিনি। তাতে গল্পের কোনো ক্ষতি অবশ্য হয় না, গল্পের সার্থকতা ও আবেদন অক্ষুণ্ণ থাকে। ছোটো ছোটো বাক্যের প্রায় নৈর্ব্যক্তিক বিবরণে গল্পের উন্মোচন ঘটান লেখক। গল্প শুরু হচ্ছে এইভাবে: ‘কবির তড়পাচ্ছে। কানের পাশ থেকে একটা ধারা গড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত। চিৎ হয়ে পড়ায় হাত দুটো ছড়িয়ে আছে। সিগারেটটা ছিটকে যায়নি। কানের পাশ থেকে যাওয়া রক্তের ধারা সিগারেট নিভিয়ে দিল। কবির আমার দিকে তখনও তাকিয়ে আছে। চোখে অবিশ্বাস। আসলে এভাবে কথা ছিল না। আমরা আজ অন্য প্ল্যান নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু কবির নিজেই গোলমালটা লাগিয়ে দিল। আর এখন তড়পাচ্ছে। সে না তড়পালে হয়তো আমি তড়পাতাম। কিংবা বাদল নিজের রক্তে গড়াগড়ি খেত এতক্ষণে।’ এই বিবরণ পড়ে পাঠক হিসেবে এক অনিবার্য ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়ে যাই। প্রায় দম বন্ধ করে এগিয়ে যেতে হয়। রক্তের ধারায় সিগারেট নিভে যাওয়ার ছবিটি মাথায় গেঁথে থাকে। তিন ছিনতাইকারীর একজন কবির তাদের উদ্দিষ্ট শিকারটিকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ শিকার লোকটি খুঁড়িয়ে হাঁটে, সে মুক্তিযোদ্ধা ছিলো এবং যুদ্ধে আহত। কবির নিজেও এক মুক্তিযোদ্ধার পুত্র। শিকারকে পালাতে দিয়ে সে সঙ্গী একজনের (গল্পের আমি) হাতে গুলিবিদ্ধ হয়। ‘… কবির উদ্দিনের লাশটা কানাগলির শেষপ্রান্তের মাঠে পড়ে থাকে। অন্ধকারে।’ নজমুল আলবাবের গল্পটি আক্রান্ত করে, পড়ার পর অনেকক্ষণ থম ধরে বসে থাকতে হয় আমাকে।

অমিত আহমেদের গল্পের নাম অবশেষে অরিন্দম…। অল্প পরিসরেই লেখাটি প্রথাসম্মত সম্পূর্ণ গল্প হয়ে উঠেছে। অণুগল্পের টান টান ব্যাপারটি অনুপস্থিত, যদিও সম্ভাবনা ও সুযোগ বিদ্যমান ছিলো।

মায়িশার আম্মার সাথে দায়িত্বশীল দুপুর হাসান মোরশেদের গল্প। ঘটনা বর্ণনায় ও পরিস্থিতি তৈরিতে হাসান মোরশেদ বরাবরই দক্ষ। বক্তব্যেও তীক্ষ্ণ। এই গল্পটিতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু এই গল্পে মায়িশার আম্মা ঠিক কীসের দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলছে তা অস্পষ্ট। আর ‘প্যালেস্টাইনে মরেছে আরো কয়েক ডজন, দারফুরে শিশুর চেয়ে শকুনের পুষ্টি বেশি, বাংলাদেশে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর নিরন্নের মিছিল। কোন হারামজাদা যেনো উপদেশ দিলো ভাতের বদলে বিষ খেতে।’ লাইনগুলি লেখকের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ যতোটা তুলে আনে, গল্প হিসেবে লেখাটি ঠিক ততোটুকুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অতন্দ্র প্রহরী বা শাহরিয়ার মামুনের ট্রাফিক সিগন্যালে একদিন প্রতিদিনের জীবন থেকে তুলে আনা এক টুকরো গল্প। প্রহরীকে গল্পের বর্ণনা ও ভাষা ব্যবহারে যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দেওয়া যায়।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী কোনো এক ব্লগপোস্টে নিজেই বলেছিলেন, জীবনে হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র গল্প লিখেছেন তিনি। অমিতকে যে প্রশ্নটা আগে করেছি, এখন শোমচৌকেও একই প্রশ্ন করা দরকার: কেন? কী কারণে গল্প লেখেন না আপনি? সংকলনে অস্তিত্বের অন্ধকার পড়ে ধারণা জন্মায়, এই লেখক লেখেন অতি স্বচ্ছন্দে, স্বতস্ফূর্তভাবে। এই গল্প সম্পর্কে আমার অনুভূতি ও প্রশ্নগুলি হাসান মোরশেদ আলাদা একটি পোস্টে করে ফেলেছেন। সেগুলির পুনরুক্তি আর করার দরকার নেই। তবে এতো অল্প শব্দ খরচ করে একটি সম্পূর্ণ গল্প লেখার কৌশলটা আমাকে এবার শিখতে হবে।

এই শ্রেণীভুক্ত সর্বশেষ দুটি রচনা আসলে কল্পগল্প। সবজান্তা নামের আড়ালের জ্যোতির্ময় বনিক লিখেছেন প্রাগৈতিহাসিক এবং লুৎফুল আরেফীনের গল্পের নাম আফসোস। দুঃখের সঙ্গে বলি, কল্পগল্পের ভোক্তা হওয়ার যোগ্যতা আমার অর্জন করা হয়নি বলে কোনো মন্তব্য করছি না। তবে দুটি গল্পই পড়েছি।

বনসাই

যে গল্পগুলিকে আমি এই শ্রেণীভুক্ত করেছি, আমার বিচারে সেগুলির স্বাভাবিক বিকাশ ঘটতে দেওয়া হয়নি। অণুগল্প সংকলনের ৫০০ শব্দের বাধ্যবাধকতায় এই লেখাগুলি আটকা পড়ে গেছে। ডালপালা ছেঁটে ফেলা অবস্থায় কৃত্রিম আকৃতিতে সম্পূর্ণতা খুঁজছে।

শেখ জলিলের ক্লিনিক্যাল ডেথ গল্পটি আরেকটু বিস্তার অবশ্যই দাবি করে। পড়তে পড়তে মনে হয়, লেখাটা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে সামনে-পেছনে যাওয়া-আসা করছে। শেখ জলিল মূলত কবি হলেও গদ্য লেখার সময় তিনি বিশুদ্ধ গদ্যই লেখেন, কবিতাক্রান্ত গদ্যরচনা করেন না। এখানেই গদ্যলেখক হিসেবে তাঁর শক্তির পরিচয়। তৃতীয় প্যারায় ‘ঘুমের মধ্যে মা স্ট্রোক করেছেন’ বাক্যটিতে আপত্তি জানিয়ে রাখি। রোগী স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়, রোগী স্ট্রোক করে না।

ফকির ইলিয়াসের পলাতক গদ্যগ্রহ লেখাটিতে ঘটনার পরম্পরা বুঝতে সমস্যা হয়। কারণ সম্ভবত ঐ অণুগল্পের আকৃতিগত কাঠামোর ভেতরে রাখার সচেতন চেষ্টা। হায়, সুন্দর মনোগ্রাহী একটি কাহিনী থাকা সত্ত্বেও গল্পটি অসম্পূর্ণ থেকে গেলো। ‘আরেকটি পলাতক গদ্যগ্রহ দুজনের পাশ ঘেঁষে পৃথিবীর প্রান্ত ছুঁয়ে যায়’ – গল্পের এই শেষ বাক্যটি বুঝিনি। পলাতক গদ্যগ্রহ কথাটির মানে কি?

খেকশিয়াল ওরফে কৌশিক দে লিখেছেন তেপান্তর। সম্ভাবনা ছিলো, তার পূর্ণতার জন্যে লেখায় আরো অনেক বিস্তার ঘটানো দরকার ছিলো, শৃঙ্খলাবদ্ধ বর্ণনা ও সুসংবদ্ধ ভাবনার স্ফূরণ আবশ্যক ছিলো।

মেহেদি রাঙা হাত গল্পের লেখক ধুসর গোধূলি। এই লেখা পড়ে ধারণা হয়, ব্যস্ত ব্লগার গল্প রচনায় বেশি সময় ব্যয় করতে নারাজ। তাঁর অবলোকনে অনেক খুঁটিনাটি ধরা পড়ে, এই গল্পের ছোটো পরিসরেও তার নমুনা আছে। কিন্তু গল্পটা কোনোমতে শেষ করতে পারলেই যেন বাঁচেন। এতো তাড়া কীসের? বর্ণনা ও ভাষা ব্যবহারে কিছুটা প্রাচীনতার গন্ধ। তার নমুনা শুরুর বাক্যটিতেই আছে – ‘বসন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে …’। ২০০৮ সালের একজন নবীন লেখকের কাছে আরো টাটকা ও অশ্রুতপূর্ব বর্ণনা আশা করি আমি। আর কিছু না হলেও অন্তত ক্লিশেবর্জিত হওয়া তো দরকার।

দ্বিধা গল্পে ঝরাপাতা/অভ্রপথিক সুন্দর একটা বিষয় নিয়েছেন, তবু শেষ পর্যন্তা তা বনসাই গল্প হয়েই থেকে যায়।

গল্পের নাম বাথটাবে একা। লেখকের নাম জাহিদ হোসেন। এই লেখক কিছু গল্পে ইতোমধ্যে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর শক্তিমত্তা। এই রচনায়ও তার পরিচয় আছে। কিন্তু অণুগল্পের দাবি মেটাতে গিয়ে গল্পটি ফুটে উঠতে পারলো না। ‘সেই কখন থেকে হাতের শিরা কেটে বসে আছি বাথটাবে…’ অতিনাটকীয় লাগে। যেমন লাগে মিঠুর আত্মহত্যাও। চরিত্র দুটিকে ফুটে ওঠার সময় ও জায়গা দেওয়া গেলে এরকম বোধ হতো না বলে আমার বিশ্বাস।

নিঝুমের গল্পের নাম পুনশ্চঃ। দুটি দীর্ঘ প্যারা এবং পুনশ্চ পর্ব দিয়ে গল্পটি গল্পের আকৃতি নির্মাণ হয়েছে। গুনে দেখিনি, তবে নির্ধারিত ৫০০ শব্দই খরচ হয়ে গেছে বলে ধারণা করি। প্রথম প্যারা দুটি পড়ে আমার এই বিশ্বাসই পোক্ত হয় যে প্রচুর কাটছাঁট করা হয়েছে অথবা স্থান সংকুলান করতে না পেরে লেখক কোনোমতে গল্প শেষ করেছেন। দ্বিতীয় দীর্ঘ প্যারার শেষের কয়েকটি লাইন খাপছাড়াও লাগলো। নিঝুম লেখা বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠছেন, তাঁর উত্তরণের নমুনাও সচলে দেখা গেছে, কিন্তু এই গল্পে তাঁর নবলব্ধ সচেতনতা ও ক্ষমতা অব্যবহৃত দেখলাম।

হলো না লো হলো না

আকাশ অবশ্যই সূর্যের চেয়ে বড় গৌতম রায়ের গল্প। গল্পটি ঠিক কী বিষয়ে এবং গল্পটি কেন গল্প তা বুঝতে ব্যর্থ হলাম।

ইশতিয়াক রউফের দুই পাহাড় স্বগত সংলাপ হিসেবে পড়তে ভালো লাগে। টানা গদ্যে লেখা কবিতা বললেও বলা যায়, এতোটাই সুখপাঠ্য। একটি সুন্দর ভাষাভঙ্গি তাঁর আয়ত্ত্বে। কিন্তু এই লেখাটা ঠিক গল্প হলো কি? গল্প আরো একটু স্পষ্টতা দাবি করে।

পরিবর্তনশীল অথবা মহিবুল কবির সাম্প্রতিককালে তাঁর গল্প লেখার ক্ষমতা দেখিয়েছেন সচলায়তনে। নেই-বিষয় নিয়েও তিনি গল্প লিখতে জানেন। এই সংকলনে তাঁর লাল-সবুজ মেশানো শাড়ির গল্প তাঁর সেই সক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে না। এই রচনাটি সচলে ব্লগরব্লগর হিসেবে বেশ ভালো হয়। এরকম একটি গুরুগম্ভীর বিষয় অণুগল্পের জন্যে উপযুক্ত হয় না তা বলি না, কিন্তু তাকে সফল গল্প করার জন্যে এই নবীন লেখকের আরো প্রস্তুতি দরকার বলে মনে হয়। আবেগ গল্প রচনার একটি উপাদান বটে, কিন্তু একমাত্র উপাদান নয়। এই লেখায় আবেগটি উপস্থিত, কিন্তু গল্পের আর সব উপকরণ কোথায়?

পথে শিরোনামে মুজিব মেহদীর অপর রচনাটি কবিতাক্রান্ত গদ্যরচনা। গল্প কি?

সর্বশেষ

একটি কথাই বলার। আমার অকপট বিরূপ মন্তব্য কাউকে আহত করার জন্যে নয়, বরং দুর্বলতাগুলি বিষয়ে একটু সচেতন করার চেষ্টামাত্র – এইটুকু বিশ্বাস করলে খুশি হই। মঙ্গল হোক সবার।

-------------------
২০ এপ্রিল ২০০৮
-------------------

ভাত বনাম আলু অথবা অন্যকিছু

মনে পড়ে, ১৯৭৪-এ দুর্ভিক্ষ যখন আসছে সেই সময়ও বিকল্প খাদ্যাভ্যাস হিসেবে একবেলা রুটি বা আলুর কথা বলা হয়েছিলো সরকারি তরফে। তার প্রতিক্রিয়া এখন যা হচ্ছে তার চেয়েও অনেক তীব্র হয়েছিলো তখন। কারণ ছিলো প্রধানত দুটি। এক, স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলের চেয়ে শস্তায় চাল পাওয়া যাবে – মানুষের এই প্রত্যাশা পূরণ করা যায়নি বাস্তব কারণেই এবং তা হতাশার কারণ ঘটিয়েছিলো। দুই, সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা এখনকার চেয়েও অনেক গুণে খারাপ ছিলো এবং বিকল্প উপার্জনের উপায়ও সুলভ না।

আমি ব্যক্তিগতভাবে দীর্ঘকাল ধরে ভাত-নির্ভরতা কমানোর পক্ষে। ১৯৭৭-৭৮ থেকে আমি সচরাচর দিনে একবেলার বেশি ভাত খাই না, এমনকি ভাত ছাড়াও কয়েক সপ্তাহ দিব্যি থাকতে পারি কোনোরকম শারীরিক ও মানসিক অস্বস্তি ছাড়াই। দেশে থাকাকালে আমার এই কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বন্ধুবান্ধবের অনেক ঠাট্টাও হজম করতে হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, সেই ৭৪-এ আমাদের একটা নিদারুণ অভিজ্ঞতা হলো, যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলাফল হিসেবে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনেক উত্থান-পতন ঘটলো। বন্যা ও ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলি আগের মতোই নিয়মিত বিরতিতে হতে থাকলো। অথচ আমাদের রাষ্ট্রের শাসক বা সমাজের নেতারা নির্বাক ও নিশ্চল হয়ে থাকলেন। ৭৪ এবং তৎপরবর্তীকালের ঘটনাবলি থেকে বিন্দুমাত্র শিক্ষা নিলেও বিকল্প খাদ্যাভ্যাস তৈরিতে মানুষকে উদ্দুদ্ধ ও অভ্যস্ত করে তোলা অসম্ভব ছিলো বলে আমি মনে করি না। পরিবার পরিকল্পনার মতো দুরূহ কর্মসূচিতেও প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় আমাদের সাফল্য বেশি – এটাও তো বাস্তব। সুতরাং একটা পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে ভাতের ওপর আমাদের নির্ভরতা অর্ধেক না হোক, সিকিভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। বিকল্প হিসেবে গম বা আলু বা ভুট্টা অথবা অন্যকিছু চিন্তা করা যেতো। ভাতের বদলে আলু বা রুটি খাওয়া দোষের হবে কেন? আজকের কাগজে দেখলাম, ভুট্টার রুটি খাওয়ার সংবাদ এসেছে। এটা সংবাদ হওয়ার কথা ছিলো না। ভুট্টার রুটি অনেক দেশে খাদ্য হিসেবে রীতিমতো প্রচলিত এবং পুষ্টিগুণে তা ভাতের তুলনায় কিছুমাত্র নিচে নয়। মেক্সিকো মোটেই কোনো ধনী দেশ নয়, সে দেশের মানুষ নিয়মিত ভাত খায় এবং পাশাপাশি গমের ও ভুট্টার রুটিও চলে। সে দেশের জলবায়ু আমাদের দেশের মতোই এবং মানুষজনের আকার-আকৃতি-গাত্রবর্ণ আমাদেরই মতো।

সত্য বটে, আমাদের দেশে এখন উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদনের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা আমাদের বাৎসরিক দুঃখের পার্বণের মতো আসে তা ঠেকানোর কী ব্যবস্থা আছে? সুতরাং ধানের মৌসুমে উৎপাদন ব্যাহত হলো তো সর্বনাশ। এই অবস্থা বদলানোর চেষ্টাও সত্যিকার অর্থে কিছু হয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ, আমাদের সাধারণ প্রবণতাই হলো, সমস্যা হলে কোনোমতে ধামাচাপা দাও, অথবা দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকো, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। সত্যি সত্যি গেছেও তো। নাহলে আমরা এতোকাল এভাবে টিকে আছি কীভাবে?

আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, চালের দামের ওপর সরকারের স্থায়িত্ব বা জনপ্রিয়তা ও নির্বাচনযোগ্যতা নির্ভর করে। নির্বাচিত-অনির্বাচিত অথবা জবরদখলকারী বা ছদ্মবেশী ক্ষমতাবানরা তবু এদিকে মনোযোগ দিলেন না কেন? বিকল্প খাদ্যাভ্যাসের জন্যে একটা সামাজিক আন্দোলনও হতে পারতো। হয়নি। আমরা ভাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারিনি। এর আংশিক কারণও সম্ভবত ঐ ৭৪-এই সন্ধান করতে হবে। দুইবেলা ভাতের বদলে একবেলা করে রুটি খাওয়ার বা বিকল্প হিসেবে আলুতে অভ্যস্ত হওয়ার কথা বলে সেই সময়ের আওয়ামী লীগ সরকার বিষম বেকায়দায় পড়েছিলো। সেই ঝুঁকি তাহলে নেওয়া কেন? এখনকার সেনাপ্রধান আলুর কথা বলে বেড়াতে পারছেন, কারণ তাঁর নির্বাচিত হওয়ার দায় নেই, এমনিতেই সব হাতের মুঠোয়। স্মরণ করা দরকার, খোলা বাজারে যখন চাল ৪৫ টাকা তখনো কেউ কেউ ১.২৫ দরে চাল পাবে, শেখ মুজিব এই ধরনের ব্যবস্থাকে নিরুৎসাহিত করতে চেয়েছিলেন বলে চরম মূল্যও তাঁকে দিতে হয়েছিলো।

কিন্তু বাস্তবতা মানতে হবে। প্রকৃতিকে যেহেতু আমরা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখি না, ধানের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হলে দুর্ভোগ কমানোর জন্যে খাদ্যাভ্যাস বদলের কথা আমাদের ভাবা দরকার। জন্ম-জন্মান্তরের অভ্যাস বদলানো সহজ নয়, সে কথা মনে রাখছি। তবু বলি, দুর্দিনে মানুষ শাকপাতা খেয়েও জীবনধারণ করে। ভাত না হলে বিকল্প হিসেবে আলু বা ভুট্টায় অভ্যস্ত হওয়া কী খুব দুরূহ? অন্তত অনাহারে থাকার চেয়ে তো ভালো।

------------------
১০ এপ্রিল ২০০৮
------------------

রাবাব-প্রজন্মের কাছে

বোন আমার, অকিঞ্চিৎকর মানুষ আমি, জানি না আমার প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্য কি না। কারণ, আমার প্রজন্মের প্রকৃত চেহারা-চরিত্র আসলে কীরকম? বিচিত্র মুখ ও মুখোশ আমরা বিভিন্ন সময়ে ধারণ করেছি। কখনো আমরা অকুতোভয় সংগ্রামী, সন্তের মতো সর্বস্বত্যাগী, জীবনের মায়া না করা যোদ্ধা। অথচ এই আমরাই যখন আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে কামড়াকামড়ি করতে শুরু করেছি এবং নাছোড়বান্দা কুকুরের মতো পরস্পরকে দংশেছি, তখন আমাদের আরেক চেহারা।

১৯৭১-এ পৃথিবী দেখেছ আমরা কী ক্ষমতা ধারণ করি। পরাশক্তির রক্তচক্ষু এবং বিশাল সংগঠিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হওয়ার ইতিহাস আমাদের। স্বপ্ন ছিলো একটি স্বাধীন দেশের, তা পেয়েছিলাম। আমাদের জানা ছিলো, স্বাধীনতার পরে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে থাকার, দরকার অফুরান মমতা ও ভালোবাসার। অথচ ঠিক তখনই আমরা বিচ্ছিন্ন হয়েছি পরস্পর থেকে, যুদ্ধের দুঃসময়ে যাকে ভাই বলে আপন জ্ঞান করেছিলাম, মুক্ত স্বদেশে তার বুকে বন্দুক তাক করেছি। নিজেদের মধ্যে কলহ-বিবাদ করে শক্তি ক্ষয় করে ফেলেছি।

একখণ্ড মাংস নিয়ে দুই কুকুর যখন বিবাদে লিপ্ত হয়, চতুর শেয়াল ঠিক তখনই সুযোগ বুঝে মাংসের দখল নিয়ে ফেলে। আমাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এইভাবে আমাদের স্বপ্নগুলি চুরি হয়ে গেছে।

আজ যখন তোমাকে তোমার প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে যাই, নিজেকে তুমি হতাশাবাদী বলে নিজেকে পরিচিত করো। কষ্টে আমার বুক ভেঙে যায়। আমার প্রজন্মের দিকে তোমার অভিযোগের আঙুল তোলার কথা। তোলোনি, সেটা তোমার মহানুভবতা, আমার সান্ত্বনা নয়। আমরা নিজেদের স্বপ্নগুলি খুইয়ে তোমাদের জন্যেও যে এক ভয়াবহ শূন্যতা ও হতাশার ব্যবস্থাপত্র তুলে দিচ্ছি, তা-ও আমরা বুঝতে অক্ষম ছিলাম। তোমাকে কোনো আশার কথা শোনাবো, সে মুখ আমার নেই, সাধ্যও নয়।

তুমি তোমার লেখায় হতাশার কথা বলেছো। তবু বলি, আশাবাদ না থাকলে হতাশা আসা সম্ভব নয়। সেই আশাটাকে বাঁচিয়ে রাখো। আমাদের এই দেশে এখনো সূর্য ওঠে, পূর্ণিমার রাত আসে, মা এখনো তোমার অপেক্ষায় থাকে। আমাদের দিয়ে যা হয়নি, তা তোমাদের দিয়ে হোক। নিজেদের তোমরা প্রস্তুত করে নাও। জয় হোক তোমাদের।

আর আমাদের ব্যর্থতাকে ক্ষমা করে দিও, যদি পারো।

------------------
২৭ মার্চ ২০০৮
------------------

দেশটি যে আমার!

… দেশের সংবাদের জন্যে এতো যে আগ্রহ, অধীরতা আমার, অনেকটা হয়তো নেশাগ্রস্তের মতো, কিন্তু কী দেখবো বলে আশা করি প্রতিদিন? স্পষ্ট কোনো উত্তর জানা নেই। ঘটনা-দুর্ঘটনা, হানাহানি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিপুল বিস্তার আর হতাশার খবরে ভরে থাকে কাগজ। দৈনিক দুঃসংবাদ নামে একটি কাগজ থাকলে খুব উপযুক্ত হতো বলে মনে হয়। কাগজে আর থাকে রাজনৈতিক ক্ষুদ্রতা ও অদূরদর্শিতার লজ্জাহীন বিস্তারের সংবাদ – দেশ নয়, দেশের মানুষ নয়, তাদের ভালোমন্দে কিছু এসে যায়না, আমি এবং আমার দলই একমাত্র বিবেচ্য। এইসব দেখে দেখে ভারি ক্লান্ত লাগে, বিষাদে মন ভরে যায়। কখনো এমনও মনে হয়, প্রতিদিন একই খবর পড়ছি। ভাবি, কী হবে আর দেখে, একদিনের কাগজ দেখলে সারা বছরের খবর পাওয়া হয়ে যায়। অথচ পরেরদিন নির্ধারিত সময়ে আবার ইন্টারনেটে না গিয়ে উপায় থাকে না আমার – মনে হতে থাকে আজই হয়তো অন্যরকম কোনো একটি সংবাদ দেখবো। আমার দেশে নতুন ও সুন্দর কিছু একটা ঘটে যাবে আর আমি যথাসময়ে সে সংবাদটি জানতে পারবো না, তাই হয়! বাস্তব এই যে বাস্তবে কিছুই ঘটে না, সুসংবাদের অপেক্ষায় দিনের পর দিন চলে যায়, তবু আমার আশা মরে না। অন্তিম বিচারে আশা নিয়েই হয়তো মানুষ বেঁচে থাকে।

… তোমার এবং আমার স্মৃতিমন্থন করার কারণও কিছু আছে! সেদিন আমাদের প্রাণে অর্জনের অহংকার ছিলো, দুই চোখ ভরা স্বপ্নের দ্যুতি ও বিস্তৃতি ছিলো। আকাশতুল্য অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে আমরা টগবগ তখন করছি, আমাদের সামনে কী আলোকময় অলৌকিক একটি ভবিষ্যৎ!

এই দিনে আজ সুদূর মনে হওয়া অনতিদূরের সেইসব কথা কি আমাদের স্মরণে আসবে না? মাঝখানের বছরগুলোকে ভাবলে ভুল, ব্যর্থতা ও হতাশার কথা আসবে, তা-ও নিশ্চিত। বিস্মৃত হতে আমরা প্রায়শ সচ্ছন্দ, হয়তো এই বিস্মৃতি না ঘটলে আমাদের দুঃখ-হতাশার আর শেষ থাকতো না, সর্বনাশে সম্পূর্ণ নিমজ্জন অমোচনীয়ভাবে ঘটে যেতে পারতো। তবু এই দিনটিকে স্মরণ না করে আমাদের উপায় নেই।

আজ আমাদের সেইসব স্বপ্ন ও সম্ভাবনার সবই ভুল ও ব্যর্থ হয়ে গেছে বলে মনে হয়। বস্তুত আমাদের ব্যর্থ স্বপ্নের গল্প অগণন। এতোদিন হয়ে গেলো, তবু কিছু অর্জনের গরিমা নেই আমার দেশের, অর্থ-বিত্তের অহংকার নেই। আছে যতোটুকু, নেই তার থেকে ঢের বেশি। দারিদ্র্য নামে যা আছে অপরিমেয়, তাকে লোকে ভালো চোখে দেখে না, অভাবীদের গৌরব যদি কিছু থাকেও, নিত্যদিনের ক্লিন্নতার আড়ালে তা অনায়াসে ঢাকা পড়ে যায়। তা-ও সহনীয় হতে পারতো, কিন্তু আমার দেশ জগতের সেরা হয় দৈনন্দিন অসততা ও অসদুপায়ের জন্যে। রাজনৈতিক কোলাহলে সে সারা পৃথিবীর নিন্দা কুড়ায়। রাষ্ট্রপ্রধান হত্যায় আমাদের দক্ষতা একসময় রাষ্ট্র হয়ে যায় বিশ্বময়। নিত্যদিনের খুনখারাবিতে মানুষের জীবনই সর্বাপেক্ষা শস্তা ও সুলভ পণ্য হিসেবে প্রতীয়মান হয়। ক্ষমতাধররা লোভ ও নির্লজ্জতার নতুন নতুন শীর্ষ আবিষ্কার করে এবং সেই শীর্ষে তাদের আরোহণপর্বটি ঘটে সাড়ম্বরে, অকম্পিত ও অপরিবর্তিত মুখে। মানুষের কোনো কীর্তি বা সাফল্য নয়, বন্যায়-মহামারীতে-দুর্ভিক্ষে বছর-বছর পৃথিবীর তাবৎ সংবাদপত্রের শিরোনাম হয় আমার দেশ। এতো যে নেই নেই, পর্বতপ্রমাণ আমাদের অক্ষমতা ও ব্যর্থতা, স্বপ্নভঙ্গের বিষাদ – তারপরেও মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলা কি মানায়!

তবু এই রুগ্ণ করুণ অসহায়, ক্ষুদ্র ভুখণ্ডটির জন্যে অতি উচ্চ একটি গৌরবস্তম্ভ ও শর্তহীন ভালোবাসা নিজের ভেতরে যত্নে লুকিয়ে রাখি। দেশটি যে আমার!

------------------
২৬ মার্চ ২০০৮
------------------

আমার গল্পের কিছু তাদের দিয়ে যাই

সপ্তাহের সমস্ত কাজ ও কর্তব্য সমাপন হলো। শনিবার রাতে কমপিউটারের সামনে বসেছি লেখালেখি করার বাসনায়। সচলায়তনে শুরু করা ‘আমাদের বাতিঘরগুলি ও আসন্ন দিন’ সিরিজটা এগোচ্ছে না, আরেকটা পর্ব আজ লিখতে হবে। ইমেল, ঢাকার দৈনিক দেখা শেষ, মধ্যরাতের কিছু পরে লেখা খুলে বসেছি। হঠাৎ মেয়ে আসে আমার ঘরে। সন্ধ্যায় সে গিয়েছিলো তার প্যালেস্টাইনি বান্ধবীর বাসায়। সেখানে আল জাজিরা চ্যানেলে সে দেখে এসেছে ইজরায়েলি সৈন্যরা কীভাবে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে নিরস্ত্র প্যালেস্টাইনিদের খুন করছে। ক্ষুব্ধ অসহায় গলায় আমাকে সে জিজ্ঞেস করে, এইসব আমেরিকার টিভি চ্যানেলগুলিতে দেখায় না কেন?

তার ইচ্ছে ওই ভিডিও ফুটেজগুলি একত্রিত করে সে সিএনএনসহ অন্যসব সংবাদ-চ্যানেলগুলিতে পাঠিয়ে দেবে প্রচার করার অনুরোধসহ।

হায়, আঠারো বছর বয়সে এইসব চিন্তা করা সম্ভব। পৃথিবীতে যাবতীয় শুভবোধ এখনো জাগ্রত এবং তার অনুরোধে পুঁজিস্বার্থের প্রতিভূরা যা করছে তা আর করবে না এবং শুধরে নেবে তাদের পাপগুলি!

তার সমান বয়সে আমরা অবশ্য অনেককিছু জেনে গিয়েছিলাম। ততোদিনে আমাদের প্রজন্ম প্রত্যক্ষ যুদ্ধ দেখে ফেলেছে, যুদ্ধের নখরাঘাতে মানুষের জীবন ও আশা-আকাঙ্খা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতে দেখেছে, চোখের সামনে সারি সারি নিরপরাধ মানুষের রক্তাক্ত শরীর অবলোকন করেছে, সপ্তম নৌবহর ও নিক্সন-কিসিঞ্জার জেনে ফেলেছে। মেয়েকে এখন আমি কী বলি?

বোঝার বয়স মেয়ের হয়েছে। পুঁজি ও ক্ষমতার স্বার্থের সম্পর্ক ইত্যাদি ব্যাখ্যা করে জানাই, এইসব পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা ব্যক্তিমানুষের আসলে নেই।

মেয়ে বলে, তাই বলে যা চলছে তার প্রতিবাদ হবে না? যা চলছে চলুক আমার কিছু এসে যায় না জাতীয় মানসিকতার মানুষ আমি হতে চাই না। কিছু একটা করতে চাই। টিভিতে দেখা ছবিগুলি আমার চোখে এখনো ভাসছে।

আমাদের কথা চলতে থাকে। কীভাবে কখন প্রসঙ্গ পাল্টায়, মেয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস জানতে চায়। মনে মনে ভাবি, এখন মার্চ, এখনই তো উপযুক্ত সময়। কথা বলতে বলতে সচলায়তনে উঁকি দিয়ে দেখি, শহীদ মিনারের ব্যানার পাল্টে দিয়েছে অরূপ, এখন সেখানে স্বাধীনতার মাসের ব্যানার উঠেছে – তোমাকে পাবার জন্য হে স্বাধীনতা।

মেয়েকে বলি, সে অনেক লম্বা গল্প। আজ অনেক রাত হয়ে গেছে, এখন তুই ঘুমাতে যা। পরে একসময় হবে।

সে এখনই শুনতে চায়। আমি আপত্তি করার কে! এই বিষয় নিয়ে জীবনভর বকবক করতেও ইচ্ছুক আমি। কথা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরে দেখি গুটি গুটি পায়ে দশ বছরের ছেলেটিও তার ঘর থেকে উঠে এসে বসছে। আমাদের কথায় তার ঘুম ভেঙে গেছে, এই গল্প সে-ও শুনতে চায়।

আমি বলে যাই আমাদের কালের কাহিনী। ৪৭-এর দেশভাগ, বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশের বিভক্তি, ভাষা আন্দোলন, ৬৫-র যুদ্ধ, শেখ মুজিব ও ৬ দফা, ৬৯-এর গণ-আন্দোলন, ৭০-এর নির্বাচন এবং ৭১। তারা ক্রমাগত প্রশ্ন করে, আমি সাধ্যমতো বলে যাই তাদের বোঝার সামর্থ্য অনুযায়ী।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের কথাও একসময় উঠে আসে। মেয়ে আচমকা জিজ্ঞস করে, তোমরা শেখ মুজিবকে খুন করলে কেন? কী করে পারলে?

এই প্রশ্ন অনন্তকালের। উত্তর কি আমার জানা আছে?

কথা শেষ হলে ঘড়িতে দেখি রাত সাড়ে তিনটা। ছেলেমেয়েকে বিছানায় পাঠিয়ে দিয়ে মনে হয়, লেখালেখি আজ আর হলো না। টের পাই, সে জন্যে আমার একটুও অনুশোচনা বা দুঃখবোধ হচ্ছে না। তার বদলে এক ধরনের পরিতৃপ্তি। আমার গল্পের কিছু ছেলেমেয়ের হাতে তুলে দেওয়া গেলো।

--------------------
০৩ মার্চ ২০০৮
--------------------

আর প্রস্থানোদ্যত নন, তিনি প্রস্থান করলেন




জানা ছিলো, সময়ের ব্যাপার মাত্র। সময় ফুরিয়ে আসছে, তিনি চলে যাবেন। বাংলাদেশের ফুটবলের স্বর্ণযুগের এক প্রধান স্তম্ভ নান্নু চলে গেলেন। এইমাত্র খবর পাওয়া গেলো।

মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, ভালো না। কথা বলতে গেলে কেঁদে ফেলতেন। চলে যাচ্ছেন, জেনে গিয়েছিলেন তো!

সপ্তাহ তিনেক আগে তাঁর সম্পর্কে গল্পের শেষ যেভাবে : প্রস্থানোদ্যত আমাদের কালের একজন নায়ক শিরোনামে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম।

গল্পটির সমাপ্তি হলো। এখন আর প্রস্থানোদ্যত নন, তিনি প্রস্থান করেছেন।

----------------------
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৮
----------------------

একটি বাংলা প্রতিশব্দ দেবেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক ছিলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ক্লাসে তাঁর ইংরেজি বক্তৃতা শুনতাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। সেই তাঁকেই আবার বিভিন্ন সভায় সেমিনারে শুনতাম বিশুদ্ধ বাংলায় বক্তৃতা করছেন। একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে। সৈয়দ শামসুল হককেও যতোটুকু শুনেছি, তিনিও ইংরেজি-বাংলার মিশেল করেন না।

কর্মস্থলে যে বিভাগে আমি কাজ করি সেখানে কর্মীর সংখ্যা প্রায় শ'দেড়েক। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি এর মধ্যে শতকরা ৬০-৬৫ জন ভারতীয়। এরা নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় তামিল, তেলেগু, গুজরাতি এইসব ভাষা ব্যবহার করে। আশ্চর্য হয়ে দেখেছি, এরা কথা বলার সময় একটিও ইংরেজি শব্দ বলে না।

সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া অঞ্চলে কর্মোপলক্ষে কিছুকাল ছিলাম, সেখানেও চিনারা বা মালেরা ইংরেজি শব্দ ছাড়াই দিব্যি নিজেদের ভাষায় কথা বলে।

আমরা পারি না। আমরা দশটি শব্দের একটি বাক্যে গড়ে ২-৩টি ইংরেজি শব্দ অবধারিতভাবে ঢুকিয়ে দিই। অথচ অনেক বিদেশী একবর্ণ বাংলা না জেনেও শুধুমাত্র ঐ ইংরেজি শব্দগুলোর কারণে আমাদের কথাবার্তার সারাংশ দিব্যি বুঝে ফেলে।

ঔপনিবেশিক শাসনকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, সেটি খোঁড়া অজুহাত। সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া-ভারতও বৃটিশ শাসনের অধীনে ছিলো। আমরা কী এক বিচিত্র কারণে ইংরেজি বিদ্যা ফলানোকে এক ধরনের আভিজাত্যই হয়তো ভাবি। এর কারণ অনুসন্ধান অবশ্য আমার এই পোস্টের উদ্দেশ্য নয়।

বাংলা ভাষাপ্রেম যদি থাকে, আমাদের দরকার মুখের কথায় এবং লেখালেখিতে যতোটা সম্ভব বাংলা ব্যবহার করতে চেষ্টা করা এবং অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি পরিহার করা। আমি কিন্তু ইংরেজি-বিদ্বেষী নই। ব্যবহারিক জীবনে কিছু কিছু বিদেশী শব্দ আমাদের ভাষার অংশ হয়ে গেছে। যেমন এখন আমি চেয়ার না বলে যদি কেদারা বলতে যাই তা খুবই হাস্যকর হয়ে যাবে। টেবিল শব্দের বাংলা আছে বলে আমার জানা নেই। ফোন? দূরালাপনী শব্দটা চালু করার চেষ্টা মনে হয় হয়েছিলো, উচ্চারণ-বান্ধব নয় বলে কাজে লাগেনি। তবে মোবাইল ফোনের বিকল্প হিসেবে নির্মলেন্দু গুণের উদ্ভাবিত মুঠোফোন চমৎকার। সত্যজিৎ রায় dictionary শব্দের বাংলা করেছিলেন 'দেখাশোনারি', impossible-কে করেছিলেন 'আম পচে বেল'! চলে কিন্তু।

সচলায়তন কিন্তু কয়েকটা চমৎকার কমপিউটার-ব্যবহার্য বাংলা শব্দ তৈরি করেছে। যেমন, homepage-কে 'নীড়পাতা', chatroom হয়েছে 'আড্ডাঘর'।

আমার বিশ্বাস সচলের সকল সদস্য অন্তত একটি করে এরকম ব্যবহারিক প্রতিশব্দ তৈরি করতে পারবেন। কয়েক মিনিট সময় খরচ করে একটি প্রতিশব্দ এখানে রেখে যান, একটি ভাণ্ডার তৈরি হোক। আমাদেরই কাজে লাগবে, আমার ভাষা সমৃদ্ধ হবে। শুধু লক্ষ্য রাখবেন আপনার বাংলা করা শব্দটি যেন উচ্চারণ-বান্ধব হয়। ভবিষ্যতে আপনার উদ্ভাবিত শব্দটির জন্যেই হয়তো আপনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, কে জানে!

-------------------
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৮
-------------------